মেয়েলি ব্রত ও কথা/বুড়াঠাকুরাণী
বুড়াঠাকুরাণী ব্রত।
ক্ষেত্র ও “বুড়াঠাকুরাণী” ব্রত এক দিনেই কর্ত্তব্য। রমণীদের বিশ্বাস, এ দুইটা ব্রত না করিলে অন্যান্য বারব্রতের অনুষ্ঠান নিষ্ফল।
বুড়া ঠাকুরাণী বা বনদেবী মহাদেবের প্রিয় কন্যা। বনে ইঁহার অধিষ্ঠান। এজন্য অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণে সেওড়া ও জবাফুলের গাছের ক্ষুদ্র শাখা পুঁতিয়া কল্পনার সাহায্যে অরণ্য সৃজন করিতে হয়। একটা “পুকুর” খনন করিয়া উহার চতুঃপার্শ্বে পিটুলি গুলিয়া আলিপনা দিবে। কদলীপত্রের ডাঁট ৯|১০ অঙ্গুলী পরিমাণে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া লইবে। অতঃপর সাদা হল্দে ও লাল এই তিন রঙ্গের পিটুলি জলে না গুলিয়া তদ্বারা অর্দ্ধবৃত্তাকারে শাখা গঠন পূর্ব্বক পূর্ব্বোক্ত এক খণ্ড কলা পাতার ডাঁটের উপর স্থাপন করিবে। শাঁখার জমিন সাদা, ও দুই দিকে লাল ও হল্দে পাড়। এইরূপ দুইটা বা এক জোড়া শাঁখা একটা ডাঁটের উপর রাখিবে। ব্রতিনীগণ প্রত্যেকে এক জোড়া শাঁখা হাতে তুলিয়া কথা শ্রবণ করিবেন। তৎপর লাল পিটুলি জলে গুলিয়া কতকটা উক্ত সেওড়া ও জবার ডালের গােড়ায় ও বাকীটুকু “পুকুরে” ঢালিয়া দিবে।
পুরােহিত বনদুর্গার পূজা করিয়া থাকেন। নৈবেদ্যের প্রধান উপকরণ দই, দুধ, কলা এবং কলাপাতার উপর রক্ষিত মুড়ি, মুড়কি, মােয়া, ছাতু, লাড়ু ইত্যাদি।
বুড়াঠাকুরাণী-ব্রত কথা।
পার্ব্বতী দুঃখ ক’রে মহাদেবকে বােল্চেন, তুমি দু’দিন যাবৎ ভিক্ষা করতে বেরােও নাই; এমনি ক’রে বসে থাকলে সংসার চল্বে কিরূপে? মনে করেছিলেম তােমাকে কিছু বলবো না; না বলেই বা কি করি। বাপের বাড়ীর গহনা-গাঁটী যা ছিল তা দিয়েই এদ্দিন কষ্টে শ্রেষ্টে চালিয়েছি। শাঁখা পরবার সাধ ছিল, তাই তুমি এ পর্য্যন্ত দিতে পাল্লে না। তা মরুক গে, এখন এদিকে ঘরে চাল নাই, ডাল নাই, তোমাকে কি খাওয়াব আর ছেলে দু’টীর মুখেই বা কি দি। অপরে আমার সামনে তোমার নিন্দে করে তা আমি প্রাণ থাকতে সইতে পারবো না; কিন্তু নিজে দুটো কথা না ব’লেও পারি না। কি সুখে আছি’ তা কা’কে বলি। ছেলে দু’টী মানুষ হলে ভাবনা ছিল না। গণেশকে তুমি নিজের যুগ্যি ক’রে তুলেছ, সে সিদ্ধি দিচ্ছে আর তুমি তাই খাচ্ছ। আর ছোটটী কেবল ময়ুর চ’ড়ে বেড়াচ্ছে। স্বামী পুত্র আমার কষ্ট বুঝলে না। একটী মেয়ে থাকতো তবে মনের কষ্ট বুঝতে পারতো। এই ব’লে পার্ব্বতী চোকে আঁচল দিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলেন।
তা’ শুনে মহাদেব বোলচেন, গৌরি, কৈলাসে কিছু অভাব আছে? চা’দ্দিকে যা দেখচো সবই তো আমার। পার্ব্বতী বোলচেন, যা কিছু অভাব, অন্নবস্ত্রের। তুমি বাঘ ছাল পর, বিষ খাও, যা ইচ্ছে তাই কর; ছেলে দু’টীকে নিয়ে আমি আজই বাপের বাড়ী চলে যাব। এই ব’লে তিনি হিমালয়ে চলে গেলেন।
কৈলাসে কোন অভাব নাই; কিন্তু এক পার্ব্বতীর অভাবে মহাদেবের চা’দ্দিক শূন্য বোধ হ’তে লাগলো। কিন্তু বিনা নিমন্ত্রণে শ্বশুর বাড়ী যাওয়া অপমান। আর গিরিরাজের অন্তঃপুরে ঢুকে পার্ব্বতীর সঙ্গে দেখা করবার উপায় কি? অনেক ভেবে চিন্তে এক মৎলব ঠাওরালেন। মহাদেবের মনে হলো, পার্ব্বতী শাঁখা পরতে চেয়েছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ শাঁখারির বেশ ধারণ করে গিরিরাজের বাড়ী উপস্থিত হলেন।
শাঁখারি এসেছে শুনে পার্ব্বতী বড় সুখী হ’লেন। রাণী মেনকা শাঁখারিকে বাড়ীর ভেতর আনালেন। পার্ব্বতী একটু ঘোমটা টেনে, কঙ্কণ খুলে শুধু-হাতের উপর খানিকটা আঁচল জড়িয়ে শাঁখা পরতে বসলেন। শাঁখারির আনন্দের সীমা নাই। শাঁখা পরানো আর ফুরোয় না। কতবার হাত টিপচেন, তেল মাখাচ্চেন, শাঁখা পরাচ্চেন, খুলচেন, মাজা-ঘসা কচ্চেন। পার্ব্বতীকে দেখে মহাদেবের আশ মিটে না।
নূতন শাঁখা প’রে পার্ব্বতী মাতাকে প্রণাম কল্লেন। শাঁখারি মেনকা রাণীকে বল্লেন, আমি দাম চাইনে; বেলা হয়েছে, যদি অনুমতি হয় তবে এখানেই আজ স্নানাহার করবো। পার্ব্বতী শাঁখা পরবার সময়েই মহাদেবকে চিনেছেন। তিনি পরম যত্নে শাঁখারির স্নানের উয্যুগ করে, নিজে রেঁধে নিজ হাতে পরিবেশন করলেন।
দেবতার চরিত্র মানুষের বুঝবার সাধ্য কি। সেই দিন রাত্রে মহাদেব নিজ মূর্ত্তিতে পার্ব্বতীর শয়ন ঘরে দেখা দিলেন। পার্ব্বতী বলেন, তোমার হাতের স্পর্শ পেয়েই আমি তোমাকে শাঁখা পরবার সময় চিনতে পেরেছি। তোমার তখন ছদ্মবেশে আসা ভাল হয়নি। মহাদেব বল্লেন, নিমন্ত্রণ না পেলে আমি এখানে আসি কি ক’রে? সেই রাত্রে দ্বাদশ দণ্ডের ভিতর পার্ব্বতীর এক কন্যা প্রসব হলো। পার্বতী চিন্তিত হয়ে বল্লেন, তুমি এখানে এসেছ তা এখন মা-বাপের কাছে না ব’লে উপায় কি? জান তো এ স্বর্গ নয়; মর্ত্তে আছি। মহাদেব বল্লেন, তোমার সে ভয় নাই, আমি এখনি মেয়েটীকে সঙ্গে ক’রে কৈলাসে যাচ্ছি। মহাদেব তাই কল্লেন। কিন্তু কতদুর রাস্তায় গিয়ে মেয়েটী বল্লে, মা’কে না দেখে থাকতে পারবো কেন, আমি মর্ত্ত্যেই থাকবো মহাদেব ছোট মেয়েটীকে আদর করে “বুড়ী” বলে ডাকতেন। বুড়ীর কথায় তিনি বল্লেন, আচ্ছা তাই হোক। এই ব’লে এক বনে গিয়ে এক সেওড়াগাছ তলায় তাকে রেখে দিলেন। বল্লেন, বুড়ী তুমি এখানেই থাক। তুমি পৃথিবীতে বনদেবী ব’লে পূজো পাবে। তোমার ব্রত না করলে অন্য ব্রত করা নিষ্ফল হবে।
মহাদেব ভাবলেন, পার্ব্বতী কার্ত্তিক গণেশকে ফেলে আমি একা এখন কৈলাসে যাই কি ক’রে। কিছুদিন মর্ত্ত্যেই থাকবো। বুড়ী তো মর্ত্ত্যের বনদেবী হ’লেন। তাকেও মাঝে মাঝে দেখা উচিত। এই ভেবে তিনি নিকটেই ছদ্মবেশে এক মুদীর দোকান ক’রে রইলেন।
সেই পথে একদিন একটী দুঃখী মেয়ে বাজারে চূণ বিক্রী কত্তে যাচ্ছিল। তার মাথায় এক চূণের মালশা। বনদেবী “বুড়া ঠাকুরাণী” তাকে ডাকলেন। সে চূণের মালশা নামিয়ে আশ্চর্য্য হয়ে দেখে, চূণতো নয়, সব দই! বনদেবী বল্লেন, আমার বড় খিদে পেরেছে, তোমায় এই কড়িটী দিচ্ছি, তুমি দই রেখে মুদী দোকান থেকে চিড়ে, মুড়ি, চিনি, দুধ, মেঠাই এনে দাও। সে ভাবতে লাগলো একটা কড়িতে বেশী কি পাব। কিন্তু মুদীর দোকানে কড়িটি দিতেই “মুদী” কত জিনিষ দিলেন, তা ব’লে শেষ করা যায় না। মেয়ে-মানুষটি লোকজন নিয়ে একে একে সব জিনিষ বনদেবীর কাছে বয়ে দিয়ে এলো। বনদেবী সামান্য একটু খেয়ে সব জিনিষ মেয়ে মানুষটিকে দিলেন। আর তাকে এক মালশা সোণা দিলেন। তখন সেই বনে লােকে লােকারণ্য হলো। বনদেবী আদেশ দিলেন, আমি মহাদেবের কন্যা; অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে শনিবারে আমার পূজা করিলে অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন হয়, ছেলে মেয়ের ব্যারাম পীড়া হয় না, সকলে সুখে থাকে, আর হরপার্ব্বতী তুষ্ট হন।
প্রণাম। বনদুর্গা বনস্থাচ বনমালা বিভূষিতা।
শঙ্করস্য প্রিয়পুত্রী বনদেবি নমােস্তুতে।