মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/১ম অংশ
গ্রন্থের সারসংগ্রহ
ডায়োডোরস
ভারতবর্ষের আকার চতুর্ভুজ ক্ষেত্রের ন্যায়। ইহার পূর্ব্ব ও দক্ষিণ পার্শ্ব মহাসাগর কর্তৃক পরিবেষ্টিত। উত্তর দিকে হিমদ (Hemodos) পর্বত স্কাইথিয়া (Skythia) হইতে ভারতবর্ষকে ব্যবচ্ছিন্ন করিতেছে। স্কাইথিয়া দেশে শক নামক স্কাইথীয় জাতি বাস করে। চতুর্থ অর্থাৎ পশ্চিম সীমায় সিন্ধু নামক নদ প্রবাহিত হইতেছে। সিন্ধু নদ এক নীল নদ ব্যতীত আর সমুদায় নদী অপেক্ষা বৃহৎ। শুনা যায়, পূর্ব হইতে পশ্চিম পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিস্তার ২৮ হাজার স্টাডিয়ম্, এবং উত্তর হইতে দক্ষিণ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৩২ হাজার স্টাডিয়ম্। এই দেশের আয়তন এত বিশাল যে, মনে হয় প্রায় সমগ্র উত্তর গ্রীষ্মমণ্ডল ইহার অন্তর্ভূত। এইজন্য ভারতের দূরতর প্রদেশে অনেক সময়ে শঙ্কু ছায়াপাত করে না এবং রাত্রিকালে সপ্তর্ষিমণ্ডল দৃষ্টিগোচর হয় না; সুতরাং আমরা শুনিতে পাই, এই সকল স্থানে দক্ষিণ দিকে ছায়া পতিত হয়।
ভারতবর্ষে বহু বিশাল পর্বত আছে সেগুলি সর্ববিধ ফলবান্ বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ; এবং অনেক বিস্তীর্ণ, উর্বর সমতল ভূমি আছে; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভিন্ন হইলেও সে সমুদায়ই অসংখ্য নদী দ্বারা খণ্ডিত ও পরিচ্ছিন্ন। সমতল ভূমির অধিকাংশই জলপ্রণালী দ্বারা সিক্ত, এজন্য বৎসরে দুই বার শস্য উৎপন্ন হয়। এই দেশ সর্বপ্রকার জীবজন্তু, পশুপক্ষীর আবাসভূমি; তাহারা আকার ও শক্তিতে বিবিধ ও বিচিত্র। অধিকন্তু, ভারতে অগণ্য অতিকায় হস্তী বিচরণ করে; ইহারা অপর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে, এজন্য লিবীয়াদেশীয় হস্তী অপেক্ষা এগুলি অনেক অধিক বলবান্। ভারতবর্ষীয়েরা বহুসংখ্যক হস্তী ধৃত ও যুদ্ধের জন্য শিক্ষিত করে; এজন্য জয়লাভের পক্ষে ইহাদিগের দ্বারা প্রচুর সহায়তা হইয়া থাকে।
এইরূপে, দেশে অপর্যাপ্ত আহার্য সামগ্রী প্রাপ্ত হওয়াতে অধিবাসীগণও অতিশয় হৃষ্টপুষ্ট ও উন্নতকায় বলিয়া প্রসিদ্ধ। তাহারা বিশুদ্ধ বায়ু সেবন ও স্বাদুতম জল পান করে; সুতরাং তাহারা শিল্পকর্মে সুনিপুণ। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে যেমন সর্ববিধ কৃষিজাত শস্য উৎপন্ন হয় তেমনি ইহার কুক্ষিতে সকল প্রকার ধাতুর খনি আছে। এই সকল খনিতে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য, অল্প তাম্র ও লৌহ, এমন কি কাংস্য টিন বা (Kassiteros) ও অন্যান্য ধাতুও প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল ধাতু অলঙ্কার, আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী, ও যুদ্ধের উপকরণ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
ভারতবর্ষে যব প্রভৃতি ব্যতীত চীনা যোয়ার ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়; এগুলি নদী হইতে আনীত বহুসংখ্যক জলপ্রণালী দ্বারা সিক্ত থাকে। এতদ্ব্যতীত উহাতে বহুল পরিমাণে বিবিধ প্রকারের ডাল, ধান্য, বস্পরম্ (bosporon) নামক শস্য এবং প্রাণধারণোপযোগী বহুবিধ শাকসবজী উৎপন্ন হয়। (শেষোক্ত খাদ্যদ্রব্যগুলি স্বতঃই জন্মিয়া থাকে।) জীবনযাত্রা নির্বাহোপযোগী অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীও অল্প উৎপন্ন হয় না। কিন্তু সে সমুদায় উল্লেখ করিতে গেলে প্রবন্ধ দীর্ঘ হইয়া পড়ে। এজন্য শুনিতে পাই ভারতবর্ষে কখনও দুর্ভিক্ষ বা দেশব্যাপী খাদ্যাভাব জনসাধারণকে প্রপীড়িত করে ন॥ কারণ এদেশে বৎসরে দুই বার বর্ষা উপস্থিত হয়। শীতকালে বারিপাত হইলে অন্যান্য দেশের ন্যায় গোধূম বপন সম্পন্ন হয়। কর্কটক্রান্তির পর (অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে) দ্বিতীয় বার বারিপাত আরম্ভ হইলে ধান্য, বম্পরম্, তিল এবং চীনা যোয়ার প্রভৃতি উপ্ত হয়। ভারতবর্ষীয়েরা প্রায়ই বৎসরে দুই বার শস্য সংগ্রহ করে; প্রথম বারের বপনে যথেষ্ট শস্য উৎপন্ন না হইলেও দ্বিতীয় বার বপনের শস্য হইতে তাহারা কখনও একেবারে বঞ্চিত হয় না। তৎপর স্বভাবজাত ফল এবং জলাভূমিতে উৎপন্ন বিবিধ স্বাদুতাবিশিষ্ট মূল অধিবাসীদিগের প্রাণধারণে প্রচুর সহায়তা করে। ফলত ভারতের প্রায় সমগ্র সমতল ভূমি নদীজল বা গ্রীষ্মকালীন বর্ষাপাত দ্বারা সিক্ত; এজন্য উহা অতি উর্বর। প্রতি বৎসর আশ্চর্য রূপে ঠিক একই সময়ে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আর গ্রীষ্মকালের প্রখর উত্তাপে জলাভূমিজাত মূল, বিশেষত দীর্ঘ নলগুলি সুপক্ব হয়। বিশেষত ভারতবাসীদিগের মধ্যে এমত কতকগুলি প্রথা আছে যাহাতে ওদেশে দুর্ভিক্ষ হইতে পারে না। অন্যান্য জাতির নিয়ম এই যে তাহারা যুদ্ধ উপস্থিত হইলে শস্য-ক্ষেত্র বিনষ্ট করিয়া সেগুলিকে মরুভূমিতে পরিণত করে। কিন্তু ভারতবর্ষে কৃষকগণ পবিত্র ও রক্ষণীয় বলিয়া পরিগণিত; এজন্য যথন পার্শ্ববর্তী স্থানে যুদ্ধ চলিতে থাকে তখনও তাহারা বিপদ কাহাকে বলে জানে না। কারণ উভয়পক্ষের যোদ্ধৃগণ যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পরস্পরকে হনন করে; কিন্তু কৃষিনিরত ব্যক্তিগণ সর্বসাধারণের হিতকারী বলিয়া অক্ষত থাকে। অধিকন্তু, ভারতবর্ষীয়েরা কখনও শত্রুর শস্য-ক্ষেত্র অগ্নিতে দগ্ধ কিংবা তাহাদিগের বৃক্ষসমূহ উচ্ছিন্ন করে না।
ভারতবর্ষে বহুসংখ্যক বৃহৎ নৌচলনোপযোগী নদী আছে। তাহারা উত্তর সীমাস্থিত পর্বতমালায় উৎপন্ন হইয়া সমতল ভূমির মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। ইহাদিগের অনেকগুলি পরস্পরের সহিত মিলিত হইয়া গঙ্গা নামক নদীতে পতিত হইয়াছে। এই গঙ্গানদী ইহার উৎপত্তি স্থানে ৩০ স্টাডিয়ম্ বিস্তৃত; ইহা উত্তর হইতে দক্ষিণে প্রবাহিত হইয়া মহাসমুদ্রে প্রবেশ করিয়াছে। গঙ্গা গাঙ্গেয়দিগের (Gangaridai) দেশের পূর্ব সীমা। গাঙ্গেয়গণের বহুসংখ্যক মহাকায় হস্তী আছে। এজন্য এই দেশ কখনও কোনও বৈদেশিক ভূপতি কর্তৃক বিজিত হয় নাই, কারণ অপরাপর সমুদায় জাতিই বিপুল বলশালী অগণ্য হস্তীর কথা শুনিয়া ভয় পায়। [যেমন, মাকেদনবাসী সেকেন্দর সাহা সমগ্র এসিয়া জয় করিয়াও কেবল গাঙ্গেয়দিগের সহিত সংগ্রামে বিমুখ হইয়াছিলেন। কারণ তিনি ভারতের অন্যান্য জাতি পরাজিত করিয়া সমগ্র সেনাবল সহ গঙ্গাতীরে উপনীত হইয়া জানিতে পারিলেন, গাঙ্গেয়গণের যুদ্ধার্থ সজ্জিত সংগ্রামনিপুণ চারি সহস্র হস্তী আছে; ইহা শুনিয়াই তিনি তাহাদিগের সহিত যুদ্ধের সংকল্প পরিত্যাগ করিলেন।] গঙ্গার সমতুল্য সিন্ধু নামক নদ উহার ন্যায় উত্তর দিকে উৎপন্ন হইয়া মহাসমুদ্রে পতিত হইয়াছে। সিন্ধু ভারতের পশ্চিম সীমা। ইহা বিস্তৃত সমতল ভূমির মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতেছে, এবং ইহাতে বহু নৌচলনোপযোগী উপনদী পতিত হইয়াছে; তন্মধ্যে হাইপানিস (Hypanis), হাইডাস্পীস (Hydaspes) ও আকেসিনীস (Akesines) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সকল নদী ব্যতীত নানা প্রকারের আরও বহুসংখ্যক নদী আছে; সমুদায় দেশ তদ্বারা সমাচ্ছন্ন ও সিক্ত হওয়াতে সর্ববিধ শস্য ও শাকসবজী অপর্যাপ্ত উৎপন্ন হইতেছে।
ভারতভূমি এমন সুজলা ও অসংখ্য নদীপূর্ণা কেন? তদ্দেশীয় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ তাহার নিম্নলিখিত কারণ নির্দেশ করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, ভারতবর্ষের চতুষ্পার্শ্ববর্তী শক, বাহলীক ও আর্যজাতির দেশ ভারতবর্ষ অপেক্ষা উচ্চ; সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে চতুর্দিক হইতে নিম্নতর সমতল ভূমিতে জলধারা প্রবাহিত হইয়া ক্রমে ক্রমে ভূমি সিক্ত করে এবং এইরূপেই বহুসংখ্যক নদী উৎপন্ন হয়।
ভারতবর্ষের একটী নদীর এক বিশেষত্ব আছে। নদীটীর নাম শিল; উহা শিল নামক নির্ঝরিণী হইতে প্রবাহিত হইতেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সমুদায় নদীর মধ্যে কেবল ইহাতে যাহা পতিত হয় তাহাই তলদেশে ডুবিয়া যায়, কিছুই ভাসে না।
সমগ্র ভারতবর্ষ অতি বিপুলায়তন; এজন্য আমরা শুনিতে পাই, এদেশে বহুসংখ্যক বিভিন্ন জাতি বাস করে। ইহাদিগের মধ্যে কোন জাতিই বিদেশ হইতে আগমন করে নাই, সমুদায় জাতিই প্রথমাবধি এদেশে বাস করিতেছে, ভারতবর্ষই তাহাদিগের উৎপত্তিস্থান। ভারতবর্ষীয়েরা কখনও বিদেশ হইতে আপনাদিগের মধ্যে কোনও উপনিবেশ গ্রহণ করে নাই, বা বিদেশে কোনও উপনিবেশ স্থাপন করে নাই। প্রবাদ আছে, প্রাচীনতম কালে এদেশের অধিবাসিগণ গ্রীকদিগের ন্যায় স্বচ্ছন্দ ভূমিজাত ফল দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিত, ও বন্য পশুর চর্ম পরিধান করিত। যেমন গ্রীসে তেমনি এদেশে শিল্প ও জীবিকানির্বাহের উপযোগী অন্যান্য উপকরণ ক্রমে ক্রমে আবিষ্কৃত হইয়াছে। অভাবই মানবকে এই সকল আবিষ্কার করিতে শিক্ষা দিয়াছে; কারণ মানবের হস্ত তাহার পরম সহায়, এবং তাহার জ্ঞান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আছে।
ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ একটি উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন, তাহার মর্ম প্রদান করা কর্তব্য। তাঁহারা বলেন, অতি প্রাচীনকালে ভারতবাসিগণ গ্রামে বাস করিত; সেই সময়ে ডায়োনীসস পশ্চিম দেশ হইতে বিপুল সেনাবল লইয়া ভারতবর্ষে উপস্থিত হন। তখন তাঁহাকে প্রতিরোধ করিতে পারে, এমন কোনও উল্লেখযোগ্য নগর বর্তমান ছিল না; এজন্য তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ বিমর্দিত করেন। কিন্তু প্রচণ্ড গ্রীষ্ম উপস্থিত হওয়াতে সেনাদলমধ্যে মহামারী আরম্ভ হইল, এবং দলে দলে সৈন্যগণ আক্রান্ত হইতে লাগিল; এজন্য এই প্রতিভাসম্পন্ন সেনানায়ক সমতল ভূমি ত্যাগ করিয়া পর্বতোপরি শিবির স্থাপন করিলেন। তথায় সৈন্যগণ শীতল বায়ু সেবন করিয়া ও নির্ঝরিণী নিঃসৃত স্রোতস্বিনীর নির্মল জল পান করিয়া শীঘ্রই রোগমুক্ত হইল। পর্বতের যে ভাগে ডায়োনীসস সৈন্যগণের আরোগ্য সম্পাদন করেন তাহা মীরস (মেরু) নামে অভিহিত হইয়াছে। ইহা নিঃসন্দেহ যে এইজন্যই গ্রীকদিগের মধ্যে বংশপরম্পরাক্রমে প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে যে দেব ডায়োনীসস জানু (মীরস) হইতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন। অতঃপর তিনি বৃক্ষলতা রোপণে মনোনিবেশ করেন এবং ভারতবাসীদিগকে মদ্য ও জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বস্তু প্রস্তুত করিবার সংকেত শিক্ষা দেন। তিনি গ্রামসমূহ সুগম স্থানে স্থানান্তরিত করিয়া বৃহৎ বৃহৎ নগর স্থাপন করেন। জনসাধারণকে দেবপূজা শিক্ষা দেন; এবং শাসনতন্ত্র ও বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এইরূপে বহু শুভ কার্য্যের অনুষ্ঠাননিবন্ধন তিনি দেবতা বলিয়া গৃহীত হন এবং অমরোচিত সম্মান লাভ করেন। তাঁহার সম্বন্ধে আরও জনশ্রুতি আছে যে, তিনি যুদ্ধযাত্রাকালে বহুসংখ্যক স্ত্রীলোক সঙ্গে লইয়া যাইতেন এবং দুন্দুভি ও করতাল-ধ্বনির সহিত সৈন্যদিগকে রণসজ্জায় সজ্জিত করিতেন; কারণ তখনও শিঙ্গা আবিষ্কৃত হয় নাই। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে বায়ান্ন বৎসর রাজত্ব করিয়া বার্ধক্যবশত পরলোকগমন করেন। তাঁহার পর তদীয় পুত্রগণ রাজ্যলাভ করেন, এবং যুগযুগান্তরের জন্য সন্তান-সন্ততিগণকে উহা প্রদান করিয়া যান। অবশেষে, বহু বংশের আবির্ভাব ও তিরোভাবের পরে ইহাদিগের হস্ত হইতে রাজদণ্ড স্খলিত হয় ও এই রাজ্যে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতবর্ষে যাহারা পার্বত্যপ্রদেশে বাস করে তাহাদিগের মধ্যে ডায়োনীসস ও তাঁহার সন্তান-সন্ততিগণ সম্বন্ধে উক্তরূপ প্রবাদ প্রচলিত আছে। তাহারা আরও বলে যে হীরাক্লীস (বা হার্ক্যুলীস) ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রীসে যেমন হীরাক্লীসের হস্তে গদা ও পরিধানে সিংহচর্ম্ম দেখিতে পাওয়া যায়, ভারতবর্ষেও সেইরূপ পরিলক্ষিত হয়। তিনি দৈহিক বল ও বীরত্বে সমুদায় মানবকে অতিক্রম করিয়াছিলেন এবং তাঁহার কৃপায় জল ও স্থল হিংস্র জন্তু হইতে সম্পূর্ণরূপে নির্মুক্ত হইয়াছিল। তিনি বহু রমণীর পাণিগ্রহণ করিয়া অনেক পুত্র লাভ করেন, কিন্তু কন্যা একটি বৈ হয় নাই। পুত্রগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে সমগ্র ভারতবর্ষ সমান অংশে বিভক্ত করিয়া তিনি এক এক জনকে এক এক অংশের রাজত্ব প্রদান করেন এবং কন্যাকেও লালনপালন করিয়া এক রাজ্যের অধিশ্বরী করিয়া যান। তিনি বহুসংখ্যক নগর প্রতিষ্ঠা করেন, তন্মধ্যে পাটলিপুত্র (Palibothra) সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও বৃহৎ। তিনি এই নগরে ঐশ্বর্য্যপূর্ণ সৌধমালা নির্মাণ করেন ও বিপুল জনমণ্ডলী স্থাপিত করেন। তিনি বড় বড় পরিখা খনন করিয়া নগরটি সুরক্ষিত করেন। নদীজলে পরিখাগুলি নিয়ত পূর্ণ থাকিত। এই সকল কারণে হীরাক্লীস মর্ত্যধাম হইতে প্রস্থান করিলে অমরোচিত সম্মান লাভ করেন। তাঁহার বংশধরগণ অনেকপুরুষ রাজত্ব করেন। তাঁহারা অনেক স্মরণীয় কর্ম সম্পাদন করিয়া কীর্তিলাভ করেন, কিন্তু কখনও ভারতবর্ষের বাহিরে যুদ্ধযাত্রা করেন নাই কিংবা বিদেশে কোনও উপনিবেশ স্থাপন করেন নাই। অবশেষে বহুযুগ পরে অধিকাংশ নগরে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়—যদিও সেকেন্দর সাহার ভারতাক্রমণ পর্যন্ত কোনও কোনও নগরে রাজতন্ত্র বর্তমান ছিল। ভারতবাসীদিগের মধ্যে যে সকল বিধি বর্তমান আছে তন্মধ্যে প্রাচীন ঋষিগণ কর্তৃক নির্দিষ্ট একটি বিধি সর্বাপেক্ষা প্রশংসাযোগ্য। এদেশের একটি বিধান এই যে কেহই কখন ক্রীতদাস বলিয়া পরিগণিত হইবে না; সকলেই স্বাধীন, সুতরাং সকলেরই স্বাধীনতায় অধিকার তুল্য সম্মান প্রাপ্ত হইবে। কারণ যাহারা গর্বভরে অপরের সহিত যথেচ্ছ ব্যবহার করে না কিংবা অপরের পদলেহন করে না তাহারাই সেই প্রকার জীবন যাপনের অধিকারী, যাহা সম্পূর্ণরূপে, সমুদায় অবস্থার উপযোগী। যে বিধান সকলে সমভাবে পালন করিতে বাধ্য, কিন্তু অসমান ধনবিভাগের অনুকূল, তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট।
ভারতবর্ষের সমগ্র অধিবাসিবৃন্দ সাত জাতিতে বিভক্ত। তন্মধ্যে প্রথম জাতি পণ্ডিতগণ (Philosophoi, sophistai)। তাঁহারা অবশিষ্ট জাতিসমূহ হইতে সংখ্যায় ন্যূন হইলেও মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁহাদিগকে কোনও প্রকার রাজকীয় কার্য সম্পাদন করিতে হয় না; সুতরাং তাঁহারা কাহারও প্রভু বা ভৃত্য নহেন। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তিকে জীবিতকালে যে সকল যজ্ঞ সম্পাদন করিতে হয় সে সমুদায় ও পরলোকগত ব্যক্তিগণের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান তাঁহারাই সম্পন্ন করিয়া থাকেন; কারণ তাঁহারা দেবতাদিগের অতি প্রিয়; এবং পরলোক সম্বন্ধেও তাঁহাদিগের সর্বাপেক্ষা অধিক জ্ঞান আছে। এই সকল অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য তাঁহারা প্রচুর সম্মান ও মহামূল্য উপহার প্রাপ্ত হন । তাঁহারা জনসাধারণেরও যথেষ্ট উপকার করিয়া থাকেন। কারণ তাঁহারা বর্ষারম্ভে মহতী সভায় সমবেত হইয়া উপস্থিত জনমণ্ডলীকে অনাবৃষ্টি, বর্ষা, সুবাতাস, ব্যাধি ও শ্রোতৃবর্গের পক্ষে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় গণনা করিয়া বলিয়া দেন। সুতরাং রাজা ও প্রজা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়া পূর্ব্বেই অভাবের জন্য সুব্যবস্থা ও অন্যান্য আবশ্যক বিষয়ের যথাবিহিত প্রতীকার করিতে সমর্থ হন। যে পণ্ডিত ভবিষ্যৎ গণনায় ভ্রম করেন তাঁহাকে আর কোনও দণ্ড ভোগ করিতে হয় না; কেবল তিনি জনসমাজে নিন্দিত হন ও অবশিষ্ট জীবনের জন্য তাঁহাকে মৌনব্রত অবলম্বন করিতে হয়।
দ্বিতীয় জাতি কৃষকগণ। ইহারা সংখ্যায় অপরাপর জাতি অপেক্ষা অধিক। ইহাদিগকে যুদ্ধ বা অপর কোনও রাজকীয় কার্য করিতে হয় না; সুতরাং ইহাদিগের সমুদায় সময়ই কৃষিকার্যে নিয়োজিত হয়। অরিগণ ক্ষেত্রে কৃষিনিরত কৃষকের সন্নিহিত হইলেও তাহার কোনও অনিষ্ট করে না। সাধারণের হিতকারী বলিয়া কৃষক সর্ববিধ অনিষ্ট হইতে সুরক্ষিত। সুতরাং শস্যক্ষেত্রের কোনও ক্ষতি না হওয়াতে উহা অপর্যাপ্ত শস্য প্রদান করে, এবং যাহা কিছু মানবের সুখের পক্ষে প্রয়োজনীয় অধিবাসিগণ সে সমুদায়ই প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হয়। কৃষকগণ স্ত্রী পুত্র লইয়া গ্রামে বাস করে, কখনও নগরে গমন করে না। তাহারা রাজাকে কর প্রদান করে, কারণ সমগ্র ভারতভূমি রাজার সম্পত্তি, প্রজাসাধারণের ভূমিতে কোনও স্বত্ব নাই। কর ভিন্ন তাহারা উৎপন্ন দ্রব্যের এক চতুর্থাংশ রাজকোষে প্রদান করে ।
তৃতীয় জাতি গোপাল ও মেষপাল, এবং মোটামুটি সেই রাখাল জাতি, যাহারা কখনও গ্রামে বা নগরে বাস করে না, কিন্তু সমস্ত জীবন শিবিরে যাপন করে। ইহারা পশু-পক্ষী শিকার ও জীবিতাবস্থায় ধৃত করিয়া দেশকে আপন্মুক্ত রাখে। ভারতবর্ষ সর্ব্বপ্রকার বন্য পশু পক্ষীতে পরিপূর্ণ। পক্ষী সকল কৃষকগণের বীজ উদরসাৎ করে। ব্যাধগণ অশেষ শ্রমসহকারে শিকারে নিযুক্ত থাকিয়া ভারতবর্ষকে এই সকল আপদ হইতে রক্ষা করে।
শিল্পিগণ চতুর্থ জাতি। ইহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করে, কেহ কেহ কৃষকগণ ও অপরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি নির্মাণে নিযুক্ত থাকে। ইহারা তো কোনও প্রকার কর প্রদান করেই না; অধিকন্তু রাজকোষ হইতে ভরণ পোষণের ব্যয় প্রাপ্ত হয়।
পঞ্চম জাতি যোদ্ধাগণ। ইঁহারা সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছেন। এই জাতি যুদ্ধার্থ সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত, কিন্তু ইঁহারা শাস্তির সময় কেবল আলস্যে ও আমোদ-প্রমোদে কাল হরণ করেন। সৈন্য, যুদ্ধাশ্ব ও যুদ্ধের হস্তী—এ সমুদায়েরই ব্যয় রাজকোষ হইতে প্রদত্ত হয়।
ষষ্ঠ জাতি অমাত্য বা মহামাত্র। ইঁহাদিগকে দেশের সমুদায় বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া রাজার নিকটে, এবং যে রাজ্যের রাজা নাই সেখানে শাসনকর্তাদিগকে তাহার বিবরণ প্রদান করিতে হয়।
সপ্তম জাতি মন্ত্রী। ইহারা মন্ত্রণা-সভায় মিলিত হইয়া রাজ্য সম্বন্ধে মন্ত্রণা করিয়া থাকেন। ইঁহারা সংখ্যায় অপর সমুদায় জাতি অপেক্ষা ন্যূন; কিন্তু বংশমর্যাদা ও জ্ঞানে সর্বাপেক্ষা সম্মানার্হ। কারণ ইঁহাদিগের মধ্য হইতেই রাজমন্ত্রী, কোষাধ্যক্ষ ও বিবাদ মীমাংসার জন্য বিচারক নিযুক্ত হন, এবং সাধারণত সেনাপতি ও শাসনকর্তৃগণও এই জাতিভুক্ত।
মোটামুটি ভারতীয় রাজ্যের অধিবাসিগণ এই সাত জাতিতে বিভক্ত। এক জাতির লোক অপর জাতিতে বিবাহ করিতে পারে না কিংবা অপর জাতির শিল্প-ব্যবসায় অবলম্বন করিতে পারে না। যেমন, যোদ্ধা কৃষিকার্য করিতে পারে না; অথবা শিল্পী ব্রাহ্মণের ন্যায় জ্ঞানচর্চা করিতে পারে না।
ভারতবর্ষে অগণ্য প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হস্তী আছে — তাহারা আকার ও বলে সুবিখ্যাত। ইহারা ঘোটক ও অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় সন্তান উৎপাদন করে—এ বিষয়ে যে বিশেষত্ব আছে বলিয়া শুনা যায় তাহা ঠিক নহে। হস্তিনী ন্যূনকল্পে ষোড়শ ও খুব অধিক হইলে অষ্টাদশ মাস গর্ভ ধারণ করে। ঘোটকীর ন্যায় হস্তিনীও সাধারণত একটি সন্তান প্রসব করে ও তাহাকে ছয় বৎসর স্তন্যদান করে। অধিকাংশ হস্তী অতি দীর্ঘায়ু মনুষ্যের ন্যায় সুদীর্ঘকাল জীবিত থাকে। কিন্তু যাহাদের পরমায়ু অত্যন্ত অধিক তাহারা দুই শত বৎসর বাঁচে।
ভারতবাসীরা বিদেশাগত ব্যক্তিদিগের জন্য কর্মচারী নিয়োগ করিয়া থাকেন। তাঁহারা তাহাদিগের তত্ত্বাবধান করেন ও সর্বদা দৃষ্টি রাখেন, যাহাতে তাহাদিগের প্রতি কোনও অত্যাচার না হয়। কোনও বৈদেশিক লোক পীড়িত হইলে তাঁহারা তাহার জন্য চিকিৎসক প্রেরণ করেন ও অন্যান্য প্রকারে তাহার যত্ন করিয়া থাকেন; এবং সে পরলোকগমন করিলে তাহার মৃতদেহ ভূগর্ভে প্রোথিত করিয়া তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তি তাহার আত্মীয়গণের নিকট পাঠাইয়া দেন। যে সকল বিবাদে বৈদেশিকগণের সংস্রব আছে বিচারকগণ অতি সূক্ষ্ম ন্যায়পরায়ণতার সহিত তাহার মীমাংসা করিয়া থাকেন এবং কেহ তাহাদিগের সহিত অন্যায় ব্যবহার করিলে তাহাকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করেন। [ভারতবর্ষ ও তাহার পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধে যাহা বলা হইল আমাদের অভিপ্রায়ের পক্ষে তাহাই যথেষ্ট।]