মৈমনসিংহ গীতিকা/কঙ্ক ও লীলা

 কঙ্ক ও লীলা

 (১) দামোদর দাস

 (২) রঘুসুত

 (৩) শ্রীনাথ বেনিয়া এবং

 (৪) নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত

কঙ্ক ও লীলা

দামোদর দাসের বন্দনা
গোলক বৈকুণ্ঠপুরী প্রথমে বন্দনা করি
তার মধ্যে বন্দি নারায়ণ।
পদ্মযোনি বন্দি গাই যাহা হইতে জন্ম পাই
যেহি দেব সৃজন-কারণ॥
কৈলাস পর্ব্বত যথা শিবদুর্গা বন্দি তথা
তাহে বন্দুম কার্ত্তিক-গণপতি।
সর্ব্ব দেবদেবীসার তাহার সঙ্গেতে আর
যোগমায়া লক্ষ্মী-সরস্বতী॥
তারপর বন্দি আমি হরশিরে মন্দাকিনী
যাহা হইতে পাপীর উদ্ধার।
অন্তকালেতে যান একবিন্দু কৈলে পান
মহাপাপী যায় স্বর্গ দ্বার॥
পরেতে বন্দনা করি কুবের যমের পুরী
ইন্দ্র আদি দশ দিকপাল।
রাত্রদিবা ভেদ নাই চন্দ্র-পূর্য্য বন্দি গাই
অন্তক বন্দিনু যমকাল[]
তেত্রিশ কোটি দেবগণে বন্দি গাই তার সনে
মুনি বন্দুম ষাইট হাজার।
বাপ-মায় বন্দি গাই যাহা হইতে জন্ম পাই
ভক্তি রত্ন সাধনের সার॥

বন্দিনু পাতালপুরে সর্প রাজ বাসুকিরে
বসুমতী যার শিরে স্থিতি।
সরল ত্রিপদী ছন্দে দামোদর দাসে বন্দে
সভা পদে জানায় মিনতি॥



নয়ান চান্দের বন্দনা


চার কোণা পৃথিবী বন্দুম বন্দুম তরুলতা।
উপরে আকাশ বন্দুম নীচে বসুমাতা॥
পিতা বন্দুম মাতা বন্দুম বন্দুম জ্যেষ্ঠ ভাই।
যা হৈতে সুহৃদ এই ত্রিভুবনে নাই॥
চন্দ্রসূর্য্য বন্দি গাই জগতের আখি।
যাহার প্রসাদে আমি রাত্রদিবা দেখি॥
সাগর-পর্ব্বত বন্দুম জলে বন্দুম মীন।
সভার চরণ বন্দি গাই আমি দীনহীন॥

* * * *

সরস্বতী মায়েরে বন্দুম যোরি দুই কর।
যার হতে পাইলু এই দেবের আসর॥
তুমি যদি ছাড়ো মাগো আমি না ছাড়িব।
বাজন্ত নূপুর হইয়া চরণে লুটিব॥
শুদ্ধাশুদ্ধ নাহি জানি আমি অন্ধমতি।
নিজগুণে ক্ষমা মোরে কর সভাপতি॥

* * * *

সভাপতির চরণ বন্দি নয়ান চান্দে কয়।
দুর্লভ মনুষ্য জন্ম হয় বা না হয়[]

শিবু গাইনের বদনা

পূর্ব্ব পূর্ব্ব পণ্ডিতেরা রচিলেন গান।
তাদের চরণে আমার সহস্র প্রণাম॥
গাহনা গাহিয়া আমি ফিরি বাড়ী বাড়ী
সভার প্রসাদে কিন্তু পাই চাউল-কড়ি॥
ইনাম বক্‌সিস্ কিছু সভাপদে চাই।
কর্মকর্তার কাছে একখান নববস্ত্র পাই॥
ভাল মন্দ নাহি জানি না চিনি আখর।
সরস্বতী মাগো মোর কণ্ঠে কর ভর॥
জিহ্বাতে বসিয়া মোর তুমি গাও গান।
তোমার চরণে মাগো সহস্র প্রণাম॥
খোল-করতাল বন্দুম যন্ত্র যত ইতি।
ওস্তাদের চরণ বন্দি করিয়া মিনতি॥
শিবু গাইন নাম মোর আশুজিয়া বাড়ী।
সভার চরণে আমি পরিচয় করি॥

লীলার বারমাসী আরম্ভ

এইমতে বন্দনা-গীত অবশেষে থুইয়া।
লীলার বারমাসীর কথা শুন মন দিয়া॥


(১)

কঙ্কের জন্ম ও পিতামাতার মৃত্যু

দিশা—দুর্লভ মনুষ্য জন্ম আর হবে না। 

বিপ্রপুরে[] ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
ভিক্ষাবৃত্তি করি করে জীবন পালন॥
গুণরাজ নাম তার ভার্য্যা বসুমতী।
পতিব্রতা সেই নারী অতি ভক্তিমতী॥
সারাদিন ভিক্ষা মাগি দুয়ারে দুয়ারে।
সন্ধ্যাকালে ফিরে বিপ্র আপনার ঘরে॥
এইমতে নিতি যাহা করয়ে অর্জন।
ইতে কোন মতে করে জীবনধারণ॥
সংসারেতে ভার্য্যা ভিন্ন কেহ নাহি ছিল।
কিছুদিন পরে এক পুত্র জনমিল॥
কেমনে পালিবে পুত্রে না দেখে উপায়।
কেউ নাহি চায় পুত্র কেউ নাহি পায়॥[]

* * * *
* * * *

সাটিয়ারা[] দিনে তাল পাতায় লিখিয়া।
কঙ্ক নাম রাখে মাতা আদর করিয়া॥

ছয় না মাসের শিশু হইল যখন।
দারুণ রোগেতে হইল মাতার মরণ॥
ভার্য্যার লাগিয়া বিপ্র পাগল হইয়া ফিরে।
কেবা রাখে শিশু পুত্রে কেবা ভিক্ষা করে॥
চিন্তাজ্বরে গুণরাজ মৈল অবশেষে।
কপালের লিখন এই কহে নয়ান ঘোষে॥

দিশা—মা তুই কোথায় রইলে গো তোর বালক সায়রে ভাসাইয়া। 

খাকুয়া[] বলিয়া কেউ নাহি লয় কোলে।
সংসারেতে কেউ নাহি শিশুরে যে পালে॥

* * * *


(২)

মুরারি চণ্ডালের গৃহে কঙ্ক

মুরারি নামেতে এক চণ্ডাল সুজন।
শিশুরে দেখিয়া তার দুঃখী হৈল মন॥
কোলেতে লইয়া শিশু নিজ ঘরে আনে।
চণ্ডালিনী পালে তারে পরম যতনে॥
নিজ পুত্র তেঁই[] স্নেহ করে দুইজনে।
মুরারিরে বাপ বলি শিশু মনে জানে॥
কৌশল্যারে ডাকে কঙ্ক জননী বলিয়া
জনকজননী পুন পাইল ফিরিয়া॥
ব্রাহ্মণকুমার হৈল চণ্ডালের পুত।
কর্ম্মফল কে খণ্ডায় কহে রঘুসুত॥

* * * *

পঞ্চ না বৎসরের শিশু হৈল যখন।
তেরাখিয়া[] জ্বরে মৈল চণ্ডাল সুজন॥

পতির লাগিয়া কান্দি দিবসরজনী।
অনাহারে অনিদ্রার ধরে চণ্ডালিনী॥
যে ডালে ভর করে সেই ভাঙ্গি যায়।
কেমনে বাচিবে শিশু কি হইবে উপায়॥
দিবানিশি চণ্ডালের শ্মশানে পড়িয়া।
দুই দিন গেল কেবল কান্দিয়া কান্দিয়া॥
কেহ নাহি হাত ধরে নেয় ফিরে ঘরে।
ভাত পানি দিয়া কেউ জিজ্ঞাসা না করে॥
বিধির বিচিত্র নীলা কে করে খণ্ডন।
কার সাধ্য নারে যদি রাখে নারায়ণ॥



(৩)

গর্গের আলয়ে

দিশা—আমার না হৈল মরণ। 

কান্দিতে কান্দিতে আমার গো যাইল জীবন॥

গর্গ নামে ছিল এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ।
শিষ্যালয় হইতে বাড়ী করেন গমন॥
পরম পণ্ডিত তিনি ধর্ম্মে বড় জ্ঞানী।
সর্ব্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত লোকে কয় শুনি॥
দেখিয়া শ্মশানে শিশু যায় গড়াগড়ি।
হাত ধরি উঠাইলা গিয়া তাড়াতাড়ি॥
নামাবলী দিয়া শিশুর বয়ান মুছায়।
সঙ্গেতে লইয়া কঙ্কে নিজ ঘরে যায়॥
দেখিয়া গায়ত্রী দেবী সুখী হৈলা মনে।
পুত্রহীনা পুত্র পাইল মাতা মাতৃহীনে॥[]

গোপাল রাখিল নাম গায়ত্রী জননী।
স্নেহভরে খাওয়ায় কঙ্কে ক্ষীর-সর-ননী॥
সেই দিন হইতে কঙ্ক উঠিয়া প্রভাতে।
লইয়া গর্গের ধেনু চরায় মাঠেতে॥
সন্ধ্যাকালে গাভী লইয়া ফিরে কঙ্ক ঘরে।
সিকায় তুলা দুগ্ধকলা খাওয়ায় কঙ্কেরে॥

* * * *

নরম স্বভাব তার সুন্দর মূরতি।
আচার বেভারে[১০] কঙ্কের সুখী সবে অতি॥
বড় বুদ্ধিমন্ত কঙ্ক বাখানি তাহারে।
মুখে মুখে সিলুক[১১] কত শিখিল অন্তরে॥
দেখিরা গর্গের মনে ইচ্ছা হইল ভারি।
দশ না বৎসরের কালে হাতে দিলা খরি॥
আদরে যতনে কঙ্কের সুখে দিন যায়।
লেখাপড়া করে আর ধেনু যে চড়ায়।১—২৪


(8)

বিপদের উপর বিপদ্

দুঃখিতের দুঃখ না যায় বিধি হৈল যাম।
বরাতের ফেরে হায় হৈল কোন কাম॥
গায়ত্রী জননী মৈল শীতলা রোগেতে।
কঙ্কের কপাল মন্দ কয় রঘুসুতে॥

দিশা—আমার দুঃখে দুঃখে গেল দিন। 
দয়া কর দয়াময়ী জেনে দীনহীন॥

দুঃখের লাগিয়া গোসাঞি রাখিলা পরাণি।
বাঘে ভৈষে নাহি খায় না ছুঁয় ডাকিনী॥

সুতের[১২] সেওলা হৈয়া ভাসিয়া বেড়ায়।
তৃতীয় বারেতে পুন হারাইলা মায়॥
লীলা নামে ছিল গর্গের একটী দুহিতা।
ভূঁয়েতে লুটিয়া কান্দে হারাইয়া মাতা॥
অষ্ট না বছরের লীলা মায়ে হারাইয়া।
বুঝিল কঙ্কের দুঃখ নিজ দুঃখ দিয়া॥
ভাই বোন মত তবে দুঁহু করে বাস।
এক জনে কান্দে যখন অন্যে দেয় আশ॥
কঙ্কেরে না দিয়া ভাত লীলা নাইযে খায়।
দুই জনে গলাগলি ঘুরিয়া বেড়ায়॥
ধেনু চরাইতে রোদে কঙ্কে মানা করে।
কঙ্কের বিরহ লীনা সহিতে না পারে॥
ঘর না ছাড়িয়া কঙ্ক থাকে যতক্ষণ।
কঙ্কের বিরহে লীলার মন উচাটন॥
দরদর দুনয়নে বহে জলধারা।
কাজকাম ফেলি লীলা পন্থে রয় খাড়া॥
বাথান[১৩] হইতে কঙ্ক ধেনু লইয়া আইসে।
আবের পাঙ্‌খা লইয়া লীলা বৈসে তার পাশে॥১—৪২


(৫)

লীলার যৌবনে পদার্পণ

হাসিয়া খেলিয়া লীলার বাল্যকাল গেল।
সোনার যৈবন[১৪] আসি অঙ্গে দেখা দিল॥
শাউনিয়া[১৫] নদী যেমন কূলে কূলে পানি।
অঙ্গে নাহি ধরে রূপে চম্পকবরণী॥
ভাদ্র মাসের চান্নি[১৬] যেমন দেখায় গাঙ্গের তলা।
বৃক্ষতলে গেলে কন্যা বৃক্ষতল আলা॥

নদীর ঘাটে গেলে কন্যা জ্বলে নদীর পানি।
লীলারে দেখিয়া বান্দে[১৭] সাউদের[১৮] তরণী॥
পুষ্প না বাগানে কন্যা পুষ্প তুলতে যায়।
মৈলান[১৯] হইয়া ফুল পাতাতে লুকায়॥
চাদমুখ দেখিয়া চান্দ আন্ধাইরেতে লুকে[২০]
পন্থের পথিক লীলার মুখ চাইয়া দেখে॥
কি কব সে রূপের কথা কইতে নাহি পারি।
চন্দ্রের সমান রূপ দেখিতে অপ্সরী॥
সুন্দর বদন লীলার ফোটা পদ্মফুল।
হাটিয়া যাইতে লীলার মাটীত পরে চুল॥
চাচর চিকণ কেশ লীলার বাতাসেতে উড়ে।
বর্ষাতিয়া[২১] চান্দে যেমন ক্ষণে আবে[২২] ঘিরে॥
উপরে যোর ভুরু নীচে নয়ানতারা।
মধুলোভে পুষ্পে যেমন বৈসাছে ভমরা॥
কাল কাজলে রাঙ্গা তার দুটী পাশে।
বর্ষাকাল্যা তারা যেমন মেঘের উপর ভাসে॥
ডালিমের ফুল যেমন বাতাসেতে উড়ে।
সিন্দুর মাখিয়া কন্যার দিয়াছে অধরে॥
তাহাতে খেলার হাসি না দেখে কোন জন।
সরমে ঢাকয়ে কন্যা আপন যৌবন॥
তার মধ্যে দত্ত লীলার নাহি যায় দেখা।
দুর্লভ মুকুতা যেমন ঝিনুর মধ্যে ঢাকা॥[২৩]
মুষ্টিতে আটয়ে লীলার চিকণ কাকালী[২৪]
হাটিয়া যাইতে কন্যার যৈবন পরে ঢলি॥

ভরা কলসি যেমন নাহি ঝল্‌কে[২৫] পানি।
সেইমত সুন্দরী লীলার চাইল-চালনী॥

বার না বছরের কন্যা তেরতে পড়িল।
আপনে দেখিয়া আপনে চিন্তিত হইল॥
বেশের নাহি আদর-যতন কেশের বন্ধনী।
কোথা হইতে আইল পাগল জোয়ারের পানি॥[২৬]
একেশ্বরী হইয়া লীলা থাকয়ে বিজনে।
ফুটিয়া বনের ফুল থাকে যেমন বনে॥
সোনার যৈবনকাল কহে নয়ান দাসে।
সাধিলে না থাকে যৈবন যত্নে নাহি আইসে॥[২৭]

* * * *

কলসী লইয়া লীলা যায় নদীর জলে।
উজান বহিয়া নদী যায় কল কলে॥
নদীর কিনারা কন্যা গো কলসী রাখিয়া॥
চাহিল নদীর জলে আঁখি ফিরাইয়া॥
হেরি সে সুন্দর রূপ চমকে সুন্দরী।
শীঘ্রগতি ঘরে ফিরে লইয়া গাগরী[২৮]

* * * *

মনের সুখেতে কঙ্ক আছে গর্গ পুরে।
গুরুর নিকটে থাকি নানা শাস্ত্র পড়ে॥
পুরাণ সংহিতা আদি হরেক প্রকার।
শিখিয়াছে যথাবিধি শাস্ত্র অলঙ্কার॥
ফেরুষাই[২৯] বারমাসী সঙ্গীত যে কত।
শিখিয়াছে কঙ্কধর তাহা শত শত॥

কঙ্কের বাঁশী শুনে নদী বহে উজান বাঁকে[৩০]
সঙ্গীতে বনের পশু সেও বশ থাকে॥
ভাটিয়াল গানেতে ঝরয়ে বৃক্ষের পাতা।
এক মনে শুন কহি তাহার বারতা॥

* * * *

“আইস আইস প্রাণের বন্ধুরে বইস আমার কাছে।
দেখিব তোমার মুখে কত মধু আছে॥
তুমি হও তরুরে বন্ধু আমি হই লতা।
বেইরা রাখব যুগলচরণ ছাইড়া যাইব কোথা॥
তোমারে শুইতে দিবরে বন্ধু অঞ্চল বিছান।
মুখেতে তুলিয়া তোমায় দিব সাচীপান॥
গলেতে গাঁথিয়ারে দিব মালতীর মালা।
ঝাড়িয়া পুঁছিয়া দিব তোমার গায়ের ধূলা॥
তুমিরে ভমরা বন্ধু আমি বনের ফুল।
তোমার লাইগারে বন্ধু ছাড়বাম জাতি-কুল॥
ধেনু বৎস লইয়া তুমি যাওরে বাথানে।
বন্দের[৩১] লাইগা থাকি চাইয়া পথ পানে॥
পথ নাহি দেখিরে বন্ধু ঝুরে আখি জলে।
পাগলিনী হইয়। ফিরি তিলেক না দেখিলে॥
নয়নের কাজলরে বন্ধু আরে বন্ধু তুমি গলার মালা।
একাকিনী ঘরে কান্দি অভাগিনী লীলা॥
না যাইও না যাইও বন্ধুরে আরে চরাইতে ধেনু।
আতপে শুকাইয়া গেছেরে বন্ধু তোমার সোণার তনু॥
আইস আইস বন্ধু খাওরে বাটার পান।
তালের পাংখায় বাতাস করি জুড়াক রে পরাণ॥
আহারে প্রাণের বন্ধু তুমি ছিলে কৈ।
তোমার লাইগা ছিকায় তোলা গামছা-বান্দা দৈ[৩২]

গামছা-বান্দ। দৈরে বন্ধু শালিধানের চিড়া।
তোমারে খাওয়াইব বন্ধু সামনে থাক্যা খাড়া॥
শ্রীনাথ বানিয়া কয় পীরিত বড় জ্বালা।
দণ্ডেক অদেখা কন্যা না হও উতলা॥

গোষ্ঠ হতে সুরভি ঐ আসিতেছে ফিরি।
ওই শোনা যায় বাজে বন্ধুর বাঁশরী॥
আইসাছে প্রাণের বন্ধু পাইয়া বহু ক্লেশ।
ঘামেতে ভিজিয়া গেছে তোমার মাথার কেশ॥
আনিতে তালের পাঙ্‌খা লীলা ঘরে যায়।
অঞ্চল পাতিয়া কঙ্ক শুয়ে আঙ্গিনায়॥১—৮৮


(৬)

যবন পীরের আগমন

এমন সময়ে কিবা হইল বিবরণ।
কহিব সকল সবে শুন দিয়া মন॥
সারগিদ[৩৩] লইয়া পঞ্চপীর একজন।
গোচারণ মাঠে আসি দিল দরশন॥
বটগাছের তলখানি চাছিয়া ছুলিয়া।
বাগ করে পীর দরগা স্থাপনা করিয়া॥
নামিডাকি[৩৪] পীর তার বড় হেকমত[৩৫]
ধূলা দিয়া ভাল করে আইসে রোগী যত॥
অন্তরের কথা নাহি দেয় বলিবারে।
আপুনি কহিয়া যায় অতি সুবিস্তারে॥
মাটী দিয়া বানায় মেওয়া কিবা মন্ত্রবলে।
শিশুগণে ডাকি তবে হস্তে দেয় তুলে॥

অবাক হইল সবে দেখি কেরামত।
দর্শন-মানসে লোক আইসে শত শত॥
যে যাহা মানত করে সিদ্ধি হয় তার।
হেকমত জাহির হইল দেশের মাঝার॥
চাউল-কলা কত সিন্নি আইসে নিতি নিতি।
মোরগ ছাগল কইতর[৩৬] নাহি তার ইতি॥
সিন্নির কণিকামাত্র পীর নাহি খায়।
গরীব দুঃখীরে সব ডাকিয়া বিলায়॥


(৭)

পীর ও কঙ্ক

বাথানে ছাড়িয়া ধেনু, হস্তেতে লইয়া বেনু,
 ছায়াতলে বসিয়া মাঠেতে।
কঙ্কধর গায় গান, শুনিলে জুড়ায় কান,
 যত সব রাখাল সহিতে॥
মধুর গাহানা[৩৭] শুনি, দৌড়িয়া সকল প্রাণী,
 কঙ্কপানে সবে ছুটে ধায়।
পশুগণ ভূমিতলে, পাখীরা বসিয়া ডালে,
 শুনি সবে শ্রবণ জুড়ায়॥
সুধা মাখা গানে তার, কুকিলায় মানে হার,
 বীণাতন্ত্রী লাজেতে মৈলান।
যুবতী ব্যাকুল ঘরে, যৈবন আইসে ফিরে,
 নদী-নালা বহেত উজান॥


বাথানে যখন বাজে কঙ্কের মোহন-বেনু।
উচ্চ পুচ্ছে ছুটে আসে গোষ্ঠের যত ধেনু॥

আহা রে কঙ্কের বাঁশী ধরে কত মধু।

কাঁকের কলসী ভূমে থুইয়া শুনে কুলবধূ॥
* * * *

এমন মধুর গীত, কেবা করে আচম্বিত,
 শুনি পীর ভাবে মনে মনে।
এ নহে সামান্য জন, পীরের হৈল মন
 ডাকাইয়া আনে নিজস্থানে॥
পীরের নিকটে বসি, মলুয়ার বারমাসী
 যবে কঙ্ক মধুরে গাহিলা।
আহা কিবা মনোহর, অশ্রু বহে দর দর,
 শুনি পীর মোহিত হইলা॥
এইরূপে নিতি নিতি, করে কঙ্ক গতায়তি
 গাহে গান পীরের সদনে।
ধেনুয়া ছাড়িয়া মাঠে, পীরের চরণে লুটে,
 কাটে সুখে ধর্ম্ম আলাপনে॥
বুদ্ধিমন্ত অতি ধীর, কঙ্কেরে দেখিলা পীর,
 মধু তার ঝরিছে বয়ানে।
আহা কিবা ভাব ভক্তি, বাখানি কবিত্বশক্তি,
 কিবা রূপ জিনিয়া মদনে॥
ভাবে পীর মনে মনে, আনি কঙ্ক নিজস্থানে,
 রাখে তারে শিষ্য বানাইয়া।
আসিলে আমার সনে, কঙ্ক অতি অল্পদিনে
 মায়া-মোহ যাবে কাটাইয়া॥
দামোদর দাসে কয়, এ ছেলে সামান্য নয়,
 গোবরে ফুটিল পদ্মফুল।
আন্ধাইরে জ্বলিল মণি, নানা গুণে হৈল গুণী,
 উজালা করিয়া নিল কুল॥১—৪০

(৮)

গোপন দীক্ষা

জুহরী[৩৮] জহর চিনে বেনে চিনে সোনা।
পীর প্যাগাস্বর চিনে সাধু কোন জনা॥
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া।
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া॥
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে।
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে॥
তার পর জাতি-ধর্ম্ম সকলি ভুলিয়া।
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া॥
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে।
সর্ব্বনাশের কথা গৰ্গ কিছুই না জানে॥
জাতি-ধর্ম্ম নাশ হৈল রটিল বদনাম।
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম[৩৯]
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে।
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে॥
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ-প্রাণ-মন।
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমৰ্পণ॥
গুরুতে বিশ্বাস যার গুরু ইষ্ট ধন।
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ॥১-১৮


(৯)

সত্যপীরের পাঁচালী

দেখিয়া শুনিয়া পীর, কঙ্কেরে করিলা স্থির
 উপযুক্ত ভক্ত এহি জন।
সত্যপীরের পাঁচালী, কঙ্কেরে লিখিতে বলি,
 একদিন হৈল অদৰ্শন॥

গুরুর আদেশ মানি, লিখিয়া পাঁচালী আনি[৪০]
 পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে।
কঙ্কের লিখন কথা, ব্যক্ত হৈল যথা তথা,
 দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে॥
কঙ্ক আর রাখাল নহে, কবিকঙ্ক লোকে কহে,
 শুনি গর্গ ভাবে চমৎকার।
হিন্দু আর মোসলমানে, সত্যপীরে উভে মানে,
 পাঁচালীর হৈল সমাদর॥
যেই পূজে সত্যপীরে, কঙ্কের পাঁচালী পড়ে,
 দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায়।
বুঝি কঙ্কের দিন ফিরে, রঘুসুত কহে ফেরে,
 দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায়॥১–১৬


(১০)

কঙ্ককে জাতিতে তোলা

জানিয়া শুনিয়া কানে, ভাবে গর্গ মনে মনে,
 নহে কঙ্ক সামান্য মানব।
ভক্তিমান অতি ধীর, গর্গ কৈলা মনে স্থির,
 কঙ্কে ঘরে তুলিয়া লইব॥
পণ্ডিত সমাজী[৪১] গণে, একত্র করিয়া ভণে[৪২],
 “এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয়।
জ্ঞান মানে নাহি রয়, চণ্ডালের অন্ন খায়,[৪৩]
 ধরে নিতে নাহিক সংশয়[৪৪]॥”

এতেক শুনিয়া নন্দু আর যত গোড়াহিন্দু
 কয় সবে মাথা নাড়াইয়া।
“আমরা সম্মত নহি, আরও শুন সবে কহি
 লহ কঙ্কে মোদেরে ছাড়িয়া॥[৪৫]

জন্মিয়া চণ্ডালের অন্ন খায় যেই জন
যে তারে সমাজে তুলে নহে সে ব্রাহ্মণ॥
অনাচারে জাতি নষ্ট, নষ্ট হয় কুল।
মাটিতে পড়িলে কেহ নাহি তুলে ফুল॥”

আর একদল ভয়ে গর্গে ডরাইয়া।
গর্গের কথায় শুধু গেল সায় দিয়া॥
আদেখা হইলে গর্গ করে কত ফন্দি।
কঙ্কে না তুলিতে ঘরে করে অন্দি সন্দি[৪৬]
কত তর্ক-যুক্তি গর্গ সকলে দেখায়।
তবু নাহি সে বিধি দিল পণ্ডিতসভায়॥
কেহ বলে তুলি ঘরে কেহ বলে নয়।
এই মতে নানা স্থানে বহু তর্ক হয়॥

চারি দিকে দাউ দাউ অনল জ্বলিল।
জ্বলিলেন গর্গ মুনি কঙ্ক ভস্ম হইল॥
এমন সুখের ঘর পুড়ে হল ছাই।
নিয়তি খণ্ডিতে পারে হেন সাধ্য নাই॥
আছিল চণ্ডাল কঙ্ক হইল ব্রাহ্মণ।
কঙ্কেরে নাশিতে যুক্তি করে দ্বিজগণ॥১—৩০

(১১)

কঙ্কের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণগণের ষড়যন্ত্র

নানা মত ভাবি তারা উপায় করিল।
সাপের চখেতে যেন ধূলা-পড়া দিল॥

রটে কঙ্ক নহে শুধু চণ্ডালের পুত।
মোসলমান পীরের কাছে হৈল দীক্ষিত॥
হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি।
কেহ ছিড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী॥
জাতি গেল মোসলমানের পুঁথি নিয়া ঘরে।
যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে॥

আর এক কথা রটে না যায় কথন।
‘কঙ্কেরে সঁপেছে লীলা জীবন-যৌবন॥’
সন্ধ্যা-মন্ত্র নাহি জানে বেদাচারহীন।
দুরন্ত দুর্জন যারা সমাজেতে ঘৃণ॥
মদ্য-মাংস খায় সদা পাষণ্ড-আচার।
জন্মিয়া ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার॥
মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া।
‘কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া॥’
একে ত কুমারী কন্যা অতি শুদ্ধমতি।
কলঙ্ক রটাইল তার যত দুষ্টমতি॥১—২২


(১২)

গর্গের মনে ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং কঙ্ক ও লীলার প্রাণনাশের সঙ্কল্প

এতেক শুনিয়া গৰ্গ ক্রোধচিত্ত হৈলা।
কেবা শত্রু কেবা মিত্র বুঝিতে নারিলা॥
“দুগ্ধ দিয়া কালসাপে করিনু পোষণ।
ফাক পাইয়া সেই মোরে করিল দংশন॥
খেদাইলে দূরে তবু মিটে নাহি আশ।
স্বহস্তে নিশ্চয় কঙ্কে করিব বিনাশ॥”

কপালের লেখা হায় কে খণ্ডাবে বল।
রঘুসুত কহে হিতে বিপরিত ফল॥

“কি কলঙ্ক কৈল মোর কহন না যায়।
কঙ্কেরে মারিয়া পরে মারিব লীলায়॥
তারপর প্রবেশিয়া জলন্ত আগুনে।
প্রায়শ্চিত্ত করব নিজে শরীর দহনে॥”


লজ্জা আর ক্রোধে গর্গ পাগল হইয়া।
এখানে সেখানে যায় ঘুরিয়া ফিরিয়া॥
ক্রোধস্বরে গর্গ লীলায় ডাক দিয়া বলে
ভয়েতে লীলার চক্ষু ভরি গেল জলে॥
“শুন কন্যা লীলাবতী আমার বচন।
ঝাটহ জলের ঘাটে করহ গমন॥
শীঘ্রগতি আন জল কলসী ভরিয়া।
দেবের মন্দির গেল অপবিত্র হইয়া॥
কুস্বপন দেখিয়াছি কাল নিশাভাগে।
দেবতা চলিয়া যান তেই সে বিরাগে॥
জল লইয়া তুমি আইস তাড়াতাড়ি।
স্বহস্তে মন্দির আমি পরিষ্কার করি॥
অপবিত্র ঘরখানি পবিত্র করিব।
জনমের তরে শেষ পূজায় বসিব॥”


সুশীলা সরলা লীলা কিছু না বুঝিল।
কোন কথা ভয়েতে না জিজ্ঞাসা করিল॥
বাপের আদেশে লীলা নদীর ঘাটে যায়।
মনেতে ভাবিয়া কিছু খুঁজে নাহি পায়॥
দৈবেতে ঘটাইল কিবা অঘট ঘটন।
আজি কেন পিতা গর্গ হইল এমন॥
গাগরী তুলিয়া কাঁকে লীলা যায় জলে।
পথ নাহি দেখে লীলা নয়নের জলে॥
এমন হৈল পিতা কিসের কারণ।
কোন দিন দেখি নাই বিরসবদন॥

ভাবিতে ভাবিতে লীলা যায় যে চলিয়া।
কহিতে লাগিল গর্গ পশ্চাতে ভাকিয়া॥
“শুন কন্যা লীলাবতী আমার বচন।
আমিই আনিব জল দেবের কারণ॥[৪৭]
কলসী রাখিয়া তুমি যাও ফিরি ঘরে।
দেবের নৈবেদ্য মোর খাইল কুকুরে॥”

পিতার আদেশে নীলা বাড়ীতে ফিরিল।
কলসী লইয়া গর্গ ঘাটেতে চলিল॥
লেপিয়া পুছিয়া ঘর পবিত্র করিয়া।
লীলার হস্তে তুলা ফুল দিল ফালাইয়া॥[৪৮]
সিংহাসন শালগ্রাম সকলি ধুইল।
সিনান করিয়। তবে পূজায় বসিল॥
দেব-পূজা করি গর্গ পবিত্র মন্দিরে।
বিশ্রাম করিয়া গেল ভোজন আগারে॥
প্রতিদিন পূজা কার্য্য সমাপন করি।
লীলায় ডাকিয়া কহে অতি তাড়াতাড়ি॥
নিজ হস্তে নীলা গর্গে করায় ভোজন।
আজি নাহি ডাকে লীনায় কিসের কারণ॥

কঙ্কের লাগিয়া ভাত লীলা যত্ন করে।
টানাইয়া রাখে নীলা কাগমলা[৪৯] উপরে॥

চকিত হইয়া গর্গ চারিদিকে চায়।
মানুষ জন কিছু নাহি দেখিবারে পায়॥
কৌটা খুলি কালজর[৫০] অন্নে মিশাইলা।
গোপনে থাকিয়া লীলা সকলি দেখিলা॥

দুঃসংবাদ


“আর বার বলে কঙ্ক ‘দেবী, তোমারে সুধাই।
তোমারে কান্দিতে জমি কভু দেখি নাই॥”

কঙ্ক ও লীলা, ২৮৩ পৃঃ

দেখিয়া শুনিয়া লীলার উড়িল পরাণ।
নিদয় হইয়া পিতা হইলা পাষাণ॥

বাথান হইতে সঙ্গে সুরভি লইয়া।
যথাকালে কক্ষধর আসিল ফিরিয়া॥
সিনান করিয়া কঙ্ক ঘরেতে যাইয়া।
দেখে লীলা ভাত লইয়া কান্দিছে বসিয়া॥
কঙ্ক বলে “লীলা দেবী কান্দ কি কারণ।
গৃহেতে ঘটিল কিবা অঘট-ঘটন॥
গোষ্ঠ হইতে ফিরি পথে দেখি অমঙ্গল।
সুরভি মুখেতে নাহি লইল তৃণ-জল॥
আর দিন আমি যবে গোষ্ঠ হতে আসি।
জিজ্ঞাসেন পিতা কত নিকটেতে আসি॥
আজি কিবা অপরাধ করিনু চরণে।
জিজ্ঞাশিয়া উত্তর না পাই তে কারণে॥”

পাষাণের মূর্ত্তি লীলা দাণ্ডায় অচল।
দুই চক্ষু বহি তার ঝড়ে অশ্রু-জল॥

* * * *

কথা নাহি সরে কঙ্কের হৃদয় বিদরে॥
আর বার বলে কঙ্ক “দেবী, তোমারে সুধাই।
তোমারে কান্দিতে আমি কভু দেখি নাই॥
আজি কেন বসুমতী কান্দিয়া ভাসাও।
কথা যদি নাহি বল মোর মাথা খাও॥
জানিত কি অজানিত অথবা স্বপনে।
করিয়াছি অপরাধ নাহি আইসে মনে॥”

বহুক্ষণ পরে লীলা অতীব যতনে[৫১]
কান্দিয়া কান্দিয়া কণ্ঠে কহিল গোপনে॥
“আমার মিনতি রাখ শুন কঙ্কধর।
পলাইয়া যাও গো তুমি ভিন্ন দেশান্তর॥

মনুষ্য-বসতি নাই নাহি মাতাপিতা।
যে দেশে বান্ধব নাই তুমি যাও তথা॥”

তারপর লীলাবতী গোপনে বসিয়া।
গর্গের সকল ফন্দি দিল জানাইয়া॥
“কতিপয় দুষ্ট লোক পিতারে ছলিল।
সর্ব্বনাশহেতু সবে যুক্তি করিল॥

* * * *

“কাল-গরল-বিষ অন্নে মাখাইয়া।
আসিছে রাক্ষসী লীলা তোমারে খুঁজিয়া॥
নাহি দয়া নাহি মায়া পাষাণ তার হিয়া।
রাক্ষসী হইয়াছে লীলা মনুষ্য হইয়া॥
কেমন করিয়া কিবা পরাণে ধরাই।
নিজ হস্তে বিষ দিয়া তোমাকে খাওয়াই॥
আজ তুমি ভিন্ন দেশে যাওরে পলাইয়া।
মরিবে অভাগী লীলা এ বিষ খাইয়া॥
শুন শুন শুনরে কঙ্ক আরে কঙ্ক আমার বচন।
যাইবার বেলা দেইখা যাহ লীলার মরণ॥”

শুনিয়া লীলার কথা কঙ্ক চমৎকার।
পন্থ নাহি পায়[৫২] শুধু দেখে অন্ধকার॥
নিদারুণ কথা কঙ্ক শুনিল যখন।
মস্তকে হুইল যেন বজ্রের পতন॥
ক্ষণেক থাকিয়া লীলায় কহে ধীরে ধীরে।
“দুষ্টের ছলনে পিতা ভুলেছে নিজেরে॥
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী মোর সাক্ষী দেবগণে।
স্বপ্নে নাহি জানি পাপ পিতার চরণে॥
পরম পণ্ডিত পিতা কিছুদিন পরে।
দুষ্টের ছলনা প্রভু পাইবে বুঝিবারে॥

শুন দেবী লীলাবতী আমার বচন।
কিছুদিন করিব আমি তীর্থে তে ভ্রমণ॥

“রাখিও পিতারে তব অতি যত্ন করে।
ভ্রম দূর হলে পিতার আসিব পুন ঘরে॥
অপরাধযোগ্য কার্য্য কিছুই না জানি।
সাক্ষী আছে চন্দ্রসূর্য্য দিবসরজনী॥
মনে করি বনে করি যত অনাচার।
দেবতা-ধরা দেখ সাক্ষী হয়রে তার॥
মেলানি মাগিয়ে[৫৩] কঙ্ক লীলা তোমার কাছে।
আবার হইবে দেখা প্রাণে যদি বাচে॥
কিছুকাল ধরে লীলা তুমি রহ একাকিনী।
সুরভি পাটলী তোমার রহিল সঙ্গিনী॥

“ঘরে আছে পোষারে পাখী হীরামণ শারী।
তাহারে ডাকিও রে লীলা ‘কঙ্ক’ নাম ধরি॥
নাহি মাতা নাহি রে পিতা আমার নাহি বন্ধু-ভাই।
যে দিকে কপালে নেয় তথি চইলে যাই॥
আর এক কহিব লীলা গো আমার নিবেদন।
অভাগা বলিয়া কঙ্কে রাখিও স্মরণ॥

“রৈল রৈল লীলা তোমার তোতা শারী।
ক্ষীর-সর দিয়। তারে পালিও যত্ন করি॥
রইল রইল রে লীলা পুষ্প-তরু যত।
জলসেচন দিয়া পালিও অবিরত॥
রইল রইল রে লীলা মালতীর লতা।
আজি হতে রইল পইরা তোমার মালা গাঁথা॥
সুরভি পাটলী রইল রে লীলা প্রাণের দোসর।
তৃণ জল দিয়া সবে করিও আদর॥

“আমার লাগিয়া যদি তারা হয়রে দুঃখমনা।
গায়ে হাত বুলাইয়া করিও সান্ত্বনা॥
গৃহের দেবতা রইল রে লীলা শালগ্রাম শিলা।
শুদ্ধ মনে পূজা তারে করিও তিন বেলা॥
দেবের পূজা রে লীলা হেলা না করিও।
সর্বনাশ ঘটিবে তবে নিশ্চয় জানিও॥
তোমার আমার গুরুরে লীলা রইলেন পিতা।
জীবনে মরণে যিনি সাক্ষাৎ দেবতা॥
এমন দেবের পূজা রে লীলা না করিও হেলন।
ইহ পরকাল নষ্ট নিশ্চয় মরণ॥
অত্যাচার করেন যদি লইও শির পাতি।
নারায়ণে স্মরিও সদা অগতির গতি॥
দুঃখ না করিও রে লীল। আমার লাগিয়া।
আবার হইবে দেখা আসিলে বাচিয়া
আজি হতে মনে কইর কঙ্ক আর নাই।
বিপদে করুণ রক্ষা তোমারে গোসাঞি॥”

আবার ভাবে রে কঙ্ক আপনার মনে।
কিরূপে বিদায় হইব পিতার চরণে॥১-১৫০


(১৩)

সুরভির মৃত্যু

কুটীর ছাড়িয়া গর্গ ঘুরিয়া ঘুরিয়া।
কেমনে বধিৰে লীলায় চিন্তে মন দিয়া॥
ক্রমে বেলা হইল গত রবি অস্ত যায়।
আশ্রমে না ফিরে গর্গ ঘুরিয়া বেড়ায়॥
“দেবের মন্দির হইল পিশাচের থানা[৫৪]
এমন পূজার ফুলে কীট দিল হানা[৫৫]

কলঙ্কে ঘাটিয়া নিল চাঁদের পসর।[৫৬]
দেবের অমৃত ফল খাইল বানর॥
আর না ফিরিব আমি আশ্রমে আমার।
আগুনে পুড়াইয়া সব করি ছারখার॥
মনেতে করিনু স্থির ভাবিয়া চিন্তিয়া।
মারিব পাপিষ্ঠা কন্যা জলে ডুবাইয়া॥”

পাষাণও দয়াল হয় হেরিলে লীলায়।
দুষমনও ফিরিয়া আঁখি পালটিয়া চায়॥[৫৭]
যাহার লাগিয়া গর্গ লইল সংসারী।
বিরাগী হইয়া নাহি ছাড়ি গেল বাড়ী॥
হইল পাষাণ গর্গ নাহি আর দয়া।
করিবে তর্পণ কঙ্কের রক্ত দিয়া॥”

* * * *

বিরলে বসিয়া কঙ্ক ভাবে মনে মন।
যাইবে সেই দেশে যথা নাহি মানুষ-জন॥
কেউ নাহি পাইবে খুঁজ কিবা নামধাম।
এমন সময়ে হায় হৈল কোন কাম॥
দৌড়িয়া আসিয়া লীলা সুধায় কঙ্কেরে।
আউল মাথার কেশ বাক্য নাহি সরে॥
“আমার বচন লহ শীঘ্রগতি আস।
আশ্রমে ঘটিল আজি কিবা সর্ব্বনাশ॥
সুরভি ভূমেতে পড়ি হইল অচেতন।
বুঝি তারে কালসাপে করিল দংশন॥
কাল-গরল-বিষে সুরভি ঢলিল।
আজি হইতে আমাদের কপাল ভাঙ্গিল॥
বিচারিয়া[৫৮] আন তুমি ওঝা একজন।
সুরভির কাছে আমি যাই ততক্ষণ॥”

দৌড়াদৌড়ি করি কঙ্ক-লীলা ছুটে যায়।
ছটফট করে ধেনু বিষের জ্বালায়॥
মনে মনে ভাবে কঙ্ক কি হইল হায়।
কালেতে খাইল যারে কি করে ওঝায়॥
লীলায় ডাকিয়া কঙ্ক ত্বরিতে শুধায়।
“বিষ-মাখ। ভাত কোথা রাখিল লীলায়॥”

বেতের ডোগার[৫৯] মত কাঁপিয়া কাঁপিয়া।
আঙ্গুলি নির্দ্দেশে লীলা দিল দেখাইয়া॥
কঙ্ক বলে “লীলা দেবী, হৈল সর্ব্বনাশ।
কিবা ক্ষতি যদি মোর হৈত প্রাণনাশ॥
দেবতা মোদের প্রতি বিরূপ হইল।
ঠাকুর বাড়ীতে হায় গোহত্যা হইল॥”

দেখিতে দেখিতে ধেনু সুরভি মরিল।
আকুল হইয়া লীলা কান্দিতে লাগিল॥
পরেত চলিয়া লীলা গেলা রসুই ঘরে।
অঞ্চল পাতিয়া শুয়ে ছুঁয়ের উপরে॥

* * * *

কপালের দোষে যেমন রামের বনবাস।
দামোদর দাসে ভনে হৈল সর্বনাশ॥
আড়াই প্রহর রাত্রি কঙ্ক কি কাম করিল।
নিম্ব বৃক্ষ তলে যাইয়া শুইয়া নিদ্রা গেল॥
ঘুমে নাহি ঢুলে আখি উঠ বৈসি করে।
বিষম চিন্তার কীট পশিল অন্তরে॥

ক্ষণে ক্ষণে তন্দ্রামগ্ন হেরিল স্বপন।
বড়ই আশ্চর্য্য কথা শুন সভাজন॥

স্বপনে দেখিল কঙ্ক রাত্রিশেষ-কালে।
শ্মশ্মশান থলাতে[৬০] পড়ে জ্বলন্ত অনলে॥
চৌদিকে পিচাশ করে তাণ্ডব-নিত্তন।
কান্দে কঙ্ক “প্রাণে মরি রাখছ জীবন॥

* * * *

রক্ত-গৌর তনু তার কাঞ্চনের কায়া।
আগুন হইতে কঙ্কে দিল বাচাইয়া॥
স্বপনে আদেশ তার পাইয়া কঙ্কধর।
প্রভাতে ‘গৌরাঙ্গ’ বলি তেজিলেন ঘর॥

* * * *


(১৪)

লীলার কঙ্ককে অন্বেষণ

প্রভাতে উঠিয়া লীলা কঙ্কের উদ্দেশে।
আলুই[৬১] মাথার কেশ পাগলিনী বেশে॥
পরথমে পশিল লীলা কঙ্কের শয়ন-ঘরে।
শূন্য শেষ[৬২] পরে আছে কঙ্ক নাহি ঘরে॥
গোয়াল ঘরেতে লীলা ধায় পাগলিনী।
শূণ্য গৃহ পরে আছে দেখে অভাগিনী॥
নয়নেতে নিদ্রা নাই পেটে নাই অন্ন।
সর্বস্থান খুঁজে লীলা করি তন্ন তন্ন॥
হেমন্তে জোয়ারে নদী জায় উজানিয়া।
তখাতে বেড়ায় লীলা কঙ্কেরে খুঁজিয়া॥
মালতী-বকুলে লীলা জিজ্ঞাসে বারতা।
“তোমরা নি দেইখছি আমার কঙ্ক গেল কোথা॥”
একস্থানে শতবার করে বিচরণ।
“কোথা কঙ্ক” বলি লীলা ডাকে ঘন ঘন॥

পোষমানা পাখীগণে লীলা কান্দিয়া সুধায়।
“তোমরা নি দেইখাছ কঙ্ক গিয়াছে কোথায়॥”
উড়িয়া ভমর বইসে মালতী-বকুলে।
তাহারে জিজ্ঞাসে কন্যা ভাসি আখিজলে॥
বস্ত্র না সম্বরে লীলা নাহি বান্ধে চুল।
আজি হইতে আশা-ভরসা সকলি নির্ম্মূল॥
আজি হইতে গেলরে কঙ্ক সন্ন্যাসী হইয়া।
অভাগিনী লীলার না বুকে শেল দিয়া॥
যাইবার কালেতে আমায় নাহি দিলা দেখা।
এহি ছিল অভাগী লীলার কপালের লেখা॥


(১৫)

গর্গের ধন্না দেওয়া ও দৈববাণী

গর্গের হৈল কিবা শুণ বিবরণ।
চৌদিকে পাগলপ্রায় করিল ভ্রমণ॥
সারারাতি অনিদ্রায় ফিরি ঘুরে ঘুরে।
প্রভাতে ফিবিল গর্গ আপনার ঘরে॥
আসিতে পথের মাঝে অমঙ্গল নানা।
চারিদিকে যেন প্রেত-পিশাচের থানা॥
কাক সাচান[৬৩] করে দিবসেতে রা।
ডাক শুনি মুনিব কাপিল সর্ব্ব গা॥
পথ কাটি শিবা ধায় না চায় ফিবিয়া।
ঝটিতে চলিল মুনি আশ্রমে ধাইয়া॥
চারিদিক শূন্যময় শুধু হাহাকার।
এত বেলা হলো কেহ না খোলে দুয়ার॥
মালতী-মল্লিকা পড়ে ঝরিয়া ভূতলে।
ভ্রমরা উড়িয়া যায় নাহি বসে ফুলে॥

নাহি খায় পুষ্প-মধু না দেয় ঝঙ্কার।
বিপদ ভাবিয়া মুনি দেখে অন্ধকার॥
দেবালয়ে নাহি বাজে ভোরের আরতি।
কাল বুঝি পূজা-গৃহে না জ্বলিল বাতি॥
পুষনিয়া[৬৪] পাখী যত নীরব খাচায়।
নাহি ডাকে কঙ্কে তারা না ডাকে লীলায়॥
প্রভাতে আসিয়া গর্গ আশ্রমে প্রবেশে।
নয়নেতে নিদ্রা নাই পাগলিয়া বেশে॥
আশ্রমে পশিয়া গর্গ দেখিলা তখন।
কালবিষে সুরভি যে তাজিছে জীবন॥
হাম্বারবে মা মা বলি ডাকিছে পাটলী[৬৫]
গর্গের পাষাণ প্রাণ আজি গেল গলি॥
কাতরে মায়ের কাছে হাম্বারবে ধায়।
কভু বা আসিয়া গর্গের চরণে লুটায়॥

এই মতে বহুক্ষণ কান্দিয়া পাগল-মন
 গর্গ পরে হইল সুস্থির।
ঘাটেতে সিনান করি বাড়ীতে আসিয়া ফিরি
 প্রবেশিলা ভিতর মন্দির॥
কপাটেতে খিল দিয়া পূজায় বসিল গিয়া
 চকে বহে জল দর দর।
বলি আজ আত্মদানে দামোদর দাসে ভণে
 অশ্রুধার পূজা উপচার[৬৬]

বলা-কওয়া করে লোকে এই মাত্র শুনে।
হত্যা[৬৭] দিয়াছেন গর্গ দেবের চরণে॥
অন্ন নাহি খায় গর্গ না খুলে দুয়ার।
ক্রমে কথা রাষ্ট্র হইল সহর-বাজার॥

শিষ্যগণ আশ্রমেতে আসি ফিরি যায়
দুইদিন গত গৰ্গ বসিছে পূজায়॥


দৈববাণী

“শুন শুন শুন গণ দেবের বচন।
দেবতা বিরূপ তোলা হইল যে কারণ।
আপন কন্যায় যে নারিতে মুক্তি করে।
পালিত জনেরে যেবা বিষ দিয়ে মারে॥”
গয়বি[৬৮] আদেশ গর্গ শুণিলা শ্রবণে।
কঙ্কেরে মারিতে বিষ দিল অকারণে॥
তেহি না কারণে তার এতেক সর্ব্বনাশ।
সেই বিষে সুরভির হইল প্রাণনাশ॥

* * * *

“না জানিয়া না শুনিয়া করিলাম কর্ম্ম।
আজি হইতে আমারে ছলিল শাস্ত্রধর্ম্ম॥[৬৯]
সর্ব্ব ধর্ম্ম পণ্ড হইল ইহ-পরকাল।
আপনার পায়ে মারি আপনি কুড়াল॥
সবলা সুশীলা কন্যা পাপ নাহি জানে।
হানিছি কাটারি ঘা তাহার পরাণে॥
অভিসন্ধি করিয়াছি মারিতে তাহায়।
কি কব পাপের কথা কইতে না জোয়ার॥
দেবের সমান যার অন্তর সরল।
হেন পুত্রে বধিবারে দেই হলাহল॥
আশ্রমে গোহত্যা হইল আমার কারণ।
অগ্নিতে পশিয়া আমি ত্যজিব জীবন॥”

* * * *

গো-হত্যা-জনিত পাপ কেমনে পাইবে মাপ
 করিবারে মুক্তির কামনা।
পুন বসি পূজাসনে অশ্রু বহে দুনয়নে
 কত মত করে আরাধনা॥
অবশেষে অতিরুষ্ট দেবতা হৈলা তুষ্ট
 তার অতি কঠোর সাধনে।
চতুর্থ দিবসে শুনি দেবতার দৈববাণী
 ইষ্টদেব তুষ্টির কারণে॥
আঙ্গিনার বাসী ফুলে অঞ্জলি ভরিয়া তুলে
 পূজা করে দেবের চরণ।
লীলার তোলা বাসী ফুলে পুজি প্রেম-অশ্রুজলে
 মুক্ত হৈল গর্গের জীবন॥
নগরিয়া সবে মিলে চক্রান্ত করি সকলে
 হল করি কঙ্কে খেদাইল।
বুঝিতে পারিয়া তবে ডাকাইয়া শিষ্য সবে
 কঙ্কেরে আনিতে যুক্তি দিল১—৭৮

(১৬)

বিচিত্র-মাধবের গমন

বিচিত্র-মাধবে গর্গ ডাকিয়া সম্ভাষে।
“কঙ্কের অন্বেষণে তোমরা যাও দেশে দেশে॥
বহুদিন পুত্র-জ্ঞানে পালিয়াছি যারে।
হীরামন তোতা মোর কোথা গেল উড়ে॥
চারিদিক শূন্য হেরি তাহার কারণ।
দেশে দেশে ঘুরি তোমরা কর বিচরণ॥
ভাইয়ের মতন তোমরা করিয়াছ স্নেহ।
কঙ্কের বিহনে মোর শূন্য হইল গেহ॥
মলিন চান্দের আলো ফুল হইল বাসী।
আমার লাগিয়। কঙ্ক হইল বৈদেশী॥

যাও যাও বিচিত্র আরে মাধব সুন্দর।
যেখানে যে দেশে গেছে পুত্র কঙ্কধর॥
লাগাল পাইলে তারে করেতে ধরিয়া।
আমার মাথার কিরা আসিও জানাইয়া॥
মাতৃহীন পাটলীরে দেয় তৃণজল।
আশ্রমে এমন আর নাহিক সম্বল॥”


“আর কইও আর কইও জানায়ে মিনতি।
সন্দেহ ঘুচেছে মোর কঙ্কধর প্রতি॥
আরও কইও আরও কইও পোষনিয়া পাখী
ক্ষীর-সর ত্যজিয়াছে তোমারে না দেখি॥
আন্ধাইরে ঢাকি রইছে চাঁদের বাগান।
আমার আশ্রম আজি হইয়াছে শ্মশান॥
যত দিন নাহি ফিরি কঙ্কেরে লইয়া।
তত দিন এহিমতে থাকিবে বসিয়া॥
না খাইব অন্ন আর না ছুইব পানি।
এইরূপে অনাহারে ত্যজিব পরাণী॥
যদি নাহি পাও তোমরা কঙ্কের দরশন।
তবে জাইন এহিভাবে আমার মরণ॥
আর যদি দেখা পাও কইও করে ধরি।
অপরাধ করিয়াছি ক্ষমা ভিক্ষ। করি॥”


গুরু-পদধূলি দোহে শিরে লইল তুলি।
আশীর্ব্বাদ করে গর্গ হরি হরি বলি॥
বিদায় হইয়া দোহে গর্গের চরণে।
চলিলেক দেশান্তরে কঙ্কের অন্বেষণে॥
বিচিত্র-মাধব যায় কঙ্কে অন্বেষিতে।
ঘরে থাকি নীল। তাহা শুনে সচকিতে॥১—৩৬

(১৭)

লীলার কষ্ট

অবধান সভাজন শুণ দিয়া মন।
বিরহিণী লীলার শুন যত বিবরণ॥
অন্ন নাহি খায় লীলা নাহি ছুয়ে পানি।
ভূতলে পাতিল শয্যা লীলা বিরহিণী॥

চলিছে বিচিত্র-মাধব কঙ্কের কারণে।
ঘরে বৈসা লীলাবতী দুঃখে ভাবে মনে॥
“অভিমানে কঙ্ক যদি ফিরে নাহি আসে।
কেমনে হইবে দেখা থাকিলে বৈদেশে॥
কি জানি কঙ্কেরে তারা খুঁজিয়া না পায়।
জিয়ন্তে না হবে দেখা কি হবে উপায়॥
আহা কঙ্ক কোথা গেলে ছাড়িয়া লীলায়।
তোমার মালঞ্চে ফুল বাসী হৈয়া যায়॥
পূবেতে উদয়রে ভানু পশ্চিমে অস্ত যাও।
ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিয়া কঙ্কের দেখানিগো পাও॥
এমন আন্ধাইর নাইরে তোমার আলো নাহি পশে।
যাওয়া-আসা ঠাকুর তোমার আছে সর্ব্বদেশে॥
কহিও কহিও ঠাকুর আরে তুমি দিনমণি।
যাহার লাগিয়া আমি হইনু পাগলিনী॥
লাগাল পাইলে তারে আমার কথা কইও।
আলোক চিনাইয়া পথ[৭০] দেশেতে জানিও॥”

“শুনরে বিদেশী ভাই মাঝি-মাল্লাগণ।
কত না দেশেতে তোমরা কর বিচরণ॥
পাহাড়ে পর্ব্বতে যাও তরণী বাহিয়া।
লাগাল পাইলে বন্ধে আনিও কহিয়া॥

যাহার লাগিয়ারে আমি হইলাম উন্মাদিনী।
নদীর কিনারে কান্দি বসি একাকিনী॥
দিবস না যায়রে মোর না পোহায় রাতি।
মন-দুঃখ কইও বন্ধে জানাইও মিনতি॥

“আর কইও কইওরে দুঃখু বন্ধেরে জানাই।
মরিতে তাহার লীলা বেশী নাকি নাই॥
শুন শুন নদী আরে শুন আমার কথা।
ভুমিত অভাগী লীলার জান মনের ব্যথা॥
তুমিত দরিয়ারে নদী আরে নদী কূলে তোমার বাসা।
তুমি জান কঙ্ক-লীলার মনের যত আশা॥
তুমি জান কঙ্ক-লীলার ভালবাসাবাসি।
জাগিয়া তোমার তীরে কাটাইয়াছি নিশি॥[৭১]
কত দেশে যাওরে নদী বহিয়া উজান।
কোথাওনি শুনিতে পাও নদী সেই বাঁশীর গান॥
পাহাড়ে পর্ব্বতে রে নদী তোমার যাওয়া-আসা।
অভাগীরে ছাইড়া বন্ধে কোথায় লইল বাসা॥
লাগাল পাইলে রে তারে কইও লীলার কথা।
মিনতি জানাইয়া কইও দুঃখের বারতা॥
নিশ্বাসে শুকায় রে নদী কান্দি গলে শিলা।
প্রাণেমাত্র এই ভাবে বাঁচি আছে লীলা॥
সেওত বেশী নহেরে নদী দিন যায় চলি।
মরিবে অভাগী লীলা আজি কিম্বা কালি॥
মরবার কালে দেখ্যা যাইতাম যুগলচরণ।
লাগাল পাইলে কইও লীলার দুষ্কের বিবরণ॥

রজনীকালের সাক্ষী শুন চন্দ্রতারা।
কোথায় হারাইল আমার নয়নের তারা॥
জাগিয়া পোহাইছি নিশি তোমরা ত জান।
কোন দেশে গেল বন্ধু বলহ সন্ধান॥

“সপ্তসাগর-তীরে পর্ব্বত অচলে।
যথা তথা যাও তোমরা এই নিশাকালে॥
অতি উচ্চে কর বাসা পাওত দেখিতে।
বল শুনি বন্ধু মোর গেল কোন পথে॥
শুন শুন শুনরে কথা যত তারাগণ।
তিলেকে বেড়াইতে পার এ তিন ভুবন॥
খুঁজিয়া দেখিও পিয়া আছে কোন স্থানে।
মরিবে অভাগী লীলা বলো তার কানে॥
নিশীথে নিদ্রার ঘোরে ছিলাম অচেতন।
অঞ্চল খুলিয়া চোরে নিয়াছে রতন॥
যে রত্ন খুঁজিয়া আমি ঘুরিয়া বেড়াই।
এমনি দুঃখের নিশি কান্দিয়া পোহাই॥
কান্দিতে কান্দিতে মোর অন্ধ হইল আখি।
কোন দেশে উইড়া গেল আমার পিঞ্জরের পাখী॥
এমন নিষ্ঠুর বিধি নাহি দিল পাখা।
উড়িয়া বন্ধের সঙ্গে করিতাম দেখ॥

“দিবস রাতির সাক্ষী তোমরা তরুলতা।
তুমি নি জান গো আমার কঙ্ক গেল কোথা॥
বল বল তরুলতা রাখ আমার প্রাণ।
দয়া করি বল তার পথের সন্ধান॥
আর যদি জানাবে বল যাইবার কালে।
অভাগী লীলার কথা গিয়াছে কি বলে॥”

বৃক্ষের ডালেতে যদি পংখী আইসা বসে।
কান্দিতে কান্দিতে লীলা তাহারে জিজ্ঞাসে॥

“উচ্চ ডালে বইসারে পাখী নজর বহুদূরে।
এই পথে নি যাইতে দেখছ আমার কঙ্কধরে॥
কত দেশে যাওরে তোমরা পাখী আরে উড়িয়া বেড়াও।
পূর্ণিমার চান্দে আমার দেখিতে নি পাও॥
দেখিতে নি পাওরে আমার হীরামণ তোতা।
দেখিলে জানাইও আমার দুঃখের বারতা॥
কইও কইও কইওরে তারে আমার মাথা খাও।
অভাগী লীলার দুঃখ যদি লাগাল পাও॥”

পিঞ্জিরাতে শারী-শুক গান করে বৈসে।
নিকটেতে গিয়া লীলা কান্দিয়া জিজ্ঞাসে॥
“তোমরাত পিঞ্জিরার পাখী নাহি থাক বনে।
তোমরা তাহার কথা ভুলিলা কেমনে॥
ক্ষীর-সর দিয়া পাখী পালিল যেজন।
কেমনে তাহার কথা হইলে বিস্মরণ॥
এত যে বাসিয়া ভাল পালিল সকলে।
কি বলিয়া গেল বঁধু যাইবার কালে॥
কোন দেশে যাবেরে বলি কহিল ঠিকানা।[৭২]
অবশ্য তোমাদের পাখী কিছু আছে জানা॥
ধরিয়া শারীর-গলা লীলা কহিছে কান্দিয়া।
আগে আগে চল আমার পথ দেখাইয়া॥
উড়িয়া যাইতে রে পাখী আছে তোমার পাখা।
একদিন অবশ্য পথে হবে তার দেখা॥”

উড়ায়ে খাচার পাখী বলে লীলাবতী।
ফিরায়ে কঙ্কেরে মোর আনহ ঝটিতি[৭৩]
উড়িয়া যাও হীরামণ তোতা উঠরে আকাশে।
শীঘ্রগতি চল মোর বন্ধু যেই দেশে॥

দেখিলে শুনাইও আমার দুঃখের গান।
বলিয়া কহিয়া আনিয়া তারে বাঁচাও লীলার প্রাণ॥
সম্পদ-কালেতে পক্ষী পালিল তোমায়।
ভুলিতে এমন জনে কভু না জোয়ায়[৭৪]
পৃথিবী ভ্রমিয়া পক্ষী করিও সন্ধান।
বারতা জানিয়া তাহার বাঁচাও লীলার প্রাণ॥১—১০৮

(১৮)

ষাণ্মাসিকী গীতি

"দারুণ ফাল্গুন মাস গাছে নানান ফুল।
মালঞ্চ[৭৫] ভরিয়া ফুটে মালতী-বকুল॥
মধু-লোভে যাওরে উড়ে ভ্রমরা-ভ্রমরী।
বহু দিন নাহি শুনি বঁধুর বাঁশরী॥
নানা দেশে যাওরে ভ্রমর আর পুষ্প-মধু খাও।
কৈও কৈও লীলার কথা যদি লাগাল পাও॥
কৈও কৈও বঁধুর আগে শুন অলিকুল।
মালতীর গাছে তার ফুটিয়াছে ফুল॥

“দারুণ চৈত্রের হাওয়া দূর হইতে আসে।
আমার বঁধু এমন কালে রৈয়াছে বিদেশে॥
গাছে গাছে সোণার পাতা ফুটে সোণার ফুল।
কুঞ্জেতে গুঞ্জরী উঠে ভ্রমরার রোল[৭৬]
ডালে বসে কোকিল ডাকে পুষ্পেতে ভ্রমর।
এমন না কালে বঁধু গেল দেশান্তর॥
না কইয়া না বইলারে বঁধু হইলা বৈদেশী।
মালঞ্চে ফুটিয়া ফুল ঝইরা হৈল বাসী॥
বিনা সুতে হার গাঁথি মালতী-বকুলে।
প্রাণের বঁধু নাহি ঘরে দিব কার গলে॥

কইও কইও কোকিলারে কইও বঁধুর আগে।
গাঁথা মালা বাসী হইলে প্রাণে বড় লাগে॥
যদি নাহি যাওরে কোকিল আমার মাথা খাও।
অভাগিনী লীলার দুঃখ বঁধুরে জানাও॥

“নূতন বৎসর আইল ধরি নব সাজ।
কুঞ্জে ফুটে রক্তজবা আর গন্ধরাজ॥
গাছে ধরে নবপত্র নবীন মুকুল।
চারিদিকে শুনি ধুমক্ষিকার রোল॥
এহিত বৈশাখ নাম অতি দুঃসময়।
দারুণ রৌদ্রের তাপে তনু দগ্ধ হয়॥
কোকিল কোকিলা মাগে বসন্ত বিদায়।
আমার বঁধু এমন কালে রইয়াছে কোথায়॥
নূতন বৎসর আইল মনে নব আশা।
অভাগী লীলার কাছে কেবলি নৈরাশা॥

“জ্যৈষ্ঠমাস জ্যেষ্ঠরে সকল মাসের বড়।[৭৭]
ফলে-ফুলে তরু-লতা দেখিতে সুন্দর॥
আম পাকে জাম পাকে পাকে নানান ফল।
মন সাধে ডালে বসি বিহঙ্গসকল॥
নানা গীতি গায়রে তারা নানান ফল খায়।
অচেনা অজানা দেশে উড়িয়া বেড়ায়॥
নিত্য আসে নব পাখী নূতন ভ্রমর।
কান্দিয়া সুধাইলে কেহ না দেয় উত্তর॥”
দারুণ গ্রীষ্মের তাপ জ্বলন্ত অনল।
ভূতলে শুইল কন্যা পাতিয়া অঞ্চল॥

“আষাঢ় মাসের কালে আশা ছিল মনে।
অবশ্য আসিবে বঁধু লীলা-সম্ভাষণে॥
নূতন বরষা আসে লইয়া নব আশা।
মিটিবে অভাগী লীলার মনের যত আশা॥

হাতেতে সোনার ঝাড়ি বর্ষা নামি আসে।
নবীন বরষা জলে বসুমাতা ভাসে॥
সঞ্জীবন সুধারাশি কে দিল ঢালিয়া।
মরা ছিল তরু-লতা উঠিল বাচিয়া॥
শুক্‌না নদী ভরে উঠে কূলে কূলে পানি।
বাণিজ্য করিতে ছুটে সাধুর তরণী॥
পাল উড়াইয়া তারা কত দেশে যায়।
আমার বঁধুর তারা লাগাল নি পায়॥
এতকাল ছিল রে লীলা বড় আশার আশে।
সাধুর তরণী বাহি বঁধু আইব দেশে॥
কত দিন বাঁচেরে প্রাণ আশায় ধরিয়া।
দুই মাস গেল লীলার কান্দিয়া কান্দিয়া॥


“কাল মেঘে সাজ করে ঢাকিয়া গগন।
ময়ূর-ময়ূরী নাচে ধরিয়া পেখম॥
কদম্বের ফুল ফুটে বর্ষার বাহার।
লতায় পাতায় শোভে হীরামণ[৭৮] হার॥
মেঘ ডাকে গুরু গুরু চমকে চপলা।
ঘরের কোণে লুকাইয়া কান্দে অভাগিনী লীলা॥
শ্রাবণ আসিল মাথে জলের পসরা।
পাথর ভাসাইয়া বহে শাউনিয়া[৭৯] ধারা॥
জলেতে কমল ফুটে আর নদী-কূল।
গন্ধে আমোদিত করি ফুটে কেওয়া ফুল॥
দিন-রাতি ভেদ নাই মেঘ বর্ষে পানি।
কুল ছাপাইয়া জলে ডুবায় ছাউনি॥
খাউরি বিউনা[৮০] করে যত ডুমের নারী।
কত দেশে যায় তারা বাহিয়া না তরী॥

“রৈয়া রৈয়া চাতক ডাকে বর্ষে জলধর।
না মিটে আকুল তৃষা পিয়াসে কাতর॥
কোন না বিরহী নারী হায় অভাগিনী।
অভেদ নাহিক জানে দিবস-রজনী॥
শাউনিয়া ধারা শিরে বজ্রধরি মাথে।
‘বউ কথা কও’ বলি কান্দি ফিরে পথে॥
কাহারে সুধাও রে পাখী আমি নাহি জানি।
আমিও তোমার মত চির বিরহিণী॥
শুনরে বিরহী পাখী আরে পাখী পাইতাম তোমার কাছে।
কহিতাম মনের দুঃখ মনে যত আছে॥
কি কব দুঃখের কথা কইতে না জুয়ায়।
দেশে না আসিল বঁধু বৰ্ষ বহি যায়॥
দিন যায় ক্ষণ রে যায় না মিটিল আশ।
এইরূপে কান্দিয়া গেল লীলার ছয় মাস॥
বিচিত্র-মাধব কঙ্কের সন্ধান করিয়া।
কঙ্কেরে লইয়া সঙ্গে আসিবে ফিরিয়া॥
এহিত আশাতে লীলার রাখিয়াছে প্রাণ।
রঘুসুতে কহে তোমার বিধি হইল বাম॥১—৯০

(১৯)

শোক-গাথা

ছয় মাস দেশে দেশে বনেতে ঘুরিয়া।
বিচিত্র-মাধব আইল দেশেতে ফিরিয়া॥
কঙ্কের সন্ধান নাই যে পাইল কোনখানে।
বিফল তালাস হায় রঘুসূতে ভনে॥

বিচিত্র-মাধবে দেখি লীলাবতী ধীরে।
জিজ্ঞাসে “আইলা নি কঙ্ক ফিরে নিজ ঘরে॥
শুন শুন বিচিত্র আরে মাধব সুন্দর।
ঘুরিয়া ফিরিয়া আইল। তোমরা বহু দেশান্তর॥

নানা স্থানে ঘুরিয়া আইলে বহু ক্লেশে।
প্রাণের ভাই কঙ্কের দেখা পাইলেনি কোন দেশে॥
বিচিত্র-মাধব শুনি লীলার বচন।
ধীরে ধীরে কহে দোহে করিয়া রোদন॥

“শুন বইন লীলাবতী আমাদের দুর্গতি
গেনু ছাড়ি আপন ভবন।
অনাহারে অনিদ্রায় অতি দুঃখে দিন বার
বহু কষ্টে করি অন্বেষণ॥
কপালের দোষে হায় নিদারুণ বিধাতায়
নাহি দিল সুদিন ফিরিয়া।
বৃথা কষ্টে কাটিলাম উদ্দেশ না পাইলাম
নিরর্থক আসিনু ঘুরিয়া॥
পরথমে আলয় ছাড়ি পূব মুখি গেনু ঘুরি
যথা হয় ছিলটের সহর।
সুর্মা গাঙ্গ্ খরসুতে[৮১] বহে পর্ব্বতের পথে
তালাসিনু ঘুরি ঘর ঘর॥
কামরূপ তারপরে ঘুরিয়া গেলাম ফিরে
দেখি তথায় কালীর মন্দিরে।
শনি আর মঙ্গলবারে যোরা মৈষ পাঠা পড়ে
আরও বলি দেয় কবিতরে[৮২]
পশ্চিম দিকেতে পরে গেনু নবদ্বীপ পুরে
যথা প্রভু গৌরাঙ্গ জন্মিল॥
গয়া কাশী বৃন্দাবন বন জঙ্গল চৌদ্দ ভুবন
খুঁজিলাম হইল-বিফল॥
নিরাশ হইয়া পরে আইনু ঘরেতে ফিরে
কহিলাম দুঃখ-বিবরণ।
বুঝি কঙ্ক বেচে নাই এমন হইল তাই
থাকিলে হৈত দরশন॥”

বিচিত্র-মাধব পরে গিয়া গুরুর স্থানে।
দরশন দিল করি প্রণাম চরণে॥
আশীর্বাদ করি কয় বিচিত্র মাধবে।
“কঙ্কের খবর কিবা কহ মোরে তবে॥
বহু ক্লেশ পাইলে তোমরা আমার কারণে।
ছয় মাস ঘুরি আইলা পর্ব্বত-কাননে॥
বল শুনি বৎসগণ তাহার বারতা।
তোমরা আইলা দেশে কঙ্ক রইল কোথা॥”

“শৈশব-সুহৃদ মোদের প্রাণের বন্ধু ভাই।
প্রাণ দিতে পারি তারে খুজে যদি পাই॥
কত যে খুঁজিনু তার নাহি লেখা জোখা।
নিখোঁজ হইলা বুঝি না পাইলাম দেখা॥”১—৪৮

(২০)

পুনরায় অনুসন্ধান

আশীর্ব্বাদ করি গুরু পুন কহে ধীরে।
“যে রকমে পার বাছা কঙ্কে আন ফিরে॥
কঙ্কেরে আনিয়া তোমরা দেও দুই জনে।
লোকালয় ছাড়িয়া যাইব মোরা বনে॥
ব্যাঘ্র ভল্লুক হবে পাড়া-প্রতিবাসী।
নগর ছাড়িয়া মোরা হব বনবাসী॥
গুরুর দক্ষিণা দেও কঙ্কেরে আনিয়া।
পরাণে মরিব নৈলে তাহারে ছাড়িয়া॥
মহাযাত্রার আর নাহি বেশী দিন বাকী।
সুখেতে মরিব যদি কঙ্কে সামনে দেখি॥
তোমরারে[৮৩] রাখিয়া এই সংসার মাঝারে।
দুই চক্ষু মুদিতাম দেখিয়া সবারে॥

* * * *

“শুন শুন বিচিত্র আরে মাধব সুন্দর।
আজি হতে তোমরা পুন যাবে দেশান্তর॥
কিন্তু এক কথা মোর শুন দিয়া মন।
গৌরাঙ্গের পূর্ণ ভক্ত হয় সেই জন।
যে দেশে বাজিছে গৌরচরণ-নূপুর॥
সেই পথ ধরি তোমরা যাও ততদূর॥
যে দেশেতে বাজে প্রভুর খোল করতাল।
হরি নামে কাঁপাইয়া আকাশ পাতাল॥
সেই দেশে কঙ্কর করিও অন্বেষণ।
অবশ্য গৌরাঙ্গ-ভক্তে পাবে দরশন॥
যে দেশে গাছের পাখী গায় হরিনাম।
নাম-সংকীর্ত্তনে নদী বহে সে উজান॥
শিষ্য-পদধূলি মেখে ছাইয়াছে, গগন।
যে দেশে অবশ্য প্রভুর পাবে দরশন॥”

বিচিত্র মাধব তবে গুরুর আদেশে।
পুনরায় দোঁহে মিলি চলিল বৈদেশে॥
কঙ্কে অন্বেষিতে পুন যায় দুইজন।
এদিকে হৈল কিবা শুন বিবরণ॥১—৩০

(২১)

জনরব

জনরব এই মাত্র সর্ব্বলোকে বলে।
ডুবিয়া মরেছে কঙ্ক দরিয়ার[৮৪] জলে॥

* * * *

বলা কওয়া করে লোকে এই মাত্র শুনি।
শুধাইলে উত্তর নাই না শুধালে শুনি॥[৮৫]

কাহারে জিজ্ঞাসে কন্যা কে দেয় উত্তর।
সত্য কি জলেতে ডুবি মৈল কঙ্কধর॥
কাহারে শুধায় কন্যা কে দেয় উত্তর।
ধূলায় পড়িয়া কান্দে কোথা কঙ্কধর॥
চাঁদ উঠে তারা উঠে কোথা কঙ্কধর।
শুধাইলে তারা নাই সে দেয় যে উত্তর॥
জিজ্ঞাসিলে চন্দ্র তারা আঁধারে লুকায়।
সর্ব্বনাশ হৈল লীলা কান্দিয়া লুটায়॥
কানে কানে কয় কেহ যেন কঙ্ক নাই।[৮৬]
কাহারে শুধাইলে বল কঙ্কের খবর পাই॥

* * * *

শুইলে সোয়াস্তি নাই নিদ্রা নাহি আইসে।
ঘুমাইলে স্বপন দেখে কঙ্ক জলে ভাসে॥

* * * *

কিছু দিন এহি মতে গেলত কাটিয়া।
একদিন মাধব তবে আইল ফিরিয়া॥
মাধবের সঙ্গে কঙ্কে লীলা না দেখিয়া।
সহিস না পায় তারে জিজ্ঞাসে ডাকিয়া॥
লীলার নিকটে তবে মাধব আসিয়া।
দুঃখমনে কহে কথা নৈরাশ হইয়া॥
“শুন শুন বইন গো লীলা বলি যে তোমারে।
কত চেষ্টা করিয়া না পাইলাম কঙ্কধরে॥
কি দিব উত্তর আমি গুরুর চরণে।
দীর্ঘকাল কাটাইনু বৃথা অন্বেষণে॥”

সন্দেহ ভুঞ্জিতে[৮৭] লীলা জিজ্ঞাসে মাধবে।
“শুনিয়াছ কিবা হৈল কিছু জনরবে॥”

মাধব কহিল তবে “শুন সমাচার।
সত্যমিথ্যা নাহি জানি জানেন ঈশ্বর॥
জনরব এই মাত্র লোকমুখে শুনি।
জলেতে ডুবিয়া কঙ্ক ত্যজিয়াছে প্রাণী॥
বিদায় হইয়া কঙ্ক আমাদের স্থানে।
সংসার ত্যজিয়। যায় গৌর-অন্বেষণে॥
আষাইঢ়া[৮৮] পাগলা নদী খরধারা বয়।
অকস্মাৎ কাল মেঘ গগনে উদয়॥
ঝর-তোফানেতে ডুবে সাধুর তরণী।
জলেতে ডুবিয়া কঙ্ক ত্যজিছে পরাণী॥”১—৩৮

(২২)

মৃত্যুশয্যায় লীলা

মাধবের কথা শুনি কান্দে লীলাবতী।
“নেও মোরে যথা গেছ করিগো মিনতি॥
আর কত কাল সয়রে বন্ধু আর কত কাল সয়।
তোমার বিচ্ছেদ-জ্বালায় তনু দগ্ধ হয়॥”

* * * *

সেই দিন হইতে লীলা ছাড়ল ভাত পানি।
একেলা বসিয়া কান্দে দিবস-যামিনী॥
কঙ্কের লাগিয়া লীলার তনু হৈল ক্ষীণ।
হায়রে সোনার অঙ্গ লীলার হৈল মলিন॥
‘বাচিয়া নাহিক কঙ্ক রইব কোন আশে।
যে দেশ গিয়াছ বন্ধু যাইব সেই দেশে॥’

* * * *

হেমন্ত চলিয়া যায় শীত আইল ঘুরে।
অঞ্চল পাতিয়া লীলা শুয়ে ভূঁয়ের পরে॥

“সোদর সাক্ষাৎ বেশি[৮৯] তাহার অধিক বাসি
হেন ভাই জলেতে ডুবিল।
কিসের কর্ম্মের লেখা আর না হইল দেখা
বিধি মোরে নিদারুণ হইল॥

* * * *

প্রাণের দোসর ভাই তা’হতে[৯০] সুহৃদ নাই
হেন ভাই জলে ডুইবা মরে।
মরিবার কাল হায় চখে না দেখিনু তায়
একি শেল রহিল অন্তরে॥”

* * * *

“অকুলে ডুবিল নাও শিশুকালে মৈল মাও
কত দুঃখে পাল্যা তুলে বাপে।
হেন বাপ বৈরী হইল কারে দোষ দিব বল
কপাল পুরিল ব্রহ্মশাপে॥
মনে চিত্তে নাহি জানি লোকে বলে কলঙ্কিনী
এত ছিল কর্ম্মে নাহি জানি।
দিবস আন্ধাইর ঘোর চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী মোর
আর কারে সাক্ষী করি আমি॥”

এক দুই তিন করি বছর গোয়াল।
দেশে না আসিল বন্ধু দিন বয়ে গেল॥
মাধব আইল হায়রে কঙ্ক না আইলা ফিরিয়া।
দিবারাত্রি ভাবে লীলা শয্যায় শুইয়া॥
ভাবিতে ভাবিতে লীলার বদন হইল কালা।
সাপের বিষ হইতে অধিক বিরহের জ্বালা॥
রঘুসুতে কয় বিধি প্রাণে বাচা দায়।
এ বিষ নামে না দেখ ঝাড়িলে ওঝায়॥

এইত না ছিল লীলার সোনার যৈবন।
হেমন্ত নিয়ারে[৯১] যেমন মরে পদ্মবন॥
গঙ্গার তরঙ্গ লীলার দীঘল কেশপাশ।
যে কেশ শুকাইয়া হইল চাচুলীর আঁশ[৯২]
হাটিয়া যাইতে কেশ লুটাইত পায়।
ছিন্নভিন্ন হৈয়া কেশ শয্যায় লুটায়॥
বদন সুন্দর লীলার পদ্মের সমান।
মেঘেতে ঢাকিল যেমন পুন্নুমাসীর চান॥
সাজুতীয়ার[৯৩] তারা যেমন লীলার দুটা আঁখি।
কোঠরে বসিল চক্ষু দেখি বা না দেখি॥
অধরযুগল লীলার সুন্দরবরণ।
মৈলান হইল আসি কাজল যেমন॥
প্রথম যৈবন কন্যা কমনীয়[৯৪] লতা।
সে দেহ শুকাইয়া হইল ইক্ষুকের[৯৫] পাতা॥
নাসিকা হালিয়া পড়ে শ্বাস বহে ঘনে।
মরণ বসিল আসি নয়নের কোণে॥
বৈকালীর[৯৬] রাঙ্গা ধনু[৯৭] মেঘেতে লুকায়।
দিনে দিনে ক্ষীণতনু শয্যাতে শুকায়॥
সব আশা মিছারে হইল লীলার প্রাণমাত্র বাকী।
একদিন উইরা গেল পিঞ্জরের পাখী॥
রঘুসুত কহে কান্দি মিছারে দুনিয়া।
কার লাগিল কেবা মরে না দেখে ভাবিয়া॥১—৫৮

(২৩)

শেষ দৃশ্য

“উঠ উঠ উঠ মাগো কত নিদ্রা যাও।
আমি অভাগায় ডাকি আঁখি মেলে চাও॥

আসিয়াছে প্রাণের ভাই তোমার লাগিয়া।
নিদ্রা ত্যজি উঠ তুমি দেখ চক্ষু চাইয়া॥
অভাগায় ছাড়িয়া মাগো কোথা যাও চলি।
একবার চাই চক্ষু দেখ আঁখি মেলি॥
ক্ষুধাতৃষ্ণায় কেবা মোরে দিবে অন্নপানি।
বিউনী[৯৮] বাতাসে কেবা জুড়াইবে প্রাণী॥
কারে লইয়া দিবরে আমি দেবের আরতি।
কে মোর আন্ধাইর ধরে জালাইবে বাতি॥
কে তুলিবে পূজার ফুল ভরিয়া না ডালা।
কি করিয়া শূন্য ঘরে রহিব একেলা॥
পড়িয়া রহিল তোমার হীরামণ শাড়ী।
পড়িয়া রহিল তোমার জলের গাগরী॥
পড়িয়া রহিল আমার মনের যত আশা।
সর্ব্বস্ব ত্যজিয়া হইলে নদীর কূলে বাসা[৯৯]
শূন্য গৃহে আর নাহি যাইব একেলা।
আজি হতে সাঙ্গ মোর সংসারের খেলা॥

* * * *

কে মোর মরণকালে বসিবে শিয়রে।
কাহারে লইয়া আমি রব শূন্য ঘরে॥
আর একবার মাগো চাও মেলি আঁখি।
নয়ন ভরিয়া তোমায় জন্মশোধ দেখি॥”

* * * *

বিচিত্রের মুখে তার বারতা পাইয়া।
শীঘ্রগতি হইয়া কঙ্ক ঘরে আসে ধাইয়া॥
আসিয়া দেখিল কঙ্ক সব অন্ধকার।
গৃহে না জ্বলয়ে বাতি সকলি আঁধার॥
শ্মশানে পড়িয়া গর্গ কান্দে উচচস্বরে।
শীঘ্রগতি হইয়া কঙ্ক গেল নদীতীরে॥

বহু কষ্টে চিতা জ্বালি প্রদক্ষিণ করে।
কন্যার লাগিয়া গর্গ কান্দে হাহাকারে॥
গর্গের কান্দনে দেখ ঝরে বৃক্ষের পাতা।
উপরে আকাশ কান্দে নীচে বসুমাতা॥
দামোদর দাস কহে সব অন্ধকার।
যে নিধি হারাইলা ফিরি না পাইবা আর॥

দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা কপাল-লিখন।
সেই দিন শ্মশানে কঙ্ক-গর্গের মিলন॥
বজ্রাঘাতে বৃক্ষ যেমন জ্বলিয়া উঠিল।
হাহাকার করি গর্গ কঙ্কেরে ধরিল॥
“হায় কঙ্ক এতকাল কোথা তুমি ছিলে।
তোমায় ডাকিয়াছে লীলা মরণের কালে॥
কিসের সংসার-ঘর কি হবে আমার।
মায়ের বিহনে আমার সকল অন্ধকার॥
পঞ্চ বছরের শিশু মাও গেল ছাড়ি।
এতকাল পালিয়াছিলাম কোলে কাঁকে করি॥
এহিত কন্যার লাগি সংসার-বন্ধন।
সেই কন্যায় হারাইলাম জন্মের মতন॥
বোধনে[১০০] প্রতিমা আমার ডুবাইলাম জলে।
কি কব এ কর্ম্মফল আছিল কপালে॥
আর না ফিরিব ঘরে তোমরা সবে যাও।
শালগ্রাম শিলা যত সায়রে[১০১] ভাসাও॥
আগুন জালিয়া মোর পুড় গৃহ-বাসা।
আজি হতে সাঙ্গ মোর সংসারের আশা॥
আজি হইতে সাঙ্গ মোর সংসারের খেলা।
আর না নিবিবে মোর সংসারের জ্বালা॥”

আকাশে দেবতা কান্দে গর্গের কান্দনে।
ভাটীয়ালে[১০২] কান্দে নদী না বহে উজানে॥
আকাশেতে চন্দ্র কান্দে তারা কান্দে রৈয়া।
বনের পশুপক্ষী কান্দে বনেতে বসিয়া॥
গর্গের কান্দনে দেখ পাথর হয় জল।
রঘুসুতে কহে আর কান্দিয়া কি ফল॥

* * * *

অনলে তাপিত হৃদি করিতে শীতল।
কঙ্কের সহিত মুনি যায় নীলাচল॥
সঙ্গে চলে অনুগত শিষ্য পঞ্চজন।
সংসার তেয়াগি গেলা জন্মের মতন॥১—৬৪

গায়েনের নিবেদন

বারমাসী পালা গীত হইল সমাপন।
নিজগুণে ক্ষমা মোরে কর সভাজন॥
কি গাইতে কি গাইলাম আমি অল্পমতি।
নিজগুণে ক্ষমা মোরে কর সভাপতি॥
দারুণ মাঘের শীত অঙ্গে বস্ত্র নাই।
কর্ম্মকর্ত্তার কাছে একখান শীতের কাপড় চাই॥
ইনাম বকসিস্ চাই কর্মকর্ত্তার বাড়ী।
বছর বছর যেন গান গাইতে পারি॥
দেবতা, সকলে মাগি করি জোড় কর।
কর্মকর্তায় তারা দিয়া যাউখাইন[১০৩] বর॥
ধন পুত্র লক্ষ্মী হউক পূর্ণ হউক আশা।
গাইন ভিক্ষুক যারা তাহাদের হউক আশা॥
দেবসভা পাইয়াছিলাম আমি যে অধমে।
প্রণাম জানাই আমি সভার চরণে॥
হরি হরি বল সবে পালা হইল শেষ।
কর্ত্তা যদি বিদায় করেন চলি যাইব দেশ॥১—১৬


  1. অন্তক—যমকাল=কালের অন্তক (কালান্তক) যমকে বন্দনা করি।
  2. হয় যা না হয়=পুনরায় লাভ হয় কি-না সন্দেহ।
  3. বিপ্রপুর=এই স্থান এখন বিপ্রবর্গ নামে পরিচিত।
  4. কেউ—পায়=কেউ পুত্র কামনা করে না, কেউ বা প্রার্থনা করিরাও পায় না।
  5. সাটিয়ারা=ষষ্ঠীর দিনে।
  6. খাকুয়া=যে মানুষ খায়।
  7. তেঁই=সেইরূপ, যেন।
  8. তেরাখিয়া=ত্রিদোষযুক্ত।
  9. পুত্রহীনা—হীন=পুত্রহীনা জননী পুত্র পাইলেন ও মাতৃহীন বালক মাতা পাইল।
  10. বেভারে=ব্যবহারে।
  11. সিলুক=শ্লোক।
  12. সুতের=সোতের (স্রোতের)।
  13. বাথান=গোচারণের।
  14. যৈবন=যৌবন।
  15. শাউনিয়া=শ্রাবণ মাসের।
  16. চান্নি=জ্যোৎস্না।
  17. বান্দে=বান্ধে, থামায়।
  18. সাউদের=সাধুর, বণিকের।
  19. মৈলান=মলিন।
  20. লুকে=লুকায়।
  21. বর্ষাতিয়া=বর্ষাকালের।
  22. আবে=অভ্র (পাতা মেঘে)।
  23. দুর্ল্লভ—ঢাকা=তাহার যুগ্ম অধরের মধ্যে দন্ত ঢাকা আছে, যেরূপ ঝিনুকের মধ্যে মহামূল্য মুক্তা লুক্কায়িত থাকে।
  24. তুল্যপদ, “মুষ্টিতে ধরিতে পারি সীতার কাঁকালী”—কৃত্তিবাস।
  25. ঝল্‌কে=ঝলকিয়া পড়ে।
  26. কোথা—পানি=এই জোয়ারে জল (যৌবনে) কোথা হইতে পাগলের মত উন্মুক্ত ভাব লইয়া হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইল।
  27. সাধিলে আইসে=যৌবনকে সাধ্য-সাধনা করিয়া দীর্ঘকাল রক্ষা করা যায় না এবং যত্ন করিলেও ঠিক সময়ের পূর্বে ইহা আসে না।
  28. গাগরী=কলসী।
  29. ফেরুষাই=ফরমাসী গান।
  30. বাঁকে=বক্রগতিতে।
  31. বন্দের=বন্ধুর।
  32. গামছা-বান্দা দৈ=এখনও পূর্ব্ববঙ্গে এরূপ উৎকৃষ্ট ঘনীভূত দধি তৈয়ারী হয় যাহা ছানার মত শক্ত এবং যাহা গামছায় বান্ধিয়া লইয়া যাইতে পারা যায়।
  33. সারগিদ=সাকরেদ, শিষ্য।
  34. নামিডাকি=নামডাকের, অত্যন্ত যশস্বী।
  35. হেকমত=ক্ষমতা (আধ্যাত্মিক)।
  36. কইতর=কবুতর, পায়রা।
  37. গাহানা=গাওনা গান।
  38. জুহরী=জহুরী।
  39. কালাম=বচন; মুসলমানী ধর্ম্মশাস্ত্রের বচন।
  40. গুরুর—আনি=কঙ্কের লিখিত সত্যপীরের পাঁচালী অথবা বিদ্যাসুন্দর পাওয়া গিয়াছে।
  41. সমাজী=সামাজিক, সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
  42. ভণে=কহিলেন।
  43. জ্ঞানে মানে—খায়=যখন জ্ঞান ও মান-বোধ কিছুই ছিল না, তখন চণ্ডালের অন্ন খাইয়াছিল।
  44. সংশয়=দ্বিধা-বোধ।
  45. লহ—ছাড়িয়া=আমাদিগকে ত্যাগ কর ও তাহাকেই রাখ।
  46. অন্দি সন্দি=নানারূপ পাকচক্র।
  47. শুন—কারণ=শেষে সহস। লীলাকে পাপী মনে করিয়া তাহাকে দেবতার জন্য জল আনিতে বারণ করিলেন।
  48. লীলার—ফালাইয়া=লীলার হাতের ফুল অপবিত্র মনে করিয়া ফেলিয়া দিলেন।
  49. কাগমলা=সিকা (?)
  50. কালজর =কালকুট বিষ।
  51. অতীব যতনে=অতি স্নেহের সহিত।
  52. পন্থ নাহি পায়=চোখে পথ দেখিতে পায় না।
  53. মেলানি নাগা=যাত্রাকালে বিদায় লওয়া।
  54. থানা=স্থান
  55. হানা=আঘাত
  56. কলঙ্কে—চাঁদের পসর=অর্থাৎ চন্দ্রের জ্যোৎস্না কলঙ্কে অনুলিপ্ত হইল।
  57. দুষমন—চায়=এতই সে সুন্দর যে দুষমন (শত্রু) ও তাহার মুখের দিকে না তাকাইয়া পারে না।
  58. বিচারিয়া=সন্ধান করিয়া, খুঁজিয়া।
  59. ডোগা=ডগা, অগ্নভাগ।
  60. থলাতে=তলাতে, শ্মশান-স্থলীতে।
  61. আলুই=এলাইয়া।
  62. শেষ=শয্যা।
  63. সাচান=চিলজাতীয় পক্ষী-বিশেষ।
  64. পুষনিয়া=পোষা।
  65. পাটলী=সুরভি গরুর বাছুর।
  66. উপচার=উপকরণ।
  67. হত্যা=ধন্না।
  68. গয়বি=দৈব।
  69. আজি—শাস্ত্রধর্ম্ম=আজি হৈতে শাস্ত্রধর্ম্ম দ্বারা আমি প্রতারিত হইলাম মাত্র।
  70. আলোক—পথ=তোমার আলোদ্বারা তাহার পথ চিনাইয়া লইয়া এস।
  71. কঙ্ক ও লীলার প্রাচীন গানটিকে সংমার্জিত করিয়া পরবর্ত্তী কবিরা এই পালা কতকটা নূতন করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা গ্রন্থারম্ভে শিবু গায়েনের বন্দনা-গীতি হইতে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে প্রেম-ঘটিত গানগুলির মধ্যে কতকগুলি বাঁধা গৎ ঢুকিয়াছিল, কবিরা স্থানে অস্থানে তাহা লাগাইয়া দিতেন। লীলা সারারাত্রি কঙ্কের সঙ্গে নদীতীরে কাটাইয়া দিয়াছেন, ইহা ঐতিহাসিক সত্যও নহে এবং কবিতার রুচি-সৌষ্ঠব-বর্ধকও নহে, ইহা একটি বাঁধা গৎ। কবি সাময়িক রুচি ও চলিত কথার অনুসরণ করিয়াছেন মাত্র।
  72. কোন দেশে—ঠিকানা=কোন্ দেশে যাইবে, এ সম্বন্ধে তোমাদিগকে কোন ঠিকানা দিয়াছে কি-না?
  73. ঝটিতি=শীঘ্র।
  74. জোয়ায়=যোগ্য হয়।
  75. মালঞ্চ=ফুল-বাগান।
  76. রোল=ময়মনসিংহের উচ্চারণ ‘রুল', সুতরাং ফুলের সঙ্গে বেশ মিলিয়া যায়।
  77. জ্যৈষ্ঠমাস বড়=জ্যৈষ্ঠ মাসের দিন খুব দীর্ঘ।
  78. হীরামণ=লতা ও পাতায় হীরা ও মণির ন্যায় সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে।
  79. শাউনিয়া=শ্রাবণ মাসের।
  80. খাউরি বিউনা=খালৈ (মৎস্যাধার) এবং পাখা।
  81. খরসুতে=খরস্রোতে।
  82. কবিতরে=কবুতরে, পায়রা।
  83. তোমরারে = তোমাদিগকে।
  84. দরিয়া=নদী।
  85. শুধাইলে—শুনি=জিজ্ঞাসা করিলে কেহ বলে না, অথচ জিজ্ঞাসা না করিয়াও অনেক সময়ে শোনা যায়।
  86. কানে—নাই=যেন কানের কাছে চুপে চুপে কেহ বলিয়া যায় ‘কঙ্ক নাই’।
  87. ভুঞ্জিতে=ভঞ্জিতে, ভঙ্গ করিতে।
  88. আঘাইঢ়া=আষাঢ় মাসের।
  89. সোদর---বেশি=সাক্ষাৎ ( সহোদর) ভ্রাতার চাইতে বেশী।
  90. তা’হতে=তাহার অপেক্ষা।
  91. নিয়ারে=নীহারে।
  92. চাচুলীর আঁশ=বাঁশ চাঁছিলে যেরূপ আঁশ হয়।
  93. সাজুতীয়ার=সাঁজের।
  94. কমনীয়=সুন্দর।
  95. ইক্ষুকের=ইক্ষুর, আখের।
  96. বৈকালীর=বিকাল বেলার।
  97. রাঙ্গা ধনু=রামধনু
  98. বিউনী=ব্যজনী (পাখা)।
  99. সর্ব্বস্ব—বাসা=রাজেশ্বরী নদীর তীরবর্তী শ্মশানে।
  100. বোধনে=বোধনের সময়, আবাহন করিয়াই।
  101. সায়রে=সাগরে।
  102. ভাটীয়ালে=ভাটির দিকে, নীচু দিকে বহিয়া।
  103. যাউখাইন=বাউন