মেয়েলি ব্রত ও কথা/নাটাই

নাটাই ব্রত।

 অবিবাহিত বালকবালিকার বিশেষতঃ অনুঢ়া কন্যার শুভ বিবাহ কামনা করিয়া কুলবতীগণ অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে সায়াহ্নে এই ব্রতের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। অনুঢ়া কন্যার সংখ্যা বেশী না হইলে, কিম্বা গৃহে “অরক্ষণীয়া” কন্যা না থাকিলে দুই এক রবিবারে ব্রত না করিলেও চলে। বলাবাহুল্য, ঘরে অবিবাহিতা বালিকা না থাকিলে নাটাই ঠাকুরাণীর প্রতি কেবল অতীতকৃপাজনিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্ত কেহ ব্রতানুষ্ঠান আবশ্যক মনে করেন না। এতদ্দেশে ব্রাহ্মণ সমাজে কন্যার সংখ্যা অল্প। কিন্তু বৈদ্য ও কায়স্থ সমাজে কাহাকেও পুত্রের বিবাহের জন্য বিশেষ বিব্রত হইতে হয় না।

 অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণে পূজাস্থল বিচিত্র আলিপনায় সুশােভিত হইয়া থাকে। মধ্যস্থলে এক চতুষ্কোণ ক্ষুদ্র “পুকুর” খনন করা হয়। উহার ভিতর নাটাই ঠাকুরাণী সশরীরে বিরাজমানা থাকেন। আলিপনার সাধারণ চিত্রের একটী নমুনা ৮৭ পৃষ্ঠায় দেওয়া গেল।

 সুনিপুণা মহিলাগণ উদ্ধৃত সাধারণ আলিম্পনের কিয়দংশ পরিবর্ত্তন ও পরিমার্জ্জন পূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে নানাবিধ সূক্ষ্ম কার্য্যের অবতারণা করিয়া চিত্র-বৈচিত্র্য প্রদর্শন করিয়া থাকেন।

 সাতটী ছােট কচুপাতা লইয়া একটীর উপর আর একটী রাখিবে। যে পাতাটী অপেক্ষাকৃত সকলের বড় তাহা সর্ব্বনিম্নে, এইরূপ ক্রমান্বয়ে যেটী সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র তাহা সর্ব্বোপরি রাখিবে। তারপর ঐরূপ ক্রমে সজ্জিত সাতটী তুলসী পত্র কচুপাতা গুলির উপর স্থাপন করিবে। অতঃপর তুলসী পত্রের উপরে সাতগাছি দুর্ব্বা দিবে। এই তিন স্তর একত্র এক “ভাগ” হইল। যতজন বালক বালিকার শুভবিবাহ কামনা করিবে ঐরূপ তত “ভাগ” করিতে হইবে। এইগুলি কদলী পত্রের উপর স্থাপন করিতে হয়।

 ইহা ব্যতীত, ভিজা চা’ল শিলে পিষিয়া প্রত্যেক বালক বালিকার জন্য সাতখানি ক্ষুদ্র চাপাটি প্রস্তুত করিবে। উহার তিনটে লবণ বর্জ্জিত, আর চারিটায় নুন সংযোগ করা হইয়া থাকে। ব্রতকথা শ্রবণের পর সরলমতি শিশুগণ উৎসাহ সহকরে ঐ চাপাটি ভক্ষণ করে। উভয়বিধ চাপাটি একপাত্রে মিশ্রিত করিয়া দেওয়া হয়। সর্ব্বাগ্রে লবণ সংযুক্ত চাপাটি তুলিয়া ভক্ষণ করিতে পারিলে শীঘ্র প্রজাপতির কৃপা লাভ হইবে, এরূপ মেয়েলী শাস্ত্রের নির্দ্দেশ। শিশুদের মধ্যে যাহারা কিঞ্চিৎ বয়স্ক তাহাদের কাহাকে রহস্যপ্রিয়া রমণী জিজ্ঞাসা করিলেন, আগে নুনের চাপাটি খেয়েছ তো? উত্তর। তা আমি মনে রেখেছি কি না।

 প্রঃ। তবে বোঝা গেছে, আলুনি খেয়েছ!

 উঃ। তাই আমি বল্লেম কি না।

 প্রঃ। তবে হয়েছে! তোমার কপাল ভাল, নুন খেয়েছ। তা বলতে হয়!

 উঃ। (অধোদৃষ্টি ও নীরব।)

 এ ব্রতে পুরোহিত আবশ্যক হয় না। গৃহকর্ত্রী সায়ংকালে স্বয়ং নাটাই দেবীর পূজা করেন। পূজান্তে সমবেত বালক বালিকাগণ আগ্রহ সহকারে কথা শ্রবণ করে।

আলিপনার নমুনা।

[ ৮৫ পৃষ্ঠা দেখ। ]

নাটাই ব্রত কথা।

 এক ছিলেন ধনপতি সওদাগর। তাঁর স্ত্রী, দু’টী সুন্দর ছোট ছেলে ও মেয়ে রেখে, হঠাৎ মারা যান। কিছু দিন পর, সওদাগর আবার সংসার করলেন। দ্বিতীয় পক্ষেও একটী ছেলে ও একটী মেয়ে হলো। মা-মরা শিশু দু’টীকে বাপ বড় ভাল বাসতেন। আর, পাড়া পড়শীরা টুকটুকে সুন্দর ছেলে মেয়ে দু’টীকে দেখলেই আদর ক’রে কোলে তুলে নিত। তাই দেখে নূতন গিন্নি ভাবলেন, হা অদেষ্ট, এ অভাগীর পেটে হয়েছে ব’লেই আমার বাছাদের এত হতাদর। এক বাড়ীতে চারিটী ভাই বােন্; তারা যদি সকলে সমান না হবে তবে লােকে আমাকে ওদের সকলকেই নিজের পেটের ছেলের মতন দেখতে বলে কেন?

 একদিন গিন্নি এসে ধনপতিকে বল্লেন, কেবল বাড়ীতে বসে থাকলে তাে আর সংসার চলবে না। শুনছি, সব সওদাগরের বিদেশে বণিজ্যে যাচ্ছে; তুমিও তাদের সঙ্গে যাও না কেন? ছেলে মেয়ে কোলে ক’রে বসে থাকা পুরুষ মানুষের কাজ নয়। তাই শুনে, ধনপতির ভাবনা বেড়ে গেল। কারণ, নূতন গিন্নি যে, বাড়ীতে খাবার এলে, লুকিয়ে আম সন্দেশ নিজের ছেলে মেয়েদের হাতে এক একটী বেশী দিতেন, তাহা তাঁর জানবার বাকী ছিল না। এজন্য বিদেশে যেতে হবে ভেবে, বড় ছেলে ও বড় মেয়েটার জন্যে তাঁর প্রাণ কাঁদতে লাগলাে। কিন্তু বিদেশে না গেলেও তাে নয়; আগে রােজগার, তার পরে সব।

 সাত পাঁচ ভেবে, ধনপতি বিদেশে যাওয়াই স্থির করলেন। যাবার আগে গােপনে মুদী, গয়লা, মেঠাইওয়ালা ও সব দোকানীদের কাছে গিয়ে বল্লেন, ভাই তােমরা আমার বড় ছেলে মেয়েদের দেখো। তারা যা চাইবে তাই দেবে, তাতে কোন আপত্তি করাে না, আমি ফিরে এসেই হিসেব চুকিয়ে দেব। এই ব’লে তাদের হাতে কিছু আগাম টাকা গুঁজে দিলেন।

 ছেলেটী বল্লে, বাবা তুমি কোথা যাবে, আমার জন্যে হীরের আংটি আনবে। মেয়েটী বল্লে, বাবা আমার জন্যে তবে মুক্তোর হার চাই। ধনপতি তাদের একত্র কোলে তুলে নিয়ে ছেলেকে আদর করে বল্লেন, তােমার জন্যে রাঙা বউ আনবো। অমনি মেয়েটা বল্লে, তবে বাবা আমার জন্যে টুকটুকে বর নিয়ে এসাে। ধনপতি চো’কের জলের সঙ্গে হেঁসে ছেলে মেয়েদের মুখ চুম্বন ক’রে কোল হতে নামিয়ে দিয়ে, মা চণ্ডীর নাম স্মরণ ক’রে নােকায় উঠে বিদেশ যাত্রা করলেন।

 সওদাগর-গিন্নি ভাবলেন, বড় ছেলেটা ও বড় মেয়েটার এত বাড়াবাড়ি ভাল নয়। ওরা সাজগােজ করে বাড়ীতে বসে থাকলে আমার বাছাদের আদর যত্ন হবে না। বাড়ীর রাখাল ছোঁড়াটার পেছনে কম খরচ হয় না। এই ভেবে, রাখালকে তাড়িয়ে দিয়ে তিনি তাদের ছাগল ও ভেড়া চরাতে দিলেন। দুই ভাই বােন্ ভােরে উঠে মাঠে যেতো, আর সন্ধ্যে বেলায় বাড়ী এসে দু’মুঠা ভাত খেতো।

 গিন্নির ভাবনা গেল না। আধ-পেটা খেয়েও সতীনের ছেলে মেয়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে, আর আমার ছেলে মেয়েদের রােজ দু’বেলা ঘি দুধ খেতে দি, তবু বাছার কেমন রােগা হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে! একদিন ছােট ছেলে ও মেয়ে বল্লে, মা আমরা দাদা ও দিদির সঙ্গে মাঠে বেড়াতে যাবো। মা বল্লেন, ষাট, তােরা কেন এই রোদে ওই হতচ্ছাড়াদের সঙ্গে গিয়ে খিদেয় কষ্ট পাবি। যা, ঘরে বসে খেলা করগে। তারা বল্লে, না মা আমাদের কোন কষ্ট হবে না; তুমি ব্যস্ত হয়াে না, আমরা বরং শীগগির বাড়ী ফিরে আসবে। এই ব’লে তারাও ওদের সঙ্গে ছাগল ভেড়া চরাতে গেল।

 দুপুর চলে গেল, বিকেল হলো; তবু ছেলেরা বাড়ী এল না। বিলম্ব দেখে সওদাগর-গিন্নি নিজের ছেলে ও মেয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে বাড়ীর চা’দ্দিক ছুটোছুটি কোরছিলেন। কেন বাছাদের আজ ওই হতভাগা দুটার সঙ্গে যেতে দিলুম। সারাদিন না খেয়ে দেয়ে বাছাদের মুখ না জানি কেমন শুকিয়ে গেছে। এই ভেবে তিনি তাদের জন্যে মুড়কি, চিড়ে ভাজা। লাড়ু, বাতাসা হাতে ক’রে ব্যাকুল হয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পথের পানে চেয়ে রইলেন। এমন সময় সন্ধ্যার কিছু আগে, চা’র ভাইবোন বাড়ী ফিরে এলো। ছোট ছেলে ও মেয়ে দৌড়ে এসে বল্লে, মা, তোমার হাতের খাবারগুলো ফেলে দাও, আমরা ওসব আর কখনো খাব না। দাদা ও দিদির সঙ্গে গিয়ে আজ পেট পুরে যা খেয়েছি, এমন জিনিষ ঘরে কোন দিন চো’কেও দেখিনি। আজ দুপুর বেলা বাজারে দোকানীরা দাদা ও দিদিকে আদর ক’রে কত জিনিষ খেতে দিয়েছে তা আর কি বলবো। দই দুধ ক্ষীর সর তো ছিলই, তা ছাড়া সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতোয়া জিলিপি, অমৃতি, ‘লালমোহন’, ‘ক্ষীরমোহন’ আর কত যে খেয়েছি তার সব নাম আমরা জানিও না। দাদা ও দিদির একটা পয়সা দিতে হলো না। তারা রোজ এই সব খায়; আমরা রোজ তাদের সঙ্গে যাবো, তোমার মানা শুনবো না।

 তাই শুনে গিন্নি গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি সব বুঝতে পারলেন। সেদিন রাত্রে তাঁর ঘুম হলো না। খুব ভোরে উঠে তিনি দোকানীদের ডাকিয়ে বল্লেন, দেখ, আমার বড় ছেলে ও বড় মেয়েকে তোমরা জল খাবার ও জিনিষপত্র ধারে দিচ্ছ, তা ভালোই। আমার পেটের ছেলে মেয়ে যেমন, তারাও তেমন। তবে, একটা কথা তোমাদের জেনে রাখা ভাল, এই জন্যেই তোমাদের ডাকিয়েছি। আজ কয় বছর বাবৎ সওদাগর বাড়ীতে নাই। যে দারুণ রোগ শরীরে নিয়ে তিনি বিদেশ যাত্রা করেছেন, তা তোমাদের না বলাই ভাল। ব্যারাম শরীরে তাঁকে আমি যেতে কত নিষেধ করেছিলেম। তিনি মানা শুনলেন না; বল্লেন, “হাতে একটা পয়সা নাই, বাণিজ্যে না বেরুলে ঘরে ব’সে কি খাব”। তারপর এ পর্য্যন্ত তাঁর খবর নাই। ভাবনায় আমার ঘুম হয় না। এদিকে তিনি রাজোর দেনা রেখে গেছেন। এর মধ্যে যদি একটা ভাল মন্দ খবর এসে পড়ে, তবে ঠিক জেনো, আমি তোমাদের কাছে একটী পয়সারও দায়ী হতে পারবো না।

 দোকানীরা খাবার দেওয়া বন্ধ কল্লে। তারপর অনেক দিন চ’লে গেল। কিন্তু গিন্নির ভাবনা দূর হলো না। সতীনের ছেলে মেয়েরা বাড়ীতে আধ পেটা খেয়ে এখনও হেসে খেলে বেড়াচ্ছে! গিন্নি আর কত সইবেন? এবার তিনি নিজেই গরজ ক’রে ওদের সঙ্গে নিজের ছেলে মেয়েদের মাঠে পাঠিয়ে দিলেন।

 গিন্নি সেদিন ব্যস্ত হয়ে পথের পানে চেয়ে ব’সে আছেন, এমনি সময় ছেলেরা বাড়ী ফিরে এলো। ছোট ছেলে ও মেয়ে দৌড়ে এসে বল্লে, মা, দাদা ও দিদির সঙ্গে গিয়ে আজ যা পেয়েছি তা আর কি বলবো। তার কাছে সন্দেশ রসগোল্লা কোথা লাগে! জঙ্গলের ভিতর গাছে এত সুন্দর ও মিষ্টি পাকা ফল ঝুলে রয়েচে তা দেখলে চো’ক জুড়ায়, আর একবার মুখে দিলে আর কিছুই খেতে সাধ হবে না। আমরা ফলের নাম জানি না, বোধ হয় ‘অমৃত ফল’ হবে। এই দেখ, একটী ফল লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। এই ব’লে ছােট মেয়ে একটী সুন্দর টুকটুকে লাল ফল মা’র হাতে দিলে।

 গিন্নি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, ‘অমৃত ফল’ বা আমও নয়, একেবারে ‘মােক্ষ ফল’! তিনি মাথায় হাত দিয়ে একেবারে বসে পড়লেন। হা অদেষ্ট, যে ফল দেবতার ভােগর জন্যে সৃষ্টি হয়েছে, তা খেতে এই পৃথিবীর ভিতর আর লােক ছিল না! রাজা মহারাজারা খেলে না, আমার ছেলে মেয়েরা খেলে না, আমিও খেলুম না, আর খেলে কি-না আমার সতীনের ছেলে মেয়েরা! হা বিধাতা, আমার মনে কষ্ট দিয়ে তােমার আশ মিটে না! সে দিন রাত্রে গিন্নির ঘুম হলো না। মনে দারুণ রাগ হলাে। রাত্রি পােহাইবার অপেক্ষায় জ্বরো রােগীর ন্যায় ছট্‌ফট্‌ করতে লাগলেন। খুব ভােরে উঠে, মুড় খ্যাংড়া হাতে নিয়ে দৌড়ে বনের ভিতর গেলেন। ‘মােক্ষ ফলের’ প্রতি ঝাঁটা উত্তোলন ও আস্ফালন ক’রে অভিশাপ দিলেন, পুর্ব্বদিকে সূর্য্য ঠাকুর তুমি সাক্ষী, যদি আমি সতী মায়ের গর্ভে জন্মলাভ করে থাকি, যদি আমার উর্দ্ধকুলে কেউ সতী থাকে, তবে পৃথিবীতে এই ফল সকলের অভক্ষ্য হউক, বাহিরে যেমন আছে তেমনি থাক্‌, ভিতর ভুস্মবৎ হউক। সতীত্বের অভিসম্পাত সফল হলো। সেই অবধি মােক্ষফল পৃথিবীতে ‘মাকাল ফল’ নামে পরিচিত হলাে।

 তার পর আবার অনেক দিন চ’লে গেল। কিন্তু সপত্নী সন্তানদের শ্রীবৃদ্ধি ও সওদাগর-গৃহিণীর মুনোকষ্ট কিছুতেই দুর হলো না। আবারও তিনি নিজের ছেলে মেয়েদের গােয়েন্দা ক’রে জানতে পারলেন তারা এখন আর কিছু না পেয়ে গৃহস্থদের ক্ষেতের গম খেয়ে ক্ষুধা দূর করে। তখনকার গম অতি সুস্বাদু ছিল ও সহজেই ভিতরের শাঁস চিবিয়ে খাওয়া যেতো। গিন্নি সহ্য হলো না। তিনি শাপ দিলেন, আজ হ’তে গমের ছাল পুরু হোক, ঢেঁকিতে পার দিয়ে ময়দা না ক’রে কেউ খেতে পারবে না। অভিশাপ সফল হলো। সতীত্বের অভিসম্পাত শকুনের শাপ নয়।

 তার পর দিন, দুই ভাই ভগিনী ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবারণের আর উপায় না দেখে অস্থির হয়ে বনে বনে বেড়াতে লাগলো। তাদের ছাগমেষ হারিয়ে গেল, সন্ধ্যা হলো, তবু খুঁজে পাওয়া গেল না। ছোট বোন বল্লে, দাদা,, কি সাহসে আর বাড়ী গিয়ে মুখ দেখাবে? ওই দুরে গৃহস্থদের বাড়ীতে আলো দেখা যাচ্ছে, চল তাদের আশ্রয়ে রাত্রি কাটিয়ে তারপর যদি সারাদিন খুঁজে ছাগলভেড়া পাওয়া যায় তবেই কাল এক সময়ে বাড়ী যাব।

 সেদিন অগ্রহায়ণ মাসের রবিবার। গৃহস্থদের মেয়েরা ছোট ছোট ছেলেপুলে সঙ্গে ক’রে নাটাই ব্রত কোরছিলেন। ব্রতের উলুধ্বনি ও আলো লক্ষ্য ক’রে দুই ভাই বোন্ তাঁদের বাড়ীর পাশে এসে দাঁড়ালো। বাড়ীর ভিতর যেতে লজ্জা বোধ হলো। এদিকে গৃহস্থ বাড়ীর মেয়েরা আশ্চর্য্য হয়ে দেখলেন তাঁদের ব্রতর চার “ভাগ” কচু ও তুলসী পাতা ছয় ‘ভাগ’ হয়েছে। চার ‘ভাগ’ চাপাটি ছয় ভাগ হয়ে গেছে। তাঁরা বলাবলি করছে লাগলেন, আমাদের বাড়ীতে চা’ট্টি ছেলে মেয়ে বই তো নয়, আর দুটী কোখেকে এলো? তখনি খোঁজ ক’রে জানা গেল ধনপতি সওদাগরের দুটী ছেলে মেয়ে বাড়ীর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অমনি চিনতে পেরে তাদের সকলে বাড়ীর ভেতর নিয়ে এলেন।

 তাদের কষ্টের কথা সব শুনে গেরস্ত বাড়ীর গিন্নির বড় দয়া হ’লো। চোখের জল আঁচলে মুছে দুঃখ করে বল্লেন, আহা এমন সোণারচাঁদ ছেলে মেয়ে! ঘরে বাপ নাই, মা-মরা শিশুদের প্রতি এমন কুব্যবহার মানুষেও করতে পারে। এদের বিমাতা তো নয়, রাক্ষসী। আরও তো কত ঘরে ঘরে সৎমা আছে, সকলে তো অমন নয়। ও পাড়ার বামুন দিদির বড় দু’ছেলেকে দেখে কারুর বলবার সাধ্য নাই যে তারা তার নিজের পেটের ছেলে নয়। ছেলেদের প্রতি তাঁর কত আদর যত্ন। একদিন ছেলেরা দুষ্টমি করেছিল বলে তিনি বকেছিলেন। তাই দেখে নাপিত বৌ বল্লে, আহা, তুমি ওদের বকো ঝকো না, লোকে শুনে কি বলবে। তাই শুনে বামুনদিদি বল্লেন, আমি তো ওদের লোকদেখানো আদর করি না। পরের ছেলে হ’লেই দুষ্টুমি দেখেও কিছু বলতুম না; ওরা যে আমার আপন ছেলে। বামুন দিদির সুখ্যাত লোকের মুখে আর ধরে না। আমি ঠিক বোলচি সওদাগর গিন্নির কখনো ভাল হবে না।

 বাড়ীর অন্য মেয়েরা বল্লেন, আর তোমাদের ভাবনা নাই। নাটাই ঠাক্‌রুণ তোমাদের প্রতি মুখ তুলে চেয়েছেন। আমাদের যেন মনে হচ্ছে, তোমাদের ভালোর জন্যে তিনিই তোমাদের আজ দিনের বেলা উপবাস ব্যবস্থা করে রেখেছেন, কারণ উপোস ক’রে বারব্রত ও পূজো কল্লে হাতে হাতে ফল লাভ হয়। বলে তারা সওদাগরের ছেলে মেয়েকে সমাদর ক’রে ব্রত করালেন। ব্রত শেষে তারা প্রণাম ক’রে বর প্রার্থনা কল্লে, নাটাই ঠাকুরাণি! আর আমাদের কষ্ট দিও না, কা’ল যেন ছাগল ও ভেড়া খুঁজে পাই। নইলে মা’র কাছে আমরা আর মুখ দেখাতে পারবো না। তাই শুনে সকলে হেসে বল্লেন, এ কি রকম বর চাওয়া হলো! তাঁরা মেয়েটীর দিকে তাকিয়ে বল্লেন, যদি বর চাইতে হয় তবে (বিয়ের) বরই চাও। তোমরা দু’জনে এই বর মাগ, ভেয়ের জন্যে বৌ আর বোনের জন্যে বর সঙ্গে করে বিদেশ থেকে বাপ শীগ্‌গির ফিরে আসুন।

 রাত্রে আহারের পর বাড়ীর মেয়েরা বল্লেন, নাটাই ঠাক্‌রুণের আশীর্ব্বাদে কা’ল তোমাদের নিশ্চয়ই সুপ্রভাত হবে। আমরা গরীব মানুষ, তোমাদের জন্যে তাড়াতাড়ি বেশী রকম খাবার আয়োজন করতে পাল্লেম না; আমাদের ত্রুটী গ্রহণ করো না। সওদাগরের ছেলে ও মেয়ে বল্লে, আজ অসময়ে পড়ে তোমাদের নুন খেয়েছি, চিরকাল তোমাদের গুণ ও নাটাই ব্রতের কথা মনে থাকবে।

 পরদিন ভোরে উঠে সকলে দেখলেন, ছাগল ও ভেড়া ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তখনি খবর পাওয়া গেল দেশের সওদাগরদের অনেক নৌকা বিদেশ থেকে বাড়ী আসছে। তাই শুনে ছাগল ও ভেড়া রেখে দুই ভাই বোন নদী তীরে ছুটে গেল। এক খানির পর আর এক খানি ক’রে অনেকগুলি সুন্দর পণ্য-বোঝাই নৌকা গুন টেনে ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে আসছিল। তারা একে একে সব নৌকার মাঝিদের ডেকে, জিজ্ঞেস কল্লে, ধনপতি সওদাগরের নৌকা কোথায়? কেউ বল্লে, দশ নৌকার পর; আবার কেউ বল্লে, পাঁচ নৌকার পর। তার পর ধনপতি সওদাগরের নৌকা এসে পঁহুছিল।

 অনেক বছর পর ধনপতি দেশে ফিরে আসছেন। বাড়ীর জন্যে তাঁর মন ব্যাকুল হয়েছে। ছেলে মেয়েরা কেমন আছে, তাদের এখন কত বড় দেখাবে, অনেক দিন তাঁকে না দেখে গিন্নির স্বভাব এখন অবিশ্যি বদলে গেছে, এইরূপ অনেক কথা তাঁহার মনে উদয় হইতেছিল। নৌকার ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে তিনি পরিচিত রাস্তাঘাট, গাছপালা, বাড়ীঘর ইত্যাদি দেখে আনন্দ উপভােগ করছিলেন। আবার কোন স্থানে নূতন শ্মশান চিহ্ন দেখে তাঁর মন কেঁপে উঠছিল। এইরূপে যেতে যেতে, কতকদুরে তিনি নিজের ছেলে মেয়েদের দেখে, অমনি নৌকা হ’তে লাফ দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

 ধনপতির সঙ্গে আরও তিন চার খানি নৌকা ছিল। তিনি বিদেশ থেকে অনেক ধনরত্ন সঙ্গে এনেছেন। নৌকার ভিতরে এনে তিনি ছেলেকে হীরের আংটি ও মেয়েকে গজমুক্তোর হার পরিয়ে তাদের মুখ চুম্বন ক’রে বল্লেন, তােমাদের জন্যে এর চেয়ে আরও সুন্দর জিনিষ এনেছি। তারা অমনি আগ্রহ করে জিজ্ঞেস কল্পে, আর কি এনেছ বাবা? সওদাগর আদর করে বল্লেন, তােমার জন্যে রাঙা বউ, আর তােমার জন্যে টুকটুকে বর! তাই শুনেন দু’ভাই বােন লজ্জায় অবনত হলো। এখন তারা একটু বড় হয়েছে!

 এদিকে বাড়ীতে সওদাগর গিন্নি ভাবছেন, সতীনের ছেলেরা গেল কোথায়? ছাগল ভেড়া ও ফিরে এল না! নিশ্চয়ই তারা ফল খুঁজতে গিয়ে বনের ভিতর বাঘ ভালুকের হাতে মারা পড়েছে। আহা, যদি বেঁচে থাকতো তবে ওদের দিয়ে সংসারের কত কাজকর্ম্ম হতে পারত! এই বলে তিনি নিজের ছেলে মেয়েদের ডেকে খুব সাবধান ক’রে দিলেন, গ্রামে বাঘের ভয়, তোমরা কখনো ঘরের বাইরে যেও না।

 ধনপতির নৌকা ঘাটে এসে পঁহুছিল। খবর পেয়ে, গিন্নি গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন। সওদাগর যে বিদেশ থেকে বিনা সংবাদে সুস্থ শরীরে হঠাৎ বাড়ী আসবেন, তার জন্যে তিনি তখন প্রস্তুত ছিলেন না। বড় ছেলে মেয়েদের না দেখে তিনি কি মনে করবেন, আর আমিই বা কি বলি! আর সময় নাই; গিন্নি তখনি ধুলায় পড়ে চেচিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমার কি হলো গো! আমি কেন বাছাদের যেতে দিলুম। আমি কত বল্লুম, গাঁয়ে বাঘ এসেছে, চা’র ভাই বোন ঘরে বসে একত্র খেলা কর। আমার কথা কিছুতেই শুনলে না গো! আমার এরাও যেমন তারাও তেমন ছিল; পেটের ছেলের মতন দু’জনে আমায় কত ভক্তি করতো! আমার কত সাধ ছিল, বড় দু’ ছেলে মেয়ের এ বছরই বিয়ে দেবো; বিদেশ থেকে সওদাগর এসে নাতি নাতনী দেখে কত সুখী হবেন! আমার সব সাধ দূর হলো গো! আমার এখন বেঁচে থেকে লাভ কি; আমায় বিষ এনে দাও, আমি আজই মরবো। আমার এ শোক সহ্য হয় না!

 গিন্নির মায়াকান্না শুনে ধনপতির বড় রাগ হলো। তিনি রাগ গোপন করে স্ত্রীর কাছে এসে সান্ত্বনার ছলে বল্লেন, যা হবার তা হয়েছে, আর মিছে শোক ক’রে ফল কি। আমার এই আফিমের কৌটটি তোমার বাক্সে রেখে দাও। ছেলেপুলের ঘর, সাবধান! এটা বিষ। বিষের কথা শুনে গিন্নির বড় ভয় হলাে। তিনি চমকে উঠে চোক তুলে বল্লেন, না না, ও তােমার জিনিস তােমার ঠেঁয়ে থাক্; আমি কোথায় হারিয়ে ফেলবাে। এই ব’লে, গিন্নির শােক আবার উথলে উঠলো। ওহাে-হোঃ! আমি কি আর এখন বাক্স খুলতে পারবো গো! আমি যে তাদের কত কাপড়, জামা ও খেলনা কিনে দিয়েছি, সবই তাে আমার বাক্সে আছে, তা আমি এখন কেমন করে দেখবাে গাে!

 আঁচলে মুখ মুছে গিন্নি শান্ত হলেন। ধনপতি ভাবলেন, বড় ছেলে মেয়েকে ও তাদের বর-কনেকে আজ হঠাৎ নৌকা থেকে বার ক’রে কাজ নাই। এই রাক্ষসীর রঙ্গ আরও একটা দিন দেখা যাক। সে দিন তিন চার নৌকা থেকে বাণিজ্যের জিনিসপত্র মণিমুক্তো জহরত ঘরে তুলতে তুলতে অনেক রাত হয়ে গেল। গিন্নির মনের ভিতর আনন্দের সীমা নাই। এত ধন দৌলত! এ সবই আমার নিজের ছেলে মেয়েরা পাবে। সওদাগর বিদেশে গিয়ে বুড়ো বয়সে আফিম ধরেছেন; কথন কি হয় বলা যায় না। এই সময় কিছু টাকাকড়ি নিজের কাছে লুকিয়ে রাখলে অসময়ে কাজে লাগবে। এই ভেবে তিনি বেশী রাত্রে চুপে চুপে বিছানা হতে উঠলেন। বাড়ীর পাশে অনেক দিনের পুরানাে এক পাতকুয়াে ছিল। তিনি তার ভেতর অনেক সােণারূপাে, মণিমুক্তো ও টাকার তােড়া ফেলতে লাগলেন। কিন্তু বিধাতার নির্ব্বন্ধ! খুব আঁধার রাত, গিন্নি পা ফসকে পাকুয়াের ভেতর পড়ে গেলেন।

 পরদিন সকালবেলা গিন্নির অপমৃত্যু ও অপমৃত্যুর কারণ প্রকাশ হয়ে পড়লাে। কারুর মনে বিশেষ দুঃখ নাই। কিন্তু ধনপতির চো’কে দু ফোঁটা জল দেখা দিল। হাজার হোক, তাঁর স্ত্রী। ভাল শিক্ষা পেলে এতদূর দুর্গতি হতো না।

 কিছু দিন পরেই ধনপতি খুব ঘটা ক’রে বড় ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিলেন। কুটুম্ব ও লোকজনে বাড়ী ভরে গেল। সেই গেরস্ত বাড়ীর গিন্নির ও মেয়েছেলেদের খুব আগ্রহ ক’রে নিমন্ত্রণ করা হলো। সারা দিনরাত কেবল খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার। গাঁয়ের প্রাচীন লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, ধনপতি যা কল্লে এমন ঘটাঘটি তারা কখনো দেখে নাই, শোনেও নাই। কিন্তু এত আনন্দ কোলাহলের তিতরেও ধনপতির চো’কে জল। আজ তাঁর গুণবতী বড় গিন্নির কথা মনে পড়েছে!

 সওদাগরের মেয়েটীর নাম ধনপৎ-কুমারী। রাত বেশী হয়েছে, বাসর ঘরে এখন কেউ নাই। ধনপৎকুমারী ও তাঁর বর শ্রীমন্তকুমার নিদ্রার ভাণ করে শুয়ে আছেন, এখনো তাঁদের দু’জনে কথা হয়নি। শ্রীমন্ত বড় লাজুক, প্রথম কি বোলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমনি সময়ে কুমারীর হঠাৎ নাটাই ব্রতের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন অগ্রহায়ণ মাসের শেষ রবিবার। যে ব্রতের পুণ্যিতে আমাদের এত হলো, আজ আমি সেই ব্রত ভুলে গেছি! এই ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি উঠলেন। বরণের ডালায় পিটুলি, দুর্ব্বা ও ফুলের মালা ছিল। পিটুলি দিয়ে প্রদীপের শীষে চাপাটি তয়ের ক’রে নাটাই ঠাক্‌রুণের পূজো ও প্রণাম করলেন। শ্রীমন্তকুমার শুয়ে শুয়ে সব দেখছিলেন। প্রদীপের আলোয় মুখখানি ভাল করে দেখতে পেয়ে তিনি ভাবলেন, আহা কি সুন্দর মুখ! কি সুন্দর চো’ক! তিনি আবার ভাবলেন, এত রাত্তিরে পটুলি দিয়ে পুতুলখেলা কেন? ভালই হলো, এখনি জিজ্ঞেস কচ্চি; এতক্ষণ পর কথা কইবার বেশ সুবিধে হলো। তখন ব্রত শেষ কবে ধনপৎকুমারী প্রদীপ নিবিয়ে দিলেন। অমনি তাঁরা আশ্চর্য্য হয়ে দেখলেন, ভোর হয়েছে! ঘরের চা’দ্দিকে মেয়েদের পায়ের শব্দ! শ্রীমন্ত নিরাশ হলেন, আর কথা কওয়া হলো না।

 পরদিন বাসি-বিয়ের পর ধনপৎকুমারী বরের সঙ্গে নৌকায় উঠে শ্বশুর বাড়ী চল্লেন। নৌকার ভিতর প্রথম কথা কওয়ার সুযোগ খুঁজে শ্রীমন্ত বল্লেন, কাল এত রাত্রে তুমি কি কোরছিলে? কুমারী লজ্জায় মাথা হেঁট করে ধীরে ধীরে বলেন, “নাটাই ব্রত কোরছিলুম।” শ্রীমন্ত জিজ্ঞেস কল্লেন, এ ব্রত কল্লে কি হয়? কুমারীর ক্রমেই সাহস হলো; তিনি উত্তর কলেন, এ ব্রত কল্লে সব হয়। এ ব্রত কল্লে যে যা চায়, সে তাই পায়। তাই শুনে শ্রীমন্ত রহস্য ক’রে হেসে বল্লেন, তোমার ব্রত করে দেখছি ‘হারানো গোরু’ও পাওয়া যায়। ধনপৎকুমারী এবার মাথা তুলে বল্লেন, হাঁ, ঠিক কথা, আমার নাটাই ঠাকরুণের কৃপায়, গোরু ছাগল ভেড়া হারিয়ে গেলে আর খুঁজতে হয় না, পরদিন ভোরে তারা নিজেই বাড়ী ফিরে আসে। শ্রীমন্ত আবার রহস্য ক’রে বল্লেন, আচ্ছা, জিনিস হারিয়ে গেলে যদি আবার পাওয়া যায় তবে তোমার গলার ওই সুন্দর গজমুক্তোর হার, হাতের হীরের বালা ও আরো কএকখানি গহনা দাও, এই পাণের ডিবেয় বন্ধ করে নদীতে ফেলে দি, সাতদিন পরে বাড়ী পঁহুছে গহনাগুলো আবার তোমার কাছে দেখতে চাই। নাটাই ঠাক্‌রুণের বড়াই এবার বোঝা যাবে। কেমন? রাজী আছ? ধনপৎকুমারী আর কথাটি না কোয়ে, তখনি হার, বালা ও গায়ের অনেক গহনা খুলে পাণের ডিবেয় বন্ধ করে “জয় নাটাই ঠাক্‌রুণের জয়” বলে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। শ্রীমন্ত আশ্চর্য হয়ে বল্লেন, কল্লে কি! কল্লে কি! আমি শুধু রহস্য করে বােলছিলেম বই তাে নয়!

 সাত দিন পরে তাঁরা বাড়ী পঁহুছিলেন। আজ বৌভাত। অনেক লােকের নেমন্তন্ন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে কোথাও মাছ পাওয়া গেল না। এখন উপায়! শ্বশুর বড় ভাবনার পড়লেন। তখন বউ শ্বশুরকে ব’লে পাঠালেন, আপনার কোন চিন্তা নাই; নাটাই ঠাক্‌রুণকে স্মরণ ক’রে জেলেরা নদীতে জাল ফেলুক, তা হলে অনেক মাছ পাওয়া যাবে। জেলের তাই কল্লে। আর তখনি তারা একটা পাঁচ মণ ভারি ‘রাঘব বোয়াল’ মাছ সকলে মিলে বয়ে নিয়ে এসে, গা মুছে, গামোছার বাতাস খেতে লাগলো। সকলে দেখে অবাক! এত বড় মাছ কেউ কুটতে সাহস কল্লে না। বউ বল্লেন, আমিই কুটবাে। বউ বঁটি নিয়ে মাছের গলা অর্দ্ধেক কাটতেই সেই রূপাের বড় পাণের ডিবে বেরিয়ে পড়লল! তার ভেতর বৌয়ের সব গহনা পাওয়া গেল। শ্রীমন্তের মুখে সকলে ঘটনা শুনে আশ্চর্য্য হয়ে বলাবলি করতে লাগলেন, ইনি তাে বউ নন, স্বয়ং লক্ষ্মী! সেই দিন থেকে নাটাই ব্রতের কথা শ্বশুরের দেশেও ঘরে ঘরে প্রচার হয়ে গেল।

 কএক বছর পর ধনপৎকুমারীর এক সুন্দর ছেলে হলাে। তাঁর শ্বশুর খুব ঘটা করে নাতির অন্নপ্রাশনের উয্যুগ করলেন। কিন্তু শ্বশুরের মনে সুখ নাই। গাঁয়ে খুব জলকষ্ট দেখে তিনি অনেক টাকা খরচ ক’রে এক পুকুর কাটিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কিছুতেই জল উঠলল না। জলাশয় প্রতিষ্ঠা ক’রে পুণ্য সঞ্চয় করবেন, বহুদিনের আশা বিফল হলো। কি দারুণ পাপে এমন হলো ভাবতে ভাবতে বুড়ো সওদাগরের প্রায়ই ঘুম হতো না। পর অন্নপ্রাশনের আগের দিন রাত্রে তিনি যে স্বপ্ন দেখলেন, তাতে তাঁর প্রাণ যেন উড়ে গেল। স্বপ্ন দেখলেন, “যদি নরকের ভয় থাকে, তবে কাল অন্নপ্রাশনের পর নাতিকে কেটে পুকুরে ফেলবে, তা হ’লে জল উঠবে ও পরকালে তোমার অক্ষয় স্বর্গলাভ হবে।” এই দারুণ স্বপ্ন দেখে বুড়ো সওদাগরের চো’কের জলে বালিস ভিজে গেল। আজ তাঁর বাড়ীতে ক্রিয়া, অনেক বেলা হয়ে গেল তবু তিনি বিছানা হতে উঠছেন না। নহবৎ ও সানাই তাঁর কাণে বিষ ঢেলে দিতে লাগলো। তিনি বিছানায় ছটফট করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে শ্রীমন্ত বাপের কাছে গেলেন। অনেক কষ্টে সওদাগর মুখে তুলে বল্লেন, যে ভীষণ স্বপ্ন দেখেছি তা কারু কাছে বোলবার নয়, শোনবারও নয়। আমি ঘোর পাপী, আমার নরকে বাস হোক, সেই ভাল, আর এ মুখ কা’কেও দেখাবো না। তারপর তিনি ছেলেকে স্বপ্নের কথা গোপনে বল্লেন। চো’কের জলে তাঁর বুক ভেসে গেল।

 শ্রীমন্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। আজ তাঁর হরিষে বিষাদ! তখনি সামলিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালেন। চো’কের জল মুছে বাপকে বল্লেন, বাবা আজ আমি ধন্য হলেম! নরকের ভয় থেকে উদ্ধারের জন্যেই লোকে পুত্র পৌত্র কামনা করে। আপনার পৌত্রকে দিয়ে আপনার অক্ষয় স্বর্গবাস হবে, এর চাইতে আমার আনন্দের কথা আর কি হতে পারে! আজ আমার পরম সৌভাগ্য! আমার জন্ম সার্থক হলো! দাতাকর্ণের পুণ্যের কথা স্মরণ করুন। আপনি আর খেদ করবেন না, আপনার আশীর্ব্বাদে আমার আরো পুত্রলাভ হতে পারবে। আপনার স্বর্গ কামনা করে আজ আমি এই শিশু উৎসর্গ করবো। আপনি উঠুন, আপনার চো’কে জল দেখলে আমার অধর্ম্ম হবে। এই ব’লে শ্রীমন্ত বাপের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে অন্নপ্রাশনের পর পুষ্করিণী উৎসর্গের জন্যে প্রস্তুত হ’তে চল্লেন।

 শ্রীমন্ত ভাবলেন, এ কথা স্ত্রীকে বলে কাজ নেই। হাজার হোক, মায়ের প্রাণ। এ সংবাদ শুনে তিনি হাহাকার করে উঠবেন, আর আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা হবে না। অন্নপ্রাশন হয়ে গেল পর তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে গোপনে পুকুর পাড়ে গেলেন। শ্রীহরির পাদপদ্মে শিশুকে মনে মনে নিবেদন করে, সাহসে বুক বেঁধে, পিতার স্বর্গকামনায় শিশুকে দুখণ্ড ক’রে কেটে পুকুরে ফেলে দিলেন। অমনি এক নিমেষে পুকুরে জল উঠে ভ’রে গেল। [এই সময় কথক ঠাকুরাণী আলিপনার মধ্যস্থিত “পুকুরে” একটা ফুল ছিঁড়িয়া ফেলিয়া উহা জলপূর্ণ করিয়া থাকেন। অন্য রমণীরা হুলুধ্বনি করেন।] পুকুরে হঠাৎ জল উঠেছে শু’নে গ্রামের লোকদের আনন্দের সীমা নাই। তখনি পুরুৎ ডেকে পূজো করে পুকুরের প্রতিষ্ঠা করা হলো।

 ধনপৎকুমারী সারাদিন রান্নাঘরে ছিলেন। অনেকক্ষণ শিশুকে না দেখে তাঁর মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। তিনি দাসীদের বল্লেন, দুধ উঠে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে, আমার ছেলে এনে দাও। তখন কেউ বল্লে ছেলেকে সে বাপের কোলে দেখেছে। কেউ বল্লে, ছেলে তার খুড়োর কাছে; আবার কেউ বল্লে ছেলে তাঁর ঠাকুর্দার কোলে ঘুমুচ্ছে।

 সন্ধ্যা হয়ে এলো। ধনপৎকুমারী ভাবলেন, শুনতে পাচ্ছি নূতন পুকুরে জল উঠেছে। আমার খোকার কত ভাগ্যি, তারই ভাতের দিনে এতকাল পর পুকুরে জল উঠলো। একবার পুকুরে গিয়ে গা ধুয়ে আসি। এই ব’লে তিনি পুকুর ঘাটে গেলেন। সে দিন অগ্রহায়ণ মাসের রবিবার। ধনপৎকুমারী পাড়াপড়শী মেয়েদের উলু শুনতে পেয়ে চমকে উঠলেন। যে ব্রতের পুণ্যিতে আমার এত হলো, আমি সেই ব্রত ভুলে গেছি! পুকুরপাড়ে পূজোর ফুল, দুর্ব্বা ও আলো চা’ল ছড়িয়ে পড়ে ছিল। তিনি তাই কুড়িয়ে তাড়াতাড়ি পিটুলির চাপাটি তয়ের করে ব্রত করলেন। অমনি নাটাই ঠাক্‌রুণ নিজ মূর্তিতে প্রকাশ হলেন। তাঁর কোলে ধনপৎকুমারীর জীয়ন্ত ছেলে! দেবী রাগের ভাণ ক’রে কুমারীর গালে ঠোনা মেরে তাঁর কোলে ছেলে দিলেন। আর বল্লেন, তোর ছেলেকে সেই কখন এরা কেটে পুকুরে ফেলেছে, আর এখন সন্ধ্যে হলো, এখনো তুই ছেলের খোঁজ কচ্চিসনে! আমি পুকুরের ভেতর আর কতক্ষণ তোর ছেলেকে কোলে নিয়ে ব’সে থাকবো। এই ব’লে নাটাই ঠাক্‌রুণ আকাশে মিশে গেলেন।

 ধনপৎকুমারী ছেলে কোলে ক’রে এসে ঘরের মেজেয় ভিজে কাপড়ে শুয়ে রইলেন। তাঁর মনে বড় অভিমান হয়েছে। তাঁকে না বোলে কোয়ে এঁরা এমন ভয়ানক ছলনার কাজ ক’রে ফেল্লেন! তাঁর পাশে বসে, ঘরের দো’রে কপাটের শিকল নেড়ে, ছেলেটী হেঁসে হেঁসে খেলা কচ্ছিল। ছেলেকে দেখে সকলে যারপর নাই আশ্চর্য্য হয়ে দৌড়ে এল। শ্বশুর বল্লেন, মা! তুমি মানুষ না দেবতা? বাড়ীর উঠানে লোকে লোকারণ্য হলো। নাটাই ঠাকরুণের কৃপায় হারাণো জিনিস পাওয়া যায়; আবার ছেলেকে কেটে ফেল্লেও জীয়ন্ত ফিরে আসে, —শুনে সকলের ভক্তি উথলে উঠলাে। নাটাই ঠাক্‌রুণের জর জয়-কারে চা’দ্দিকে ছেয়ে গেল।

 এ ব্রত কল্লে কি হয়? বিয়ে হয়। আর কি হয়? ছেলে হয়। আর কি হয়? হারাণো ধন পাওয়া যায়। আর কি হয়? সব হয়।