মেয়েলি ব্রত ও কথা/কুলই

কুলই ব্রত।

 এই ব্রত অগ্রহায়ণ মাসে রবিবার কিম্বা বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। পুরোহিত কুল-দেবতার অর্চ্চনা করেন। এক খানি কুলার উপর ছাতু (শক্তু) দ্বারা কুলদেবতার মূর্ত্তি রচনা করা হয়। মঙ্গল ও শুক্রবারের অপর নাম কুলবার। কুলবারে কুলচণ্ডী বা কুলই চণ্ডী পূজার প্রথা অন্যত্র থাকিলেও, তৎসঙ্গে এতদ্দেশীয় কুলই-ব্রতের কোন সংস্রব নাই।


 কুলকামিনীগণ এই ব্রতের দিবস অন্নাহার না করিয়া খই, চিড়া, দই, ছাতু ইত্যাদি ভোজন করিয়া থাকেন।

ধ্যান।  ওঁ কুলদেবং মহাভাগং শত্রুঘ্নন্তু বরপ্রদং।
  শার্দ্দূল বাহনং দেবং নানালঙ্কার ভূষিতং।

কুলই ব্রত কথা।

 এক বিধবা ব্রাহ্মণী। তিনি বড়ই “শুদ্ধাচারিণী”। নিষ্ঠা ও শুদ্ধাচারের বাড়াবাড়িতে তিনি শুচিবাইগ্রস্তা হয়ে পড়লেন। ময়লা কাপড় পরতেন, আর যেমন তেমন পুকুর বা ডোবার ময়লা জলে একটা ডুব দিলেই শুদ্ধ হলেন মনে করতেন। বাড়ীর ছোট ছোট শিশুরা খেলতে খেলতে কাছে এলে তাদের ছোঁবার ভয়ে চমকে উঠে দশ হাত দূরে সরে যেতেন। কোথাও কিছু নাই, তবু তিনি ভাবতেন সব ‘সগড়ী’ হয়ে গেল! এজন্য দিনে সাতবার স্নান করতেন। কোন জিনিষ একবার ধুয়ে শুদ্ধ মনে হতো না। রোজ ঝাঁট দিবার আগে কাঠিগুলি খুলে, গোবর মেখে, ধুয়ে, আবার বেঁধে তবে ঝাঁট দিতেন।

 তিনি আর কা’কেও গৃহ দেবতার সেবা করতে দিতেন না; অথচ, তিনি নিজে মুখে আঁচল বেঁধে, নৈবেদ্য রচনা ও পূজার আয়োজন করতে গেলে, যে পূজা সকালে হবার কথা, তা সন্ধ্যার আগে কিছুতেই হতো না। আর এক কথা। তিনি রাঁধবার আগে কাঠগুলি জলে ধুয়ে নিতেন। ভিজে কাঠ, এজন্যে কিছুতেই সন্ধ্যার আগে দেবতার ভোগ হতো না। পচা গোররের দুর্গন্ধে ঠাকুরের ঘরে তিষ্ঠানো ভার। দেবতারা আর কত সহ্য় করিবেন। তাঁরা এই সব কারণে বড় কুপিত হলেন, ব্রাহ্মণীর পূজা গ্রহণ করলেন না। একদিন তিনি পূজার ঘরে প্রবেশ করবেন এমন সময়ে দৈববাণী হলো, সাবধান! তুমি। এঘরে আর কখনো এসো না।

 দেবতার কোপ হ’লে কিছুই অসম্ভব নয়। গ্রামে দৈববাণীর নানাজনে নানারূপ ব্যাখ্যা করতে লাগলো। বিধবা কুলকামিনীর কুৎসা রটনা হলো। ব্রাহ্মণী তাহা শুনিয়া যেন মরিয়া গেলেন। তাঁর আহার নিদ্রা নাই। রিষ্টি খণ্ডনের দুরাশায় রাহু কেতু শনি ও পীরের পূজা মানত করলেন, নানাস্থান হতে তাবিজ ও মাহলি সংগ্রহ ক’রে হাতের কনুইতে, গলায় ও মাথার চুলে ধারণ করলেন। কিন্তু দেবতার কোপ; কিছুতেই দুর্ণাম দূর হলো না।

 অনেক লাঞ্ছনার পর দেবতারা অবশেষে তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দিলেন, তুমি শুচিবাই ত্যাগ কর, সর্ব্বদা মন খাঁটি রেখে ভক্তিভাবে কুলদেবতার পূজা কর। তবেই তোমার দুর্ণাম দূর হয়ে সুনাম হবে, আর চিরকাল সুখে থাকবে।

 তিনি তাই করলেন। দেবতার কোপ গেল। সেই অবধি পৃথিবীতে কুলই ব্রত প্রচারিত হলো। এ ব্রত কল্লে কুলে কলঙ্ক হয় না, চিরকাল কুল উজ্জ্বল থাকে।

প্রণাম।  ওঁ কুলদেবং নমস্তুভ্যং সর্ব্বদা ভক্তবৎসলঃ।
  ভক্তিমুক্তিপ্রদো নিত্যং তস্মৈ নিত্যং নমোনমঃ॥