মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/২৭তম অংশ
স্ট্রাবো
ভারতবাসীদিগের আচার-ব্যবহার
ভারতবাসিগণ সকলেই আহার সম্বন্ধে মিতাচারী—বিশেষত শিবিরে। তাহারা বিপুল জনসংঘ ভালবাসে না, এজন্য তাহাদের জীবন সুসংযত সুশৃঙ্খল। চৌর্য অত্যন্ত বিরল। মেগাস্থেনীস লিথিয়াছেন যে, যাহারা চন্দ্রগুপ্তের শিবিরে বাস করিয়াছিলেন (উহাতে চারি লক্ষ লোক অবস্থিতি করিত) তাঁহারা বলেন, ঐ শিবিরে কোন দিনই ত্রিশ মুদ্রার (Drachma) অধিক মূল্যের বস্তু অপহৃত হইয়াছে বলিয়া শুনা যায় নাই। ভারতবর্ষে লিখিত বিধির ব্যবহার নাই— তাহাতেই এইরূপ। ভারতবাসীরা লিখিতে জানে না, সুতরাং সমস্ত কার্যেই তাহাদিগকে স্মৃতির উপর নির্ভর করিতে হয়। তথাপি তাহারা সরলচিত্ত ও মিতাচারী বলিয়া সুখেই কালযাপন করে। তাহারা এক যজ্ঞের সময় ভিন্ন আর কখনও মদ্যপান করে না। তাহারা যে মদ্য পান করে তাহা যব হইতে প্রস্তুত নহে, অন্ন হইতে প্রস্তুত।
তাহাদিগের প্রধান খাদ্য অন্নব্যঞ্জন। তাহাদিগের বিধি ও পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকার সমুদায়ই সরল; তাহার প্রমাণ এই যে তাহারা কখনও রাজদ্বারে অভিযোগ উপস্থিত করে না। তাহারা যাহা গচ্ছিত বা আবদ্ধ রাখে তৎসম্পর্কে কোনও অভিযোগ করিতে হয় না। তাহাদিগের সাক্ষী কিংবা মোহরের আবশ্যক হয় না, কিন্তু তাহারা পরস্পরকে বিশ্বাস করিয়াই বস্তু গচ্ছিত রাখে। তাহাদিগের গৃহ সচরাচর অরক্ষিত থাকে । এ সমস্তই সুসংযত বুদ্ধিসঙ্গত। কিন্তু অপর কতকগুলি বিষয়ের অনুমোদন করা যায় না। যেমন, তাহারা আজীবনই একাকী ভোজন করে; দিবসে কিংবা রাত্রিতে এমন কোনও নির্দিষ্ট সময় নাই যখন সকলে মিলিত হইয়া ভোজন করিতে পারে। কিন্তু যখন যাহার ইচ্ছা তখন সে আহার করে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের পক্ষে ইহার বিপরীত নিয়মই শ্রেষ্ঠ।
শরীর ঘর্ষণপূর্ব্বক ব্যায়ামই ভারতবাসীদিগের বিশেষ প্রিয়। ইহা নানা রূপে সম্পন্ন হয়; তন্মধ্যে মসৃণ হস্তিদন্তের দণ্ড ঘর্ষণ করিয়া ত্বক্ মসৃণ করিবার প্রণালী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাহাদিগের সমাধিস্থান অলংকৃত ও মৃতদেহোপরি স্থাপিত মৃত্তিকা-স্তূপ অনুচ্চ। তাহারা অন্যান্য বিষয়ে আড়ম্বর— প্রিয় নহে, কিন্তু অলংকারে সজ্জিত হইতে ভালবাসে। তাহারা স্বর্ণ ও মূল্যবান্ প্রস্তরের অলংকার ব্যবহার করে ও কৃত্রিম পুষ্পসজ্জিত মসলিন বস্ত্র পরিধান করিয়া থাকে। ছত্রধর তাহাদিগের অনুগমন করে। তাহারা সৌন্দর্যের সম্মান করে এবং সুন্দর হইবার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে। তাহারা সত্য ও ধর্মের তুল্যরূপে আদর করিয়া থাকে: এজন্য জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ না হইলে তাহারা বৃদ্ধদিগকে বিশেষ অধিকার প্রদান করে না। [১] তাহারা বহুবিবাহ করিয়া থাকে এবং যুগ্ম গো বিনিময়ে পিতামাতার নিকট হইতে কন্যা গ্রহণ করে। তাহারা পত্নীগণের মধ্যে কাহাকে কাহাকেও গৃহকর্মে সাহায্যের উদ্দেশ্যে এবং কাহাকে কাহাকেও সুখ ও বহু সস্তান প্রাপ্তির আশায় বিবাহ করে। তাহারা সতী হইতে বাধ্য না হইলে ব্যভিচারিণী হয়। কেহই মস্তকে মাল্যধারণ করিয়া বলিদান কিংবা যজ্ঞ সম্পাদন করে না। তাহারা বলির পশু খড়গ দ্বারা ছেদন না করিয়া শ্বাসরোধ করিয়া হত্যা করে, কারণ তাহাতে পশুটি অঙ্গহীন না হইয়া সমগ্রভাবে দেবতার চরণে উৎসর্গীকৃত হয়।
যাহারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাহাদিগের হস্তপদ ছেদন করা হয়। যে অপরের অঙ্গ হানি করে সে কেবল সেই অঙ্গে বঞ্চিত হয় তাহা নহে, কিন্তু তাহার হস্তও ছেদন করা হইয়া থাকে। যদি কেহ কোনও শিল্পীর হস্ত কিংবা চক্ষু বিনষ্ট করে তবে সে প্রাণ হারায়। এই লেখক বলেন যে কোন ভারতবাসীই ক্রীতদাস রাখে না। [অনীসিক্রিটস বলেন যে মুষিকানস (Mousikanos) যে প্রদেশের রাজা উক্ত প্রথা সেই প্রদেশেরই বিশেষত্ব। ইত্যাদি।]
রাজার শরীর রক্ষার জন্য স্ত্রী-রক্ষী নিযুক্ত হইয়া থাকে; তাহারাও পিতামাতার নিকট হইতে ক্রীত হয়। শরীররক্ষী ও অন্যান্য সৈন্যগণ দ্বারের বাহিরে অবস্থান করে। যে স্ত্রী মদ্যা—ভিভূত রাজাকে হত্যা করে সে তাঁহার উত্তরাধিকারীর পত্নীরূপে গৃহীত হয়। পুত্রগণ পিতার উত্তরাধিকারী। রাজা দিবসে নিদ্রা যাইতে পারেন না; এবং রাত্রিতেও তাঁহাকে ষড়যন্ত্রের ভয়ে দণ্ডে দণ্ডে শয্যা পরিবর্তন করিতে হয়।
নৃপতি কেবল যুদ্ধের সময়ে রাজপ্রাসাদ হইতে বহির্গত হন, তাহা নহে; বিচারকার্য নির্বাহের জন্যও তাঁহাকে প্রাসাদ ত্যাগ করিতে হয়। তখন তিনি শেষ পর্যন্ত বিচারকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া সমস্ত দিন বিচারালয়ে অতিবাহিত করেন, এমনকি দেহ পরিচর্যার সময় উপস্থিত হইলেও নিরস্ত হন না। দণ্ড দ্বারা দেহ ঘর্ষণ করাই দেহ-পরিচর্যা। তিনি বাদানুবাদ শুনিতে থাকেন এবং চারি জন পরিচারক দণ্ড দ্বারা তাঁহার দেহ ধর্ষণ করিতে থাকে। তিনি যজ্ঞ সম্পাদনের উদ্দেশ্যেও প্রাসাদের বাহিরে গমন করেন। তৃতীয়ত, মহা জাঁকজমকে শিকারের অভিপ্রায়ে তিনি প্রাসাদ ত্যাগ করেন। তখন তিনি রমণীবৃন্দে বেষ্টিত হইয়া গমন করেন; রমণী-শ্রেণীর বাহিরে বর্শাধারিগণ মণ্ডলাকারে সজ্জিত থাকে। রজ্জু দ্বারা পথ চিনিতে হয়; পুরুষ, এমনকি স্ত্রীলোকও রজ্জুর মধ্যে গমন করিলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। কাঁসর ও দুন্দুভিধারিগণ অগ্রে অগ্রে গমন করে। রাজা বেষ্টিত স্থানে শিকার করেন ও মঞ্চ হইতে তীর নিক্ষেপ করেন। নিকটে দুই তিন জন সশস্ত্র স্ত্রীলোক দণ্ডায়মান থাকে। তিনি উন্মুক্ত স্থানে হস্তিপৃষ্ঠে শিকার করেন। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে কেহ রথে, কেহ অশ্বোপরি, কেহ বা হস্তিপৃষ্ঠে, যুদ্ধযাত্রার মত সর্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া অবস্থান করে।[২]
[আমাদিগের প্রথাগুলির সহিত তুলনায় এ সমস্তই অত্যন্ত অদ্ভুত, কিন্তু নিম্নলিখিত প্রথাগুলি আরও অদ্ভুত।] মেগাস্থেনীস বলেন যে, ককেসসবাসিগণ প্রকাশ্যে স্ত্রীসঙ্গম করে ও আত্মীয়-স্বজনের দেহ ভক্ষণ করে।[৩] এবং এক প্রকার বানর আছে, তাহারা প্রস্তর বর্ষণ করে। ইত্যাদি।
- ↑
ন তেন বৃদ্ধো ভবতি যেনাস্য পলিতং শিরঃ।
যো বৈ যুবাপ্যধীয়ানস্তং দেবাঃ স্থবিরং বিদুঃ॥
মনু, ২।১৫৬। - ↑ কালিদাস অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকে এই বর্ণনার সমর্থন করিয়াছেন। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রারম্ভে বিদূষক দুষ্মন্ত সম্বন্ধে বলিতেছেন—এসো বানাসনহ্থথাহিং জঅনীহিং বনপুপ্ফুমালাধারিণীহিং পরিবুদো ইদো এব্ব আআচ্ছই পিঅবঅসে্সা। (এষঃ বাণাসনহস্তাভিঃ যবনীভিঃ বনপুষ্পমালাধারিণীভিঃ পরিবৃতঃ ইতঃ এব আগচ্ছতি প্রিয়বয়স্য।)
- ↑ হীরডটসও বলেন, প্রথমোক্ত প্রথা কালাতীয় (Calateis) ও পদয় (Padaeis) জাতি ও দ্বিতীয় প্রথা অপর কোনও ভারতীয় জাতির মধ্যে বর্তমান আছে। (৩য় ভাগ, ৩৮, ৯৯, ১০১ অধ্যায়।) মার্কো—পলো বলেন, বিন্ধ্যপর্বতবাসী কোনও জাতি আত্মীয়স্বজনের দেহ ভক্ষণ করে, সুতরাং মনে করা যাইতে পারে মেগাস্থেনীন যাহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছেন তাহাই লিপিবন্ধ করিয়াছেন। তবে ভারতবাসীরা বর্বর আদিম নিবাসীদিগের বর্ণনায় সমুদায় মাত্রা অতিক্রম করিত এরূপ মনে করা অসঙ্গত নহে।