মেয়েলি ব্রত ও কথা/নাগপঞ্চমী

নাগ পঞ্চমী ব্রত।

 শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমীতে এই ব্রত করণীয়। বর্ষা সমাগমে সর্পগণ ক্ষেত্র ও অরণ্যের বিবর পরিত্যাগ পূর্ব্বক লোকালয়ে বাস করিতে অগ্রসর হইয়া থাকে। চোর অগ্নি ও ব্যাঘ্রভয় প্রভৃতি বিপদে সতর্কতা অবলম্বন বরং সুসাধ্য। কিন্তু। একমাত্র মনসাদেবীর কৃপা ভিন্ন সর্পভয় হইতে মুক্তিলাভের গত্যন্তর নাই। এক শ্রাবণ মাসেই নিম্নবঙ্গে সর্পদংশনে অধিকাংশ অকালমৃত্যু সঙ্ঘটিত হইয়া থাকে। সুতরাং এই সময় গ্রামবাসীদিগকে অতিশয় শঙ্কিত অবস্থায় কালযাপন করিতে হয়। পল্লিবাসিনীগণ শাস্ত্রবিহিত কৃষ্ণা পঞ্চমীতে একবার মাত্র ব্রত করিয়াই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না। তাঁহারা ভীতি-সঙ্কুল শ্রাবণের আদি এবং অন্তেও (আষাঢ় ও শ্রাবণ সংক্রান্তি দ্বয়ে) বিষহরী মনসাদেবীর অর্চ্চনা করেন। সুগৃহিণীগণ রাত্রে শয্যা নিদ্রার পূর্ব্বে মিলিত-করতলদ্বয়ের অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ঘন ঘন ললাট স্পর্শ পূর্ব্বক “আস্তীকস্য মুনের্মাতা” মনসাদেবীকে নমস্কার জ্ঞাপন করিয়া চক্ষু নিমীলিত করেন। প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গের পর তাঁহারা “দুর্গা দুর্গা” অক্ষরদ্বয় স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞতা স্বীকার পূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিয়া থাকেন। শ্রাবণ মাসে ইতর সমাজেও পদ্মপুরাণ বর্ণিত বেহুলা সতীর উপাখ্যান খোল ও করতাল সংযোগে পল্লি-সমূহ মুখরিত করিয়া তুলে। শ্রাবণের সংক্রান্তি দিবসে জলপ্লাবিত গ্রাম্যবর্ত্মে নৌকা বাইচ এক অপরূপ দৃশ্য। নৌকার গলুই উপরি স্থাপিত মৃণ্ময় অষ্টনাগমূর্ত্তি বহন করিয়া শত শত তরি অবারিত জলপথে “তীর তারা উল্কা ও বায়ুর” সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতা করিয়া প্রধাবিত হইয়া থাকে।

 ব্রতের দিন অন্নাহার নিষেধ। মনসা পূজায় কাঁচা দুধ ৩ পাঁচটা কলা নৈবেদ্যের প্রধান উপকরণ। মনসার পূজায় ধুনা দিতে নাই। ধ্যান যথা;

ওঁ দেবীমম্বা মহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাং,
হংসারূঢ়ামুদারাং সুললিতনয়নাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ।
স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কণকমণিগণৈঃ নাগরত্নৈরনেকৈঃ,
বন্দেহহং সাষ্টনাগাং উরুকুচযুগলং ভোগিনীং কামরূপাং॥

নাগ পঞ্চমীব্রত কথা।

 এক ব্রাহ্মণী; তাঁর তিনপুত্র ও তিন পুত্র-বধূ। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি পড়ছে। বৌয়েরা পুকুরে স্নান কত্তে যাচ্ছিলেন। ছোট বউকে শুনিয়ে, বড় বউ বল্লেন, আজ হেন দিনে বাপের বাড়ী হলে বেশ ক’রে খিচুড়ি খাওয়া যেতো। মেজো বউ বল্লেন, আজ হেন দিনে বাপের বাড়ীতে ঘি মেখে চা’ল কড়াই ভাজা, কাঁটাল বীচি ভাজা, আর গরম গরম লুচি খেতুম। ছোট বউ জা-দের বাপের বাড়ীর বড়াই শু’নে চুপ করে রইলেন। তাঁরা বল্লেন, ছোট বউ, তুমি কিছু বল্লে না? দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ছোট বউ বল্লেন, বাপের বাড়ীতে “সেজনের” (অর্থাৎ “আমার”। ৩ পৃষ্ঠার নিম্নে টীকা দেখ।) আর কে আছে! বড় দুই ভাই ছিল, তাদেরও মা মনসা নিয়েছেন। শুনেছি, ছেলে বেলায় সর্পাঘাতে তারা মারা গেছে। বৃষ্টি বাদলার দিনে তোমাদের যদি ভাল খেতে এতই সাধ, তবে এখানেই কি আজ ঠাকরুণকে বলে খিচুড়ী আর ভাজাভুজি হ’তে পারে না? তোমরা নেয়ে ঘরে যাও; আমি দেখি যদি পারি পুকুর থেকে দুটি মাচ নিয়ে গিয়ে তোমাদের খাওয়াব। বড় বউ বল্লেন, এখানকার এ ডোবাটার ভেতর আর কি পাবে। আমার বাপের বাড়ীতে বাইরের দুটী পুকুরে বড় বড় রুই, কাতলা, ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু বল্লে বিশ্বাস করবে না, আমাদের খিড়কীর পুকুরে প্রায় এক হাত লম্বা কই মাচ যে কত, তা আর কি বলবো; আর আঃ, তার স্বাদই বা কি! মেজ বউও গরব ক’রে ঐরূপ একটা কিছু বল্লেন।

 বড় ও মেজো নেয়ে চলে গেল পরে, ছোট বউ দেখলেন, দুটো শোল মাচ জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি তাই ধরে নিয়ে গিয়ে হেঁসেলে গামলা ঢাকা দিয়ে রাখলেন। তারপর গামলা তুলে দেখেন, শোল মাচ তো নয়, দুটা সাপ! তার গা শিউরে উঠলো। তখন সাপ দুটী সুন্দর মানুষের মুর্ত্তি ধরে বল্লে, বোন আমাদের নাম এয়ারাজ ও মুনিরাজ, আমরা তোমার দাদা। মা মনসার কাছে আমরা পরম সুখে আছি। তুমি তোমার জা-দের বাপের বাড়ীর বড়াই শুনে মুখ ছোট করে থাক, তা আমাদের মনে বড় দুঃখ হয়; চল তোমাকে নিয়ে মা মনসার কাছে যাই, আবার দিন সাতেক পরেই তোমাকে এখানে রেখে যাব। এই ব’লে তাঁরা ভগিনীর শ্বাশুরীর কাছে গিয়ে তাকে বাপের বাড়ী নে যাবার প্রস্তাব কল্লেন। ব্রাহ্মণী বল্লেন, সে কি কথা গো; ছোট বৌয়ের বাপের বাড়ীতে তার ভেয়েরা আছে তা তো আগে জানতুম না। এয়োরাজ ও মুনিরাজ বল্লেন, আমরা ছোট বেলায় বিদেশে গেছলুম সেখানে আমাদের সর্পাঘাত হয়েছিল বটে, কিন্তু মা মনসার বরে বেঁচেই আছি।

 ভেয়ের ছোট বউকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে সাত সমুদ্র পার হ’য়ে এক মহা অরণ্যে প্রবেশ কল্লেন। তারপর মা মনসা ঠাকরুণের বাড়ীতে পঁহুছিলেন। সেখানে বাড়ীর মেয়ের মত ছোট বউয়ের পরম সমাদর। আজ খিচুড়ী, কাল মাংস, তারপর নানারকম ভাজা, গরম গরম লুচি ছোট বউ রোজ আহার কত্তে লাগলেন। একদিন মনসা ঠাকরুণ ‘ছোট বউ’কে আদর ক’রে বল্লেন, মা আজ নাগপঞ্চমী, আমি মর্ত্ত্যে পূজোর নেমতন্নে যাচ্ছি, তুমিই আমার হয়ে রান্নার উয্যুগ সুয্যুগ ক’রে ভেয়েদের খাওয়াবে, আর নাগেদের দুধ খেতে দিবে। নাগেরা অদুরে ছেলে, অল্পেতেই রেগে উঠে; দেখো, তাদের যেন কোন বিষয়ে ত্রুটী না হয়। তাই শুনে আমাদের ছোট বউ বল্লেন, মা তোমার কোন চিন্তা নাই, আমি সব করবো। মনসা দেবী মর্ত্ত্যে চ’লে গেলেন।

 শ্রাবণ মাস বৃষ্টির দিন। গরম গরম খাওয়া ভাল, এই মনে ক’রে ছোট বউ দুধ জ্বাল দিয়ে খুব গরম থাকতেই নাগেদের গর্ত্তে টলে দিলেন।[১] হিতে বিপরীত হলো। গরম দুধ লেগে নাগেদের কারুর মুখ, কারুর ঠোঁট, কারও বা সর্ব্বাঙ্গ পুড়ে গেল। দারুণ রাগে নাগেরা গর্জ্জিয়া উঠিল। কি, আমরা হলুম কদ্রুসন্তান নাগ, কোথেকে এক সামান্য মানবকন্যা এসে কি-না এদের অপমান করবে! এয়োরাজ ও মুনিরাজ আস্তীককে সঙ্গে ক’রে বাসুকি মামাকে ব’লে ক’য়ে নাগেদের শান্ত কত্তে চেষ্টা কল্লেন। কিন্তু গোখরো ও বোড়া নাগের রাগ কিছুতেই থামিল না। তারা তেড়ে গিয়ে মানবকন্যার বাঁ হাতে ও বাঁ পায়ে দংশন কল্লে। ছোট বউ ঢ’লে পড়লো। মনসা ঠাকরুণ এসে দেখলেন, প্রমাদ হয়েছে। তিনি বল্লেন, আমি তখনি মনে করেছিলুম দেবে মানবে একঠাই হলে একটা কিছু না বেধে যাবে না। আমি মানবকন্যাটীর তো কোন দোষ দেখতেতে পাচ্ছিনে; ভাল কত্তে গিয়েই এর মন্দ হলো। মা মনসার আশীর্ব্বাদে তখন ছোট বউ বেঁচে উঠলো। মনসাদেবীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি হলো। দেবী এয়োরাজ ও মুনিরাজকে আগেকার প্রাণ দান কল্লেন ও বল্লেন, তোমরা ভগিনীকে নিয়ে তোমাদের বাড়ী যাও। এই ব’লে ছোট বউকে গা-ভরা গহনা তার দুই ভাইকে ধন রত্ন দিয়ে বিদায় কল্লেন।

 এয়োরাজ ও মুনিরাজ বাড়ী এসে ঘর দো’র দুরন্ত ক’রে, ভগিনীকে অনেক জিনিষ পত্র সঙ্গে দিয়ে তার শ্বশুর বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। ব্রাহ্মণী এত গহনা ও জিনিষ দেখে আশ্চর্য্য হলেন। বড় বৌ ও মেজ বৌয়ের যেন একটু হিংসা হলো। ছোট বউয়ের গা-ভরা গহনা। কিন্তু সর্পাঘাতের ঘা এখনো ভালরূপে শুকোয় নাই, এই জন্যে তিনি বাঁ হাতের ও বাঁ পায়ের বালা ও মল খুলে রেখেছেন। তাই দেখে, ছোট বউকে শুনিয়ে, বড় ও মেজ বউ বলাবলি কোরচেন, আধ-অঙ্গে গহনা পরেই এত ঝম্ ঝম্‌, সর্ব্বাঙ্গে পরলে এ বাড়ীতে তিষ্ঠানো ভার হবে। তাই শুনে, হঠাৎ কোথেকে একটা সাপ এসে ফোঁস করে মাথা তুলে বড় বৌ ও মেজ বৌয়ের দিকে চেয়ে বল্লে,

পরের মন্দে ভাল যে করে,
ভাতে পুতে সে বাড়ে।
পরের ভালোয় মন্দ যে করে,
ভষ্ম হয়ে সে মরে।

সেই দিন থেকে ছোট বউয়ের সঙ্গে বড় বউ ও মেজ বউয়ের ভয়ে ভয়ে খুব ভাব হয়ে গেল।

 কিছু কাল পর, এয়োরাজ ও মুনিরাজ আবার ভগিনীকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে যেতে লোক পাঠাইলেন। তখন ছোট বৌয়ের সন্তান সম্ভাবনা। বড় মানুষ কুটুম, আর প্রথম সন্তন পিত্রালয়ে হওয়াই ভাল, এই মনে ক’রে ব্রাহ্মণী বউকে যেতে দিলেন।

 যথা সময়ে ছোট বউয়ের এক পরম সুন্দর পুত্র সন্তান হলো। এয়োরাজ ও মুনিরাজ খুব সমারোহ ক’রে ভাগনের অন্নপ্রাশন দিলেন। ছেলের ভাতের নিমন্ত্রণ পেয়ে ছেলের বাপ, জেঠারা ঠাকুরমা ও জেঠাইরা ছেলের মামা বাড়ী এলেন। সেখানে খুব ঘটাঘটি হলো। সন্দেশের ছড়াছড়ি, দইয়ের কাদা। রোজ ৫০ মণ মাচ। ছোট বউ জা-দের যারপর নাই সমাদর কল্লেন। বড় কই মাচের জন্যে অনেক চেষ্টা কল্লেন, শেষে বড় বৌয়ের বাপের বাড়ীর খিড়কির পুকুরেও লোক পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট বৌয়ের মনে একটা বড় দুঃখ রয়ে গেল, এক হাত লম্বা কই মৎস্য কোথাও পাওয়া গেল না!

 এই ব্রত যে করে, মা মনসা জলে জঙ্গলে তার ছেলে পুলে রক্ষা করেন। চিরকাল সুখে যায়।

 প্রণাম। আস্তীকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকে স্তথা।

জরৎকারু মুনেঃ পত্নী মনসাদেবি নমোস্তুতে।


  1. এই কল্পিত ঘটনা হইতেই বোধ হয় বিষহরী মনসার পূজায় কাঁচা দুগ্ধ দেওয়ার প্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়াছে।