মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম পরিচ্ছেদ।
বঙ্গেশ্বর।অতি বিস্তীর্ণ সভামণ্ডপে নবদ্বীপােজ্বলকারী রাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর লাক্ষ্মণেয়, বিরাজ করিতেছেন। উচ্চ শ্বেত প্রস্তরের বেদির উপরে রত্ন প্রবাল বিভূষিত সিংহাসনে, রত্ন প্রবাল মণ্ডিত ছত্র তলে বর্ষীয়ান্ রাজা বসিয়া আছেন। শিরােপরে কনককিঙ্কিণী সম্বেষ্টিত বিচিত্র কারু কার্য্য়ে খচিত শুভ্র চন্দ্রাতপ শােভা পাইতেছে। এক দিকে পৃথগাসনে, হােমাবশেষ বিভূষিত, অনিন্দমূর্ত্তি ব্রাহ্মণমণ্ডলী সভাপণ্ডিতকে পরিবেষ্টিত করিয়া বসিয়া আছেন। যে আসনে, এক দিন হলায়ূধ উপবেশন করিয়াছিলেন, সে আসনে এক্ষণে একজন অপরিণামদর্শী চাটুকার অধিষ্ঠান করিতেছিল। অন্য দিকে মহামাত্য ধর্ম্মাধিকারকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া প্রধান রাজপুরুষেরা উপবেশন করিয়াছিলেন। মহাসামন্ত, মহাকুমারামাত্য, প্রমাতা, উপরিক, দাসাপরাধিক, চৌরােদ্ধরণিক, শৌল্কিক, গৌল্মিকগণ, ক্যত্রপ, প্রাপ্তপালেরা, কোষ্ঠপালেরা, কাণ্ডারক্য, তদাযুক্তক, বিনিযুক্তক, প্রভৃতি সকলে উপবেশন করিতেছেন। মহাপ্রতীহার সশস্ত্রে সভার অসাধারণ রক্ষা করিতেছেন। স্তাবকেরা উভয় পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাড়াইয়া আছে। সর্ব্বজন হইতে পৃথগাসনে, কুশাসন মাত্র গ্রহণ করিয়া পণ্ডিতবর মাধবাচার্য্য উপবেশন করিয়া আছেন।
রাজসভার নিয়মিত কার্য্য সকল সমাপ্ত হইলে, সভাভঙ্গের উদ্যোগ হইল। তখন মাধবাচার্য্য রাজাকে সম্বােধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! ব্রাহ্মণের বাচালতা মার্জ্জনা করিবেন। আপনি রাজনীতি বিশারদ, এক্ষণে ভূমণ্ডলে যত রাজগণ আছেন, সর্ব্বাপেক্ষা বহুদর্শী; প্রজাপালক; আপনিই আজন্ম রাজা। আপনার অবিদিত নাই যে শত্রুদমন রাজার প্রধান ধর্ম্ম। আপনিই প্রবল শত্রুদমনের কি উপায় করিয়াছেন?”
রাজা কহিলেন, “কি অজ্ঞা করিতেছেন?” সকল কথা বর্ষীয়ান রাজার শ্রুতিসুলভ হয় নাই।
মাধবাচার্য্যের পুনরুক্তির প্রতীক্ষা না করিয়া ধর্ম্মাধিকার পশুপতি কহিলেন, “মহারাজাধিরাজ! মাধবাচার্য্য রাজসমীপে জিজ্ঞাসু হইয়াছেন, যে রাজশত্রু দমনের কি উপায় হইয়াছে। বঙ্গেশ্বরের কোন্ শত্রু এ পর্যন্ত দমিত হয় নাই, তাহা এখনও আচার্য্য ব্যক্ত করেন নাই। তিনি সবিশেষ বাচন করুন।”
মাধবাচার্য্য অল্প হাস্য করিয়া এবার অত্যুচ্চস্বরে কহিলেন, “মহারাজ, তুরকীয়েরা আর্য্যাবর্ত্ত প্রায় সমুদয় হস্তগত করিয়াছে। আপাততঃ তাহারা মগধ জয় করিয়া গৌড়রাজ্য আক্রমণের উদ্যোগে আছে।”
এবার কথা রাজার কর্ণে প্রবেশ লাভ করিল। তিনি কহিলেন, “তুরকীদিগের কথা বলিতেছেন? তুরকীয়েরা কি আসিয়াছে?”
মাধবাচার্য্য কহিলেন, “ঈশ্বর রক্ষা করিতেছেন; এখনও তাহারা এখানে আসে নাই। কিন্তু আসিলে আপনি কি প্রকারে তাহাদিগের নিবারণ করিবেন?”
রাজা কহিলেন, “আমি কি করিব—আমি কি করিব? আমার এই প্রাচীন শরীর, আমার যুদ্ধের উদ্যোগ সম্ভবে না। আমার এক্ষণে গঙ্গালাভ হইলেই হয়। তুরকীয়েরা আসে আসুক।”
এবম্ভূত রাজবাক্য সমাপ্ত হইলে সভাস্থ সকলেই নীরব হইল। কেবল মহাসামন্তের কোষমধ্যস্থ অসি অকারণ ঈষৎ ঝনৎকার শব্দ করিল। অধিকাংশ শ্রোতৃবর্গের মুখে কোন ভাবই ব্যক্ত হইল না। মাধবাচার্য্যের চক্ষে একবিন্দু অশ্রুপাত হইল।
সভাপণ্ডিত দামােদর প্রথমে কথা কহিলেন। “আচার্য্য, আপনি কি ক্ষুব্ধ হইলেন? যেরূপ রাজাজ্ঞা হইল, ইহা শাস্ত্র সঙ্গত। শাস্ত্রে ঋষিবাক্য প্রযুক্ত আছে, যে তুরকীয়েরা এ দেশ অধিকার করিবে। শাস্ত্রে আছে, অবশ্য ঘটিবে—কাহার সাধ্য নিবারণ করে? তবে যুদ্ধোদমে প্রয়ােজন কি?”
মাধবাচার্য্য কহিলেন, “ভাল সভাপণ্ডিত মহাশয়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আপনি এতদুক্তি কোন শাস্ত্রে দেখিয়াছেন?”
দামােদর কহিলেন, “মৎস্যপুরাণে আছে যথা—”
মাধ। “যথা থাকুক—মৎস্যপুরাণ আনিতে অনুমতি করুন; দেখান এরূপ উক্তি কোথায় আছে?”
দামাে। “আমি বিস্মৃত হইয়াছিলাম, বিষ্ণুপুরাণে আছে।”
মাধ। “বিষ্ণুপুরাণ আমি সমগ্র কণ্ঠস্থ বলিতেছি; দেখান এ কবিতা কোথায় আছে?”
দামাে। “আমি কি এতই ভ্রান্ত হইলাম? ভাল স্মরণ করিয়া দেখুন দেখি, মানব ধর্ম্ম শাস্ত্রে একথা আছে কি না?”
মাধ। “বঙ্গেশ্বরের সভাপতি মানব ধর্ম্ম শাস্ত্রের ও কি পারদর্শী নহেন?”
দামাে। “কি জ্বালা! আপনি আমাকে বিহ্বল করিয়া তুলিলেন। আপনার সম্মুখে সরস্বতী বিমনা হয়েন, আমি কোন্ ছার? আপনার সম্মুখে আমার গ্রন্থের নাম স্মরণ হইবে না; কিন্তু কবিতাটা শ্রবণ করুন।”
মাধ। “গৌড়েশ্বরের সভাপণ্ডিত যে অনষ্টুপ্ছন্দে একটী কবিতা রচনা করিয়া থাকিবেন, ইহা কিছুই অসম্ভব নহে। কিন্তু আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি—তুরকজাতীয় কর্তৃক বঙ্গবিজয়বিষয়িণী কথা কোন শাস্ত্রে কোথাও নাই।”
পশুপতি কহিলেন, “আপনি কি সর্ব্বশাস্ত্রবিৎ?”
মাধবাচার্য্য কহিলেন, “আপনি যদি পারেন, তবে আমাকে অশাস্ত্রজ্ঞ বলিয়া প্রতিপন্ন করুন।”
সভাপণ্ডিতের একজন পারিষদ কহিলেন, “আমি করিব। আত্মশ্লাঘা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। যে আত্মশ্লাঘা পরবশ—সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে?”
মাধবাচার্য্য কহিলেন, “মূর্খ তিন জন। যে আত্মরক্ষায় যত্নহীন, যে সেই যত্নহীনতার প্রতিপোষক, আর যে আত্মবুদ্ধির অতীত বিষয়ে বাক্যব্যয় করে, ইহারাই মূর্খ। আপনি ত্রিবিধ মূর্খ।”
সভাপণ্ডিতের পারিষদ্ অধোবদনে উপবেশন করিলেন।
পশুপতি কহিলেন, “যবন আইসে আমরা যুদ্ধ করিব।”
মাধবাচার্য কহিলেন “সাধু! সাধু! আপনার যেরূপ যশঃ সেইরূপ প্রস্তাব করিলেন। জগদীশ্বর আপনাকে কুশলী করুন। আমার কেবল এই জিজ্ঞাস্য যে যদি যুদ্ধই অভিপ্রায়, তবে তাহার কি উদ্যোগ হইয়াছে?”
পশুপতি কহিলেন, “মন্ত্রণা গোপনেই বক্তব্য। এ সভাতলে প্রকাশ্য নহে। কিন্তু যে অশ্ব পদাতি এবং নাবিক সেনা সংগৃহীত হইতেছে কিছু দিন এই নগরী পর্যটন করিলে তাহা জানিতে পারিবেন।”
মা। “কতক কতক জানিয়াছি।”
প। “তবে এ প্রস্তাব করিতেছেন কেন?”
মা। “প্রস্তাবের তাৎপর্য্য এই যে এক বীর পুরুষ এক্ষণে এখানে সমাগত হইয়াছেন। মগধের যুবরাজ হেমচন্দ্রের বীর্য্যের খ্যাতি শুনিয়া থাকিবেন?”
প। “বিশেষ শুনিয়াছি। ইহাও শ্রুত আছি যে তিনি মহাশয়ের শিষ্য। আপনি বলিতে পারিবেন যে ঈদৃশ বীর পুরুষের বাহু-রক্ষিত মগধ রাজ্য পরহস্তগত হইল কি প্রকারে?”
মাধ। “যবন বিপ্লবের কালে যুবরাজ প্রবাসে ছিলেন। এই মাত্র কারণ।”
প। “তিনি কি এক্ষণে নবদ্বীপে আগমন করিয়াছেন?”
মাধ। “আসিয়াছেন। রাজ্যপহারক যবন এই দেশে আগমন করিতেছে শুনিয়া এই দেশে তাহাদিগের সহিত সংগ্রাম করিয়া দস্যুর দণ্ডবিধান করিবেন। বঙ্গরাজ তাঁহার সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করিয়া উভয়ের শত্রু বিনাশের চেষ্টা করিলে উভয়ের মঙ্গল।”
প। “রাজবল্লভের অদ্যই তাঁহার পরিচর্যায় নিযুক্ত হইবে। তাঁহার নিবাসার্থে যথাযােগ্য বাসগৃহই নির্দ্দিষ্ট হইবে। সন্ধিনিবন্ধনের মন্ত্রণা যথাযােগ্য সময়ে স্থির হইবে।”
পরে রাজাজ্ঞায় সভা ভঙ্গ হইল।