মেয়েলি ব্রত ও কথা/মূলাষষ্ঠী
মূলা-ষষ্ঠী ব্রত।
অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লষষ্ঠী তিথিতে মূলোষষ্ঠীব্রত করিতে হয়। নিরামিষ আহারের গৌরব প্রকটিত করা অন্যতম উদ্দেশ্য বলিয়া বোধ হয়। পক্ক আম্রফল নৈবেদ্যের প্রধান উপকরণ বলিয়া জৈষ্ঠ্য মাসের অরণ্যষষ্ঠীব্রতের অপরনাম আমষষ্ঠী। তদ্রূপ, শীতকাল সুলভ (অথচ মাঘ মাসে নিষিদ্ধ) মুলক তরকারির অগ্রহায়ণে প্রথম আবির্ভাব বলিয়া উহা অতি সমাদরে নিবেদন করা যায়, এই জন্য এই ব্রতের ঐরূপ নামকরণ। ইহার অপর নাম “ছয় আনাজের যষ্ঠী”। ব্রতচারিণী সধবাগণও এ দিন ছয় আনাজের নিরামিষ ব্যঞ্জন আহার করেন। ছয় আনাজের মধ্যে মুলো সর্ব্বপ্রধান। অন্য পাঁচটী তরকারি সম্বন্ধে বিশেষ নিয়ম নাই। সাধারণতঃ গোল আলু, রাঙ্গা আলু, বেগুণ, মিঠে কুমড়ো, সিম,পটোল, ঝিঙ্গে, উচ্ছে, কপি, কড়াইশুঁটি এতন্মধ্যে যে কোন পাঁচটী লইবে। আনাজ কুটিয়া বাটনা বঁটিয়া পুজার কাছে দিতে হয়। আলিপনা, পূজা ও অন্য নৈবেদ্যাদি অরণ্যষষ্ঠীর ন্যয়। কেবল দুর্ব্বার আটি ও পাখা লইতে হয় না। কিন্তু নোড়ার উপর দুর্ব্বা দ্বারা ‘ষাট বাছা’ তন্ত্র মন্ত্র অরণ্যষষ্ঠীর মত। আর একটী বিশেষ প্রভেদ এই যে পিটুলির দ্বারা ক্ষুদ্র গাই ও ও বাছুরের পুতুল গড়িতে হয়। যত জন ব্রত করিবেন ততটী গাই ও ততটা বাছুর গড়িবে। হলুদ, চুণ ও মশলা সংযোগে সাদা, হলদে, লাল প্রভৃতি নানা রঙ্গের পুতুল গড়িবে। পূজান্তে প্রত্যেকে একটা গাই ও একটা বাছুর হাতে লইয়া ব্রত কথা শুনিবে। পরে ছেলেরা ঐ পুতুল দ্বারা খেলা করে।
মূলা-ষষ্ঠীব্রত কথা।
এক ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাঁর মাংস খেতে সাধ গেল। এক দিন কোথেকে এক হাঁস নিয়ে এসে ব্রাহ্মণীকে বলেন, আমার মাংস খেতে ইচ্ছে হয়েছে, আমায় রেঁধে দাও। আর তুমি না পার, বউমাকে বল, সেই রেঁধে দিবে। তার বাপেরা বড় লোক, কত দেখেছে শুনেছে ও ভাল রান্না জানে। বউ মাংস রেঁধে বাড়ীর দাসীকে বল্লে, ঝি, ঠাকুর এত সাধ ক’রে খাবেন, তুই একটু চেকে দেখ, কেমন রান্না হয়েছে। আমার সকল সময় নুন আন্দাজি ঠিক হয় না। দাসী কোন দিন মাংস খায়নি। তার বড় লোভ হলো। সে খানিকটা খেয়ে বল্লে, যে গরম দিয়েছ কিছু স্বাদ পেলুম না; আর একটু দাও দখি। আবার মাংস চেকে বল্লে, হাঁ হয়েছে, তবু যেন কেমন একটু লাগছে; আবার দাও দেখি। বেশী করে দাও, ঠাওরাতে পাচ্ছিনে। লোভে ঝির নোলা সগবগিয়ে উঠেছে, এম্নি ক’রে চাক্তে চাক্তে হাঁড়ির মাংস ফুরিয়ে গেল। বউ বল্লে, ঝি তুই কি কল্লি, সব মাংস খেয়ে ফেল্লি! কি হবে! তুই শীগগির দৌড়ে যা, আর একটী হাঁস যদি পাস্ তবে তোকে পুরস্কার দেবো, আমি দাম দিচ্ছি। ঝি ভয়ে ও পুরস্কারের লোভে হাঁস না পেয়ে, অবশেষে পাড়ায় গেরস্তদের একটা আধ-মরা রোগা বাছুর ছিল, তাই লুকিয়ে কেটে বউকে মাংস এনে দিলে। মাংস কিছুতেই সিদ্ধ হয় না। বউ বল্লে, ঝি, কি মাংস আন্লি, সেদ্ধ হয় না কেন? তোর বুকের পাটা তো কম নয়। ঝি যতমত খেয়ে বল্লে, সে কি কথা গো, হাঁসের মাংস চিন্তে পার না? তোমরা রাঁধতে জান বটে, কিন্তু মাংস চেন না। এই বলে সে লুকিয়ে কতকগুলি পেঁয়াজ বেটে হাঁড়িতে ফেলে দিলে। পেঁয়াজের গন্ধে বউ তিষ্ঠাতে পারেন না। ভাবলেন পেঁয়াজ দিয়েছে, সর্ব্বনাশ হয়েছে! আর কি মাংস আন্লে তাও তো বুঝতে পাচ্ছি না। কিন্তু কা’কে বলি, একথা কার কাছে বলবার নয়, শোনবারও নয়। অনেক ভেবে চিন্তে বউ ঠিক কল্লেন, খাবার জায়গা পিছল করে রাখি, পরিবেশন করবার সময় আমি আছাড় খেয়ে পড়বো, আমার যেন দাঁত কপাটি লেগেছে কথা কইব না। লোকজন রান্নাঘরে ঢুকবে, তবেই হেঁসেলের হাঁড়ি কুড়ি সব নষ্ট হয়ে যাবে, ঠাকুরের খাওয়া হবে না। তবেই যদি ব্রাহ্মণের জাত রক্ষা কত্তে পারি, আর উপায় দেখি না। যা ভাবলেন তাই কল্লেন। ভাতের থানা হাতে ক’রে হঠাৎ পড়ে গেলেন, কথা কইতে পারেন না। পাড়ার লোকে রান্নাঘর ভ’রে গেল। ব্রাহ্মণের খাওয়া হলো না। জাত রক্ষা হলো। তারপর বউ সুস্থ হয়ে উঠলেন। শ্বশুরের প্রশ্নে মিছে কথা বলা যায় না। বউ ঝির উপর সন্দেহের কথা প্রকাশ কল্লেন, আর জাত রক্ষার জন্যে যা যা করেছিলেন সব বল্লেন। তখনি খোঁজ খবর করাতে দাসীর বাছুর কাটার কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো। তা শুনে সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে দিন অঘ্রাণ মাসের শুক্লাষষ্ঠী। বউ ছেলে বেলা হ’তে ষষ্ঠী ব্রত করতেন। ব্রত ক’রে পূজার জল দুর্ব্বা যেখানে বাছুরের হাড়-গোড় ছিল তার উপরে ছড়িয়ে দিলেন। তখনই মরা বাছুর বেঁচে উঠলো। সকলে অবাক হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ ভাবলেন, বউ তো নয়, স্বয়ং লক্ষ্মী! তখন ব্রাহ্মণ সোণার ষষ্ঠী গড়িয়ে মুক্তার হার পরিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করলেন। সে দিন তিনি নিরামিষ আহার ক’রে পৃথিবীতে প্রচার ক’রে দিলেন, ষষ্ঠীব্রতের দিন মাংস দূরে থাক কেউ মাছও যেন না খায়। এই ব্রত যে করবে সে পুত্রকন্যা নিয়ে পরম সুখে কালযাপন করবে।[১]
প্রণাম। জয়দেবি জগন্মাতঃ ইত্যাদি।
- ↑ আশা করা যায় উপরোক্ত ব্রত কথা পাঠ করিয়া অন্ততঃ দু'একটী উদ্ভ্রান্ত হিন্দু যুবক “হোটেল” বা মাংস-বিপণির আহার স্পৃহা সংযত করিতে চেষ্টা করিবেন।