মৃতের কথোপকথন/ বুদ্ধ, লাও-ৎস, কং-ফুৎস

১৩

বুদ্ধ, লাও-ৎস, কং-ফুৎস[]

বুদ্ধ

 তিক্ত, তিক্ত জীবন-মদিরা!

লাও-ৎস

 মধুর, মধুর জীবনের সুধা!

কং-ফুৎস

 তিক্তও নয়, মধুরও নয়—জীবনের রস শুধু অম্ল।

বুদ্ধ

 আমি স্পষ্ট দেখছি তিক্ত, নিঃসন্দেহে তিক্ত। জীবনটা কি? মূর্ত্ত দুঃখ। রোগ, জরা, মৃত্যু— এই ত জীবনের পরিণাম। আর জীবনের চির-সাথী কি? শোক তাপ—লোভ মোহ-হিংসা-দ্বেষ—অন্যায় অত্যাচার—প্রলয় মহামারী। দুঃখের ভূত প্রেত পৃথিবীর বুক জুড়ে চ’রে বেড়াচ্ছে, মানুষ তাদের আহার। এদের কোন প্রতীকার নাই, এদের হাত থেকে পরিত্রাণ নাই—জীবনকে

মানুষ যদি আঁকড়ে ধ’রে থাকে। মুক্তি অর্থ—জীবন হ’তে মুক্তি। তৃষ্ণা, জীবনের তৃষ্ণাই সকল দুঃখের গোড়া। সুতরাং এই তৃষ্ণার নিরাকরণই মানুষের পরম শ্রেয়। আমি তাই শিক্ষা দিয়েছি, আমার সমস্ত সাধনাই এই, জীবন হতে কি ক'রে অবসর গ্রহণ করা যায়, জীবনের স্রোতে যে ভেসে চলেছি তা থেকে কি ক'রে উদ্ধার পাওয়া যায়, জীবনের স্রোতকে কি ক'রে বন্ধ করা যায়। জীবনের নির্ব্বাণই পরি-নির্ব্বাণ।

কং-ফুৎস

 একটা দিক তুমি অত্যন্ত বড় ক'রে দেখছ, সিদ্ধার্থ, তাই সৃষ্টি তোমার কাছে এমন বিভীষিকা। জীবনে দুঃখ আছে—তুমি যত দৈত্যদানার নাম করলে সবই আছে—তাই বলে’ জীবনটা যে ব্যর্থ, তাকে উড়িয়ে দেওয়াই যে পরম পুরুষার্থ, এমন আমি স্বীকার করি না। অভাব অভিযোগ বেদনা যন্ত্রণা আছে, কিন্তু তাদের উপর কর্তৃত্ব করবার শক্তিও মানুষের আছে। প্রকৃতির উৎপাত আছে, কিন্তু তাতে মানুষজাতি লয় পায় নি। সমাজের অত্যাচার আছে, মানুষ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, দাঁড়িয়েছে ও। ব্যক্তির মধ্যে রিপুর লীলা আছে, তাকেও সংযত করা যায়, অন্ততঃ তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। সতা বটে, রোগ জরা মৃত্যুর উপর মানুষের হাত নাই, কিন্তু এই তিনটিই ত জীবনের সব কথা নয়। মানুষের রোগ আছে; স্বাস্থ্য কি মোটেও নাই? জরা আছে; যৌবন নাই? মৃত্যু আছে; প্রাণের উচ্ছাস নাই? জীবন ভাল-মন্দ নিয়ে— ভালকে গ্রহণ কর, মন্দের সাথে যুদ্ধ করতে করতে চল, মানুষের তাতেই মনুষ্যত্ব।

লাও-ৎস

 ঠিক কথা—জীবন একটানা সুর নয়। বিচিত্র, বিরোধী গতির ভিতর দিয়ে তা ছন্দায়িত হয়ে উঠেছে। জীবনকে যখন দেখি কেটে কেটে, তখনই একটা অংশের দিকে সমস্ত নজর দিয়ে বলি এখানে রয়েছে সুখ, আবার আর একটা অংশের দিকে সেই রকমই নজর দিয়ে বলি ওখানে রয়েছে দুঃখ—এখানে ভাল, আর ওখানে মন্দ। এর পরের ধাপ হচ্ছে সুখকে, ভালকে না দেখা বা ভুলে যাওয়া—দুঃখকে মন্দকে একছত্র রাজা ক'রে তোলা। কিন্তু জীবনকে ওভাবে দেখা সত্যকার দেখা নয়। দেখ গোটা জীবনকে যুগপৎ, সৃষ্টিকে দেখ ভিতরের অখণ্ড দৃষ্টিতে—দেখবে সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দের দ্বন্দ্ব ঘুচে গেছে, দেখবে দুই রকম গতির ছন্দ কিন্তু উভয়ত্রই রয়েছে আনন্দের আবেগ। “সৃষ্টি আনন্দ হইতে উদ্ভুত, আনন্দের মধ্যেই ঘুরিয়া ফিরিয়া চলিয়াছে, আনন্দের মধ্যেই যাইয়া মিশিয়াছে।”

বুদ্ধ

সত্যকে বাস্তবকে তুমি খালি চোখে মুখে মুখি দেখতে চাও না, জীবনকে তুমি দেখছ কল্পনার রঙিন কাঁচের ভিতর দিয়া, তাই এখানে তোমার মনে হচ্ছে সবই সুন্দর, সবই আনন্দ! রোগটা, জরাটা, মৃত্যুটা কি বড় সুন্দর, খুব আনন্দের জিনিষ? যার রোগ হয়েছে তাকে জিজ্ঞাসা কর। জরায় যে জীর্ণ তাকে জিজ্ঞাসা কর। মৃত্যু-শয্যায় যে প'ড়ে তাকে জিজ্ঞাসা কর। ভুক্তভোগী কি বলে জান? কবির খোস খেয়াল সত্যের পরিচয় দিতে পারে না।

লাও-ৎস

 ভুক্তভোগীর নিরানন্দের খেয়ালও সত্যের পরিচয় দিতে পারে না—ভুক্তভোগীর অনুভূতি ও খেয়াল, তবে সেটা তামসিক খেয়াল। বরং কবির খোস-খেয়ালই সত্যের কাছে কাছে গিয়েছে। ফুল ফোটে, শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে তাতে দুঃখের কি আছে? ফুল ঝরে নতুন জীবের এক যায়, আর আসে, যে যায় সৃষ্টির জন্য, আবার নতুন ফুল ফোটানোর জন্য। সেই ঘুরে আসে। এই যে অবিচ্ছিন্নগতি, এই যে অনন্তযাত্রা—এরই নাম “তা’ও”, পথ—আনন্দের চির প্রবাহী ধারা, এরই বুকে বুকে আমরা উঠছি, ফুট্ছি, ডুবছি, আবার উঠছি। এই মহাপথে জন্মের যে তীব্র আনন্দ তারই নাম বেদনা, অসহ্য যে সুখ তারই নাম দুঃখ।

কং-ফুৎস

 এখানে আমি সিদ্ধার্থের পক্ষপাতী। জীবনের সবই আনন্দময় কথাটা অতিশয়োক্তি। যে দুঃখ পায়, তাকে যদি বলা হয় ওটা দুঃখ নয় সুখের আতিশয্য, তাতে দুঃখীর দুঃখ কিছুমাত্র লাঘব হয় না—এমন চমৎকার ব্যঙ্গটি উপলব্ধি করার মতও অবস্থা বোধ হয় তার থাকে না। দুঃখ আছে, খুবই দুঃখ আছে জীবনে। জীবন তা হলে জীবন হত না। কিন্তু তাই বলে সিদ্ধার্থের মত আবার জীবনটাকে ছেড়ে যাবই বা কোথায়? মানুষের সকল ধর্ম্ম সকল কর্ম্ম এই জীবন নিয়ে। দুঃখ ত আছে, জীবনের স্বরূপই এই—কিন্তু মুহ্যমান হব না, সহ্য করব, কঠোর হয়ে কর্ত্তব্যের পথে চলব। এই ত মানুষের কথা। জীবনের পথ কণ্টকাকীর্ণ কিন্তু আমার আছে অন্তরের শক্তি, মনের বল।

লাও-ৎস

 এই অন্তরের শক্তিটা কি, মনের বলই বা কি? কোন অনুভূতির প্রসাদে জীবনের বাধা আর বাধা বলে বোধ হবে না? আমি বলি চোখের দেখা নয়—চোখ দেখে কেটে কেটে, এককালে একটি জিনিষ আর সে জিনিষটার স্থূল নিরেট রূপ—কিন্তু মানুষ তার চোখের চেয়ে ঢের বড়। তার ভিতরে আছে এমন একটা চেতনা যেখানে জেগে উঠ‍্তে পারলে, ক্ষুদ্র চোখের দেখা সবই তার বদলে যায়। এই বৃহৎ চেতনাই মানুষের সত্যিকার বৃহৎ সত্তা আর তা আনন্দময়। ক্ষুদ্র দৃষ্টি দিয়ে মানুষ যখন দেখে তখনই তার কাছে বোধ হয় যেন আছে শোক তাপ দুঃখ অকল্যাণ আধিব্যাধি প্রভৃতি। কিন্তু এটা আসল সুস্থ দৃষ্টি নয়——এটা ভুল দৃষ্টি, বিকারের দৃষ্টি।

বুদ্ধ

 আমিও ত তাই বলি জীবনটা সৃষ্টিটা হচ্ছে আপেক্ষিক সত্য। সমস্ত জীবন ধারাটাই তৈরী হয়েছে, তুমি যাকে বলছ ক্ষুদ্র দৃষ্টি তাই দিয়ে! ক্ষুদ্র দৃষ্টিটা ভেঙ্গে ফেল, জীবনও ভেঙ্গে যাবে, সকল দুঃখের অবসান হবে! এই ভাঙ্গা, এই অবসানই মানুষের চরম লক্ষ্য। সেটা আনন্দময় কি না, সে প্রশ্ন নিরর্থক। যদি কোন সত্তাই না থাকে, তাতে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নাই! আমি বুঝি জীবনের শেষ যেখানে, সেখানে আর কিছু না থাকুক সেটাই হচ্ছে শান্তি; মানুষের পক্ষে তাই দরকারী সত্য।

লাও-ৎস

 জীবনের শেষ নয়, জীবনের সমগ্রতা যেখানে সেইখানেই পূর্ণ সত্য। শান্তিও যদি পেতে চাও, তবে জীবনের বাইরে চলে যাবার কোন প্রয়োজন নাই! চোখের দৃষ্টিটা ক্ষুদ্র বলে, চোখটা নষ্ট করবার সার্থকতা কিছু নাই, স্থূল চোখের পেছনে জাগাও তোমার তৃতীয় নেত্র, তবেই এই ক্ষুদ্র স্থূল চোখেই জগৎজীবন রূপান্তরিত হয়ে ফুটে উঠেছে দেখবে। দেখবে প্রতি খণ্ডে পূর্ণ সমগ্র, প্রতি মুহূর্ত্তে সমস্ত অনন্ত।

কং-ফুৎস

 জীবনের শেষ কোথায় জানি না, খণ্ড-মানুষ জীবনটাকে অখণ্ডভাবে কি রকমে ধর‍্বে তাও বুঝি না। মানুষ মানুষ, তার দোষেগুণে ষে মানুষত্ব তাই নিয়ে। তার মানুষত্ব লোপ করে দিয়ে কোথায় কি হবে সে বৃথা তর্ক করবার ঔৎসুক্য আমার নাই। মানুষকে আকাশকুসুম দেখিয়ে কি হবে? দেখিয়ে দাও, তার মানুষত্ব নিয়ে, তার দৈনন্দিন জীবনকে নিয়ে সে কি করবে! পৃথিবীতে তার যে নির্দ্দিষ্ট স্থান কাল সেখানে থেকে তার কি কর্ত্তব্য। তোমরা যে ভাবে নিয়ে মানুষকে বিচার করছ, তাতে মনে হয়, যেন মানুষ হাওয়ার জীব, নিজের মধ্যে নিজে সম্পূর্ণ, একলা একলাই সার্থক। কিন্তু তাত নয়। মানুষ পাঁচজনকে নিয়ে—তার সার্থকতা সমাজের সার্থকতার সাথে অনেকখানি মিশে আছে। আর এই সমস্যাই হচ্ছে সব চেয়ে দরকারী সমস্যা—কারণ তা হচ্ছে বর্ত্তমানের সমস্যা। আজকার কি সংস্থান সে সম্বন্ধে কিছু উচ্চবাচ্য না করে, তোমরা মাথা ঘামাচ্ছ ভবিষ্যতে কি হবে তাই নিয়ে। আমার সে অবসর নাই—আজ, এই মুহূর্ত্তে মানুষের যে অব্যবহিত প্রয়োজন তারই মীমাংসা আমি যদি দিতে পারি, তবেই নিজেকে সফলকাম মনে করব।

বুদ্ধ

 মানুষ যদি তাতেই সুখী হত, তবে আমিও বোধ হয় তোমারই পথে চল্‌তাম। কিন্তু তাত নয়। মানুষ সমাজের মানুষ হলেও কেবলই সেটাকে বন্ধন বলে মনে করছে না, সেটাকে ছাড়িয়ে যেতে চাচ্ছে না? মানুষ চায় যে এমন ব্যবস্থা, এমন একটা মীমাংসা যা শুধু এখনকার নয়, চিরকালের—দেহের মনের প্রাণের সমাজের পরিবারের সকল দাবিদাওয়া মিটিয়েও তার যে একটা প্রশ্ন সর্ব্বদাই জেগে থাকে—ততঃ কিম্‌!

লাও-ৎস

 জগতের জীবনের কোন সম্বন্ধই বন্ধনের নয়, যদি সকল সম্বন্ধের মধ্যে রয়েছে যে বৃহত্তর সম্বন্ধ যে সম্বন্ধাতীত সম্বন্ধ তার খোঁজ পাই। জীবনের একান্ত ভিতরেও নয়, আবার একান্ত বাইরেও নয়, মানুষের সমস্যা এ দুটির মধ্যে যুগপৎ লীলা খেলা।


  1. কং-ফুৎস অর্থাৎ ইংরাজীতে (অর্থাৎ লাতিনে।) যাঁহার নাম Confucius ( কন্-ফুসিয়স্‌)। কং-ফুৎস বিশেষভাবে ছিলেন উত্তর চীনের ধর্ম্মগুরু্যু—তাঁহার ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠিত নীতি, সদাচারের উপর; তিনি আমাদের দেশের ধর্ম্মশাস্ত্রকার অর্থাৎ সামাজিক ব্যবস্থা প্রণেতাদের সহিত তুলনীয়। লাও-ৎস ছিলেন বিশেষভাবে দক্ষিণ চীনের ধর্ম্মগুরু—ইঁহার ধর্ম্ম, ইঁহার সিদ্ধান্ত ও সাধনায় আমাদের ঋষিদের বেদান্তবাদ, প্রধানতঃ ঊপনিষদের আনন্দ-ব্রহ্মবাদের ছায়া অনেকখানি পাই। কং-ফুস, লাও-ৎস ও বুদ্ধ প্রায় সমসাময়িক। চীনদেশে একটি কিংবদন্তীতে আছে যে একই ভাণ্ডের মদ্য আস্বাদন করিয়া তিন জনে তিন মত দিয়াছিলেন—বর্তমান কথোপকথনের আরম্ভে তাহাই দেওয়া হইয়াছে। এ সম্বন্ধে একটি বিখ্যাত পুরাতন জাপানী চিত্রও আছে।—লেখক