মেয়েলি ব্রত ও কথা/ক্ষেত্র
ক্ষেত্র ব্রত।
এই ব্রত অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম শনিবারে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। পশ্চাদুক্ত “বুড়াঠাকুরাণীর ব্রত”ও এই। শনিবারে করিতে হয়।
ক্ষেত্রব্রত কৃষিজীবিদের কল্যাণ কামনায় উদ্ভাবিত হইয়াছে। কৃষিকর্ম্মের প্রতি কমলার অর্দ্ধ দৃষ্টি চির প্রসিদ্ধ। একমাত্র শস্যের অভাবে পৃথিবীর অন্য সুখ-সম্পদ বিফল। অগ্রহায়ণ মাস হইতে যোষিৎ প্রচলিত বার-ব্রতাদির গণনা আরম্ভ হয়। অগ্রহায়ণেই ব্রত সংখ্যা বেশী। বিবাহিতা কুলকামিনী অগ্রহায়ণে সর্ব্ব প্রথম ক্ষেত্রব্রতে দীক্ষিতা হইলে তাঁহার অন্যান্য গার্হস্থ্য ব্রতে অধিকার লাভ হয়। ইহা অগ্রে না করিয়া অগ্রহায়ণে কর্ত্তব্য অন্যান্য বারব্রতাদি করা নিস্ফল। ক্ষেত্রব্রত যদি কোন বৎসর অগ্রহায়ণের শেষভাগে নিরূপিত হয়, তবে অগ্রহায়ণের অন্যান্য ব্রত মাঘমাসে করিবে। শস্যপ্রাচুর্য্য বশতঃ মাতৃভূমি মার্গশীর্ষে নূতন সৌন্দর্য্যে উদ্ভাসিত, সুতরাং ক্ষেত্র দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই উপযুক্ত সময়।
কৃষক নেহাৎ “চাষা” কিম্বা “ভদ্র”? ইহার উত্তরে এখন আর দুই মত হইতে পারে না। কারণ, সম্প্রতি কতিপয় কমলার প্রিয়-পুত্র জমিদার ও বাণী-পুত্র মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত স্বহস্তে একযোগে হলচালনা করিয়া একবাক্যে উক্ত প্রশ্নের সমাধান করিয়া দিয়াছেন। হংস-পুচ্ছ অপেক্ষা লাঙ্গলের গুরুভার দেখিয়া কেহ ভ্রমক্রমে কৃষিকর্ম্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ না করেন, এই জন্যই গজেন্দ্র-বদনের অগ্রপূজার ন্যায়, ক্ষেত্রব্রত সর্ব্বাগ্রে কর্ত্তব্য এইরূপ বিধি প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকিবে।
নূতন ধান্যের প্রস্তুত মুড়ি, মুড়কি, চা’ল ভাজা, ছাতু প্রভৃতি পূজার বিশিষ্ট নৈবেদ্য। একখানি কুলার উপর ছাতু দ্বারা ক্ষেত্র দেবতার মূর্ত্তি রচিত হয়। পুরোহিত ক্ষেত্রপাল দেবতার পূজা করেন। গৃহকর্ত্রী অন্নাহার না করিয়া পূজান্তে দধি-দুগ্ধ ফল মূলাদি ভোজন করিবেন।
ক্ষেত্র ব্রত কথা।
এক গরীব চাষীর ছেলে। তার মা বাপ নাই। এজন্যে সে মামার বাড়ীতে থাকতো। মামা ও মামী তাকে ভাল বাসতেন না। ছেলেটীকে মামাদের ক্ষেতে সারাদিন দা, কোদাল ও লাঙ্গল নিয়ে খুব খাটতে হতো। বাড়ীতে ফিরে এলেও দা ও কোদাল রেখে তার একটুও বিশ্রাম করবার সময় হতো না। পাড়া পড়শীরা এজন্য তাকে “দা-কোদালে” ব’লে ডাকতো। “দা-কোদালে’ বালক হলেও ক্ষেত্র দেবতার বিশে ভক্ত ছিল। তারই পুণ্যের জোরে তার মামার ক্ষেত-ভরা ফসল জন্মাতে। কিন্তু এত যে খাটুনি তবু সে কোন দিন পেট পুরে খেতে পেতো না। আধপেটা খেয়ে থাকতো। ক্ষুধার সময় কিছু চিড়ে, মুড়ি, ছাতু পেলেও অর্দ্ধেক ক্ষেত্রদেবতাকে নিবেদন ক’রে বাকী টুকু নিজে খেতে। মামার গোয়াল ভরা গোরু, পাল ভরা মোষ; ঘরে দই, দুধ, ক্ষীর সর অনেক। ছেলে মানুষ, বিশেষ বুদ্ধি শুদ্ধি নাই; সে একদিন ঘরে বেশী দুধের সর দেখে একটু খেতে চাইলে। মামী বল্লে, হতভাগা ছেলে কোথাকার, তোর জন্যে কি আর ঘরে দুধের সর রাখতে পারবো। রোজগার নাই, সর খেতে চাওয়া, কি আমার কেঃ ঠাকুর গো!
দা-কোদালের মনে বড় দুঃখ হলো। ক্ষেত্র দেবতা ভাবলেন, এই ছেলেটী ছাড়া আর কেউ আমায় ভক্তি করে না। বালকের ভক্তি দেখে, তিনি তাকে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে দেখা দিয়ে বল্লেন, বাছা, আমার কথা শোন। আর পরের গোলামী করা কেন; যাও তুমি এখনি তোমার মামার বাড়ী ত্যাগ ক’রে অই যে খুব দূরে এক প্রকাও মাঠ দেখতে পাচ্ছ সেইখানে কুঁড়েঘর ক’রে চাষ-বাস করগে। তোমার দুঃখ দূর হবে। দা-কোদালে তাই কল্লে। তার পর অগ্রহায়ণ মাস শনিবার, সে ভোরে উঠে দেখলে, তার ক্ষেতে ধান তো নয়, সবই সোণা! ক্ষেত্র দেবতার কৃপায় তখনই তার কুঁড়েঘর রাজ অট্টালিকা হয়ে গেল। দা-কোদালে রাজা হলেন, অট্টালিকায় রাজার হালে বাস কত্তে লাগলেন। তাঁর এখন ঐশ্বর্য্যের সীমা নাই।
এদিকে, ভাগনে চ’লে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষী মামাদের ঘর ত্যাগ কল্লেন। তারা ভাতের কাঙ্গাল হয়ে পড়লো। ক্ষেত্র দেবতার কোপে দেশে দারুণ দুর্ভিক্ষ ও জলকষ্ট হলো। দা-কোদালে এখন বড়লোক হলেও গরীবের প্রতি তাঁর বড় দয়া। তিনি অনেক পুকুর কাটাতে লাগলেন। যারা মজুরী কত্তে আসতো তাদের অকাতরে অন্ন দান করতেন। খেতে না পেয়ে তাঁর মামা মামীও অন্নসত্রে এসেছিল। তারা কোদাল হাতে করে পুকুরের কাজে যাবে এমন সময়ে দা-কোদালে তাদের দেখে চিনতে পেয়ে চাকর-বাকরদের হুকুম দিলেন, শীগগির পুরুষ ও স্ত্রীলোক মজুর দু’টীকে স্নান করিয়ে নূতন কাপড় পরিয়ে বাড়ীর ভেতর নিয়ে এস। মামা ও মামী ভয়ে অস্থির। রাজার পুকুরে কি জল হচ্ছে না? রাজ বাড়ীতে তো কালীমন্দির নাই? তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। মামা ও মামীকে সঙ্গে ক’রে একত্র আহার করবেন মনে ক’রে দা-কোদালে খাবার ঘরে তিনটী জায়গা করালেন। পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভাত দেখে মামা ও মামীর চক্ষু স্থির। তার পর রাজা এলেন। “ওঃ হরি! ‘রাজা’ তো নয়, আমাদের সেই দা-কোদালে!” এই ব’লে মামা ও মামীর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। তাদের তখন আহ্লাদের সীমা নাই।
মামা রাজসংসারের কর্ত্তা হলেন। দা-কোদালের এখন আদর যত্ন কত! এটা খাও, ওটা খাও ব’লে মামী ভাগনেকে কেবলি দু’বেলা দই দুধ ক্ষীর সন্দেশ ও দুধের সর খাওয়াতেন। খাব না বল্লেও ছাড়েন না। একদিন বেশী দুধের সর দেখে দা-কোদালে মামীকে রহস্য করে বলেন,
সেই মামা সেই মামী পুকুর পাড়ে ঘর।
এখন কেন মামা মামী দুধে এত সর॥
মামী লজ্জিত হলেন। তার পর দা-কোদালে এক রাজকন্যা বিবাহ কল্লেন। তাঁরা ক্ষেত্র দেবতার ব্রত পৃথিবীতে প্রচার কল্লেন। এ ব্রত কল্লে ক্ষেতে ধান হয়, ধন জন হয়, দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।
প্রণাম। ক্ষেত্রপাল নমস্তুভ্যং হলধরং বরপ্রদং।
ঈতি-ভয় হরংদেবং ত্বাং সদা প্রণমাম্যহং।