মেয়েলি ব্রত ও কথা/পাটাই

পাটাই ব্রত।

 শাস্ত্রোক্ত পাষাণ-চতুর্দশী ব্রতের রূপান্তর পাটাই ব্রত। ‘পাষাণ দুর্গা’ উপাস্য দেবতা। ইহা অগ্রহায়ণে করণীয়। কিন্তু উক্ত মাসে ব্রতসংখ্যার প্রাচুর্য্য বশতঃ ব্রাহ্মণেতর জাতীয়দের অনেকেই পৌষের শুক্লা চতুর্দ্দশীতে সায়ংকালে ব্রতের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। কেহ কেহ মধ্যাহ্নে পূজা সমাপন করেন। ব্রত না হওয়া পর্য্যন্ত উপবাসে থাকিতে হয়। “আড়াই ব্যঞ্জন” ও অন্ন রন্ধন করিয়া দুই থালায় নৈবেদ্য সাজাইতে হয়। ঝােল, তরকারী ও ভাজা এই কয়টাকে “আড়াই ব্যঞ্জন” বলে। পূজান্তে এক থালা নৈবেদ্য ধােপানীর প্রাপ্য, অন্য থালা ভুঁইমালী পাইয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত, সঙ্গতিপন্ন গৃহে পৌষ পার্ব্বণের ন্যায় পিষ্টক ও পরমান্নের বিপুল আয়ােজন হইয়া থাকে। সুতরাং এ দিনের “আড়াই ব্যঞ্জন” প্রকৃত পক্ষে পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের সমতুল্য।

 বীরণ তৃণ (চলিত কথায় বেণাঘাস) সার্দ্ধ দুই হস্ত পরিমিত দীর্ঘাকারে জড়াইয়া লইবে। ইহারই নাম ‘পাটাই’। যতজন রমণী ব্রত করিবেন ততটী পাটাই নির্ম্মাণ করিতে হয়। এই গুলি অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণে ঘনসন্নিবিষ্ট করিয়া এক সারিতে রােপণ করিবে। সম্মুখে এক ক্ষুদ্র “পুকুর” করিয়া চতুঃপার্শ্বে আলিপনা দিবে। পাটাইগুলি সরিষাফুল ও গেঁদা ফুল দ্বারা সজ্জিত করা হয়।

 নৈবেদ্যের অন্ন গৃহিণীরা স্বয়ং রন্ধন করেন বলিয়া কায়স্থদের গৃহে ব্রাহ্মণ পুরােহিতেরা এই ব্রতের পূজা করেন না। কিন্তু পুরােহিত উপস্থিত থাকিয়া মন্ত্র বলিয়া দেন, গৃহকর্ত্রী স্বয়ং পূজা করেন। ধ্যান যথা;

 ওঁ সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রক্ষা চতুর্ভিভুজৈঃ।
শঙ্খং চক্রধনুঃ শরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শােভিতা।
আমুক্তাঙ্গদহার কঙ্কণরণৎ কাঞ্চিক্কণ ন্নূপুরা।
দুর্গা দুর্গতি হারিণী ভবতু নাে রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা।

 পরদিন প্রত্যুষে কাক ডাকিবার পূর্বে পাটাইগুলি প্রাঙ্গণ হইতে তুলিয়া পুকুর পাড়ে রোপণ করিতে হয়। ইহা ভুঁইমালীর কর্ত্তব্য।

পাটাই ব্রত কথা।

 এক বিধবা বামুন ঠাক্‌রুণ। তাঁর বৌয়ের ছেলে হয়ে বাঁচে না। বউটী দেখতে শুনতে মন্দ নয়; তবে এক দোষ ছিল, —বড় লােভ। দুধ জ্বাল দিয়ে লুকিয়ে সরটুক খেয়ে ফেলতেন। বার-ব্রতের জন্যে ঘরে ভাল খাবার তৈরি হ’লে তাঁর নােলা সগবগিয়ে উঠতো; লুকিয়ে নৈবেদ্যের আগ খেয়ে ফেলতেন। শাশুরী টের পেলে, বিড়ালে খেয়েছে ব’লে বুঝিয়ে দিতেন। জিভের দোষ তাঁর কিছুতেই গেল না। এজন্যে তাঁর উপোস করা হতো না, ব্রতের ফলও হতো না। এদিকে ষষ্ঠী ঠাকরুণ তাঁর বাহন বিড়ালের উপর মিছে বদনাম শুনে কুপিত হলেন। ফলে, বৌয়ের ভাল হলো না। তাঁর সন্তান হয়ে বাঁচতো না। মাদুলি তাবিজ কবচ সবই বৃথা হলো।

 অগ্রহায়ণ (অথবা পৌষ) মাস, কাল বাড়ীতে পাটাই ব্রত। ব্রাহ্মণীর রাত্রে ঘুম হলো না। তিনি অনেক ভেবে চিন্তে স্থির করিলেন, বউকে কোন কাজে আটকে রাখবো যাতে সে সারাদিন উপোস ক’রে থাকে, আর ঘরে ব্রতের আয়োজন টের না পায়। এই ভেবে ঘরে যত ময়লা কাপড় ছিল তাতে তিনি তেল ও কালী মেখে রাখলেন। ভোরে উঠে বউকে বল্লেন, বউ, এ কাপড়গুলি ধোপাবাড়ী পাঠিয়ে কাজ নেই, তুমি এগুলো পুকুর থেকে বেশ ক’রে ধুয়ে নিয়ে এসো। কাপড় কাচা শেষ না হলে বাড়ী ফিরিও না। বউ চলে গেলে পরে ব্রাহ্মণী তাড়াতাড়ি রান্না বান্না ও পিটে পায়েস তয়ের করে ব্রতের আয়োজন করতে লাগলেন।

 এদিকে বউ পুকুর ঘাটে সারাদিন খেটে তেল কালীর দাগ কিছুতেই উঠাতে পারলেন না। খিদেয় তাঁর প্রাণ যেন বেরিয়ে যেতে লাগলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়েছে। পাড়ার গেরস্ত মেয়েদের উলু (কেহ ‘জয়কার’ বা ‘জোকার’ শব্দ ব্যবহার করেন) শুনতে পেয়ে তাঁর হঠাৎ মনে পড়লো, ওই যাঃ! আজ তো পাটাই ব্রত; ঘরে কত পিটে পায়েস হয়েছে, তা ফেলে আমি এখনাে উপােস ক’রে আছি! অমনি ঘাটে কাপড় ফেলে তিনি বাড়ী ছুটলেন। খাবার লােভে তাঁর নােলায় জল সরতে লাগলাে। রাস্তার ধারে বেণাঘাসের ঝোপ ছিল। তার খারাল পাতায় সাড়ী আটকিয়ে বউ হঠাৎ পড়ে গেলেন। তাঁর মুখ থেকে আড়াই হাত লম্বা জিভ বেরিয়ে বেণাঘাসে জড়িয়ে গেল। তিনি বেহুস হয়ে পড়ে রইলেন।

 ব্রত শেষ করে ব্রাহ্মণী বৌয়ের দুর্গতির খবর পেয়ে দৌড়ে এলেন। পূজার ফুল দুর্ব্বা ও জলের ছিটা পেয়ে বউ উদ্ধার হলেন। তাঁর প্রকৃত চৈতন্য হলাে। সেই দিন থেকে ব্রত উপবাস শিক্ষা করলেন। পাটাই দেবীর কৃপায় ছেলেপুলে হলো, ষষ্টী ঠাকরুণের কোপ গেল। ব্রাহ্মণী বউ নিয়ে সুখে ঘর কন্না করতে লাগলেন।

প্রণাম। সর্ব্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
  শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমােস্তুতে।

সমাপ্ত।