মেজদিদি/আঁধারে আলো/তিন

॥তিন॥

 রমণী প্রত্যহ অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান করিতে আসেন, সত্য তাহা বুঝিয়া লইয়াছিল। এতদিন যে উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটে নাই, তাহার একমাত্র হেতু পূর্বে সত্য কতকটা বেলা করিয়াই স্নানে আসিত।

 জাহ্নবীতটে উপর্য্যুপরি আজ সাতদিন উভয়ের চারি চক্ষু মিলিয়াছে, কিন্তু যেখানে চাহনিতে কথা হয়, সেখানে মুখের কথাকে মূক হইয়া থাকিতে হয়। এই অপরিচিত রূপসী যেই হোন, তিনি যে চোখ দিয়া কথা কহিতে শিক্ষা করিয়াছেন, এবং সে-বিদ্যায় পারদর্শী সত্যর অন্তর্য্যামী তাহা নিভৃত অন্তরের মধ্যে অনুভব করিতে পারিয়া ছিল।  সেদিন স্নান করিয়া সে কতকটা অন্যমনস্কের মত বাসায় ফিরিতেছিল, হঠাৎ তাহার কানো গেল, ‘একবার শুনুন।’ মুখ তুলিয়া দেখিল, রেলওয়ে লাইনের ওপারে সেই রমণী দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার বাম বক্ষে জলপূর্ণ ক্ষুদ্র পিতলের কলস, দক্ষিণ হস্তে সিক্তবস্ত্র। মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে আহ্বান করিলেন। সত্য এদিক-ওদিক চাহিয়া কাছে গিয়া দাঁড়াইল, তিনি উৎসুক-চক্ষে চাহিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, আমার ঝি আজ আসেনি, দয়া করে একটু যদি এগিয়ে দেন ত বড়ো ভাল হয়।

 অন্যদিন তিনি দাসী সঙ্গে করিয়া আসেন, আজ একা। সত্যের মনের মধ্যে দ্বিধা জাগিল, কাজটা ভাল নয় বলিয়া একবার মনেও হইল, কিন্তু সে ’না’ বলিতে পারিল না। রমণী তাহার মনের ভাব অনুমান করিয়া একটু হাসিলেন। এ হাসি যাহারা হাসিতে জানে, সংসারে তাহদের অপ্রাপ্য কিছুই নাই। সত্য তৎক্ষণাৎ 'চলুন' বলিয়া উহার অনুসরণ করিল। দুই-চারি পা অগ্রসর হইয়া রমণী আবার কথা কহিলেন, ঝির অসুখ, সে আসতে পারলে না, কিন্তু আমিও গঙ্গাস্নান না করে থাকতে পারি নে,—আপনারও দেখচি এ বদ্‌ অভ্যাস আছে।

 সত্য আস্তে আস্তে জবাব দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিও প্রায় গঙ্গাস্নান করি।

 এখানে কোথায় আপনি থাকেন?

 চোরবাগানে আমার বাসা।

 আমাদের বাড়ি জোড়াসাঁকোয়। আপনি আমাকে পাথুরেঘাটায় মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বড় রাস্তা হয়ে যাবেন।

 তাই হবে।

 বহুক্ষণ আর কোন কথাবার্ত হইল না। চিৎপুর রাস্তায় আসিয়া রমণী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আবার সেই হাসি হাসিয়া বলিলেন, কাছেই আমাদের বাড়ি-এবারে যেতে পারব।—নমস্কার।  নমস্কার, বলিয়া সত্য ঘাড় গুঁজিয়া তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। সেদিন সমস্ত দিন ধরিয়া তাহার বুকের মধ্যে যে কি করিতে লাগিল, সে কথা লিখিয়া জানান অসাধ্য। যৌবনে পঞ্চশরের প্রথম পুষ্পবাণের আঘাত যাঁহাকে সহিতে হইয়াছে, শুধু তাঁহারই মনে পড়িবে, শুধু তিনিই বুঝিবেন, সেদিন কি হইয়াছিল। সবাই বুঝিবেন না, কি উন্মাদ নেশায় মাতিলে জল-স্থল, আকাশ-বাতাস-সব রাঙা দেখায়, সমস্ত চৈতন্য কি করিয়া চেতনা হারাইয়া, একখণ্ড প্রাণহীণ, চুম্বকশলাকার মত শুধু এই একদিকে ঝুঁকিয়া পড়িবাব জন্য অনুক্ষণ উন্মুখ হইয়া থাকে।

 পরদিন সকালে সত্য উঠিয়া দেখিল, রোদ উঠিয়াছে। একটা ব্যথার তরঙ্গ তাহার কণ্ঠ পর্য্যন্ত আলোড়িত করিয়া গড়াইয়া গেল; সে নিশ্চিত বুঝিল, আজিকার দিনটা একেবারে ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। চাকরটা সুমুখ দিয়া যাইতেছিল, তাহাকে ভয়ানক ধমক দিয়া কহিল, হারামজাদা, এত বেলা হয়েচে, তুলে দিতে পারিসনি? যা তোর এক টাকা জরিমানা।

 সে বেচারা হতবুদ্ধি হইয়া চাহিয়া রহিল। সত্য দ্বিতীয় বস্ত্র না লইয়াই রুষ্ট-মুখে বাসা হইতে বাহির হইয়া গেল।

 পথে আসিয়া গাড়ি ভাড়া করিল এবং গাডোয়ানকে পাথুরেঘাটার ভিতর দিয়া হাঁকাইতে হুকুম করিয়া, রাস্তার দু-দিকে প্রাণপণে চোখ পাতিয়া রাখিল। কিন্তু গঙ্গায় আসিয়া ঘাটের দিকে চাহিতেই তাহার সমস্ত ক্ষোভ যেন জুড়াইয়া গেল, বরঞ্চ মনে হইল, যেন অকস্মাৎ পথের উপরে নিক্ষিপ্ত একটা অমূল্য রত্ন কুড়াইয়া পাইল।

 গাড়ি হইতে নামিতেই তিনি মৃদু হাসিয়া নিতান্ত পরিচিতের মত বলিলেন, এত দেরি যে? আমি আদ্‌ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি-শিগগির নেয়ে निन, আজও আমার ঝি আসেননি।

 এক মিনিট সবুর করুন, বলিয়া সত্য দ্রুতপদে জলে গিয়া নামিল। সাঁতার কাটা তাহার কোথায় গেল। সে কোনমতে গোটা দুই-তিন ডুব দিয়া ফিরিয়া আসিয়া কহিল, আমার গাড়ি গেল কোথায়?

 রমণী কহিলেন, আমি তাকে ভাড়া দিয়ে বিদেয় করেচি।

 আপনি ভাড়া দিলেন!

 দিলামই বা। চলুন। বলিয়া আর একবার ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া অগ্রবর্তিনী হইলেন।

 সত্য একেবারেই মরিয়াছিল, না হইলে যত নিরীহ, যত অনভিজ্ঞই হৌক, একবার সন্দেহ হইত-এ সব কি!

 পথ চলিতে চলিতে রমণী কহিলেন, কোথায় বাসা বললেন, চোরবাগান?

 সত্য কহিল, হ্যাঁ।

 সেখানে কি কেবল চোরেরাই থাকে?

 সত্য আশ্চর্য হইয়া কহিল, কেন?

 আপনি ত চোরের রাজা। বলিয়া রমণী ঈষৎ ঘাড় বাঁকাইয়া কটাক্ষে হাসিয়া আবার নির্বাক মরাল-গমনে চলিতে লাগিলেন। আজ কক্ষের ঘট অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ছিল, ভিতরে গঙ্গাজল ছলাৎ-ছল্‌ ছলাৎ-ছল্‌ শব্দে-অর্থাৎ ওরে মুঢ়-ওরে অন্ধ যুবক। সাবধান। এ-সব ছলনা-সব ফাঁকি, বলিয়া উছলিয়া একবার ব্যঙ্গ, একবার তিরস্কার করিতে লাগিল।

 মোড়ের কাছাকাছি আসিয়া সত্য সসঙ্কোচে কহিল, গাড়ি ভাড়াটা-

 রমণী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া অফুট মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, সে ত আপনার দেওয়াই হয়েচে।

 সত্য এই ইঙ্গিত না বুঝিয়া প্রশ্ন করিল, আমার দেওয়া কি করে?

 আমার আর আছে কি দেব! যা ছিল সমস্তই তুমি ত চুরিডাকাতি করে নিয়েচ। বলিয়াই সে চকিতে মুখ ফিরাইয়া, বোধ করি উচ্ছ্বসিত হাসির বেগ জোর করিয়া রোধ করিতে লাগিল।

 অভিনয় সত্য দেখিতে পায় নাই, তাই এই চুরির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তীব্র তড়িৎরেখার মত তাহার সংশয়ের জাল আপ্রান্ত বিদীর্ণ করিয়া বুকের অন্তস্থল পর্য্যন্ত উদ্ভাসিত করিয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্ত্তে সাধ হইল, এই প্রকাশ্য রাজপথেই ওই দুই রাঙা পায়ে লুঢ়াইয়া পড়ে, কন্তু চক্ষের নিমিষে গভীর লজ্জায় তাহার মাথা এমনি হেঁট হইয়া গল যে, সে মুখ তুলিয়া একবার প্রিয়তমার মুখের দিকে চাহিয়া দখিতেও পারিল না, নিঃশব্দে নতমুখে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

 ও-ফুটপাতে তাঁহার আদেশমত দাসী অপেক্ষা করিতেছিল, কাছে আসিয়া কহিল, আচ্ছা দিদিমণি, বাবুটকে এমন করে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? বলি, কিছু আছে টাছে? দু’পয়সা টানতে পারবে তা?

 রমণী হাসিয়া বলিল, তা জানি নে, কিন্তু হাবা-গোবা লোকগুলোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরোতে আমার বেশ লাগে।

 দাসীটিও খুব খানিকটা হাসিয়া বলিল, এতও পার তুমি। কিন্তু তাই বল দিদিমণি, দেখতে যেন রাজপুত্তুর। যেমন চোখ-মুখ, তেমনি ঙ। তোমাদের দুটিকে দিব্যি মানায়-দাঁড়িয়ে কথা কছিল, যেন একটি জোড়া-গোলাপ ফুটে ছিল।

 রমণী মুখ টিপিয়া বলিল, আচ্ছা চল্‌। পছন্দ হয়ে থাকে ত না য় তুই নিস্‌।

 দাসীও হটবার পাত্রা নয়, সেও জবাব দিল, না দিদিমণি, ও জনিস প্রাণ ধরে কাউকে দিতে পারবে না, তা বলে দিলুম।