মৃতের কথোপকথন/সাবিত্রী, দ্রৌপদী
সাবিত্রী, দ্রৌপদী
সাবিত্রী
নারী একবারই নিজেকে ঢেলে দিতে জানে, দুইবার নয়। নারী এক পুরুষেরই কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে, দুই পুরুষের কাছে নয়। নারীর প্রাণ জন্মে জন্মে একই দেবতার চরণে অখণ্ডভাবে নিবেদিত—সতীর সত্য উচ্ছিষ্ট হবার নয়। তোমার জীবনের রহস্য কি তবে, দ্রৌপদী!
দ্রৌপদী
তোমার জীবনের যে রহস্য, আমার জীবনেরও সেই রহস্য—সকল নারীর, সকল সতীর জীবনেরই সেই রহস্য। আমার জীবন প্রাণও জন্মে জন্মে একজনেরই কাছে সর্ব্বতোভাবে সমর্পিত।
সাবিত্রী
সে কি? পঞ্চপাণ্ডবের কথা তবে কাহিনী মাত্র? কবির কল্পনা তোমাকে নিয়ে ত বড় নিষ্ঠুর, বড় অন্যায় খেলা খেলেছে।
দ্রৌপদী
কাহিনীও নয়, কবি কল্পনাও নয়। আমি পঞ্চপাণ্ডবেরই ছিলাম সহধর্ম্মিণী।
সাবিত্রী
তুমি বল্তে চাও, তুমি ছিলে মিথ্যাচারিণী? গোপনে বরণ করে নিয়েছ একজনকে আর প্রকাশ্যে আত্মবিক্রয় করেছ একজনের—কেবল একজনেরও নয়, আর বহু জনের কাছে? এই তোমার তেজ, তোমার নিষ্ঠা—তোমার নারীত্ব?
কিন্তু জানতে পারি কি, দ্রৌপদী, কে—কে ছিল তোমার প্রাণের দেবতা, তোমার সত্যকার পতি। অর্জুনের সম্বন্ধে কি একটা কথা শুনেছিলাম, তাই তবে সত্য?
দ্রৌপদী
আমার সত্যকার পতি—অর্জুনও নয়, পঞ্চ ভ্রাতার কেউ নয়, সাবিত্রী।
সাবিত্রী
তুমি এই স্বীকার করলে তুমি পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী, আবার বলছ তোমার পতি এঁদের কেউ নয়, আর এক ব্যক্তি। আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে, তোমার, হেঁয়ালী ভেঙ্গে সাদা কথায় বল ত শুনি।
দ্রৌপদী
আমার প্রাণের দেবতা যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ।
মৃতের কথোপকথন
সাবিত্রী
কি বল তুমি? তবুও ত কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আবার পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী হলে কি রকমে?
দ্রৌপদী
সহজ কথা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আমি উৎসর্গীকৃত—তাঁরই নির্দেশ মত আমি চলেছি। তিনি আমাকে যে আদেশ দিয়েছেন অকুণ্ঠিত-চিত্তে আমি সেই আদেশই পালন করেছি।
সাবিত্রী
ভগবান ত সবারই অন্তরে। এক হিসেবে তিনি সবারই পতি—কি পুরুষ, কি নারী। কিন্তু জীবনে যিনি আমার পতি, আমার নারীত্বের যিনি অধিকারী তিনি আমারই মত মানুষ—জীবনের ব্রতে তিনিই আমার জাগ্রত ভগবান;
ভগবানকে যদি পাই তবে তাঁরই মধ্যে, তাঁরই সহায়ে।
দ্রৌপদী
আমার কৃষ্ণও মানুষ, আমার নারীত্বের একমাত্র অধিকারী পুরুষ—তিনিই আমার মানুষী দেবতা।
সাবিত্রী
সে দেতা তবে তোমায় গ্রহণ করলেন না কেন নিজে? এমন ত নয় যে পত্নী হিসেবে তিনি কাউকে গ্রহণ করেন নাই। তা না করে তিনি ঠেলে দিলেন তোমাকে আর পাঁচ জনার কাছে-এ কোন নীতি, কোন ধর্ম্ম?
দ্রৌপদী
সে বিচারের ভার আমি লই নাই। নীতি ধর্ম্ম আমি সব জলাঞ্জলি দিয়েছি তাঁরই আদেশের মধ্যে। ধর্ম্ম যে কি তা আমি জানি, কিন্তু তাতে আমার কোন অনুরাগ নাই; অধর্ম্ম যে কি তাও জানি, তাতেও আবার আমার বিরাগ নাই—আমার হৃদয়স্থিত হৃষীকেশ যে ভাবে আমায় নিযুক্ত করছেন আমি সেই কাজই চলেছি।
সাবিত্রী
তুমি না হয় এই রকমে অব্যাহতি পেলে কিন্তু আমার প্রাণ তাতে সায় দিতে পারছে না। ভগবান ধর্ম্মাধর্ম্মের অতীত হলেও, তিনি অধর্ম্মের প্রশ্রয় দেবেন কেন, নিজেই অধর্ম্মাচারী হবেন কেন? তাঁহাতেই ত পরম ধর্ম্ম—
দ্রৌপদী
সে ধর্ম্ম মানুষের ক্ষুদ্রবুদ্ধির নয়, সে তাঁর নিজের ধর্ম্ম। মানুষের পরিচিত সংস্কারগত অনেক ধর্ম্মকেই তা ব্যাহত করে চলে।
সাবিত্রী
মানুষের সমাজ তা হলে থাকে কি রকমে? সমাজকে উৎসন্ন দেওয়াইত ভগবানের ইচ্ছা নয়। সমাজের মধ্যে যে সব ধর্ম্ম ফুটে উঠেছে, তাতে কি ভগবানেরই নির্দেশ নাই, সে সকলও কি ভগবানের নিজের হাতের গড়া নয়?
দ্রৌপদী
কিন্তু সমাজে কি একটা বিশেষ ধর্ম্ম দেখা দিয়েছে? চেয়ে দেখ, দেশ ভেদে কাল ভেদে কত সমাজে কত রকম ধর্ম্ম ফুটে উঠেছে। তোমার কথাই যদি ঠিক হয়, তবে এ সব গুলিকেই সমান ভাবে স্বীকার করতে হুয়। সাবিত্রী! তুমি নিজের পক্ষে স্বধর্ম্ম বলে যেটা জেনেছ, সেটাকেই শুধু সকলের ধর্ম্ম বলে প্রতিষ্টা করতে চাইছ কেন? পুরুষ নারীর যে একই অকাট্য ধরণের সম্বন্ধ হতে পারে তা ত নয়। সমাজের প্রয়োজনেই এ সম্বন্ধ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিভিন্ন সমাজের প্রয়োজন বিভিন্ন, তাই পুরুষ নারীর সম্বন্ধের রূপও বিভিন্ন। এক পতীত্ব, এক পত্নীত্ব, বহু পতিত্ব, বহু পত্নীত্ব মানুষের সমাজে এ সব রকম ব্যবস্থাই ত রয়েছে।
সাবিত্রী
স্বীকার করি। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে একটা আদৰ্শ আছে—একট। উচ্চতম সত্য আছে। সকল সমাজ সে আদর্শ, সে সত্য ধরতে পারে নি। যে সমাজ পেরেছে সে সমাজ তত উন্নত আর যে পারে নি সে তত অনুন্নত, অপরিণত। যে মানুষ যে নরনারী এই মাদর্শ, এই সত্য জীবনে ফলিয়ে ধরেছে তারাই শ্রেষ্ঠ।
দ্রৌপদী
সত্যই তাই কি? তোমার নিজের ব্যক্তিগত যে সংস্কার, তোমার নিজের সমাজের যে ব্যবস্থা তার উপর ঐকান্তিক শ্রদ্ধাবশত তাকে তুমি সকলের উপর স্থান দিচ্ছ না ত? আদর্শের কথা যদি বল আর এও যদি স্বীকার কর যে আদর্শে আদর্শেও ইতর বিশেষ আছে, তবে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আদর্শ কি ভগবান স্বয়ং নহেন?
সাবিত্রী
কিন্তু স্বয়ং ভগবানকে কে দেখেছে, কে জোর করে বলতে পারে এইটিই তাঁর ব্যবস্থা?
দ্রৌপদী
আমি ভগবানকে দেখেছি, আমি জোর করে বলতে পারি আমি অনুসরণ করেছি তাঁর ব্যবস্থা—একটুখানি মানুষী দৌর্ববল্য আমার মধ্যে দেখা দিয়েছিল হয়ত, আর তার জন্যে আমার নরক দর্শনও হয়েছে।
সাবিত্রী
আমি যখন তা পারি না, আমি যখন দেখেছি আমি মানুষ মাত্র, তখন আমার মানুষী হৃদয়ে যে সত্য যে আদর্শ জ্বলে উঠেছে, তাকেই শ্রেষ্ঠ পদ দিব, তাকেই ভগবানের নির্দেশ বলে অকুণ্ঠিত চিত্তে চলব।
দ্রৌপদী
আমি হয়ত সমাজের মানুষের বাহিরে, সাবিত্রী। আমার পথে তোমাকে কখন চলতে বলি না।