মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
বাপীকূলে।
অকাল জলদোদয় স্বরূপ ভীম মূর্ত্তি রাজপুত্র হেমচন্দ্র যবনান্বেষণে নিষ্কন্ত হইলেন। ব্যাঘ্র আহার্য্য দেখিবামাত্র বেগে ধাবিত হয়, হেমচন্দ্র যবন দেখিবামাত্র সেইরূপ ধাবিত হইলেন। কিন্তু কোথায় যবনের সাক্ষাৎ পাইবেন তাহার স্থিরতা ছিল না।
হেমচন্দ্র একটা মাত্র যবন দেখিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এই সিদ্ধান্ত করিলেন, যে হয় যবন সেনা নগর সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া লুক্কায়িত আছে নতুবা এই ব্যক্তি যবন সেনার পূর্ব্বচর। যদি যবন সেনাই আসিয়া থাকে, তবে তৎসঙ্গে একাকী সংগ্রাম সম্ভবে না। কিন্তু যাহাই হউক, প্রকৃত অবস্থা কি তাহার অনুসন্ধান না করিয়া হেমচন্দ্র কদাচ স্থির থাকিতে পারেন না। যে মহংকার্য্য জন্য মৃণালিনীকে ত্যাগ করিয়াছেন, অদ্য রাত্রে নিদ্রা ভিভূত হইয়া সে কর্ম্মে উপেক্ষা করিতে পারেন না। বিশেষ যবনবধে হেমচন্দ্রের অন্তরিক আনন্দ। উষ্ণীযধারী মুণ্ড দেখিয়া অবধি তাঁহার জিঘাংসা ভয়ানক প্রবল হইয়াছে সুতরাং তিনি হির হইবার সম্ভাবনা কি? অতএব দ্রুতপদ বিক্ষেপে হেমচন্দ্র রাজপথাভিমুখে চলিলেন।
উপবন গৃহ হইতে রাজপথ কিছু দূর। যে পথ বাহিত করিয়া উপবন গৃহ হইতে রাজপথে যাইতে হয় সে বিরল-লোকপ্রবাহ গ্রাম্য পথ মাত্র। হেমচন্দ্র সেই পথে চলিলেন। সেই পথ পার্শ্বে অতি বিস্তারিত, সুরম্য সোপানাবলি শোভিত, এক দীর্ঘিকা ছিল। দীর্ঘিকা পার্শ্বে অনেক বকুল, শাল, অশোক, চম্পক, কদম্ব, অশ্বথ, বট, আম, তিন্তিড়ী প্রভৃতি বৃক্ষ সমূহ ছিল। বৃক্ষগুলিন সুশৃঙ্খল শ্রেণীবিন্যস্ত ছিল এমত নহে, বহুতর বৃক্ষ পরস্পর শাখায় শাখায় সম্বদ্ধ হইয়া বাপীতীরে ঘনান্ধকার করিয়া রহিত। দিবসেও তথায় অন্ধকার। কিম্বদন্তী ছিল যে সেই সরোবরে ভূতযোনি বিহার করিত। এই সংস্কার প্রতিবাসীদিগের মনে এরূপ দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছিল যে সচরাচর তথায় কেহ যাইত না। যদি যাইত তবে একাকী কেহ যাইত না। নিশাকালে কদাপি কেহ যাইত না।
পৌরাণিক ধর্ম্মের একাধিপত্য কালে হেমচন্দ্রও দেবযোনির অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রত্যয়শালী হইবেন তাহার বিচিত্র কি? কিন্তু প্রেত সম্বন্ধে প্রত্যয়শালী বলিয়া তিনি গন্তব্য পথে যাইতে সঙ্কোচ করেন এরূপ ভীরু স্বভাব তাঁহার নহে। অতএব তিনি নিঃসঙ্কোচে বাপীপার্শ্ব দিয়া চলিলেন। নিঃসঙ্কোচ বটে কিন্তু কৌতুহল শূন্য নহেন। বাপীর পার্শ্বে সর্ব্বত্র এবং তত্তীর প্রতি অনিমিক লোচনে চক্ষুঃ নিক্ষিপ্ত করিতে করিতে চলিলেন। সোপানমার্গের নিকটবর্তী হইলেন। সহসা চমকিত হইলেন। জনশ্রুতির প্রতি তাহার বিশ্বাস দৃঢ়ীকৃত হইল। দেখিলেন, চন্দ্রালোকে, সর্ব্বাধঃস্থ সোপানে, জলে চরণ রক্ষা করিয়া শ্বেতবসন-পরিধানা কে বসিয়া আছে। স্ত্রীমূর্ত্তি বলিয়া তাঁহার বোধ হইল। শ্বেত-বসনা, অবেণী-সম্বদ্ধকুন্তলা; কেশজালে স্কন্ধ, পৃষ্ঠদেশ, বাহুযুগল, মুখমণ্ডল, হৃদয়, সর্ব্বত্র আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। প্রেত বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র নিঃশব্দে চলিয়া যাইতে ছিলেন। কিন্তু মনে ভাবিলেন, যদি মনুষ্য হয়? এত রাত্রে কে এ স্থানে? সে ত যবনকে দেখিলে দেখিয়া থাকিতে পারে? এই সন্দেহে হেমচন্দ্র ফিরিলেন। সাহসে ভর করিয়া বাপীতীরারোহণ করিলেন, সোপানমার্গে ধীরে ধীরে অবতরণ করিতে লাগিলেন। প্রেতিনী তাঁহার আগমন জানিতে পারিযাও সরিল না। পূর্ব্ববৎ রহিল। হেমচন্দ্র তাহার নিকটে আসিলেন। তখন সে উঠিয়া দাঁড়াইল; হেমচন্দ্রের দিকে ফিরিল; হস্ত দ্বারা মুখাবরণকারী কেশদাম অপসৃত করিল। হেমচন্দ্র তাহার মুখ দেখিলেন। সে প্রেতিনী নহে, কিন্তু প্রেতিনী হইলে হেমচন্দ্র অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইতেন না। কহিলেন, “কে মনোরমে! তুমি এখানে?” মনোরমা কহিল, “আমি এখানে অনেক বার আসি—কিন্তু তুমি এখানে কেন?”
হেম। “আমার কর্ম্ম আছে।”
মনো। “এ রাত্রে কি কর্ম্ম?”
হেম। “পশ্চাৎ বলিব, তুমি এরাত্রে এখানে কেন?”
মনো। “তোমার এ বেশ কেন? হাতে শূল; কাঁকালে তরবারি; তরবারে এ কি জ্বলিতেছে? একি হীরা? মাথায় এ কি? ইহাতে যে ঝক্মক্ করিয়া জ্বলিতেছে, এই বা কি? এও কি হীরা? এত হীরা পেলে কোথা?”
হেম। “আমার ছিল।”
মনো। “এ রাত্রে এত হীরা পরিয়া কোথায় যাইতেছ? চোরে যে কাড়িয়া লইবে?”
হেম। “আমার নিকট হইতে চোরে কাড়িতে পারে না।”
মনো। “ত রাত্রে এত অলঙ্কারে প্রয়োজন কি? তুমি কি বিবাহ করিতে যাইতেছ।”
হেম। “তোমার কি বোধ হয় মনোরমে?”
মনো। “মানুষ মারিবার অস্ত্র লইয়া কেহ বিবাহ করিতে যায় না। তুমি যুদ্ধে যাইতেছ?”
হেম। “কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? তুমিই বা এখানে কি করিতেছিলে?”
মনো। “স্নান করিতেছিলাম। স্নান করিয়া বাতাসে চুল শুকাইতেছিলাম। এই দেখ চুল এখনও ভিজিয়া রহিয়াছে।” এই বলিয়া মনোরমা আর্দ্র কেশ হেমচন্দ্রের হস্তে স্পর্শ করাইলেন।
হেম। “এত রাত্রে স্নান কেন?”
মনো। “আমার গা জ্বালা করে।”
হে। “গঙ্গাস্নান না করিয়া এখানে কেন?”
মনো। “এখানকার জল বড় শীতল।”
হে। “তুমি সর্ব্বদা এখানে আইস?”
মনো। “আসি।”
হে। “আমি তোমার সম্বন্ধ করিতেছি―তোমার বিবাহ হইবে। বিবাহ হইলে এরূপ কি প্রকারে আসিবে?”
মনো। “আগে বিবাহ হউক।”
হে। হাসিয়া কহিলেন, “তোমার লজ্জা নাই―তুমি কালামুখী।”
মনো। “তিরস্কার কর কেন? তুমি যে বলিয়াছিলে তিরস্কার করিবে না।”
হে। “সে অপরাধ লইও না। এখান দিয়া কাহাকে যাইতে দেখিয়াছ?”
ম। “দেখিয়াছি।”
হে। “তাহার কি বেশ?”
ম। “যবনের বেশ।”
হেমচন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “সে কি? তুমি যবন চিনিলে কি প্রকারে?”
ম। “আমি পূর্ব্বে যবন দেখিয়াছি।”
হে। “সে কি? কোথায় দেখিলে?”
ম। “যে খানে দেখি—তুমি কি সেই যবনের অনুসরণ করিবে?”
হে। “করিব—সে কোন্ পথে গেল?”
ম। “কেন?”
হে। “তাহাকে বধ করিব?
ম। “নরহত্যা করিয়া কি হইবে?”
হে। “যবন আমার পরম শত্রু।”
ম। “তবে একটী যবন মারিয়া কি তৃপ্তিলাভ করিবে?”
হে। “আমি যত যবন দেখিতে পাইব তত মারিব।”
ম। “পারিবে?”
হে। “পারিব।”
মনোরমা বলিলেন, “তবে সাবধানে আমার সঙ্গে আইস।”
হেমচন্দ্র ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। যবন যুদ্ধে এই বালিকা পথপ্রদর্শিণী।
মনোরমা তাঁহার মানসিক ভাব বুঝিলেন, বলিলেন “আমাকে বালিকা ভাবিয়া অবিশ্বাস করিতেছ?”
হেমচন্দ্র মনোরমার প্রতি চাহিয়া দেখিলেন। বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভাবিলেন—মনোরমা কি মানুষী?