মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/১৫শ অংশ (খ)

এলিয়ান

কতিপয় ভারতীয় বন্য জন্তু

 শুনা যায়, ভারতবর্ষের কোন কোন প্রদেশে (আমি অভ্যন্তরস্থিত প্রদেশসমূহের কথা বলিতেছি) দুরারোহ ও বন্যজন্তুসমাকীর্ণ শৈলমালা আছে। উহাতে আমাদের দেশে যে সকল জন্তু দৃষ্ট হয় তাহাও আছে, কিন্তু তাহারা বন্য। কারণ আমরা শুনিতে পাই, তথায় মেষও বন্য; তদ্ভিন্ন কুকুর ও ছাগ ও বৃষ স্বচ্ছন্দে ও স্বাধীনভাবে বিচরণ করে—তাহারা মেষপাল বা গোপালের শাসন কাহাকে বলে জানে না। তাহারা সংখ্যায় গণনাতীত—ইহা কেবল উক্ত দেশ সম্বন্ধীয় লেখকগণের উক্তি নহে, কিন্তু তদ্দেশীয় পণ্ডিতগণও এইরূপ বলিয়া থাকেন। ব্রাহ্মণগণ পণ্ডিতগণের মধ্যে গণ্য হইবার উপযুক্ত; ইঁহারাও এই সকল বিষয়ে একমত। জনশ্রুতি এই যে ভারতবর্ষে এক প্রকার একশৃঙ্গ জন্তু আছে, ভারতবাসীরা তাহাকে কর্তাজোন (Kortazon) বলে। এই জন্তু পূর্ণাবয়ব ঘোটকের ন্যায় বৃহৎ। ইহার শিখা ও পীতবর্ণ কোমল রোম আছে। ইহার পদগুলি অত্যুৎকৃষ্ট এবং ইহা অত্যন্ত দ্রুতগামী। ইহার পদগুলি সন্ধিবিহীন, হস্তীর পদের ন্যায় গঠিত; লাঙ্গুল শূকরের মত। ইহার ভ্রূযুগলের মধ্যভাগে শৃঙ্গ উৎপন্ন হয়। উহা সরল নহে, কিন্তু অতি স্বাভাবিক কুণ্ডলাকারে আবর্তিত এবং কৃষ্ণবর্ণ। প্রবাদ এই যে, এই শৃঙ্গ অতিশয় তীক্ষ্ণ। আমি শুনিয়াছি যে, ইহার রব সর্বাপেক্ষা কর্কশ ও উচ্চ। ইহা অপর জন্তুকে আপনার নিকট আসিতে দেয়, তাহাদিগের পক্ষে ইহা শান্ত। কিন্তু শুনিতে পাওয়া যায়, এই জন্তু স্বগোত্রের সহিত বিলক্ষণ কলহপরায়ণ। পুংজাতীয় জন্তুগুলি শৃঙ্গে শৃঙ্গে সংঘর্ষণ করিয়া যে কেবল পরস্পরের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহা নহে, কিন্তু স্ত্রীজাতীয় জন্তুগুলির সহিতও যুদ্ধের আগ্রহ প্রকাশ করে। ইহাদিগের যুদ্ধপ্রিয়তা এত অধিক যে পরাজিত প্রতিপক্ষ হত না হওয়া পর্যন্ত ইহারা কিছুতে যুদ্ধ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয় না। ইহার দেহের সমস্তই অত্যন্ত বলশালী, কিন্তু শৃঙ্গের শক্তি অপরাজেয়। ইহা নির্জনে আহার ও একাকী বিচরণ করিতে ভালবাসে। সঙ্গমেচ্ছাকালে ইহা স্ত্রীজাতীয় জন্তুর সহিত শান্ত ব্যবহার করে, এমনকি তখন ইহারা একত্র আহারবিহার করে। কিন্তু এই কাল অতীত ও স্ত্রী-কর্তাজোন গর্ভবতী হইলে পুং-কর্তাজোন পুনরায় হিংস্রস্বভাব হয় ও নির্জনতা অন্বেষণ করে। শুনা যায়, ইহাদিগের শাবকগুলি অতি শৈশবে প্রাচ্যগণের রাজার নিকট আনীত হয় ও আড়ম্বরপূর্ণ মহোৎসবে পরস্পরের সহিত যুদ্ধে নিয়োজিত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক জন্তু কখনও ধৃত হইয়াছে বলিয়া কাহারও স্মরণ হয় না।

 শুনা যায়, ভারতবর্ষের অভ্যন্তরস্থিত প্রদেশের সীমাস্থিত পর্বত উত্তীর্ণ হইলে বনাকীর্ণ খাত দৃষ্ট হয়; ভারতবাসীরা ঐ অঞ্চলকে করূদ (Korouda) বলে। এই খাতগুলিতে সাটীরের ন্যায় আকারবিশিষ্ট একপ্রকার জন্তু বাস করে। ইহাদিগের দেহ কর্কশ রোমাবৃত, এবং কটিদেশ হইতে ঘোটকের মত লাঙ্গুল বাহির হইয়াছে। উত্যক্ত না হইলে ইহারা গুল্মবনে বাস করে ও বন্য ফল আহার করিয়া প্রাণধারণ করে; কিন্তু শিকারীর হুংকার ও কুকুরের চীৎকার শুনিবামাত্রই ইহারা অসম্ভব দ্রুতগতিতে উচ্চস্থানে আরোহণ করে, কারণ ইহারা পর্বতারোহণে অভ্যস্ত। ইহারা প্রস্তর গড়াইয়া আক্রমণকারীর সহিত প্রাণপণে যুদ্ধ করে এবং বহু জনকে প্রস্তরাঘাতে হত করে। ইহাদিগকে ধৃত করাই অত্যন্ত কঠিন। শুনা যায় যে, দীর্ঘকাল ব্যবধানে বহু কষ্টে ধৃত হইয়া কয়েকটি জন্তু প্রাচ্যগণের নিকট আনীত হইয়াছিল; কিন্তু এগুলি হয় পীড়িত ছিল, নতুবা গর্ভবতী স্ত্রীজাতীয় জন্তু ছিল; সুতরাৎ যেগুলি পীড়িত সেগুলিকে পীড়ানিবন্ধন ও যেগুলি গর্ভবর্তী সেগুলিকে গর্ভভারবশত ধৃত করা সম্ভব হইয়াছিল।