মেজদিদি/আঁধারে আলো/চার

॥চার॥

 জ্ঞানীরা কহিয়াছেন, অসম্ভব। কাণ্ড চোখে দেখিলেও বলিবে না, কারণ, অজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে না। এই অপরাধেই শ্রীমন্ত বেচারা নাকি মশানে গিয়াছিল। সে যাই হোক, ইহা অতি সত্য কথা, সত্য পাকটি সেদিন বাসায় ফিরিয়া টেনিসন্‌ পড়িয়াছিল এবং ডন্‌ জুয়ানের ব্যাংলা তর্জমা করিতে বসিয়াছিল। অতবড় ছেলে, কিন্তু একবারও এ ংশয়ের কণামাত্রও তাহার মনে উঠে নাই যে, দিনের বেলা সহরের থে-ঘাটে এমন অদ্ভূত প্রেমের বান ডাকা সম্ভব কি না, কিংবা সে বানের স্রোতে গা ভাসাইতে চলা নিরাপদ কি না।

 দিন-দুই পরে স্নানান্তে বাটী ফিরিবার পথে অপরিচিতা সহসা কহিল, কাল রাত্রে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলুম, সরলার কষ্ট দেখলে বুক ফেটে যায়-না?

 সত্য সরলার প্লে দেখে নাই, স্বর্ণলতা বই পড়িয়াছিল; আস্তে। আস্তে বলিল, হাঁ বড় দুঃখ পেয়েই মারা গেল।

 রমণী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, উঃ, কি ভয়ানক কষ্ট। আচ্ছা সরলাই বা তার স্বামীকে এত ভালবাসলে কি করে, আর তার বড় জা-ই বা পারেনি কেন বলতে পার?

 সত্য সংক্ষেপে জবাব দিল, স্বভাব।

 রমণী কহিল, ঠিক তাই! বিয়ে তা সকলেরই হয়, কিন্তু সব স্ত্রী পুরুষই কি পরস্পরকে সমান ভালবাসতে পারে? পারে না। কিন্তু লোক আছে, মরবার দিনটি পর্য্যন্ত ভালবাসা কি, জানতেও পায় না। জানিবার ক্ষমতা তাদের থাকে না। দেখনি, কত লোক গান-বাজন হাজার ভাল হলেও মন দিয়ে শুনতে পারে না, কত লোক কিছুতেই রাগে না। —রাগতেই পারে না! লোকে তাদের খুব গুণ গায় বটে, আমার কিন্তু নিন্দে করতে ইচ্ছা করে।

 সত্য হাসিয়া বলিল, কেন?

 রমণী উদ্দীপ্ত কণ্ঠে উত্তর করিল, তারা অক্ষম বলে। অক্ষমতার কিছু কিছু গুণ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু দোষটাই বেশী। এ যেমন সরলার ভাশুর, স্ত্রীর অতবড় অত্যাচারেও তার রাগ হ’ল না।

 সত্য চুপ করিয়া রহিল।

 সে পুনরায় কহিল, আর তার স্ত্রী, ঐ প্রমদাটা কি শয়তান মেয়েমানুষ! আমি থাকতুম ত রাক্ষসীর গলা টিপে দিতুম।

 সত্য সহস্যে কহিল, থাকতে কি করে? প্রমদা বলে সত্যই কেউ ছিল না-কবির কল্পনা-

 রমণী বাধা দিয়া কহিল, তবে অমন কল্পনা করা কেন? আছ সবাই বলে, সমস্ত মানুষের ভেতরই ভগবান আছেন, আত্মা আছে কিন্তু প্রমদার চরিত্র দেখলে মনে হয় না যে, তার ভেতরেও ভগবান ছিলেন। সত্যি বলচি তোমাকে, কোথায় বড় বড় লোকের বই পড়ে মানুষ ভাল হবে, মানুষকে মানুষ ভাল বাসবে, তা-না, এমন বই লিখে দিলেন যে, পড়লে মানুষের ওপর মানুষের ঘৃণা জন্মে যায়-বিশ্বাস হয় না যে সত্যিই সব মানুষের অন্তরেই ভগবানের মন্দির আছে।

 সত্য বিস্মিত হইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, তুমি বুঝি খুব বই পড়?

 রমণী কহিল, ইংরাজী জানি নে ত, বাংলা বই যা বেরোয় সব পড়ি। এক-একদিন সারারাত্রি পড়ি-এই যে বড় রাস্তা-চল আমাদের বাড়ি, যত বই আছে সব দেখাব।

 সত্য চমকিয়া উঠিল—তোমাদের বাড়ি?

 হাঁ, আমাদের বাড়ি-চল, যেতে হবে তোমাকে।

 হঠাৎ সত্যর মুখ পাণ্ডুর হইয়া গেল, সভয়ে বলিয়া উঠিল, না না, ছি ছি,

 ছি ছি কিছু নেই-চল!

 না না, আজ না-আজ থাক্‌ বলিয়া সত্য কম্পিত দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। এই অপরিচিত প্রেমাস্পদার উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধার ভারে আজ তাহার হৃদয় অবনত হইয়া রহিল।