মৃণালিনী (১৮৭৪)/প্রথম খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।


লুব্ধ।

 মৃণালিনী বা গিরিজায়া এতন্মধ্যে কেহই আত্মপ্রতিশ্রুত বিস্মৃতা হইলেন না। উভয়ে প্রহরেক রাত্রে হৃষীকেশের গৃহপার্শ্বে সংমিলিত হইলেন। মৃণালিনী গিরিজায়াকে দেখিবামাত্র কহিলেন,

 “কই, হেমচন্দ্র কোথায়?

 গিরিজায়া কহিল “তিনি আইসেন নাই।”

 “আইসেন নাই!” এই কথাটী মৃণালিনীর অন্তস্তল হইতে ধ্বনিত হইল। ক্ষণেক উভয়ে নীরব। তৎপরে মৃণালিনী, জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন আসিলেন না?”

 গি। “তাহা আমি জানি না। এই পত্র দিয়াছেন।” এই বলিয়া গিরিজায়া তাঁহার হস্তে লিপি দান করিল। মৃণালিনী কহিলেন, “কি প্রকারে বা লিপি পাঠ করি? গৃহে গিয়া প্রদীপ জ্বলিয়া পাঠ করিলে মণিমালিনী জাগরিতা হইয়া দেখিতে পাইবে—হা বিধাত!”

 গিরিজায়া কহিল “অধীর হইও না। আমি প্রদীপ, তৈল, পাতর, লোহা, সকলই আনিয়া রাখিয়াছি। এখনই আলো করিতেছি।”

 গিরিজায়া শীঘ্র হস্তে অগ্ন্যুৎপাদন করিয়া প্রদীপ জ্বালিত করিল। অগ্ন্যুৎপাদন শব্দ এক জন গৃহবাসীর কর্ণে প্রবেশ করিল—দীপালোক সে দেখিতে পাইল।

 গিরিজায়া দীপ জ্বালিত করিলে মৃণালিনী নিম্নলিখিত মত মনে মনে পাঠ করিলেন।

 “মৃণালিনী! কি বলিয়া আমি তোমাকে পত্র লিখিব? তুমি আমার জন্যে দেশত্যাগিনী হইয়া পর গৃহে কষ্টে কালাতিপাত করিতেছ। যদি দৈবানুগ্রহে তোমার সন্ধান পাইয়াছি, তথাপি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম না। তুমি ইহাতে আমাকে অপ্রণয়ী মনে করিবে—অথবা অন্যা হইলে মনে করিত—তুমি করিবে না। আমি কোন বিশেষ ব্রতে নিযুক্ত আছি—যদি তৎপ্রতি আমি অবহেলা করি, তবে আমি কুলাঙ্গার। তৎসাধন জন্য আমি গুরুর নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছি যে, তোমার সহিত এ স্থানে সাক্ষাৎ করিব না। আমি নিশ্চিত জানি যে, আমি যে তোমার জন্য সত্য ভঙ্গ করিব, তোমারও এমত সাধ নহে। অতএব এক বৎসর কোন ক্রমে দিন যাপন কর। পরে ঈশ্বর প্রসন্ন হয়েন, তবে অচিরাৎ তোমাকে রাজপুরবধূ করিয়া আত্মসুখ সম্পূর্ণ করিব। এই অল্পবয়স্কা প্রগল‍্ভবুদ্ধি বালিকা হস্তে উত্তর প্রেরণ করিও।” মণালিনী পত্র পড়িয়া গিরিজয়াকে কহিলেন,

 “গিরিজায়ে! আমার লেখনী পত্রাদি কিছুই নাই যে লিপি প্রেরণ করি। তুমি মুখে আমার প্রত্যুত্তর লইয়া যাও। তুমি বিশ্বাসভাগিনী—পুরস্কার স্বরূপ আমার অঙ্গের অলঙ্কার দিতেছি।”

 গিরিজায়া কহিল, “প্রত্যুত্তর কাহার নিকট লইয়া যাইব। তিনি আমাকে লিপি দিয়া বিদায় করিবার সময় বলিয়া দিয়াছিলেন, যে আজি রাত্রেই তামাকে প্রত্যুত্তর আনিয়া দিও। আমিও স্বীকৃত ছিলাম। আসিবার সময় মনে করিলাম, হয়ত তোলার নিকট মসী লেখনী প্রভৃতি নাই; এ জন্য সে সকল সংগ্রহ করিয়া আনিবার জন্য তাঁহার উদ্দেশে গেলাম। তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলাম না, শুনিলাম তিনি সন্ধ্যাকালে নবদ্বীপ যাত্রা করিয়াছেন।”

 মৃ। “নবদ্বীপ?”

 গি। “নবদ্বীপ।”

 মৃ। “সন্ধ্যাকালেই?”

 গি। “সন্ধ্যাকালেই। শুনিলাম তাঁহার গুরু আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছেন।”

 মৃ। “মাধবাচার্য! মাধবাচার্যই আমার কালস্বরূপ।” পরে অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়ে, তুমি বিদায় হও। অধিককাল আমি গৃহের বাহিরে থাকিব না।”

 গিরিজায়া কহিল, “আমি চলিলাম। এই বলিয়া গিরিজায়া বিদায় হইল। তাহার মৃদু মৃদু গীতধ্বনি শুনিতে শুনিতে মৃণালিনী গৃহমধ্যে পুনঃ প্রবেশ করিলেন।

 মৃণালিনী বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া যেমন দ্বার রুদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, অমনি পশ্চাৎ হইতে কে আসিয়া তাঁহার হস্ত ধারণ করিল। মৃণালিনী চমকিয়া উঠিলেন। হস্ত রোধকারী কহিল,

 “তবে সাধ্বি! এই বার জালে পড়িয়াছ। এ গুপ্ত প্রসাদভোজী কে শুনিতে পাই না।”

 মৃণালিনী তখন ক্রোধে কম্পিত হইয়া কহিলেন, “ব্যোমকেশ! ব্রাহ্মণকুলে পাষণ্ড! হস্ত ত্যাগ কর।”

 ব্যোমকেশ হৃষীকেশের পুত্র। এ ব্যক্তি ঘোরমূর্খ, এবং দুশ্চরিত্র। সে মৃণালিনীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়াছিল, এবং স্বাভিলাষ পূরণের অন্য কোন সম্ভাবনা নাই জানিয়া বলপ্রকাশে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিল। কিন্তু মৃণালিনী মণিমালিনীর সঙ্গ প্রায় ত্যাগ করিতেন না এ জন্য ব্যোমকেশ এ পর্য্যন্ত অবসর প্রাপ্ত হয় নাই।

 মৃণালিনীর ভর্ৎসনায় ব্যোমকেশ কহিল “কেন, হস্ত ত্যাগ করিব? আমি কি মনুষ্য নই? যদি একের মনোরঞ্জন করিয়াছ, তবে অপরের পার না?”

 মৃ। “দুর্ব্বৃত্ত! যদি না ছাড়িবে, তবে এখনই ডাকিয়া গৃহস্থ সকলকে উঠাইব।”

 ব্যো। “উঠাও। আমি কহিব অভিসারিকাকে ধরিআছি।”

 মৃ। “তবে অধঃপাতে যাও।” এই বলিয়া মৃণালিনী সবলে হস্তমোচন জন্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। ব্যোমকেশ কহিল, “অধীর হইও না। আমার মনোরথ পূর্ণ হইলেই আমি তোলায় ত্যাগ করিব। এখন তোমার সই ভগিনী মণিমালিনী কোথায়?”

 মৃ। “আমিই তোমার ভগিনী।”

 ব্যো। “তুমি আমার প্রাণেশ্বরী।”

 এই বলিয়া ব্যোমকেশ মৃণালিনীকে হস্তদ্বারা আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিলেন। যখন মাধবাচার্য্য তাঁহাকে হরণ করিয়াছিল, তখন মৃণালিনী স্ত্রীস্বভাবসুলভ চীৎকারে রতি দেখান্ নাই, এখনও শব্দ করিলেন না।

 অকস্মাৎ ব্যোমকেশ কাতর স্বরে বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল। “রাক্ষসি! তোর দন্তে কি বিষ আছে?” এই বলিয়া ব্যোমকেশ মৃণালিনীর হস্ত ত্যাগ করিয়া আপন পৃষ্ঠে হস্ত মার্জ্জন করিতে লাগিলেন। স্পর্শানুভবে জানিলেন যে পৃষ্ঠ দিয়া দরদরিত রুধির পড়িতেছে।

 মৃণালিনী মুক্তহস্ত হইয়াও পলাইলেন না। তিনিও প্রথমে ব্যোমকেশের ন্যায় বিস্মিত হইয়াছিলেন, কেন না তিনি ত ব্যোমকেশকে দংশন করেন নাই। ভল্লুকোচিত কার্য্য তাঁহার করণীয় নহে। কিন্তু তখনই নক্ষত্রালোকে খর্ব্বাকৃতা বালিকামূর্ত্তি সম্মুখ হইতে অপসৃত হইতেছে দেখিতে পাইলেন। গিরিজায়া তাঁহার বসনাকর্ষণ করিয়া মৃদুস্বরে “পলাইয়া আইস” বলিয়া স্বয়ং পলায়ন করিল।

 পলায়ন মৃণালিনীর স্বভাবসঙ্গত নহে। তিনি পলায়ন করিলেন না। ব্যোমকেশ প্রাঙ্গনে দাঁড়াইয়া আর্ত্তনাদ করিতেছে এবং কাতরোক্তি করিতেছে দেখিয়া, তিনি গজেন্দ্রগমনে নিজ শয়নাগার অভিমুখে চলিলেন। কিন্তু তৎকালে ব্যোমকেশের আর্ত্তনাদে গৃহস্থ সকলেই জাগরিত হইয়াছিল। সম্মুখে হৃষীকেশ। হৃষীকেশ পুত্রকে শশব্যস্ত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,

 “কি হইয়াছে, কেন যাঁড়ের ন্যায় চীৎকার করিতেছ?”

 ব্যোমকেশ কহিল, “মৃণালিনী অভিসারে গমন করিয়াছিল, আমি তাহাকে ধৃত করিয়াছি বলিয়া সে আমার পৃষ্ঠে দারুণ দংশন করিয়াছে।”

 হৃষীকেশ পুত্রের কুরীতি কিছুই জানিতেন না। মৃণালিনীকে প্রাঙ্গন হইতে উঠিতে দেখিয়া এ কথায় তাঁহার বিশ্বাস হইল। তৎকালে তিনি মৃণালিনীকে কিছুই বলিলেন না। নিঃশব্দে গজগামিনীর পশ্চাৎ তাঁহার শয়নাগারে আসিলেন।