মেয়েলি ব্রত ও কথা/ইতু-রা’ল
ইতু-রা’ল ব্রত।
অগ্রহায়ণ মাসে “ক্ষেত্র” ও “বুড়াঠাকুরাণী” ব্রতের পরদিন (রবিবার) এই ব্রত করিতে হয়। এক বাড়ীতে দু’চার জন মহিলা একত্র হইয়া ইতু-রা’ল ব্রত করিবে; একা করিবে না। প্রত্যেক ব্রতচারিণী বিয়াল্লিশটা আতপ-তণ্ডুল নখ দ্বারা খুঁটিয়া লইবেন। পাঁচ মেয়ে একত্র হয়েছেন, এবং এতগুলি তণ্ডুল খুঁটিয়া লওয়া কিঞ্চিৎ সময় সাধ্য, ব্রতের উপাখ্যানও বড়। এজন্য তাঁহারা এই সময়েই নিম্নোক্ত ব্রত কথা শ্রবণ করেন। পূজান্তে এত কথা স্মরণ করিয়া ভূতলে একটা আঁচড় কাটিলেই পুনরায় কথা শ্রবণ আবশ্যক হয় না।
মঙ্গলচণ্ডীর শেখর বা অর্ঘ্যের ন্যায় এ ব্রতেও অর্ঘ্য নির্ম্মাণ করিতে হয়। কিন্তু কলাপাতার পরিবর্ত্তে পিটুলির এক ডেলা প্রস্তুত করিয়া তাহার ভিতর আতপ তণ্ডুল ও দুর্ব্বা স্থাপন করিবে। প্রতি ব্রতিনীর জন্য এইরূপ দুইটী পিটুলি-পিণ্ডের অর্ঘ্য আবশ্যক। প্রতি অর্ঘ্যে একুশগাছি দুর্ব্বা স্থাপন করিতে হয়। একটী অর্ঘ্যের নাম দুয়ােরাজ, অন্যটী সুয়ােরাজ। একটীর ভিতর পূর্বোক্ত বিয়াল্লিশটা আতপ-চা’লের অর্দ্ধেক (একুশ) দিতে হইবে, অপরটিতে একুশটি ধান দিবে। অবশিষ্ট একুশটি আতপ চা’ল আলাহিদা রাখিয়া দিবে। তার পর পূজা হইয়া গেলে পিটুলি দ্বারা একুশটী পুলি (বা “দইলা”) প্রস্তুত করিবে। উহার কুড়িটী ছােট এবং একটী বড় বর্ত্তুলাকার। এই বড়টীর ভিতর পূর্ব্বোক্ত অবশিষ্ট একুশটী আলাে চা’ল দিবে। পূজান্তে রন্ধনের সময় এইগুলি ভাতের সঙ্গে সিদ্ধ করিবে। পুরােহিত পূর্ব্বাহ্নে সূর্য্যের পূজা করিবেন। পূজান্তে ব্রতচারিণীগণ উল্লিখিত একুশটী পুলি ভক্ষণ ও ডাল সিদ্ধ ভাতেভাত আহার করিবেন। কথা শ্রবণের পর প্রণাম যথা;
জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং।
ইতু-রা’ল ব্রত কথা।
এক গরীব ব্রাহ্মণ। তাঁর গৃহ শূন্য। দু’টী পরমা সুন্দরী অবিবাহিতা ছােট কন্যা ছাড়া সংসারে তাঁর আর কেউ নাই। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পান তাতেই অতিকষ্টে দিন চলে।
একদিন মেয়েরা ভিক্ষার ধান কয়টী রােদে শুকুতে দিয়ে খেলা কচ্ছিল; কতগুলি পায়রা উড়ে এসে সব ধান খেয়ে ফেলে। মেয়ে দু’টি কাঁদতে লাগলাে। তারা মনে কল্লে, বাবা সারাদিন পরে বাড়ী এলে, তাঁকে কি রেঁধে খাওয়াব, আর আমরাই বা কি খাব। রাগে ও দুঃখে তারা তেড়ে গিয়ে একটা পায়রা ধরে ফেল্লে। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাই দেখে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসে বল্লেন, কর কি! কর কি! এ যে ইতু-রা’ল পরমেশ্বর ঠাকুরের পায়রা, এখুনি ছেড়ে দাও। তারপর মেয়েদের দুঃখের কথা শুনে বুড়ো ব্রাহ্মণের বড় দয়া হলো। তিনি বল্লেন, তোমরা ইতু-রা’ল ঠাকুরের ব্রত কর, তবেই তোমাদের সব দুঃখ দূর হবে। সেদিন অগ্রহায়ণ মাসের রবিবার; মেয়ে দু’টী তো উপোস করেই ছিল, তখনি তারা পূজো ক’রে ব্রত নিয়ম পালন কল্লে। ব্রতের পুণ্যিতে এক নিমেষে যেখানে তাদের কুঁড়েঘর ছিল সেখানে প্রকাণ্ড রাজ অট্টালিকা হলো। মরাই ভরা ধান হলো, গোয়াল ভরা গরু হলো, পাল ভরা মোষ হলো। বাড়ীঘর ধন জনে ভরে গেল।
মেয়ে সেদিন আনন্দে পথের পানে চেয়ে আছে কখন বাপ বাড়ী আসবে। কিন্তু সন্ধ্যে হলো, তবু ব্রাহ্মণ ভিক্ষা ক’রে বাড়ী ফেরেন না; এজন্যে মেয়েরা বড় ব্যস্ত হলো। বড় মেয়েটীর নাম অমুনা, ছোটটী যমুনা। ছোট হলেও যমুনা অমুনার চেয়ে বেশী সেয়ানা। সে বলে, দিদি, বাবা আমাদের বাড়ীঘর এখন চিনতে পারবেন কেন; তিনি হয়তো ভাবছেন কোন রাজা এসে আমাদের তাড়িয়ে দিয়ে এখানে রাজ অট্টালিকা করেছে। চল যাই বাবাকে খুঁজে আনিগে। এই বলে তারা বাইরে গিয়ে দেখলে, ব্রাহ্মণের হাতে ভিক্ষার ঝুলি, তিনি বাড়ীর পাশে হা হুতাশ ক’রে পড়ে আছেন। মেয়েরা তাঁকে ইতু-রা’ল ব্রতের প্রত্যক্ষ ফলের কথা বলাতে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে নূতন বাড়ীতে প্রবেশ কল্লেন। অমুনা ও যমুনা ইতু-রা’ল দেবতার, কাছে প্রার্থনা কল্লে, ঠাকুর, আমাদের তো সবই হলো, কিন্তু ঘরে মা নেই; আমাদের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করাে।
সেই দেশের রাজার এক পরম রূপবতী কন্যা ছিল। রাজকন্যা বড় হয়েছেন তবু বিয়ে হয় নাই। আইবুড় সােমত্ত মেয়ে দেখে রাণীর মুখে ভাত রােচে না। রাজা অন্তঃপুরে আসতেন না, আর মেয়ে যে এত বড় হয়েছে তাও তাঁর জ্ঞান নাই। রাজা একদিন হঠাৎ অন্দরে এসে খেতে বসেছেন; রাণী মেয়েকে দিয়ে পরিবেশন করালেন। রাজা কন্যাকে চিনতে পারেননি। রহস্য করে বল্লেন, রাণি! তােমার ছােট বােনটীর চেহারা তাে বেশ, তােমার চেয়ে সুন্দর। একে কবে আনলে? আহা, দুটা দিন এখানে থাক্। এবার আমাকে অন্তঃপুরে কয়েদ রাখবার বেশ উপায় ঠাউরিয়েছ। তােমার বুদ্ধি বলিহারি যাই, আর আমি অন্তঃপুর ছাড়বো না। রাণী খুব চটে বল্লেন, মরণ আর কি! চোকের মাথা খেয়েছ? আমিও তােমার বুদ্ধিকে বলিহারি যাই। রাজা নিজের ভ্রম বুঝতে পেরে লজ্জায় মরে গেলেন। তাঁর খাওয়া হলাে না; তিনি প্রতিজ্ঞা কল্লেন, কাল ভােরে উঠে যার মুখ দেখবাে, জাত বিচার না ক’রে তাকেই কন্যা সম্প্রদান করবো। কন্যা সম্প্রদান না ক’রে আর এক বিন্দু জল গ্রহণ করবো না।
এদিকে সেই ব্রাহ্মণ এখন বড়লােক হলেও তাঁর বহুদিনের ভিক্ষাবৃত্তির অভ্যাসটি যায় নাই। ইতু-রা’ল ঠাকুর শেষ রাত্রে তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দিলেন, তুমি খুব ভােরে উঠে রাজবাড়ী যাবে, রাজা দাতাকর্ণ হয়ে আজ দানের মতন দান করবেন। তুমি পশ্চিম মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ভুলাে না, সাবধান! শেষ রাত্রের স্বপ্ন দেখে ব্রাহ্মণের আর ঘুম হলো না। ব্রাহ্মমূহুর্তে উঠে দুর্গানাম স্মরণ ক’রে ভিক্ষার ঝুলিটা হাতে লয়ে ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি রাজবাড়ী ছুটে গেলেন এবং পশ্চিম মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা শষ্যা ত্যাগ ক’রে সূর্য্য প্রণাম করেই সর্ব্বাগ্রে ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন। তিনি পরম তুষ্ট হয়ে তাঁকে শুভক্ষণে রাজকন্যা সম্প্রদান কল্লেন।
মা পেয়ে অমুনা ও যমুনার আনন্দের সীমা নাই। কিছু কাল পরে যখন তাদের একটী ভাই হলো তখন দু’ বোন্ কিরূপ সুখী হলো তা বলবার নয়। ভাইটীকে কোলে ক’রে তারা সদাই বাড়ীর ভিতর হেসে খেলে বেড়ায়। কিন্তু নূতন ব্রাহ্মণীর চোখে মেয়ে দুটীর এতটা নির্ভাবনা ও স্ফূর্ত্তি ভাল লাগিল না। তিনি দেখলেন বাড়ীর লোকজন ওদের ইঙ্গিতেই যেন চলা ফেরা করে। ভাবলেন, এত বাড়াবাড়ি কেন? ওদের যদি তাড়িয়ে না দিতে পারি তবে আমি রাজার মেয়েই নই।
একদিন দুই বোন্ ইতু-রা’ল ব্রতের উদ্যোগ ক’রে মাকে বলে, মা ভাইটীকে কোলে নাও, আমাদের ব্রতের জিনিষ ফেলে দিচ্ছে। যেই এই বলা, আর অমনি ব্রাহ্মণী হঠাৎ রেগে ছেলের গায় ঠাস্ করে এক চড় দিয়ে বল্লে, হতভাগা ছেলে! কেন ওদের কাছে যাস্। ছেলেটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো। ব্রাহ্মণী রাগে গর্ গর্ করে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ী গিয়ে শুয়ে রইলেন। বামুন ঠাকুর তখন বাড়ী ছিলেন না। বাড়ী এসে তিনি ব্রাহ্মণীকে সেধে আনতে গেলেন। অনেক সাধ্যি সাধনার পর ব্রাহ্মণী বল্লে, আমি তেমন মানুষের মেয়ে নই, অপমান হতে তোমার ঘর কত্তে আসিনি। এই অবােধ শিশু “দিদি দিদি” ব’লে অধীর হয়। তােমার দস্যি মেয়ে দুটার কোন কাজ কর্ম্ম নেই, ফি রবিবার পিটুলির পুতুল গড়ে খেলা করে, শিশুকে কিছুতেই খেলাতে দেবে না, তাকে মেরেছে। আর আমায় যা-না-বলবার তাই বলে গালাগাল দিয়েছে; ঘেন্নায় লজ্জায় আমি পালিয়ে এসেছি। তুমি কন্যা নিয়ে সুখে ঘরকন্না কর, আমাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দাও; সেখানে আমার চা’ট্টি অন্নের অভাব হবে না। হায়, আমি কেন এমন ছােট লােকের ঘর কত্তে এলুম। এই ব’লে ব্রাহ্মণী মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
বেচারী বামুনের মুখে কথা নাই। তিনি ভাবলেন ব্যাপার গুরুতর; অমুনা ও যমুনা নিশ্চয়ই বিশেষ অপরাধ করেছে। ব্রাহ্মণকে নরম দেখে ব্রাহ্মণী আবার কান্নার সুরে বলেন, মেয়ে দুটোকে কালই বনবাস দাও তবেই আমি তােমার ঘরে যাব নইলে আমি এখুনি বিষ খেয়ে মরবাে। ব্রাহ্মণ বুল্লেন, বনবাস তাে বনবাস, যদি তুমি বল আমি ওদের এখুনি কেটে ফেলি। তুমি মনে ক’রে নাও আমি ওদের বনবাস দিয়েছি, তুমি ঘরে চল। এই ব’লে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীর হাত ধরে বাড়ী ফিরলেন।
পরদিন ব্রাহ্মণ কন্যাগণকে ডেকে বল্লেন, চল, আমার সঙ্গে তােমরা তােমাদের মাসীর বাড়ী যাবে। তারা আশ্চর্য হয়ে বল্লে, বাবা, বল কি, আমাদের তাে মাসী নেই! “হ্যাঁ আছে বৈ কি, তােমরা ছেলে মানুষ, সব জান না” এই বলে সারাদিন পথ হেঁটে, বামুন ঠাকুর মেয়েদের সঙ্গে ক’রে সন্ধ্যার কিছু আগে এক ঘাের অরণ্যে প্রবেশ করলেন। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে মেয়েরা বাপের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। বামুনের দুর্ম্মতি হয়েছে; তিনি কন্যাদের শিয়রে দুখানি ইট রেখে আস্তে আস্তে সরে পরলেন।
দুপুর রাত। মেয়ে দু’টীর ঘুম ভাঙ্গলো। তারা দেখলে বাপ নেই, চাদ্দিকে ঘোর আঁধার ও বাঘ ভালুকের রব। এখন উপায়! যমুনা সেয়ানা; সে বলে, দিদি বুঝতে পাচ্ছ না! বাবা আমাদের মায়ের চক্রান্তে বনবাস দিয়েছেন। তখন দু’বোন করযোড়ে ইতু-রা’ল ঠাকুরকে ভক্তিভরে ডাকতে লাগলো। তাঁর কৃপায় কোন ভয় রইল না; দুই ভগিনী বনের ভিতর এক কুটীরে বাস কত্তে লাগলো। ইতু-রা’ল ঠাকুর তাদের সঙ্গে রইলেন।
একদিন এক দূর দেশের রাজপুত্র আর মন্ত্রীর পুত্র বনে মৃগয়া কত্তে এসেছেন। তাঁরা পিপাসায় কাতর হয়ে জলের অন্বেষণে অরণ্যের ভিতর লোকজন পাঠালেন। তারা কুটীরে এসে ব্রাহ্মণ কন্যাদের কাছ থেকে জল নিয়ে গেল। ইতু-রা’ল ঠাকুরের চক্র, তাই জলপানের সময় রাজপুত্র ও মন্ত্রী-পুত্র জলের ভিতর খুব লম্বা দু’গাছি মাথার চুল দেখতে পেলেন। তাঁরা আশ্চর্য্য হয়ে বল্লেন, আহা চুল তো নয়, যেন শ্যামাঠাক্রুণের কেশ! এই ঘোর অরণ্যে সুকেশী রূপবতী রমণী কোথায়? অনুসন্ধান ক’রে জানতে পারলেন কুটীরের ভিতর দুইটী পরমা সুন্দরী কন্যা আছে। তাঁরা কুটীরে গিয়ে তাঁদের দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। ইতু-রা’ল ঠাকুর তাঁদের মন জেনে ছদ্মবেশে প্রকাশ হয়ে, রাজপুত্রের সঙ্গে অমুনার এবং মন্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে যমুনার বিয়ে দিলেন। তাঁরা বউ নিয়ে খুব ঘটা ক’রে বাড়ী যাত্রা করলেন। তখন যমুনা অমুনাকে বল্লন, দিদি তুমি চল্লে তোমার বাড়ী, আমি চল্লুম আমার বাড়ী; কিন্তু সাবধান। ইতু-রা’ল ঠাকুরের ব্রত যেন ভুলো না।
কিছু দিন পর রাজপুত্র রাজা হলেন, মন্ত্রীর পুত্র মন্ত্রী হলেন। তাদের দু’জনেরই ছেলে হলো। পরম সুখে দিন যেতে লাগলো। রাণীর উপর রাজার অগাধ ভালবাসা। তিনি যা বলেন রাজা তাই করেন। রোজ নূতন হীরের ফুল, গজ-মুক্তোর হার রাণীকে পরিয়ে রাজার আশ মিটতো না। একদিন রাজার চোকে রাণীর পায়ের আলতার রং একটু যেন ময়লা বোধ হলো। আর অমনি, রাণীর ঘর ভাল ক’রে ঝাঁট দেয়নি কেন এই অপরাধে, ঝাড়ুদার ও তার সাত ছেলের গর্দ্দানা নেবার হুকুম দিয়ে ফেল্লেন।
কিন্তু রাজার এত যে ভালবাসা, তা একদিন বালির বাঁধের মত ধসে গেল। রাণী অমুনা পিটুলির পুলি গড়ে ইতু-রা’ল ব্রত কোরতেন। রাজা প্রায়ই বোলতেন, ছি, তুমি হলে রাজরাণী, ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে পরীটির মত সারাদিন বসে থাকবে। আর যদি ব্রত করতেই হয় তবে রাজা রাজড়ার মত ব্রত করবে; হাতী দান করবে, ঘোড়া দান করবে। তা না ক’রে, এ তুচ্ছ পিটুলির ব্রত তোমায় কে শেখালে? আমার কথাটা রাখ, এ ব্রত আর করো না। রাণী আর কিছুতেই মানা শুনলেন না। একদিন রাজা ব্রতের জিনিষ পায় ঠেলে ফেলে দিয়ে রেগে আগুন হয়ে বল্লেন, জঙ্গলী মেয়ে! জঙ্গলই তোর যোগ্য স্থান। এই ব’লে অমুনাকে বাড়ী হ’তে তাড়িয়ে দিলেন। ইতু-রা’ল ঠাকুর বিরূপ হলেন।
অমুনার দুঃখের সীমা নাই। কাল রাজরাণী ছিলেন, আজ পথের ভিকিরি। তিনি ভাবলেন, এখন যাই কোথা। বাপের বাড়ী ঠাঁই নাই। এমন যে রাজরাজেশ্বর সােয়ামী, তিনিও আমায় ত্যাগ করলেন! হায়, এ দুঃখের কথা কার কাছে বলি। যমুনা এক মায়ের পেটের বােন্, অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা নাই। তাকে একবার না দেখে কোথাও যাব না। এই ভেবে তিনি তাঁর ছেলেটীকে কোলে ক’রে কাঙালীর বেশে মন্ত্রীর বাড়ীর দিকে চল্লেন। অন্দরের দরজায় গিয়ে তাঁর বুক দুর দুর করতে লাগলাে। খিড়কির পুকুর পাড়ে বসে ভাবতে লাগলেন, ভগিনী কি আমায় এ বেশে চিনতে পারবে। তখন দেখলেন যমুনার দাসী তাঁর স্নানের জল নিয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজের হাতের আংটি লুকিয়ে কলসীর ভিতর ফেলে দিলেন।
যমুনা ঘরে বসে গান কোরছিলেন। জল ঢালতেই অমুনার আংটি তাঁর গায়ে পড়লাে। তিনি দাসীকে বােকে উঠলেন, ঝি, বল্ দেখি তাের কি আক্কেল, তুই “তুক” করেছিস্ না কি? স্নানের জলের ভেতর আংটি দিলি কেন? দাসী ভয়ে জড়সড় হয়ে বল্লে, ঠাকরুণ আমি তাে কিছুই জানি না। তবে পুকুর পাড়ে একটী মেয়ে ও একটী ছােট ছেলে বসে রয়েছে এই জানি। মেয়েটী দেখতে তােমারই মতন সুন্দর, গরীব অথচ দামী গহনা পরা; আমার সন্দেহ হয় এ তারই কাজ। যমুনা আংটী তুলে দেখলেন ও দিদিকে চিনতে পারলেন। অমনি ছুটে গিয়ে তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে পরম সমাদরে ঘরে নিয়ে এলেন।
অনেক দিন পরে দুই ভগিনীর পরস্পর দেখা। চো’কের জল মুছিতে মুছিতে কত সুখ দুঃখের কথা তারা বলিতে লাগি লেন। যমুনা রাজার দুর্মতির কথা শুনে কাঁদতে লাগলেন। অমুনাকে তিনি গােপনে নিজ বাড়ীতে রাখলেন। অমুনা যমুনাকে বল্লেন, বােন্ আমি যে এখানে রইলুম তা কেউ রাজার কাণে না তােলে। মন্ত্রী মশাইকে ব’লে কাজ নেই। যমুনা বল্লেন, দিদি মন্ত্রীর মন্ত্র আমার হাতে, তােমার কোন ভয় নাই। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
এদিকে, কিছুদিন পর রাজার চৈতন্য হলাে। তিনি রাণীর জন্য ব্যাকুল হলেন। অনুতাপ করে মন্ত্রীকে বলেন, আমি বিনা দোষে রাণীকে ও ছেলেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। যত টাকা লাগে দেব, তুমি লোকজন পাঠিয়ে তাঁদের খুঁজে নিয়ে এসো। রাণীকে না দেখে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রী মহা বিপদে পড়লেন। সব লােক ফিরে এলাে, কেউ রাণীর খোঁজ পেলে না। রাণীকে পাওয়া গেল না বল্লে চাক্রি তাে থাকবেই না, আরও কি হয়, এই ভেবে তিনি মনের দুঃখে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন। যমুনা এসে বল্লেন, তুমি এত ভাবচো কেন, আমি থাকতে তােমার চাকরি যাবার ভয় নাই। রাজা রাণীর জন্যে এত উতলা হয়েছেন তা শুনে আমি সুখী হলেম। রাণীর সঙ্গে যাই হােক আমার একটা রক্তের টান। আছে, এজন্যে আমি নিজেই লােক পাঠিয়ে তাঁকে খুঁজে নিয়ে এসেছি। তুমি যাও রাজাকে সংবাদ দাওগে, আমি রাণীকে পাল্কী ক’রে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
যমুনা রাণীকে ও তাঁর ছেলেকে সাজগােজ করিয়ে অনেক ধন রত্ন সঙ্গে দিয়ে রাজবাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। ঐসব ধন রত্ন রাজভাণ্ডারে না যাইতেই ইতু-রা’ল ঠাকুরের কোপে অদৃশ্য হইয়া গেল। রাজা রাণীকে পেয়ে প্রথমে খুব সন্তুষ্ট হলেন বটে, কিন্তু তাঁকে কিছুতেই ব্রত করতে দিলেন না। অনেক দিন ব্রত না করাতে রাণীও ব্রত ভুলিয়া গেলেন। সে দিন থেকে মা লক্ষ্মীও রাজবাড়ী ত্যাগ করলেন। রাজার হাতীশালে হাতী মলো, ঘােড়াশালে ঘােড় মলো; দারুণ রােদে শস্য পুড়ে গিয়ে দেশে দুর্ভিক্ষ হলো। রাজা ভাবলেন কি কুক্ষণে আমি এই বনবাসিনীকে ঘরে এনেছিলেম। আমার সোনার সংসার ছিল, সবই ছারখার হয়ে গেল। একবার তাড়িয়ে দিয়েছিলেম, ভালই হয়েছিল। আবার অলক্ষ্মীকে ডেকে নিয়ে এসে কি আহাম্মুকি করেছি! রাণী ও তার পেটের ছেলেটা বেঁচে থাকতে আমার কিছুতেই ভাল হবে না।
রাজা মন্ত্রীকে ডাকিয়ে বল্লেন, দেখ ভাই তুমিও বনবাসিনী কন্যে বিয়ে করেছ আমিও তাই করেছি। তবে তােমার এত সুখ সম্পদ কেন, আমারই বা সব উল্টো কেন? রাণী বেঁচে থাকতে আমার অদৃষ্টে কিছুতেই শান্তি নাই। রাণীর ও তার ছেলের সুন্দর মুখ ও রূপ দেখলে আমি সব ভুলে যাই। আমি নিজ হাতে হত্যা করতে পারবাে না; জল্লাদের হাতে দিয়ে অপমান করবারও ইচ্ছে নাই। আমি আদেশ দিচ্ছি, তুমি এক কাজ কর। রাণীকে ও তার ছেলেকে গােপনে নিয়ে যাও, গােপনে হত্যাসাধন ক’রে আমাকে তাদের রক্ত দর্শন করাও। তাদের রক্ত দেখলেই আমার শান্তিলাভ হবে। যাও, আর দ্বিরুক্তি করিও না।
মন্ত্রী বাড়ী গিয়ে যমুনাকে বল্লেন, এখন উপায়? যমুনা খানিক চুপ ক’রে ভাবতে লাগলেন। পরে বল্লেন, রাজার হুকুম, তা অমান্য করা তোমার উচিত হয় না। রাজার আদেশ ভাল কি মন্দ সে বিচার উপরওয়ালা ভগবান করবেন, সে ভার আমাদের নয়। তুমি হুকুম মত ওদের রাজবাড়ী থেকে গোপনে নিয়ে এসো। মন্ত্রী তাই করলেন। যমুনা ভাবলেন, রাজারাজড়ার মেজাজ, একবার বোল্চে তাড়িয়ে দাও, আবার বোল্চে এনে দাও। আজ বোল্চে কেটে ফেল, আবার কাল কোন্ না বল্বে বাঁচিয়ে এনে দাও। রাজার দুর্মতি হয়েছে, দিদিও ব্রত ভুলে গেছে। যাই হোক, আমি এর প্রতীকার কচ্ছি। তার পর তিনি কতগুলি মশলা লালরঙ্গে গুলে মন্ত্রীর কাছে গিয়ে বল্লেন, আমি কাজটা সেরে ফেলেছি। রাজার আদেশ, কি করা যায়। ছেলে বেলা কার বোন্ বই তো নয়, তা এমন বেশী কি। বিয়ে হয়ে গেলে পর আর সম্পর্ক কি। আমরা ভাল মন্দ বুঝি না, আমাদের অন্ন বজায় থাকলেই হলো, কি বল? আমি তোক দিয়ে খুব গোপনে ওদের কেটে ফেলে এই রক্ত এনেছি; যাও রাজাকে দেখাওগে। রক্ত না দেখলে তাঁর প্রত্যয় হবে না। মন্ত্রী তাই করলেন! যমুনা, রাণী ও তাঁর ছেলেকে লুকিয়ে ঘরে রাখলেন।
একদিন যমুনা বোলচেন, দিদি ব্রতটা ভুলে গিয়েই তোমার এই দশা। আমার কথা রাখ, তোমার ব্রত করতেই হবে। তা শুনে অমুনা বোলচেন, বোন, কি সুখ কামনা ক’রে আমি ব্রত করব? সোয়ামীর চেয়ে বড় দেবতা মেয়ে মানুষের আর পৃথিবীতে নাই। সেই সোয়ামী যদি ব্রত না করলেই সুখী হন, তবে তার মনে কষ্ট দিয়ে আমার লাভ কি। তাঁর অনুমতি না পেলে আমি কি করে ব্রত করবো। আর আমি এখনও বেঁচে আছি তা শুনেই বা তিনি কি মনে করবেন? কেবল এই শিশুটীর মুখ দেখে আমার এখনো মরতে ইচ্ছা হচ্ছে না। এই বলে রাণী অমুনা চো’কে আঁচল দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
এইরূপে কিছুদিন চলে গেল। পাছে ব্রত করতে হয় এই ভয়ে অমুনা উপােস থাকতেন না। রােজ সকালে উঠে কিছু না খেয়ে বােনের সঙ্গে দেখা করতেন না।
যমুনা ভাবলেন, দিদি যাই বলুন, ইতু-রা’ল ঠাকুরের কৃপা না হ’লে তাঁর উদ্ধার নাই। আস্ছে কাল রবিবার, এঁকে জোর করে উপােস রেখে সকাল সকাল ব্রত করাতে হবে। মনে একটা মৎলব এটে তিনি সে দিন রাত্তিরে মন্ত্রীর বিছানা বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ভগিনীর সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করলেন। অমুনা ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর আঁচলে নিজের আঁচল বেঁধে, হাতে হাত রেখে শুয়ে রইলেন, যেন রাণী সকালে উঠে কিছু মুখে দিতে না পারেন।
এদিকে মন্ত্রী মহাশয়ের চো’কে ঘুম নাই। তিনি মনে করলেন, গিন্নির বুদ্ধি বেশী বয়সও কাঁচা, ভাবনার কথা বটে। আমার চো’কে কি ধুলো দিচ্ছে, ভগবান জানেন। কিছু না বােলে কোয়ে আজ হঠাৎ আমাকে বাইরে রাখলে কেন? রাজা কি দোষে ছেলে-শুদ্ধ সুন্দরী স্ত্রীকে ত্যাগ করলেন তা ঠিক জানি না, এ তাে তারি সহােদরা! সারা রাত মন্ত্রীর ঘুম হলাে না, মনে দারুণ সন্দেহ জন্মালো। খুব ভোরে উঠে তিনি অন্দরে গিন্নির ঘরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। হাতে নাতে ধরে ফেলেছি! কোন্ পর পুরুষের সঙ্গে একত্র আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে শুয়ে রয়েছে। তবে রে দ্বিচারিণি, জঙ্গলী মেয়ে! রাজা রাণীর কেবল রক্ত দেখেছেন, আমি তাের রক্তে স্নান করবো। এই ব’লে রাগে অন্ধ হ’য়ে যেই একখানি দা হাতে তুলে নিয়েছেন অমনি দেখতে পেলেন, যাকে পুরুষ ভেবেছেন তার পায়ে মল ও হাতে শাঁখা।
মন্ত্রীর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। তিনি যমুনাকে জাগিয়ে সব কথা শুনলেন। তিনি ভাবলেন, স্ত্রী আমার পরম সতী; এঁরি পুণ্যবলে আজ দু দু’টী স্ত্রীবধ হতে রক্ষা পেলুম। রাণীকে বিনা বিচারে হত্যা করিয়েছি মনে ক’রে আমার ঘুম হতাে না; এঁরি পুণ্যবলে সে পাপ আমার হয়নি। ইতু-রা’ল ঠাকুরকে ধন্যবাদ! এই ব’লে তিনি নিজে উয্যুগী হয়ে রাণীকে ও স্ত্রীকে খুব সমারােহে ব্রত করালেন। রাণীর কোন দোষ নাই, রাজারই দুর্মতি হয়েছে তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। তিনি সকলকে বলতে লাগলেন, আমি আর রাজার ভয় করি না, তিনি পাগল হয়েছেন।
রাণী ব্রত সমাপন ক’রে করযােড়ে বর মাগলেন, ভগবান ইতু-রা’ল ঠাকুর! স্বামী আমার দেবতা, তাঁকে সুমতি দাও, আমার আর কিছু আকাঙ্ক্ষা নাই। তাঁর দোষ ক্ষমা কর।
রাজার মতির স্থিরতা নাই। রাণীর অভাবে তিনি আবার অধীর হয়ে উঠলেন। তিনি মন্ত্রীকে এখন রোজ বােল্চেন, হায় আমি কি কাজ করেছি। রাণী আমার গৃহের লক্ষ্মী ছিলেন। তিনি যাবার পর আর ঘরের শ্রী ফিরিল না। রাণী তাঁর ইষ্ট দেবতার ব্রত কোরতেন, আমি না বুঝে তাঁর অপমান করেছি। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই। ভাই, বলে দাও কোন্ স্থানে আমার দেবীর দেহের রক্তপাত হলাে; সেই খানে আমার নিজ শরীরের রক্তপাত ক’রে পৃথিবী হইতে বিদায় নিই। রাজার সময়ে নাওয়া নাই, সময়ে খাওয়া নাই, মুখে কেবল “রাণী অমুনা”।
রাজা রাণীর শােকে ক্রমে পাগল হয়ে উঠলেন। এখন তাঁর জ্ঞান নাই। একদিন মন্ত্রীকে বল্লেন, মন্ত্রী, যত টাকা লাগে দেবো; স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল যেখান থেকে পার আমার রাণীকে খুঁজে এনে দাও। নইলে ঠিক জেনাে, তােমার গর্দ্দানা নেবাে। যাও, দু’দিন সময় দিলুম।
বাড়ী এসে মন্ত্রী বল্লেন, গিন্নি তুমিই আমার ধড়ে মুণ্ড রাখলে। চাকরি তাে দুরের কথা, এবার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়েছিল। দাও, রাণীকে শীঘ্র আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও। এই বলে তিনি রাজার নূতন হুকুমের কথা সব খুলে বল্লেন। তা শুনে যমুনা বলেন, আমি সব আগেই জানি। তােমার অত তাড়াতাড়ি কেন, অন্ততঃ দুটা দিন যাক। তারপর স্বামীর সাহস পরীক্ষা করবার জন্য তিনি বল্লেন, কা’ল তুমি রাজ দরবারে গিয়ে রাজাকে দেখে প্রণাম করাে না। মন্ত্রী বল্লেন, সে কি কথা! আমার ঘাড়ে একটা বই দশটী মাথা নয়। তিনি হচ্ছেন রাজা, তাঁকে দেখে প্রণাম না জানালে কি আর রক্ষে আছে? যমুনা হেঁসে বল্লেন, তুমিই তাে সে দিন গরব ক’রে বোলছিলে “আমি রাজাকে ভয় করি না, তিনি পাগল হয়েছেন”। মন্ত্রী লজ্জিত হ’লেন। যমুনা তখন তাঁকে সাহস দিয়ে কি কি করতে হবে সে বিষয়ে অনেক উপদেশ দিলেন।
পরদিন রাজার সঙ্গে তার দেখা হলো। চক্ষু লজ্জার ভয়ে মন্ত্রী একটু মুখ ফিরিয়ে প্রণাম করলেন। রাজা কুপিত হলেন। রেগে কথা কইতে পারেন না। তখন মন্ত্রী বল্লেন, রাজা তুমি নিশ্চয়ই পাগল হয়েছ; নইলে যে রাণীকে স্বয়ং হুকুম দিয়ে কেটে ফেলেছ তাকে খুঁজে দেবার জন্য হুকুম দেবে কেন? আমার গর্দ্দানাটা তো গিয়েই রয়েছে তবে আর তোমাকে প্রণাম বা কেন, ভক্তিই বা কেন? তোমাকে আর আমি ভয় করি না। শুনে রাজা নরম হয়ে গেলেন। মন্ত্রী আবার বলতে লাগলেন, রাজা, তোমার প্রতি ইতু-রা’ল ঠাকুরের কোপ। তাঁর ক্রোধের শান্তি না হ’লে স্বর্গ, মর্ত, পাতাল খুঁজলেও রাণীকে আর পাওয়া যাবে না। যদি ভাল চাও, তবে আমার ঘরে চল। আমার স্ত্রী আজ ইতু-রা’ল ঠাকুরের ব্রত করবে; ঠাকুরের কৃপা হলে রাণীকে ও ছেলেকে পেলেও পেতে পার।
রাজা তাই করলেন। তিনি মন্ত্রীর বাড়ী গেলেন। অমুনা ও যমুনা ভক্তি ক’রে ব্রত সমাপন করলেন। তারপর যমুনা, অমুনাকে ও তাঁর ছেলেকে সাজিয়ে গুজিয়ে আড়ালে রাখলেন। তখন মন্ত্রী রাজাকে অন্দরে ডেকে এনে বল্লেন, ব্রত হয়ে গেছে। তুমি ভুঁয়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কর। রাজা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। চোখ বুজে মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ঠাকুর আমার শত অপরাধ মার্জ্জনা কর। রাণীকে ও পুত্রকে বিনাদোষে প্রাণদণ্ড করেছি, তোমার চরণে এই ভিক্ষা তাঁদের সঙ্গে আমায় মিলিত কর। পৃথিবীতে আমার অন্য সাধ নাই। এই বলিয়া রাজা মাটীতে মাথা লুটাইয়া গাত্রোখান করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলিয়া দেখতে পেলেন, রাণী ও তাঁর পুত্র ঠিক সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন। রাজা আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাঁদের জড়িয়ে ধরলেন।
রাজা রাণীর আনন্দের সীমা নাই। এত আহ্লাদের ভিতরেও তাঁদের দুজনের চো’কে জল। রাজা স্ত্রীপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মহা সমারোহে রাজবাড়ী চল্লেন। রাজ বাড়ীতে মহা ধুমধাম। সাত দিন সাত রাত চারদিকে কেবল “খাও দাও” রব। রবিবার দিন আমোদ আহ্লাদে রাজা ও রাণী আহার করে উঠেছেন, এমন সময় ইতু-রা’ল ব্রতের কথা মনে পড়ে গেল! এখন উপায়? এই আনন্দের কোলাহলের ভিতর রাজ বাড়ীতে আর কে উপবাসী আছে, যে তাঁদের হয়ে আজ ব্রত করবে! তখন খোঁজ খবর করে জানা গেল, সেই ঝাড়ুদারের বিধবা স্ত্রী, পতিপুত্রশোকে জর্জ্জরিত হয়ে এ পর্য্যন্ত জল গ্রহণ করে নাই। রাজা রাগের মাথায় বিনা দোষে, বিনা বিচারে তার স্বামীর ও সাত পুত্রের প্রাণ দণ্ড করেছিলেন। রাজার মনে বড় অনুতাপ হলো। এই বিধবা পুত্র-শোক-কাতরা দুঃখী রমণীর চো’কের জল থাকতে কিছুতেই আমার মঙ্গল হবে না। রাজা তাকে সমাদরে ডেকে প্রতিনিধি করে ইতু-রা’ল ব্রত করালেন। তখনি তার সোয়ামী ও সাত ছেলে বেঁচে উঠলো। রাজা প্রজা সকলেরই আনন্দের সীমা রহিল না। “জয়, ইতু-রা’ল ঠাকুরের জয়’ রবে চারি দিক ছেয়ে গেল।
রাণী অমুনা ও মন্ত্রী-মহিষী যমুনা মাবাপকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হলেন। তাঁদের পূর্ব্ব আচরণ মেয়েরা এখন ভুলে গেছেন। এক রাজার জামাই ও আর এক রাজার শ্বশুর, সেই ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রণ পেয়ে ব্রাহ্মণী ও পুত্রকে সঙ্গে করে অনেক দিন পর মেয়েদের দেখতে এলেন। যমুনা বয়ঃপ্রাপ্ত ভাইকে কোলে নেবার উদ্যোগ অভিনয় করে মা’কে হেঁসে বল্লেন, মা দুষ্ট ভাইটি আমাদের ব্রতের জিনিষ তো ফেলে দেবে না? মাও হেঁসে উত্তর করলেন, সে ভয় এখন তোমাদের নাই; আমিও ইতু-রা’ল ঠাকুরের ব্রতটী শিখেছি। তোমরা আমার পেটের সন্তান। দুয়োরাজ ও সুয়োরাজকে সঙ্গে ক’রে ইতু-রা’ল ঠাকুর আমাকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন, সোয়ামীর ছেলেতে ও নিজের পেটের ছেলেতে যে তফাৎ মনে করে সে অভাগী যেন আমার ব্রত না করে।
ধ্যান। ওঁ ক্ষত্রিয়ং কাশ্যপং রক্তং কলিঙ্গং বাদশাঙ্গুলং।
পদ্মহস্তদ্বয়ং পূর্ব্বাননং সপ্তাশ্ববাহনং।
শিবাধিদৈবতং সূর্য্যং বহ্ণি প্রত্যধি দৈবতং।
৬৬ পৃষ্ঠায় প্রণাম মন্ত্র দেওয়া হইয়াছে। কেবল বিল্বপত্র দ্বারা ইতু-রা’ল দেবের পূজা করা নিষেধ।