মৃতের কথোপকথন/আলেকসান্দের, পুরু
৬
আলেকসান্দের, পুরু
আলেকসান্দের
আমার প্রথম পরাজয় তোমার হাতে, পুরু।[১] ইতিহাসে যাই বলুক, গর্ব্বের বশে আমি নিজেও যা বলে থাকি না কেন, আজ সে কথা স্বীকার করছি। সে ভীষণ রাত্রির ছবি আমি এখনও ভুলতে পাচ্ছি নে— সেই তিমির অন্ধকার, ঘোর ঝঞ্ঝাবৃষ্টি, ঘন ঘন বজ্রপাত, শতদ্রুর স্ফীত কল্লোলিত খর স্রোত, হস্তির, অশ্বের, রথের, মানুষের সে প্রলয় সংঘর্ষ আমার মনে এখনও কি একটা কম্পন রেখে গেছে। তারপর অতিকায় হস্তির উপরে তোমার সেই বিপুল কলেবর, তার কাছে অশ্বরাজ বুকেফালের উপরে আলেকসান্দেরকেও সেদিন বোধ হয় ছোটই দেখাচ্ছিল। বর্ব্বরের দেশে এ পরিণামের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
পুরু
তুমি মনে করেছিলে সিন্ধুর পারে সকলেই বুঝি তক্ষশীলার মত নির্জীব মুখপ্রিয়, পথ ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াবে, তোমাকে বরণ করে নিয়ে, তোমার চরণে দেশকে উপঢৌকন দিয়ে পরম সৌভাগ্যবান মনে করবে?
আলেকসান্দের
তা হ’লে যে খারাপই হ’ত, আমি মনে করি নে, পুরু। আলেকসান্দের শুধু অস্ত্র নিয়ে আসে নি, আলেকসান্দের এসেছিল গ্রীসের আলো নিয়ে। পাশ্চাত্যের প্রতিভা দিয়ে আমি তোমার সমস্ত ভারতকে, সমস্ত পৃথিবীকে এক ক’রে দিতেম, মানবজাতি এক হ’য়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠত। সে আদর্শকে তুমি ব্যাহত করেছ। কিন্তু আজ দেখছ ত সে আদর্শ আমার মিথ্যা ছিল না— তার মধ্যে কি সতা, কি জীবন ছিল। তুমি আমার দেহকে হটিয়েছ, পুরু, কিন্তু আমার প্রাণকে হটাতে পার নি।
পুরু
সেই দুঃখই ত আমার বুকে শেল হয়ে আছে। ভারতের পাঁজরা কেটে তুমি পথ ক’রে দিয়েছ— তোমাকে হটিয়েও আমি সে পথ বন্ধ করতে পারি নি। সে পথ দিয়ে হুণ, শক, তাতার, মোগল সব ঢুকেছে, এ সোনার দেশকে দেহে প্রাণে মনে ক্ষিণ্ণ অবসন্ন করে ফেলেছে। আজ তার দেখ কি অবস্থা! বিদেশীর হাত ধ’রে না থাকলে চল্তে পারে না। তার ধর্ম্মে কর্ম্মে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে নিজের কিছুই নেই—সে অপরের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। ভারত আর আর্য্য জাতি নয়—সে হচ্ছে একটা মুমুর্ষু সঙ্কর জাতি।
আলেকসান্দের
আমি ত দেখছি তোমার দেশ যে এতদিন বেঁচে আছে তার কারণ আমি। আমি তার দেহে নূতন রক্ত ভরে দেবার সুরু করেছিলেম, আমি তার মনে বাইরে থেকে নূতন ভাব এনে চারিয়ে দেবার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেম। তোমার বিশুদ্ধ আর্য্যজাতি তোমার বিশুদ্ধ আর্য্যদীক্ষা নিয়ে কবে লোপ পেয়ে যেত, আলেকসান্দের যদি তাকে ধাক্কা দিয়ে না জাগিয়ে তুল্ত, পাশ্চাত্যের আলো, জীবন তার দেহে প্রাণে অনুপ্রবেশ না করিয়ে দিত।
পুরু
নবীন পাশ্চাত্যের এ শুধু দাম্ভিকতা, আলেকসান্দের। তাকিয়ে দেখ সুদুর অতীতে, বিদেশীর বিজাতির বিধর্মীর স্থূল হস্ত যখন আমাদের জীবনের আমাদের শিক্ষা দীক্ষার উপর পড়ে নাই, কি গরীয়ান ছিল এই সভ্যতার আদি জননী ভারত। পরের স্পর্শে এসে যেদিন সে পরমুখী হয়ে স্বধর্ম্মকে বিসর্জ্জন দিয়েছে সেদিন থেকেই নিজের অন্তরাত্মাকে হারিয়ে মৃত্যুর দিকে চলেছে। নিজেকে নিজের স্বধর্ম্মকে স্বাতন্ত্র্যকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারত, ভয়াবহ পরধর্ম্ম তার অন্তরাত্মার উপর চেপে না পড়ত, তবে দেখ্তে আজ ভারতের কি শোভা কি শ্রী কি মহিমা। নিজেকে ভারত বিশুদ্ধ রাখ্তে পারে নি, হাজার রকম বাইরের বিষাক্ত প্রভাব এসে তাকে জর্জ্জরিত ক’রে ফেলেছে, তার যথার্থ সৃষ্টির জীবনবিকাশের ক্ষমতাকে পঙ্গু ক’রে ফেলেছে। কোথায় বৈদিক ঋষির ভারত আর কোথায় চেয়ে দেখ ইংরাজের নকল ভারত।
আলেকসান্দের
তোমাদেরও আত্মাভিমান কম নয়, পুরু। বৈদিক ভারতের কথা কি বল্ছ? ভারতের এক কোণে কতকগুলি ছোট ছোট গ্রাম বা নগর—ক্ষুদে রাজা, সহজ সরল জীবন ধারা, অপরিপক্ক আদিম সমাজ, মাঝে মাঝে দুচার জনা জ্ঞানী বা তোমরা যাদেকে বল ঋষি। তোমাদের রামায়ণের তোমাদের মহাভারতের যুগেও এর চেয়ে বেশী খুব এগিয়ে তোমরা যাও নি। সমস্ত ভারতকে একরাষ্ট্রের এক শাসনতন্ত্রে বেঁধে দেবার স্বপ্ন কার মাথায় প্রথম জেগেছিল, কে তার ভিত প্রথম গড়েছিল, কার গড়া সে কাটামো এখন ইংরাজের ব্যবস্থার নীচে মুসলমানের ব্যবস্থার নীচে তলে তলে দেখা যাচ্ছে? তোমার মনে পড়ে কি সেই বালকের কথা—যার সে রাজশ্রীমণ্ডিত মুখখানি তোমায় দেখিয়ে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করি, এ বালক আমার মত হবে? সেই মৌর্য্য চন্দ্রগুপ্তই তোমার আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা। আর চন্দ্রগুপ্তের আদর্শ ছিল কে, প্রেরণা ছিল কে? এই আলেকসান্দের। তারপর থেকেই স্বদেশী বিদেশী রাজা সম্রাট একের পর একে এসে ভারতকে বর্দ্ধিত পুষ্ট সংহত ক’রে তুলেছে। শিক্ষা দীক্ষা শিল্প কলা সব দেখ—সবই ত আমার পরে, গ্রীসের প্রভাব তার গায়ে গায়ে লেগে আছে, গ্রীসই সে সবকে জাগিয়ে তুলে তোমার দেশে ছাইয়ে ফেলেছে। গ্রীসের পথে পরে এসেছে পারস্য মোগল ইংরেজ—বিদেশীরা তাদের ঐশ্বর্য্য তোমাদের ভাণ্ডারে ঢেলে দিয়েছে বলেই তোমরা পেয়েছ কালিদাস, অজন্তা, তাজমহল।
পুরু
ইতিহাসের ব্যাখ্যা তুমি আর দিও না, আলেকসান্দের। ভারত পূর্ব্বে কি ছিল, তা বুঝ্বার ক্ষমতা যদি তোমার থাকৃত, তবে তোমার হাতে একটি জ্ঞানী একটি সাধকও প্রাণ হারাত না। আমিও সে কথা তুলবো না। শুধু বল্বো এই, বিদেশীর অস্ত্রাঘাতের পরেও ভারত যদি জীবনের পরিচয় দিয়ে থাকে কোথাও কোথাও, তাতে তোমাদের কিছুই কৃতিত্ব নেই। তোমাদের জন্য নয় তোমাদের সত্ত্বেও সে জীবন-প্রতিভা ফুটে বেরিয়েছে। এত পাষাণ চাপের ভিতর দিয়েও যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সব বেরিয়েছে, তা দেখেই তুমি আশ্চর্য্যাম্বিত। সে পাষাণ চাপ যদি না থাক্ত তবে দেখতে ভারতের কি অপরূপ মূর্ত্তি। ভারতের অমর অন্তরাত্মা কোথাও লুকিয়ে আছে আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যে, তারই পরিচয় পাই এ সবে।
আলেকসান্দের
তুমি ভুলে যাচ্ছ, পুরু, পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ পৃথক আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ কেউ থাক্তে পারে না, তা সে যত মহৎ শক্তিমান জাতিই হোক্, আর মানুষই হোক্। বিশুদ্ধ কোন জিনিস নেই—সবই গড়ে উঠেছে আদান প্রদানের ফলে। এই আদান প্রদান যে কর্তে পারে না, সেই মৃত বা মরণাপন্ন। বড় ছোটকে দিচ্ছে, ছোট বড়র কাছ থেকে গ্রহণ কর্ছে। আবার ছোটরও যদি কিছু দেওয়ার থাকে তবে বড়কে দিচ্ছে, বড়ও তা নিচ্ছে। চিরকাল এই হয়ে আসছে—একে বাধা দিতে যাওয়া মস্ত ভুল। চেয়ে দেখ আজকালকার জগৎ, এখন বেশ স্পষ্ট বুঝবে সমস্ত মানবজাতি কেমন এক শিক্ষা এক ভাব, এমন কি এক সমাজ এক রাষ্ট্রের দিকে ক্রমে এগিয়ে চল্ছে।
পুরু
সেই রকম দেখাচ্ছিল বটে, কিন্তু এক হওয়ার অর্থ যে একাকার হওয়া নয়, সে ভুলও ধরা পড়েছে। নিজত্বকে বজায় রাখ্তে হবে। প্রত্যেককে স্বতন্ত্র হতে হবে, স্বধর্ম্ম পেতে হবে। আত্মকর্ত্তৃত্বকে বলি দিয়ে একটা বিপুল যন্ত্রের— বিশেষতঃ পরের গড়া যন্ত্রের অংশীভূত হয়ে যাওয়ার কোন সার্থকতা নেই। জগতের বৈচিত্র্য যে নষ্ট কর্তে যাবে, সে জগতকে বানিয়ে ফেল্বে একটা নিথর জড় পদার্থ!
আলেকসান্দের
আর বৈচিত্র্য অর্থ যদি হয় স্ব স্ব প্রধান হয়ে ওঠা, নিজেকে বিশুদ্ধ রাখ্তে গিয়ে কূপমণ্ডুক হয়ে পড়া, স্বধর্ম্ম হারানোর ভয়ে নিজের নিজের চারদিকে চীনে দেয়াল তুলে দেওয়া তবে সে ক্ষুদে ক্ষুদে জীব সে ক্ষুদে সমাজও জগতে বেশী দিন জীবন্ত হয়ে টি কে থাকবে না।
পুরু
আমি বলি “স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ”; পরের সাথে মিল্তে মিশ্তে যাওয়ার আগে চাই নিজেকে পাওয়া। নিজেকে পাওয়ার জন্যে যদি পরের সংস্রব সব ত্যাগ কর্তে হয় তা’ও ভাল। ক্ষুদে নিজত্ব বৃহৎ পরত্বের অপেক্ষা অনেক গরীয়ান। আমি সাম্রাজ্যের সাধক নই, আমি সাধক স্বারাজ্যের।
- ↑ প্রচলিত ইতিহাস আমি একটু পরিবর্তন করিয়া দিয়েছি। তবে ইতিহাসের দিক হইতেও ইহার স্বপক্ষে কিছু বলা যায় কি না তাহার বিচার ঐতিহাসিকেরা করিবেন।—লেখক।