মৃণালিনী (১৮৭৪)/প্রথম খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ
হৃষীকেশ।
মৃণালিনীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার শয়নাগারে আসিয়া হৃষীকেশ কহিলেন,
“মৃণালিনি! তােমার এ কি চরিত্র?”
মৃ। “আমার কি চরিত্র?”
হৃ। “তুমি অজ্ঞাত কুলশীলা পরকন্যা, গুরুর অনুরােধে আমি তােমাকে গৃহে স্থান দিয়াছি। তুমি আমার কন্যা মণিমালিনীর সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন কর—তােমার কুলটাবৃত্তি কেন?”
মৃ। “আমার কুলটাবৃত্তি যে বলে সে মিথ্যাবাদী।”
হৃষীকেশের ক্রোধে অধর কম্পিত হইল। কহিলেন, “কি পাপীয়সি! আমার অন্নে উদর পােষণ করিয়া দুষ্কর্ম্ম করিবি, আর আমাকে দুর্ব্বাক্য বলিবি? তুই আমার গৃহ হইতে দূর হ। না হয় মাধবাচার্য্য ক্রোধ করিবেন, তা বলিয়া এমন কাল সর্প গৃহে রাখিতে পারিব না।”
মৃ। “যে আজ্ঞা—কালি প্রাতে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না।”
হৃষীকেশের বােধ ছিল যে যে কালে তাঁহার গৃহবহিষ্কৃতা হইলেই মৃণালিনী আশ্রয়হীনা হয়, সে কালে এমত উত্তর তাঁহার সম্ভবে না। কিন্তু মৃণালিনী নিরাশ্রয়ের আশঙ্কায় কিছুমাত্র ভীত নহে দেখিয়া মনে করিলেন যে তিনি আত্মজার গৃহে স্থান পাই বার ভরসাতেই এরূপ উত্তর করিলেন। ইহাতে তাঁহার কোপ আরও বৃদ্ধি হইল। তিনি অধিকতর বেগে কহিলেন,
“কালি প্রাতে! অদ্যই দূর হও।”
মৃ। “যে আজ্ঞা। আমি সখী মণিমালিনীর নিকট বিদায় হইয়া আজি দূর হইতেছি।” এই বলিয়া মৃণালিনী গাত্রোত্থান করিলেন।
হৃষীকেশ কহিলেন, “মণিমালিনীর সহিত কুলটার আলাপ কি?”
এবার মৃণালিনীর চক্ষে জল আসিল। কহিলেন, “তাহাই হইবে। আমি কিছুই লইয়া আসি নাই; কিছুই লইয়া যাইব না। এক বসনে চলিলাম। আপনাকে প্রণাম হই।”
এই বলিয়া দ্বিতীয় বাক্যব্যয় ব্যতীত মৃণালিনী শয়নাগার হইতে বহিষ্কৃতা হইয়া চলিলেন।
যেমন অন্যান্য গৃহবাসীর ব্যোমকেশের আর্ত্তনাদে শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়াছিলেন, মণিমালিনীও তদ্রূপ উঠিয়াছিলেন। মৃণালিনীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার পিতা শয্যাগৃহ পর্যন্ত আসিলেন দেখিয়া তিনি এই অবসরে ভ্রাতার সহিত কথােপকথন করিতেছিলেন। এবং ভ্রাতার দুশ্চরিত্র বুঝিতে পারিয়া তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন। যখন তিনি ভর্ৎসনা সমাপন করিয়া প্রত্যাগমন করেন, তখন প্রাঙ্গনভূমে, দ্রুতপাদ-বিক্ষেপিনী মৃণালিনীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন,
“সই, অমন করিয়া এত রাত্রে কোথা যাইতেছ?”
মৃণালিনী কহিলেন “সখি, মণিমালিনি, তুমি চিরায়ুষ্মতী হও। আমার সহিত আলাপ করিও না—তােমার পিতার নিষেধ।”
মণি। “সে কি মৃণালিনী তুমি কঁদিতেছ কেন? সর্ব্বনাশ! পিতা কি বলিতে না জানি কি বলিয়াছেন, সখি, ফের। রাগ করিও না।”
মণিমালিনী মৃণালিনীকে ফিরাইতে পারিলেন না। পর্ব্বতসানুবাহী শিলাখণ্ডের ন্যায় অভিমানিনী সাধ্বী চলিয়া গেলেন। তখন অতি ব্যস্ত মণিমালিনী পিতৃসন্নিধানে আসিলেন। মৃণালিনীও গৃহের বাহিরে আসিলেন।
বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, পূর্ব্ব সঙ্কেত স্থানে গিরিজায়া দাঁড়াইয়া আছে। মৃণালিনী তাহাকে দেখিয়া কহিলেন,
“তুমি এখনও দাঁড়াইয়া কেন?”
গি। “আমি যে তােমাকে পলাইতে বলিয়া আসিলাম। তুমি আইস না আইস—দেখিয়া যাইবার জন্য দাঁড়াইয়া আছি।”
মৃ। “তুমি কি ব্রাহ্মণকে দংশন করিয়াছিলে?”
গি। “নহিলে কে?”
মৃ। “নহিলে কে? কিন্তু তুমি যে গান করিতে করিতে চলিয়া গেলে শুনিলাম?”
গি। “তার পর তােমাদের কথা বার্ত্তার শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিতে আসিয়াছিলাম। পরে অবস্থামতে কার্য্য করিলাম। এখন তুমি কোথা যাইবে?”
মৃ। “তােমার গৃহ আছে?”
গি। “আছে। পাতার কূটীর।”
মৃ। “সেখানে আর কে থাকে?”
গি। “এক বৃদ্ধা মাত্র। তাহাকে আজি বলি।”
মৃ। “চল তােমার গৃহে যাব।”
গি। “চল। তাই ভাবিতেছিলাম।” এই বলিয়া দুই জনে চলিলেন। যাইতে যাইতে গিরিজায়া কহিল, “কিন্তু সে ত কুটীর। সেখানে কয়দিন থাকিবে?”
মৃ। “কালি প্রাতে, অন্যত্র যাইব।”
গি। “কোথা? মথুরায়?”
মৃ। “মথুরায় আমার আর স্থান নাই।”
গি। “তবে কোথায়?”
মৃ। “যমালয়। এ কথা কি তােমার বিশ্বাস হয়?”
গি। “বিশ্বাস হইবে না কেন? কিন্তু সে স্থান ত আছেই—যখন ইচ্ছা তখনই যাইতে পারিবে। এখন কেন আর এক স্থানে যাও না?”
মৃ। “কোথা?”
গি। “নবদ্বীপ।”
মৃ। “গিরিজায়া তুমি ভিখারিণী বেশে কোন মায়াবিনী। তোমার নিকট কোন কথা গােপন করিব না। বিশেষ তুমি হিতৈষিণী। নবদ্বীপেই যাইব সংকল্প করিয়াছি।”
গি। “একাকিনী যাইবে?”
মৃ। “সঙ্গী কোথায় পাইব।”
গি। (গাইতে গাইতে)
“মেঘ দরশনে হায়, চাতকিনী ধায় রে।
সঙ্গে যাবি কে কে তােরা আয় আয় আয় রে॥
মেঘেতে বিজলি হাসি, আমি বড় ভাল বাসি,
যে যাবি সে যাবি তােরা, গিরিজায়া যায় রে॥”
মৃ। “একি রহস্য গিরিজায়া?”
গি। “আমি যাব।”
মৃ। “সত্য সত্যই?”
গি। “সত্য সত্যই যাব।”
মৃ। “কেন যাবে?”
গি। “আমার সর্ব্বত্র সমান। রাজধানীতে ভিক্ষা বিস্তর।”