মৃতের কথোপকথন/রাণা কুম্ভ, মীরাবাঈ

রাণা কুম্ভ, মীরাবাঈ

রাণা কুম্ভ

 মীরা! তুমি আমার প্রেমের গুরু। তোমাকে নমস্কার করতে আজ আমার কোন দ্বিধা নেই।

মীরাবাঈ

 সে নমস্কার গ্রহণ করতে আমারও লজ্জা নেই। সে নমস্কার যে আমার নন্দলালার কাছে গিয়ে পৌঁছুচ্চে।

রাণা কুম্ভ

 মীরা! তুমি আমার চোখের দৃষ্টি, আমার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছ। তুমি আমায় বুঝিয়ে দিয়েছ স্বামী স্ত্রীর প্রকৃত সম্বন্ধ, দেখিয়ে দিয়েছ পুরুষ-নারীর মিলন রহস্য। আজ আমি তাই যথার্থ আনন্দের অধিকারী। আজ আমার গেহ গেহ হয়েছে, আজ আমার দেহ দেহ হয়েছে, আজ আমার সব সন্দেহ টুটেছে।

মীরাবাঈ

 রাধানাথের করুণা সে। বাদসাহের রূঢ় কামদৃষ্টি যে দিন আমার ছার রূপের উপর পড়েছিল, সে দিন হ’তেই অনুভব করেছি নারীদেহের মূলা কি। কোথা থেকে কি একটা তীব্র তেজ এসে আমার সব দেহবোধ পুড়িয়ে ছাই ক’রে দিলে—তারপর কি স্নিগ্ধ কোমল প্রলেপে আমার সবখানি শীতল টল টল করে দিলে। তোমাকে আমি আর আগের চোখে দেখ‍্তে পারলেম না।

রাণা কুম্ভ

 পুরুষের পশুর শরীর আমার, তা বুঝ্বে কি করে? তোমাকে তাই কত কষ্ট কত যন্ত্রণা দিয়েছি। পুরুষের দাম্ভিকতাকে পুরুষের মর্যাদা ব’লে নারীর নারীত্বকে অপমানিত করেছি। সে ভুল আমার তুমি তোমার নারী-হৃদয়ের নিষ্ঠার বলে, অপরূপ প্রেমের আলো ছড়িয়ে ভেঙে দিয়েছ। পুরুষ ও নারীর মিলন দেহে নয়, প্রাণে নয়, মনে নয়, এ জগতে নয়।

মীরাবাঈ

 সে মিলন ভগবানের মাঝে। পুরুষ কে, নারী কে? তুমি কে, আমি কে? নন্দলালার মধুর শ্যাম-মূর্ত্তি সর্ব্বত্র সব জিনিষে। তিনি ছাড়া কেউ নাই, আর কিছু নাই। দেহ-ঘেরা এই আমিটুকুকে আমি মনে করা, চতুর-সেরার কি চাতুরী!

রাণা কুম্ভ

 সে চাতুরী আর আমাদের ভোলাতে পারছে, না, মীরা। মানুষের ভালাবাসা কতটুকু, কতক্ষণের? মানুষের ভালবাসা, সে ত কেবল ক্ষুধা—এতটুকু খেলেই তৃপ্তি হয়ে যায়, আবার অতিরিক্ত খেতে গেলে অজীর্ণ হয়। মানুষের ভালবাসা, সে ত অধিকারের লোভ—দুজনা দুজনাকে পরস্পর গিল্‌তে চেষ্টা করা। কি করুণ ইতিহাস মানুষের ভালবাসার—উত্তেজনা, অবসাদ, ঔদাসীন্য, অতৃপ্তি, বিরোধ—এই ত!

মীরাবাঈ

 মানুষ চায় হয়ত একে অপরের মধ্যে ঢেলে গ’লে মিশে যেতে—কিন্তু জানে না তা কি ক’রে সম্ভব। পুরুষ যত দিন পুরুষ, নারী যতদিন নারী—নিজ নিজ বোধ নিয়ে নিজের নিজের বোধের মধ্যে আবদ্ধ থেকে এ চেষ্টা কর‍্বে ততদিন তার চেষ্টা সফল হতে পারে না। এ সহজ কথাটা বুঝ‍্বে কবে তারা?

রাণা কুম্ভ

 আমার ভালবাসাকে তুমি অসীম অনন্ত করে দিয়েছ, মীরা। হৃদয় আমার ভরাট, কোথাও এতটুকু ফাঁক নাই, এতটুকু শূন্যতা নাই। আমাকে তুমি তুলে ধরেছ তোমার গোপীনাথের মধ্যে—আমরা দুজনে তাঁর মধ্যে তাঁর রসের সাগরে এক হয়ে গেছি।

মীরাবাঈ

 তাই সব ভালবাস। তাঁকে সমর্পণ করতে হয়, নিজের সব ভুলে তাঁতে ডুবে যেতে হয়। তারপর তাঁর লীলা তিনিই বুঝবেন।