মৃতের কথোপকথন/মাট্সীনি, কাভূর, গারিবাল্দি
২
মাট্সীনি, কাভুর, গারিবাল্দি
মাট্সীনি
আমার বার্তার যে প্রয়োজন ছিল, তার প্রমাণ ইতালির বর্ত্তমান অবস্থা। কাভুরেব পথে মাকিয়াভেল্লির কূট রাজনীতি আবার প্রাণ পেয়েছে, ইতালি অধীর হ’য়ে যত্নের আশুফল আঁকড়ে ধরতে গিয়েছে, তাই আমি যে দিব্যদৃষ্টি তাকে দিয়েছিলেম তা তার মুছে গেছে। তাই তার দুঃখ ঘোচেনি। ফলের জন্য কাজ ত করতেই হবে—কিন্তু আসক্তি যদি তার উপর এত হয় যে সেটাকে তাড়াতাড়ি ধরতে গিয়ে আসল উপায়টি বিসর্জ্জন দিয়ে ফেলি, তবে শেষে আসল লক্ষাটিকেও সেই সাথে বিসর্জ্জন দিতে হয়।
কাভুর
আমার পথ যে নির্ভুল, তার প্রমাণ ইতালির রাষ্ট্র। মাট্সীনি, তুমি এখনও ভাবুকের মত, খেয়ালীর মত কথা বল্ছ। রাষ্ট্রনীতিক আদর্শকে মানেন, কিন্তু খেয়ালের সাথে তাঁর কোন কারবার নেই। তাঁর লক্ষ্য আসল জিনিষটিকে হাত করা, খুঁটিনাটির অনেক তিনি বিসর্জ্জন দিতে পারেন।
মাট্সীনি
তুমি যা বলছ তা সত্য; কিন্তু খুঁটিনাটির ত বিসর্জ্জন দেওয়া হয় নাই, আসলেরই বিসর্জ্জন হয়েছে।
কাভুর
ইতালি এক, ইতালি স্বাধীন:
গারিবাল্দি
মাট্সীনি
ইতালি এক, ইতালি স্বাধীন—দেহে প্রাণে নয়। গারিবাল্দি, ইতালিকে এক ক’রে তুমি একজন মানুষের হাতে তুলে দিয়েছ, দেশের লোককে দাও নি।
গারিবাল্দি
রাজাকে, বীরকে, ইতালির প্রতিনিধিকে আমি দিয়েছি। খারাপ কাজ করেছি বলে আমি তা মনে করি না। দেশ বল্লে, “আমার হয়ে দাঁড়িয়ে ঐ লোক” —আমি দেশের বাণী মাথা পেতে নিলেম।
কাভুর
জীবনের ঐ তোমার শ্রেষ্ঠ কাজ। সব সমস্যা পূরণ হয় নি, জাতির অঙ্গে কোথাও কোথাও এখনও দুঃস্থতা রয়ে গেছে—কিন্তু সে ত স্বাভাবিক। বসে বসে স্বপ্ন যে দেখে সেই চায় এমন সুদীর্ঘ এমন ক্ষয়কর রোগ হ’তে এক মুহূর্ত্তে নিরাময় হয়ে যেতে। আমরা করেছি অস্ত্র প্রয়োগ, এখন ঔষধের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বিনা আড়ম্বরে ক্রমে হচ্ছে। ইতালিতে একজন মানুষের দরকার হয়েছিল, তাকে পেয়ে সে বরণ করে নিয়েছে।
মাট্সীনি
কিন্তু ইতালি তার ব্রত পূর্ণ করতে পারে নাই। তার দিকে তাকালে দুঃখে আমার বুক ভরে যায়। যাকে আমি শিক্ষা দিলেম জগতের নেতা হয়ে চলতে, সে কিনা আজ একটি নগণ্য রাষ্ট্রশক্তি, স্বার্থপর কুটিল টিউটনশক্তিকে ভর করে তবে তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। যার কাজ ছিল মুক্তির যুগের নতুন ভাবের নতুন ছাঁচে শাসনযন্ত্রকে সমাজকে ঢেলে গড়ে তোলা, সে কিনা সবার পিছনে পড়ে রইল, ‘গলে’র সাক্সনে’র পদানুসরণ করতে লাগ্ল। ইউরোপের অভিনব দীক্ষার উৎস যে হ’ত, তাকে শিক্ষায় যারা মানবজাতির অগ্রণী, তাদের মধ্যে ত দেখ্তে পাচ্ছি না। এশিয়াবাসীর মত বর্ব্বর রুশও মানব জাতির জন্যে যা কর্ছে, রোমকের উত্তরাধিকারীরা তাও পারছে না।
কাভুর
রাজনীতিজ্ঞের ধৈর্য্য চাই, প্রত্যেক ধাপ ঠিক করে নিয়ে লক্ষ্যের দিকে ধীরভাবে শান্তভাবে অগ্রসর হতে হবে। মাট্সীনির আদর্শ তখনই কার্য্যে পরিণত হবে যখন ইতালির অর্থকষ্ট দূর হয়ে যাবে, যখন পৌরোহিত্য-ধর্ম্ম উন্নতির পথে আর বাধা দেবে না। ইতালির মস্তিষ্ক, ইতালির তরবারি এখনও ইউরোপকে ধরে চালিয়ে নিতে পারে।
মাট্সীনি
চালবাজ যে, সময়ের ফেরে ফেরে চলে যে, তাকে দিয়ে বৃহৎ সিদ্ধি কখন কিছু হতে পারে না। সময় যার হুকুম মেনে চলে, সুবিধা যে তৈরী করে নেয়, চাই এমনতর বীর হৃদয়, তেজীয়ান মস্তিষ্ক। ইতালিকে আমি বীর-ধর্ম্মে দীক্ষিত কর্তে চেয়েছিলেম। আমি জান্তেম ইউরোপ তৃতীয় বারের জন্য নব জীবন পেতে যাচ্ছে, আর ইতালিই হবে সে কাজের পথ প্রদর্শক। আমি যখন পিতৃপুরুষদের লোক হতে পৃথিবীতে মানবদেহ ধারণ করতে যাব, তখন আমাকে এই কথা বলে পাঠান হয়েছিল “ইতালি দুইবার ইউরোপকে নতুন দীক্ষা দিয়াছে, আর একবার সে দেবে”। আমাদের নেমে আসবার সময়কার বাণী কখন নিষ্ফল হয় না।
কাভুর
তা বটে, কিন্তু ফল যে তৎক্ষণাৎ পাওয়া যায় তা নয়। অনেক পরীক্ষার ভিতর দিয়ে চলতে হয়, আস্তে আস্তে শুদ্ধির আগুনে পুড়ে উঠতে হয়— এমন কি যে জিনিষ অব্যর্থ ভবিতব্য, তাকেও মনে হয় যেন একটা অমূলক স্বপ্ন। সিদ্ধি হবে এই জেনে আমাদের কাজে লেগে যেতে হবে, সে সিদ্ধি বিলম্বিত হলেও অধীর না হয়ে, ক্ষুব্ধ না হয়ে, হতাশ না হয়ে কাজ করেই যেতে হবে সে সিদ্ধি লাভের সময় হয়ত আমাদের উপরই ডাক পড়বে। ইতালিকে আমরা চিরকাল সাহায্য করে এসেছি, আবার একবার সাহায্য করবো।
মাট্সীনি
তা জানি না—কিন্তু এই আনন্দের লোকেও দিনগুলি আমার যেন ভারি হয়ে উঠ্ছে। ডাক যখন আবার আসে তখন যেন আমরা বিজয়ী হই, কূটনীতি দিয়ে নয় কিন্তু সত্যের, সজীব সাহসের জোরে—এই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।
গারিবাল্দি
হাঁ, দর দপ্তর করে নয় কিন্তু বীরের তরবারি সহায়ে—
মাট্সীনি
রাজনীতি দিয়ে নয়, কিন্তু সার্ব্বভৌমিক প্রীতি দিয়ে, মহান্ জ্ঞান দিয়ে।
কাভুর
ইতালির জয় হলেই আমি সন্তুষ্ট।
গারিবাল্দি
ইতালির হাত হতে যে তরবারি আবিসীনীয়াবাসীর আঘাতে বিচ্যুত হয়েছিল, সে তরবারি আবার যখন উত্থিত হবে—তাকে তুলে ধরতে আমি উপস্থিত থাকবো।