মৈমনসিংহ গীতিকা/দস্যু কেনারামের পালা
দস্যু কেনারামের পালা
বন্দনা
(১)
স্বপ্ন-দর্শন ও দেবী-পূজা
জালিয়া বন্দের[১] পারে বাকুলিয়া[২] গ্রাম।
তার মধ্যে বাস করে দ্বিজ খেলারাম॥
তিনকাল গেলরে তার অপুত্ত্রক হৈয়া।
মুখ নাহি দেখে লোকে আটখুর[৩] বলিয়া।
ঘরে বৈসা যশোধারা কান্দে খেলারাম।
কি পাপ কইরাছি তাইতে বিধি হৈলা বাম॥
মনেতে করছিলা যদি করবা আটকুড়িয়া।
কেন দিছিলা জন্ম আর কেন হইল বিয়া॥
ভাত নাই সে খাইব আর না ছুঁইব পানি।
দুয়ার বান্ধিয়া ঘরে ত্যজিব পরাণী॥
অনাহারে মরব আর নাহি সহে দুঃখ।
আর না দেখিব উঠিয়া পাড়াপরশির মুখ॥
আর না দেখিব সূর্য্য না জ্বালাইব বাতি।
আন্ধাইরে[৪] পরিয়া মোরা কাটাইবাম দিবারাতি॥
এহি মত এক দিন দুই দিন গেল।
তিন না দিনের কালে কোন কার্য্য হৈল॥
রাত্তি না নিশার কালে[৫] ঘোমে অচেতন।
যশোধারা দেখিল এক অপূর্ব্ব স্বপন॥
দেখিল শিয়রে এক দেবী অধিষ্ঠান।
চতুর্ভুজ ত্রিনয়নী পদ্মা মূর্ত্তিমান॥
দেবী আগমনে ঘর হইল উজালা[৬]।
সুগোল সুঠাম অঙ্গ পাকা সবরিকলা॥
অষ্ট নাগ অঙ্গে তার হেলায় দুলায়।
পদ্মের উপরে বৈসা ধীরে ধীরে কয়॥
“শুন ওগো যশোধারা চাও ফিরে মুখ।
শুনলো কেমনে তোমার যাইবে মনের দুঃখ॥
হইবেলো পুত্ত্র তোমার আরে চিন্তা নাইসে কর।
ভক্তিযুত হইয়ালো তুমি মোর পূজা কর॥
আষাঢ়-সংক্রান্তি দিনেলো শুন দিয়া মন।
উপাস থাকিয়া করলো ঘট-সংস্থাপন॥
মণ্ডপেতে প্রতিদিন দিও ধূপ-বাতি।
স্মরণে রাখিও মোরে প্রতি দিবারাতি॥
এহি মতে একমাস করিয়া পালন।
শ্রাবণ-সংক্রান্তি দিনে করহ পূজন॥”
এতেক বলিয়া দেবী হইলা অন্তৰ্দ্ধান।
জাগিয়াত যশোধারা চারি দিকে চান॥
আচম্বিত[৭] হৈয়া পরে কয় পতির স্থানে।
পূর্ব্বাপর যত কিছু দেখিলা স্বপনে॥
খেলারাম কয় “যদি পাই পুত্ত্র ধন।
লও মোরা করি তবে দেবীর পূজন॥”
আষাঢ়-সংক্রান্তিতে ঘট করিয়া স্থাপন।
দেবীর আদেশ করি মাসেক পালন॥
সংক্রান্তি দিবসে করে পূজা আয়োজন।
ইষ্ট কুটুম্ব জনে করে নিমন্ত্রণ॥
যোড়া পাঁঠা দিয়া বলি পূজা যে করিয়া।
নির্ম্মাল্য ধরিল শিরে ভক্তিযুথ[৮] হৈয়া॥
(২)
কেনারামের জন্ম ও নানাকষ্ট
তার পরে যশোধারা শুন দিয়া মন।
মাসেকের মধ্যে হৈল গর্ভের লক্ষণ॥
সুগোল সুন্দর তনু গো লাবণিজড়িত।
সর্ব্ব অঙ্গ দিনে দিনে হইল পূরিত[৯]॥
অজীর্ণ অরুচি আর মাথাঘোরা আদি।
আলস্য জরতা হৈল আছে যত ব্যাধি॥
সর্ব অঙ্গে জ্বালা মাথা তুলিতে না পারে।
আহার করিবা মাত্র ফেলে বমি করে॥
রুচি হৈল চুকা[১০] আর ছিকর[১১] মাটীতে।
বিছানা ছাড়িয়া শুয়ে কেবল ভূমিতে॥
এহি মতে দশ মাস দশ দিন গেল।
পরেত গর্ভেত এক ছাওয়াল[১২] জন্মিল॥
চন্দ্রাবতী কয় শুন গো অপুত্ত্রার ঘরে।
সুন্দর ছাওয়াল হৈল মনসার বরে॥
মায়ের অঞ্চলের নিধি গো মায়ের পরাণী।
দিন দিন বাড়ে যেমন চাঁদের লাবণী[১৩]॥
ছয় না মাসের শিশু গো হইল যখন।
মহা আয়োজনে করে অন্ন-পরশন॥
বাছিয়া রাখিল মাঝে গো শুন কিবা নাম।
দেবীর পূজার কিনা তাই “কেনারাম[১৪]॥”
হায়রে দারুণ বিধি কি লিখিলা ভালে।
মরিলা জননী হায়রে সাত মাসের কালে॥
কোলেতে লইয়া পুত্ত্র কান্দে খেলারাম।
“কি হেতু হইলা মোর প্রতি বাম॥
মাও ভিন্ন কেবা জানেরে পুত্ত্রের বেদন।
যাহার স্তনেতে হয় শরীর-পালন॥
সেই মায়েরে নিলা কারি[১৫] কিসের কারণে।
কি মতে বাঁচাইয়া পুত্র রাখিব জীবনে॥
অপুত্ত্রা ছিলাম গো মোরা সেই ছিল ভাল।
ভুলাইয়া মায়ায় পরে কেন দেও শেল॥”
কান্দিয়া কান্দিয়া তবে যায় খেলারাম।
পুত্ত্র কোলে উপনীত দেবপুর গ্রাম॥
সেহিত গ্রামেতে হয় মাতুল আলয়।
মামার বাড়ীতে কেনা কিছুদিন রয়॥
দুগ্ধ দিয়া মামী তার পালয়ে কুমারে।
দিনে দিনে বাড়ে গো শিশু দেবতার বরে॥
এক না বছরের শিশু হইল যখন।
খেলারাম গেল তীর্থ করিতে ভ্রমণ॥
এক দুই করি পার তিন বছর গেল।
খেলারাম ফিরিয়া আর ঘরে না আসিল॥
এমত সময়ে পরে শুন সভাজন।
আকাল হইলো গো অনাবৃষ্টির কারণ॥
একমুষ্টি ধান্য নাহি গৃহস্থের ঘরে।
অনাহারে পথে ঘাটে যত লোক মরে॥
আগেত বৃক্ষের ফল করিল ভোজন।
তাহার পরে গাছের পাতা করিল ভক্ষণ॥
পরেত ঘাসেতে নাহি হইল কুলান।
ক্ষুধায় কাতর হৈল যত লোকজন॥
গরুবাছুর বেচিয়া খাইল খাইল হালিধান[১৬]।
স্ত্রী পুত্ত্র বেচে নাহি গো গণে কুলমান॥
পরমাদ ভাবিল মাতুল কেমনে বাচে প্রাণ।
কেনারামে বেচল লইয়া পাঁচ কাঠা ধান॥ ১—৫২
(৩)
দস্যুদলে প্রবেশ
হালুয়া কিনিয়া পরে গো লইয়া কেনারামে।
হরষ অন্তরে গেলা আপন মোকামে॥
হালুয়ার সাত পুত্ত্র গো ডাকাইতের সর্দ্দার।
ডাকাতি করিয়া কৈল দৌলত বিস্তর॥
গারুয়া পাহাড়[১৭] হৈতে দক্ষিণ সাগর।
ঘরবাড়ী নাহি কেবল নল খাগড়ার গড়॥
বনেতে লুকাইয়। যত ডাকাতিয়াগণ।
পথিক ধরিয়া মারে ধনের কারণ॥
টাকা পয়সা রাখে লোকে মাটীতে পুতিয়া।
ডাকাতে কারিয়া লয় গামছা মুড়া দিয়া॥
ডাকাতে দেশের রাজা বাদশায় না মানে।
উজার হইন রাজ্য কাজীর শাসনে॥
হালুয়ার[১৮] পুত্ত্রগণ ডাকাত এমন।
আদেখা থাকিয়া বনে করয়ে ভ্রমণ॥
পথিক পাইলে পরে গো সকলে ধরিয়া।
তিন খণ্ড করে আগে খাণ্ডার[১৯] বাড়ী দিয়া॥
পয়সা কড়ি যাহা পায় সকলি লইয়া।
খাগড়া বনেতে পরে রাখে লুকাইয়া॥
ডাকাতি করিয়া হইল দৌলত এমন।
তবু না ছাড়য়ে পাপ অভ্যাস কারণ॥
থাকিয়াত কেনারাম তাদের সহিত।
অল্পেতে হইল এক মস্ত ডাকাত॥
হাত পার গোছা তার গো কলাগাছের গোড়া।
আসমানে জমীনে ঠেকে যখন হয় খাড়া॥
কৃষ্ণবর্ণ দেহ তার পর্ব্বতপ্রমাণ।
রাবণের মত হৈল অতি বলবান॥
শিশুকাল হইতে সে না জানে দেবতায়।
ভালমন্দ ভেদ নাই তার সীমানায়॥
পাপ কারে কয় নাহি জানে কেনারাম।
স্ত্রী পুত্ত্র নাহি তার নাই পয়সার কাম॥
তবুও পথিক সামনে পড়িলে তখন।
হরষ অন্তরে মারে ধনের কারণ॥
বাঘ যেমন মারে জন্তু খেলিয়া খেলিয়া।
এহি মতে মারে দুষ্ট মানুষ ধরিয়া॥
লইয়া পরের ধন লুকায় বনের মাঝে।
মাটীতে পুতিয়া রাখে না লাগায় কাজে॥
দলবল সঙ্গে কেনা বনে বনে ঘুরে।
জঙ্গলে পড়িয়া থাকে নাহি যায় ঘরে॥
বাতানে[২০] মহিষ আর পালে যত গাই।
কত যে চরিত তার লেখাজুখা নাই॥
পরাণ ভরিয়া কেনা করে দুগ্ধ পান।
তাইতে হইল দুষ্ট এত বলীয়ান॥
পথের পথিকের যদি ক্ষুধাতৃষ্ণা পায়।
পরাণ ভরিয়া সবে গাইয়ের দুধ খায়॥
হইল ডাকাত কেনা দুর্দ্দান্ত এমন।
তাহার তরাসে[২১] কাঁপে নল খাগড়া বন॥
সুশুঙ্গ হইতে সেই জালিয়া হাওর।
ঘুরিয়া বেড়ায় কেনারাম নিরন্তর॥
নৌকা বহিয়া সাধু ভাটী গাঙ্গে[২২] যায়।
ধনরত্ন কাড়ি লইয়া সায়রে ডুবায়॥
কত পুত্ত্র হারাইয়া কান্দেত জননী।
ঘরেতে থাকিয়া তবু স্থির নহে প্রাণী॥
এক ডাকে চিনে তারে দস্যু কেনারাম।
উজান ভাটীয়াল জুড়িয়া হইল বদ্নাম॥
যে পড়ে তাহার হাতে নাহি ফিরে দেশে।
মা বাপে দেখল না হায় মরিলা বৈদেশে॥
কেনার নামেতে সবে ভয়ে কম্পমান।
তাহার ভয়েতে কেউ না যান দূরস্থান॥
সন্ধ্যাকালে কেউ না হয় ঘরের বাহির।
আন্ধাইরে করয়ে বাস ভয়েতে অস্থির॥১—৬৪
(৪)
বংশীদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ
জালিয়া হাওর নাম ব্যক্ত ত্রিভুবন।
দিনেকের পথ জুড়ি নল খাগড় বন॥
ভাসান গাইতে পিতা যান দেশান্তরে।
পথে পাইয়া কেনারাম আগুলিল তারে॥
খোল বাজে করতাল বাজে বাজে একতারা।
পিতার সহিতে গায় শিষ্য সঙ্গে যারা॥
শ্রী অঙ্গেতে নামাবলী সন্ন্যাসীর বেশ।
ললাটে তিলক ছটা দীর্ঘ জটা কেশ॥
ভাবেতে বিভোর যত ভক্ত সমুদয়।
আগে আগে যান পিতা পাছে শিষ্যচয়॥
প্রেমানন্দে হস্ত তুলে কেহ গলা ধরে।
কেহ বা অশ্রুতে ভাসি পড়ে ধরা পরে॥
না জানে কোথায় তারা গান গাইয়া যায়।
কোথায় আইল নাহি চক্ষু তুলে চায়॥
গাইতে গাইতে আইলা জালিয়া হাওরে।
চারিদিক বেড়িয়াছে নলে আর খাগরে॥
মানুষের নাই নামগন্ধ অষ্টপ্রহর জুড়ি।
নল আর খাগড়ে সব রহিয়াছে বেড়ি॥
দূরেতে উঠিল ধ্বনি ‘জয় কালী’ নাম।
সন্মুখে দাঁড়াইল আসি দস্যু কেনারাম॥
পাছু হইয়া খাড়া রয় দস্যুগণ যত।
কমরবান্ধা মালকোচা খাণ্ডা লইয়া হাত॥
পাহাড়িয়া দেহ যেন কাল মেঘের সাজ।
যমদূতগণ সঙ্গে যেন যমরাজ॥
আগুলিয়া কেনারাম জিজ্ঞাসে পিতারে।
“কেমন ঠাকুর তুমি চেন কি আমরারে॥”
হাসিয়া কহেন পিতা ডাকাইতের স্থানে।
“পাপেরে দেখিয়া বল কেবা নাহি চিনে॥”
“দেহ যাহা আছে" দস্যু কহে উচ্চৈস্বরে।
ঝুলি ঝাড়িয়া পিতা দেখান সবারে॥
“কয় খানা ছেড়া বস্ত্র আছে সঙ্গে মোর।
এ সব লইয়া বল লভ্য কিবা তোর॥”
কেনা কহে “গান গাইয়া ফির বাড়ী বাড়ী।
তাতেও কি নাহি জুটে কিছু পয়সা-কড়ি॥”
“গাহানা শুনিয়া পয়সা দিবে কোন জন।
এমন মনুষ্য নাহি দেখি এই বন॥
দেবতার লীলা গাই দুয়ারে দুয়ারে।
গান গাইয়া পাপীর মন চাই গলাবারে॥”
“পাই বা না পাই কিছু ইতে[২৩] নাহি দুখ।
মানুষ মারিয়া আমি পাই বড় সুখ॥”
হাসিতে হাসিতে কেনা এতেক বলিয়া।
খাণ্ডা তুলিয়া লইল ‘জয় কালী’ বলিয়া॥”
ঠাকুর বলেন “দস্যু নরহত্যা পাপ।
নরকে যাইবা তুমি না পাইবা মাপ॥
বিধাতার কাছে তোমার হইবে বিচার।
যাচিয়া নরক-ভোগ কর পরিহার॥
মানুষ মারিয়া বল কোন প্রয়োজন।
টাকাকড়ি এ সকল নহে কোন ধন॥
মনসাচরণ দেখ সর্ব্বধন সার।
সে ধন পাইলে হবে ভবনদী পায়॥”
হাসিয়া হাসিয়া তবে কহে দস্যুপতি।
“সাত পাচে ভুলাইতে চাহ অল্পমতি॥
মানুষ মারিয়া মোর গেল তিন কাল।
শুনিব তোমার কাছে ধর্ম্মের আলাপ॥
মানুষ মারিয়া মোর মনে নাহি দুখ।
যত মারি তত যেন পাই মনের সুখ॥
পাপপুণ্য নাহি জানি মানুষ মারিব।
তোমার কাছেতে ঠাকুর ধর্ম্ম না শিখিব॥”
ঠাকুর কহেন “দস্যু কিবা তোমার নাম।”
দস্যু কহে “চিনিলে না আমি কেনারাম॥”
যার নাম শুনি লোক কাঁপে থরথরি।
শিউরি বৃক্ষের পাতা পড়ে ঝরঝরি॥
শুনিয়া কেনার নাম কাঁদে শিষ্যগণ।
অটল অচল পিতা হাসিমুখে কন॥
“গান গাহিয়া আমি দেশে দেশে ঘুরি।
দুঃখ মোর নাই তোমার হাতে মরি॥
তোমার পাপের বোঝা ভারি হইল বড়।
পরপারে বইয়া নিতে হইবে কাতর॥
সঙ্গেতে না যাবে কেউ একা যেতে হবে।
কি কার্য্য করিতে কেনা আসিলে এ ভবে॥
দিনে দিনে তোমার সুদিন হইল গত।
উড়িয়া যাইবে যখন তেউর[২৪] পক্ষীর মত॥
যাইতে দেখিবে পথে ঘোর অন্ধকার।
পাষাণে ভাঙ্গিয়া মাথা করবে হায় হায়॥”
ঠাকুর বলেন “কেনা, কি কাম করিলে।
অন্তিমে সম্বল কিছু সঙ্গে না লইলে॥”
চোরা নাহি শুনে দেখ ধর্ম্মের কাহিনী।
পিশাচে না শুনে রাম অন্তরেতে গ্লানি॥
কেনা কহে “ঠাকুর মোরে দেখিলা নয়নে।
আমারে যে না ডরায় নাহি এ ভুবনে॥
ভয় নাই সে কর তুমি কে হও ঠাকুর।
খাণ্ডায় তোমায় পাঠাইব বনের পুর॥
এহিত আমার খাণ্ডা অতি খরশাণ।
এক কুবেতে[২৫] তোমার লইবাম প্রাণ॥”
ঠাকুর কহিলা “আমি দরিদ্র বামন।
আমার মাসেতে তোমার কোন প্রয়োজন॥”
কেনা কয় “শীঘ্র করি নাম নাহি বল।
সময় করিয়া নষ্ট আছে কিবা ফল॥”
ঠাকুর কহিলা “মোর দ্বিজবংশী নাম।”
শুনিয়া চমকিয়া উঠে দস্যু কেনারাম॥
“তুমি ঠাকুর দ্বিজবংশী যার নাম শুনি।
পাগ্লা ভাটীয়াল নদী বহে যে উজানি॥
পাষাণ গলিয়া মেঘ বর্ষে যার গানে।
সেই দ্বিজবংশী তুমি খাগরের বনে॥
পশুপক্ষী উড়িয়া আসে যার গান শুনিয়া।
ভুজঙ্গ চলিয়া যায় শির নোয়াইয়া॥”
কহেন ঠাকুর শুনি এতেক বচন।
“আমার গানেতে গলে কঠিন পাষাণ॥
পাষাণ গলাইতে আমি পারি শতবার।
কিন্তু মানুষের মন গলাইতে ভার॥
বনের পশুপক্ষী মোগ্ধ[২৬] আমার গান শুনি।
না পারিলাম গলাইতে মানুষের প্রাণী॥
লৌহের বাড়াই[২৭] দেখ মানুষের প্রাণ।
শাপেতে হইয়াছে যেমন অহল্যা পাষাণ॥”
এতেক শুনিয়া কেনা নীরব হইলা।
কেনারে ডাকিয়া পিতা কহিতে লাগিলা॥
“লইয়া পরের ধন কোন কর্ম্ম কর।
পাপেতে মজিয়া কেন ভরা বুঝাই[২৮] কর॥
এ ভরা ডুবিবে তোমার মাইঝ[২৯] গাঙ্গের জলে।
বন্ধু না খারাইবে[৩০] কেউ তোমায় ধইরা তুলে॥
এ ধন লইয়া তুমি কোন কার্য্য কর।
ধনের লাগিয়া কেন পাগল হইয়া মর॥
দারাপুত্ত্র কেউ নয় তোমার পাপের ভাগী।
পাপেতে মজিয়া হইলে ধর্ম্মেতে বিরাগী॥”
কেনা বলে “দারাপুত্ত্র কিছু মোর নাই।
মানুষ মারিয়া আমি বড় সুখ পাই॥
ধনে নাহি প্রয়োজন টাকায় নাহি কাম।
মানুষ মারিয়া মোর হইল সুনাম॥”
ঠাকুর বলেন “কেনা, এই ধন লইয়া।
কোথায় রাখিছ তুমি বল ভারাইয়া[৩১]॥
কারে দেও টাকাকড়ি কেন হেন কর।
ধরম ছাড়িয়া কেন পাপ কইরা মর॥
দবিদ্রে বিলাও কিম্বা নিজে ভোগ কর।”
কেনারাম কহে “ঠাকুর, মনে হইল দর[৩২]॥
দবিদ্রেরে করি যদি এই ধন দান।
ধনলোভে হবে সেই আমার সমান॥
ধনলোভে মত্ত হইয়া করিবে কুকাজ।
হাজার কলঙ্কে তার নাহি হবে লাজ॥
পড়িলে একটী বার লোভের বিপাকে।
মানুষ ডাকাইত হয় জ্ঞান নাহি থাকে॥
যত ধন করিয়াছি ডাকাইতি করিয়া।
ফুরাইতে না পারিবে সাত পুরুষ খাইয়া॥
তবুও প্রাণের টান দস্যু বৃত্তি করি।
বৈসা না খাইতে পারি দণ্ড দুই চারি॥”
ঠাকুর কহেন “তবে ধনরত্ন লইয়া।
কোন কার্য্য কর তুমি ডাকাতি করিয়া॥
“না দেখে মানুষ জন বনের পশুপাখী।
যার ধন তার কাছে লুকাইয়া রাখি॥”
“কার ধন কার কাছে রাখ লুকাইয়া।”
অবাক্যি[৩৩] হইলা ঠাকুর একথা শুনিয়া॥
কেনা কহে “এ ধন সকলি মাটীর।
মাটীতে লুকাইয়া রাখি যুক্তি করি স্থির॥
মাটীতে মিশিয়া ধন যাউক মাটী হইয়া।
মানুষ যে নাহি পায় সে ধন খুজিয়া॥
ভাবিয়া দেখহ ঠাকুর যত টাকাকড়ি।
কেবলি লোভের চিহ্ন জগতের বৈরী॥”
ঠাকুর কহেন “বল লাভ তাহায়।
ধন লইয়া কোন জন মাটীতে লুকায়॥
ভোগ নাহি কর ধন রাখ লুকাইয়া।
এ ধনে কি ফল আছে অর্জন করিয়া॥”
কেনারাম বলে “ঠাকুর ভোগের লাগিয়া।
ধন নাহি লই আমি পথিকে ভারাইয়া॥
দেশে যত ধনী আছে তাহাদের ধনে।
ভিক্ষুক লোকের আসে কোন প্রয়োজনে॥
থাকিয়া ভাণ্ডারের ধন ভাণ্ডারেতে ক্ষয়।
এ ধনেতে সংসারের কোন কার্য্য হয়॥
কথায় কথায় ঠাকুর অনেকক্ষণ গেল।
বেলা ফুরাইয়া দেখ সন্ধ্যা যে হইল॥”
খাণ্ডা তুলিরা ধরে কেনারাম কয়।
"শীঘ্র করি মারি সবে দেরী নাহি সয়॥”
(৫)
ভাসান সংগীত
ঠাকুর কহেন তবে শুন কেনারাম।
“এইখানে গাইব আমি জন্মের শেষ গান॥”
দুই চক্ষে অশ্রু বহে মনসা স্মরিয়া।
“জীবনের শেষ গান লইব গাহিয়া॥
তাইতে একটু সময় দেও মোরে ধার।
গান শেষে কর তুমি কার্য্য আপনার॥”
কি জানি ভাবিয়া কেনা কয় ঠাকুরের স্থানে।
“গাও খাণ্ডা পুনঃ নাহি ধরি যতক্ষণে॥”
আকাশ চাঁদোয়া হইল শুনে পশুপাখী।
কেনারাম বসিল যে হাতের খাণ্ডা রাখি॥
উড়িয়া যায় পাখী আসি বসিল ডালেতে।
মনসা ভাসান গায় অঞ্জনার[৩৪] সুতে॥
বিস্তার প্রান্তরে কেনা দূর্ব্বার বিছানে।
গাহান[৩৫] শুনিতে বসল দলবল সনে॥
প্রেমেতে বিভোর পিতা ভাবে আত্মহারা।
কথায় কথায় চক্ষে বহে অশ্রুধারা॥
গাহান শুনিয়া কেনা ভাবে মনে মনে।
সাক্ষাৎ দেবতা বুঝি নামিতা ভুবনে॥
গাহিতে গাহিতে পরে সন্ধ্যা গুজরিল[৩৬]।
কেনার হুকুমে গান চলিতে লাগিল॥
কেনার ইঙ্গিতে যত ডাকাতিয়া ছিল।
আন্ধার নাশিতে সবে মশাল জ্বালিল॥
মশালের তেজে হইল বন যে উজালা।
সূর্য্যের পশরে[৩৭] যেমন দিন হইল আলা॥
মনসা মঙ্গল
বন্দনা
জয় বন্দ ভবানি ভবদুঃখ-বিনাশিনী
সিংহবাহিনী মহামায়া।
কার্ত্তিক-গণের মাতা হিমগিরিরাজ-সূতা
ঈশ্বরঘরণী অৰ্দ্ধকায়া॥
মহিষাসুর-মর্দ্দিনী দশভুজা ত্রিনয়নী
পূর্ণ চন্দ্রমুখ মনোহার।
শিরে রত্নমুকুট পিঙ্গল জটাজুট
অর্দ্ধ-ইন্দুভূষিত শিখর॥
ত্রিভঙ্গের ভঙ্গিমা বর পীনোন্নত পয়োধর
প্রথম যৌবন কলেবর।
অতসী কুসুম আভা নানা রত্ন মণি শোভা
সিত শ্বেত সুরঙ্গ অধর॥
খৰ্গ চক্র ধনুর্ব্বাণ হাতে খাণ্ডা খরশান[৩৮]
বজ্রাঙ্কুশ ঘণ্টা যে কুঠার।
পূর্ণ অস্ত্র দশভুজে অদ্ভুত বনমাঝে
বিরাজিত সর্ব্ব অলঙ্কার॥
দক্ষিণ-চরণমূল রক্তপদ্ম সমতুল
সমলগ্নে সিংহ আরোহণ।
কিঞ্চিদূর্দ্ধে বামাঙ্গুষ্ঠে লাগিছে মহিষপৃষ্ঠে
দ্বিজ বংশীদাসের রচন॥
প্রথমে বন্দিনু দেব অনাদি চরণ।
দ্বিতীয় বন্দিনু ব্রহ্মা পরম কারণ॥
তৃতীয়ে বন্দিনু বিষ্ণু জগতের পতি।
তার দুই ভার্য্যা বন্দ লক্ষ্মী সরস্বতী॥
চতুর্থে বন্দিনু শিব গণেশ সহিতে।
অৰ্দ্ধ অঙ্গে গৌরী শোভে গঙ্গা শোভে মাথে॥
পূর্ব্বে বন্দ ভানুরে পশ্চিমে যায় অস্ত।
উড়িষ্যা দেশেতে বন্দ প্রভু জগন্নাথ॥
পুষ্পমধ্যে বন্দি গাই আদ্যের তুলসী।
ব্রতমধ্যে বন্দি গাই ভীম একাদশী॥
পাতালে বাসুকি আদি বন্দ নাগগণ।
নারদ আদি বন্দিনু যত দেবগণ॥
মায়ের দুটী স্তন বন্দ অক্ষয় ভাণ্ডার।
গয়া কাশী গিয়া যার শোধিতে নারি ধার॥
এক স্তনের দুগ্ধে হবে লক্ষ কড়ি মূল।
আমি পুত্ত্রে বেচিলে না হবে সমতুল॥
এহি মতে বন্দনা-গীতি নিরবধি থৈয়া[৩৯]।
পদ্মার জনম কথা শুন মন দিয়া॥
এক দিন ঘরে চণ্ডী না দেখি শঙ্করে।
ডাক দিয়া নারদেরে আনিল সত্বরে॥
“তুমিত নারদ ভাগিনা আমি তোমার মামী।
মামা তোমার কোথায় গেছে নিশ্চয় না জানি॥”
নারদ বলেন “শুন গণেশজননী।
পদ্মবনে শুনিয়াছি জন্মেছে পদ্মিনী॥
তাহার যে রূপ মামী নাহি তব ঠাই।
বিবাহ করিতে তারে গিয়াছে গোসাঞী॥”
ক্রোধিত হইল চণ্ডী নারদ-বচনে।
শঙ্কর মোহিতে কাজে চলিলা আপনে॥
ত্বরিত গমনে গেল নদীর নিকটে।
আসিয়া শিবেরে চণ্ডী না দেখিলা ঘাটে॥
চণ্ডী বলে “শুন সরুয়া[৪০] আমার উত্তর।
তোর অলঙ্কার মোরে পরি বদল কর॥
তব কাংসপিত্তলের দেহ অলঙ্কার।
তুমি নিয়া যাহ মোর রত্ন অলঙ্কার॥
খেয়াঘাটের নৌকাখানা মোর ঠাই দিয়া।
আপনার ঘরে তুমি সুখে রহ গিয়া॥”
এত শুনি ডুমুনী যে গেলেন হরিষে।
নৌকার উপরে চণ্ডী ডুমুনীর বেশে॥
দেড় প্রহর বেলা আছে আড়াই প্রহর বাদে।
আসিয়া মিলিল শিব চণ্ডীকার ফাঁদে[৪১]॥
দেখিল অদ্ভুত নদী অতি খরস্রোত।
নৌকার উপরে দেখে কামিনী অদ্ভুত॥
ডাকিয়। শঙ্কর বলে “নৌকা আন ঘাটে।
দূরেত যাইবারে চাহি পার কর ঝাঠে[৪২]॥”
সুকবি নারায়ণ দেবের সুরস পাচালী।
পয়ার প্রবন্ধে বলি এক যে লাচারী[৪৩]॥
খোয়াঘাটে বসিয়া শঙ্কর।
“ডুমুনী ডুমুনী” করি ডাক ছাড়ে অধিকারী[৪৪]
“নৌকা লইয়া আসহ সত্বর॥”
ডাক দিয়। বলে শিব “পার হৈলে কিছু দিব
কেন পার না কর আমারে।
বেলা হৈল অতিশয় বিলম্ব উচিত নয়
যাব আমি পদ্ম তুলিবারে॥”
কৌতুকেতে মায়া করি বলিল ডুমের নারী
“শুন শুন দেব শূলপাণি।
মোর ডোম নাহি ঘরে এত ডাক ডাক কারে
ঘাটেতে নাহিক নৌকা আনি॥
যেই আছে নৌকাখানি বাগে বাগে বহে পানি
কেমন করিয়া হৈবা পার।
ভাঙ্গা কেরুয়াল[৪৫] খান না ধরে জলের টান
শিচিয়া[৪৬] না পারি রাখিবার॥
এই ঘাটে খেয়া করি দেন প্রতি নয় খুরী[৪৭]
দিবেত উচিত খেয়া করি।”
ডাক দিয়া বলে শিব “পার হৈলে কি কি দিব
শুন শুন সরুয়া ডুমুনী॥
ঝুলিতে আছে ইন্দ্রাসন সংসারের সার ধন
পার হৈলে কিছু দিতে পারি॥”
বুকেতে চাপর মারি কহিছে ডুমের নারী
“আমারে ভারিয়া যাইতে আশা।
খেয়া দিতে ভাঙ্গের গুড়া পার হৈতে চাহ বুড়া
দূর হওরে ভাঙ্গর মুনছা[৪৮]॥”
“ডুমুনীরে না নিন্দা কর যদি কিছু খাইতে পার
ত্রিভুবন নয়নগোচর।
যুগ পথে মন দর ঝিমাইতে সুখ বড়
সদাই আনন্দ কলেবর॥”
হাসি বলে ডুমের নারী “নায়ে উঠ ত্বরা করি
মনে কিছু না করিও দ্বিধা।
একবার করিব পার ত্রিভুবনে জানাবার
ঝুলীকাথা থুইয়া যাহ বান্ধা॥”
সংসার মোহিত করে হেন রূপ চণ্ডী ধরে
দেখি শিবের সাত পাঁচ মন।
রমণ করিতে আশ শিবের মনে অভিলাষ
নারায়ণ দেবের সুরচন॥
দিশা:—বিনোদিনী রাই। গোকুল ছাড়িযা বৃন্দাবনে যাই।
ডোমনীর বচন শুনিয়া মহেশ্বর।
ঝটীতে উঠিল গিয়া নায়ের উপর॥
খেয়া দেয় ডুমুনী যে ধরিয়া কাঁড়াব।
সাতারিয়। বৃষ গোটা নদী হৈল পার॥
ডুমুনীর রূপ দেখি অতি সুলক্ষণ।
কামেতে পাগল ভোলা স্থিব নহে মন॥
শিব বলে “শুনলো ডুমুনী তুমি আমার সই।
তোমার কাছেতে কিছু দুঃখের কথা কই॥
এমন যৌবন তোমার বৃথা বৈয়া যায়।
তোমারে ছাড়িয়া ডুমনা গিয়াছে কোথায়॥
ডুমুনী বলে “মোর ডোম গিয়াছে গাওয়ালে[৪৯]।
একাকিনী খেয়া দেই এই ঘাটকূলে॥”
ডুমুনীর বোলে শিব পরম কৌতুক।
চোরে ধন পাইলে যেমন মনে হয় সুখ॥
কাঁড়াল[৫০] ধরিয়া ডুমুনী বৈঠা বায় লাসে।
ক্ষণেতে ডুমুনীর গায়ের কাপড় খসে॥
শিব বলে “শুন কই সরুয়া[৫১] ডুমুনী।
ক্ষণে ক্ষণে দেখি যেন সাক্ষাৎ ভবানী॥
তোর রূপ দেখি মোর স্থির নহে প্রাণ।
প্রাণ রক্ষা কর মোরে দিয়া রতি দান॥”
ডুমুনী বলে “দাড়ী-চুল পাকাইলা কেনে।
আপনার কথা বুড়া না বুঝ আপনে॥
বানরের মুখে যেন ঝুনা নারিকেল[৫২]।
কাকেতে খাইতে আশা যেন পাকা বেল॥
আমিত যুবতী নারী তুমি বৃদ্ধ বুড়া।
দন্তহীন বাঘে যেন কামড়ায় মরা॥
বয়স কালে যা করেছ সেই লয় মনে।
পূর্ব্বকথা কহ বুড়া নির্লজ্জ কারণে॥”
শিব বলে “বুড়া কথা না কহ ডুমুনী।
মরিচ যতই পাকে তত হয় ঝাল।
আমি ভাবি এহিত মোর যৌবনের কাল॥”
ডুমুনী বলয়ে “তুমি কড়ার ভিখারী।
কি দিয়া করিখে বশ পরের সুন্দরী॥”
শিব বলে “খেয়া দিয়া পাও যত কড়ি।
তাহার দ্বিগুণ কড়ি লহ লেখা করি॥
কালি প্রাতে যান আমি কুবের-নগরে।
ভিক্ষা করি যাহা পাই দিব আমি তোরে॥”
ডুমুনী বলে ত “মোর হইল ভরসা।
ভিক্ষা করি ধন আনি পুরাইবে আশা॥
এমন ভাঙ্গর তুমি নাহি কিছু জ্ঞান।
মনে ভাব আমা হতে তুমি জ্ঞানবান্॥”
শিব বলে “কেন তুমি বল এমন কথা।
শুনিয়া তোমার কথা শেল হৃদে গাঁথা॥”
হাসয়ে ডুমুনী শুনি শিবের বচন।
আস্তে ব্যস্তে ঘাটে নৌকা লাগায় তখন॥
লড় দিয়া ডুমুনী যে চলে নিজ ঘরে।
পশ্চাতে সামায়[৫৩] শিব ডুমুনীর ঘরে॥
চীৎকার করিয়া ডুমুনী ডাকে সর্ব্বজনে।
প্রমাদ পড়িল হেতা সাক্ষী কারে মানে॥
“যদি মোর ডোম আসে লাগ পায় তোর।
দিবে সে উচিত শাস্তি চুলে ধরি তোর॥
তোমারে কাটিয়া আজি ফেলিবেক গাড়ি[৫৪]।
বৃষ গোটা বেচিয়া লইবে খেয়ার কড়ি॥”
আপনার নিজ মূর্ত্তি ধরিলা ভবানী।
লজ্জিত হৈলা দেখি দেব শূলপাণি॥
“ভাগ্যে যে আসিনু আমি ডুমুনীর রূপ ধরি।
তে কারণে জাতিরক্ষা হৈল ত্রিপুরারি॥”
- এত দূরে গিয়া যখন মৃদঙ্গে মারল তালী।
- দলবলে কেনারাম হাসে খলখলি॥
“সঙ্গে না লইও তারে মোর মাথা খাও[৫৫]॥
এহি কন্যা অষ্ট কোটী নাগের জননী।
বিষহরি নামে কন্যা হবে ত্রিলোচনী॥
দেব নর যক্ষ রক্ষ ডরিবে তাহারে।
কন্যারে রাখিয়া তুমি যাও নিজ ঘরে॥”
এহি কথা শুনে চণ্ডী গেলা পদ্মবনে।
পদ্মবন দেখে চণ্ডী হরসিত মনে॥
এক দিন দুই দিন তিন দিন গেল।
দারুণ বিষের জ্বালা অঙ্গে প্রবেশিল॥
দিবাশেষে কন্যা এক লভিল জনম।
কন্যার রূপেতে উজলা পদ্মবন॥
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন উদিল ধরায়।
কন্যারে দেখিয়া চণ্ডী করে হায় হায়॥
এমন কন্যারে রাখি কেমনে যাব ঘরে।
শিবের বচন চণ্ডী ক্ষণে ক্ষণে স্মরে॥
হেন রূপে কৈলাসে যায় জগতের মাতা।
রাবণ পণ্ডিতে গায় পদ্মার জন্মকথা॥
- বিষহরির জন্মকথা শুনে কেনারাম।
- উদ্দেশে জানায় পদে শতেক প্রণাম॥
পদ্মার জনমকথা নিরবধি থৈয়া।
নেতার জনমকথা শুন মন দিয়া॥
নেতার জনমকথা এইখানে থৈয়॥
সমুদ্রমন্থনকথা শুন মন দিয়া॥
ভক্তিকথা একচিত্তে শুন মন দিয়া।
তুণ্ডক নামেতে ছিল এক দানবীয়া[৫৬]॥
মনেতে ভাবিয়া তুণ্ডক সংসার অসার।
ধর্ম্মভাব জাগরিল হৃদয়ে তাহার॥
“কেবা আছে পৃথিবীতে হেন গুরুজন।
যাহার দয়াতে হবে পাপবিমোচন॥
গুরু বিনা কেমনে হবে ভবনদী পার।
কেবা মন্ত্র দিবে মোরে আমি দুরাচার॥”
এহি কথ। ভাবি মনে তুণ্ডক দানবীয়া।
শুক্রাচার্যের কাছে বলে উপনীত হৈয়া॥
“শুন মোর কথা দেব দয়া যে করিয়া।
উদ্ধার করহ মোরে পদে স্থান দিয়া॥
তোমার চরণে মোর এহি নিবেদন।
অধম বলিয়া নাহি ঠেলো গুরুধন॥
পাপকার্য্যে রত আমি পাপী মোর হিয়া।
আমায় করহ পার পদতরী দিয়া॥
আর না যাইব তব চরণ ছাড়িয়া।
মার কাট কিংবা রাখ পদে স্থান দিয়া॥”
এহি কথা শুনে শুক্রের দয়া উপজিল।
দীক্ষিত করিয়া তারে শিষ্য বানাইল॥
সেহিদিন হইতে তুণ্ডক শুক্রাচার্য্যের স্থানে।
মন দিয়া শুনে যাহা গুরুদেব ভণে[৫৭]॥
একেত তুণ্ডক হয় অসুরের সূত।
পাপপূর্ণ বোধহীন সদা হিংসারত॥
তার পরে ক্রোধ তার ছিল অতিশয়।
যাহা ইচ্ছা তাহা করে নাহি মনে ভয়॥
একদিন কিবা জানি উচ্ছিল্লা[৫৮] করিয়া।
গুরুর পূজার ফুল দিল ফালাইয়া॥
রাগিয়া কহিলা গুরু তুণ্ডকের স্থানে।
“আর না রাখিব দুষ্ট আমার ভবনে॥”
পরেত তুণ্ডক গুরুর চরণ ধরিয়া।
আরও কিছুদিন থাকে ক্ষমাভিক্ষা পাইয়া॥
তার পর কিবা হৈল শুন দিয়া মন।
তুণ্ডক ত্যজিতে নারে স্বভাব আপন॥
অসুরের বুদ্ধি তার অসুরিয়া মন।
রাত্রদিনে শুক্রাচার্য্যে করে বিড়ম্বন॥
একদিন দানব দুষ্ট কি কাম করিল।
আছাড় মারিয়া ভাঙ্গে গুরুর কমুণ্ডল॥
ক্রোধিত হইয়া গুরু কহিলা তাহারে।
“আজি হতে দুরাচার যাও দেশান্তরে॥
মন্ত্রতন্ত্র যাহা দিনু সব বৃথা গেল।
আজি হতে গুরুশিষ্য সম্বন্ধ ঘুচিল॥”
তুণ্ডক কহিছে গুরু “শুন নিবেদন।
আরও কিছুকাল পূজি তোমার চরণ॥”
পায়ে ধরি ক্ষমা চায় দুরন্ত অসুরে।
পুনঃ স্থান দিলেন গুরু দয়া করি তারে॥
নিদ্রা যায় শুক্রাচার্য্য অজিন আসনে।
দুরন্ত অসুর তাহা দেখে সঙ্গোপনে॥
জটাচুল ধরি গুরুর নিদ্রা যে ভাঙ্গিল।
ক্রোধিত হইয়া মুনি পদাঘাত কৈল॥
দিব্য দেহ ধরি তুণ্ডক কহে গুরুর স্থানে।
“পাইয়াছি যাহা চাই তোমার সদনে॥
চিত্রক গন্ধর্ব্ব আমি পূর্ব্বে জন্মেছিনু।
শাপেতে অসুরকুলে জনম লভিনু॥
“তোমার চরণস্পর্শে মুক্ত হয়ে যাই।
আশীর্ব্বাদ কর গুরু এহি ভিক্ষা চাই॥
মন্ত্রতন্ত্র নাহি জানি এহি মোর ভাল।
আসিলাম হয়ে শুধু পদের কাঙ্গাল॥”
রাবণ পণ্ডিত[৫৯] কয় শুন দিয়া মন।
পাপীর ভরসা কেবল শ্রীগুরুর চরণ॥
এক ফোটা পায়ের ধুলায় নাহি পরিমাণ।
গয়া কাশী বৃন্দাবন তীর্থের সমান॥
- তুণ্ডকের কথা কেনা যখন শুনিল।
- পায়েতে ধরিয়া ঠাকুরে প্রণাম করিল॥
- চামর দুলাইয়া পিতা গাণ উচ্চৈস্বরে।
- আকাশে থাকিয়া শুনে গন্ধর্ব্ব অমরে॥
ততক্ষণে অন্য কথা করি সমাপন।
চান্দ সদাগরের কথা কৈলা আরম্ভণ॥
দক্ষিণ সাগরতীরে চম্পক নগর।
তাহাতে রাজত্ব করে রাজা কোটীশ্বর॥
তাহার ঘরেতে জন্মে চান্দ সদাগর।
চান্দের জনম কথা শুন অতঃপর॥
পূর্ব্বজন্মে চান্দের ছিল পশু-সখা নাম।
চন্দ্রবংশে জানি রাজা করে রাজকাম॥
দ্বিজ বংশীদাসে গায় পদ্মার চরণ।
ভবসিন্ধু তরিবারে বল নারায়ণ॥
পুত্ত্র হৈল কোটীশ্বর হরষিত মনে।
নানাবিধ মহোৎসব কৈল দিনে দিনে॥
লক্ষ্মীপূজা আদি করি যতেক মঙ্গল।
জাত-কর্ম্ম চূড়া-কর্ম্ম করিল সকল॥
বেদ অনুসারে কর্ম্ম করিয়া সুমার[৬০]।
গুরুর নিকটে দিল শাস্ত্র শিখিবার॥
পড়িয়া পণ্ডিত হৈল কবিত্বের শিক্ষা।
গুরু যে ভৈরবমন্ত্রে করিলেক দীক্ষা॥
পূর্ব্ব পুণ্যফলে হৈল মহামতি।
বাপের আজ্ঞায় পুজে শঙ্করপার্ব্বতী॥
ভক্তি দেখি তুষ্ট হৈয়া ভবাণীশঙ্কর।
প্রসন্ন হইয়া শিব দিলেন উত্তর॥
চান্দ বলে “যদি মোরে হইলে সদয়।
মহাজ্ঞান দিয়া মোরে করহ নির্ভয়॥”
শিব বলে “মহাজ্ঞান দিয়া গেলাম তোমারে।
এক বাক্য বলি বাপু রাখিবা ইহারে॥
মহাজ্ঞান দিল পুত্ত্র ব্যক্ত না করিবা।
অধিক যতনে মাত্র মায়েরে কহিবা॥”
এহি বর দিয়া গেল ভবানীশঙ্কর।
সন্তুষ্ট হৈয়া ঘরে গেল চন্দ্রধর॥
দেখিয়া বাপের বড় হৰ্ষ হইল মনে।
উদ্যোগ করিল তার বিবাহকারণে॥
দেশে দেশে ব্রাহ্মণ পাঠাইল অনুচর।
চান্দের বিবাহসজ্জা কৈল কোটীশ্বর॥
দ্বিজ বংশীদাসে গায় পদ্মার বচন।
ভবসিন্ধু তরিবারে বল নারায়ণ॥
দিশা:— ভাট পাঠাইলা দেশে দেশে।
তেই অনুরূপ বর কন্যা আছে কার ঘর
চন্দ্রধরের বিবাহ উদ্দেশে॥
মানিক্য-পাটুনি দেশে শুদ্ধ বণিকবংশে
সুর সাহার বেটা শঙ্খপতি।
কুলশীলে অতিশয় গন্ধবণিক হয়
তার ঘরে কন্যা গুণবতী॥
পদ্মিনী জাতিতে কন্যা রূপে গুণে শত ধন্যা
তার নাম সুলুকা[৬১] সুন্দরী।
পঞ্চ ভায়ের ভগিনী স্বাহা স্বধা স্বরূপিণী
রূপে গুণে জিনি বিদ্যাধরী॥
রাশি নক্ষত্র কাল আসিয়া মিলিল ভাল
চন্দ্রতারা যোড়া শুদ্ধ লাগে।
যম ছত্র সর্পাকার শুদ্ধি কৈল বিচার
এহি মতে ঘটে শুভ যোগে॥
ঘটক পাঠাইয়া তথা কহিল বিবাহকথা
সকল নিবন্ধ কর্ম্ম করি।
দ্বিজ বংশীদাসে ভণে লগ্ন কৈল শুভক্ষণে
জ্যোতিষশাস্ত্র বিচারি॥
বিবাহ করিয়া চন্দ ফিরি নিজ ঘরে।
ছয় পুত্র হইল তার দেবতার বরে॥
পূর্ব্বজন্ম কর্ম্মফল শুন দিয়া মন।
মনসার সঙ্গে হৈল বাদবিড়ম্বন॥
ছয় পুত্ত্রে দংশিলেক পদ্মার ছয় নাগে।
মহাজ্ঞান-বলে রাজা জিয়াইলা[৬২] আগে॥
নেতার সঙ্গেতে পদ্মা যুক্তি স্থির করি।
বনমধ্যে ভ্রমে পদ্মা হয়ে একেশ্বরী॥
দেখিতে সুন্দর বন শোভে ফলফুলে।
মৃগশিকারেতে চান্দ যায় হেন কালে॥
দেখিয়া পদ্মার রূপ মোহিত হইল।
পরিচয়-কথা তার জানিতে চাহিল॥
কামেতে আকুল হৈয়া বলে সদাগর।
“কার কন্যা তপ কর দেহত উত্তর॥”
পদ্মা বলে “এ সংসারে বাপ মাও নাই।
পাগল হইয়া আমি বনেতে বেড়াই॥”
ছয় পুত্ত্রে খাইছে মোর পদ্মার ছয় সাপে।
বাড়ীঘর ছাড়িয়াছি সেই অনুতাপে॥
পাগলিনী হইয়া আমি বেড়াই সংসারে।
জান যদি মহাজ্ঞান ভিক্ষ। দাও মোরে॥”
এহি কথা শুনিয়া চান্দের পূর্ব্বকথা মনে।
ছয় পুত্রের মৃত্যুকথা পড়িল স্মরণে॥
দূরিতে পরের দুঃখ স্থির করি মন।
মহাজ্ঞান দিল চান্দ কৃপাযুক্ত মন॥
দৈবের নিবন্ধ কভু না যায় খণ্ডন।
নিজমূর্ত্তি ধরিলেন পদ্মা ততক্ষণ॥
অন্তরীক্ষ হতে পদ্মা বলে ডাক দিয়া।
“এইবার বুঝা যাবে চান্দ বানিয়া॥”
রাবণ পণ্ডিতে কয় বিষাদ ভাবিয়া।
বাড়ীতে ফিরিলা চাঁদ সর্ব্বস্ব খুয়াইয়া[৬৩]॥
জালুর পুত্ত্র কানাইয়া জাল বহিতে যায়।
পদ্মার আদেশে কাল দংশে তার পায়॥
পার্ব্বতী কানাইয়ার মাও এই কথা শুনি।
আউলাইয়া মাথার কেশ ছুটে পাগলিনী॥
হেনকালে দেখে তথায় একটী যোগিনী।
সর্ব্ব অঙ্গে ভস্ম মাখা গল-দেশে ফণী॥
চূড়াকারে বান্ধা কেশ পিঙ্গল চরণ।
পার্ব্বতী কান্দিয়া ধরে তাহার চরণ॥
আউলা পার্ব্বতী বলিছে “মোর মাও।
বিনামূল্যে হব দাসী ছাওয়ালে জিয়াও॥”
পদ্মার কৃপায় কানাই পাইল পরাণ।
পূজাবিধি কৈয়া দেবী হৈলা অন্তর্ধান॥
আছিল জালিয়া সেও হইল লক্ষেশ্বর।
মাছ নাহি ধরে শুয়ে পালঙ্ক উপর॥
রত্নাবলী কন্যাকে যে বিবাহ করিয়া।
হাওয়া খায় কানাইয়া যে জলটঙ্গিতে[৬৪] বৈয়া[৬৫]॥
এহি কথা রটন্তি হৈল দেশে যথা তথা।
এই কথা শুনিলেন চান্দের বনিতা॥
পার্ব্বতীরে ডাকি কয় সুলকা সুন্দরী।
“এত ধন পাইলা তুমি কার পূজা করি॥”
হস্ত জোর করি তবে কহিলা পার্ব্বতী।
“রাজার মহিষী তুমি বড় ভাগ্যবতী॥
জগতে প্রচার হৈল মনসার পূজা।
ভিক্ষুকে পূজয়ে যদি হয় সেই রাজা॥
অপুত্ত্রে পূজিলে তার হয় পুত্ত্রধন।
কাঙ্গালে পূজিলে পায় রত্নাদি কাঞ্চন॥
অন্ধেতে পূজিলে দেখ চক্ষুদান পায়।”
পূজার পদ্ধতি কথা পার্ব্বতী জানায়॥
“পঞ্চবর্ণের গুঁড়ীতে অষ্ট নাগ আঁকিয়া।
স্থাপন করহ ঘট ভক্তিযুক্ত হৈয়া॥
জয়াদি জোকার দিয়া পূজয়ে মনসা
পূর্ণ সে হইবে তোমার মনের যত আশা॥
ভক্তিযুথ হৈয়া রাণী পূজা যে করিল।
দ্রব্যসামগ্রী যত ভারেতে আনিল॥
ঘটস্থাপন করি করিল পূজন।
হেথায় অজ্ঞান রাজা কৈল অলক্ষণ॥
হেমতালের বাড়ী দিয়া ঘট যে ভাঙ্গিল।
মনসার সঙ্গে বাদে সবংশে মজিল॥
ঘোষণা করিল রাজ সপ্তশত ঢোলে।
“যে করিবে পদ্মা পূজা তারে দিব শূলে॥”
প্রাণ লয়ে পদ্মাবতী উঠে দিল লড়।
সিজবৃক্ষের ডালেতে রহিলা করি ভর॥
পদ্মা বলে “শুন রাজা আমার উত্তর।
যেমত করিল কর্ম্ম চান্দ সদাগর॥
ত্রিভুবনে পূজা মোর না হইল প্রচার।
ভরক[৬৬] ভাঙ্গিল মোর দুষ্ট দুরাচার॥
এক্ষণে বধিব চান্দের পুত্ত্র যে সকল।
জিয়াইতে আর নাহি মহাজ্ঞান-বল॥”
পাণ্ডুনাগে পদ্মাবতী আনে ডাক দিয়া।
“চান্দের ছয় পুত্ত্র আজি আসহ দংশিয়া॥”
আজ্ঞামাত্র পাণ্ডুনাগ চলিল সত্বর।
নিশাকালে উপনীত চম্পক নগর॥
পালঙ্ক উপরে নিদ্রা যায় ছয়জন।
শিরে বসি ছয় পুত্ত্রে করিল দংশন[৬৭]॥
রাবণ পণ্ডিতে কয় ভাবিয়া বিষাদ।
মানুষ হইয়া দেবতার সঙ্গে বাদ॥
ছয় নাগে দংশিলেক ছয়টী কুমারে।
কাঞ্চা রাড়ী ছয় বধূ রহিলেক ঘরে॥
দলে দলে মরে লোক চম্পক শ্মশান।
কি দিয়ে বাঁচাইব রাজা নাহি মহাজ্ঞান॥
ধন্বন্তরী ওঝ নাই নাহি মন্ত্রবল।
দিনে দিনে রাজ্যধন যায় রসাতল॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা ডুবে যত বাণিজ্যের তরী।
আগুন লাগিয়া পুড়ে চম্পকের পুরী॥
ঔষধী বাগান ছিল চম্পক বেড়ীয়া।
সীমে[৬৮] না আসিতে পারে সাপ ধাঙ্গুড়িয়া[৬৯]॥
এহেন চান্দের বাগ যুক্তি সে করিয়া।
নেতা পদ্মা[৭০] পুড়ে তারে অগ্নি লাগাইয়া॥
ঔষধ না পায় রাজা নাহি বাচে মরা।
রাজ্য ছারি পলাইল যত লোক তারা॥
চান্দ বলে “নেড়া[৭১] মোরা দেবতার বরে।
এহি বার লঘু কানি[৭২] দেখাইব তোরে॥”
পরেত হইল কিবা শুন দিয়া মন।
চান্দের ঔরষে জন্মে সুন্দর নন্দন॥
লক্ষ্মী কোজাগর দিনে জন্মিল কোঙর।
সনকা রাখিল নাম পুত্ত্র লক্ষ্মীন্দর॥
কর্ম্মকোষ্ঠি হেতু রাজা গণকে ডাকিল।
খুঙ্গি পুঁথি হাতে লইয়া গণক আসিল॥
গণক লিখিল কুঠি অতি অলক্ষণ।
কালরাত্রে খাবে পুত্ত্রে কাল রাতি দিনে॥
এক দুই তিন করি বছর যে গেল।
যথাশাস্ত্র চূড়াকর্ম্ম রাজা যে করিল॥
ক্রমেতে বিবাহকাল হৈল উপস্থিত।
লক্ষ্মীন্দরে দেখি রাজা হৈল চিন্তিত॥
বিবাহের হেতু রাজ। দেশ দেশান্তরে।
ভাট পাঠাইয়া দিল কন্যা দেখিবারে॥
রাবণ পণ্ডিতে কর নিবন্ধ বিধির।
এহি মতে লক্ষ্মীন্দরের বিয়া হৈল স্থির॥
দিশা:— ভাট বলে শুন অধিকারী।
শিশুকাল হতে আমি যত যত দেশ ভ্রমি
কহি শুন মন স্থির করি॥
প্রথমে শ্রীহট্ট দেশে ভ্রমিয়াছি সবিশেষে
কামরূপ কামাক্ষা নীলগিরি।
ত্রিপুরা জৈতা জয়ালঙ্গ ভ্রমিয়াছি নানা রঙ্গ
গৌর মঙ্গল আদি করে॥
অযোধ্যা মথুরা কাশী আর যত ব্রজবাসী
গয়া প্রয়াগ বারাণসী গিয়া।
লাহোর দিল্লি খোরোসান[৭৩] আর যত হিন্দুস্থান
পশ্চিম দেশ আসিয়াছি ভ্রমিয়া॥
এহি মতে দেশ যত ভ্রমিয়াহি কত শত
তাহার কথা কহিতে অপার।
দ্বিজ বংশীদাস ভণে চান্দের কৌতুক মনে
শেষে কৈল কন্যার বিচার।
দিশা:— হরি বোলারে বল হরি বল—
ভাট বলে শুন সাধু বচন আমার।
শাস্ত্র বিহিতে কহে কন্যার বিচার॥
মাতৃপক্ষে পঞ্চ গোত্র ত্যজিবেক নারী।
পিতৃপক্ষে সপ্ত গোত্র শাস্ত্র অনুসারী॥
তবে বিহা করিবে শুন সদাগর।
নিকটে করিব বিয়া ত্রিগোত্র অন্তর॥
এহি মতে করিলেক কন্যার বিচার।
“যে যে কন্যা জানি আমি শুন কহি আর॥
মেহার পাটনে রাজা প্রচণ্ডের পুত্ত্র।
জখ সেন[৭৪] নাম তার ভরদ্বাজ গোত্র।
তাঁর কন্যা চন্দ্রকলা রূপ অতিশয়।”
চান্দ বলে “সগোত্রেতে উচিত না হয়॥”
“ভগীরখ সদাগর মথরা নগরে।
পদ্মাবতী নামে কন্যা আছে তার ঘরে॥”
চান্দ বলে “রাম রাম তার নাহি নাম।
শুনিতে উচিত নয় কানির স্বনাম[৭৫]॥”
“ভানুপোেড়া নগরে আছে আর এক কন্যা।
ভানুরাজার ঘরে রূপে গুণে ধন্যা॥
জাতিতে পদ্মিনী কন্যা কেশ অল্প গুছি[৭৬]।”
চান্দ বলে “না কহিও পূর্ব্বে শুনিয়াছি॥”
“প্রতাপ রুদ্রের কন্যা নামেতে সুনাই।
তার সম রূপে গুণে সংসারেতে নাই॥”
চান্দ বলে “সে সম্বন্ধ কদাচিত নয়।
লক্ষ্মীন্দরের মাতৃনাম মোর সেই হয়॥”
“সিন্ধু দ্বিপেতে বৈসে অনন্ত মাণিক।
আলেমান গোত্র হয় সে গন্ধবণিক॥”
চান্দ বলে “তার নয় স্বনামে গমন[৭৭]।
ঘাটিয়া সম্বন্ধ[৭৮] আমি করি কি কারণ॥”
“লক্ষ্মীন্দর সদাগর বৈসে লক্ষ্মীপুরা।
তার ঘরে আছে কন্যা নাম উদয়তারা॥
পদ্মিনী জাতিতে কন্যা পরমা সুন্দরী।”
চান্দ বলে “অনুচিত লখাইর ঝিয়ারী॥”
“উড়িষ্যা নগরে বৈসে শ্রীবাস ধর।
শচীপ্রভা নাম কন্যা আছে তার ঘর॥”
চান্দ বলে “এ সম্বন্ধ করিতে নাহি সাধ।
গৌরীর সহিতে বেটা করিছে বিবাদ॥[৭৯]
এহি মতে যত কন্যা দোষে গুণে আছে।
ভাবিয়া মাধব ভাট কহিলেক শেষে॥
দ্বিজ বংশীদাসে গায় পদ্মার চরণ।
ভবসিন্ধু তরিবারে বল নারায়ণ॥
পুনরপি সদুত্তর ভাটে বলে “সদাগর
শুন কথা অবধান করি।
ভ্রমিয়া দেখিনু দেশ উদ্দেশ করিল শেষ
কন্যা আছে বেহুলা সুন্দরী॥
উজনি নগর তথি গন্ধ বনিয়া জাতি
সাহ রাজা বড় ধনেশ্বর।
তার কন্যা বেহুলা রূপে গুণে চন্দ্রকলা
সেহি কন্যা যোগ্য লক্ষ্মীন্দর॥
সেই সে কন্যার গুণে হারাইলে ধন আনে
মইলে মরা জিয়াইতে পারে।
শুদ্ধমতি অতিশয় দেবতা সাক্ষাৎ হয়
স্মরণে জানায় দেবপুরে॥
লোহার তণ্ডুলে অন্ন যদ্যপি কর ভক্ষণ
সতী কন্যা রান্ধিবারে পারে।
এহি মত কন্যার কথা সর্ব্বগুণ সুচরিতা
জানি আমি কহিনু তোমারে॥”
হাসিয়া বলয়ে চান্দ “যদি থাকে নির্ব্বন্ধ
এই কন্যা করাইবা বিয়া।
কুলে শীলে যোগ্য ঘর যেন কন্যা তেন বর
কার্য্য আর নাহি বিচারিয়া॥
বিলম্বে নাহি কাজ হস্তী-ঘোড়। কর সাজ
যাইব আমি কন্যার যোরনী।
জ্ঞাতি-কুটুম্বগণ শীঘ্র কর নিমন্ত্রণ”
দ্বিজ বংশীর মধুরস বাণী॥
কর্ম্মকর্ত্তা ফরমাইস দিলা বিয়ার কথা থইয়া।
বেউলার পূর্ব্বজন্মকথা শুন মন দিয়া॥
ঊষা অনিরুদ্ধ নামে গন্ধর্ব্ব আছিল।
নৃত্যগীত করিবারে ইন্দ্রপুরে গেল॥
কাঁচা মৃত্তিকার সরা[৮০] তাতে ভর করি।
দেবেরে মোহিতে নাচে ঊমা যে সুন্দরী॥
চারি দিকে দেবগণ ইন্দ্র সভামাঝে।
হংসাসনে বিষহরি আইলা নিজ কাজে॥
পদ্মার কপটে উষার তাল যে ভাঙ্গিল
ক্রুদ্ধ হইয়। দেবরাজ শাপ তারে দিল॥
“মনুষ্য হইয়া জন্ম থাকিবে ধরায়।”
এহি কথা শুনি ঊষা করে হায় হায়॥
ঊষার কান্দনে তবে কান্দে দেবগণ।
কিঞ্চিত গলিল তায় বাসবের মন॥
ইন্দ্র বলে “রাজা আছে চম্পক নগরে।
অনিরুদ্ধ জন্ম গিয়া লউক তার ঘরে॥
ঊষা গিয়া জন্ম লউক সাহ রাজার ঘরে।
মরা পতি জিয়াইবে মনসার বরে॥”
গন্ধর্ব্ব আছিল শাপে মানুষ হইল।
কর্ম্মসিদ্ধিহেতু পদ্মায় ধরায় আনিল॥[৮১]
অনিরুদ্ধ জন্ম লইল চন্দ্রধরের ঘরে।
লক্ষ্মীন্দর নাম রাখে চান্দ সদাগরে॥
হইল ঊষার জন্ম সাহরাজার পুরী।
ঊষার রাখিল নাম বেহুলাসুন্দরী॥
কোটীশ্বর দাস[৮২] কহে পূর্ব্বজন্মকথা।
এহি খানে কহি শুন বিবাহের কথা॥
গণকের কথা রাজার মনে যে পরিল।
কেশাই কামারে রাজা ডাকিয়া আনিল॥
মনেতে ভাবিয়া তবে চান্দ সদাগর।
শীঘ্র করি বানাইল লোহার বাসর॥
লোহার কপাট আর লোহার দিছে ছানি।
লোহা দিয়া গড়িয়াছে বড় বড় ঠুনী॥
চারি দিকে গড় কাটি অগ্নি জ্বালাইয়া।
হাতী ঘোড়া রাখিয়াছে চৌদিকে বান্ধিয়া॥
নেউল ময়ূর আদি সৰ্পভুক্ যত।
চারিদিকে রাখিয়াছে কত শত শত॥
লাগাইয়া ওষুধীবৃক্ষ সর্পভয় নাশে।
চম্পকে[৮৩] না আসে সর্প তাহার বাতাসে॥
ছমাসের মরা জিয়ে ঔষধের গুণে।
হেন বৈদ্য ডাকি রাজা রাখিছে ভবনে॥
কোটীশ্বর দাস কহে হেন কর্ম্ম করে।
বিধির নিবন্ধ কেবা খণ্ডাইতে পারে॥
রহিল লোহার ঘরে বেউলা লক্ষ্মীন্দর।
নেতা পদ্মার কথা তবে শুন অতঃপর॥
উজানি নগরে পদ্মা নাগগণ সনে।
দেখিয়া লখাইর বিয়া স্থির করে মনে॥
আজি রাত্রি মধ্যে হবে পরাজয়।
রাত্রি পোহাইলে আর নাহি কোন ভয়॥
এতেক ভাবিয়া মনে করি অনুমান।
সত্বরে চলিয়া গেল সূর্য্য বিদ্যমান॥
স্তুতি করি বলে পদ্মা সূর্য্যের গোচর।[৮৪]
“চান্দের সহিতে বাদ পূর্ব্বাপর॥
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তিন রূপ তুমি।
বাপ খুড়ার আগে অরি কি কহিব আমি॥
দেব হইয়া মানুষের নিকটে পরাজয়।
তাই তব স্থানে আইনু শুন মহাশয়॥
রথ রাখ আজ তুমি মন্দগতি করি।
তাহলে চালের বাদ সাধিবারে পারি॥
চারিপ্রহর রাত্রি যদি অষ্টপ্রহর হয়।
তবে কার্য্যসিদ্ধি হয় শুন মহাশয়॥”
সূর্য্য বলে “মম রথ নিয়মিত চলে।
কমাতে বাড়াতে কেউ নাহি পারে বলে॥
তোমার গৌরবহেতু কহিনু নিশ্চয়।
সাধিয়া যে কার্য্য তব হইবে উদয়॥
শঙ্করদুহিতা তুমি জগৎ-জননী।
কার্য্যসিদ্ধি হবে যাহ স্বস্থানে আপনি॥”
এত শুনি হরষিত জয় বিষহরি।
বিদায় হইয়া তবে যান নিজপুরী॥
পদ্মা বলে “পাণ্ডু নাগ সত্বরে যাও ধাইয়া।
অখিলের নাগ যত আন ডাক দিয়া॥
সপ্ত দ্বীপে যত নাগ সাগর পর্ব্বতে।
আজ রাত্র ভিতরে সব আনহ ত্বরিতে॥”
এতেক শুনিয়া পাণ্ডু আকাশে উড়িল।
হেন কালে আগু হইয়া ঢুরা[৮৫] জানাইল॥
সর্ব্বনাগ পরাজয় এই কথা শুনি।
বিষাদ ভাবিয়া কহে নেতা ঠাকুরাণী॥
“আমার কথা শুন তুমি জয় বিষহরি।
একান্তে চলিয়া যাও কৈলাসের পুরী॥
পিতার জটায় বাস করে কালনাগ।
পিতার কাছেতে তুমি তারে ভিক্ষা মাগ॥
যে সে সাপের কাজ নয় লখারে দংশিতে।
রাত্রিমধ্যে কালনাগে আনহ ত্বরিতে॥”
এত শুনি পদ্মাবতী কোন কার্য্য করে।
রাতারাতি করি যায় বাপের গোচরে॥
- যখন গাহিল পিতা বেউলা হইল রাড়ী।
- কেনারামের চক্ষে জল বহে দড়দড়ি॥
শাখে কালে পাখীরা পশুরা কান্দে বনে।
বেহুলা হইল রাড়ী কালরাত্তির দিনে[৮৬]॥
কান্দয়ে সনকা রাণী বুক চাপড়িয়া।
“লখিন্দর পুত্ত্র কোথা গেলরে ছাড়িয়া॥”
ছয় ভাইয়ের বৌয়ে কাদে শিরে দিয়া হাত।
মঠের মাথায় ফুর[৮৭] পরল অকস্মাৎ॥
পাগল হইয়া শুনাই[৮৮] ফিরে পথে পথে।
“লখিন্দর পুত্ত্র মোর গেল কোন পথে॥”
যারে দেখে তারে রাণী পুত্ত্র পুত্ত্র বলে।
পথ নাহি দেখে রাণী চক্ষের যে জলে॥
এহিত কান্দন দেখি চান্দ সদাগর।
ধীরে ধীরে কয় মুখে “বম হর হর॥
কার পুত্র কার কন্যা মিছারে সংসার।
ভাই বন্ধু মিছ। সব সকলি মায়ার॥
পুত্ত্র মারা গেলে দেখ কেউ না যায় সাথে।
মরিবার কালে দেখ কেউ না যায় সঙ্গেতে॥
বাপ বল মা বল গর্ভ-সোদর ভাই।
কামাই করলে খাউয়া আছে সঙ্গে যাউয়া নাই॥”[৮৯]
কোটীশ্বর দাস কহে “সংসার অসার।
সংসার ছাড়িলে হবে ভবনদী পার॥
জ্ঞাতি কুটুম্বে চান্দ ডাক দিয়া কয়।
“মরা ধরে রাখা আর উচিত না হয়॥
বিলম্ব করিতে দেখ শাস্ত্র মানান করে।
লখাইরে পুড়াও নিয়া গুঞ্জরীর[৯০] তীরে॥”
এই কথা শুনি তবে বেহুলাসুন্দরী।
শ্বশুরের পায়ে কহে বিলাপ নাছাড়ী[৯১]॥
বেহুলা আসিয়া কহে শ্বশুরের ঠাই।
“ভেলা বান্দিয়া দেহ দেবপুরে যাই॥”
কলাগাছ কাটিতে রাণী বাগানে পাঠায়।
চান্দ বলে “যে পাঠায় ঝাটা তার মাথায়॥
কানির উচ্ছিষ্ট পুত্ত্র জলেতে ভাসাও।
পুত্র মারা গেল সঙ্গে কলাগাছ দাও॥
এক কলাগাছ মোর নয় নয় বুড়ি।
কি কারণে দিব আমি হেন কলা ছাড়ি॥
লখীন্দর পুত্ত্র মইল সেও প্রাণে সয়।
কলাগাছ কাটা গেলে জীবন সংশয়॥”
তাহা শুনি পাত্র মিত্র বলয়ে চান্দেরে।
“পূর্ব্বের যতেক কথা পাশরিলে তারে॥
মৈলে মরা জিয়ায় হারাইলে ধন আনে।
সতীকন্যা বিবাহ করাইল তে কারণে॥
ইহাতে বিলম্ব নয় যাক স্বামী লইয়া।
ভেলা বান্ধি শীঘ্র তারে দেও ভাসাইয়া॥”
বেউলা বলে “শুন বাপ বণিক-নন্দন।
স্বামী লইয়া যাই আমি দেবের ভবন॥
দেবের সভাতে যাই পদ্মারে জিনিয়া।
সাতটী কুমার তব দিব জিয়াইয়া॥
তোমারে জিনিতে পদ্মার হইয়াছে সাধ।
পদ্মারে জিনিয়া আমি ঘুচাইব বিবাদ॥”
পদ্মারে জিনিবে গুনি হাস্য হইল তার।
আজ্ঞা দিল কলা কাটি ভেলা বান্ধিবার॥
কহ কলাগাছ তব আনি সব কেটে।
দাসগণ লয়ে যাব গুঞ্জরীর ঘাটে॥
দুই কুড়ি কলাগাছ ডাঙ্গর[৯২] ভেলা বান্ধে।
মধ্যে মধ্যে খিল দিল সুন্দি বেতে[৯৩]র ছান্দে॥
চারি ধারে খুটী তার গড়িল গজারি[৯৪]।
উপরে বান্ধিল ঘর চৌচালা করি॥
চারি ধারে বেড়া বান্ধি রাখিল দুয়ার।
বিছানা করিল তাতে নেতের কান্থার[৯৫]।
মরার লক্ষণ দিল উপরে গৃধিনী।
চারিদিকে বসাইল চারটী শকুনী॥
রাঙ্গা কুকুড়া দিল শ্বেত বিড়াল আর।
ইহাদের জন্য দিল ছয়মাসের আহার॥
এহি মত ভেলা খান দেখিতে সুন্দর।
বসন্ত কালেতে যেন কামটুঙ্গী[৯৬] ঘর॥
ভেলা বান্ধি দাসগণে সত্বরে দিল জান।
ঘাটেতে আনিয়া মরা করাইল স্নান॥
সুগন্ধি চন্দন দিল সর্বাঙ্গে লেপিয়া।
বিচিত্র বিছানা দিল ভেলাতে তুলিয়া॥
কাছার ভিতরে মরা বস্ত্রে ঢাকি এরি[৯৭]।
বিদায় মাগে বেহুলা শ্বশুরের পায়ে পড়ি॥
“দেবপুরে যাই মাগো বিদায় দেহ মোরে।
আশীর্ব্বাদ কইর যেন পুন আসি ঘরে॥”
তা শুনি শুলুকা ধরিতে নারে হিয়া।
গলায় ধরিয়া কান্দে ফুকার ছাড়িয়া॥
দ্বিজ বংশীদাসে গায় পদ্মার চরণ।
ভবসিন্ধু তরিবারে বল নারায়ণ॥
“বড় দয়া লাগে বধু না ধরয়ে হিয়া।
স্বরূপে কি যাবে তুমি লখাইরে লইয়া॥
এক রাত্রি সম্বন্ধেতে এত প্রেমবন্ধ।
যে নয় তোমার চিত্ত কি কব ভালমন্দ॥
স্বামী-সঙ্গে না বঞ্চিলে নাহি লাগে দয়া।
কি মতে ছাড়িয়া দিব সাগরে ভাসিয়া॥
জোরের কপোত মম হৃদয়ের নলি।[৯৮]
একবারে উড়িয়া গেল খুপ[৯৯] করি খালি॥
রাজার কুমারী তুমি হও সুবদনী।
কি মতে সখি দুঃখ ত্যজি অন্নপানি॥
পিঞ্জরের শুক মোর আধার মাণিক।
এহি খানে বহ বধু দেখিব খানিক॥
শরীরে না সহে দুঃখ হেন লয় চিতে।
পক্ষী হয়ে উড়ে যাই তোমার সঙ্গেতে॥”
শুলুকা ক্রন্দন শুনি পাষাণ মিলায়।
ধারাস্রোতে বহে জল দ্বিজ বংশী গায়॥
উজান বইয়া যায় গুঞ্জরীর পানি।
ভেলার উপর কান্দে কন্যা জনমদুখিনী॥
সাত নয় পাঁচ নয় এক রাত্রির কালে।
প্রাণের অধিক পতি খাইয়াছে কালে॥
মরা পতি লইয়া কন্যা দেবপুরে যায়।
দেখিয়া চম্পকের লোক করে হায় হায়॥
মন্ত্রৌষধি
“যখন গাইলা পিতা বেহুলা ভাসান।
ফেলিয়া হাতের খাণ্ডা কান্দে কেনারাম॥”
“আজি হতে গেল এই চম্পকের বাহার।
বাগান করিয়া খালি গেল পম্পসার॥
সোনার মন্দির দেখ আন্ধাইর করিয়া।
সন্ধ্যাকালের বাতি যেন গেলরে নিবিয়া॥”
মরা পতি লইয়া কন্যা যায় দেবপুরে।
তাহা দেখি রাজ্যের লোক হাহাকার করে॥
গজ কান্দে অশ্ব কান্দে কান্দে পশুপাখী।
ছয় ভাইয়ের বউয়ে কান্দে “কেমনে ঘরে থাকি॥”[১০০]
(৬)
কেনারামের জীবনে পরিবর্ত্তন
যখন গাইলা পিতা বেহুলা ভাসান।
ফেলিয়া হাতের খাণ্ডা কান্দে কেনারাম॥
“গুরুগো কি গান শুনাইলা গুরু ফিরে কও শুনি।
শুনিয়া পাগল হইল পাষণ্ডের প্রাণী॥
কিবা ধন দিব গুরু কোন ধন আছে।
তোমারে যে দিব ধন আইস মোর কাছে॥
বড়া ভরা ধন আমি রাখিয়াছি লুকাইয়া।
সাত পুরুষ খাইবা তুমি গৃহেতে বসিয়া॥
মনুষ্য মারিয়া আমি কামাইয়াছি ধন।
জীবন ভরিয়া যত করছি উপার্জন॥
সেই সব ধন আমি দিব যে তোমায়।
অন্তকালে স্থান গুরু দিও রাঙ্গা পায়॥
ভিক্ষা না করিও আর বাড়ী বাড়ী ঘুরি।
জীবনের কামাই যত দিবাম ঘড়া ভরি॥”
ঠাকুর কহিছে “আমার ধনে কার্য্য নাই।
যে ধন পাইয়াছি আমি তোমাকে জানাই॥
সে ধনের কাছে দেখ এই সব ধন।
মানিকের কাছে দেখ ছিসেরছ[১০১] মতন॥
এধন লইয়া মোর কোন কার্য্য নাই।
তোমার কাছে থাকুক ধন আমার কার্য্য নাই॥
ভিক্ষা করিয়া আমি পাই চাউল কড়ি।
ভরিয়া পাপের বোঝা ডুবাই কেন তরী॥
মানুষ মারিয়া তুমি করিয়াছ পাপ।
জীবনান্তে পাবে কেনা তার অনুতাপ॥
চউরাশি নরককুণ্ডে রহিবে ডুবিয়া।
যখন হানিবে যম শিরে দণ্ড দিয়া॥”
আকাশ পাতালে কেনা চাহে বারে বার।
চেয়ে দেখে দশ দিক ঘোর অন্ধকার॥
চারিদিক চাইয়া দেখে না দেখে কাহারে।
“থাক কেহ দেখা দেহ এই অন্ধকারে॥
জন্মিয়া না দেখছি মায় না দেখছি বাপে।
সংসার ছাড়িয়াছি আমি কত অনুতাপে॥
কেউ না আছিলা মোর ডাইকা জিজ্ঞাস করে।
কেউ না আছিল হেন শিক্ষা দেয় মোরে॥
আগেতে মরিলা মাও বাপ গেলা ছাড়ি।
বিপাকে পড়িয়া আমি গেলাম মামার বাড়ী॥
দুরন্ত আকালে মামা কোন কার্য্য করে।
জানিয়া পরের পুত্ত্র বেচিল আমারে॥
পাচ কাঠা শালি ধান কিম্মতক[১০২] আমার।
কুসঙ্গে মজিয়া হইছি হেন দুরাচার॥
শৈশবে না পাইলাম শিক্ষা না চিনিলাম পথ।
এতদিনে পাইয়া তোমায় সিদ্ধ মনোরথ॥
এসব পাপের ভরা ধরা না সহিবে।
মরিলে এ সব যদি সঙ্গে নাহি যাবে॥
পাপেতে ডুবিল দেহ আর রক্ষা নাই।
আমারে ছাড়িয়া গেলে ধর্মের দোহাই॥”
“জন্মের কামাই আমি ভাসাইব নদীর জলে।
ডুবিয়া মরিব আমি ঐ না নদীর জলে॥”
ছাপাইয়া বহে নদী হলচ্ তলচ্ পানি[১০৩]।
ভয়ে নাহি বহিয়া যায় সাউদের তরণী॥
শিষ্যগণে[১০৪] ডাক দিয়া কহে কেনারাম।
“যথায় আছে ধনের ধড়া শীঘ্র করি আন॥”
আউরাইয়া[১০৫] নলের বন দস্যুগণ যায়।
বইয়া আনে যত ধন যে যেখানে পায়॥
কেনারাম বলে “ঠাকুর, দাড়াও নদীর পারে।
পাপের অর্জিত ধন ভাসাইব সায়রে॥”
এক ঘড়া দুই ঘড়া তিন ঘড়া ধন।
একে একে দেয় সব জলে বিসর্জন॥
পাপের অর্জিত ধন জলে যায় ভাসে।
তা দেখিয়া কেনারাম খলখলি হাসে॥
খাঁণ্ডা তুলিয়া কেনা ধরে নিজ মাথে।
বিদায় চাহিল কেনা গুরুর সাক্ষাতে॥
রক্তজবা আখি কেনা পাগলের প্রায়।
আপন দেহের মাংস আপনি কামড়ায়॥
“কত পাপ করিয়াছি লেখাজুখা নাই।
আমার মতন পাপী ত্রিভুবনে নাই॥
কত লোক মারিয়াছি এই খাণ্ডা দিয়া।
আপনি মরিব আজি দেখ দাড়াইয়া॥”
ঠাকুর বলেন “কেনা আর কার্য্য নাই।
স্নান কইরা আস তুমি মুক্তিমন্ত্র দেই॥
মিছা মায়া এ সংসার কেউ কার নয়।
পথিকে পথিকে যেমন পথে পরিচয়॥
টাকাকড়ি ধনজন সঙ্গে নাহি যাবে।
একাকী এসেছ তুমি একা যেতে হবে॥
মরিয়াত কার্য্য নাই শুন কেনারাম।
দীক্ষামন্ত্র আজি তোরে করিবরে দান॥
আজি হইতে তুমি মোর শিষ্য যে হইলে।
তোমারে লইয়া আমি বাড়ী যাব চলে॥
এই গান শিক্ষা কর মনসা ভাসান।
মায়ের নামেতে তুমি পাবে পরিত্রাণ॥”
এক দুই দিন যায় গুরু সঙ্গে থাকি।
কেনারাম শিখে গীত পিঞ্জিরার পাখী॥
আকাশ ছাপাইয়া গান যায় স্বগ পুরে।
মৃদঙ্গ বাজাইয়া কেনা বাড়ী বাড়ী ঘুরে॥
কক্ষেতে ভিক্ষার ঝুলি “মুক্তিভিক্ষা চাই।
এই মুষ্টি চাউল পাইলে খুসী হইয়া যাই॥”
গাইতে গাইতে কেনার চক্ষে আসে জল।
নাইচা গাইয়া ফিরে যেমন ভাবের পাগল॥
যারে দেখ্যা দেশের লোক আগে পাইত ভয়।
তাহারে ডাকিয়া লোকে গীত গাইতে কয়॥
যাহারে দেখিলে লোকের উড়িত পরাণ।
শুনিলে তাহার গান গলয়ে পাষাণ॥
শিউরি উঠিত লোক যে কেনার নামে।
পাগল হইয়া যায় সেই কেনার গানে॥
পাষাণ মানুষ হইল মহাজনের বরে।
কেনারাম গায় গীত প্রতি ঘরে ঘরে॥
কেনারাম গায় গীত ঝরে বৃক্ষের পাতা।
পয়ার প্রবন্ধে ভনে দ্বিজ বংশী-সুতা॥১—৮৯
- ↑ জালিয়া বন্দের=জালিয়ার হাওর।
- ↑ বাকুলিয়া=গ্রাম, জালিয়ার হাওরের নিকটবর্তী, ম্যাপ দ্রষ্টব্য।
- ↑ আটখুর=নিঃসন্তান।
- ↑ আন্ধাইরে=অন্ধকারে।
- ↑ রাত্তি——কালে=গভীর রাত্রিতে।
- ↑ উজালা=উজ্জ্বলা।
- ↑ আচম্বিত=আশ্চর্য্য।
- ↑ যুথ=যুক্ত।
- ↑ পূরিত=পূর্ণ।
- ↑ চুকা=অম্ল দ্রব্য।
- ↑ ছিকর=শিকর
- ↑ ছাওয়াল=ছেলে।
- ↑ কেনারামের রং কালো ছিল, এখানে অর্থ নয় যে চাঁদের মত লাবণ্য তার বাড়িয়া চলিল। এই ছত্রের অর্থ এই যে, চাঁদের লাবণ্য যেরূপ প্রতি কলার বাড়িয়া পূর্ণ হয়, সেইরূপ সেও বাড়িতে লাগিল।
- ↑ কেনারাম=দেবীর পূজার দ্বারা তাহাকে ক্রয় করা হইয়াছে (পাওয়া গিয়াছে) এজন্য তাহার নাম “কেনারাম” হইল।
- ↑ কারি=কাড়ি, কাড়িয়া।
- ↑ হালিধান=শালিধান্য, অথবা হালের দ্বারা যে ধান্য উৎপন্ন করা হইয়াছে।
- ↑ গারুয়া-পাহাড়=গাড়ো পাহাড়।
- ↑ হালুয়ার=হেলে দাসের, হেলে কৈবর্ত্তের।
- ↑ খাণ্ডার=খাঁড়া
- ↑ বাতান=গোচারণের জায়গা।
- ↑ তরাসে=ভয়ে, ত্রাসে।
- ↑ গাঙ্গে=নদীতে, শুধু গঙ্গা নহে, সমস্ত নদীকেই পূর্ব্ববঙ্গে ‘গাঙ্গ’ কহে।
- ↑ ইতে=ইহাতে।
- ↑ তেউর=চড়ুই।
- ↑ কুবেতে=কোপে।
- ↑ মোগ্ধ=মুগ্ধ।
- ↑ লৌহের বাড়াই=লোহার বাড়া—লোহার চেয়ে শক্ত।
- ↑ বুঝাই=বোঝাই।
- ↑ মাইঝ=মাঝ।
- ↑ খারাইবে=দাঁড়াইবে।
- ↑ ভারাইয়া=ছলনা করিয়া।
- ↑ মনে—দর=দড়, দৃঢ়, মনস্থ করিলাম।
- ↑ অবাক্যি=অবাক্।
- ↑ অঞ্জনা=দ্বীজবংশীর মাতার নাম।
- ↑ গাহান=গান।
- ↑ গুজরিল=উত্তীর্ণ হইল।
- ↑ পশরে=প্রভাব।
- ↑ খরশান=তীক্ষ্ন।
- ↑ থৈয়া=রাখিয়া।
- ↑ সরুয়া=পাটনী বালিকা।
- ↑ ফাঁদে=ফন্দিতে (পড়িলেন)।
- ↑ ঝাঠে=শীঘ্র।
- ↑ লাচারী=ত্রিপদী।
- ↑ অধিকারী=শিব (আচার্য্য)।
- ↑ কেরুয়াল=“কাণ্ডার” শব্দের অপভ্রংশ।
- ↑ শিচিয়া=সিঞ্চন করিয়া।
- ↑ খুরী=এক প্রকারের ওজন বিশেষ।
- ↑ ভাঙ্গর মুনছা=ভাঙ্গ খোর মিন্সে (মনুষ্য)।
- ↑ গাওয়ালে=গ্রামে কাজ করিতে।
- ↑ কাঁড়াল=কাণ্ডার, হাল।
- ↑ সরুয়া=পাটনি।
- ↑ বানরের....নারিকেল=এই উপমাটি চণ্ডীদাসের পদে কয়েক স্থানে পাওয়া গিরাছে।
- ↑ সামায়=সান্ধায়, প্রবেশ করে।
- ↑ গাড়ি=পুতিয়া।
- ↑ ইহার পূর্ব্বে কতক ছত্র বাদ পড়িয়াছে, তাহাতে মনসাদেবীর জন্মের কথা ছিল।
- ↑ দানবীয়া=দানব।
- ↑ ভণে=বলেন।
- ↑ উচ্ছিলা=ছুঁতো।
- ↑ এই রাবণ পণ্ডিত কে?
- ↑ সুমার=সাঙ্গ, নির্ব্বাহ।
- ↑ সুলুকা=চাঁদের রাণীর নাম সাধারণতঃ ‘সনকা’ বলিয়া জানি, কোন কোন পুথিতে শুলুকা এবং কোন কোন পুথিতে আবার শুক্লা নামও পাওয়া যায়।
- ↑ জিয়াইলা=পুনর্জীবিত করিলা।
- ↑ বিজয় গুপ্তের এবং অপর কয়েক জন লেখকের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, পদ্মাবতীর রূপে ভুলিয়া হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হইয়া চাঁদ তাঁহার মহাজ্ঞান দিয়াছিলেন। কিন্তু এখানে দেখা যায় বণিক্পতি শুধু দয়াবশতঃ পদ্মাবতীকে স্বীয় মহাজ্ঞান দান করিয়াছিলেন।
- ↑ জলটঙ্গী=জলটুঙ্গী, জলের মধ্যে উচ্চবর।
- ↑ বৈয়া=বসিয়া।
- ↑ ভরক=ঘট।
- ↑ অন্যান্য ভাসানে উপাধ্যান-ভাগ অন্যরূপ।
- ↑ সীমে=সীমানার কাছে।
- ↑ ধাঙ্গুড়িয়া সাপ=বৃহৎ সৰ্প।
- ↑ নেতা পদ্মা—পদ্মা=মনসাদেবী এবং নেতা তাঁহার সখী।
- ↑ নেড়া=চাঁদের ভৃত্যের নাম।
- ↑ লঘু কানি=চাঁদ ঘৃণার সহিত মনসাদেবীকে ঐ নামে ডাকিতেন। লবু=ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, নীচ। কানি=একচক্ষুহীন মনসাদেবী।
- ↑ খোরাসান যে এক সময় ভারতবর্মের অন্তর্গত ছিল, এ সংস্কার বংশীদাসের সময়েও প্রচলিত ছিল।
- ↑ জখ সেন=যক্ষ সেন।
- ↑ কানির স্বনাম=মনসা দেবীর (পদ্মাবতীর) নামের সংস্রবহেতু পরিত্যাজ্য।
- ↑ গুছি=গুচ্ছ, কেশগুছি=চুলের গোছা।
- ↑ নয় স্বনামে গমন=সে স্বনামধন্য ব্যক্তি নয়, অপরের নামে পরিচিত।
- ↑ ঘাটিয়া সম্বন্ধ=হীন সম্বন্ধ।
- ↑ গৌরীর—বিবাদ=দুর্গার বিদ্বেষী। চাঁদ হরগৌরীর সেবক ছিলেন।
- ↑ কাঁচা মাটীর সরার উপর নৃত্য করিয়া কলাকৌশল দেখাইবার প্রথা ছিল। এরূপ ক্ষিপ্রচরণে, প্রায় বায়ুতে ভর করিয়া নৃত্য করা হইত যে, কাঁচা মাটীর সরার উপর পা পড়িত কি না পড়িত। এই কলা এখন বিলুপ্ত।
- ↑ কর্ম্ম—আনিল=মনসাদেবী তাঁহার নিজ অভিপ্রায়সিদ্ধির জন্য ইহাদিগকে এই ছলায় ধরাধামে আনিলেন।
- ↑ কোটীশ্বর দাস= এই কবির আর কোন পরিচয় পাওয়া যায় ন।
- ↑ চম্পকে=চম্পক নগরে।
- ↑ বঙ্গদেশে বহু সূর্য্যমূর্ত্তি পাওয়া যাইতেছে, এককালে এদেশে সূর্য্যই প্রধান দেবতাস্বরূপ গণ্য ছিলেন।
- ↑ ঢুরা=ঢেমনা সাপ, ঢোঁড়া সাপ।
- ↑ কালরাত্তির দিনে=বিবাহের পরের রাত্রিকে ‘কালরাত্রি’ বলিয়া থাকে। ‘দিনে’=সময়ে।
- ↑ ফুর=সম্ভবতঃ স্ফুরণ শব্দ হইতে আসিয়াছে, বিদ্যুৎ-স্ফুরণ।
- ↑ শুনাই=সনকা
- ↑ কামাই—নাই=উপার্জন করিলে খাইবার লোক আছে, সঙ্গে যাইবার কেউ নাই।
- ↑ গুঞ্জরী=অপরাপর অনেক কাব্যে “গাঙ্গুর” নদীর উল্লেখ আছে।
- ↑ নাছাড়ী=লাচাড়ি।
- ↑ ডাঙ্গর=বড়।
- ↑ সুন্দি বেত=একরূপ বেত। খুব শক্ত ও সরু বেত্রবিশেষ।
- ↑ গজারি=বৃক্ষবিশেষ।
- ↑ নেতের কান্থার=কাপড় দিয়া কাঁথা (কম্বা) তৈরী করিয়া।
- ↑ কামটুঙ্গী=পূর্ব্বে লোকে জলাশয়ের মধ্যে বিলাস-গৃহ নির্ম্মাণ করিত, তাহাকে ‘টুঙ্গী’ বা ‘কামটুঙ্গী’
বলা হইত। - ↑ এরি=রাখিয়া।
- ↑ জোরের..নলি=তুমি আমার জোড়া পায়রার একটি এবং বক্ষের হাড়।
- ↑ খুপ=খোঁপ।
- ↑ এই (পঞ্চম) অধ্যায়টি নারায়ণদেব, বংশীদাস, কোটীশ্বর দাস, রাবণ পণ্ডিত প্রভৃতি কবির রচিত মনসা-মঙ্গল হইতে সংগৃহীত। ইহা পালা-গায়কেরা কেনারামের প্রসঙ্গে গাহিয়া থাকে। কেনারামের আখ্যায়িকার এরূপ দীর্ঘ মনসা-মঙ্গল কতকটা অপ্রাসঙ্গিক, এই জন্য ইহার অতি সংক্ষিপ্ত সারাংশ ইংরাজীতে দিয়াছি। তবে এই অধ্যায়ের কয়েকটি ছত্র চন্দ্রাবতীর রচিত, সেই ছত্রগুলির প্রথম অক্ষরের সম্মুখ ভাগে নক্ষত্র-চিহ্ন দিয়াছি। বলা বাহুল্য, পূর্ব্ববর্ত্তী ও পরবর্ত্তী অধ্যায় সমস্তই চন্দ্রাবতীর রচনা।
- ↑ িসের=সীসার
- ↑ িম্মত=মূল্য
- ↑ হলচ্ তলচ্ পানি=উচ্ছ্বসিত জলরাশি।
- ↑ শিষ্য=অনুচর।
- ↑ আউরাইরা=আন্দোলন করিয়া।