মৃতের কথোপকথন/শিবাজী, জয়সিংহ
১
শিবাজী, জয়সিংহ
জয়সিংহ
দুজনার আমাদের কারোই জয় হয় নি। দেশের উপরে তৃতীয় একটা শক্তি এসে পড়ে, তোমার কর্ম্মের ফল আহরণ করেছে—আর আমার কর্ম্ম, তা ত ভেঙ্গে চুরে গেছে; যে আদর্শ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তা এখন ধূলির সাথে মিশে গেছে।
শিবাজী
ফলের জন্য আমি কর্ম্ম করি নি। ব্যর্থতায় তাই আমি স্তম্ভিত নই, হতাশও নই।
জয়সিংহ
আমিও ত নিজের লাভের জন্যে কর্ম্ম করি নি। আমি করেছিলেম রাজপুতের আদর্শকে তুলে ধরতে। ন্যায়যুদ্ধে অটুট সাহস, শত্রুমিত্র নির্ব্বিশেষে মর্য্যাদাদান, রাজা বলে আমি ষাঁকে স্বীকার করে নিয়েছি তাঁর উপর নিষ্ঠা, এই ত ভারতের খাঁটি সনাতন প্রথা। হিন্দু জাতির একত্ব ও প্রভুত্বের যে আদর্শ তার চেয়েও একে আমি বড় মনে করি। তাই তোমার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারি নি; বরং আমার পথ অনুসরণ করতে তোমায় আমি ডেকেছিলাম। কিন্তু যখন দেখ্ লেম তোমার সাথে যে সত্য করা হয়েছিল, আমারও সাথে যে সত্য করা হয়েছিল তা রক্ষা করা হোল না, তখন তোমার পলারনে সাহায্য করে আমি আমার আত্মসম্মানকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেম।
শিবাজী
ভগবান তাঁর অভয় হস্ত আমার উপর প্রসারিত করে দিয়েছিলেন, তাই একটি নারীর হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠলো; সে এসে আমায় ভালবাসা দিলে, সাহায্য দিলে। প্রথার পরিবর্ত্তন হয়। রাজপুতের আদর্শ ভবিষ্যতে কাজে আস্বে, কিন্তু এর কাঠামটি ভেঙ্গে ফেল্তে হবে, এর ভিতর যা কেবল সাময়িক সেটা যাতে দূর হয়ে যায়। আমি যাঁকে রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছি তাঁর উপর নিষ্ঠা, ভাল কথা; কিন্তু আরও ভাল আমার দেশ যাঁকে রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছে তাঁর উপর নিষ্ঠা। রাজা দেবতা, কিন্তু ভগবানের যে শক্তি তাঁর মধ্যে ফুটে উঠেছে তারই বলে। রাজা এই শক্তি ধারণ করেন, যখন প্রকৃতিপুঞ্জ তাঁকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়। দেশের অন্তরে যে ভগবান, তিনিই ইষ্ট; রাজা, তাঁর সেবক মাত্র। বিঠোবা, মারাঠার বিরাট প্রাণরূপিনী ভবানী, এঁদের শক্তিতে আমি বিজয়ী হয়েছি!
জয়সিংহ
তোমার রাষ্ট্রের আদর্শ খুব মহৎ, কিন্তু উপায় তোমার যে ধরণের তা আমাদের সকল নীতি ধর্ম্মের মূলচ্ছেদকারী। চাতুরী, বিশ্বাসঘাতকতা, লুঠ, খুন—এ সব ত তোমার কাজের বাইরে ছিল না।
শিবাজী
আমি ভগবানের জন্য, মহারাষ্ট্র ধর্ম্মের জন্য, রামদাস যে ধর্ম্ম দিয়েছিলেন সেই হিন্দুরাষ্ট্রের ধর্ম্মের জন্য অসি ধরে ছিলেম, শাসন দণ্ড ধরেছিলেম— নিজের জন্য নয়। আমি আমার মস্তক ভবানীর কাছে উৎসর্গ করে দিই। মা তা আমাকেই রাখতে বল্লেন, তা দিয়ে জাতির কল্যাণের জন্যে মন্ত্রণা কর্তে, কৌশল উদ্ভাবন কর্তে। আমার রাজ্য আমি রামদাসকে দিয়ে দিই, তিনি ভগবানের, মারাঠার দানরূপে তা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এই দুই আদেশই আমি পালন করেছি। আমি হত্যা করেছি ভগবানের আজ্ঞায়। আমি লুঠ করেছি যখন ঐটিকেই উপায় বলে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বাসঘাতক আমি কখনও ছিলাম না। কিন্তু লোকসংখ্যা ও উপকরণের অভাব আমায় মিটিয়ে নিতে হয়েছে—ছলের ও কৌশলের সহায়ে; শারীরিক বলকে আমি হটিয়েছি বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা মস্তিষ্কের জোর দিয়ে। যুদ্ধে ও রাষ্ট্রনীতিতে ছলের স্থান জগৎ স্বীকার করে নিয়েছে। রাজপুতের সম্মুখযুদ্ধ ঔদার্য্যের চিহ্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু পাশ্চাত্যের কি প্রাচ্যের কোন জাতিই তা মেনে চলে নি।
জয়সিংহ
আমি ধর্ম্মকেই শ্রেষ্ঠ বস্তু বলে জান্তেম। তাই ভগবানের আদেশ পর্য্যন্ত তা হ’তে আমাকে বিচ্যুত কর্তে পার্ত না।
শিবাজী
আমি আমার সবই ভগবানকে দিয়ে দিয়েছিলেম। ধর্ম্মকে পর্যন্ত রাখি নি। তাঁর ইচ্ছাই আমার ধর্ম্ম। তিনি আমার সেনানী, আমি তাঁর অধীনে সৈনিক মাত্র। আমার নিষ্ঠা এইখানে। ঔরঙ্গজেবের উপর নয়, কোন নীতি-শাস্ত্রের উপর নয়, আমার নিষ্ঠা যে ভগবান আমাকে এ মর্ত্তালোকে পাঠিয়েছেন তাঁর উপরে।
জয়সিংহ
ভগবান আমাদের সবাইকেই পাঠিয়েছেন, তবে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যের জন্য। আর সে উদ্দেশ্যের মত করেই তিনি প্রত্যেকের আদর্শকে স্বভাবকে গড়েন। মোগলের পতনে আমি দুঃখ করিনা। নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখবার যোগ্যতা তার যদি থাকত, তবে সে বস্তু কখনই সে হারাত না। কিন্তু অযোগ্য হয়ে পড়লেও, আমার প্রতিশ্রুতি, আমার নিষ্ঠা আমার সেবাকে অটুট রেখেছি। আমার সম্রাটের অনুজ্ঞার সম্বন্ধে তর্ক বিতর্ক তোলা আমার কাজ নয়। ভগবান তাঁকে মনোনীত করেছেন, তিনিই তাঁর বিচার কর্তে পারেন। আমার কর্ত্তব্য তা নয়।
শিবাজী
যে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়, অন্যায় প্রভুত্বকে মেনে নিয়ে তার আয়ু বাড়িয়ে দিতে চায় না তাকেও ভগবানই মনোনীত করেন। ভগবান সব সময়েই শক্তিশালীর পক্ষ নেন না, কখন কখনও তিনি পরিত্রাতা হয়ে থাকেন।
জয়সিংহ
শিবাজী
কোথা থেকে তিনি নেমে আস্বেন? তিনি ষে এইখানেই রয়েছেন, আমাদের অন্তরের মধ্যে। আমি তাঁকে এই এখানে দেখ্ছি, তাই ত আমার ব্রত সাধন করবার শক্তি আমি পেয়েছিলেম।
জয়সিংহ
কিন্তু তোমার কাজে তাঁর পাঞ্জা, তাঁর হুকুমনামা কই?
শিবাজী
একটা সাম্রাজ্যকে আমি টলিয়ে দিয়েছি—আর তা গড়ে ওঠেনি। একটা জাতিকে আমি সৃষ্টি করেছি, এখনও তা ধ্বংস হয় নি।