মলুয়া

মলুয়া

বন্দনা

আদিতে বন্দিয়া গাই অনাদি ঈশ্বর।
দেবের মধ্যে বন্দি গাই ভোলা মহেশ্বর॥
দেবীর মধ্যে বন্দি গাই শ্রীদুর্গা ভবানী।
লক্ষ্মী-সরস্বতী বন্দুম যুগল নন্দিনী॥
ধন-সম্পদ মিলে লক্ষ্মীরে পূজিলে।
সরস্বতী বন্দি গাই বিদ্যা যাতে মিলে॥
কার্ত্তিক-গণেশ বন্দুম যত দেবগণ।
আকাশ বন্দিয়া গাই গরুড়-পবন॥
চন্দ্র-সূর্য্য বন্দিয়। গাই জগতের আখি।
সপ্ত পাতাল বন্দুম নাগান্ত[] বাসুকী॥
মনসা দেবীরে বন্দুম আস্তিকের মাতা।
যাহার বিষের তেজ ডরায় বিধাতা॥
ভক্তমধ্যে বন্দিয়া গাই রাজা চন্দ্রধর।
তার সঙ্গে ৰন্দিয়া গাই বেউলা-লক্ষ্মীন্দর॥
নদীর মধ্যে বন্দিয়া গাই গঙ্গা ভাগীরথী।
নারীর মধ্যে বন্দিয়া গাই সীতা বড় সতী॥
বৃক্ষের মধ্যে বন্দিয়া গাই আদ্যের তুলসী[]
তীর্থের মধ্যে বন্দিয়া গাই গয়া আর কাশী॥

সংসারের সার বন্দুম বাপ আর মায়ে।
অভাগীর জনম হৈল যার পদছায়ে॥
মুনির মধ্যে বন্দিয়া গাই বাল্মীকি তপোধন।
তরুলতা বন্দিয়া গাই স্থাবর-জঙ্গম॥
জল বন্দুম স্থল বন্দুম আকাশ-পাতাল।
হর-শিরে বন্দিয়া গাই কাল-মহাকাল॥
তার পর বন্দিলাম শ্রীগুরুচরণ।
সবার চরণ বন্দিয়া জানাই নিবেদন॥
চার কুনা[] পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি।
সলাভ্য?[] বন্দনা গীত গায় চন্দ্রাবতী॥১–২৮


( ১ )

জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ

মন্দান্যা[] আইশ্‌নারে[] পানি ভাটি বাইয়া যায়।[]
চান্দ বিনোদে ডাক্যা কইছে তার মায়॥
“উঠ উঠ বিনোদ আরে ডাকে তোমার মাও[]
চান্দ মুখ পাখলিয়া মাঠের পানে যাও॥
মাঠের পানে যাওরে যাদু ভালা[] বান্দ আইল।
আগণ[১০] মাসেতে হইব ক্ষেতে কাত্তিকা সাইল[১১]

মেঘ ডাকে গুরু গুরু ডাক্যা তুলে পানি।[১২]
সকাল কইরা ক্ষেতে যাও আমার যাদুমণি॥
আশমান ছাইল কালা মেঘে দেওয়ায়[১৩] ডাকে রইয়া।
আর কতকাল থাকবে যাদু ঘরের মাঝে শুইয়া॥”
আইল আইশ্‌নারে পানি উভে[১৪] কর্‌ল তল।
ক্ষেত কিশ্যি[১৫] ডুবাইয়া দিল না রইল সম্বল॥
দেশে আইল দুর্গাপুজা জগত-জননী।
কুলের[১৬] ছাল্যা[১৭] বান্ধ্যা দিয়া পূজে দুর্গারাণী॥
এই মতে আশ্বিন গেল, আইল কার্ত্তিক মাস।
ষরু[১৮] শষ্য ক্ষেতে নাই হইল সর্ব্বনাশ॥
লাগিয়া কার্ত্তিকের উষ[১৯] গায়ে হইল জ্বর।
বিনোদের মায়ে কান্দে, হইয়া কাতর॥
জোড়া মইষ[২০] দিয়া মায় মানসিক করে।
মায়ত[২১] কান্দিয়া কয় পুত্র বুঝি মরে॥
দেবের দোয়াতে[২২] পুত্র পরাণে বাচিল।
এমতে কার্ত্তিক গিয়া আগুণ[২৩] পড়িল॥
উত্তরিয়া[২৪] শীতে পরাণ কাঁপে থরথরি।
ছিড়া[২৫] বসন দিয়া মায় অঙ্গ রাখে মুরি[২৬]
ভালা হইল চান্দ বিনোদ দেবতার বরে।
ঘরে নাই সে লক্ষ্মীর দানা[২৭] লক্ষ্মীপূজার তরে॥

ধারের কাচি[২৮] আন্যা মায়ে তুল্যা দিল হাতে।
“ক্ষেতে যাওরে পুত্রু আমার ধান্য যে কাটিতে॥”

পাঞ্চ গাছি বাতার[২৯] ডুগল[৩০] হাতেতে লইয়া।
মাঠের মাঝে যায় বিনোদ বারমাসী গাইয়া॥
আশ্বিন্যা পানিতে দেখে মাঠে নাইক ধান।
এরে[৩১] দেখ্যা চান্দ বিনোদের কান্দিল পরাণ॥

চান্দ বিনোদ আসি কয় মায়ের কাছে।
“আইশ্‌না পানিতে মাও সব শস্যি গেছে॥”
মায়ে কান্দে পুত্র কান্দে সিরে দিয়ে হাত।
সারা বছরের লাগ্যা গেছে ঘরের ভাত॥
টাকায় দেড় আড়া[৩২] ধান পইড়াছে আকাল[৩৩]
কি দিয়া পালিব মায় কুলের ছাওয়াল॥
পোষ মাসে পোষা আন্ধি[৩৪] বিনোদে ডাকিয়া।
মায় পুতে যুক্তি করে ধরেতে বসিয়া॥

আছিল হালের গরু বেচিয়া খাইল।
পাঁচ গোটা ক্ষেত বিনোদ মাজনে[৩৫] দিল॥

খেত খোলা[৩৬] নাই তার, নাই হালের গরু।
না বুনায় ধান কালাই না বুনায় সরু॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া বিনোদ কোন কাম করে।
মাঘ-ফাল্গুন দুই মাস কাটাইল ঘরে॥

চৈত-বৈশাখ মাস গেল এই মতে।
জ্যৈষ্ঠ মাসেতে বিনোদ পিঁজরা[৩৭] লইল হাতে॥
মায়েরে ডাকিয়া কয় মধুরস বাণী।
“কুড়া শীগারে[৩৮] যাইতে বিদায় দেও মা জননী॥”
ঘুম থাকা উঠ্যা বিনোদ মায়েরে কহিল।
কুড়া শীগারে যাইতে বিদায় মাগিল॥
টিক্কা না জ্বালাইয়া বিনোদ হুক্কায় ভরে পানি।
ঘরে নাই বাসি ভাত কালা মুখখানি॥
ঘরে নাই খুদের অন্ন কি রান্ধিব মায়।
উপাস থাকিয়া পুত্র শীগারেতে যায়॥
মায়ের আক্ষির জলে বুক যায়রে ভাসি।
ঘরতনে[৩৯] বাইর অইল বিনোদ বিলাতের[৪০] উপাসী॥
জষ্ঠি মাসের রবির জ্বালা পবনের নাই বাও[৪১]
পুত্রেরে শীগারে দিয়া পাগল হইলা মাও॥১—৬০

( ২ )

পথে

আগরাঙ্গ্যা[৪২] সাইলের খেত পাক্যা[৪৩] ভূমে পড়ে।
পন্থে আছে বইনের বাড়ী যাইব মনে করে॥
“মায়ের পেটের বইন গো তুমি শুন আমার বাণী।
শীগারে যাইতে শীঘ্র বিদায় কর তুমি॥
ধরে ছিল সাচি পান চুন খয়ার দিয়া।
ভাইয়ের লাগ্যা বইনে দিল পান বানাইয়া॥
উত্তম সাইলের চিড়া গিষ্ঠেতে[৪৪] বান্ধিল।
ঘরে ছিল শবরী কলা তাও সঙ্গে দিল॥
কিছু কিছু তামুক আর টিক্কা দিল সাথে।
মেলা কইরা[৪৫] বিনোদ বাহির হইল পথে॥
যতদূর দেখা যায় বইনে রইল চাইয়া।
শীগারে চলিল বিনোদ পালা[৪৬] কুড়া লইয়া॥

কুড়ায় ডাকে ঘন ঘন আষাঢ় মাস আসে।
জমীনে পড়িল ছায়া মেঘ আসমানে ভাসে॥
গুরু গুরু দেওয়ায় ডাকে জিল্কি[৪৭] ঠাডা[৪৮] পড়ে।
অভাগী জননী দেখ ঘরে পুইরা[৪৯] মরে॥
আইল আষাঢ় মাস জলের বাড়ে ফেনা।
কুড়ার ডাকেতে শুনে বর্ষার নমুনা॥[৫০]
মায়ে বইনে না দেখিল বুকে রইল শেল।
কুড়া লইয়া চান্দ বিনোদ কোন বা দেশে গেল॥
একলা থাকিয়া ঘরে কান্দে তার মায়।
কি জানি যাদুরে মোর সাপে বাঘে খায়॥১—২২

( ৩ )

পূর্ব্বরাগ

কোন দেশেতে গেল বিনোদ শুন বিবরণ।
আড়ালিয়া গেরামে[৫১] যাইয়া দিল দরশন॥
গাঁয়ের পাছে আন্ধ্যাপুখুর[৫২] ঝাড়জঙ্গলে ঘেরা।
চাইর[৫৩] দিগে কলাগাছ মান্দার গাছের বেড়া॥
জলে যাইতে এক পন্থ আনাগুনা[৫৪] করে।
জলের শোভা দেখে বিনোদ পুষ্কর্নির পাড়ে॥
ঘাটেতে কদম গাছে ফুট্যা রইছে ফুল।
কড়ারে রাখিয়া বিনোদ রইল তার তল[৫৫]
জেঠ[৫৬] মাসের ছোট রাইত ঘুমের আরি[৫৭] না মিটে।
কদমতলায় শুইয়া বিনোদ দিনের দুপুর কাটে॥


ঘুমাইতে ঘুমাইতে বিনোদ অইল সন্ধ্যাবেল৷
“ঘাটের পারে নিদ্রা যাও কে তুমি একেলা॥”
সাত ভাইয়ের বইন মলুয়া জল ভরিতে আসে।
সন্ধ্যাবেল। নাগর শুইয়া একলা জলের ঘাটে॥
কাঁদের কলসী ভূমিত থইয়া[৫৮] মলুয়া সুন্দরী।
লামিল[৫৯] জলের ঘাটে অতি তরাতরি॥
একবার লামে কন্যা আরবার চায়।
সুন্দর পুরুষ এক অঘুরে[৬০] ঘুমায়॥

সন্ধ্যা মিলাইয়া যায় রবি পশ্চিম পাটে[৬১]
তবু না ভাঙ্গিল নিদ্রা একলা জলের ঘাটে॥

“রাত্রি নিশাকালে যদি ভাঙ্গে নিদ্রা তার।
ভিন দেশী পুরুষ বল যাইবে কোথায় আর॥
বাড়ী নাই ঘররে নাই নাই বাপ-মাই।
রাত্রি পোষাইতে কেবা দিব একটুক ঠাই॥
কোথা হইতে আইল নাগর কোথায় বাড়ীঘর।
কুলের কুমারী আমি কেমনে পাই উত্তর॥
উঠ উঠ নাগর” কন্যা ডাকে মনে মনে।
কি জানি মনের ডাক সেও নাগর শুনে॥

“ভিন দেশী পুরুষ এই লাজে মাথা কাটে।
কেমন কইরা সন্ধ্যাবেলা একলা রইবাম ঘাটে॥
মনে লয় পুরুষে আমি জাগাই ডাকিয়া।
বাপের বাড়ীর পথ আমি তারে দেই দেখাইয়া॥
আন্ধাইর রাইতে কোথায় যাইব পথ না চিনিলে।
এমন সময় চক্ষে বিধি কালনিদ্রা দিলে॥
উঠ উঠ ভিন্ন পুরুষ তুমি কত নিদ্রা যাও।
যার বুকের ধন তুমি তার কাছে যাও॥”

কলসী লইয়া কন্যা জলে দিল ঢেউ।
“এই ঘুম ভাঙ্গিতে পারে সঙ্গে নাই মোর কেউ॥
আইত[৬২] যদি ভাইয়ের বউ সঙ্গেতে আমার।
কোন মতে কাল ঘুম ভাঙ্গিতাম যে তার॥
মাও যদি সঙ্গে আইত কি করিতাম তারে।
মায়রে দিয়া কইয়া বুল্যা[৬৩] লইয়া যাইতাম ঘরে॥
একলা অবলা আমি কুলমানের ভয়।
পন্থ-হারা ভিন পুরুষের দুঃখ নাহি সয়॥”

এই না ভাবিয়া কন্যা কোন কাম করিল।
কাছে আছিল শুধা[৬৪] কলস টানিয়া আনিল॥

“শুনরে পিতলের কলসী কইয়া বুঝাই তরে।
ডাক দিয়া জাগাও তুমি ভিন্ পুরুষেরে॥”
এত বলি কলসী কন্যা জলেতে ভরিল।
জলভরণের শব্দে বিনোদ জাগিয়া উঠিল॥
জলভরণের শব্দে কুড়া ঘন ডাক ছাড়ে।
জাগিয়া না চান্দ বিনোদ কোন কাম করে॥
দেখিল সুন্দর কন্যা জল লইয়া যায়।
মেঘের বরণ কন্যার গায়েতে লুটায়॥
এইত কেশ না কন্যার লাখ টাকার মূল।
শুকনা কাননে যেন মহুয়ার ফুল॥
ডাগল[৬৫] দীঘল আখি যার পানে চায়।
একবার দেখলে তারে পাগল হইয়া যায়॥

“এমন সুন্দর কন্যা না দেখি কখন।
কার ঘরের উজল বাতি চুরি করল মন॥
জাগিয়া দেখ্যাছি কিবা নিশির স্বপন।
কার ঘরের সুন্দর নারী কার পরাণের ধন॥
জলের না পদ্মফুল শুকনায় ফুটে রইয়া।
আসমানের তারা ফুটে মঞ্চেতে ভরিয়া॥[৬৬]
শুন শুন কুড়া আরে কহি যে তোমারে।
পরিচয়-কথা কন্যার আন্যা দেও আমারে॥
কার বা নারী কার বা কন্যা কোথায় বাড়ীঘর।
উইরে যাওরে বনের কুড়া আন গিয়া উত্তর॥

শুন চন্দ্রমুখী কন্যা কহি যে তোমারে।
একবার ফিরিয়ে চাও দেখি যে তোমারে॥
কি ক্ষণে আইলাম আমি কুড়া না[৬৭] শীগারে।
পরাণ রাখিয়া গেলাম এই না জলের ঘাটে॥
একবার চাওলো কন্যা মুখ ফিরাইয়া।
আর একবার দেখি আমি আপনা ভুলিয়া॥
অর্দ্ধেক যৌবন কন্যার বিয়ার নাই সে বাকী।
পরের নারী দেখ্যা কেন মজে আমার আখি॥
বিয়া যদি নাহি হয় কি করিবাম তায়।
পরের ঘরের কন্যা না দেখি উপায়॥
উইরে যাওরে বনের কুড়া কইও মায়ের আগে।
তোমার না চান্দ বিনোদে খাইছে জঙ্গলার বাঘে॥
উইরে যাওরে বনের কুড়া কইও বইনের ঠাই।
মইরা গেছে চান্দ বিনোদ আরত বাচ্যা[৬৮] নাই॥
উইরা যাওরে বনের কুড়া কন্যারে জানাও।
আমার পরাণের কথা যথায় লাগাল পাও॥”

ভিন দেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতন।
লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন॥
কলসী ভরিয়া কন্যা ঘরেতে ফিরিল।
কুড়া লইয়া চান্দ বিনোদ বইনের বাড়ী গেল॥
আশ্বিনে পূবের মেঘ পশ্চিমে ভাস্যা যায়।
ঘরে থাক্যা কান্দা মরে অভাগিনী মায়॥১—৯০

(৪)

কৈফিয়ৎ তলপ এবং মলুয়ার জবাব

পঞ্চ ভাইয়ের বৌয়ে ডাক্যা[৬৯] কয় “ননদিনী।
সন্ধ্যাকালে জলের ঘাটে একলা কেন তুমি॥

অসময়ে নিদ্রা


“ভিন দেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতন।
লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন॥”
মলুয়া, ৫৪ পৃঃ

আউলা ঝাউলা[৭০] অঙ্গের বসন মাথায় কেশ খুলা[৭১]
আজি কেন জলের ঘাটে গিয়াছিলা একলা॥
আধা কলসী ভরা দেখি আধা কলসী খালি।
আইজ যে দেখি ফোটা ফুল কাইল দেখ্যাছি কলি॥
কি হইয়াছে জলের ঘাটে সত্য করি বল।
না ভাড়াইও ননদিনী না করিও ছল॥
আইজ সকালে জলের ঘাটে মোদের সঙ্গে চল।
সঙ্গে কইরা কলসী লও ভইরা আনতে জল॥
ঘরে আছে গন্ধতৈল আবের কাকই[৭২] দিয়া।
রাতির আইলা[৭৩] চাচর[৭৪] কেশ দিবাম বান্ধিয়া॥
তরে[৭৫] লইয়া ননদিনী আমরা যাইবাম জলে।
মনের কথা কইবাম গিয়া ঐ না জলের ঘাটে॥
বিয়ার বছর হইল, না আইল বর।
এমন যে কন্যা আইজও রইল বাপের ঘর॥
পরথম যৌবন কন্যা পরমসুন্দরী।
তরে দেখ্যা ননদিনী আমরা জ্বল্যা মরি॥”

মলুয়া কহিছে “বউ মোর বাক্য ধর।
একলা যাইতে জলের ঘাটে কেন বা মানা কর॥”
পাচ ভাইয়ের বধু কয় “একলা যাইয়ে চান্দে।
কি জানি চণ্ডালের[৭৬] কাছে ফালায় তারে ফান্দে॥”

“কালিকার রাত্রি আমার গেছে দারুন জ্বরে।
বেদনা হইছে বধু আমার পেটের কামরে॥

তোমরা সবে জলে যাও না যাইব আমি।”
পাচ ভাইয়ের বধু তবে করে কানাকানি॥
কানাকানি করি তারা জলের ঘাটে গেল।
শয়নমন্দিরে কন্যা পরবেশ করিল॥১—২৮


( ৫ )

মলুয়ার পরিচয়

জাতিতে হালুয়া দাস[৭৭] গাঁয়ের[৭৮] মরল[৭৯]
মলুয়ার বাপ হয় নাম হীরাধর॥
পাঁচ পুত্র হয় তার অতি ভাগ্যবান।
সরু সশ্যে ভরা টাইল[৮০] গোলা ভরা ধান॥
ধরে আছে দুধবিয়ানী[৮১] দশ গোটা গাই।
হালের বলদ আছে তার কোন দুঃখ নাই॥
বাইস আড়া[৮২] জমীন তার সাইল আর আমন
ধনে পুত্রে বর তারে দিছে দেবগণ॥
দোল-দুর্গোৎসব তার পরব-পার্ব্বণ।
বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধে করে ব্রাহ্মণ-ভোজন॥

বার না বচছরের কন্যা পরমসুন্দরী।
না হইল বিয়া কন্যার চিন্তা মনে ভারি॥
বাপ-মায় চায় বর রাজার সমান।
একমাত্র কন্যা মাও-বাপের পরাণ॥
কত ঘর আইল গেল পছন্দ না হয়।
ভালা ঘরে বিয়া দেওয়া হইল সংশয়॥

( ৬ )

স্নানের ঘাটে

শয্যাতে শুইয়া কন্যা ভাবে মনে মন।
“কোথায় তনে[৮৩] আইল পুরুষ চান্দের মতন॥
কুড়া শীগার কইরা ফিরে বনে বনে।
আজি যে জলের ঘাটে দেখলাম কিবা ক্ষণে॥
কালি রাত্রি পোষাইল কার বাড়ীতে থাকি।
কোথায় জানি রাখল তার সঙ্গের কুড়াপাখী॥
আমি যদি হইতাম কুড়া থাকতাম তার সনে।
তার সঙ্গে থাক্যা আমি ঘুরতাম বনে বনে॥
আসমানে থাকিয়া দেওয়া ডাকছ তুমি কারে।
ঐনা আষাঢ়ের পানি বইছে শত ধারে॥
গাং ভাসে নদী ভাসে শুকনায় না ধরে পানি।
এমন রাতে কোথায় গেল কিছুই না জানি॥
অতিথ বলিয়া যদি আইত আমার বাড়ী।
বাপেরে কহিয়া আমি বইতে[৮৪] দিতাম পিড়ি॥
শুইতে দিতাম শীতল পাটী বাটাভরা পান।
আইত[৮৫] যদি সোণার অতিথ যৌবন করতাম দান॥”

দুপুরবেলা গেল কন্যার ভাবিয়া চিন্তিয়া।
বিয়াল[৮৬] বেলা গেল কন্যার বিছানাতে শুইয়া॥
সন্ধ্যাকাল আইলে কন্যা কোন কাম করে।
পিতলা কলসী কন্যা লইল কাঁকের উপরে॥
কলসী লইয়া কন্যা জলের ঘাটে যায়।
পাঞ্চ ভাইয়ের বউয়েরে কন্যা কিছু না জানায়॥
মেষ আরা[৮৭] আষাঢ়ের রইদ[৮৮] গায়ে বড় জ্বালা।
ছান[৮৯] করিতে জলের ঘাটে যায় যে একেলা॥

কিসের ছান কিসের পানি কিসের জল ভরা।
দুইয়ের প্রাণে টান পইড়াছে এমন প্রেমের ধারা॥
একলা সন্ধ্যাকালে কন্যা জলের ঘাটে যায়।
চান্দ বিনোদ শুইয়। আছে কদমতলায়॥
শিয়রে থাকিয়া কুড়। ডাকে ঘন ঘন।
কুড়ার ডাকেতে বিনোদ মেলিল নয়ন॥
আখি না মেলিয়া বিনোদ ঘাটের পানে চায়।
জল ভরে সুন্দরী কন্যা দেখিবারে পায়॥


চাঁদ বিনোদ

“কুড়া শীগার কইরা আমি ফিরি বনে বনে।
আমার যত মনের দুঃখ কেউত না শুনে॥
কে তুমি সুন্দরী কন্যা নিত্যি ভর পানি।
রইয়া শুন আমার কথা কিছু কইবাম[৯০] আমি॥
কুড়া শীগার করি আমি চান্দ বিনোদ নাম।
পরিচয়-কথা মোর সত্য কহিলাম॥
কার কন্যা কোথায় বাড়ী কিবা নাম ধর।
আমি চাই পরিচয় দেও যে উত্তর॥
কলসী বুড়াইয়া[৯১] কন্যা জলে দিছ দেউ।
সন্ধ্যাবেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাই আর কেউ
কাইল গেছে আশে পাশে আইজ রইলাম বইয়া[৯২]
মনের আগুন নিবাও কন্যা পরিচয় কইয়া॥
বিয়া যদি হইয়া থাকে হও পরের নারী।
সেও কথা কও কন্যা আজি সত্য করি॥
তোমার পানে চাইয়া কন্যা আমি যাইবাম ফিরে।
আর না আসিবাম কন্যা কুড়া-শীকারে॥”

মলুয়া

“বাপের নাম হীরাধর অসমা মোর মাও[৯৩]
কালী দেখলাম জলের ঘাটে শুইয়া নিদ্রা যাও॥
ভিন দেশী পুরুষ তুমি কি কহি তোমারে।
অতিথ হইয়া আজি থাক আমার বাপের ঘরে॥
কুড়া লইয়া তুমি থাক বনে বনে।
কেমনে কাটাও নিশি এইমতে কাননে॥
বনে আছে বাঘ-ভালুক তোমার ভয় নাই।
এমন কইরা কেমনে তুমি ফির ঠাই ঠাই॥
আন্ধুয়া পুষ্কুনির পাড় কালনাগের বাসা।
একবার ডংশিলে[৯৪] যাইব[৯৫] পরাণের আশা॥
সাধুমন্ত[৯৬] বাপ আমার মাও যে সুজন।
ঘরেতে আমার আছে ভাই পঞ্চ জন।
পঞ্চ ভাইয়ের বউ আছে ইষ্টিকুটুম করি।
আজি নিশি অতিথ হইয়া রইবা আমার বাড়ী॥
এই পন্থে যাইতে আজি তোমায় করি মানা।
সামনে আছে গেরামের[৯৭] পথ লোকের আনাগুনা॥
সেই পন্থ ধইরা তুমি মেলা নাই সে কর।[৯৮]
এই পথে যাইতে দেখবা বার-দুয়াইরা ঘর[৯৯]
সামনে আছে পুষ্কুনি সানে বান্ধা ঘাট।
পূব মুখ্যা[১০০] বাড়ীখানি আয়নার কপাট॥
আগে পাছে বাগ-বাগিচা আছে সারি সারি।
পারাপশ্বির লোকে[১০১] কয় গাও মরলের[১০২] বাড়ী॥

দুঃখু কেনে করবা তুমি আজি নিশা বনে।
শীতল পাটী পাত্যা দিবাম তোমার বিছানে॥
পাঁচ ভাইয়ের বউয়ে রান্‌ব[১০৩] ছত্রিশ বেনুন।
আজি নিশি থাক্যা তুমি করিও ভোঞ্জন॥”

এইত বলিয়া কন্যা জল লইয়া যায়।
কুড়া লইয়া চান্দ বিনোদ ভিন্ন পথে যায়॥

(৭)

অতিথির অভ্যর্থনা

সন্ধ্যাকালে অতিথ আইল ভিন দেশে ঘর।
পাঁচ পুত্রে ডাক্যা[১০৪] কয় সাধু হীরাধর॥
লোটা ভইরা শীতল জল দিল খরম পানি।
পাঁচ ভাইয়ের বউয়ে রান্ধে পরম[১০৫] রান্ধুনি॥
মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।
মাছের সরুয়া[১০৬] রান্ধে জিরার সম্বার॥
কাইট্টা[১০৭] লইছে কই মাছ চরচরি খারা।
ভালা কইরে রান্ধে বেনুন দিয়া কাল্যাজিরা॥
একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি।
শুকনা মাছ পুইড়া[১০৮] রান্ধে আগল বেসাতি॥

পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিনোদ পিড়িত বস্যা[১০৯] খায়।
এমন ভোঞ্জন বিনোদ জন্মে নাই সে খায়॥

শুকত[১১০] খাইল বেনুন খাইল আর ভাজা বরা।
পুলি পিঠা খাইল বিনোদ দুধের শিস্যার ভরা[১১১]
পাত পিঠা বরা পিঠা চিত[১১২] চন্দ্রপুলি।
পোয়া চই[১১৩] খাইল কত রসে চলঢলি॥
আচাইয়া চান্দ বিনোদ উঠিল তখন।
বার-দুয়ারিয়া ঘরে গিয়া করিল শয়ন॥
বাটাভরা সাচি পান নং এলাচি দিয়া।
পাঁচ ভাইয়ের বউ দিছে পান সাজাইয়া॥
শুইতে দিছে শীতল পাটী উত্তম বিছান।
বাতাস করিতে দিছে আবের পাঙ্খাখান॥
এইমতে শুইয়া বিনোদ সুখে নিদ্রা যায়।
পরভাতে উঠিয়া বিনোদ বিদায় যে চায়॥

পন্নাম করিল বিনোদ হীরাধরের পায়।
পঞ্চ ভাইয়েরে বিনোদ পন্নাম জানায়॥
বন তনে বাহির হইয়া বিনোদ পন্থে দিল মেলা।
সুন্দরী মলুয়া ঘরে রইল একেলা॥

(৮)

বিবাহের প্রস্তাব

বইনের কাছে গিয়া বিনোদ বইনের আগে কয়।
শীগারে গেছিলাম যত কইল সমুদয়॥
আদিগুরি বির্ত্তান্ত সব বইনেরে শুনায়।
বিয়ার কথা কইতে বিনোদ মনে লজ্‌জা পায়॥
বইনেত বুঝিল তবে ভাইএর বেদন।
মায়ের কাছে যাইতে বিনোদ করিল গমন॥

মায়ের কাছে কইতে বিনোদ মনে লজ্‌জা পায়।
কেমন কইরা কইব কথা না দেখি উপায়॥
এক দুই তিন করি আষাঢ় মাস যায়।
সাইর সরসিরে[১১৪] বিনোদ বেদনা জানায়॥
একে একে যত কথা উঠল মায়ের কানে।
ঘটক পাঠাইল পরে বিয়ার সন্ধানে॥

এগার উতরিয়া কন্যা বারয় দিল পাও।
দেখিয়া চিন্তিত হইল তার বাপ-মাও॥
ঘুরা[১১৫] না যায় অঙ্গের বসন করে টানাটানি।
তারে দেখ্যা পাড়ার লোকে করে কানাকানি॥
কানাকানি করে কেউ করে বলাবলি।
দিনে দিনে ফোটে কন্যার যৌবনের কলি॥

আষাঢ় মাস হীরাধরের আশার আশে যায়।
বিয়া নাই সে হইল কন্যার কি করি উপায়॥
শায়ন[১১৬] মাসে বিয়া দিতে দেশের মানা আছে।
এই মাসে বিয়া দিয়া বেউলা[১১৭] রাঢ়ি[১১৮] হইছে॥
ভাদ্র মাসে শাস্ত্রমতে দেবকার্য্য মানা।
এই মাসে না হইল বিয়া কেবল আনাগুনা॥
আশ্বিন মাসেতে দেখ দুর্গাপূজা দেশে।
এও মাস গেল বাপের পূজার আন্দেসে[১১৯]
কার্ত্তিক মাসেতে পাইৰ কার্ত্তিকসমান বর।
মন নাহি উঠে বাপের আইল যত ঘর॥
আগণ[১২০] মাসে রাঙ্গা ধান জমীনে ফলে সোনা।
রাঙ্গা জামাই ঘরে আনতে বাপের হইল মানা॥
পৌষ মাসে পোষা আন্ধি দেশাচারে দোষ।
এই মাস গেলে হইব বিয়ার সন্তোষ॥

মাঘ মাসে করমি[১২১] আইল হীরাধরের বাড়ী।
একে একে দেখে বাপে সম্বন্ধ বিচারি॥

চম্পাতলার সোনাধর এক পুত্র তার।
দেখিতে সুন্দর পুত্র কার্ত্তিক কুমার॥
আড়ায়[১২২] পুড়ায় তার আছয়ে জমীন।
হীরাধর কয় বংশে সেও অকুলিন॥
আর এক করমি আইল দীঘলহাটী হইতে।
ধনে জনে সেও ভাল সকল কথা কইতে[১২৩]
ঘরের ভাত খায় সে যে গোয়াইলভরা গরু।
কাঠাতে মাপিয়া তুলে ধান-চাউল সরু॥
বাপের নাই সে উঠে মন হইল বিষম লেঠা।
ঘরবর পছন্দ হইল বংশে আছে খুটা[১২৪]
উত্তরে সুসুঙ্গ হইতে আইল আরও ঘর।
অবস্থা-বেবস্থা তার অতিশয় সুন্দর॥
ধানে চাউলে মহাজন চাইর পুত্র তার।
এক এক পুত্র যেমন তার দেব অবতার॥
ঘাটে বান্ধা দৌড়ের নাও[১২৫] পছন্দ বাহার।
লড়াই করিতে আছে চাইর গোটা ষাঁড়[১২৬]
ভাত ফালাইয়া ভাত খায় চিন্তা-ভাবনা নাই।
মহারোগীর বংশ[১২৭] বল্যা কন্যা দিতে নাই॥

এমন কালে করমি গেল সম্বন্ধ করিতে।
চান্দ বিনোদের বিয়া কৈল[১২৮] বিধিমতে॥
কার পুত্র কোথায় বাড়ী সকল জানিয়া।
বাপে ভাবে হেথায় কন্যা দিব কি না বিয়া॥

বরত পছন্দ হয় কার্ত্তিক কুমার।
বংশেতে কুলিন সেই যত হালুয়ার॥
হালুয়া গোষ্ঠীর মধ্যে বড় বাপের বেটা।
বংশেতে কুলিন সেই নাই কোন খোটা॥
এক চিন্তা করে বাপে শিরে হাত দিয়া।
“কেমন কইরা এমন ঘরে কন্যা দিবাম বিয়া॥
এক কাঠা ভুই নাই খলা[১২৯] পাতিবারে।
কেমন কইরা বিয়া দিবাম কন্যা এই ঘরে॥
একখানি ভাঙ্গা ঘর চালে নাই ছানি।
কেমনে খাইব কন্যা উচ্ছিলার[১৩০] পানি॥
বাপের দুলাল কন্যা দুঃখ নাহি জানে।
পাঁচ ভাইয়ের বইন এত না সইব পরাণে॥
একমুষ্টি ধান নাই লক্ষ্মীপূজার তরে।
কি খাইয়া থাকব কন্যা দরিদ্রের ঘরে॥
পাটের শাড়ী পিন্দ্যা[১৩১] কন্যা সুখ নাহি পায়।
হেন ঘরে কন্যা দিতে মন না জুয়ায়[১৩২]॥”


করমি ফিরিয়া গেল সম্বন্ধ না হয়।
চান্দ বিনোদের মায় ডাক্যা সবে কয়॥
এহা শুন্যা বিনোদের মা চিন্তিত হইল।
পুত্রের রাখিতে মন দৈবে নাহি দিল॥
আঁচা আঁচি[১৩৩] সকল কথা চান্দ বিনোদ শুনে।
বৈদেশে যাইতে বিনোদ দড় করল মনে॥১—৮২

( ৯ )

ভাগ্যচক্রের পরিবর্তন

ঘুম থাকা উঠ্যা বিনোদ মায়ের আগে কয়।
“গিরে[১৩৪] বস্যা উচিত মা থাকতে নাহি হয়॥
কামাই রোজগার নাই ঘরে নাই ভাত।
এমন করিয়া কেমনে রইব কুলজাত॥
বিদায় দেও মা জননী বলি তোমার আগে।
বৈদেশ যাইতে তোমার পুত্র বিদায় যে মাগে॥”

ঘরে আছিল পানিভাত বাইরা[১৩৫] দিল মায়।
কাচালঙ্কা দিয়া বিনোদ কিছু কিছু খায়॥
মায়ের পায়ের ধূলা বিনোদ তুল্যা লইল শিরে।
বৈদেশে যাইতে বিনোদ পথে মেলা করে॥
কুড়া শীগারী বিনোদ পিজরা নইল হাতে।
এক বারে উতরিল সরাইয়ের[১৩৬] পথে॥

বৈদেশেতে যায় যাদু যদ্দুর দেখা যায়।
পিছন থাকা চাইয়া দেখে অভাগিনী মায়॥
বাঁশের ঝাড় বনজঙ্গলে পুতের পিষ্ঠে পড়ে।
আখির পানি মুছ্যা মায় ফিরা আইল ঘরে॥
এক মাস দুই মাস তিন মাস যায়।
ছয় সাত আট করি বছর গোয়ায়॥

“কি কর বিনোদের মাও কি কর বসিয়া।
তোমার পুত্র বিনোদ আইল দেখ বাইর হইয়া॥
আইসাছে তোমার যাদু দুই আখির তারা।”
ডাক শুনিয়া পাগল মাও পন্থে হইল খাড়া॥
দেখিয়। পুত্রের মুখ এক বছর পরে।
অভাগী দুঃখিনী মায়ের দুই নয়ান ঝুরে॥

কুড়া শীগার কইরা বিনোদ পাইল জমীন বাড়ী।
ইনাম বকশিস্ পাইল কত কইতে নাহি পারি॥
রাজ্যের রাজা দেওয়ান সাহেব সদয় হইল তারে।
কুড়ি আড়া জমীন দেওয়ান লেখ্যা দিল তারে॥

কামলার[১৩৭] কাম বিনোদ তাও ভালা জানে।
ভালা কইরা বান্ধে বাড়ী সূত্যা নদীর কানে[১৩৮]
আট চালা চৌচালা ঘর বান্ধিয়া সুন্দর।
ভালা কইরা বান্ধে বিনোদ বার-দুয়াইরা ঘর॥
শীতল পাটী দিয়া বিনোদ ঘরের দিল বেড়া।
উলুছনে ছাইল চাল দেখতে মনহারা॥
ঝাপে ঝুপে করে বিনোদ কামলার কাম।
দেখিতে সুন্দর বাড়ী চান্দের সমান॥
মাছুয়াপক্ষীর পাখ দিয়া সাজুয়া[১৩৯] বানায়।
কামলা ডাকিয়া বিনোদ পুষ্কুনি কাটায়।
বাড়ীর সামনে পুষ্কুনি জলে টলমল।
এক মায়ের এক পুত পরানের সম্বল।
পাড়াপড়সি কয় মাও বড় ভাগ্যবতী।
এক পুতের বরাতে তার দুয়ারে বান্ধা হাতী॥
এক পুতের গুণে তার লক্ষ্মী বান্ধা ঘরে।
ধনসম্পদ হইল তার দেবতার বরে॥১—৪৪


( ১০ )

বিবাহ

এরে শুন্যা হীরাধর কোন কাম করিল।
কন্যার বিয়ার লাগ্যা ভাটুয়া[১৪০] পাঠাইল॥
ভাটুয়া আসিয়া কয় বিনোদের মার আগে।
কন্যা বিয়া করাও তুমি সমুখের মাঘে॥

কথাবার্ত্তা হইল স্থির না রইল বাকী।
গণক ডাকাইয়া বাপে দেখে পাঞ্জিপুঁথি॥
পাঞ্জিপুঁথি দেখ্যা গণক বিয়ার লগ্ন করে।
চল্যা গিয়া হইব বিয়া শ্বশুরের ঘরে॥

ঠাটঠমকে বিনোদ হইল আগুসার[১৪১]
ঘোড়ার উপরে বিনোদ হইল সোয়ার॥
আগে পাছে বাদ্য বাজে ঢোলডগর।
বরযাত্রী হইল যত পাড়ার নাগর[১৪২]
হাঐ খিলই[১৪৩] ছাড়ে আর তুম্‌রি শত শত।
বাদ্যভাণ্ড লইয়া চলে রুসনাই[১৪৪] করি পথ॥

উপস্থিত হইল লোক হীরাধরের বাড়ী।
অর্গা পুছ্যা[১৪৫] চান্দ বিনোদে নিল যত নারী।
জয়াদি[১৪৬] জুকার[১৪৭] দেয় কত ঝাড়ে ঝাড়।
গীতবাদ্য করে যত নারী চমৎকার॥
তবেত মলুয়ার মাও খুড়ীজেঠী লইয়া।
সোহাগ মাগিতে[১৪৮] মাও বিয়ার মঙ্গল চাইয়া॥
খুড়ীর সোহাগ জেঠীর সোহাগ আর মাসীপিসী।
সোহাগ মাগে কন্যার মাও মঙ্গল উদ্দেশি॥
শ্বশুরবাড়ী গিয়া কন্যা থাকুক সোহাগে।
তেকারণে কন্যার মাও ভাল সোহাগ মাগে॥
মাথায় লক্ষ্মীর কুলা অঞ্চলে ঘুড়িয়া।[১৪৯]
সোহাগ মাগিল মায়ে বাড়ী বাড়ী গিয়া॥
উত্তম সাইলের চাউলে পিঠালী বাটিয়া।
বন্দনা করিল আগে তিন আবা[১৫০] দিয়া॥

চিমঠিয়া[১৫১] তুলে সবে দুয়ারের মাটী।
সোহাগের দ্রব্য আনি দেয় কুটি কুটি॥
হলদি চাকি চাকি আর তৈল সিন্দুরে।
এরে দিয়া সোহাগ ভালা সাজায় সুবিস্তরে[১৫২]
পাছে পাছে গীত গায় পাড়ার যত নারী।
সোহাগ মাগিয়া মায় ফিরে নিল বাড়ী॥
চুরপানি[১৫৩] দিল মায় টুপায়[১৫৪] ভরিয়া।
ধন[১৫৫] মন[১৫৬] ছয়াইল যতন করিয়া॥
ধন ছুয়াইল মায় ধন পাইবার আশে।
মন ছুয়াইল মায় জামাইর অভিলাষে॥
নান্দিমুখ আদি যত শুভ কার্য্য শেষে।
শুভলগ্নে হইল পরে বিয়া অবশেষে॥

পাশা খেলায় চান্দ বিনোদ মলুয়ারে লইয়া।
পাশায় হারিল বিনোদ চিতের লাগিয়া॥
ফুলশয্যা করে বিনোদ রাত্রি হইল শেষ।
সেই দিন ভাবে বিনোদ ফিরবে নিজ দেশ॥
কালরাতে কালক্ষয় যাত্রা করতে মানা।
এই দিনে জামাই বউয়ে নাহি দেখাশুনা॥
কালরাইত গিয়া বিনোদের শুভরাইত আইল।
শয়ানমন্দিরে বিনোদ শয়ান করিল॥

ঘরেতে জ্বলিছে বাতি সাজুয়ার তারা[১৫৭]
শয়ানমন্দিরে মলুয়া সামনে হইল খাড়া॥
নিশিরাইত পইড়া আইল[১৫৮] ঘুমে ঢুলে আখি।
চিত্তে খুসী হইল বিনোদ মলুয়ারে দেখি॥

টানিয়া অঙ্গের বাস যতনে শুয়ায়[১৫৯]
মাথা হইতে ঘোমটা বিনোদ টানিয়া লামায়॥
কিবা মুখ কিবা সুখ ভুরুর ভঙ্গিমা।
আন্ধাইর[১৬০] ঘরেতে যেমন জ্বলে কাঞ্চা সোনা॥
এইরূপ দেখিয়া বিনোদ হইল পাগল।
চান্দের সমান রূপ করে ঝলমল॥
শিরে না দীঘল কেশ পড়ে কন্যার পায়।
সেই কেশ লইয়া বিনোদ মেঘুরী[১৬১] খেলায়॥

“কি কর পরাণের বন্ধু শুন মোর কথা।
আজি রাতে মানা দেও খাও মোর মাথা॥
না ফুটিতে ফুল কেন তুল্যা লও কলি।
মধু না আসিতে ফুলে নাহি আসে অলি॥
খিধা লাগলে তাপ্তা[১৬২] ভাত জুড়াইয়া সে খায়।
এমন হইতে বন্ধু তোমায় না জুয়ায়॥
পঞ্চ ভাইয়ের বউ নিদ্রা নাহি গেছে।
বেড়ার ফাক দিয়া তারা তোমায় দেখিছে॥
ভূষণের রুণুঝুণু শব্দ শুনি কানে।
পরিহাস করবে তারা কালিকা বিহানে॥
পরদীম[১৬৩] নিবাইয়া বন্ধু আজি কাট নিশি।
চিত্তে ক্ষেমা দিও বন্ধু না বানাইও দোষী॥”

নিবিয়া ঘরের বাতী অন্ধকার হইল।
শুভক্ষণ শুভ রাইত পোয়াইয়া গেল॥
পরভাতে উঠিয়া কন্যা বাসি জল দিয়া।
হাত পাও ধোয় বিনোদ পিড়িত ৰসিয়া॥১—৭৬

(১১)

ঘরে ফেরা

আজি রাত্রে যাইব বিনোদ আপনার বাড়ী।
সঙ্গেতে করিয়া লইব আপনার নারী॥
মায়ে কান্দে বাপে কান্দে কান্দে মাসীপিসী।
পরের ঘর যায় ঝি কান্দে পাড়াপড়সি॥
“পরের লাগ্যা পাল্যা[১৬৪] অত করিলাম বড়।
আমরারে[১৬৫] ছাড়িয়া মাও যাইবা পরের ঘর॥
ডাক ছাড়্যা কান্দে বাপে বিলাপ করে মায়।
“আজি হইতে কন্যা আমার পরের ঘরে যায়॥”

বিলাপ নাই সে কর মাও ছাড়হ কান্দন।
কি কি দ্রব্য দিবা সঙ্গে করহ সাজন॥

ঝাইল[১৬৬] পেটেরা দিল সঙ্গেতে করিয়া।
সজ মসলা দিল থলিতে ভরিয়া॥
আরও সঙ্গে দিল মাও চিকনের চাইল।
তৈলসিন্দুর দিল খৈয়া বিন্নির ধান॥
“বড় দুঃখু পাইছ মাগো থাক্যা আমার বাড়ী।
এই জন্মের লাগ্যা যাইবা অভাগী মায় ছাড়ি॥
ভালা কইরা থাক্য[১৬৭] মাও শ্বশুরের ঘরে।
পাড়াপড়সি যাতে মন্দ না কহিতে পারে॥”

দধি ভোজন করি বিনোদ যাত্রা যে করিল।
শ্বশুর-শাশুড়ীর পায় পন্নাম করিল॥
জেঠাখুড়া গুরুজনে পরনাম জানায়।
বিয়া কইর। চান্দ বিনোদ আপন ধরে যায়॥

“কি কর বিনোদের মাও গিরেতে বসিয়া।
তোমার পুত্র বিনোদ আইছে রইদ্রেতে ঘামিয়া॥
কি কর বিনোদের মাসী ঘরেতে বসিয়া।
তোমার চান্দ বিনোদ আসে নয়া বউ লইয়া॥
কি কর বিনোদের মাসী বৈসা তুমি ঘরে।
সোনার ছত্র আন্যা ধর চান্দ বিনোদের শিরে॥"

ধানদূর্ব্বা দিয়া পরে আর্ঘিয়া পুছিয়া।
চান্দ মুখ লইল মায়ে মুছিয়া মুছিয়া॥
মায়ের চরণ বন্দ্যা যাদু লইয়া পায়ের ধূলা।
পথে আইতে চান্দ মুখ হইয়াছে কালা॥
বউগড়া[১৬৮] লইল মায় পিড়িতে বসিয়া।
ঘরের লক্ষ্মী ঘরে মায় লইল তুলিয়া॥
জয়াদি জুকার দেয় পাড়ার যত নারী।
রাখিল মঙ্গলঘট গঙ্গাজলে ভরি॥
সোনারূপা দিয়া সবে বউয়ের মুখ দেখে।
খুড়ী মাসী জেঠী যত সবে একে একে॥
এই মতে হইল যত মঙ্গল আচার।
এই মত মায়ের সুখ হইল অপার॥

বাড়ীর শোভা বাগবাগিচা ঘরের শোভা বেড়া।
কুলের[১৬৯] শোভা বউ—শাশুড়ীর বুক জুড়া[১৭০]
বউ পাইয়া বিনোদের মা পরম সুখী হইল।
ঘরগিরস্থি যত সব যতনে পাতিল॥১—৪৪

(১২)

কাজীর বিচার

পরেত হইল কিবা শুন দিয়া মন।
লুচ্চা দুষমন কাজী কৈল বিড়ম্বন॥

বড়ই দুরন্ত কাজী ক্ষেমতা অপার।
চোরে আশ্রা[১৭১] দিয়া মিয়া সাউদেরে[১৭২] দেয় কার[১৭৩]
ভালামন্দ নাহি জানে বিচার আচার।
কুলের বধূ বাহির করে অতি দুরাচার॥

একদিন দুষমন কাজী পন্থে আনাগুনি।
জল ভরিতে ঘাটে যায় বিনোদের কামিনী॥
দেখিয়া সুন্দর নারী পাগল হইল।
ঘোড়াতে সোয়ার কাজী চাহিয়া রহিল॥
ভূঁয়েতে বাইয়া[১৭৪] তার পরে লম্বা চুল।
সুন্দর বদন যেমন মহুয়ার ফুল॥
আখির ফাঁকেতে[১৭৫] তার নাচয়ে খঞ্জনা।
এরে দেখ্যা নিত্তি নিত্তি কাজীর আনাগুনা॥
আনাগুনা কইরা কাজী হইল বাওরা[১৭৬]
রাখিতে না পারে মন করে পংক্ষী উড়া[১৭৭]

ভাবিয়া চিন্তিয়া কাজী কোন কাম করে।
একবারে বসে গিয়া কুটুনির[১৭৮] ঘরে॥
গেরামে আছিল দুষ্ট নেতাই কুটুনি।
তার স্বভাবের কথা কিছু লও শুনি॥

বয়সেতে বেশ্যামতি কত পতি ধরে।
বয়স হারাইয়া অখন বসিয়াছে ঘরে॥
বয়স হারাইয়া তবু স্বভাব না যায়।
কুমন্ত্রণা দিয়া কত কামিনী মজায়॥
চুল পাকিয়াছে তার পড়িয়াছে দাত।
এতেক করিয়া অখন জুটায় পেটের ভাত॥

কাজীর কাজ


“ঘোড়াতে সোয়ার কাজী চাহিয়া রহিল॥”
মলুয়া, ৭২ পৃঃ

কাজীরে দেখিয়া বুড়ি কোন কাম করে।
কাঠালের পিড়ি দিল বৈসনের তরে॥
“কিসের লাগ্যা আইছুইন[১৭৯] আইজ দুয়ারে আমার।
কোন জন্মের ভাগ্যি মোর নাহি জানি তার॥”

কাজী কয় “কুটুনিলো তরে দিবাম সোনা।
করিবা আমার কাজ হইয়া সামিনা[১৮০]
সাতখুন মাপ তোমার আমার বিচারে।
এই কাম করলে তোমার কপাল যাইব ফিরে॥
যেমন কইরা আমার ঘোড়া বনে ছোটা খায়।
তেমন কইরা বেড়াইবা না গঠিব[১৮১] দায়॥
ছনেতে বান্ধিয়। দিব তোমার ঘরখানি।
ধনদৌলত যোগাইবাম যাহা লাগে আমি॥
পর গেরামেতে যাইতে পন্থে আনাগুনি।[১৮২]
জলের ঘাটে দেখলাম এক সুন্দর কামিনী॥
পরিচয়-কথা তার শুন দিয়া মন।
চান্দ বিনোদ সে যে আমার দুষমন॥
দেশেতে ভমরা নাই কি করি উপায়।
গোলাপের মধু তায় গোবরিয়া[১৮৩] খায়॥
ছুতানাতা ধইরা তুমি যাও তার বাড়ী।
একলা পাইবা যখন সেই ত সুন্দরী॥
আমার মনের কথা কইও তার আগে।
ধনদৌলত তার সুবিস্তর লাগে[১৮৪]
তারায় গাথিয়া তার দিয়াম গলার মালা।
দেখিয়া তাহার রূপ হইয়াছি পাগলা॥

নিখা যদি করে মোরে ভাল মত চাইয়া।
আমার ঘরের যত নারী রইব বান্দি হইয়া॥
সোনা দিয়া বেইরা দিবাম সর্ব্বাঙ্গ শরীর।
সাতখুন মাপ তার বিচারে কাজীর॥
সোনার পালঙ্ক দিবাম সাজুয়া[১৮৫] বিছান।
গলায় গাথিয়া দিবাম মোহরের থান॥
দিবাম কাঁকের কলসী সোনাতে বান্দিয়া।
নাকের বেসর দিবাম তায় হীরায় গড়িয়॥”

এতেক বলিয়া কাজী নিজ ঘরে যায়।
এই দিকে কুটুনি মাগি চিন্তয়ে উপায়॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া নেতাই যায় বিনোদের বাড়ী।
তিন ডাক মারে তারে নষ্টা দুষ্টা বুড়ি॥
“কি কর বিনোদের মা কি কর বসিয়া।
অনেক দিনে আইলাম বাড়ীত তোমারে চাহিয়া[১৮৬]
শুনিয়াছি নয়া বউ আনিয়াছ ঘরে।
এই মত সুন্দর নারী নাহিক সহরে॥
চক্ষে নাই সে দেখি আমি কানে নাই সে শুনি।
কিমত তোমার বউ দেখাও সেয়ানী॥”

এই মত নিত্তি নিত্তি আনাগুনি করে।
এক দিন একলা ঘাঠে পাইল মলুয়ারে॥
কাজীর যতেক কথা তাহারে জানায়।
একে একে কথা সব কহে মলুয়ায়॥
“তুমিত ঘরের বধু অঙ্গ কাঞ্চা সোনা।
রইয়া শুন আমার কথার কিঞ্চিৎ নমুনা॥
বিচারের মালীক কাজী দেশের পরধান।
কইবাম তার সকল কথা না করিবাম আন[১৮৭]

তোমার রূপ দেখ্যা কাজী হইয়াছে ফানা[১৮৮]
অঙ্গ ভরিয়া তোমায় দিব কাঞ্চা সোনা॥
নিখা যদি কর তারে ভাল মত চাইয়া[১৮৯]
তার ঘরের যত নারী রইব বান্দি হইয়া॥
সোনা দিয়া বেইরা দিব সর্ব্বাঙ্গ শরীর।
সাতখুন মাপ তোমার বিচারে কাজীর॥
সোনার পালঙ্ক দিব সাজুয়া বিছান।
গলায় গাথিয়া দিব মোহরের থান॥
দিব যে কাঁকের কলসী সোনাতে বান্ধিয়া।
নাকের বেসর দিব হীরায় গড়িয়া॥”

ভয় পাইয়া কন্যা কাঁকের কলসী ভরে।
একবারে চলে কন্যা আপনার ঘরে॥
মনের কথা জান্তে না দেয় পাছে পাছে যায়।
শাশুড়ী ঘরেতে নাই না দেখে উপায়॥

আর বার কথার ফাঁদ ফাদিল কুট্টুনি।
রোষিয়া কহিল মলুয়া, “শুনলো কুট্টুনি॥
স্বামী মোর ঘরে নাই কি বলিবাম তরে।
থাকিলে মারিতাম ঝাটা তর পাক্‌না[১৯০] শিরে।
বয়স গিয়াছে তর মরবি আজিকালি।
লোকের দুষমন তুই দুই চক্ষের বালি॥
কুল বেচ্যা খাইছ তুমি বয়সের কালে।
সেই মত দেখ বুঝি নাগরিয়া[১৯১] সকলে॥
কাজীরে কহিও কথা নাহি চাই[১৯২] আমি।
রাজার দোসর[১৯৩] সেই আমার সোয়ামী॥
আমার সোয়ামী সে যে পর্ব্বতের চূড়া।
আমার সোয়ামী যেমন রণ-দৌড়ের ঘোড়া[১৯৪]

আমার সোয়ামী যেমন আসমানের চান[১৯৫]
না হয় দুষমন কাজী নউখের[১৯৬] সমান॥
অপমান্যা[১৯৭] বুড়ি তুমি যাও নিজের বাড়ী।
কাজীরে কহিও কথা সব সবিস্তারি॥
দুষমন কুকুর কাজী পাপে দিল মন।
ঝাটার বাড়ী দিয়া তারে করতাম বিরম্বন॥
বাচ্যা থাকুন সোরামী আমার লক্ষ পরমাই পাইয়া।
থানের মোহর ভাঙ্গি কাজীর পায়ের লাথি দিয়া॥
আমার স্বামী কাঞ্চাসোনা অঞ্চলের ধন।
তার সঙ্গে কাজীর সোনার না হয় তুলন॥
জাতে মুসলমান কাজী তার ঘরের নারী।
মনের আপছুস মিটাক তারা সাত নিখা করি॥[১৯৮]
সেই মতে আমারে যে ভাব্যাছে লম্পটা।
কাজীরে জানাইও তার মুখে মারি ঝাটা॥
বয়সেতে বুড়া তুই মা-বাপের বড়।
তে কারণে ছাড়িলাম যাও নিজ ঘর॥”


অপমান পাইয়া তবে নেতাই কুটুনি।
সকল কথা কয় তবে কাজীর সামনি[১৯৯]
শুনিয়া দুষমন কাজী গুসা[২০০] যে হইল।
পরতিশোধ দিতে তবে সল্লা[২০১] যে আটিল॥
বিনোদের উপরে কাজী পরণা[২০২] জারি করে।
হুকম লিখিয়া দিল পরণা উপরে॥

“সাদি কইরাছ তুমি গেছে ছয়মাস।
নজর মরেচা[২০৩] রইছে তোমার অপরকাশ[২০৪]
আজি হইতে হপ্ত। মধ্যে আমার বিচারে।
নজর মরেচা তুমি দিবা দেওয়ানেরে॥
নজর মরেচা যদি নাহি দেও তুমি।
বাজেপ্ত হইব তোমার যত বাড়ী জমী॥”

পরণা হইল জারি বিনোদের উপরে।
ভাব্যা নাহি পায় বিনোদ কোন কাম করে॥
পঞ্চশত রূপ্যা[২০৫] সে যে কমবেশী নয়।
কোথায় পাইব বিনোদ ভাবয়ে চিন্তয়॥
ফানা[২০৬] বেকরার[২০৭] হইয়া ভাবিয়া চিন্তিয়া।
এই মতে হুপ্তা কাল গেল যে চলিয়া॥
আর বার পরণা কাজী জাহীর করিয়া।
বাজেপ্ত করিল জমী ঝাণ্ডা গারি[২০৮] দিয়া॥

সুখেতে আছিল বিনোদ কপালের ফেরে।
আসমান ভাঙ্গিয়া পড়ে মাথার উপরে॥
ঘরের ধান ফুরাইয়া দুঃখেতে পড়িল।
হালের বলদ বেচ্যা কিন্যা বিনোদ খাইল॥
দুধের গাই বেচ্যা খাইল ভাবিয়া চিন্তিয়া।
বিনোদের মাও কান্দে মাথা থাপাইয়া[২০৯]
রঙ্গিনা[২১০] আটচালা ঘর তাও বেচ্য। খাইল।
একখানি ঘর মাত্র বাড়ীতে রহিল॥

সেও খানি বেচে কিনা ভাবে মনে মন।
“গাছের তলাতে রইবাম করিয়া শয়ন॥
আমি রইলাম গাছের তলায় তাতে ক্ষতি নাই।
প্রাণের দোসর মলুয়ারে রাখি কোন ঠাই॥
বুড়াকালে মাও মোর বড় পাইল দুঃখ।
উবাসে কাবাসে তার শুখাইল মুখ॥”

এক দিন কয় বিনোদ মলুয়ারে চাইয়া[২১১]
“বাপের বাড়ীত যাও তুমি মায়েরে লইয়॥৷
পঞ্চ ভাইয়ের বইন তুমি দুঃখ নাহি জান।
ফুলছিট্‌কি[২১২] নাহি সয় তোমার পরাণ॥
ভালা কাপড় ভালা চোপর উবাস[২১৩] নাহি জান।
কেমন কইরা অত দুঃখ সহিবে পরাণ॥
মাও আছে বাপ আছে আছে সোদর ভাই।
ভালবাস্যা রইবে তুমি তাহাদের ঠাই॥
কড়ার ভিখারী আমি রইবাম গাছের তলে।
অত দুঃখ তোমার নাহি সহিবে শরীলে[২১৪]॥”

শুনিয়া মলুয়া তবে কহিতে লাগিল।
“বাপের বাড়ীর যত সুখ বিয়া হইতেই গেল॥
বনে থাক ছনে থাক গাছের তলায়।
তুমি বিনে মলুয়ার নাহিক উপায়॥
সাত দিনের উপাস যদি তোমার মুখ চাইয়া।
বড় সুখ পাইবাম তোমার চন্নামির্তি[২১৫] খাইয়া॥
রাজার হালে থাকে যদি আমার বাপের বাড়ী।
মলুয়া নহেত সেই সুখের আশারী[২১৬]
শাৰভাত খাই যদি গাছতলায় থাকি।
দিনের শেষে দেখলে মুখ হইবাম সুখি॥

পিরথিমির[২১৭] সুখ মোর তোমার পায়ের ধুলা।
বাপের বাড়ী না যাইবাম আমি ত একেলা॥

বিদেশে যাইতে বিনোদ মনে কৈল স্থির।
এই কথা শুন্যা মলুয়া উতকা[২১৮] অস্থির॥
“না দিব প্রাণের বন্ধু না দিব ছাড়িয়া।
ছাড়িব আভাগ্যা পরাণ উবাস করিয়া॥
আঞ্চল পাতিয়া থাকবাম গাছের তলায়।
বনেতে ঘুরিবাম ঠিক কহিলাম তোমায়॥”

(১৩)

নিদারুণ অর্থকষ্ট

নাকের নথ বেচ্যা মলুয়া আষাঢ়মাস খাইল।
গলায় যে মতির মালা তাও বেচ্যা খাইল॥
শায়ণমাসেতে মলুয়া পায়ের খাড়ু[২১৯] বেচে।
এত দুঃখ মলুয়ার কপালেতে আছে॥
হাতের বাজু বান্ধা দিয়। ভাদ্রমাস যায়।
পাটের শাড়ী বেচ্যা মলুয়া আশ্বিনমাস খায়॥
কানের ফুল বেচ্যা মলুয়া কার্ত্তিক গোয়াইল।
অঙ্গের যত সোনাদানা সকল বান্ধা দিল॥
শতালি[২২০] অঙ্গের বাস হাতের কঙ্কণ বাকী।
আর নাহি চলে দিন মুঠি চাউলের খাকী॥
ছেড়া কাপড়ে মলুয়ার অঙ্গ নাহি ঢাকে।
একদিন গেল মলুয়ার দুরন্ত উবাসে॥
ঘরে নাই লক্ষ্মীর দানা এক মুইঠ খুদ।
দিনরাইত বাড়তে আছে মহাজনের সুদ॥

শাক সাজনা খাইয়া তবে দুই দিন যায়।
দেখিয়া সোয়ামীর মুখ বুক ফাট্যা যায়॥
আপনি উবাস থাক্যা পরে নাহি কয়।
সোয়ামী-শাশুড়ীর দুঃখু আর কত সয়॥
লাজত মানের ভয় আর নাই রক্ষা।[২২১]
অখন করিবে মাত্র বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা॥

এরে দেখ্যা চান্দ বিনোদ কোন কাম করিল।
ঘরের স্ত্রীর কাছে কিছু ফুইদ[২২২] না করিল॥
মায়েরে না কইয়া বিনোদ রাত্র নিশাকালে।
বৈদেশে করিল মেলা পোঘমাস্যা দিনে॥

(১৪)

অদৃষ্টের ফের

এমন দুঃখু কালে কাজী কোন কাম করে।
ফিরিয়া পাঠাইল সেই নেতাই কুটুনিরে॥

কুট্টুনি আসিয়া কয় “বড় বাপের ঝি।
পরের লাগ্যা দুঃখু কইরা তোমার হইব কি॥
কাজীর ঘরে গেলে দাতে কাট্যা[২২৩] খাইবা সোনা।
উপাস করিয়া কেন হও ক্ষিধায় ফানা॥
এই মুইঠ চাউল নাই ঘরেতে তোমার।
এমন শরীরে দুঃখু কত সহে আর॥
ফিরিয়া পাঠাইল কাজী তোমার দোয়ারে[২২৪]
মরজি করিয়া তুমি সাদি কর তারে॥
ধান ভান সুতা কাট না সাজে তোমায়।
এমন অঙ্গে ছিড়া কাপড় শোভা নাহি পায়॥

নাকেতে বেসর নাই কানে নাই ফুল।
সর্ব্বাঙ্গ হইরাছে তোমার ধুতুরার ফুল॥
সোনায় জুড়িয়া দিব অঙ্গ যে তোমার।
কাজীরে করিয়া বাদি ঘরে যাও তার॥”

রক্তজবা আখি কন্যা কুট্টুনিরে কয়।
“কাটা ঘায়ে লুনের ছিটা আর কত সয়॥
বিদেশে গিয়াছে সোয়ামী বড় পাই তাপ।
তর মুখ দেখলে কুট্টুনি মোর বাড়ে পাপ॥
আন্ধাইরে কাটিব আমি দুঃখের দিবারাতি।
কাজীরে কহিও তার মুখে মারি লাথি॥
পরের ধান বান্যা খাই এও বড় সুখ।[২২৫]
তর কথা শুন্যা আমি বড় পাই দুখ॥
ভিক্ষা করি খাই যদি দুয়ারে দুয়ারে।
কড়ার আশা নাহি করি দুষমন কাজীর ধারে॥
পঞ্চ ভাই আছে মোর যমের সমান।
তর যে কাটিব নাক কাজীর কাটব কাণ॥
পরানে মারিব তরে মুখ থুবরিয়া।
বাপের বাড়ী দেই আগে পত্র পাঠাইয়া॥”

বৈমুখ হইয়া বুড়ী বাড়িতে ফিরিল।
কত কষ্ট করে তবু স্বীকুরি[২২৬] না গেল॥
সোয়ামী বিদেশে গেছে বাড়ী হইল খালি।
পাড়াপড়শির যত লোক করে বলাবলি॥

এই কথা শুনল যদি মলুয়ার মায়।
পঞ্চ ভাইয়েরে দিয়া খবর পাঠায়॥
সাজ্যা আইল পঞ্চ ভাই বাপের বাড়ী নিতে।
পঞ্চ ভাইরে দেখ্যা মলুয়া লাগিল কান্দিতে॥

ভাইরে বইনে মিল্যা কান্দে গলা ধরাধরি।
“এমন দুঃখের কথা কেমনে পাশরি॥
পঞ্চ ভাইয়ের বইন আছলা[২২৭] বড় আদরের।
ভাগ দেখ্যা দিলাম বিয়া কপালের ফের॥
পঞ্চ বউয়ের অঙ্গে নাহি ধরে সোনা।
তোমার অঙ্গ খানি দেখ্যা হইয়াছি ফানা॥
অঙ্গেতে মৈলান[২২৮] বসন শত জোরা তালি।
ধুলামাটী লাগ্যা বইনের অঙ্গ হইছে কালি॥
খালি ভূমে পইরা[২২৯] বইন শুইয়া নিদ্রা যায়।
শীতল পাটী ঘরে দেখ তুল্যা রাখছে মায়॥
ঘুমাইতে না পার বইন মশার কামরে।
আবের পাঙ্খা ঝালুয়াইর[২৩০] ও মশইর টাঙ্গাইল[২৩১] তোমার ঘরে॥
ভাত ফালাইয়া ভাত খাও বাপের বাড়ী।
উবাস কইরাছ বইন শুন্যা দুঃখে মরি॥
অত খেজালত আর না টানায় প্রাণে।
সোয়ারী[২৩২] পাঠাইব বল কালুকা বিয়ানে।
ধানে চাউলে গোলা ভরা কত লোকে খায়।
আমার বইনের উবাস প্রাণে বরদাস্ত না পায়॥
বার বছর পালছে মার কোলেতে করিয়া।
কড়ার কাম না করছে বইন বাড়ীতে থাকিয়া॥
আলুফা[২৩৩] জিনিস যত কেউ না খাইয়া।
ছোট বইনের লাগ্যা রাখছে ছিকায় তুলিয়া॥
এও কথা শুন্যা মাও হইছে পাগলিনী।
তিন দিন ধরা যায় না খায় অন্নপানি॥
বাপের বাড়ী না যাও যদি কাইল বিয়ানে তুমি।
উবাস থাকিয়া মায়ে ত্যজিব পরানি॥

ঘরে নাহি জ্বলে জাল[২৩৪] সন্ধ্যাকালে বাড়ি।
তেরাত্র কান্দিয়া মাও পোহাইয়াছে রাতি॥”

পঞ্চ ভাইয়ের গলা ধইরা কান্দয়ে সুন্দরী।
“কি কহিবাম দুঃখের কথা কইতে নাহি পারি॥
ভালা ঘরে দিছলা বিয়া ভালা বরের কাছে।
কেমনে খণ্ডাইবা দুঃখ কপালে যা আছে॥
শ্বশুরবাড়ীত থাকবাম আমি করিয়াছি মন।
সেইত আমার গয়া-কাশী সেইত বৃন্দাবন॥
মা-বাপের সেবা কর তোমরা পঞ্চ ভাই।
শাশুড়ীর সেবা কইরা ধর্ম্ম আমি চাই॥
ঘরেতে আছয়ে বুড়া থইয়া[২৩৫] কেমনে যাইবাম।
মায়েরে কহিও আমি সেইখান না থাকবাম॥
পঞ্চ ভাইয়ের বউ আছে দেখ্যা তারার মুখ।
কিছু ত মায়ের তবু ঠাণ্ডা রইব বুক॥
বুড়া শাশুড়ী আমার পুত্র নাই ঘরে।
কি দেখ্যা মায়ের কও এই দুঃখু পাশয়ে॥”
এই কথা শুনিয়া তবে তার পাঁচ ভাই।
জানাইল সকল কথা বাপ-মায়ের ঠাই॥

সূতা কাটে ধান ভানে শাশুড়ীরে লইয়া।
এই মতে দিন কাটে দুঃখু যে পাইয়া॥
মাঘ-ফাল্গুন গেল মলুয়ার ভাবিয়া চিন্তিয়া।
চৈত্র-বৈশাখ গেল আশায় রহিয়া॥
জ্যৈষ্ঠমাস আম পাকে কাউয়ায়[২৩৬] করে রাও।
কোন বা দেশে আছে বন্ধু নাহি জানে তাও॥
আইল আষাঢ়মাস মেঘের বর ধারা।
সোয়ামীর চান্দ মুখ না যার পশিরা॥

মেঘ ডাকে গুরু গুরু দেওয়ায় ডাকে রইয়া।
সোরামীর কথা ভাবে খালি ঘরে শুইয়া॥
শায়ন মাসেতে লোকে পূজে মনসা।
এই মাসে আইব সোয়ামী মনে বড় আশা॥
শায়ন গেল ভাদ্র গেল আশ্বিন মাস যায়।
দুর্গাপূজা আইল[২৩৭] দেশে শব্দে শুনা যায়॥
মনের দুঃখ মনে রইল আশ্বিন মাস গেল।
পূজার কালেতে সোয়ামী ঘর না আসিল॥
যার ঘরে পুত্র নাই তার কত দুঃখ।
পূজার উচ্ছবে[২৩৮] তার পরাণে নাই সুখ॥

কার্ত্তিক মালেতে বিনোদ বিদেশ কামাইয়া[২৩৯]
ঘরেতে আইল বিনোদ মায়েরে ডাকিয়া॥
দিন নাই রাইত নাই মায়ের আখি ঝুড়ে।
মা বলিয়া কে ডাকল আইজ দুঃখিনী মায়েরে॥
কামাইর টাকা দিয়া বিনোদ নজর আদি দিল।
বাজেপ্ত[২৪০] আছিল জমী খালাস হইল॥
আটচালা বান্ধিল বিনোদ যতন করিয়া।
হরষিতে শুইল বিনোদ মলুয়ারে লইয়া॥
বিরহ-বিচ্ছেদের কথা দুঃখের কাহিনী।
একে একে বিনোদেরে শুনায় কামিনী॥
মেওয়া মিশ্রি সকল মিঠা মিঠা গঙ্গাজল।
তার থাক্যা মিঠা দেখ শীতল ভাবের জল॥
তার থাক্যা মিঠা দেখ দুঃখের পরে সুখ।
তার থাক্যা মিঠা যখন ভরে খালি বুক॥
তার থাক্যা মিঠা যদি পায় হারানো ধন।
সকল থাক্যা অধিক মিঠা বিরহে মিলন॥

( ১৫ )

দুরন্ত সমস্যা

এই মতে সুখে দুঃখে দিন বইয়া যায়।
অপরেতে হইল কিবা শুন সমুদায়॥
দুরন্ত দুষমন কাজী কোন কাম করে।
সল্লা করিয়া বিনোদেরে ফালাইল ফেরে॥
পরণা করিল জারি বিনোদের উপর।

“পরমা সুন্দর নারী আছে তোমার ঘর॥
সিন্দুকি[২৪১] জানাইল বার্ত্তা দেওয়ান সাবের কাছে।
পরীর মত নারী এক তোমার ঘরে আছে॥
পরণা করলাম জারি তোমার উপর।
আজি হইতে হপ্তাকাল দিনের ভিতর॥
তোমার ঘরের নারী দিবা দেওয়ানের কাছে।
এতেক করিলে তোমার গর্দ্দান যদি বাচে॥
হপ্তা হইলে পার হইবে মরণ।
পরণা করিলাম জারী এই বিবরণ॥”

হাটুতে পাতিয়া মাথা চিন্তে বিনোদ ঘরে।
হরিণা পড়িল যেমন বাঘের কামরে॥
যমে মাইন্‌ষে[২৪২] টানাটানি বিনোদে লইয়া।
দারুণ বিধাতা দিছে কপালে লিখিয়া॥
হপ্তা হইলে পার পেয়াদা মির্দ্দা আসি।
ধরিয়া বাধিয়া বিনোদের গলায় দিল ফাঁসী॥
বিনোদেরে ধইর‍্যা নেয় কাজীর বরাতে[২৪৩]
বিচার করিয়া কাজী লাগিল কহিতে॥
“হুকুম তামিল নাই করহ আমার।
রাখিছ সুন্দর নারী ঘরে আপনার॥”

হুকুম করিল কাজী পেয়াদা পশ্চানে[২৪৪]
“বিনোদেরে নইয়া যাও নিরলইক্ষার ময়দানে॥
জেতায়[২৪৫] রাখিয়া তারে কব্বরে মাটি দিও।
তার ঘরের নারীরে কাড়িয়া আনিও॥
জাজিরপুরে বাস করে দেওয়ান জাহাঙ্গির।
তাহার হাউলীতে[২৪৬] নিয়া করিও হাজির॥

হুকুম পাইয়া যত পেয়াদা মির্দ্দাগণ।
বিনোদে ধরিয়া লয় নিরলইক্ষার চর॥
বিনোদের মায় কান্দে মাটিতে পড়িয়া।
“হায় হায় আমার যাদু গেলরে ছাড়িয়া॥
যমে যদি নিত পুত্রে না থাকিত আড়ি।
মাইন্‌ষের হাতে গেল প্রাণ কেমনে পাশরি[২৪৭]
পিঞ্জরের পাখী মোর হৃদয়ের নলি।
একেবারে গেল মোর বুক কইর‍্যা খালি॥”

শিয়রে বইস্যা মলুয়া মায়েরে বুঝায়।
মলুয়ার চক্ষের জলে জমিন ভাইস্যা যায়॥
কান্দিয়া কাটিয়া মলুয়া কোন কাম করে।
পঞ্চ ভাইয়ে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে[২৪৮]
বিনোদে ধরিয়া নিল কাজীর পেয়দায়।
কাজীর হুকুম কথা লিখে সমুদায়॥
পত্র লিখিয়া মলুয়া কোন কাম করে।
কোড়ার মুখে দিল পত্র অতি যতন করে॥
বহুকালের পালা কোড়া ইসারাতে জানে।
উইরা গেল সোণার কোড়া ভাইয়ের বির্দ্দমানে॥

পত্র পইড়্যা পঞ্চ ভাই কোন কাম করে।
লাঠি-ঝাটা লইয়া যায় নিরলইক্ষার চরে॥
হারামি কাজীর পেয়াদা কাটিতে কবর।
পঞ্চ ভাই উপনীত হইল তদান্তর॥
লাঠি মাইর‍্যা বিনোদেরে আছান[২৪৯] করিল।
মলুয়া বইনের কাছে পাছুরী[২৫০] চলিল॥

দেখে বিনোদের মাও মাটিতে পড়িয়া।
আছাড়ি পাছাড়ি কালে পুত্রেরে ডাকিয়া॥
শুন্য ঘর পইড়্যা রইছে নাহিক সুন্দরী।
রাবণে হরিয়া নিছে শ্রীরামের নারী॥
খালি পিজরা পইড়া রইছে উইরা গেছে তোতা।
নিব্যাছে নিশার দীপ কইরা আন্ধাইরতা[২৫১]
পঞ্চ ভাইয়ে গড়াগড়ি মাটিতে পড়িয়া।
চান্দ বিনোদে কান্দে মলুয়ারে ডাকিয়া॥
বুকের পাঞ্জর ভাঙ্গে বিনোদের কান্দনে।
যার অন্তরায় দুঃখ সেই ভাল জানে॥

“পইরা রইছে জলের কলসী আছে সব তাই[২৫২]
ঘরের শোভা মল্লু আমার কেবল ঘরে নাই॥
পইরা রইছে ঘর-দরজা পাটির বিছানা।
কোন জনে হরিয়া নিছে আমার কাঞ্চা সোনা॥
পইরা রইছে বাগ-বাগিচা সকলি আন্ধাই।
কোন বা পথে গেল মনুয়া উদ্দিশ না পাই॥”

কান্দিয়া কাটিয়া বিনোদ কোন কাম করে।
হাইরা[২৫৩] পিজরার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসে কোড়ারে॥

“বনের কোড়া মনের কোড়া জন্মকালের ভাই।
তোমার জন্য যদি আমি মল্লুর উদ্দিশ পাই॥”
মায়েরে লইয়া বিনোদ কোড়া সঙ্গে লইল।
বাড়ীঘর ছাইড়া বিনোদ দেশান্তর হইল॥


( ১৬ )

দেওয়ান সাহেবের হাউলীতে মলুয়া

হাউলাতে বসিয়া কান্দে মলুয়া সুন্দরী।
পালঙ্ক ছাড়িয়া বসে জমীন উপরী॥
আরাম খানা আরাম পিনা আইন্যাছে বান্দিরা।
সাম্‌নে খাড়া দেওয়ান সাব মাথার দিছে কিরা[২৫৪]

“আমার মাথা খাও কন্যা আমার মাথা খাও।
দুষ্মনি করিয়া আর মোরে না ভারাও॥
আরাম খানা খাইয়া বস পালঙ্ক উপরে।
পিত্থিমীর সুখ আইন্যা দিবাম তোমারে॥
দিল্লি হইতে আইন্যা দিবাম অগ্নি-পাটের সাড়ি।
নাকের বেসর দিবাম তোমার কাঞ্চা সোণায় গড়ি।
বান্দী দাসী আছে যত লেখাযুখা নাই।
অনুগত হইর। তারা মানিবে ফরমাই (স)॥
পালঙ্কে বলিয়া তুমি করিবে আরাম।
জনাবে থাকিবে বান্দা হইয়া গোলাম॥”

হরিণা পড়িয়া যেমন বাঘের কামড়ে।
কাইন্দা কাইন্দা কয় মলুয়া দেওয়ানের গোচরে॥
“বার মাসের বর্ত্ত[২৫৫] মোর নয় মাস গেছে।
পরত্তিষ্টা[২৫৬] করিতে আর তিন মাস আছে॥
শুন শুন দেওয়ান সাব কহি যে তোমারে।
পরতিজ্ঞা করহ তুমি আমার গোচরে॥

না খাইব উচ্ছিষ্ট অন্ন না ছুইব পানি।
এক জালে খাইব অন্ন আলু ও আলুনি॥
পালঙ্কে শুইতে মোর দেবের আছে মানা।
জমিনে শুইব আমি আঁচল বিছানা॥
পরাচিত্ত[২৫৭] করি আমি ব্রত না ভাঙ্গিব।
পরপুরুষের মুখ কভু না দেখিব॥
এই তিন মাস মোর না আইস অন্দরে।
সময় হইলে গত বলিবাম তোমারে॥
এহার অন্যথা হইলে হইবা দুষ্মন।
বিষ-পানী খাইয়া আমি ত্যজিবাম জীবন॥”

এক মাস দুই মাস তিন মাস গেল।
তিন মাস পরে দেওয়ান কোন কাম করিল॥
মুখেতে সুগন্ধি পান অতি ধীরে ধীরে।
সুনালী[২৫৮] রুমাল হাতে দেওয়ান পশিল অন্দরে॥
দেওয়ানে দেখিয়া মলুয়া বড় ভয় পাইল।
বাঘের কামড়ে যেন হরিণা পড়িল॥

“তিন মাস গেছে কন্যা ভাড়াইয়া আমায়।
সত্য করিয়াছ কন্যা ভাবিতে যোয়ায়[২৫৯]
জমিন ছাড়িয়া আস পালঙ্ক উপরে।
অন্তরে হইয়া খুসী ভজহ আমারে॥
দিলারাম কন্যা তুমি কর দেল খোস।
তোমার স্বামীর মুক্ত করব না রইব আপ্‌শোষ॥”

কন্যা বলে “কাজী মোরে বড় দুঃখ দিল।
অবিচার করি মোর সোয়ামীরে মারিল॥
কিবা মুক্তি দিবা স্বামীর কি কহিবাম তোমারে।
জেতায় রাখ্যা কবর দিছে নিরলইক্ষার চরে॥

হেন কাজী থাক্‌তে নহে মনের মিলন।
যত দুঃখ দিল কাজী না হয় পাশরণ॥”

হুকুম করিয়া দেওয়ান কোটালেরে বলে।
“কাজীরে ধরিয়া শীঘ্র দেও নিয়া শূলে॥”
পরণা হুকুম লইয়া পেয়াদা মির্দ্দা যায়।
ঐদিনে মনের দুঃখ মলুয়া মিটায়॥
খুসী হইয়া মলুয়া তবে দেওয়ানে কহিল।
“বার মাসের বার দিন বাকী মাত্র রইল॥
এই বার দিন তুমি বারদস্তি করিয়া।
কোড়া শিকারে যাইতে সাজাও ভাওয়ালিয়া[২৬০]
জানহ সোয়ামী মোর ভালত শিকারী।
সদাকাল ঘরে থাকি আমি তার নারী॥
বিস্তর জানিলাম আমি শিকারের ফন্দি।
একেবারে শতেক কোড়া করি আমি বন্দি॥”

দিন ক্ষেণ সুস্থির হইল যাইতে শিকারে।
হেথায় সুন্দরী কন্যা কোন কাম করে।
ভাইয়ের কাছে পত্র লেখে সন্ধান করিয়া।
যত্ন করি পালা কোড়া দিল উড়াইয়া॥
পঞ্চ ভাইয়ে পত্র পাইয়া পান্‌সী নাও করে[২৬১]
ছল করিয়া তারা কোড়া শিকার ধরে॥
বিস্তার[২৬২] ধলাই বিল পদ্মফুলে ভরা।
কোড়া শিকার করতে দেওয়ান যায় দুপুর বেলা॥
সঙ্গেতে মলুয়। কন্যা পরমা সুন্দরী।
পান্‌সী লইয়া পঞ্চ ভাই লইলেক ঘেরী॥

লাঠির বাড়ীতে ছিল যত দায়ী মাঝি।
উবুত[২৬৩] হইয়া জলে পড়ে করে কাজিমাজি[২৬৪]
পঞ্চ ভাইয়ের পান্‌সীখানা দেখিতে সুন্দর।
লম্ফ দিয়ে উঠে কন্যা তাহার উপর॥
আষ্ট দারে মারে টান জ্ঞাতি বন্ধুজনে।
পঙ্খী উড়া করে পান্‌সী ভাইঙ্গা পদ্মবনে॥
সোয়ামী সহিত মলুয়া যায় বাপের বাড়ী।
ছীরাম উদ্ধার করে যেন আপনার নারী॥


( ১৭ )

আত্মীয়গণের নিষ্ঠুরতা

এ দিকে হইল কিবা শুন দিয়া মন
দুষ্মনি করিল যত জ্ঞাতি বন্ধুগণ॥
কেহ বলে মনুয়া যে হইল অসতী।
মুসলমানের অন্ন খাইয়া গেল তার জাতি॥
তিন মাস ছিল মলুয়া দেওয়ান সাবের ঘরে।
কেমনে রাখিল প্রাণ না জানি কি মতে॥

বিনদের মামা সে যে জাতিতে কুলীন।
হালুয়া দাসের গুষ্ঠীর মধ্যে সেই ত প্রবীন॥
“ভাইগ্‌না[২৬৫] বউয়ের হাতের ভাত খাইতে নাহি পারি।
জাতিতে উঠুক বিনোদ পরাচিত্তি করি॥”
সম্বন্ধে বিনোদের পিসা কুলের বড় জাঁক।
সে কয় “আমার কথা না শুনিলে পাপ॥
তিন মাস রইল কন্যা দেওয়ান সাহেব ঘরে।
কি দিয়া রাইখ্যাছে পরান কে কহিতে পারে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া বিনোদ কোন কাম করিল।
ব্রাহ্মণের পাতি[২৬৬] দিয়ে পরাচিত্তি করিল॥

পরাচিত্তি করিয়া বিনোদ তাজে ঘরের নারী।
আন্ধারে লুকাইয়া কান্দে মনুয়া সুন্দরী॥
“কোথা যাই কারে কই মনের বেদন।
স্বামীতে[২৬৭] ছাড়িল যদি কি ছাড় জীবন॥”

পঞ্চ ভাইয়ে বলে “বইন না কান্দিও তুমি।
শীঘ্র কইরা বাপের বাড়ী লইয়া যাইবাম আমি॥
ভাত-কাপড়ের অভাব নাই চিন্তা না করিও।
বাপের বাড়ী থাকবা তুমি পরম সুখী হইও॥”

বাপে বুঝায় ভাইয়ে বুঝায় না বুঝে সুন্দরী।
“বাইর কামুলী[২৬৮] হইয়া আমি থাকবাম সোয়ামীর বাড়ী॥
গোবর ছিডা[২৬৯] দিয়াম আমি সকাল-সন্ধ্যাবেলা।
বাইরের যত কাম আমি করিবাম একালা॥
অন্নজল না নিতে না পারিব আমি।
ভালা দেইখ্যা বিয়া কর সুন্দরী কামিনী॥”
পঞ্চ ভাইয়েরে মলুয়া কয় মাথার কিরা দিয়া।
“ভাল দেইখ্যা সোয়ামীরে আগে করাও বিয়া॥
বুড়ি শাশুড়ী মোর না দেখে না শুনে।
কেমন কইর‍্যা কাটবে দিন এমন গুজরাণে[২৭০]॥”

জ্ঞাতি বন্ধু মিলি তবে বিবাহ করায়।
বাইর কামুলী মলুয়ার মনে দুঃখ নাহি পায়॥
বাইর কামুলীর কাম করে মনের সন্তোষে।
সতীনেরে রাখে কন্যা মনের হরষে॥
তথাপি মলুয়া নাহি যায় বাপের বাড়ী।
যতন করিয়া সেবে সোয়ামী-শাশুড়ী॥

(১৮)

মৃতের জীবনপ্রাপ্তি

শুইয়াছিল অভাগী মাও আপনার ঘরে।
স্বপন দেখিল সে রাত্র নিশাকালে॥
ঘুমতে উঠিয়। বিনোদ ভাতের দিন তাড়া।
অভাগী মায় উইঠ্যা বলে চাউল নাই কাড়া[২৭১]
বিনোদ কহিছে মাও শুন মোর কথা।
“শীগ্‌গীর কইরা রান্ধ ভাত খাও মোর মাথা॥
কোড়া-শিকারে আমি যাইবাম দূর স্থানে।
বিদায় মাগিছি মাও তোমার চরণে॥”

রাঁধিতে বাড়িতে ভাত দেরী নাহি সয়।
ঘরে ছিল পানিভাত তাই খাইয়া লয়॥
পানিভাত খাইয়া বিনোদ পন্থে মেলা দিল।
কোড়া-শিকারেতে যাইতে মায়ে পন্নামিল[২৭২]
ডাইন হাতে হাইরা পিজ্‌রা বাম হাতে কোড়া।
দুপইরা কালে বিনোদ পন্থে দিল মেলা॥
পন্থে আছিল বইনের বাড়ী উঠিয়া বসিল।
ভাইয়েরে দেখিয়া বইন কান্দিতে লাগিল॥
হেথা হইতে চলে বিনোদ বইনেরে কহিয়া।
গহিন[২৭৩] কাননে গেল কোড়া হাতে লইয়া॥
দুর্ব্বাক্ষেত্রের মধ্যে বিনোদ কোড়া হালা[২৭৪] দিল।
হাইরা পিজ্‌রা হাতে লইয়া কোড়ারে ছাড়িল॥

কোড়া না ছাড়িয়া বিনোদ কোন কাম করিল।
বন ছোবার[২৭৫] আড়ালে বিনোদ আসিয়া বসিল॥

ছোবায় ছিল কালসাপ কোন কাম করিল।
কানি আঙ্গুলের মাঝে ছোব যে মারিল॥
কালকূট বিষ হায়রে উজান ধাইল।
মস্তকে উঠিল বিষ ঢলিয়া পড়িল॥

“উইরা যাওরে পশুপাঙ্খী কইও মায়ের আগে।
আমি বিনোদ মারা গেলাম এই জঙ্গলার মাঝে॥
সাক্ষী হইও চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী হইও তুমি।
বিনা দোষে কালনাগে দংশিল মোর পরাণী॥
কোন জনে জানাইব কথা অভাগিনী মায়।
জন্মের মত না দেখিলাম সুন্দর মলুয়ায়॥
বাড়ীঘর পইরা রইল বেবান্[২৭৬] পান্থরে[২৭৭]
বাড়ীঘর থইয়া বিনোদ এইখানে মরে॥”
পন্থেতে পথিক যায় “কোন বা দেশে ঘর।
মায়ের কাছে কইও আমার এইনা খবর॥
সন্ধ্যাবেলা খবর দিল পথের পথিকে।
“তোমার বিনোদ মারা গেল পড়িয়া বিপাকে॥”

আউলাইয়া মাথার কেশ পন্থে মেলা দিল।
যেখানে বিনোদ মাও তথায় চলিল॥
নাকেতে নিশ্বাস নাই মুখে নাই কথা।
ভূমে আছাড় খাইয়া পড়ে অভাগিনী মাতা॥
ধরাধরি কইরা সবে বিনোদ আনে বাড়ী।
ভূমেতে পড়িয়া কান্দে মলুয়া সুন্দরী॥

“হায় প্রভু কোথা গেলা অঞ্চলের ধন।
তোমারে ছাড়িয়া কেম্‌নে রাখিবাম জীবন॥
তোমারে থইয়া কেন মোরে না খাইল নাগে।
বাইর কামুলীরে নাহি খায় জঙ্গনার বাঘে।
বাইরে থাকি বাইর কামুলী বাইরের কাম করি।
সোয়ামীর মুখ চাইয়া আমি সকল পাশরি॥

সেও সাধে বিধাতা মোর উড়াইল ছাই।
জীবন রাখিতে মোর আর ইচ্ছা নাই॥
আগুনে পশিব আমি প্রভু কোলে লইয়া৷
জলেতে ডুৰিব আমি সকল ছাড়িয়া॥
হিজল গাছের ডালে টাঙ্গাইৰ ফাঁসী।
হাম অভাগী নারী কোন বা দোষের দোষী॥

খবর পাইয়া পঞ্চ ভাই আসিলেক ধাইয়া।
পঞ্চ ভাই কান্দে বসি মরা কোলে লইয়া॥
মুখের লাল বাইয়া পরে চক্ষের মণি ধুয়া[২৭৮]
“কেমন কইরা কাটাইলে আমাদের মায়া॥
পঞ্চ ভাইয়ের বইনে সইপ্যা দিলাম তোমার করে
রাড়ী হইয়া বইন আমার কেমনে থাকবে ঘরে॥
তিন দোষে দোষী বইন সেও ছিল ভালা।
রাড়ী হইয়া সইব কেমনে কালবিষের জ্বালা॥
হাতেতে সোণার শঙ্ক কেমনে ভাঙ্গিব।
দুঃখের বদন বইনের কেমনে দেখিব॥”

“না কাইন্দ না কাইন্দ ভাই আমার কথা শুন।
পরীখাইয়া[২৭৯] দেখি একবার আছে কিনা প্রাণ॥
ঘাটেতে আছে বাঁধা মন পবনের নাও।
শীঘ্র লইয়া তারে ওঝার বাড়ী যাও॥”

পাচ ভাইয়ে পাচ দাড় নায়েতে উঠিল।
মরা স্বামী কোলে লইয়া মলুয়া বসিল॥
গাড়রী[২৮০] ওঝার বাড়ী সাত দিনের আড়ি[২৮১]
এক দিনে গেল মলুয়া গাড়রীর বাড়ী।
নাকমুখ দেইখ্যা ওঝা মাথায় থাপা[২৮২] দিল।
বুকেতে আনিয়া বিষ কোমরে নামাইল॥

কোমরে আনিয়া বিষ হাটুতে নামাইল।
হাটুতে আনিয়া বিঘ্ন পায়ে নামাইল॥
পাতালেতে কালনাগ চুমকে লইল।
যখনে নাগিনী বিষ চুমকে[২৮৩] লইল॥
বিষজ্বালা গেল বিনোদ আখি মেইল্যা চাইল।

পতি জিয়াইয়া সতী ফিইর‍্যা আইল ঘরে।
জয় জয় ধ্বনি হইল জুড়িয়া নগরে॥
কেউ বলে “বেহুলা জিয়াইল লক্ষ্মীন্দরে।”
কেউ বলে “সতী কন্যা গেছিল দেবপুরে॥
হালুয়া দাসের গোষ্ঠী করিতে উদ্ধার।
বংশাইয়া[২৮৪] সতী কন্যা হইল অবতার॥
পান ফুল দিয়া কন্যায় তুইল্যা লও ঘরে।
সতী কন্যা হইয়া কেন কামুলির কাম করে॥
মরা পতি জিয়াইয়া আনে যেই নারী।
তাহারে সমাজে লইতে কেন দৈমত[২৮৫] করি॥”


( ১৯ )

শেষ দৃশ্য

বিনোদের মামা বলে হালুয়ার সরদার।
“যে ঘরে তুলিয়া লইবে জাতি যাইবে তার॥”
বিনোদের পিশা কয় ভাবিয়া চিন্তিয়া।
“ঘরেতে না লইব কন্যা জাতিধর্ম ছাড়িয়া॥”
দুঃখিনী দুঃখের কন্যা দুঃখে দিন যায়।
এত দুঃখ ছিল তার কইতে না যোয়ায়॥

শিশু বেলার বড় সুখ বাপে-ভাইয়ে দিল।
মায়ের কোলে থাইক্যা কন্যা বড় সুখ পাইল॥
মায়ের নয়নতারা নয়নের মণি।
ফুল ছিট্‌কীর পরি নাহি সহিছে পরাণী॥
পাচ ভাইয়ের থাইক্যা[২৮৬] কন্যার ছিল দর[২৮৭]
এমন কন্যার দুঃখ না সহে অন্তর॥
ভাৰিয়া চিন্তিয়া মলুয়া না দেখে উপায়।
আপনি থাকিতে নাহি স্বামীর দুঃখ যায়॥
বদনাম কলঙ্ক যত না যাইব সোয়ামীর।
পরাণ ত্যজিবে কন্যা মনে কৈল স্থির॥

ঘাটেতে আছিল বান্ধা মন-পবনের নাও।
দুপুরিয়া কালে কন্যা নাওয়ে দিল পাও॥
ঝলকে ঝলকে উঠে ভাঙ্গা নাও সে পানি।
কতদূরে পাতালপুরী আমি নাহি জানি॥
উঠুক উঠুক আরও জল নায়ের বাতা বাইয়া।
বিনোদের ভগ্নি আইল জলের ঘাটে ধাইয়া॥

“শুন শুন বধূ ওগো কইয়া বুঝাই তরে।
ভাঙ্গা নাও ছাইড়া তুমি আইস মোদের ঘরে॥”
“না যাইব ধরে আর শুনহে ননদিনী।
তোমরা সবের মুখ দেইখ্যা ফাটিছে পরাণী॥
উঠুক উঠুক উঠুক পানি ডুবুক ভাঙ্গা নাও।
জন্মের মত মলুয়ারে একবার দেইখ্যা যাও॥”

দৌইড়া আইল শাশুড়ী আউলা মাথার কেশ।
বস্ত্র না সম্বরে মাও পাগলিনীর বেশ॥
“শুন গো পরাণ বন্ধু কইয়া বুঝাই তরে।
ঘরের লক্ষ্মী বউ যে আমার ফিইরা আইস ঘরে॥

ভাঙ্গা ঘরের চান্দের আলো আন্ধাইর ঘরের বাতি।
তোমারে না ছাইড়া থাকিবাম এক দিবারাতি॥”
“উঠুক উঠুক উঠুক পানি ডুবুক ভাঙ্গা নাও।
বিদায় দেও মা জননী ধরি তোমার পাও॥”

ভাঙ্গা নায়ে উঠল পানি করি কল কল।
পাড়ে কান্দে হাউড়ী[২৮৮] নাও অৰ্দ্ধেক হইল তল॥
একে একে দৌইড়া আইল গর্ভ-সোদর ভাই।
জ্ঞাতি বন্ধু আইল যত লেখাযুখা নাই॥
পঞ্চ ভাইয়ে ডাইক্যা কয় সোনা বইনের কাছে।
“ভাঙ্গা নায়ে উইঠ্যা বইন কোন বা কার্য্য আছে॥
বাপের বাড়ী যাইতে সোয়াদ[২৮৯] কও সত্য করিয়া।
পঞ্চ ভাইয়ে লইয়া যাইব সোনার পান্‌সী দিয়া॥”

“না যাইবাম না যাইবাম ভাই আর সে বাপের বাড়ী।
ভাইয়ের কাছে বিদায় মাগে মলুয়া সুন্দরী॥
উঠুক উঠুক উঠুক জল ডুবুক ভাঙ্গা নাও।
মলুয়ারে রাইখ্যা তোমরা আপন ঘরে যাও॥”

বাতা বাইয়া উঠে পানি ডুবে ভাঙ্গা নাও।
“দোইড়া আস চান্দ বিনোদ দেখ্‌তে যদি চাও॥”
দৌইড়া আইস্যা চান্দ বিনোদ নদীর পাড়ে খাড়া।
“এমন কইরা জলে ডুবে আমার নয়নতারা॥
চালসূরুজ ডুবুক আমার সংসারে কাজ নাই।
জ্ঞতি বন্ধু জনে আমি আর ত নাই চাই॥
তুমি যদি ডুব কন্যা আমায় সঙ্গে নেও
একটিবার মুখে চাইয়া প্রাণের বেদন কও॥
ঘরে তুইল্যা লইবাম তোমায় সমাজে কাজ নাই।
জলে না ডুবিও কন্যা ধর্ম্মের দোহাই॥”

“গত হইয়া গেছে দিন আরত নাই বাকী।
কিসের লাইগ্যা সংসারে কাজ আর বা কেন থাকি॥
আমি নারী থাক্‌তে তোমার কলঙ্ক না যাবে।
জ্ঞাতি বন্ধু জনে তোমায় সদাই ঘাটিবে[২৯০]
কলঙ্কজীবন মোর ভালাইব সাগরে।
এখান হইতে সোয়ামী মোর চইল্যা যাও ঘরে॥
ঘরে আছে সুন্দর নারী তার মুখ চাইয়া৷
সুখে কর গির-বাস[২৯১] তাহারে লইয়া॥
উঠুক উঠুক উঠুক পানি ডুবুক ভাঙ্গা নাও।
অভাগারে রাইখ্যা তুমি আপন ঘরে যাও॥
বাতা বাইয়া উঠুক পানি মাইজ-দরিয়ার কোলে।”
জ্ঞাতি বন্ধু জনে কন্যা ডাক দিয়া বলে॥
“বড় দোষের দোষী যেই সেও যায় চলি।
খোটা উষ্ঠা যত দোষ আমার সকলি।
কপালে আছিল দুঃখ না যায় খণ্ডনে।
কোন দোষের দোষী নয় আমার সোয়ামী॥”


“শুনগো শাশুড়ী মোর শত জন্মের মাও।
এইখানে থাইক্যা পন্নাম আমি জানাই তোমার পাও॥”
সুন্দরী মলুয়া কয় সতীনে ডাকিয়া।
“সুখে কর গির-বাস সোয়ামী লইয়া॥
আজি হইতে না দেখিবা মনুয়ার মুখ।
আমার দুঃখ পাশরিবা দেইখ্যা স্বামীর মুখ॥”


পূবেতে উঠিল ঝড় গর্জিয়া উঠে দেওয়া।
এই সাগরের কূল নাই ঘাটে নাই খেওয়া॥

“ডুবুক ডুবুক ডুবুক নাও আর বা কত দূর।
ডুইব্যা দেখি কতদূরে আছে পাতালপুর॥”

পূবেতে গর্জিল দেওয়া ছুটল বিষম বাও।
কইবা গেল সুন্দর কন্যা মন-পবনের নাও॥

সমাপ্ত

  1. নাগান্ত = নাগ, অনন্ত?
  2. আদ্যের তুলসী = দেখা যায় বৈষ্ণবদের ন্যায় ধর্ম্মপূজকেরাও তুলসীর মাহাত্ম্য স্বীকার করিয়াছেন।
  3. কুনা=কোণ।
  4. সলাভ্য=?
  5. মন্দান্যা= মন্দ মন্দ। ন্যা=না, এই “না” কথার কোন অর্থ নাই, “ন্যা” বা “না”-এর অর্থ অনেক সময় “হাঁ”। কোন উক্তিতে জোর দেওয়ার জন্য উহা ব্যবহৃত হয়; যথা “এই না ভাবিয়া কন্যা কোন কাম করে।” এই স্থলে “এই না ভাবিয়া” অর্থ ‘এই ভাবিয়া’—এই পুস্তকেই এইভাবে “না”-এর ব্যবহারের অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইবে।
  6. আইশ্‌নারে=আশ্বিনের; আইশ্‌না = আশ্বিনা, “রে” পাদ-পূরণে।
  7. মন্দ মন্দ আশ্বিনের জল করিতে আরম্ভ করিল।
  8. মাও=মা (যথা, পদ=পাও=পা পূর্ববঙ্গে এরূপভাবে ‘ও’কার অনেক পদে পাওয়া যায়)।
  9. ভালা=ভাল (ভাল করিয়া)।
  10. আগণ=অগ্রহায়ণ।
  11. কার্ত্তিকা সাইল=কার্ত্তিকের শালি ধান্য।
  12. গুরু গুরু ডাকিয়া যেন জলকে জাগাইয়া তুলিয়াছে।
  13. দেওয়ায় = মেঘ (দেওয়ায় = দেবে); রইয়া = রহিয়া রহিয়া।
  14. উভে = সম্পূর্ণ রূপে।
  15. কিশ্যি=কৃষি।
  16. কুলের = কোলের; ময়মনসিংহের অনেক স্থলে ‘ও’কারের স্থানে ‘উ’কার ব্যবহৃত হয়।
  17. ছাল্যা=ছেলে
  18. ষরু = ‘সরু শস্য’ যথা সরিষা
  19. উষ বা ওষ= হিম।
  20. মইষ=মহিষ।
  21. মায়ত = মায়, মা।
  22. দোয়াতে = আশীর্ব্বাদে।
  23. আগুণ = অগ্রহায়ণ।
  24. উত্তরিয়া = উত্তর দিক্ হইতে আগত।
  25. ছিড়া = ছিন্ন, ছেঁড়া।
  26. মুরি= ঘেরিয়া।
  27. দানা = চাউল।
  28. ধারের কাচি = তীক্ষ্ন কাস্তে।
  29. পূর্ব্ববঙ্গে “বাতা” শব্দ নানা স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা অঞ্চলে বেড়া আট্‌কাইবার জন্য উহার মধ্যে মধ্যে যে চাঁছা বাঁশ ব্যবহৃত হয়, তাহাকে বাতা বলে। কিন্তু ময়মনসিংহে ঐরূপ ব্যবহারের জন্য “বাতা” নামক একরূপ স্বতন্ত্র গাছই পাওয়া যায়।
  30. ডুগল = অগ্রভাগ। প্রথম দিন ধান ফাটিবার সময়ে কৃষকেরা পাঁচটি বাতা গাছের অগভাগ লইয়া ক্ষেত্রে যায়, তাহা সিন্দুর প্রভৃতি মাঙ্গলিক দ্রব্যে অনুলিপ্ত হয়। এই বাতার পাঁচটি ‘ডুগলের’ সঙ্গে পাঁচটি ধান্যের ছড়া বাঁধা হয়, তাহাই কৃষকেরা লক্ষ্মীর আসন মনে করিয়া ঘরের কোণে বিশিষ্ট জ্বলে তুলিয়া রাখে।
  31. এরে=ইহা।
  32. এক আড়া = ৪ মণ।
  33. আকাল = অকাল, দুর্ভিক্ষ।
  34. পোষা আন্ধি=পৌষ মাসের কুয়াসার অন্ধকার।
  35. মাজনে = মহাজনকে।
  36. খোলা = ক্ষেত শব্দের সঙ্গে খোলা শব্দ অনেক সময় একত্র ব্যবহৃত হয়, ইহার বিশেষ কোন অর্থ আছে বলিয়া বোধ হয় না।
  37. পিঁজরা =পিঞ্জর, পাথী রাখিবার খাঁচা।
  38. শীগারে = শিকারে।
  39. ঘরতনে=ঘর হইতে।
  40. বিলাতের=বিদেশ-গমনোদ্যত।
  41. পবনের নাই বাও=পবন দেবতা বাতাস দিচ্ছেন না; বাও = বাতাস।
  42. আগরাঙ্গ্যা = অগ্রভাগ যাহার পাকিয়া রাঙ্গা হইয়াছে।
  43. পাক্যা = পাকিয়া।
  44. গিষ্ঠেতে = গিঠে, গেড়ো দিয়া কাপড়ে বান্ধিল।
  45. মেলা কইরা = যাত্রা করিয়া।
  46. পালা =পোষা।
  47. জিল্কি = বিদ্যুৎ।
  48. ঠাডা = ঠাঠা = বজ্র।
  49. পুইরা = পুড়িয়া (দুশ্চিন্তায়)।
  50. কুড়ার ডাকেতে—নমুনা = কুড়া পাখীর ডাকে বর্ষা আসিতেছে আভাসে বুঝা যায়।
  51. গেরাম=গ্রাম
  52. আন্ধ্যাপুখুর=যে পুকুর নানারূপ গুল্মলতায় আবৃত।
  53. চাইর=চারি
  54. পন্থ=পথিক। আনাগুনা=আনাগোনা।
  55. চলিত কথায় সে অঞ্চলে “তল” শব্দের “তুল’ উচ্চারণও শোনা যায়। এই সকল গ্রাম্য কবির কবিতা এইজন্য উচ্চারণ হিসাবে দোষযুক্ত হয় নাই। ফুলের সঙ্গে তুল মিলিয়া যায়।
  56. জেঠ=জ্যৈষ্ঠ।
  57. আরি=জের, ইচ্ছা।
  58. থইয়া=রাখিয়া।
  59. লামিল=নামিল।
  60. অঘুরে=একান্ত অভিভূত হইয়া।
  61. পাটে=আসনে।
  62. আইত=আসিত।
  63. কইয়া বুল্যা=ব’লে ক’য়ে।
  64. শুধা = শূন্য।
  65. ডাগল = ডাগর, বড়।
  66. জলের পদ্ম স্থলে ফুটিয়া রহিয়াছে। মঞ্চেতে = মর্ত্তে, পৃথিবীতে। মঞ্চেতে ভরিয়া, আকাশের তারা পৃথিবী ভরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে।
    উইরে=উড়িয়া।
  67. ‘না’ শব্দের অর্থ নাই।
  68. বাচ্যা = বাঁচিয়া।
  69. ডাক্যা = ডাকিয়া
  70. আউলা ঝাউলা=এলোমেলো।
  71. খুলা = খোলা।
  72. আবের কাকই=অভ্র-খচিত চিরুণী।
  73. আইলা = এলায়িত, এলো। রাতির—বান্ধিয়া=রাত্রিকালে তোমার কুঞ্চিত কেশ এলাইয়া গিয়াছে, তাহা বান্ধিয়া দিব।
  74. চাচর = কুঞ্চিত।
  75. তরে=তোরে।
  76. চণ্ডাল=রাহু।
  77. হালুয়া দাস=হেলে দাস (কৈবর্ত্ত)।
  78. গাঁয়ের = গ্রামের।
  79. মরল = মোড়ল।
  80. টাইল = ধান-সরিষা প্রভৃতি রাখিবার জন্য বাঁশের তৈয়ারী চতুষ্কোণ পাত্র।
  81. দুধবিয়ানী = দুগ্ধবতী।
  82. বাইস আড়া=প্রায় ২৮ বিঘা।
  83. তনে= হইতে; ‘স্থানাৎ’ শব্দের অপভ্রংশ।
  84. বইতে = বসিতে।
  85. আইত=আসিত।
  86. বিয়াল=বিকাল।
  87. মেঘ আরা=মেঘের অন্তরালে।
  88. রইদ = রোদ।
  89. ছান=স্নান
  90. কইবাম=কহিব।
  91. বুড়াইয়া=ডুবাইয়া।
  92. বইয়া=বসিয়া, অপেক্ষা করিয়া।
  93. মাও=মা।
  94. ডংশিলে=দংশন করিলে।
  95. যাইব=যাবে।
  96. সাধুমন্ত=সজ্জন, ভাল লোক।
  97. গেরামের =গ্রামের।
  98. মেলা—কর=সে পথ ধরিয়া তুমি যেও; ‘নাই’ শব্দ নিরর্থ।
  99. বার-দুয়াইরা ঘর=বহির্দ্বারবিশিষ্ট ঘর।
  100. পূব মূখ্যা=পূর্ব্বমুখী।
  101. পারাপশ্বির লোকে=পাড়াপরসীরা।
  102. গাও মরলের=গ্রামের মোড়লের।
  103. রান্‌ব=রান্ধিবে।
  104. ডাক্যা=ডাকিয়া।
  105. পরম=অত্যন্ত নিপুণ।
  106. সরুয়া=ঝোলযুক্ত ব্যঞ্জন।
  107. কাইট্টা=কাটিয়া।
  108. পুইড়া=পুড়িয়া।
  109. পিড়িত বস্যা=কাষ্ঠাসনে বসিয়া।
  110. শুকত=শুক্‌তা।
  111. শিস্যায় ভরা=দুধের শিষে ভরা, ক্ষীর দিয়া ভরা।
  112. চিত= চিতই; আস্‌কে।
  113. পোয়া=মাল্‌পো। চই=একরূপ ঝাল শাক।
  114. সাইর সরসিরে=সঙ্গীদের।
  115. ঘুরা=ঘেরিয়া ফেলা।
  116. শায়ন=শ্রাবণ।
  117. বেউলা=বেহুলা
  118. রাঢ়ি=রাঁড়ী; বিধবা।
  119. আন্দেসে=আমোদপ্রমোদে।
  120. আগণ=অগ্রহায়ণ।
  121. করমি=ঘটক।
  122. আড়া=১৬ কাঠায় এক আড়া।
  123. সকল কথা কইতে=সকল দিক দিয়া দেখিলে।
  124. খুঁটা=খোটা; নিন্দা।
  125. দৌড়ের নাও=বাইছ খেলার নৌকা (racing boats)।
  126. লড়াই—ষাঁড়=fighting bulls।
  127. মহারোগীর বংশ=বংশে কাহারও কুণ্ঠব্যাধী ছিল।
  128. কৈল=কহিল, প্রস্তাব করিল।
  129. খলা=খোল, ধান শুকাইবার স্থান।
  130. উচ্ছিলার=ঘরের চাল হইতে যে জল পড়ে।
  131. পিন্দ্যা=পরিধান করিয়া।
  132. জুয়ায়=যোগ্য হয়, যোগ্য মনে হয় না।
  133. আঁচা আঁচি=ইঙ্গিত দ্বারা।
  134. গিরে=গৃহে।
  135. বাইরা=বাড়িয়া।
  136. সরাইয়ের=চটির, হোটেলখানার।
  137. কামলার=জনমজুরের।
  138. কানে=অতি নিকটে।
  139. সাজুয়া=সাজসজ্‌জা।
  140. ভাটুয়া=ভাট, ঘটক।
  141. আগুসার=অগ্রসর।
  142. নাগর=যুবকবৃন্দ।
  143. খিলই=একরূপ বাজি।
  144. রুসনাই=আলো।
  145. অর্গা পুছ্যা= অর্ঘ দিয়া মুছিয়া, বরণ করিয়া।
  146. জয়াদি=জয় দেওয়া প্রভৃতি।
  147. জুকার=জোকার (জয়-জয়কার শব্দ হইতে)।
  148. “সোহাগ মাগা”=ভালবাসা চাওয়া। এখনও পুর্ববঙ্গে কোন কোন স্থানে প্রচলিত আছে, মেয়ের মঙ্গলের জন্য আত্মীয় ও পাড়াপড়শীদের নিকট আশীর্বাদ চাওয়া।
  149. মাথায়—ঘুড়িয়া=লক্ষ্মীর কুলা মাথায় করিয়া তাহা অঞ্চল দিয়া ঘিরিয়া।
  150. আবা=ঠোঁট হাত দিয়া আঘাত করিয়া “আবা” “আবা” শব্দ করা।
  151. চিমঠিয়া=চিম্‌টি দিয়া।
  152. সুবিস্তরে=ভাল করিয়া, পূর্ণ ভাবে।
  153. চুরপানি=চোরা পানি (স্ত্রী-আচার)—মুণ্ময় ঘটে জল ও পাঁচটি ফল এবং অঙ্গুরী লুকাইয়া রাখা হয়, বিবাহের পর বর সেই ঘট হইতে অঙ্গুরী ও ফলাদি বাহির করেন।
  154. টুপা=মৃন্ময় ঘট।
  155. ধন=অর্থ মুদ্রা।
  156. মন=একরূপ গাছের কাঠ।
  157. সাজুয়ার তারা= সাঁজের (সন্ধ্যাকালের) তারা।
  158. নিশিরাইত......আইল=গভীর রাত্রি হইল।
  159. শুয়ায়=শয়ন করায়।
  160. আন্ধাইর=অন্ধকার।
  161. মেঘুরী=চুল লইয়া অঙ্গুলী দিয়া একরূপ খেলা।
  162. তাপ্তা=গরম।
  163. পরদীম=প্রদীপ।
  164. পাল্যা=পালিয়া।
  165. আমরারে=আমাদেরে।
  166. ঝাইল=ঝালি; ঝাঁপি।
  167. থাক্য=থাকিও।
  168. বউগড়া=বউটিকে।
  169. কুলের=কোলের।
  170. জুড়া=জোড়া।
  171. আশ্রা=আশ্রয়।
  172. সাউদেরে=সাধুরে।
  173. কার=কারাবাস।
  174. বাইয়া=বাহিয়া।
  175. ফাঁকেতে=অবকাশে।
  176. বাওরা=পাগল।
  177. পংক্ষী উড়া=পাখী যেরূপ হাত হইতে উড়িয়া যায়, তাহার মন সেইরূপ হইল।
  178. কুটুনি=কুট্‌নী।
  179. আইছুইন=আসিয়াছেন।
  180. সামিনা=সাবধান।
  181. গঠিব=ঘটিবে।
  182. পর—আনাগুনি=ভিন্ন গ্রামে যাইবার জন্য আমি পথে চলাফেরা করিতেছিলাম।
  183. গোবরিয়া=গোবরা পোকা (“কে শিখাল তোরে এই বিদ্যে, গোবরা পোকা হয়ে বসিলি পদ্মে, থাক্ থাক্‌, থাক্‌, হয়ে দাঁড়কাক, ঠোকর দিলি শিবলৈবিদ্যে।” গোপাল উড়ে)।
  184. সুবিস্তর লাগে=তার জন্য খুব ভাল করিয়া ব্যবস্থা করিব।
  185. সাজুয়া=সাজ-সজ্‌জাযুক্ত।
  186. চাহিয়া=লাগিয়া।
  187. না—আন=অন্যথা করিব না।
  188. ফানা=পাগল।
  189. চাইয়া=বিবেচনা করিয়া।
  190. পাক্‌না=পক্বকেশযুক্ত।
  191. নাগরিয়া=নগরের স্ত্রীলোক।
  192. চাই=শুনিতে চাই।
  193. দোসর=তুল্য।
  194. রণ-দৌড়ের ঘোড়া=রণক্ষেত্রে যে ঘোড়া বিপক্ষকে দলন করিতে ছুটিরা যায়।
  195. চান=চান্দ।
  196. নউখের = নখের।
  197. অপমান্যা=অপমানকারী।
  198. মনের—করি=তাহারা সাতবার নিখা করিয়া তাহাদের মনের আপশোষ মিটাক।
  199. সামনি=সামনে।
  200. গুসা = গোস্মা (রাগান্বিত)।
  201. সল্লা=কুপরামর্শ।
  202. পরণা=পরওয়ানা।
  203. নজর মরেচা=বিবাহের সময় দেওয়ানকে নজর দিতে হইত, এই নজরের নাম “নজর মরেচা”।
  204. অপরকাশ=অপ্রকাশ, তুমি দিয়েছ এরূপ প্রকাশ নাই—অর্থাৎ দেও নাই
  205. রূপ্যা=(রূপায়া) রৌপ্যমুদ্রা।
  206. ফানা=উন্মাদবৎ।
  207. বেকরার অস্থিরচিত্ত; চন্দ্রকুমারের মতে ‘বেহুঁস’।
  208. ঝাণ্ডা গারি= বংশদণ্ড পুঁতিয়া।
  209. থাপাইয়া=থাবরাইয়া।
  210. রঙ্গিনা=কারুকার্য্যে সজ্‌জিত।
  211. চাইয়া=লক্ষ্য করিয়া।
  212. ফুলছিট্‌কি=ফুলের ঘা (হিট্‌কি=চাবুক)।
  213. উবাস=উপবাস।
  214. শরীলে=শরীরে।
  215. চন্নামির্তি=চরণামৃত।
  216. আশারী=আশান্বিত, ইচ্ছুক।
  217. পিরথিমির=পৃথিবীর।
  218. উতকা=উতালা।
  219. খাড়ু=মল।
  220. শতালি=একশত তালি।
  221. লাজত—রক্ষা=লাজ এবং মানের ভয় আর রক্ষা করা যায় না।
  222. ফুইদ=(স্ফুট) প্রকাশ।
  223. কাট্যা=কাটিয়া।
  224. দোয়ারে=দুয়ারে
  225. পরের—সুখ=পরের ধন বানিয়া খাই, ইহাও আমার খুব সুখ।
  226. স্বীকুরি=স্বীকার
  227. আছলা=ছিলে
  228. মৈলান= মলিন।
  229. পইরা=পড়িয়া।
  230. বালুয়াইর = বানর, অথবা ‘ঝালুয়া’ নামক স্থানের।
  231. টাঙ্গাইল=টাঙ্গানো আছে।
  232. সোয়ারী=পাল্কি বা ডুলি।
  233. আলুফা=দুষ্প্রাপ্য।
  234. জাল=(জ্বাল) উনুনের আগুন।
  235. থইয়া=থুইয়া।
  236. কাউয়া=কাক।
  237. আইল=আসিল
  238. উচ্ছবে=উৎসবে।
  239. কামাইয়া=অর্জন করিয়া।
  240. বাজেপ্ত=বাজেয়াপ্ত, যাহা জমিদারকর্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল।
  241. সিন্দুকি=গুপ্তচর।
  242. মাইন্‌ষে=মানুষে।
  243. বরাতে=সম্মুখে।
  244. পশ্চানে=পশ্চাতে?
  245. জেতায়=জীবিত অবস্থায়।
  246. হাউলী=হাবিলি, প্রাসাদ, বড়লোকের বাড়ী।
  247. পাশরি=বিস্তৃত হই।
  248. আড়াই অক্ষরে=অল্প কথায়। ময়নামতীর গান, ধর্ম্মপুজার কথা প্রভৃতিতে আমরা “আড়াই অক্ষরের মন্ত্রে”র কথা অনেকবার পাইয়াছি।
  249. আছান=মুক্ত
  250. পাছুরী=পশ্চাৎ।
  251. আন্ধাইরতা=আবার।
  252. সব তাই=সকল জিনিসই।
  253. হাইরা=হাড়িয়া, হাড়িদের প্রস্তুত? অথবা হাণ্ডীর (হাঁড়ির) মত বৃহদাকৃতি।
  254. কিরা=শপথ
  255. বর্ত্ত=ব্রত
  256. পরত্তিষ্টা=প্রতিষ্ঠা
  257. পরাচিত্ত=প্রায়শ্চিত্ত।
  258. সুনালী=সোনালী
  259. যোয়ার=যোগ্য হয়।
  260. ভাওয়ালিয়া=বড় নৌকাবিশেষ।
  261. পান্‌সী—করে =পানসি নৌকা ভাড়া করে।
  262. বিস্তার=প্রশন্ত, বিস্তৃত।
  263. উবুত=উপুড়।
  264. কাজিমাজি=চেঁচামেচি।
  265. ভাইগ্‌না=ভাগ্নে
  266. পাতি=ব্যবস্থা।
  267. স্বামীতে=স্বামী।
  268. বাইর কামুলী=বাহিরের দাসী।
  269. ছিডা=ছিটা, ছড়া।
  270. গুজরাণে=অবস্থায় হালে।
  271. কাড়া=কাঁড়া, ছাঁটা, পরিষ্কৃত।
  272. পন্নামিল=প্রণাম করিল।
  273. গহিন=গভীর।
  274. হালা=ছাড়িয়া।
  275. ছোবার=ঝোপের।
  276. বেবান্=অজানা, অনির্দিষ্ট।
  277. পান্থরে=প্রান্তরে।
  278. ধুয়া=ঘোলা।
  279. পরীখাইয়া=পরীক্ষা করিয়া।
  280. গাড়রী=‘গরুড়’ উপাধি সাপের ওঝারা ব্যবহার করিতেন।
  281. আড়ি=পথ।
  282. থাপা=থাবা, থাপ্পর।
  283. চুমকে=চুমুক দিয়া।
  284. বংশাইয়া=বংশে আইয়া; এই বংশে আসিয়া।
  285. দৈমত=দুইমত, দ্বিধা
  286. থাইক্যা=থাকিয়া।
  287. দর=মূল্য, পাঁচ ভাই অপেক্ষা কন্যা প্রিয়তরা ছিল।
  288. হাউড়ী=শাশুড়ি
  289. সোয়াদ=অভিপ্রায়, ইচ্ছা, সাধ।
  290. ঘাটিবে=দোষ কীর্ত্তন করিবে।
  291. গির-বাস=গৃহ-বাস।