মৃণালিনী (১৮৭৪)/প্রথম খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
দূতী।
লক্ষ্মণাবতী নগরীর প্রদেশান্তরে যেখানে সর্ব্বধন বণিকের বাটীতে হেমচন্দ্র অবস্থিতি করিতেছিলেন, পাঠক মহাশয় সেই খানে চলুন। বণিকের গৃহদ্বারে এক অশোক বৃক্ষ বিরাজ করিতেছিল; অপরাহ্নে তাহার তলে উপবেশন করিয়া, একটী কুসু- মিত অশোকশাখা নিষ্প্রয়োজনে হেমচন্দ্র ছুরিকা দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিতেছিলেন, এবং মূহুর্মূহুঃ পথপ্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন, যেন কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছেন। যাহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, সে আসিল না। দিগ্বিজয় আসিল, হেমচন্দ্র দিগ্বিজয়কে কহিলেন,
“দিগ্বিজয়, ভিখারিণী আজি এখনও আসিল না। আমি বড় ব্যস্ত হইয়াছি। তুমি একবার তাহার সন্ধানে যাও।”
“যে আজ্ঞা” বলিয়া দিগ্বিজয় গিরিজায়ার সন্ধানে চলিল। নগরীর রাজপথে গিরিজায়ার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল।
গিরিজায়া বলিল, “কে ও দিগ্বিজয়?” দিগ্বিজয় রাগ করিয়া কহিল, “আমার নাম দিগ্বিজয়।”
গি। “ভাল দিগ্বিজয়—আজি কোন্ দিগ্জয় করিতে চলিয়াছ?”
দি। “তোমার দিগ্।”
গি। “আমি কি একটা দিগ্? তোর দিগ্বিদিগ্ জান নাই।”
দি। “কেমন করিয়া থাকিবে—তুমি যে অন্ধকার। এখন চল, প্রভু তোমাকে ডাকিয়াছেন।”
গি। “কেন?”
দি। “তোমার সঙ্গে বুঝি আমার বিবাহ দিবেন।”
গি। “কেন ভোমার কি মুখ-অগ্নি করিবার আর লোক যুটিল না।”
দি। “না। সে কাজ তোমাকেই করিতে হইবে। এখন চল।”
গি। “পরের জন্যেই মলেম। তবে চল।”
এই বলিয়া গিরিজায়া দিগ্বিজয়ের সঙ্গে চলিলেন। দিগ্বিজয়, অশোকতলস্থ হেমচন্দ্রকে দেখাইয়া দিয়া অন্যত্র গমন করিল। হেমচন্দ্র অন্যমনে মৃদু মৃদু গাইতেছিলেন।
“বিকচ নলিনে, যমুনা পুলিনে, বহুত পিয়াসা রে”
গিরিজায়া পশ্চাৎ হইতে গাইল
“চন্দ্রমাশালিনী, যা মধু যামিনী, না মিটল আশা রে।”
গিরিজায়াকে দেখিয়া হেমচন্দ্রের মুখ প্রফুল্ল হইল। কহিলেন,
“কে গিরিজায়া! আশা কি মিট্ল?”
গি। “কার আশা? আপনার না আমার।”
হে। “আমার আশা। তাহা হইলেই তোমার মিটিবে।”
গি। “আপনার আশা কি প্রকারে মিটিবে? লোকে বলে রাজা রাজড়ার আশা কিছুতেই মিটে না।”
হে। “আমার অতি সামান্য আশা।”
গি। “যদি কখন মৃণালিনীর সাক্ষাৎ পাই তবে এ কথা তাঁহার নিকট বলিব।”
হেমচন্দ্র বিষণ্ণ হইলেন। কহিলেন, “তবে কি আজিও মৃণালিনীর সন্ধান পাও নাই? আজি কোন্ পাড়ায় গীত গাইতে গিয়াছিলে?”
গি। “অনেক পাড়ায়—সে পরিচয় আপনার নিকট নিত্য নিত্য কি দিব? অন্য কথা বলুন।”
হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “বুঝিলাম বিধাতা বিমুখ। ভাল পুনর্ব্বার কালি সন্ধানে যাইবে।”
গিরিজায়া তখন প্রণাম করিয়া কপট বিদায়ের উদ্যোগ করিল। গমনকালে হেমচন্দ্র তাহাকে কহিলেন, “ভাল—গিরিজায়া—তোমাকেত আমি তোমার পুরস্কার স্বরূপ বসন ভূষণ দিরাছি—সে গুলিন্ পর না কেন?”
গি। “সুবদনা ভিখারিণীকে কে ভিক্ষা দিবে? আপনি যত দিন আছেন, তত দিন যেন আমার ভিক্ষার প্রয়োজন নাই। আপনি যথেষ্ট পুরস্কার করিতেছেন কিন্ত আপনি ত বসন্তের কোকিল। উড়িয়া গেলে আমার যে ভিক্ষা, সেই ভিক্ষা করিতে হইবে। আর আমি আপনার কোন কাজ করিতে পারিলাম না; সে গুলিন আপনার ফিরাইয়া দিব।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “ফিরাইয়া দিবে কেন? গিরিজায়া, তুমি হাসিতেছ না কিন্ত তোমার চক্ষু হাসিতেছে। আজি কি তোমার গান শুনিয়া কেহ কিছ বলিয়াছে?”
গি। “কে কি বলিবে? এক মাগী তাড়া করিয়া মারিতে আসিয়াছিল—বলে মথুরাবাসিনীর জন্যে শ্যামসুন্দরের ত মাথাব্যথা পড়িয়াছে।”
হেমচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অস্ফুটস্বরে, যেন আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন “এত যত্নেও যদি সন্ধান না পাইলাম, তবে আর বৃথা আশা—কেন মিছা কালক্ষেপ করিয়া আত্মকর্ম্ম নষ্ট করি;—গিরিজায়ে, কালি তোমাদিগের নগর হইতে বিদায় হইব।”
“তথাস্ত।” বলিয়া গিরিজায়া মৃদু মৃদু গান করিতে লাগিল,—
“শুনি যাওয়ে চলি, বাজায়ি মুরলী, বনে বনে একা রে।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “ও গান এই পর্য্যন্ত! অন্য গীত গাও।”
গিরিজায়া গাইল,
“কটিবাস কসিয়ে, রাস রসে রসিয়ে, মাতিল রস কামিনী।”
গাইতে গাইতে গিরিজায়া লজ্জিতা হইলেন, তখন গীত পরিবর্ত্তন করিয়া গাইলেন,
“যে ফুল ফুটিত সখি; গৃহ তরু শাখে,
কেন রে পবনা, উড়ালি তাকে।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “পবনে যে ফুল উড়ে তাহার জন্য দুঃখ কি? ভাল গীত গাও।”
গিরিজায়া গাইল,
“কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে।
জলে তারে ডুবাইল, পড়িয়া মরমে॥”
হেম। “কি কি? মৃণাল কি?”
গি। | “কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে। |
না—অন্য গান গাই।”
হে। “না—না—না—এই গান—এই গান গাও। তুমি রাক্ষসী।”
গি। | “বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন। |
হে। “গিরিজায়ে! গিরি—এ গীত তোমাকে কে শিখাইল?”
গি। (সহাস্যে)
“হেনকালে কাল মেঘ উদিল আকাশে।
উড়িল মরালরাজ, মানস বিলাসে॥
ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম তার বেগভরে।
ডুবিয়া অতল জলে মৃণালিনী মরে।”
হেমচন্দ্র বাষ্পাকুললোচনে গদ্গদস্বরে গিরিজীয়াকে কহিদেন, “এ আমারি মৃণালিনী। তুমি তাহাকে কোথায় দেখিলে?”
গি। | “দেখিলাম সরোবরে, কাঁপিচে পবন ভরে, |
হে। “এখন রূপক রাখ আমার কথার উত্তর দাও—কোথায় মৃণালিনী?”
গি। “এই নগরে।”
হেমচন্দ্র রুষ্টভাবে কইলেন, “তা ত আমি অনেক দিন জানি। এ নগরে কোন্ স্থানে?”
গি। “হৃষীকেশ শর্ম্মার বাড়ী।”
হে। “কি পাপ! সে কথা আমিই তোমাকে বলিয়া দিয়াছিলাম। এত দিনত তাহার সন্ধান করিতে পার নাই, এক্ষণে কি সন্ধান করিয়াছ?”
গি। “সন্ধান করিয়াছি।”
হেমচন্দ্র দুই বিন্দু—দুই বিন্দু মাত্র অশ্রু মোচন করিলেন। পুনরপি কহিলেন “সে এখান হইতে কত দূর?”
গি। “অনেক দুর।”
হে। “সে এখান হইতে কোন্ দিকে যাইতে হয়?”
গি। “এখান হইতে দক্ষিণ, তার পর পূর্ব্ব; তার পর উত্তর, তার পর পশ্চিম—”
হেমচন্দ্র হস্ত মুষ্টিবদ্ধ করিলেন। কহিলেন এ সময়ে ব্যঙ্গ ত্যাগ কর নচেৎ মস্তক চূর্ণ করিব।”
গি। “শান্ত হউন। পথ বলিয়া দিলে কি আপনি চিনিতে পারিবেন? যদি তা না পারিবেন, তবে জিজ্ঞাসার আবশ্যক? আজ্ঞা করিলে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।”
মেঘমুক্ত সূর্য্য়ের ন্যায় হেমচন্দ্রের মুখ প্রফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন,
তোমার সর্ব্বকামনা সিদ্ধ হউক—মৃণালিনী কি বলিল?”
গি। “তা ত বলিয়াছি।”
“ডুবিয়া অতল জলে মৃণালিনী মরে।”
হে। “মৃণালিনী কেমন আছে?”
গি। “দেখিলাম শরীরে কোন পীড়া নাই।”
হে। “সুখে আছে কি ক্লেশে আছে কি বুঝিলে?”
গি। “শরীরে গহনা, পরিধানে ভাল কাঁড়-হৃষীকেশ ব্রাহ্মণের কন্যার সই।”
হে। “তুমি অধঃপাতে যাও; মনের কথা কিছু বুঝিলে?”
গি। “বর্ষাকালের পদ্মের মত। মুখখানি কেবল জলে ভাসিতেছে।”
হে। “পরগৃহে কি ভাবে আছে?”
গি। “এই অশোক ফুলের স্তবকের মত। আপন গৌরবে আপনি নম্র।”
হে। “গিরিজায়ে! তুমি বয়সে বালিকা মাত্র। তোমার ন্যায় বালিকা আর দেখি নাই।”
গি। “মুষ্ট্যাঘাতের উপযুক্ত পাত্রও এমন আর দেখেন নাই।”
হে। “সে আপরাধ লইও না। মৃণালিনী আর কি বলিল?”
গি। “যো দিন জানকী—”
হে। “আবার?”
গি। “যো দিন জানকী—রঘুবীর নিরখি—”
হেমচন্দ্র গিরিজায়ার কেশাকর্ষণ করিলেন। তখন সে কহিল “ছাড়! ছাড়! বলি! বলি!”
“বল্” বলিয়া হেমচন্দ্র কেশ ত্যাগ করিলেন।
তখন গিরিজায়া আদ্যোপান্ত মুণালিনীর সহিত কথোপকথন বিবরিত করিল। পরে কহিল;
“মহাশয় আপনি যদি মৃণালিনীকে দেখিতে চান তবে আমার সঙ্গে একপ্রহর রাত্রে যাত্রা করিবেন।”
গিরিজায়ার কথা সমাপ্ত হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নিঃশবে অশোক তলে পাদচারণ করিতে লাগিলেন। বহুক্ষণ পরে কিছুমাত্র না বলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। এবং তথা হইতে একখানি পত্র আনিয়া গিরিজায়ার হস্তে দিলেন, এবং কহিলেন,
“মৃণালিনীর সহিত সাক্ষাতে আমার এক্ষণে অধিকার নাই। তুমি রাত্রে কথামত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে এবং এই পত্র তাঁহাকে দিবে। কহিবে দেবতা প্রসন্ন হইলে অবশ্য শীঘ্র বৎসরেক মধ্যে সাক্ষাৎ হইবে। মৃণালিনী কি বলেন অদ্য রাত্রেই আমাকে বলিয়া যাইও।”
গিরিজায়া বিদায় হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ চিন্তিতান্তঃকরণে অশোক বৃক্ষতলে তৃণশয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন। ভুজোপরে মস্তক রক্ষা করিয়া, পৃথিবীর দিকে মুখ রাখিয়া, শয়ান রহিলেন। কিয়ৎকাল পরে, সহসা তাঁহার পৃষ্ঠদেশে কঠিন করস্পর্শ হইল। মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, সম্মুখে মাধবাচার্য্য।
মাধবাচার্য্য কহিলেন, “বৎস! গাত্রোত্থান কর। আমি তোমার প্রতি অসন্তষ্ট হইয়াছি—সন্তুষ্টও হইয়াছি। তুমি আমাকে দেখিয়া বিস্মিতের ন্যায় কেন চাহিয়া রহিয়াছ?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি এখানে কোথা হইতে আসিলেন?”
মাধবাচার্য্য এ কথায় কোন উত্তর না দিয়া কহিতে লাগিলেন,
তুমি এ পর্য্যন্ত নবদ্বীপে না গিয়া পথে বিলম্ব করিতেছ—ইহাতে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি। আর তুমি বে মৃণালিনীর সন্ধান পাইয়াও আত্মসত্য প্রতিপালনার্থ তাহার সাক্ষাতের সুযোগ উপেক্ষা করিলে, এজন্য তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছি। তোমাকে কোন তিরস্কার করিব না। কিন্ত এখানে তোমার আর বিলম্ব করা হইবে না। মৃণালিনীর প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা করা হইবে না। বেগবান্ হৃদয়কে বিশ্বাস নাই। আমি অদ্যই নবদীপে যাত্রা করিব। তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে নৌকা প্রস্তত আছে। অস্ত্র শস্ত্রাদি গৃহমধ্য হইতে লইয়া আইস। আমার সঙ্গে চল।”
হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন। হানি নাই—আমি আশা ভরসা বিসর্জ্জন করিরাছি। চলুন। কিন্ত আপনি—কামচর না অন্তর্যামী?”
এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ পূর্ব্বক বনিকের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন। এবং আপনার সম্পত্তি এক জন বাহকের স্বন্ধে দিয়া আচার্য্যের অনুবর্ত্তী হইলেন।