মৈমনসিংহ গীতিকা/রূপবতী
রূপবতী
রূপবতী
(১)
রাজ্য করে রাজচন্দ্র রামপুর সহরে।
বারবাংলার[১] ঘর বান্ছে[২] ফুলেশ্বরীর পারে॥
গড় খন্দর[৩] রাজার লাখের জমিদারী।
হস্তী ঘোড়া আছে রাজার পাইক পাটুয়ারী[৪]॥
ঢুলী নাগারচী[৫] রাজার রাজ্যে বাস করে।
রসুনচকী বাজায় তারা হাফার খানা[৬] ঘরে॥
সেইত গীত না শুনিয়া রাজা জাগে বিয়ান বেলা।
দরবারে বসিল রাজা সহিত আমলা॥
সভাজনেরে রাজা ডাকু দিয়া কয়৷
“নবাবের দরবারে যাইতে উচিত যে হয়॥
গণকে ডাকিয়া রাজা দিন স্থির করে।
আষ্ট[৭] দিন বাকি আছে যাইতে নবাবের সরে[৮]॥
কানা চইতা উভুতিয়া তারা দুইটী ভাই।
পান্সী সাজাইতে তারা পাইল ফরমাই[৯]॥
ষোল দাঁড় জুইত[১০] করে আরও তুলে পাল।
পালীতে ভরিয়া রাজা তুলে মালামাল॥
আবের কাঁকই[১১] লইল রাজা আবের চিরুণি।
আবেতে রঙ্গিয়া[১২] লইল খাড়ি আর বিউনি[১৩]॥
হাত্তীর দাঁতের পাটি লইল গজমতি মালা।
ভেট দিতে নবাবের করিল যে মেলা॥
খাজনা উগাইয়া[১৪] তঙ্কা লইল দশ হাজার।
গাউইয়া বাজুইয়া[১৫] লইল সঙ্গে এক ঝাড়॥
উজান পানি বাইয়া রাজা পান্সী বাইয়া যায়।
নাগরীয়া[১৬] যত লোকে করিল বিদায়॥
দানদক্ষিণা আদি পুণ্যকার্য্য করি।
রাণীর কাছে সঁপিয়া গেল কুলের[১৭] কুমারী॥
চারি দিকে নানাগ্রাম নেহালিয়া দেখে।
ফুলেশ্বরী উথারিয়া[১৮] পড়ে নরসুন্দার মুখে॥
সেই নদী ছড়াইয়া যায় ঘোড়া-উত্রা বাইয়া।
মেঘনা সায়রে পান্সী চলিল ভাসিয়া॥
ঢেউএ করে বাইড়াবাইড়ি[১৯] কাছাড়[২০] ভাইঙ্গা পড়ে।
এইমতে যায় রাজা নবাবের সরে॥
তিন মাস থাক্যা[২১] রাজা জলের উপর।
চাইর মাসে গেল রাজা নবাবের সর॥
সঙ্গের যতেক দ্রব্য যত লোকজনে।
একে একে ভেট দিল নবাবের স্থানে॥
পূবইয়া[২২] আবের কাকই আবের চিরুণী।
চক্ষে না দেখেছি শুধু লোকমুখে শুনি॥
শীতল পাটী পাইয়া তবে শীতল হইল মন।
পাইল ভেটের দ্রব্য যত আয়োজন॥
দশ হাজার তঙ্কা পাইয়া খুসী হইলা মিঞা।
রাজচন্দ্রে দিলা ঘর বাছাই করিয়া॥
নবাবের সরে রাজা আছে খুসী মন।
ঘরেতে থাকিয়া রাণী দেখিল স্বপন॥১—৪৪
(২)
এক দুই মাস করি বছর গোঁয়ায়[২৩]।
কুস্বপন দেখিয়া রাণী করে হায় হায়॥
বছর গোঁয়াইল রাণী তবে এইমতে।
দুই বছর যায় রাণী চাইয়া পথে পথে॥
তিন বছর গেল যদি রাজা না আইল।
বিপদ গণিয়া রাণীর বড় চিন্তা হইল॥
ঘরেতে কুমারী কন্যা বিয়ার যোগ্য হইল।
চৌদ্দ বছরের কন্যা আবিয়াইত[২৪] রইল॥
পাড়ার লোকে কানাকানি রাণী তাহা শুনে।
কি মতে ধরায়[২৫] কহ মায়ের পরাণে॥
যুবা[২৬] কন্যা লইয়া মায়ে একলা শুয়ে ঘরে।
রাত্রিদিন করে রাণা চিন্তা জারে জারে[২৭]॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া রাণী কি কাম করিল।
রাজার নিকটে এক লিখনি[২৮] পাঠাইল॥
লিখনিতে লেখে রাণী যত সমাচার।
পরথমে[২৯] পতির পায়ে করে নমস্কার॥
রাজ্যের আবেস্থা[৩০] যত লিখিরা জানায়।
কন্যার কথা লেখে রাণী করিয়া আলায়[৩১]॥
তিন বছর যায় রাজা আছত বৈদেশে।
ঘরেতে তোমার কন্যা আছে কোন্ বেশে॥
পরথম যৌবন কন্যার লোকে কানাকানি।
তা শুন্যা কেমনে সহে মায়ের পরানি॥
বিবাহের কাল গেলে উচিত না হয়।
এমন কন্যা ধরে রাখ্লে ধর্ম্মনাশ হয়॥
পত্র পাইয়া তুমি বিলম্ব না কর।
শীঘ্র চলিয়া আইস আপনার ঘর॥
এই পত্র লেখ্যা রাণী কোন্ কাম করে।
লোক দিয়া পাঠায় পত্র মুর্শিদাবাদ সরে॥
এক গণক আইল তবে খুঙ্গীপুথি লইয়া।
এই গণক আইয়া[৩২] কয় গণিয়া বাছিয়া॥
“হুড় পরী জিনি কন্যা পরমা সুন্দরী।
ইহার সুখের কথা কহিতে না পারি॥
রাজার ঘরে অইব[৩৩] বিয়া রাজার পাটরাণী।
সুখেতে কাটাইব কাল কহিলাম আমি॥”
আর গণক বলে “কন্যার চলন-চালন[৩৪] বেশ।
যোগ্য[৩৫] ভুরু আছে কন্যার মাথায় দীঘল কেশ॥
পাশাল[৩৬] কপাল কন্যার মুক্তা দন্তপাট[৩৭]।
এই কন্যার বড় ভাগ্য আছে রাজার পাট[৩৮]॥
চরণ ধোয়াইব কন্যার শতেক কিঙ্করে।
দক্ষিণ দেশে অইব বিয়া ধনী সদাগরে॥”
আর গণক বলে “কন্যা সর্ব্বসুলক্ষণ।
পদ্মের মতন দেখি দুখানি চরণ॥
হাঁটিয়া যাইতে কন্যার চাপিয়া পড়ে পারা[৩৯]।
উত্তরিয়া[৪০] রাজার ঘর করিবে পসরা[৪১]॥
পায়ের দুইখানি গোছ[৪২] যেমন চিরুণী।
এই লক্ষণ থাক্লে কন্যা হয় রাজরাণী॥”
আর গণক আইসা তবে হস্ত দেইখা[৪৩] কয়।
“ঝটিতে হইবে বিয়া নাহি কোন ভয়॥
পদ্মের সমান কন্যার যেমন মুখখানি।
চক্ষু দুইটী দেখি ভাল নাচয়ে খঞ্জনী॥
গণ্ডেত সিন্দুরের ঝালা[৪৪] চান্দের বরণ।
সর্ব্বাঙ্গ দেখিলাম তার অতি সুলক্ষণ॥
রাজার ঘরে হইব বিয়া তার নাহি থা[৪৫]।
একে একে হইব কন্যা সাত পুতের মা॥”
আর গণক বলে “কন্যার কাল চক্ষের মণি।
ভাগ্যমতী[৪৬] হবে কন্যা হবে রাজরাণী॥
রিষ্টিতে আছিয়ে দোষ কোষ্ঠী ফলে ঝালা[৪৭]।
গর দোষ আছে কন্যার কাট এই বেলা॥
উত্তম বসন জোর[৪৮] আর সবরী কলা[৪৯]।
ঘৃত দুগ্ধ তণ্ডুল আন সাজাইয়া ডালা॥
দ্বাদশ ব্রাহ্মণে আনি করাও ভোজন।
গরদোষ কাটিয়া যাইবে ততক্ষণ॥
তীর্থ জলে যাইব ছিনান করাইয়া।
আইজ যাইব গরদোষ কাইল হইব বিয়া॥”
এই সব করে রাণী ভক্তিযুত মনে।
বাড়ী আইল রাজচন্দ্র বিয়ার কারণে॥১—৬৬
(৩)
ভাবিয়া চিন্তিয়া রাজার বরণ হইছে কালি।
রাজ্য নাহি করে রাজা নাহিক ঠাকুরালী[৫০]॥
শয়ন করিয়া রাজা কভু না ঘুমায়।
উঠি বসি করে রাজা করে হায় হায়॥
তাহারে দেখিয়া রাণী জিজ্ঞাসা করিল।
“কি কারণে প্রাণপতি এমন হইল॥
তাম্বুল-চুয়া পইড়া থাকে বাটায় পড়িয়া।
নিদ্রা নাহি যাও তুমি পালঙ্কে শুইয়া॥
থালেতে পড়িয়া থাকে চিকনির ভাত[৫১]।
অন্নব্যঞ্জনে কেন নাহি দেও হাত॥
প্রাণের দোসর কন্যা তারে নাহি দেখ।
একদিন কাছে পাইয়া মা বলিয়া না ডাক॥
বিষ হইল ঘরবাড়ী বিষ হইলাম আমি।
কর্ম্মদোষে বিষ হইল ঘরের নন্দিনী॥
বিয়ার কাল গেল কন্যার না কর ভাবন।
তোমায় দেখ্যা হইল আমার নিকট মরণ॥”
“শুন শুন রাণী আরে কহি যে তোমারে।
(আরে কহি যে তোমারে)
কলিজা খাইছে মোর জলের কুম্ভীরে॥
বনের বাঘে খাইছে মোর সর্বাঙ্গ শরীর[৫২]।
শেলেতে বিন্ধিয়া বুক হইছে দুই চির[৫৩]॥
কি করিলা রাণী আরে কি করিলা তুমি।
কুক্ষণে আমার কাছে লিখিনা লিখনী॥
লিখনী লইয়া গেলাম নবাব দরবারে।
লিখনী দেখিয়া মোরে জিজ্ঞাসা যে করে॥
যখন দেখিল বেটা পত্র লেখা আছে।
ভর যুবতী[৫৪] কন্যা বিয়ার বাকী রইছে॥
দেশে ফিরব বল্যা[৫৫] যখন চাহিলাম বিদায়।
আমারে কহিল বেটা ‘শুন ওহে রায়॥
শুন্যাছি তোমার কন্যা ছুরৎ জামালী[৫৬]।
আমার কাছে বিয়া দিয়া ভোগ ঠাকুরালী[৫৭]॥
খেতাব হইবে তুমি মোর ছাহেবান[৫৮]।
দরবারে পাইবা তুমি আমার ছেলাম॥
ঝটিতি চলিয়া যাও আপনার ঘরে।
যাবত যোগাড় আমি করি নিজপুরে॥’
জাতিনাশ ধর্ম্মনাশ বাইচ্যা[৫৯] কাজ নাই।
রাজত্বি ছাড়িয়া চল জঙ্গলাতে যাই॥
পর্তিজ্ঞা করিয়াছি আমি মনেতে ভাবিয়া।
‘কাইল দেখবাম যার মুখ সকালে উঠিয়া॥
মালী ডোম আইজঙ্গ[৬০] না করব বিচার।
কন্যা বিলাইয়া দিবাম নাহিক আচার॥’
মুসলমানে কন্যা দিতে নাহি সরে মন।
রাজত্ব হইল আমার কর্ম্মবিড়ম্বন॥
গলায় কলসী বান্ধ্যা জলে ডুব্যা মরি।
এ বিষ না ঝাড়তে পারে ওঝা ধন্বন্তরী॥”
এই কথা শুন্যা রাণী চিন্তিত হইল।
বাড়ীর নফরে এক ডাক দিয়া আনিল॥
আজ রাত্রি যায় যদি অইব সর্ব্বনাশ।
রাত্রি যেন থাকে সূর্য্য না হয় পরকাশ॥
আছিল বাড়ীর বক্সী নামেতে মদন।
দেখিতে সুন্দর রূপ * * * নন্দন॥
হাটবাজার করে ডাকের আগে খাড়া[৬১]।
সুন্দর কুমার সে যে প্রভাতিয়া[৬২] তারা॥
বাহির অন্দরে ছেড়া[৬৩] করে আনাগোনা।
অঙ্গেতে মাখিয়া তার খইছে কাঞ্চা সোনা॥
ডাক দিয়া আন্যা রাণী মদনের আগে কয়।
“পুত্রের সমান তুমি না করিও ভয়॥
দারুণ পর্তিজ্ঞা রাজা যেমতে করিল।
পূর্ব্বাপর বিবরণ রাণী সকল কহিল॥
শুন শুন মদন আরে কহিযে তোমারে।
নিশি ভোর কালে তুমি যাইয়ো শয়নমন্দির-দ্বারে॥
হুক্কাতে তামুক লইয়া ছল কইরা যাইও।
মন্দির-দুয়ারে তুমি গিয়া খাড়া হইও॥”
না ভাবিল উত্তর-পশ্চিম না ভাবিল পূব।
কিসের লাগিয়া রাণী কহে এমন অপরূপ॥
শয়ন-মন্দিরে রাণী করিল গমন।
নিশিভোরে দুয়ারে দাঁড়াইল মদন॥
আজল[৬৪] কাজল মেঘ আকাশের গায়।
পুর্ব্বদিকে লাল সূরুয উকি দিয়া চায়॥
নহবত বাদ্যি বাজে হাফারখানা ঘরে।
পালঙ্ক ছাড়িয়া রায় উঠিলা সত্বরে॥
রাণী ত খুলিয়া দিল কপাটের খিল।
মন্দির ছাড়িয়া রাজা হইল বাহির॥
নেউলিয়া[৬৫] রাজচন্দ্র দেখিল চাহিয়া।
নফর চাহিয়া আছে হুক্কা হাতে লইয়া॥
জলচৌকি সোণার ঝাড়ি তাতে শীতল পাণি।
হাতমুখ ধুইল রাজা শীতল পরাণি॥
মদনে ডাকিয়া রাজা জিজ্ঞাসা যে করে।
“কি কারণে আইলা তুমি আমার মন্দিরে॥”
“রাজার নফর আমি হুকুমের চাকর।
আমার যাইতে নাহি মানা বাহির আন্দর॥
বার বছর ধইরা আমি করি তাবেদারী[৬৬]।
এইখানে আছি আমি হইয়া শিরের পরী[৬৭]॥”
কোথায় বাড়ী কোথায় ঘর কেবা বাপ মাও।
পরিচয় জানতে রাজা নফরে জিগায়॥
পরিচয় পাইয়া রাজা সানন্দিত মন।
বিবাহ-কারণে করে মঙ্গল আয়োজন॥
শুভদিন শুভক্ষণ স্থির যে করিল।
শুভ লগ্ন পাইয়া রাজা কন্যাদান দিন॥
যতেক সামগ্রী দিল নাই তার নাম[৬৮]।
জমিদারী লেখ্যা দিল বামুনকান্দি গ্রাম॥
(তৃতীয় অধ্যায়ের পাঠান্তর)
রাজা বলে “রাণী আমি যুক্তি স্থির করি।
নবাবে না দিলে কন্যা না থাকবে জমিদারী॥[৬৯]
জয়পুর সর দিব দরিয়ায় ভাসাইয়া।
গর্দ্দান লইবে আসি পাঠানে বান্ধিয়া॥
কন্যার লাগিয়া মোর ঘটিল জঞ্জাল।
এই কন্যা হইল মোর পরাণের ফাল্[৭০]॥
জাতিনাশ ধর্ম্মনাশ গো রাণী উপায় না দেখি।
আখরির দিন[৭১] গেল আর নাহি বাকি॥
এই দিনের আগে কন্যা নবাবের সরে।
পাঠাইতে হইবে কন্যা তাহার অন্দরে॥
বিষ কি খাওয়াইয়া মারি আগুন জ্বালাই।
কোন্ দেশে গেলে বল আমি রক্ষা পাই॥
আয়োজন কর রাণী পাঠাও কন্যারে।
গলায় কলসী বান্ধ্যা আমি ডুবিব সায়রে॥”
এই কথা শুন্যা রাণী কোন্ কাম করিল।
মনেতে ভাবিয়া রাণী যুক্তি স্থির কৈল॥
বাড়ীর নফর ছিল মদন তার নাম।
দেখিতে সুন্দর বড় রূপের কাঠাম[৭২]॥
পূজার ফুল তুল্যা আনে ডাকের আগে খাড়া।
দেখিতে সুন্দর রূপ আসমানের তারা॥
জাতি না ভাবিল রাণী কুলমানের কথা।
এই মতে ছাড়ে রাণী কন্যার মমতা॥
ঘরে থাক্যা রূপবতী এতেক না জানে।
নিশিকালে গেল রাণী তার বিদ্যমানে॥
পালঙ্কে ঘুমায় কন্যা চান্দের সমান।
দেখিয়া সুন্দর কন্যা মায়ের কান্দিল পরাণ॥
সুবর্ণ কপোতী মায়ের হৃদয়ের নলী[৭৩]।
কেমনে উড়াইয়া দিব খোপ কইরা খালি॥
“উঠ উঠ রূপবতী আঁখি মেল্যা চাও।
শিয়রে দাঁড়াইয়া কান্দে অভাগিনী মাও॥
উঠ উঠ কন্যা আরে দেখ চক্ষু চাহিয়া।
নগরে আগুন লাগল তোমার লাগিয়া॥
তোমার লাগিয়া রাজা জলে ডুইব্যা মরে।
তোমার লাগিয়া আমরা যাই বনান্তরে॥”
স্বপ্ন দেখে রূপবতী মায় কাইন্দা জার[৭৪]।
নগর জুড়িয়া উঠে ক্রন্দন হাহাকার॥
স্বপন দেখিয়া কন্যা উঠিয়া বসিল।
শিয়রে দাঁড়াইয়া মায় কান্দিতে লাগিল॥
“কি কারণে কান্দ মাগো কও কও শুনি।
পরাণে না সয় দেখ্যা তোমার চক্ষের পাণি॥
কিবা অপরাধ আমি করিয়াছি পায়।”
শিয়রে দাঁড়াইয়া কান্দে অভাগিনী মায়॥
(৪)
না গাইল বিয়ার গীত না হইল আচার।
পুরীতে না দিল কেউ মঙ্গল জোকার[৭৭]॥
পাড়াপড়শীর কাছে সোহাগ না মাগিল মায়[৭৮]।
বিয়ার হলদি না মাখিল কন্যার গায়॥
জল না ভরিল কেউ না গাইল গান।
শোকেতে কান্দিয়া মরে মায়ের পরাণ॥
আন্ধাইরা[৭৯] নিঝুম রাতি আশমানে জ্বলে তারা।
মদন আসিয়া দুয়ারে হইল খাড়া॥
লাজেতে গলিয়া পড়ে[৮০] কন্যার মাথার কেশ।
আস্তে ব্যস্তে টানিয়া কন্যা পরে নিজ বেশ॥
না আসিল পুরোহিত কুল আচরণ।
নিঝুম রাতে করে মায় কন্যা সমপণ॥
লইয়া কন্যার হাত মদনেরে দিল।
কেহ না জানিল মায় কন্যা সমর্পিল॥
কেহ না দিল তায় মঙ্গল জোকার।
বিবাহের গীত হইল ক্রন্দন হাহাকার॥
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী হইল মায় কাইন্দা মরে।
হাতে হাতে সমর্পণ করিল ঝিয়েরে॥
“শুন শুন মদন আরে কহি যে তোমারে।
মায়ের দুলালী কন্যা দিলাম তোমারে॥
বংশের পরদীম্[৮১] মোর একমাত্র ঝি।
তারে সমর্পণ কইলাম আর কৈবাম[৮২] কি॥
ছিঁড়িয়া বুকের নলী[৮৩] দিলাম তোমারে।
পোষা পাখী দিলাম আমার ভাঙ্গিয়া পিঞ্জরে॥
বনে থাক জলে থাক রাইখ[৮৪] মায়ের কথা।
এই কন্যার মনে তুমি নাহি দিও ব্যথা॥
সুখে রাখ দুঃখে রাখ, তুমি প্রাণপতি।
তুমি বিনে অভাগীর নাহি অন্য গতি॥”
মায়ে কান্দে ঝিএ কান্দে কান্দি জারজার।
গাছের ডালে বসি কান্দে পবন পক্ষী আর॥
নিশিরাইতে ডাক্যা মায় মাঝিমাল্লা আনে।
নগরীয়া লোক তাহা কহ নাহি জানে॥
পুরের মাঝি কানা চইতা এক চক্ষু কান।
তাহারে করিল মায় ধনরত্ন দান॥
রূপবতী কন্যা লইয়া উঠিল ত্বরিতে।
ঝি-জামাইয়ে রাণী বিদায় কৈল এইমতে॥
নিশিরাইতে বাইয়া তারা যায় তরীখানি।
পাল টাঙ্গাইয়া[৮৫] চলে তের বাঁক পানি[৮৬]॥
চৌদ্দ বাঁকের মাথায় গিয়া রাত্রি ভোর হইল।
সেই খানে গিয়া কানা তরী লাগাইল[৮৭]॥
“রাণীর হুকুম বলি শুন চরনদার[৮৮]।
রজনী হইলে তোর বিদায় আমার॥”
গাও-গেরাম নাই কাছে অনছতলছ[৮৯] পানি।
বনে ডাকে বাঘ-ভালুক জলে কুম্ভরিণী॥
সেই খানে দুই জনে বনবাস দিয়া।
দেশের ভায়[৯০] চল্ল চইতা তরীখানি বাইয়া॥
“বাপের বাড়ীর পান্সীরে কোথায় চল্যা যাও।
মায়ের আগে খবর কইও আমার মাথা খাও॥
মায়ের আগে খবর কইয়ো দুখিনী ঝিএরে।
মাঝিমাল্লা দিয়া গেল এই না বনান্তরে॥
বাপের আগে কইও খবর অন্য কেহ নাই।
বনেতে পড়িয়া কেম্নে জীবন গোঁয়াই॥
চলিতে চলিতে পান্সী আর দেখা নাই।
বনের হরিণী যেমন বনেতে বেড়াই॥
শুন শুন পবন আরে যাও মায়ের আগে।
রূপবতী কন্যা তার খাইছে[৯১] জংলার বাঘে॥”
“না কাইন্দ না কাইন্দ কন্যা কান্দিলে কি হয়।
বিধাতা লিখ্যাছে বল কোন্ জনে খণ্ডায়॥
শিরে কইলে[৯২] সর্পাঘাত ওঝার কিবা করে।
কর্ম্মদোষে আমরা দুইজন আইলাম বনান্তরে॥
দেবের নৈবেদ্য করে কুক্কুরে ভোজন।
তার লাগিয়া কন্যা তুমি করিছ ক্রন্দন॥
জেলেদের কথা
“কাঙ্গালীয়া জাঙ্গালীয়া তারা দুইটি ভাই।
জাল বাইয়া মাছ মারে অন্য কার্য্য নাই॥”
রূপবতী, ২৫৩ পৃঃ
আমিত চণ্ডাল কন্যা তুমি গঙ্গার পানি।
না ধরিব না ছুঁইব তোমার চরণখানি॥
ক্ষিদায় দিয়াম বনের ফল তিয়াষে[৯৩] দিয়াম পানি।
গাছের পাতা পাইড়া[৯৪] দিয়া করিব বিছানি[৯৫]॥
রাজার দুলালী কন্যা নাহি জান কেল্লেশে[৯৬]।
একলা কইরা কেমনে তুমি থাক্বা বনবাসে॥
বনের দোসর সঙ্গী আমিত নফর।”
কথা শুন্যা কান্দ্যা কন্যা করিলা উত্তর॥
“শুন শুন প্রাণপতি কই যে তোমায়।
তোমার হস্তে সমর্পণ কইরা দিন মায়॥
বনে জঙ্গলায় থাকি তুমি মোর স্বামী।
তুমি বিনা অন্য কারে নাহি জানি আমি॥
এতেক করিল বিধি কপালেরে দোষি।
আমার লাগিয়া বন্ধু তুমি বনবাসী॥”১-৭৬
(৫)
কাঙ্গালীয়া জাঙ্গালীয়া তারা দুইটি ভাই।
জাল বাইয়া মাছ মারে অন্য কার্য্য নাই।
কোমরে বান্ধিয়া ডোলা[৯৭] হাতে লইয়া জাল।
নদীর কিনারে ঘুরে সকাল বিকাল॥
ঘুরিতে ঘুরিতে তারা এইখানে আইল।
রূপবতী কন্যার সঙ্গে বনে দেখা হইল॥
দুই ভাইয়ের তিন বিয়া পুত্ত্রকন্যা নাই।
ঘরের যে বড় বউ নাম তার পুনাই॥
“পুনাই পুনাই” বলি কাঙ্গালীয়া ডাকে।
ঘরের বাহির হইয়া পুনাই চাইয়া তবে দেখে॥
আচানক[৯৮] পুরুষ এক সঙ্গে তার নারী।
জিনিয়া চান্দের ছটা যেন হুরপরী॥
লক্ষ্মীর সমান রূপ সর্ব্বসুলক্ষণ।
পুনাই বলি কাঙ্গালীয়া ডাকে ঘনঘন॥
“সারাদিন বাইলাম জাল কাটাইলাম বিফলে।
কানপনা[৯৯] না পাইলাম আজি নদীর জলে॥
পন্থে পাইয়া লক্ষ্মী টুকাইয়া[১০০] আনি।
যত্ন কইরা এই ধন পাল নিয়া তুমি॥”
পুত্রকন্যা নাই পুনাইর বড় দুঃখ মন।
কন্যারে দেখিয়া পুনাইর আনন্দিত মন॥
কার কন্যা কেবা বাপ কোথা তোমার বাসা।
একে একে যত কথা করয়ে জিজ্ঞাসা॥
একে একে যত কথা জিজ্ঞাসয়ে আর।
“সঙ্গেতে পুরুষ দেখি কি হয় তোমার॥”
“নাহি পিতা নাহি মাতা নাহি সোদর ভাই।
জলের শেওলা-সম ভাসিয়া বেড়াই॥
কপালের দোষে হইয়াছিলাম বনবাসী।
দুঃখেতে পড়িয়া কাটাই যত দিবানিশি॥
দৈবযোগে দেখা হইল তোমাদের সনে।
স্থান মাগি ধর্ম্মের মাওগো তোমার চরণে॥”
পোলা নাই পুরি[১০১] নাই পুনাইর শূন্য ত্রিসংসার।
পুত্রকন্যা পাইল পুনাই ত্রিজগতের সার॥
(৬)
“শুন শুন প্রাণপ্রিয়া কই যে তোমারে।
পক্ষকালের জন্য বিদায় দেও ত আমারে॥
ছয় বচ্ছর কাটাইলাম তোমার বাপের কাছে।
আমার বাপ-মাও কি প্রাণে বাঁচ্যা আছে।
একবার দেখ্যা আইয়াম্[১০২] তাদের মুখখানি৷
কিছু কালের জন্য কন্যা মাগিগো মেলানি॥”
দিশা— ভ্রমররে নিশা যায় বইয়া।
“কাজলবরণ ভ্রমরের রূপার বরণ আঁখি।
কোন্ বিধাতায় গড়ছে তোমায় কইরা বনের পাখী॥
শুন শুন ভ্রমররে আমার মাথা খাও।
উদ্দেশ[১০৩] করিয়া দেখ বন্ধুরে নি[১০৪] পাও॥
এক পক্ষ চল্যা গেল মরা চান্ জীয়ে[১০৫]।
কেন না আইল বন্ধু কিসের লাগিয়ে॥
আর পক্ষ যায় বন্ধুর পথপানে চাইয়া।
অভাগীর কথা বন্ধু গেছে কি ভুলিয়া॥
পন্থের পানে চাইয়া থাকি বন্ধুর লাগিয়া।
চক্ষে ঝুরে মাকড়াসা আন্ধার[১০৬] লাগিয়া॥
তুলিয়া[১০৭] গাঁথিলাম মালা মালা হইল বাসি।
এমন যৈবনকালে বন্ধু হইল বৈদেশী॥
রাইত যায় আমার আশে দিনে আইব বলি[১০৮]।
পন্থের পানে চাইয়া থাক্তে চক্ষে পড়ে বালি॥”
এইমত কান্দে কন্যা সকরুণ মন।
ওদিকে হইল কিবা শুন বিবরণ॥
রাজা যে মারিল ডঙ্কা সহরে বাজারে।
যেজন ধরিয়া দিবে তার দুষমনেরে॥
জাতি নাশ কৈল দুষমন কুলে দিল কালি।
দুষমনে ধরিয়া রাজা দিবে নরবলি॥
চুটিয়া চুটী[১০৯] গাইল মালাবতীর ঠাঁই।
তোমার সোয়ামীরে ধইরা নিছে[১১০] আর রক্ষা নাই॥
শিরেতে পড়িল বাজ বুকে পড়ে হানা।
ভূমিতে পড়িয়া কান্দে রূপবতী কন্যা॥
“শুন শুন পুনাই ধর্ম্মের মাও গো
(ছাইড়া দে[১১১])।
কি শুনিলাম কানে ওগো, কি শুনিলাম কানে
(ছাইড়া দে)॥
রাজার ঘরে জন্ম লইয়া হইলাম বনবাসী
আর কারে বা দিব দোষ কপালেরে দোষি গো
(ছাইড়া দে)।
নিশিরাইতে সঁপ্যা[১১২] দিল অভাগিনী মাও
ভাব্যাচিন্ত্যা আন্ধাইর পথে বাড়াইলাম পাও গো
(ছাইড়া দে)॥
পইড়া রইন দালান কোঠা যত দাসদাসী
বন্ধুরে লইয়া আমি হইলাম বনবাসী গো
(ছাইড়া দে)।
দৈবযোগে ধর্ম্ম-পিতার সনে হইল দেখা
অভাগিনীর ভাগ্যে বিধি সুখের পাইলাম দেখা গো
(ছাইড়া দে)॥
মা ভুললাম, বাপ ভুললাম, ভুললাম বাড়ীঘর
এই ছিল কর্ম্মের লেখা আপন হইল পর গো
(ছাইড়া দে)।
বানাইয়া পানের খিলি তুল্যা না দিলাম বন্ধুর মুখে গো
(ছাইড়া দে)॥
জ্বালাইয়া ঘির্তের বাতি একদিন না দেখিলাম
—বন্ধুর চান্দ মুখ গো
ফালাইয়া[১১৩] শীতল পাটি না শুইলাম বন্ধুর সনে গো
(ছাইড়া দে)।
দুই দিন না বঞ্চিলাম সুখের গিরবাস[১১৪]
কর্ম্ম ফেরে অভাগিনী হইল নৈরাশ গো
(ছাইড়া দে)॥
গাঁথিয়া পুষ্পের হার একদিন নাহি দিলাম বন্ধুর গলে গো
রাঁধিয়া চিকণের ভাত তুইল্যা না দিলাম বন্ধুর মুখে গো
(ছাইড়া দে)।
দেইখা আসি ধর্ম্মের মাও গো ছাইড়া দে॥
পর্বোধ না মানে কন্যা পুনাই বুঝায়
যতই বুঝায় কন্যা করে হায় হায়।
রূপবতী বলে “মাও
ধরি তোমার দুই পাও
আমারে লইয়া চল যাই।
যেখানেতে গেছে পতি
অইবাম[১১৫] মরণের সাথী
জীবনে আমার কার্য্য নাই॥
মনে মনে দুঃখ পাইলাম
একদিন না বঞ্চিলাম
করিলাম পতি সঙ্গে ঘর।
দুষ্মন হইল বাপ
চিত্তে মোর দিল তাপ
মাও বাপ হইয়া হইল পর॥
বিষ খাইয়া মরবাম[১১৬] গো আমি
যদি না দেখাও স্বামী
গলেতে তুলিয়া দিবাম কাতি।”
পুনাই বুঝাইয়া কয়
এ বড় বিষয় হয়,
বইল্যা কইয়া[১১৭] পোহাইল রাতি॥
প্রভাতে উঠিয়া পুনাই কোন্ কাম করে।
নৌকা সাজাইতে তবে কয় জাঙ্গাইলারে॥
জাঙ্গাইলা আনিল পান্সী ঘাটেতে লাগায়।
কন্যারে লইয়া পুনাই রাজার দেশে যায়॥
দরবারে বইসাছে রায় পাত্রমিত্র লইয়া।
দরবারের ঘরে পুনাই খাড়া হইল গিয়া॥
কাঙ্গালীরা জাঙ্গালীয়া পাছে দুই ভাই।
পর্থমে দরবারে দিল ধর্ম্মের দোহাই॥
রাজার দোহাই দিয়া পুনাই যোড়হাতে কয়।
“এক নালিশ আছে মোর কইতে বাসি ভয়॥
কোন্ দোষে জামাই মোর বন্দীখানা ঘরে।
কিসের লাগিয়া তুমি আন্যাছ তাহারে॥”
পাত্রমিত্রগণ তবে পুনাইরে জিজ্ঞাসে।
“কার জামাই কোথায় ধর আইল বন্দী-বেশে॥”
পুনাই কান্দিয়া কয় “বড় দুঃখের ঝি
তাহার দুষ্কের কথা কহিবাম কি॥
শুন শুন রাজা আরে কহি যে তোমারে।
পালিয়া পংখিনী কও কেবা মারে তীরে॥
শুন শুন রাজা আরে কহি যে তোমায়।
ঘর বান্ধিয়া কেবা তায় আগুন লাগায়॥
বাগোয়ান[১১৮] লাগাইয়া বল কেবা গাছ কাটে।
পায় আছাড়িয়া কেবা ভাঙ্গে পূজার ঘটে॥
নিশি রাইতে রাণী যারে কন্যা দিল দান।
সেইত জামাই তোমার পুত্রের সমান॥
জামাই কন্যার কহ কিবা দোঘ আছে।
স্বামী হারাইয়া কন্যা কি রকমে বাঁচে॥
পাগলিনী হইয়া কন্যা জল ডুবতে চায়।
বাউরা[১১৯] কন্যারে তোমার ধইরা রাখন দায়॥
আমার কথা রাখ্যা যাও বন্দীখানা ঘরে।
আগে কেনে বিয়া দিলা মারবা যদি পরে॥
বনবাসী হইল কন্যা ছিল পরের ঘর।
মাও বাপ হইয়া তোমরা কেনে হইলা পর॥”
গালি পাড়ে পুনাই শুনে সভাজন।
রাজার হইল মনে কন্যার বদন॥
সকরুণ-মন রাজা ভাসে চক্ষের জলে।
পাত্রমিত্র জনে রাজা বুঝাইয়া বলে॥
রাজার আদেশে হইল বিয়ার আয়োজন।
বন্দীখানা হইতে মুক্তি হইল মদন॥
হাতী ছিল ঘোড়া ছিল আর জমীবাড়ী।
জামাই কন্যায় লেখ্যা দিল বাড়ীর জমীদারী॥
বাড়ীতে বান্ধিয়া দিল বারদুয়ারী ঘর।
রূপবতী লইয়া জামাই যায় নিজ ঘর॥১—১৩৭
- ↑ বারবাংলা=বারদুয়ারী বাঙ্গালা ঘর। কেহ কেহ মনে করেন বাহিরবাটীর বাঙ্গালা ঘর।
- ↑ বান্ছে=বান্ধিয়াছে।
- ↑ গড় খন্দর=গড়খাই। নিম্ন জমিকে পূর্ববঙ্গের স্থানবিশেষে খন্দ (=খানা) বলে।
- ↑ পাটুয়ারী= সম্ভবতঃ পাত্রশব্দের অপভ্রংশ, আম্লা।
- ↑ নাগারচী=যাহারা নাগরা (চর্ম্মযুক্ত ঢোলজাতীয় বাদ্যবিশেষ) বাজায়।
- ↑ হাফার খানা=নহবৎ-গৃহ।
- ↑ আষ্ট=আট।
- ↑ সরে=শহরে।
- ↑ ফরমাই=ফরমাস, আদেশ।
- ↑ জুইত=যুক্ত করিয়া।
- ↑ আবের কাঁকই=আব (আভ্, অভ্র হইতে), কাঁকই=চিরুণী; অভ্রের চিরুণী।
- ↑ রঙ্গিয়া=রঙ্গ ইয়া।
- ↑ খাড়ি আর বিউনি=ডালা ও পাখা।
- ↑ উগাইয়া=শোধ করিবার জন্য।
- ↑ গাউইরা বাজুইয়া=গায়ক ও বাদক।
- ↑ নাগরীয়া=নাগরিক; নগরবাসী।
- ↑ কুলের=কোলের, ছোট।
- ↑ উথারিয়া=উত্তীর্ণ হইয়া, পার হইয়া।
- ↑ বাইড়াবাইতড়ি=ঘাত-প্রতিঘাত।
- ↑ কাছাড়=নদীর পার।
- ↑ থাক্যা=থাকিয়া।
- ↑ পূবইয়া=পূর্ব্বদেশীয়।
- ↑ গোঁয়ায়=গত হইল।
- ↑ আবিয়াইত=অবিবাহিতা।
- ↑ ধরায়=ধৈর্য্য ধরে।
- ↑ যুবা=যুবতী।
- ↑ চিন্তা জারে জারে=চিন্তায় জর্জরিত হইয়া।
- ↑ লিখনি=চিঠি।
- ↑ পরথমে=প্রথমে।
- ↑ আবেস্থা=অবস্থা।
- ↑ আলায়=আক্ষেপ
- ↑ আইয়া=আসিয়া।
- ↑ অইব=হইবে।
- ↑ চলন-চালন=গমন-ভঙ্গি।
- ↑ যোগ্য=যুগ্ম।
- ↑ পাশাল=সুপ্রসার, প্রশস্ত।
- ↑ দন্তপাট=দন্তপাটি।
- ↑ পাট=সিংহাসন
- ↑ পারা=পদ-ন্যাস, পায়ের দাগ, সমস্ত পায়ের ছাপ মাটীতে পড়ে। অলক্ষণা মেয়েদের পায়ের
..ক থাকায় সমস্ত পা মাটীতে পড়ে না। তাহাদিগকে চলিত ভাষায় “খড়ম পেয়ে” বলে। - ↑ উত্তরিয়া=উত্তরদেশীয়।
- ↑ পসরা=আলোকিত।
- ↑ গোছ=গঠন।
- ↑ দেইখা=দেখিয়া।
- ↑ ঝালা=রক্তিমাভা।
- ↑ থা=অন্যথা।
- ↑ ভাগ্যমতী=ভাগ্যবতী।
- ↑ ঝালা=এখানে ব্যতিক্রম অর্থ বুঝিতে হইবে।
- ↑ জোর=জোড়া।
- ↑ সবরী কলা=(পশ্চিমবঙ্গে) চাটিম।
- ↑ ঠাকুরালী=রাজ ক্ষমতা-প্রচার।
- ↑ চিকনির ভাত=সরু চাউলের ভাত।
- ↑ সর্ব্বাঙ্গ শরীর=সকল শরীর (দ্বিরুক্তি-দোষদুষ্ট পদপ্রয়োগ)।
- ↑ চির=ফাঁক, ভাগ।
- ↑ ভর যুবতী=পূর্ণ যৌবনা।
- ↑ বল্যা=বলিয়া।
- ↑ ছুরৎ জামালী=শ্রেষ্ঠা সুন্দরী।
- ↑ ঠাকুরালী=শ্রেষ্ঠ পদগৌরব।
- ↑ ছাহেবান=গুরুজনস্থানীয়, পূজনীয়।
- ↑ বাইচ্যা=বাঁচিয়া।
- ↑ আইজঙ্গ=হাইভঙ্গ, গাড়ো পাহাড়ের একশ্রেণীর অসভ্য অধিবাসীকে হাইজঙ্গ বা হাজাং বলা হয়। ইহারা প্রেতোপাসক। কৃষিকার্য্য, গো, মহিষ, মেঘ ইত্যাদির পালন ও শিক্ষার ইহাদের কাজ। অসভ্য হইলেও ইহারা সত্যপরায়ণ ও অহিংস্র।
- ↑ ডাকের আগে খাড়া=ডাক দিবামাত্রই হাজির।
- ↑ প্রভাতিয়া=প্রভাতকালীন।
- ↑ ছেড়া=ছোকরা; ছেলে।
- ↑ আজল=ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে জলে-ভরা।
- ↑ নেউলিয়া=ফিরিয়া
- ↑ তাবেদারি=হুকুম পালন।
- ↑ শিরের পরী=শিওরের প্রহরী।
- ↑ নাই তার নাম=নাম করিয়া শেষ করা যায় না।
- ↑ নবাবে—জমিদারী=জমিদারী আর থাকিবে না।
- ↑ ফাল্=লাঙ্গলের ফাল। লৌহনিখিত অগ্রভাগ, এখানে লৌহের শেল-বিশেষ।
- ↑ আখরির দিন=নির্দ্দিষ্ট দিন।
- ↑ কাঠাম=প্রতিমা।
- ↑ নলী=বক্ষের হাড়।
- ↑ জার=জর্জরিত, অবসন্ন। রূপবর্তী স্বপ্নে দেখিল যে তাহার মা কাঁদিতে কাঁদিতে অবসন্না হইয়া গিয়াছেন।
- ↑ কপালেরে দোষি=কপালের দোষ দেই।
- ↑ পোষনিয়া পংখী=পোষা পাখী।
- ↑ জোকার=জয় জয়কার হইতে; উলুধ্বনি।
- ↑ সোহাগ না মাগিল মায়=সোহাগ-মাগা বিবাহকালীন স্ত্রী-আচারবিশেষ।
- ↑ আন্ধাইরা=অন্ধকার।
- ↑ গলিয়া পড়ে=এলাইয়া পড়ে।
- ↑ পর্দীম=প্রদীপ।
- ↑ কৈবাম=কহিব।
- ↑ বুকের নলী=বুকের হাড়।
- ↑ রাইখ=রাখিয়ো।
- ↑ টাঙ্গাইয়া=খাটাইয়া।
- ↑ তের বাঁক পানি=নদী স্থানে স্থানে মোড় ফিরিয়া যায়, তাহাকে নদীর বাঁক বলা হয়। এইরূপ তেরটি বাঁক অতিক্রম করিয়া চৈতার নৌকা চলিয়াছে।
- ↑ লাগাইল=ভিড়াইল।
- ↑ চরনদার=আরোহী।
- ↑ অলছতলছ=উচ্ছৃঙ্খল।
- ↑ ভায়=প্রতি।
- ↑ খাইছে=খাইয়াছে।
- ↑ কইলে=করিলে।
- ↑ তিয়াষ=তৃষ্ণা।
- ↑ পাইড়া=পাতিয়া
- ↑ বিছানি=বিছানা।
- ↑ কেল্লেশে=ক্লেশে।
- ↑ ডোলা=মৎস্যাধার।
- ↑ আচানক= অপরিচিত, আশ্চর্য্য।
- ↑ কানপনা=স্মৃতি ক্ষুদ্র একজাতীয় মাছ।
- ↑ টুকাইয়া=কুড়াইরা।
- ↑ পোলা=পুত্র, পুরি=কন্যা।
- ↑ দেখ্যা আইয়াম্=দেখিয়া আসিব।
- ↑ উদ্দেশ=অনুসন্ধান।
- ↑ নি=কিনা।
- ↑ জীয়ে=জীবিত হয়। মরা চান জীয়ে= শুক্লপক্ষ দেখা দিয়াছে।
- ↑ মাকড়াসা=মাকড়সার জাল, ক্ষুদ্র অশ্রুবিন্দু চোখের উপর গড়িয়া মাকড়সার জালের মত দেখাইতেছে।
- ↑ তুলিয়া=ফুল তুলিয়া।
- ↑ দিনে আইব বলি=দিনে আসিবে বলিয়া।
- ↑ চুটিয়া চুটী=(?)
- ↑ নিছে=নিয়াছে।
- ↑ ছাইড়া দে=ছাড়িয়া দেও
- ↑ সঁপ্যা=সঁপিয়া, সমৰ্পন করি।
- ↑ ফালাইয়া=পাতিয়া।
- ↑ গিরবাস=গৃহবাস।
- ↑ অইবাম=হইব।
- ↑ মরবাম=মরিব
- ↑ বইল্যা কইয়া=বলিয়া কহিয়া।
- ↑ বাগোয়ান=বাগান।
- ↑ বাউরা=পাগলপ্রায়।