মৃতের কথোপকথন/স্ত্রী, পুরুষ
স্ত্রী, পুরুষ
স্ত্রী
তুমি আমায় চেয়েছিলে, এই এসেছি তাই। চল তবে, সে অনাস্বাদিত আনন্দ পৃথিবীতে গিয়ে আমরা ভোগ করি। এবার আমাদের অনুমতি হ’য়েছে।
পুরুষ
আমি তোমায় চেয়েছিলাম! কই, কিছুই ত আমার মনে পড়ে না! তোমার মতন কা’কেও যে দেখেছি কখন তা’ও স্মরণে আসছে না। তুমি ভুল করেছ নিশ্চয়ই।
স্ত্রী
কিন্তু ভুল ত এ জগতে হয় না। আচ্ছা, মানস-চক্ষে একবার দেখ ত। ঐ খরস্রোতা ত্রিস্রোতা ছুটে চলেছে—ভরা বর্ষা, থৈ থৈ ঢেউ। গোধূলির আকাশে কাল মেঘ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর পাড় দিয়ে পায়ে-চলা পথে যুবক এক দ্রুতপদে চলেছে—মুখে তার কি একটা চিন্তা-কুলতা, দৃষ্টিতে কি একটা উদাস আবেগ। চলতে চলতে হঠাৎ সে থম্কে দাঁড়াল, এক নিমেষের জন্য বোধ হয়—এক নিমেষের জন্য শুধু তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল, ঐ যে অর্দ্ধাবৃতা যুবর্তী ঘাটের উপরে আনমনে বসেছিল তারই উপরে। এক নিমেষেরই জন্যে উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হ’ল, তারপর যুবতীও মুখ ফিরিয়ে নিল, যুবকও আপন পথে চলে গেল। বল ত সে যুবক কে, সে যুবতীই বা কে?
পুরুষ
তুমি, আমি? তোমার কথার সুরে কি একটা স্বপ্নের মত জিনিষ যেন আমার প্রাণের কোন গভীর অতল থেকে ভেসে উঠতে চাচ্ছে। হাঁ, এবার মনে পড়ছে। সে একখানা ছবি, আমার খুবই মধুর লেগেছিল। সন্ধ্যার শান্ত-শীতল আলো-ছায়া-মেঘের নীচে দিয়ে কৃষ্ণায়মান জলরাশির ওপারে সূর্য্য ডুবে যাচ্ছে—এপারে নারী এক, স্থির- বিদ্যুৎসন্নিভা, এলায়িত-কুন্তলা, পাশে অনাদৃত শূন্যকুন্ত, যোগিনীর মত অচঞ্চল, এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঐ দূরান্তরে, অনন্তের রহস্যের পানে। সকল ভুলে, এমন একখানি পট এক মুহূর্ত্তে চেয়ে দেখতে কা’র না সাধ হয়?
স্ত্রী
কিন্তু সেই এক মুহূর্তের জন্য তুমি আমায় প্রাণ ভরে চেয়েছিলে, আমিও সেই এক মুহূর্ভের জন্যই তোমায় স্বীকার ক'রে নিয়েছিলাম। সেই এক মুহূর্ত্তেই আমাদের কর্ম্মের বীজ উপ্ত হ’য়েছে। এখন তার ফল সংগ্রহের দিন উপস্থিত, তাই তোমায় ডেকে নিতে আমার উপর আদেশ হ'য়েছে।
পুরুষ
কিন্তু সত্য সত্যই ত আর তোমাকে আমি চাই নাই। একটি নূতন কবিতা, একখানা অভিনব আলেখ্য, এক কলি অশ্রুতপূর্ব্ব গান—দিব্য-শিল্পীর একটি অপরূপ শিল্প-সৃষ্টিতে আমি মুগ্ধ হ’য়েছিলাম, তা’র রসাস্বাদনে উৎসুক হ’য়েছিলাম—এই শুধু! তার বেশীতে আমার লোভও ছিল না, আকাঙ্ক্ষাও ছিল না।
স্ত্রী
তার বেশী দরকারও হয় না। ঐটুকু রসাস্বাদন, সকল সৃষ্টির উৎস। ঐটুকু আনন্দ ভোগই আনন্দ ভোগই অন্তরাত্মার ঐটুকু রসানুভূতিই ডেকে আনে প্রাণের ভোগ। তোমার রসপিপাসু অন্তরাত্মা তোমার প্রাণকেও রসায়িত তৃষ্ণায়িত করে তুলেছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু আমার দিক হ’তে সম্মতি, তাও সে পেয়েছে। তোমার প্রাণের তরঙ্গ আমার প্রাণকে দুলিয়ে দিয়েছে, আমার অন্তরাত্মায় ব’য়ে এনেছে তোমারই অন্তরাত্মা হ’তে একটা মধুমতী ধারা।তোমার জীব-পুরুষের কামনা জেগে উঠে স্পন্দিত ক'রে তুলেছে যে কর্ম্মের সূক্ষ্মগতি, আমার নারীশক্তি তাকে গ্রহণ করে, মুর্ত্তি দিতে চলেছে। যে আনন্দ-শক্তি আমরা দু'জন মিলে অজ্ঞানে হোক্, সজ্ঞানে হোক—উদ্বোধন করেছি, তার পূর্ণ তৃপ্তি চাই, ইচ্ছা করলেও আর ত তাকে আমরা ফিরাতে পারি না।
পুরুষ
কিন্তু যে বিধাতা আজ আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাঁর নির্দেশে আমি চলেছি বিশেষ একটা ব্রত নিয়ে। এবার আমার ভোগের জীবন নয়, আমার কর্ম্মের ক্ষেত্র, আমার ধর্ম্মের ধারা হবে ভিন্ন রকমের। সেখানে নারীর স্থান হবে কিনা সন্দেহ। তাই আমার মনে হয় ক্ষণিকের স্বপ্ন হিসাবেই যে জিনিষের ভোগ হয়ে গেছে, তাকে আর জাগ্রতে ধ'রে ফুটিয়ে তোলবার কোন সার্থকতা নাই।
স্ত্রী
কর্ম্মের গতি অত সহজ ও ঋজু নয়। জীবনের পাটে সহস্র সূত্র ওতপ্রোত ভাবে নানাদিকে নানা ভঙ্গীতে সংমিশ্রিত। তোমার জীবন-বিধাতা তোমায় যে নির্দেশ দিয়েছেন তা’ সত্য হতে পারে; কিন্তু ঐটুকুই যেসব সত্য তা তুমি ধরে নিয়েছ কেন? আমারও জীবন-বিধাতা বলছেন, তোমারই সাথে মিলিয়ে এবার আমার লীলা।
পুরুষ
কিন্তু সে লীলা তোমার সার্থক হবে কি? যে কামনার জন্য তুমি আমায় ডাক্ছ, তার সমস্ত দাবী-দাওয়া আমার ব্রত মিটাতে পারবে কি? তৃপ্তির, স্বস্তির জীবন না হ'য়ে, হয়ত আমাদের হ'য়ে উঠবে অতৃপ্তির ব্যথার জীবন। যে সুখের আশে আমরা চলবো, তা হয়ত দুঃখই নিয়ে আসবে। আমাদের মিলনের বুকে ব্যর্থতাই জেগে উঠবে।
স্ত্রী
মিলনের আনন্দ, মিলনে—সুখে দুঃখে নয়। সুখ দুঃখ, তৃপ্তি অতৃপ্তি, স্বস্তি ব্যথা—এ সবই ছোট জিনিষ, বাইরের ব্যাপার। এই সব দ্বৈতের ভিতর দিয়েই অন্তরের আনন্দ রসাশুভূতি লীলায়িত হয়ে ওঠে। ভিতরের যে সার্থকতা—আমার সার্থকতা, তোমারও সার্থকতা—তার কখন এ সব অন্তরায় হ’তে পারে না। এ সবই হয়ত হবে আয়োজনের উপকরণ।
পুরুষ
কে জানে সৃষ্টির রহস্য কি? কি ভঙ্গীতে, কোন্ পথে চলেছে কর্ম্মের গতি? চল তবে, অজানা শক্তির হাতে আমরা ক্রীড়াপুত্তলিকা মাত্র। সে যখন আমাদের ঠেলে দিচ্ছে, তখন তাকে বাধা দেওয়ার সামর্থ্যও আমাদের নেই, ইচ্ছাও থাকতে পারে না।