মৃতের কথোপকথন/মিরাবো, দান্তন, রোব্‌সপীয়ের—নেপোলিয়ন

মিরাবো, দান্তন, রোবস‍্পিয়ের—

নেপোলিয়ন

মিরাবো

 যুগান্তরের মাথা এই এখানে। মহাবিপ্লবের প্রথম ঢেউ তুলে দিয়েছে এই কণ্ঠের বাণী। অন্যায়ের অত্যাচারের পীড়ন একটা জাতিকে যখন শুধু শরীরে নয়, মনে প্রাণেও দান হীন ক’রে ফেলেছে, একটা অর্দ্ধস্ফুট ক্ষোভে ও রোষে মানুষ যখন ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে অথচ প্রতীকারের পন্থা দেখ‍্ছে না বা দেখেও সাহস ক’রে সে পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না, তখনই এই অগ্রণীপুরুষ নির্ভয়ে তার বুক এগিয়ে দিয়েছে শত্রুর সঙ্গীনের সম্মুখে, সকলের প্রাণের কথা মন্ত্রের মত উচ্চারণ করেছে—দেশের কর্ত্তা কোন ব্যক্তি নয়, কোন শ্রেণী নয়, দেশের কর্ত্তা দেশ নিজে। এই মুখের এক ফুৎকারে সব সম্মোহন উড়ে গিয়েছে—শতাব্দির পর শতাব্দি ধ’রে যে পাষাণের চাপ দেশের বুকের উপর ক্রমাগতই স্তূপীকৃত হ’য়ে চলেছিল, এই মাথার কেশরের এক দোলনে সব ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে, এই গলার এক হাঁকে কোথা হ’তে মুক্তির প্লাবন ছুটে বেরিয়েছে।

দান্তন

 সে প্লাবন বিপুল মূর্ত্তিমান করে তুলেছে এই দাস্তন। দেশকে সাহস তুমি দিয়েছ, মিরাবো, কিন্তু আমি দিয়েছি দুঃসাহস। জিনিষ সুরু করা খুব কঠিন নয়, কিন্তু কঠিন হচ্ছে তাকে বাড়িয়ে চালিয়ে নেওয়া। পাহাড়ের শিখর থেকে একটা পতনোন্মুখ প্রস্তরস্তূপ হয়ত একটি মাত্র পদাঘাতে নাড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু সেই পাথর অদম্যবেগে সব ভেঙ্গে চুরে ক্রমেই নাম্‌তে থাকে যখন তখন তার সাথে সমান তালে চলা, তাকে আরও জোরে ঠেলে দেওয়া যে সে শক্তির কাজ নয়। দৈত্যকে ডেকে আনা বরং সহজ কিন্তু ডেকে এনে নিত্য তার কাজের খোরাক জোগান, তার ঘাড়ে চেপে আর একটা দৈতাই হয়ে উঠা— এজন্য চাই অমানুষী তেজ একটা অলৌকিক সামর্থ্য। তুমি সৃষ্টিকর্ত্তা হ’তে পার, মিরাবো, কিন্তু তোমার সৃষ্টি তোমার চেয়ে বড়, তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে। নিজের কাজের দিকে তুমি নিজে মুখ তুলে তাকাতে পার নি। যে শক্তিকে তুমি জাগিয়েছিলে, তার সব অর্থ তুমি বোঝ নি, তার কাজ শেষ হওয়া ত দূরের কথা, একটু এগিয়ে যেতে না যেতেই তুমি তাকে তোমার অহঙ্কারের সীমা দিয়ে বেঁধে দিতে চেয়েছিলে। জনসঙ্ঘের, দেশের নেতা তুমি হ’তে চেয়েছিলে কিন্তু দূরে থেকে, নিজের আভিজাত্যের দেমাক সম্পূর্ণ অটুট রেখে! দুই কূল কখন রাখা যায় না। সত্যের বন্যায় মিথ্যার বাঁধ তুমি দিতে চেয়েছিলে, পার নি!

মিরাবো

 আমি ধ্বংসকে চেয়েছিলেম, কিন্তু গড়নের জন্যে। ভাঙ্গার পথ আমি দেখিয়ে দিয়েছিলেম, কিন্তু সেই সাথে গড়ার প্রণালীও দিতে চেয়েছিলেম। অদম্য প্রাণের আবেগ, হৃদয়ের অন্ধ আকুলতার পিছনে যদি না থাকে স্থির মস্তিষ্ক, নির্ম্মল দৃষ্টি তবে সব পরিশ্রম সব আকাঙ্ক্ষাই ধোঁয়ায় পর্যবসিত হয়। অতীতের ধারা দেখে বর্ত্তমানকে নিয়ন্ত্রিত কর‍্তে হবে, তার উপরই ভবিষ্যৎকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনের একটা খেয়ালের উপর গড়া, সে ত হাওয়ার উপর গড়‍্তে চেষ্টা করা। অতীতের চেহারা যতই কুশ্রী হোক্ না কেন, তার ভিতর দিয়েই যে একটা সমবেত জীবন-প্রতিভা ফুটে উঠেছে, তাই ক্রোধে আত্মহারা হয়ে আমি তাকে কেটে ছেঁটে ফেলতে চাই নি—তার সত্যটিকে ধ’রে বর্ত্ত মানে একটা সজীব রূপ দিয়ে এক মহিমান্বিত ভবিষ্যতের সাথে ফরাসী জাতিকে নিবিড় সামঞ্জস্যের সূত্রে আমি বেঁধে দিতে চেয়েছিলেম। কিন্তু দেশের শিকড় ধরে তুমি টান দিলে। গোড়ার মাটি সব খুঁড়ে তুলে ছড়িয়ে দিলে। অজ্ঞানের, অধৈর্য্যের, আক্রোশের, অন্ধকারের যত সব বিকট বীভৎস শক্তি তাদেকে তুমি একেবারে তলা থেকে ডেকে জাগিয়ে তুল‍্লে। ভূতের তাণ্ডবনৃত্যে আমি যোগ দিতে চাই নি।

দান্তন

 যেমন ব্যাধি তার চাই তেমনি প্রতীকার। যা পুরাতন জীর্ণ দুঃস্থ বিষাক্ত, তাকে শোধরানের চেষ্টা মুর্খতা। পুরাতন বলেই তা রোগের কারণ। সব ভেঙ্গে চুরে ধূলিসাৎ ক’রে দেওয়াই তখন দরকার ছিল—শুধু তাই নয়, সম্ভব হ’লে সারা ফরাসীদেশের দশহাত মাটি খুঁড়ে আটলাণ্টিকের জলে ফেলে দেওয়াই ছিল তখনকার কাজ। দেশের তলা ধ’রে আমি টান দিয়েছি—তাই যে আমার গর্ব্ব। জাতির প্রাণ-শক্তি যেখানে, সেখানকার মুখ আমি খুলে দিয়েছি—চাই যে আগে প্রাণের জীবনের পরিচয়, বুদ্ধির আলো সজীব প্রাণেই শোভা পায়। গড়নের কথা আমি যে জান‍্তেম না, তা নয়। কিন্তু তোমার মত জোড়াতালি দিতে আমি চাই নি। আমি চেয়েছিলেম একেবারে নূতন ক’রে পাকা বনিয়াদ। দেশের প্রাণ যে তাই চেয়েছিল— ইচ্ছা কর‍্লেই বা তাকে কে ঠেকিয়ে রাখ‍্বে? ঝঞ্ঝার সম্মুখে দাঁড় করাতে চাও তৃণগুচ্ছ? কে হুকুম দেবে, সে এখানে এইটুকু ভাঙবে, ওখানে ঐটুকু বাঁচাবে, এ পাশ দিয়ে ঘুরে ওপাশ দিয়ে যাবে? মহাবিপ্লবের তোড় চলে আপন পথে, আপন নিয়মে।

রোব‍্সপিয়ের

 সে নিয়ম কাজ করেছে এই হাত দিয়ে। প্রলয়ের প্রাণমূর্ত্তি ছিলে তুমি দান্তন, স্বীকার করি। কিন্তু তোমার সে প্রাণও এক জায়গায় গিয়ে ইতস্ততঃ কর‍্ছিল, ফিরে আস‍্তে চাচ্ছিল। তাই আমায় এগিয়ে দাঁড়াতে হ’ল —নির্ম্মম অকুণ্ঠ অচঞ্চল উদ্যত-দণ্ডের মত। দান্তন নিজেও যখন বলতে আরম্ভ করলে, “আর না, এই পর্য্যন্ত”— তখন দেশের শক্তি গিলটিনের করাল কৃপাণ-মূর্ত্তি নিয়ে আমারই মধ্যে পূর্ণভাবে আবির্ভূত হ’ল। সে রুদ্রশক্তি বড় ছোট মানে না, দান্তন—তাই অক্লেশে তোমাকে পর্য্যন্ত সরিয়ে দিলে। যা কর‍্তে হবে তা আধখানা করে রাখা উচিত নয়, তাকে শেষই করতে হবে, সে জন্যে যতদূর যাওয়া দরকার যেতেই হবে। আদর্শের চাই চরম সিদ্ধি —কঠিন ভীষণ ব’লে মাঝ-পথে যে রফার মিটমাটের জন্যে উদ্গ্রীব হয়, সে সাধক ভ্রষ্ট, পতিত, আদর্শের শত্রু।

দান্তন

 হাত যখন হাতের পিছনে যে শক্তি আছে তাকে ছাড়িয়ে যায়, যন্ত্র যখন যন্ত্রীর কর্ত্তা হ’য়ে তাকে চালাতে চায়, তখন যে কি ফল দাঁড়ায় তার মূর্ত্তিমান নিদর্শন, তুমি রোব‍্সপিয়ের। দান্তন কোনদিন ইতস্ততঃ করে নি, ফিরে আস‍্তে চায় নি। আমি আদর্শকেই চেয়েছিলেম, কিন্তু তুমি আদর্শের জায়গায় উপায়কেই সর্ব্বেসবা ক’রে তুল্‌তে চেয়েছিলে। লক্ষ্য অটুট চাই, কিন্তু তার জন্যে ব্যবস্থা সময়ের প্রয়োজনের সাথে পরিবর্ত্তনীয়। তুমিই লক্ষ্যকে ভুলে, একটা বিধানকেই চরম ক’রে নিয়েছিলে। তোমার জড় যন্ত্রে যখন দান্তনের প্রাণের স্পন্দন আর খেল্‌লো না, তখনই তা ভেঙ্গে পড়‍্লো। আমার পরে তুমি কতদিন টিঁকে থাক্‌তে পেরেছিলে?

মিরাবো

 হাতের পিছনে প্রাণ, কিন্তু প্রাণেরও পিছনে মাথা। রোব্সপীয়ের ত তোমারই অব্যর্থ পরিণতি, দান্তন—তাকে দোষ দাও কেন? দেশ যেদিন মিরাবোর পথে না চ’লে, চলেছে দান্তনের পথে, প্রাণশক্তি যেদিন মস্তিষ্কের নির্দ্দেশ ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে—সে দিনই আমি দিব্য চক্ষে দেখেছি কি দুর্দ্দশা ফরাসী দেশের ভাগ্যে লেখা রয়েছে। তাই আমি আগে হ’তেই বিদায় নিয়েছি।

দান্তন

 দেশের মাথায় নূতন জীবনীশক্তির দরকার ছিল, তাই সেখানে আমি কঠিন অস্ত্র প্রয়োগ করেছি। তোমার পথে না চ’লে, আমার পথে চ’লে ফরাসীদেশ যে নূতন সত্যে দীক্ষিত হয়েছে, তা ভুল নয়—তার প্রমাণ চেয়ে দেখ বর্ত্তমানে।

রোব‍্সপিয়ের

 বর্ত্তমান বর্ত্তমান হ’ত না, যদি দান্তন বা মিরা বোর মত রোব‍্সপিয়েরও হাত গুটিয়ে নিতে চাইত।

নেপোলিয়ন

 তোমরা সকলেই উপকরণ জোগাড় করে দিয়েছ, তা থেকে একটা নূতন শিক্ষা দীক্ষার, একটা নূতন জীবনের বিপুল সৌধ গ’ড়ে তোলবার জন্যে দরকার হয়েছিল একজন মহাশিল্পী। তোমাদের সমবেত সাধনা সিদ্ধি লাভ করেছে, তোমাদের মহা প্রয়াস পূর্ণ মূর্ত্ত সার্থক হয়েছে এই নেপোলিয়নে।