মৃণালিনী (১৮৭৪)/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


ভিখারিণী।

 সখীদ্বয় অল্পক্ষণ নিঃশব্দে আলেখ্যেদত্তমনা হইয়া কর্ম্ম করিতেছিলেন, এমত সময়ে বালকণ্ঠনিঃসৃত মধুর সঙ্গীত তাঁহাদিগের কর্ণরন্ধে প্রবেশ করিল।

“মথুরাবাসিনি, মধুর হাসিনি,
শ্যামবিলাসিনি—রে!”

 মৃণালিনী কহিলেন, “সই, কোথায় গান করিতেছে।”

 মণিমালিনী কহিলেন “বহির্ব্বাটীতে গাইতেছে।”

 গায়ক গাইতে লাগিল।

“কহলো নাগরি, গেহ পরিহরি,
কাহে বিবাসিনী—রে।”

 মৃ। “সখি! কে গাইতেছে জান?”

 মণি। “কোন ভিখারিণী হইবে।”

 আবার গীত।

“বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন,
কাহে তু তেয়াগী,—রে
দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর,
ফিরে তুয়া লাগি—রে।”

 মৃণালিনী বেগের সহিত কহিলেন, “সই! সই! উহাকে বাটীর ভিতর ডাকিয়া আন।”

 মণিমালিনী গায়িকাকে ডাকিতে গেলেন। ততক্ষণ সে গাইতে লাগিল।

“বিকচনলিনে, যমুনা পুলিনে,
বহুত পিয়াসা—রে।
চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী,
না মিটল আশা—রে॥
সা নিশা সমরি—”

 এমন সময়ে মণিমালিনী উহাকে ডাকিয়া বাড়ীর ভিতর আনিলেন।

 সে অন্তঃপুরে আসিয়া পূর্ব্ববৎ গাইতে লাগিল।

“সা নিশা সমরি, কহলো সুন্দরি,
কাঁহা মিলে দেখা—রে।
শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী,
বনে বনে একা—রে।”

 মৃণালিনী তাহাকে কহিলেন, “তোমার দিব্য স্বর, তুমি গীতটী আবার গাও।”

 গায়িকার বয়স ষোড়শ বৎসর। ষোড়শী, খর্ব্বাকৃতা এবং কৃষ্ণাঙ্গী। গিরিজায়া প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণা। তাই বলিয়া তাহার গায়ে ভ্রমর বসিলে যে দেখা যাইত না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছে বোধ হইত কিম্বা জল মাখিলে কালি বোধ হইত যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, ইহার সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু বর্ণ যেমন হউক না কেন, ভিখারিণী কুরূপা নহে। তাহার অঙ্গ পরিষ্কার, সুমার্জ্জিত, চাকচিক্যবিশিষ্ট; মুখখানি প্রফুল্ল, চক্ষু দুটী বড়, অত্যন্ত শ্বেত, চঞ্চল, হাস্যময়; লোচনতারা নিবিড় কৃষ্ণ, এক টী তারার পার্শ্বে একটী তিল। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র, রক্তপ্রভ, তদন্তরে অতি পরিষ্কার, অমলশ্বেত, কুন্দকলিকা-সন্নিভ দুই শ্রেণী দন্ত। কেশগুলিন সূক্ষ্ম, গ্রীবার উপরে মোহিনী কবরী, তাহাতে যূথিকার মালা বেষ্টিত। যৌবন সঞ্চারে শরীরের গঠন সুন্দর হইয়াছিল, যেন কৃষ্ণ প্রস্তরে কোন শিল্পকার পুত্তল খোদিত করিয়াছিল। পরিচ্ছদ অতি সামান্য কিন্তু পরিষ্কার, ধূলি কর্দ্দম পরিপূর্ণ নহে। অঙ্গ একেবারে নিরাভরণ নহে, অথচ অলঙ্কার গুলিন, ভিখারির যোগ্য বটে। প্রকোষ্ঠে পিতলের বলয়; গলায় কাছের মালা’ নাসিকায়, ক্ষুদ্র একটী তিলক, ভ্রূমধ্যে ক্ষুদ্র একটী চন্দনের “টিপ।” সে আজ্ঞামত পূর্ব্ববৎ গায়িতে লাগিল।

“মথুরাবাসিনী, মধুরহাসিনী, শ্যামবিলাসিনী,—রে।[]
কহলো নাগরি, গেহ পরিহরি, কাহে বিবাসিনী—রে॥
বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন, কাহে তু তেয়াগী—রে॥
দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর, ফিরে তুয়া লাগি—রে॥
বিকচ নলিনে, যমুনা পুলিনে, বহুতপিয়াসা—রে॥
চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা—রে॥
সা নিশা সমরি, কহলো সুন্দরি, কাঁহা মিলে দেখা—রে॥
শুনি, যাওয়ে চলি, বাজায়ি মুরলী, বনে বনে একা—রে।”

 গীত সমাপ্ত হইলে মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি সুন্দর গাও।” সই মণিমালিনী, ইহাকে কিছু দিলে ভাল হয়। তুমি আজি একটী মুদ্রা আমায় ঋণ দাও; মাধবাচার্য্যের স্বীকৃত অর্থ আসিলে আমি পরিশোধ করিব।”

 মণিমালিনী অর্থ আনিতে গেলেন, ইত্যবসরে মৃণালিনী বালিকাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “শুন ভিখারিণি; তোমার নাম কি?”

 ভিখা। “আমার নাম গিরিজায়া।”

 মৃ। “তোমার গৃহ কোথা?”

 গিরি। “এই নগরেই থাকি।”

 মৃ। “তুমি কি গীত গাইয়া দিন যাপন কর?”

 গিরি। “আর কি করিব?”

 মৃ। “তুমি গীত সকল কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছ?”

 গি। “যেখানে যা পাই তাহা শিখি।”

 মৃ। “এ গীতটী কোথা শিখিলে?”

 গি। “একটী বণিক আমাকে শিখাইয়াছে।”

 মৃ। “সে বণিক্ কোথায় থাকে?”

 গি। “এই নগরেই আছে।”

 মৃণালিনীর মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল—প্রাতঃসূর্য্যকর স্পর্শে যেন পদ্ম ফুটিয়া উঠিল। কহিলেন,

 “সে বণিক্ কিসের বাণিজ্য করে?”

 গিরি। “যাহার বাণিজ্য সকলে করে, সেও তাহার বাণিজ্য করে।”

 মৃ। “সে কিসের বাণিজ্য?”

 গি। “কথার বাণিজ্য।”

 মৃ। “এ নূতন বাণিজ্য বটে। তাহাতে লাভালাভ কিরূপ?”

 গি। “ইহাতে লাভের অংশ প্রীতি, অলাভ কলহ।”

 মৃ। “তুমিও ব্যবসায়ী বটে। ইহার মহাজন কে?”

 গি। “যে মহাজন।”

 মৃ। “তুমি ইহার কি?”

 গি। “নগ্দা মুটে।”

 মৃ। “ভাল—তোমার বোঝা নামাও। সামগ্রী কি আছে দেখি।”

 গি। “এ সামগ্রী দেখে না; শুনে।”  মৃ। “ভাল শুনি।”

 গি। “তবে শুনুন।” এই বলিয়া গিরিজায়া গাইতে লাগিল।

“যমুনার জলে মোরে, কি নিধি মিলিল।
ঝাঁপ দিয়া পশি জলে, যতনে তুলিয়া গলে,
পরেছিনু কুতূহলে, যে রতনে।
নিদ্রার আবেশে মোর, গৃহেতে পশিল চোর,
কণ্ঠের কাটিল ডোর, মণি হরে নিল।

 মৃণালিনী, বাস্পপীড়িত লোচনে, গদ্গদস্বরে, অথচ হাসিয়া কহিলেন, “এ কোন্ চোরের কথা।”

 গি। “বণিক্ বলিলেন চুরির ধন লইয়াই তাঁহার ব্যাপার।”

 মৃ। “তাঁহাকে বলিও যে চোরা ব্যাপারে সাধু লোকের প্রাণ বাঁচে না।”

 গি। “বুঝি ব্যাপারিরও নয়।”

 মৃ। “কেন ব্যাপারির কি?”

 গিরিজায়া গাইল।

“ঘাট বাট তট মাট ফিরি, ফিরনু বহু দেশ।
কঁহা মেরে কান্ত বরণ, কাঁহা রাজবেশ।
হিয়াপর রোপনু পঙ্কজ, কৈনু যতন ভারি।
সোহি পঙ্কজ কাঁহা মোর, কাঁহা মৃণাল হামারি॥”

 মৃণালিনী, সস্নেহ কোমল স্বরে কহিলেন, “মৃণাল কোথায়? আমি সন্ধান বলিয়া দিতে পারি, তাহা মনে রাখিতে পারিবে?”

 গি। “পারিব—কোথায় বল।”

 মৃণালিনী বলিলেন।

“কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে।
জলে তারে ডুবাইল পীড়িয়া মরমে॥

“রাজহংস দেখি এক নয়নরঞ্জন।
চরণে বেড়িয়া তারে, করিল বন্ধন॥
বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন।
হৃদয় কমলে মোর, তোমার আসন॥
আসিয়া বসিল হংস হৃদয় কমলে।
কাঁপিল কণ্টক সহ মৃণালিনী জলে॥
হেন কালে কাল মেঘ, উদিল আকাশে।
উড়িল মরালরাজ, মানস বিলাসে॥
ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম, তার বেগভরে।
ডুবিয়া অতল জলে, মৃণালিনী মরে॥”

 কেমন গিরিজায়া শিখিতে পারিবি?

 গিরি। “তা পারিব। চক্ষের জল টুকু শুদ্ধ কি শিখিব?”

 মৃ। “না। এ ব্যবসায় আমার লাভের মধ্যে ঐ টুকু।”

 মৃণালিনী গিরিজায়াকে এই কবিতা গুলিন অভ্যাস করাইতে ছিলেন। এমত সময়ে মণিমালিনীর পদধ্বনি শুনিতে পাইলেন। মণিমালিনী তাঁহার স্নেহশালিনী সখী সকলেই জানিয়াছেন। তথাপি মণিমালিনী পিতৃপ্রতিজ্ঞাভঙ্গের সহায়তা করিবে এরূপ তাঁহার বিশ্বাস জন্মিল না। অতএব তিনি এ সকল কথা সখীর নিকট গোপনে যত্নবতী হইয়া গিরিজায়াকে কহিলেন; “আজি আর কাজ নাই। বণিকের সহিত সাক্ষাৎ করিও। তোমার বোঝা কালি আবার আনিও। যদি গ্রহণযোগ্য কোন সামগ্রী থাকে, তবে তাহা আমি ক্রয় করিব।”

 গিরিজায় বিদায় হইল। মৃণালিনী যে তাহাকে পারিতোষিক দিবার অভিপ্রায় করিয়াছিলেন তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।

 গিরিজায়া কতিপয় পদ গমন করিলে মণিমালিনী একটী রৌপ্য মুদ্রা আনিয়া মৃণালিনীর হস্তে অর্পণ করিলেন। তখন মৃণালিনী মুদ্রাটী লইয়া গিরিজায়াকে দিতে গেলেন এবং দানের অবকাশে উহার কাণে কাণে কহিলেন, “আমার ধৈর্য্য হইতেছে। কালি পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিব না; তুমি আজ রাত্রে প্রহরেকের সময় আসিয়া এই গৃহের উত্তর দিকে প্রাচীর মূলে অবস্থিতি করিও; তথায় আমার সাক্ষাৎ পাইবে। তোমার বণিক যদি আসেন, সঙ্গে আনিও।”

 গিরিজায়া কহিল, “বুঝিয়াছি। আমি নিশ্চিত আসিব।”

 মণিমালিনীর নিকট প্রত্যাগতা হইলে মণিমালিনী কহিলেন, “সই ভিখারিণীকে কাণে কাণে কি বলিতেছিলে?”

 মৃণালিনীকহিলেন, “কি বলিব সই—

সই মনের কথা সই, সই মনের কথা সই।
কাণে কাণে কি কথাটি বলে দিলি ওই॥
সই ফিরে কনা সই, সই ফিরে কনা সই।
সই কথা কোস্ কথা কব, নইলে কারো নই।”

 মণিমালিনী হাসিয়া কহিলেন,

 “হলি কিলো সই?”

 মৃণালিনী কহিলেন,

 “তোমারই সই।”

  1. এই গীত জয়জয়ন্তী রাগিণী ঢিমে তেতালা তাল।