মৃতের কথোপকথন/দীনশাহ্, পরীজাদ
১৪
দীনশাহ্, পরীজাদ
(১)
দীনশাহ্
পরীজাদ, কি মনোহর আমাদের এই মাজিন্দেরান শহর। ইরাণেও তরুছায়া এমন শীতল এমন মধুর ছিল না। দেখ, কি শান্তির ধারা বক্ষে নিয়ে নদীটি চলেছে। কূলে কূলে তার বাগিচা। বাগিচায় বাগিচায় প্রস্ফুটিত ফুলের গালিচা। সে ফুলে কত সৌন্দর্য কত সুরভি। গাছে গাছে পাখীর গান কি কলরোল তুলে দিয়েছে, আকাশে বাতাসে কি অপার্থিব আনন্দের উল্লাস মেখে দিয়েছে। তাদের পালক কত রকমারি, তাদের সঙই বা কত বিচিত্র—সে মধুর সে উজ্জ্বল ছবি দেখে দেখেই প্রাণ ভরে যায়—তাদের নামধাম জানবার কৌতুহল আর কিছু থাকে না। এখানে এই দু’ হাজার বছর ধরে আমরা দেবতার ভোগ ভোগ করে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি না ইরাণের স্মৃতি আমার মনে জেগে উঠ্ছে। আবার যেন দেখতে ইচ্ছা হচ্চে, জিহুন যেখানে তার জলধারা নিয়ে বয়ে চল্ত, যাযাবর তাতারী যেখানে তাদের তাঁবু নিয়ে ঘুরে বেড়াত, দামাস্কনগর যেখানে তার বিপুল ঐশ্বর্য্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের নিজেদের সেই শহর যেখানে আমাদের পিতা পিতৃপুরুষদের বাড়ী দুটি পাশাপাশি হয়ে ছিল, সেই যে বাড়ী দুটির বারান্দা থেকে ঝুঁকে আমরা দুজন দুজনার পানে চেয়ে পরম গোপনে কথাবার্ত্তা কইতাম।
পরীজাদ
আমাদের পুরাণো আবাসে ফিরে যেতে আমারও কোন অনিচ্ছা নেই। তাই বলে মাজিন্ দেরান শহরে আমি যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি তা নয়। আমারও প্রাণের ভিতরে কে যেন আবার চাচ্ছে পৃথিবীর নশ্বর আনন্দ, সেই ক্ষণিকে-পাওয়া ক্ষণিকে-হারানো অথচ তীব্র পূর্ণ তৃপ্তি। তবে এক কথা, দীনশা, দুটি হাজার বছর কেটে গিয়েছে, যাওয়ার আগে এখন একবার কি দেখা উচিত নয়, আমাদের সে সাধের জায়গা সব কেমনতর মূর্ত্তি নিয়েছে? সেখানে এসেছে আর এক ধরণের মানুষ, আর এক ধরণের ভাষা, আর এক ধরণের আদবকায়দা। তাদের মধ্যে আমরা হয়ত বিদেশীর মত গিয়ে পড়বো, আমাদের হয়ত সেখানে খাপ খাবে না।
দীনশা
আচ্ছা, আমি তবে গিয়ে দেখে আসছি। ততক্ষণ তুমি অপেক্ষা করো, পরীজাদ।
(২)
দীনশাহ্
পরীজাদ, পরীজাদ! পৃথিবীতে আর গিয়ে কাজ নাই। এস. মাজিন্দেরান শহরেই আমরা চিরকাল থেকে যাব। পৃথিবী দেখে এলেম, সব বদলে গিয়েছে। তুমি ত ঠিক ঠিকই বলেছিলে, পরীজাদ।
পরীজাদ
কি দেখলে, কি শুনলে, দীনশা?
দীনশাহ্
দেখলেম, এক শ্রীহারা পৃথিবী। ঘর বাড়ী সবে রূপ নেই, গড়ন নেই, শৃঙ্খলা নেই—কুৎসিত রুচির পরিচয় দিচ্ছে তারা, একটা অসম্ভব বাহ্য আড়ম্বরের ভারে মানুষের সৃষ্টি পীড়িত। ইঁটের স্তূপের পর ইঁটের স্তূপ কেবলই চলেছে, কোথাও এতটুকু সবুজের ফাঁক নাই—এই হ’ল মানুষের শহর। একটা বিকট চীৎকার কেবলই সেখান থেকে উঠ্ছে, দেখা যাচ্ছে আগুনের হল্কা, শোনা যাচ্ছে হাতুড়ীর শব্দ, কালো ময়লা ধোঁয়ার রাশি সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছে! বাগ-বাগিচা সব কোথায় শুকিয়ে মরে গেছে। মানুষের মুখ নিরানন্দ, চলন কুৎসিত—পোষাক পরিচ্ছদ তাদের আরও বীভৎস। এ যে অসভ্যের দেশ। পাতাল থেকে যেন ভূত প্রেত দৈত্য দানা সব উঠে এসে দিনের আলো দখল ক’রে বসেছে।
পরীজাদ
বড় দুঃখের কথা, দীনশা। আমাদের তবে যেতেই হবে। সেইজন্যেই ত আমাদের প্রাণে ডাক এসেছে।
দীনশাহ্
তা মানি। কিন্তু এই কদর্য্যতাকে চেয়ে ত আমাদের প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে নি। আমরা যে চেয়ে ছিলেম ইরাণের মিনার, ইরাণের বাগান।
পরীজাদ
দীনশা, কে জানে, আমাদের ডাক পড়েছে হয়ত পৃথিবীকে আবার আগের মত ক’রে তৈরী করতে, গানে আনন্দে সৌন্দর্যে ভ’রে দিতে। নয় কি? আমরা যদি সেখানে যাই, তবে তাকে আমাদের মনের মতনটি ক’রে গড়বই ত।
দীনশাহ্
তুমি ঠিকই বলেছ, পরীজাদ। তোমার কথা কখন ভুল মিথ্যা হয় না। এস তবে, আমরা রওনা হই।
সমাপ্ত।