মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/৪১তম অংশ
ষ্ট্রাবো
ভারতীয় পণ্ডিতগণ
পণ্ডিতগণের সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া মেগাস্থেনীস লিখিয়াছেন যে, ইঁহাদিগের মধ্যে যাঁহারা পর্বতে বাস করেন তাঁহারা ডায়োনীসসের উপাসক। (ডায়োনীসস যে ভারতবর্ষে আগমন করিয়াছিলেন) তাহার প্রমাণ বন্য দ্রাক্ষা। উহা কেবল তাঁহাদের দেশেই জন্মে—আইভি (lvy), লরেল (Laurel), মার্টল (Martle), বক্স-বৃক্ষ (Box-tree) এবং অন্যান্য চির হরিৎ তরুরাজি। এই সকল বৃক্ষের কোনটিই ইয়ুফ্রাটিস নদীর পূর্ব দিকে জন্মে না, কেবল উপবনে অল্পসংখ্যক জন্মিয়া থাকে; সেখানেও ইহাদিগের রক্ষার জন্য সাতিশয় যত্ন আবশ্যক। ডায়োনীসসের উপাসকদিগের ন্যায় তাঁহারা মসলিনবস্ত্র পরিধান করেন, মাথায় পাগড়ি পরেন, গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করেন, উজ্জ্বল বর্ণের ফুলতোলা কাপড়ে দেহ সজ্জিত করেন এবং রাজারা যখন বাহিরে আগমন করেন তখন তাঁহাদিগের অগ্রে অগ্রে দুন্দুভি ও ঘণ্টাধ্বনি হইতে থাকে। কিন্তু যে সকল পণ্ডিত সমতলভূমিবাসী তাঁহারা হীরাক্লিসের পূজা করেন। কিন্তু এই বৃত্তান্ত কাল্পনিক। অনেক লেখক এ বিষয়ে, বিশেষত দ্রাক্ষা ও মদ্য সম্বন্ধে যাহা উক্ত হইয়াছে তদ্বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। কারণ আর্মেনিয়ার অধিকাংশ, সমগ্র মেসপটমিয়া ও মীডিয়া, এবং পারস্য ও আর্মেনিয়া পর্যন্ত সমুদায় ভূভাগ ইয়ুফ্রাটিসের পূর্ব দিকে অবস্থিত। শুনা যায়, এই সকল দেশের প্রত্যেকটির অনেক স্থানেই উত্তম দ্রাক্ষা জন্মে ও উৎকৃষ্ট মদ্য প্রস্তুত হয়।
মেগাস্থেনীস পণ্ডিতদিগকে অন্য রূপে বিভক্ত করিয়াছেন। তাঁহার মতে পণ্ডিতগণ দুই ভাগে বিভক্ত। তিনি এক ভাগকে ব্রাহ্মণ ও অপর ভাগকে শ্রমণ নামে অভিহিত করিয়াছেন। ব্রাহ্মণগণই সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানভাজন, কারণ তাঁহাদিগের ধর্মমত অধিকতর সঙ্গতিবিশিষ্ট। তাঁহারা গর্ভস্থ হইবামাত্রই জ্ঞানী ব্যক্তিগণের যত্নলাভ করেন। ইঁহারা মাতার নিকট গমন করিয়া তাঁহার ও গর্ভস্থ শিশুর কল্যাণোদ্দেশ্যে মন্ত্র আবৃত্তি করিবার ছলে তাঁহাকে সদুপদেশ ও সৎপরামর্শ প্রদান করেন। যে সকল রমণী আগ্রহের সহিত ইঁহাদিগের উপদেশ শ্রবণ করেন তাঁহারা সুসন্তান লাভ করিয়া থাকেন। ইহাই জনসাধারণের বিশ্বাস। ভূমিষ্ঠ হইবার পরে শিশুগণ একের পর অন্যের যত্নে লালিতপালিত হয়; তাহাদিগের বয়স যেমন বাড়িতে থাকে তেমনি পূর্ববর্তীদিগের অপেক্ষা অধিকতর সুশিক্ষিত ও সুনিপুণ গুরু নির্বাচিত হইয়া থাকেন।
পণ্ডিতগণ নগরের সম্মুখস্থ প্রাচীরবেষ্টিত নাতিবৃহৎ ক্ষেত্রমধ্যে উপবনে বাস করেন। তাঁহারা আড়ম্বরবিহীন জীবন যাপন করেন এবং তৃণশয্যায় বা চর্মে শয়ন করেন। তাঁহারা মংস্য মাংস আহার ও ইন্দ্রিয়সম্ভোগ হইতে বিরত থাকেন এবং জ্ঞানগর্ভ প্রসঙ্গ শ্রবণে ও যাহারা উহা শুনিতে ইচ্ছুক তাহাদিগের নিকট ঐরূপ প্রসঙ্গ করণে কালাতিপাত করেন। শ্রোতার পক্ষে কথা বলা, কাসা কিংবা থুথুফেলা নিষেধ; এরূপ করিলে সে আত্মসংযমবিহীন বলিয়া সেই দিনই সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয়। সাঁইত্রিশ বৎসর এইরূপে জীবন ধারণ করিয়া প্রত্যেকেই আপন আপন সম্পত্তির অধিকারী হন, এবং অবশিষ্ট জীবন স্বচ্ছন্দে ও নিরুপদ্রবে যাপন করেন। তখন তাঁহারা উৎকৃষ্ট মসলিন বস্ত্র পরিধান করেন এবং হস্তে ও কর্ণে কয়েকটি স্বর্ণালংকার ধারণ করেন। তাঁহারা মাংস ভক্ষণ করেন, কিন্তু শ্রমসাধ্য কর্মে নিযুক্ত পশুর মাংস ভক্ষণ করেন না, এবং উগ্র ও অত্যধিক স্বাদু খাদ্য বর্জন করেন। তাঁহারা বহবপত্যলাভের আশায় যত ইচ্ছা তত রমণীর পাণিগ্রহণ করেন, কারণ বহু স্ত্রী থাকিলে অনেক প্রকারের সুবিধা হইয়া থাকে। আর তাঁহাদিগের ক্রীতদাস নাই, এজন্য প্রয়োজনমত উপস্থিত সন্তান-সন্তুতির সেবা তাঁহাদিগের পক্ষে একান্ত আবশ্যক।
ব্রাহ্মণগণ স্বীয় পত্নীদিগকে তাঁহাদিগের দর্শন শিক্ষা দেন না, কারণ তাহা হইলে যাহারা দুষ্টা তাহারা অপরের পক্ষে নিষিদ্ধ ঐ জ্ঞান ব্রাহ্মণেতর ব্যক্তিগণের নিকট প্রকাশ করিয়া দিবে, আর বাহারা সম্যক্ ব্যুৎপত্তি-সম্পন্না তাহারা তাঁহাদিগকে ত্যাগ করিবে। যেহতু সুখ ও দুঃখ, জীবন ও মরণ যাহার নিকট তুচ্ছ সে অপরের অধীন হইতে চাহে না; জ্ঞানী পুরুষ ও জ্ঞানবতী রমণীর ইহাই লক্ষণ।
তাঁহারা প্রায় সর্বদাই মৃত্যু সম্বন্ধে আলোচনা করেন। তাঁহারা মনে করেন ঐহিক জীবন যেন গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ-কাল; মৃত্যুই জ্ঞানিগণের পক্ষে সত্য ও আনন্দপূর্ণ জীবনে জন্ম গ্রহণ। সুতরাং তাঁহারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইবার উদ্দেশ্যে বহু প্রকার সাধন করেন। তাঁহাদিগের মতে মানুষের ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন, তাহা ভালও নহে, মন্দও নহে; ভাল মন্দ বলিয়া যাহা মনে হয় তাহা স্বপ্নকালীন অনুভূতির ন্যায় অপ্রকৃত; নতুবা একই বস্তু হইতে কাহারও বা সুথ, কাহারও বা দুঃখ বোধ হয় কেন? এবং একই বস্তু বিভিন্ন সময়ে একই ব্যক্তির বিপরীত ভাব উৎপাদন করে কেন?
এই লেখক বলেন, জড়-জগৎ সম্বন্ধে ইঁহাদিগের মত বালকোচিত, কারণ ইঁহারা যুক্তি অপেক্ষা কার্যেই অধিকতর সুদক্ষ; যেহেতু ইঁহারা যাহা বিশ্বাস করেন তাহার অধিকাংশই উপাখ্যান হইতে গৃহীত। কিন্তু অনেক বিষয়ে ইঁহারা গ্রীকদিগের সহিত একমত। কারণ গ্রীকদিগের ন্যায় ইঁহারাও বলেন যে এই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে, এবং ইহা ধ্বংসশীল ও গোলাকার। যে দেবতা ইহা রচনা করিয়াছেন ও ইহাকে নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন তিনি ইহার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। বিশ্বের মূলস্বরূপ কয়েকটি ভূত বর্তমান রহিয়াছে এবং জল হইতে এই জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে । (গ্রীক দর্শনোক্ত ক্ষিতি, অপ্, তেজঃ ও মরুৎ) এই চারি ভূত ব্যতীত একটি পঞ্চম ভূত (অর্থাৎ আকাশ) আছে, তাহা হইতেই দ্যুলোক ও তারাসমূহ সৃষ্ট হইয়াছে। পৃথিবী এই বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। জনন, আত্মা ও অন্যান্য বহু বিষয়ে ইহাদিগের ও গ্রীকদিগের মত এক। প্লেটোর ন্যায় ইঁহারাও আত্মার অমরত্ব, প্রেতলোকে বিচার ও এতদনুরূপ বিষয়ে আপনাদিগের বিশ্বাস রূপকাকারে গ্রথিত করিয়াছেন। ব্রাহ্মণদিগের সম্বন্ধে তিনি এই রূপ লিথিয়া গিয়াছেন ।
শ্রমণদিগের বর্ণনা করিতে যাইয়া তিনি লিখিয়াছেন যে ইঁহাদিগের মধ্যে যাঁহারা সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানভাজন তাঁহাদিগের নাম বনবাসী (Hylobioi অর্থাৎ বানপ্রস্থাবলম্বী)। ইঁহারা বনে বাস করেন, পত্র ও বন্য ফল ভোজন করিয়া প্রাণধারণ করেন, বৃক্ষবল্কল পরিধান করেন এবং মদ্যপান ও ইন্দ্রিয়সম্ভোগ হইতে বিরত থাকেন। নৃপতিদিগের সহিত ইঁহাদিগের বাক্যবিনিময় হইয়া থাকে; তাঁহারা দূত দ্বারা ঘটনার কারণ সম্বন্ধে ইঁহাদিগের মতামত জিজ্ঞাসা করেন এবং ইঁহাদের দ্বারাই দেবতার আরাধনা ও তাঁহার নিকট আত্মনিবেদন সম্পাদন করাইয়া থাকেন। বনবাসীদিগের পরেই বৈদ্যগণ সম্মানে দ্বিতীয়স্থানীয়, কারণ ইঁহারা মানব-প্রকৃতিতে অভিজ্ঞ। ইঁহারা সহজ জীবন যাপন করেন, কিন্তু মঠে বাস করেন না । ইঁহারা ভাত ও যব আহার করিয়া জীবন ধারণ করেন, উহা যখন ইচ্ছা চাহিলেই প্রাপ্ত হন, কিম্বা কাহারও গৃহে অতিথি হইয়া লাভ করেন। ইঁহারা ঔষধ দ্বারা রমণীকে বহু সন্তানবতী ও সন্তানকে পুরুষ কিংবা স্ত্রী করিতে পারেন। ইঁহারা সচরাচর ঔষধ অপেক্ষা পথ্য দ্বারাই আরোগ্য সম্পাদন করেন। ঔষধের মধ্যে মলম প্রলেপ সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আদরণীয়। ইঁহারা আর সমস্তই অত্যন্ত অপকারী বলিয়া বিবেচনা করেন। এই উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিগণই শ্রমসাধ্য কর্ম করিয়া ও দুঃখ সহিয়া সহিষ্ণুতা অভ্যাস করেন, সুতরাং তাঁহারা সমস্ত দিন একই অবস্থায় নিশ্চল হইয়া থাকিতে পারেন।
এতদ্ব্যতীত, গণক, যাদুকর এবং প্রেতবিদ্যা ও প্রেতশাস্ত্রবিশারদ ব্যক্তিগণ উল্লেখযোগ্য। তাহারা গ্রামে ও নগরে ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়। ইহাদিগের মধ্যে যাহারা বিদ্যা ও জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ তাহারাও পরলোক সম্বন্ধে এমনসব কুসংস্কার প্রচার করে যদ্দ্বারা তাহাদিগের মতে ধর্মভীরুতা ও পবিত্রতা বর্ধিত হয়। স্ত্রীলোকেরা তাহাদিগের সহিত জ্ঞানচর্চা করে কিন্তু ইন্দ্রিয়সেবা হইতে বিরত থাকে।