মহুয়া

(দৃশ্যকাব্য)

দ্বিজ কানাই প্রণীত

মৈমনসিংহ-গীতিকা

মহুয়া

(প্রাচীন পল্লীনাটিকা)

বন্দনাগীতি

পূবেতে বন্দনা করলাম পূবের ভানুশ্বর[১]
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর[২]
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষীর নদী সাগর।
যেখানে বানিজ্‌জি করে চান্দ সদাগর॥
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্‌বত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের[৩] পাথ্‌থর॥
পশ্চিমে বন্দনা গোঁ করলাম মক্কা এন[৪] স্থান।
উর্‌দিশে[৫] বাড়ায়[৬] ছেলাম মমিন[৭] মুসলমান।
সভা কইর‍্যা বইছ ভাইরে ইন্দু[৮] মুসলমান।
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম॥
চাইর কুনা[৯] পির্‌থিমি[১০] গো বইন্ধ্যা[১১] মন করলাম স্থির।
সুন্দর বন[১২] মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর॥

আসমানে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয[১৩]
আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব আর কুরাণ[১৪]
কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি।
উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি[১৫] ১-১৬

বন্দনাগীতি সমাপ্ত।[১৬]

(১)

হুমরা বেদে

উত্তর‍্যা না গারো পাহাড় ছয় মাস্যা পথ।
তাহার উত্তরে আছে হিমানী পর্‌বত॥
হিমানী পর্‌বত পারে তাহারই উত্তর।
তথায় বিরাজ করে সপ্ত সমুদ্দর[১৭]
চাঁন্দ সুরুয নাই[১৮] আন্দারিতে[১৯] ঘেরা।
বাঘ ভালুক বইসে[২০] মাইন্‌সের[২১] নাই লরাচরা[২২]
বনেতে করিত বাস হুমরা বাইদ্যা[২৩] নাম।
তাহার কথা শুন কইরে ইন্দু[২৪] মুসলমান॥
ডাকাতি করিত বেটা ডাকাইতের সর্দ্দার।
মাইন্‌কা নামে ছুডু[২৫] ভাই আছিল তাহার॥

ঘুরিয়া ফিরিয়া তারা ভ্রমে নানান দেশ।
অচরিত[২৬] কাইনী কথা কইবাম সবিশেষ॥
আর ভাইরে,
ভর্‌মিতে[২৭] ভর্‌মিতেে তারা কি কাম করিল।
ধনু নদীর পারে যাইয়া উপস্থিত অইল॥
কাঞ্চনপুর নামে তথা আচিল[২৮] গেরাম।
তথায় বসতি করত বির্দ্দ[২৯] এক বরাম্মন[৩০]
ছয় মাসের শিশু কইন্যা[৩১] পরমা সুন্দরী।
রাত্রি নিশাকালে হুমরা তারে করল চুরী॥
চুরী না কইর‍্যা হুমরা ছার‍্যা[৩২] গেল দেশ।
কইবাম্ সে কন্যার কথা শুন সবিশেষ॥
ছয় মাসের শিশু কন্যা বচ্ছরের[৩৩] হৈল।
পিঞ্জরে রাখিয়া পঙ্খী[৩৪] পালিতে লাগিল॥
এক দুই তিন করি শুল[৩৫] বছর যায়।
খেলা কছরত[৩৬] তারে যতনে শিখায়॥
সাপের মাথায় যেমন থাইক্যা[৩৭] জলে মণি।
যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী॥
বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা।
আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা॥
হাট্টীয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল।
মুখেতে ফুট্টা[৩৮] উঠে কনক চাম্পার ফুল॥

আগল ডাগল[৩৯] আখিরে আস্‌মানের তারা।
তিলেক মাত্র দেখলে কইন্যা না যায় পাশুরা[৪০]
বাইদ্যার কইন্যার রূপে ভাইরে মুনীর টলে মন।
এই কইন্যা লইয়া বাইদ্যা ভর্‌মে তির্‌ভুবন॥
পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্যার নারী।
ভাব্যা চিন্ত্যা নাম রাখল “মহুয়া সুন্দরী”॥ ১—৩৭

(২)

গারো পাহাড়; বনপ্রদেশ

(হুমড়া ও মাইন্‌কিয়া সহ দলবলের প্রবেশ)

হুমড়া বাইদ্যা ডাক দিয়া কয় মাইন্‌কিয়া ওরে ভাই।
খেলা দেখাইবারে চল বৈদেশেতে[৪১] যাই॥
মাইন্‌কিয়া বাইদ্যা কয় ভাই শুন দিয়া মন।
বৈদেশেতে যাব আমরা শুক্কুর বাইর‍্যা[৪২] দিন॥
শুক্কুর বাইর‍্যা দিন আইল সকালে উঠিয়া।
দলের লোক চলে যত গাট্টীবুচ্‌কা[৪৩] লইয়া॥
আগে চলে হুমরা বাইদ্যা পাছে মাইন্‌কিয়া ভাই।
তার পাছে চলে লোক লেখা জুখা নাই॥
বাশ তাম্বু লইল সবে দড়ি আর কাছি।[৪৪]

তোতা লইল ময়না লইল আরো লইল টিয়া।
সোণামুখী দইয়ল[৪৫] লইল পিঞ্জিরায় ভরিয়া॥
ঘোড়া লইল গাধা লইল কত কইব আর।
সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়[৪৬]
শিকারী কুকুর লইল শিয়াল হেজা[৪৭] ধরে।
মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে॥
তারও সঙ্গেতে চলে মহুয়া সুন্দরী।
তার সঙ্গে পালঙ্ক সই গলা ধরাধরি॥
এক দুই তিন করি মাস গুয়াইল[৪৮]
বামনকান্দা গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইল॥১—১৯

(৩)

নদের চাঁদের সভা

সভা কইরিয়া বইস্যা আছে ঠাকুর নদ্যার চান[৪৯]
আস্‌মানে তারার মধ্যে পূর্ণ মাসীর চান॥
আগে পাছে বইছে লোক সভা যে করিয়া।
পরবেশ করিল লেংরা[৫০] ছেলাম জানাইয়া॥

“শুন শুন ঠাকুর মশয় বলি যে তোমারে।
নতুন একদল বাইদ্যা আইছে তামসা দেখাইবারে॥
পরম এক সুন্দরী কইন্যা সঙ্গেতে তাহার।
জন্মিয়া ভন্মিয়া এমুন দেখি নাইকো আর॥”
এই কথা শুনিয়া ঠাকুর কি কাম করিল।
মা জননীর কাছে যাইয়া উপনীত হইল॥
“শুন শুন মা জননী বলি যে তোমারে।
নতুন একদল বাইদ্যা আইছে তাম্‌সা করিবারে॥
তোমার আদেশ পাইলে মাগো আর না কিছু চাই।
আদেশ যদি কর মাগো তাম্‌সা করাই॥”
“বাইদ্যার তাম্‌সা করাইতে কয়শ টেকা লাগে।”
“বাইদ্যার তাম্‌সা করাইতে একশ টেকা লাগে॥”
“শুন শুন নদ্যার চানরে বলি যে তোমারে।
বাইদ্যার তাম্‌সা করাও নিয়া বাইর বাড়ীর মহলে॥” ১-১৮

(৪)

খেলা-প্রদর্শন

হুমড়া বাইদ্যা ডাক দিয়া বলে মাইন্‌কিয়া ওরে ভাই।
ধনু কাডি[৫১] লইয়া চল তাম্‌সা করতে যাই॥
যখন নাকি হুমড়া বাইদ্যা ডুলে[৫২] মাইলো বাড়ী।
নদ্যাপুরের যত মানুষ লাগলো দৌড়াদৌড়ি॥
এক জনে ডাক দিয়া কয়রে আর এক জনের ঠাই।
ঠাকুর বাড়ী বাইদ্যার তাম্‌সা চল দেইখ্যা আই[৫৩]
চাইর[৫৪] দিকেতে রইল লোকজন তাম্‌সা দেখিবারে।
মধ্যে বইয়া[৫৫] নদ্যার ঠাকুর উকি ঝুকি মারে॥

যখন নাকি বাইদ্যার ছেরি[৫৬] বাশে মাইলো লাড়া।[৫৭]
বইস্যা আছিল নদ্যার ঠাকুর উঠ্যা ঐল খাড়া॥
দড়ি বাইয়া উঠ্যা যখন বাশে বাজী করে।
নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পইরা নাকি মরে॥[৫৮]
কর্‌তালের রুনুঝুনু ডুলে মাইলো তালি৷[৫৯]
গান করিতে আইলাম আমরা নদ্যা ঠাকুরের বাড়ী॥
বাজী করলাম তাম্‌সা করলাম ইনাম বক্সিস চাই।
মনে বলে নদ্যার ঠাকুর মন যেন তার পাই॥[৬০]
হাজার টেকার শাল দিল আরো টেকা কড়ি।
বসত করতে হুমড়া বাইদ্যা চাইল একখান বাড়ী॥
ডাইল দিল চাইল দিল রসুই কইরা খাইও।
নতুন বাড়ীত খাইয়া তোমরা সুখে নিদ্রা যাইও॥
পাড়া করলাম কইলৎ করলাম[৬১]
ভালা করা বান্দ বাড়ী উলুইয়াকান্দা[৬২] গিয়া॥
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা বানলো জুইতের[৬৩] ঘর।
লীলুয়া বয়ারে[৬৪] কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর॥
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন[৬৫]
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন॥
কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর।
সেই বাইঙ্গন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলায় হার॥[৬৬]

নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো উরি[৬৭]
তুমি কইন্যা না থাকলে আমার গলায় ছুরি॥
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো কচু।
সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু॥
নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো কলা।
সেই কলা বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা॥
নয়। বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলে। চৌকারী[৬৮]
চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি।
হাস মারলাম কইতর[৬৯] মারলাম বাচ্যা[৭০] মারলাম টিয়া।
ভালা কইর‍্যা রাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া॥ ১—৩৮


(৫)

নদ্যার ঠাকুরের সঙ্গে মহুয়ার জলের ঘাটে দেখা

এক দিন নদ্যার ঠাকুর পন্থে করে মেলা[৭১]
ঘরের কুনায়[৭২] বাতি জ্বালে তিন সন্ধ্যার বেলা॥
তাম্‌সা কইরিয়া বাদ্যার ছেড়ী ফিরে নিজের বাড়ী।
নদ্যার ঠাকুর পথে পাইয়া কহে তড়াতড়ি॥
শুন শুন কইন্যা ওরে আমার কথা রাখ।
মনের কথা কইবাম আমি একটু কাছে থাক॥
সইন্ধ্যা বেলায় চান্নি[৭৩] উঠে সুরুয বইসে পাটে[৭৪]
হেন কালেতে একলা তুমি যাইও জলের ঘাটে॥

সইন্ধ্যা বেলা জলের ঘাটে একলা যাইও তুমি।
ভরা কলসী কাঙ্কে[৭৫] তোমার তুল্যা দিয়াম আমি॥
কলসী করিয়া কাঙ্কে মহুয়া যায় জলে।
নদ্যার চান[৭৬] ঘাটে গেল সেইনা সইন্ধ্যা কালে॥
“জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ মন।
কাইল যে কইছিলাম কথা আছে নি স্মরণ॥”
“শুন শুন ভিন দেশী[৭৭] কুমার বলি তোমার ঠাই।
কাইল বা কি কইছলা[৭৮] কথা আমার মনে নাই॥”
“নবীন যইবন[৭৯] কইন্যা ভুলা[৮০] তোমার মন।
এক রাতিরে[৮১] এই কথাটা হইলে বিস্মরণ॥”
“তুমি ত ভিন দেশী পুরুষ আমি ভিন্ন নারী।
তোমার সঙ্গে কইতে কথা আমি লজ্জায় মরি॥”
“জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ॥
কেবা তোমার মাতা কইন্যা কেবা তোমার পিতা।
এই দেশে আসিবার আগে পূর্ব্বে ছিলি কোথা॥”
“নাহি আমার মাতাপিতা গর্ভ সুদর[৮২] ভাই।
সুতের হেওলা[৮৩] অইয়া[৮৪] ভাইস্যা বেড়াই॥
কপালে আছিল লিখন বাইদ্যার সঙ্গে ফিরি।
নিজের আগুনে আমি নিজে পুইর‍্যা[৮৫] মরি॥
এই দেশে দরদী[৮৬] নাইরে কারে কইবাম কথা।
কোন জন বুঝিবে আমার পুরা মনের বেথা॥

মনের সুখে তুমি ঠাকুর সুন্দর নারী লইয়া।
আপন হালে[৮৭] করছ ঘর সুখেতে বান্ধিয়া॥”
ঠাকুর বলে “কইন্যা তোমার শানে[৮৮] বান্ধা হিয়া।
মিছা কথা কইছ তুমি না কইরাছি বিয়া॥”
“কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার প্রাণ।
এমন যইবন তোমার যায় অকারণ॥
কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার হিয়া।
এমন যইবন কালে নাহি দিছে বিয়া॥”
“কঠিন আমার মাতাপিতা কঠিন আমার হিয়া।
তোমার মত নারী পাইলে করি আমি বিয়া॥
“লজ্‌জা নাই নির্লজ্‌জ ঠাকুর লজ্‌জা নাইরে তর[৮৯]
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুব্যা মর॥”
“কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ী।
তুমি হও গহীন[৯০] গাঙ্গ[৯১] আমি ডুব্যা মরি॥”
১—৪৪

(৬)

পালঙ্ক সই ও মহুয়ার কথোপকথন

“শুন শুন বইন[৯২] মহুয়া আমার মাথা খাও।
এক্‌লা কেন সইন্ধ্যা[৯৩] বেলা জলের ঘাটে যাও॥
সারা নিশি কাইন্দ্যা পুয়াও[৯৪] চউক্ষে[৯৫] বহে পানি।
একটি বার মনের কথা কওনা কেনে শুনি॥
হাইম[৯৬] ফেলিয়া চাইয়া থাক ঠাকুরবাড়ীর পানে।
নদ্যা ঠাকুর পাগল অইছে[৯৭] শুনছি তোমার গানে॥”

এই কথা শুনিয়া মহুয়া বলে ধীরে ধীরে।
“মনের আগুন নিবাই সখি বল কেমন কইরে॥
এই দেশ ছাড়িয়া চল ভিন দেশেতে যাই।
বুঝাইলে না বুঝে মন কি দিয়া বুঝাই॥”
“শুন শুন শুন গো বইন মোর কথাটী রাখ।
সাত দিন না যাও জলের ঘাটে ঘরে বইস্যা থাক॥
আইসে যখন নদ্যার ঠাকুর বল্যা দিয়াম[৯৮] তারে।
কাইল নিশিতে সুন্দর নারী গেছে তোমার মইরে॥”
এই কথা শুনিয়া মহুয়া ধীরে ধীরে বলে।
“আগে আমি যাইবাম মইরা মুরতেক[৯৯] না দেখিলে॥।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী সই সাক্ষী হইও তুমি।
নদ্যার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামী॥
বাইদ্যার সঙ্গে আমি যে সই যথায় তথায় যাই।
আমার মন বান্‌ধ্যা[১০০] রাখে এমন স্থান আর নাই।
বন্ধুরে লইয়া আমি অইবাম[১০১] দেশান্তরি।
বিষ খাইয়া মরবাম কিম্বা গলায় দিয়াম দড়ি॥” ১—২২


( ৭ )

হুমরা ও মাইন্‌কিয়ার পরামর্শ

“শুন শুন মানিক ভাইরে বলি যে তোমাই[১০২]
এই না দেশ ছাইড়া চল অন্য দেশে যাই॥
কি করবো ভাই বাড়ী ঘরে খাইবাম[১০৩] ভিক্ষা মাগে।
আমার কন্যা পাগল হইছে নদ্যার ঠাকুরের লাগে[১০৪]

মাইন্‌কিয়া[১০৫] বলে “এমন কথা না কহিও তুমি।
ছাইড়া যাইতে মন না চলে সোনার বাড়ী জমি॥
সানে বান্ধা পুষ্করিণী গলায় গলায় জল।
পাইক্যা[১০৬] আইছে[১০৭] সাইলের ধান সোনার ফসল॥
তা দিয়া কুটিয়া খাইয়াম সালি ধানের চিরা।
এই দেশ না ছাইরো ভাইরে আমার মাথার কিরা[১০৮]॥”  ১—১০

(৮)

গভীর নিশিতে মহুয়ার সঙ্গে নদ্যার ঠাকুরের পুনর্মিলন

ফাল্গুন মাসে চল্যা যায়রে চৈত্র মাসে আসে।
সোনার[১০৯] কুইল[১১০] কু ডাকে[১১১] বইস্যা গাছে গাছে॥
আগ রাঙ্গিয়া সাইলের ধান উঠ্যাছে পাকিয়া।[১১২]
মধ্য রাত্রে নদ্যার চান উঠিল জাগিয়া॥
শিরে ছিল আর[১১৩] বাশীটি তুল্যা নিল হাতে।
ঠার দিয়া[১১৪] বাজাইল বাশী মহুয়ায় আনিতে॥
আসমানেতে চৈতার বউ[১১৫] ডাকে ঘনে ঘন।
বাশী শুন্যা সুন্দর কইন্যার ভাঙ্গ্যা গেল ঘুম॥
সুখে ঘুমায় বাইদ্যার দল নয়া[১১৬] ঘরে শুইয়া।
ঘরের বাইর হইল কইন্যা পাগল হইয়া॥

ধীরে ধীরে চল্যা কইন্যা নদীর ঘাটে আসি।
আইস্যা দেখে নদ্যার ঠাকুর বাজায় প্রেমের বাশী॥
কোলাকোলি গলাগলি করে দুইজন।
নদ্যার ঠাকুর কহে কথা শুন দিয়া মন॥
“মা ছাড়বাম[১১৭] বাপ ছাড়বাম ছাড়বাম ঘর বাড়ী।
তোমারে লইয়া কইন্যা অইয়াম[১১৮] দেশান্তরি॥”
বাইদ্যার ছেড়ী[১১৯] কান্দে ধইর‍্যা নদ্যার ঠাকুরের গলা।
“আমি নারী পাগলিনী বন্ধুরে তুমি গলার মালা॥
তিলেক মাত্র না দেখিলে হইরে পাগলিনী।
পিঞ্জরায় বাইন্ধ্যা রাখছে পাগলা পঙ্খিনী[১২০]
ফুল যদি হইতারে বন্ধু ফুল হইতে তুমি।
কেশেতে ছাপাই[১২১] রাখতাম ঝাইড়িয়া[১২২] বানতাম[১২৩] বেনী॥
আমি মরি জলে ডুব্যারে বন্ধু আমার মাথা খাও।
ছাড়ান দিয়া আমার আশা ঘরে চল্যা যাও॥”
দুইয়ে জনে এতেক করে হুমরা তাহা দেখে।
চল্যা গিয়া কতক দূর পাছে পাছে থাকে॥
রাত্রি ভোরে নদ্যার ঠাকুর ফিরে নিজের বাড়ী।
সকালবেলা চলে কইন্যা লইয়া ঘাঘুরী[১২৪]১—২৮

(৯)

শেষ বিদায়—মহুয়ার উক্তি

“শুন শুন নদ্যার ঠাকুর বলি যে তোমারে।
এই না গেরাম ছাড়্যা যাইবাম আজি নিশাকালে।

মাও বাপে সঙ্গে কর‍্যা ছাড়্যা যাইবো বাড়ী।
তোর সঙ্গে যাইয়াম রে বন্ধু হইয়া দেশান্তরী॥
তোমার সঙ্গে আমার সঙ্গেরে বন্ধু এই না শেষ দেখা।
কেমন কর‍্যা থাকবাম আমি হইয়া অদেখা॥
আমি যে অবলা নারী আছে কুল মান।
বাপের সঙ্গে নাহি গেলে নাহি থাকব মান॥
পড়্যা রইল বাড়ী জমি পড়্যা রইলা তুমি।
কেমুন কইরা পাগল মনে বান্ধ্যা রাখাম আমি॥
আর না শুনবাম রে বন্ধু তোমার গুণের বাশী।
আর না জাগিয়া বন্ধু পুয়াইবাম নিশি॥
মনে যদি লয়রে বন্ধু রাখ্যো আমার কথা।
দেখা করতে যাইও বন্ধু খাওরে আমার মাথা॥
জাগিয়া না দেখবাম বন্ধু তোমার সোনামুখ।
ভরমিয়া তোমার সঙ্গে আর না পাইব সুখ॥
যাইবার কালে একটি কথা বল্যা যাই তোমারে।
উত্তর দেশে যাইও তুমি কয়েক দিন পরে॥
আমার বাড়ীত যাইওরে বন্ধু অমনি বরাবর।
নল খাগড়ের বেড়া আছে দক্ষিণ দেয়ারিয়া ঘর॥
সেই খানেতে আমরা সবে বাস্যা কয় মাস থাকি।
সেই খানে যাইও বন্ধু অতিথ হইয়া তুমি॥
আমার বাড়ীত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা।
জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা॥
সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরী কলা।
ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা॥
আইজের দেখা শেষ দেখারে বন্ধু আর না হবে দেখা॥” ১—২৭

পলায়ন

“বাঁশ লইল দড়ী লইল সকল লইয়া সাথে।
পলাইল বাইদ্যার দল আইন্ধ্যারিইয়া নিশিতে॥”

মহুয়া, ১৭ পৃঃ

(১০)

বেদের দলের পলায়ন

“সন্দে[১২৫] গুচ্যা[১২৬] গেল ভাইরে আর না থাকবাম[১২৭] দেশে।
আমার কথা রাখ্যা চল যাইগা অন্য দেশে॥
বাড়ী ঘর পড়্যা থাকুক থাকুক সাইলের চিরা।
এই দেশেতে না থাক্য[১২৮] ভাইরে আমার মাথার কিরা॥”
বাঁশ লইল দড়ী লইল সকল লইয়া সাথে।
পলাইল বাইদ্যার দল আইন্ধ্যারিয়া[১২৯] নিশিতে॥
পড়্যা রইল ঘর দরজা বাড়ী জমীন পড়া।
এই কথা শুন্যা সবে লাগে চমক তারা॥[১৩০]
যখন নাকি নদ্যার ঠাকুর এই কথা শুনিল।
খাইতে বইয়া[১৩১] মুখের গরাস[১৩২] ভূমিতে ফেলিল॥
মায় ডাকে বাপে ডাকে নাহি শুনে কথা।
নদ্যার ঠাকুর পাগল হইল সকল লোকে কয়॥ ১—১২

(১১)

মায়ের নিকট হইতে নদ্যার চাঁদের বিদায়-গ্রহণ

“ভাঙ্গা ঘর পড়িয়া রইছে চালে নাইরে ছানি।
পিঞ্জিরা করিয়া খালি উইড়াছে পঙ্খিনী॥
এইত উঠানে কন্যা নিরালা বসিয়া।
বিনা সূতে গাঁথ্‌ত মালা আমার লাগিয়া॥
দিন যায় মাস যায় আর না হইবে দেখা।
আছিলাম ব্রাহ্মণের পুত্র কপালের এই লেখা॥

সাক্ষী হও চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী হওরে তারা।
বিদায় দেও মা জননী বিদায় দেও আমারে।
তীর্থ করিতে আমি যাইবাম দেশান্তরে॥
ভাত রাইন্দো[১৩৩] মা জননী না ফালাইও[১৩৪] ফেনা।
আমি পুত্র বৈদেশে[১৩৫] যাইতে না করিও মানা॥
বিদায় দেও গো মা জননী বিদায় দেও আমারে।
তীর্থ করতে যাইব আমি অতি দূর দেশে॥”

মায় বলে “পুত তুমি আমার আখির তারা।
তিলেক দণ্ড না দেখিলে হই যে পাগল পারা॥
তোমারে না দেখলে পুত্র গলে দিবাম কাতি।
তুমি পুত্র বিনে নাই আমার বংশে দিতে বাতি॥
ভিক্ষা মাইগ্যা খাইয়াম[১৩৬] আমি তোমারে লইয়া।
উরের ধন দূরে দিব তবু না দিব ছাড়িয়া॥[১৩৭]
আধ পিঠ খাইলো মায়ের গুয়ে আর মুতে।
আধ পিঠ খাইলো দারুণ মাঘ মাস্যা শীতে॥[১৩৮]
বিদেশে বিবাসে যদি পুত্র মারা যায়।[১৩৯]
দেশে না জানিবার আগে জানে কেবল মায়॥
পরবুধ[১৪০] না মানে পরাণ কেম্‌নে থাকবাম[১৪১] ধরে।
তুমি পুত্র ছাড়্যা গেলে আমি যাইয়াম মইরে॥” ১-২৫

(১২)

নদের চাঁদের নিরুদ্দেশ

রাত্রি নিশাকালে পুত্র‍ু কি না কাম করিল।
উরদিশে[১৪২] মায়ের পায়ে পন্নাম করিল॥
“সাক্ষী হইও চান্দ সুরুয সাক্ষী হইও তুমি।
ঘর দোয়ার ছাড়িয়া আজি বৈদেশী হইলাম আমি॥
মা রইলো বাপ রইলো রইলো রে সুদুর[১৪৩] ভাই।
সকল থাকিতে আমার কেউ যেন নাই॥
চান্দ সূরুয পন্নাম করি পন্নাম করি সবে।
মায় বাপে পন্নাম করি যাইব বৈদেশে॥”
রাত্র নিশাকালে ঠাকুর কি কাম করিল।
বাইদ্যার নারীর লাগ্যা ঠাকুর বৈদেশী হইল॥ ১—১০

(১৩)

মহুয়ার সন্ধানে নদের চাঁদের ভ্রমণ

কিসের গয়া কিসের কাশী কিসের বৃন্দাবন।
বাইদ্যার কন্যা খুজতে ঠাকুর ভর্‌মে তিরভুবন[১৪৪]
একমাস দুইমাস আরে ভালা তিনমাস যায়।
খুঁজ্যা না পাইল দেখা ভর্‌মিয়া বেড়ায়॥
কোথায় আছে জইতার পাহাড়[১৪৫] কোথায় গহীন বন।
পাগল হইয়া নদীয়ার চাঁন ভর্‌মে তিরভুবন॥
পন্থে যারে দেখে ঠাকুর তারে ডাক দিয়া পুছ করে[১৪৬]
“বিদেশী বাইদ্যার লাগাল পাইবাম কত দূরে॥

গরু রাখ রাউখাল[১৪৭] ভাইরে কর লড়ালড়ি[১৪৮]
এই পন্থে যাইতে নি দেখ্‌ছ[১৪৯] মহুয়া সুন্দরী॥
মেঘের সমান কেশ তার তারার সম আঁখি।
এই দেশেনি উইড়া আইছে আমার তোতা পাখী॥
বাঁশ বাইয়া বাজী করে সুন্দর বাইদ্যার নারী।
চাঁচর চিকণ কেশ কন্যার পরম সুন্দরী॥
আন্ধাইর ঘরে থইলে কন্যা কাঁঞ্চা সোনা জ্বলে।
বনে ফুটে ফুলরে ভাল পরাবতে জলে মণি।
সেইত কন্যার লাগিয়ারে পাগল হইলাম আমি॥
এই ঘাটে ভরিত জলরে আরে ভালা[১৫০] মহুয়া সুন্দরী।
এই ঘাটে কেন আমি ডুইবা নাইসে মরি॥
এই পন্থে চলিত কন্যা কলসী কাঙ্কে লইয়া।
দূরে থাক্যা আমি রূপ ভালা দেখ্‌তামরে[১৫১] চাহিয়া॥
কোথায় গেলে পাব কন্যা আরে তোমার দরশন।
তিলেক আদেখা হইলে আছিল মরণ॥
উইড়া[১৫২] যাওরে পশুপঙ্‍খী নজর বহুদূর।
এই না পন্থে বাইদ্যার দল গেছে কতকদূর॥”

যেইখানে বসিয়া কন্যা করিত রন্ধন।
তথায় বইসা নদীয়ার ঠাকুর জুড়িল কান্দন॥
ঘোড়ার পায়ের খুরার দাগ ছাগল খাইত ঘাস।
এইখানে আছিল কন্যা ফাল্‍গুন-চইতের[১৫৩] মাস॥[১৫৪]
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ না মাস গেল এই মতে।
কাইন্দা বেড়ায় নদীয়ার ঠাকুর উচা নীচা পথে॥

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এইরূপে যায়।
পূবেতে গর্‌জিয়া দেওয়া পশ্চিমেতে ভায়[১৫৫]
ভাদ্র-আশ্বিন মাস আসে এই মতে।
দিন রাইত নদীয়ার ঠাকুর খুঁজে নানান মতে॥
বাড়ীতে দুর্গার পূজা কান্দে বাপ মায়।
খালি মণ্ডপ রইলরে পইড়া নদীয়ার ঠাকুরের দায়[১৫৬]
মাও রইল বাপ রইল রইলরে সোদর ভাই।
মেঘে ভিজ্যা রইদেরে পুইড়া রজনী পোয়াই॥[১৫৭]
কার্ত্তিক মাসে কার্ত্তিক বরত[১৫৮] পুত্রের লাগিয়া।
আক্ষি ঘোর[১৫৯] হইল মায়ের কান্দিয়া কান্দিয়া॥
আগুণ[১৬০] মাসে অল্প শীত কংসাই নদীর পাড়ি[১৬১]
নাগাল পাইল নদীয়ার চান্ মহুয়া সুন্দরী॥
সাপে যেমন পাইল মণি পিয়াসী পাইল জল।
পদ্মফুলের মধু খাইতে ভমরা পাগল॥ ১—৪৫

(১৪)

নূতন অতিথি

সন্ধ্যাবেলা অতিথ আইল ভিন্ন দেশে বাড়ী।
কলসী লইয়া জলে যায় মহুয়া সুন্দরী॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যার যৌবন হইল কালী।
দলের যত বাইদ্যা লোক করে বলাবলি॥
“নিদ্রা নাই সে যায় কন্যা না ছুঁয়ে ভাতপানী
মাথার বিষেতে কন্যা হইল পাগলিনী॥

সর্ব্বাঙ্গে বাতের বেদনা আইঞ্চল পাতিয়া।
ছয় মাস যায় কন্যার কান্দিয়া কান্দিয়া॥
ভাত নাই সে রান্ধে কন্যা খেলায় নাই সে মন।
এইরূপ হইয়াছিল কন্যা সংশয় জীবন॥
আজি কেনে অকস্মাতে হইল এমন ধারা।
ছয় মাইস্যা মরা যেন উঠ্যা হইল খারা॥”[১৬২]

দেল ভরিয়া কন্যা করিল রন্ধন।
জাতি দিয়া নদীয়ার ঠাকুর করিল ভোঞ্জন॥[১৬৩]
হোম্‌রা বাইদ্যা ডাক দিয়া বলে মাইন্‌কা ওরে ভাই।
“ভিন্‌ দেশী অতিথে আজ করিব পরখাই[১৬৪]॥”
“আমার কাছে থাক ঠাকুর সুখে কর বাস।
দেশে দেশে ঘুইরা ফিরবা লইয়া দড়ি বাঁশ॥
যত্ন কইরা শিইখ খেলা থাক্যো মোদের পাশে।
বার মাস ঘুইরা[১৬৫] আমরা ফিরি দেশে দেশে॥”১—২০

(১৫)

নদের চাঁদের প্রাণবিনাশার্থ হোম্‌রা কর্ত্তৃক মহুয়াকে ছুরিকা-প্রদান

অন্ধকাইরা রাইতের নিশি আরে ভালা আসমানে জ্বলে তারা।
ভাবিয়া চিইন্ত্যা হোম্‌রা বাইদ্যা উইঠ্যা হইল খারা॥
নদীর পারে হিজল গাছ পাতার বিছানা।
নদীয়ার ঠাকুর শুইয়া আছে হইয়া মইতানা[১৬৬]

এই দিনে হইল কিবা শুন বিবরণ।
কন্যার শিওরা[১৬৭] বইসা ডাকে ঘন ঘন॥
“উঠ কন্যা মহুয়া গো কত নিদ্রা যাও।
আমি তোর বাপ ডাকি আঁখি মেলি চাও॥
ষোল বছর পালিলাম কত দুঃখ করি।
এক কথা রাখ মোর মহুয়া সুন্দরী॥”

ঘুমাইয়া কাণের কাছে দেওয়ার গরজন।
ভিন্‌ দেশী অতিথির মুখ দেখয়ে স্বপন॥
চম্‌কিয়া উঠিল কন্যা বাপের ডাক শুনি।
চোখ্ চাইয়া দেখে কন্যা জ্বলন্ত আগুনি॥
“এই ছুরি লইয়া তুমি যাও নদীর পারে।
শুইয়া আছে নদীয়ার ঠাকুর মাইরা আইস তারে॥
ষোল বচছর পাল্‌লাম কন্যা কত দুঃখ করি।
আমার কথা রাখ তুমি মহুয়া সুন্দরী॥
ভিন্ দেশী দুষমন সেই যাদুমন্ত্র জানে।
বইক্ষেতে[১৬৮] হানিয়া ছুরি মারহ পরাণে॥
আমার মাথা খাওরে কন্যা আমার মাথা খাও।
দুষমনে মারিয়া ছুরি সাওরে[১৬৯] ভাসাও॥”

ডুবিল আসমানের তারা চান্দে না যায় দেখা।
সুনালী[১৭০] চান্নীর[১৭১] রাইত আবে[১৭২] পড়্ল ঢাকা॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কি কাম করিল।
বাপের হাতের ছুরি লইয়া ঠাকুরের কাছে গেল॥
পায়ে পড়ে মাথার চুল চক্ষে পড়ে পানি।
উপায় চিন্তিয়া[১৭৩] কন্যা হইল উন্‌মাদিনী॥ ১-২৮

(১৬)

প্রেমের জয়

পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে।
নিদ্রা যায় নদীয়ার ঠাকুর হিজল গাছের তলে॥
আশমানের চান্দ যেমন জমিনে পড়িয়া।
নিদ্রা যায় নদীয়ার চান্ অচৈতন্য হইয়া॥
একবার দুইবার তিনবার করি।
উঠাইল নামাইল কন্যা বিষলক্ষের[১৭৪] ছুরি॥
“উঠ উঠ নদ্যাঠাকুর কত নিদ্রা যাও।
অভাগী মহুয়া ডাকে আখি মেইল্যা চাও॥
পাষাণ বাপে দিল ছুরি তোমায় মারিতে।
কিরূপে বধিব তোমায় নাহি লয় চিতে॥
পাষাণ আমার মাও বাপ পাষাণ আমার হিয়া।
কেমনে ঘরে যাইবাম ফিইরা তোমারে মারিয়া॥
জ্বালিয়া ঘীয়ের বাতি ফু দিয়া নিবাই।[১৭৫]
তুমি বন্ধুরে আমার আর লইক্ষ্য নাই॥
তুমারে[১৭৬] মারিয়া আমি কেমনে যাইবাম ঘরে।
পাষাণ হইয়া মাও বাপে বধিল আমারে॥
কাজ নাই ভিন্ দেশী বন্ধুরে দুঃখ নাইসে করি।
আমার বুকে মারবাম আমি এই বিষলক্ষের ছুরি॥”

কি কর কি কর কন্যা কি কর বসিয়া।
কাঞ্চা ঘুমে জাগে ঠাকুর স্বপন দেখিয়া॥
শিওরে বসিয়া দেখে কান্দিছে সুন্দরী।
হাতে তুইল্যা নইছে কন্যা বিষলক্ষের ছুরি॥

“শুন শুন ঠাকুর আরে শুন মোর কথা।
কঠিন তোমার প্রাণ-পিওয়া[১৭৭] কঠিন মাতা-পিতা॥
শাণে বান্ধা হিয়া আমার পাষাণে বান্ধা প্রাণ।
তোমায় বধিতে বাপে কহিল সইন্ধান॥
হাতেতে আছিল মোর বিষলক্ষের ছুরি।
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু আমার বুকে মারি॥
পলাইয়া মায়ের ধন নিজের দেশে যাও।
সুন্দর নারী বিয়া কইরা সুখে বইসা খাও॥
বরামণের[১৭৮] পুত্র তুমি রাজার ছাওয়াল।
তোমার সুখের ঘরে আমি হইলাম কাল॥
কি করিতে কি করিলাম নাহি পাই দিশা।
অরদিশ[১৭৯] হইয়া আমি———————————————

“মাও ছাড়ছি বাপ ছাড়ছি ছাড়ছি জাতিকুল[১৮০]
ভমর হইলাম আমি তুমি বনের ফুল॥
তোমার লাগিয়া কন্যা ফিরি দেশ বিদেশে।
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা আর না যাইবাম দেশে॥
বি কইবাম বাপ মায়ে কেমনে যাইবাম ঘরে।
জাতি নাশ কর্‌লাম কন্যা তোমারে পাইবার তরে॥
তোমায় যদি না পাই কন্যা আর না যাইবাম বাড়ী।
এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি॥”

“পইড়া থাকুক বাপ মাও পইড়া থাকুক ঘর[১৮১]
তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর॥
দুই আঁখি যে দিগে যায় যাইবাম সেই খানে।
আমার সঙ্গে চল বন্ধু যাইবাম গহীন বনে॥
বাপের আছে তাজি ঘোড়া ঐ না নদীর পারে।
দুইজনেতে উঠ্যা চল যাইগো দেশান্তরে॥

না জানিবে বাপ মায় না জানিবে কেহ।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী কইরা ছাইড়া যাইবাম দেশ॥”
আবে করে ঝিলীমিলী[১৮২] নদীর কুলে দিয়া।
দুইজনে চলিল ভালা ঘোড়ায় সুয়ার হইয়া॥
চান্দ-সুরুজ যেন ঘোড়ায় চড়িল।
চাবুক খাইয়া ঘোড়া শণেতে[১৮৩] উড়িল॥ ১—৫৪

(১৭)

সম্মুখে পার্ব্বত্য নদী; নদের চাঁদ ও মহুয়া তীরে দাঁড়াইয়া

“বাপের বাড়ীর তাজী ঘোড়া আরে আমার মাথা খাও।
যেই দেশেতে বাপ মাও সেই দেশেতে যাও॥
বাপের আগে কইও ঘোড়া কইও মায়ের আগে।
তোমার কন্যা মহুয়ারে খাইছে জংলার[১৮৪] বাঘে॥”
লাগাম ছাড়িয়া ঘোড়ার পৃষ্ঠে মাইল থাপা[১৮৫]
ছুট্যা গেল দৌড়ের ঘোড়া যথায় বাদ্যার দফা[১৮৬]

“বিস্তার[১৮৭] পাহাড়ীয়া নদী ঢেউয়ে মারে বাড়ি।
এমন তরঙ্গ নদীর কেমনে দিবাম পারি॥
চর পইড়া যাওরে নদী দুইচার দণ্ডের লাগি।
পার হইয়া যাইবাম মোরা এই ভিক্ষা মাগি॥”

নদীতে না পড়ল চর উজান বাঁকে পানি।
“এইনা আসে সাধুর ডিঙ্গা ভরা বোঝাই খানি॥
পক্ষী নয় পক্ষী নয়রে উড়াইয়া দিছে পাল।[১৮৮]
এই সে নৌকায় উঠ্যা যাইবাম যা থাকে কপাল॥

শুন্‌রে ভিন দেশী সাধু বাণিজ্যকারণ।
কত দেশে যাওরে তোমরা ভরম তিরভুবন॥
গইন[১৮৯] গম্ভীরা নদী সাঁতার না জানি।
পার কইরা দিলে বাঁচে এ দুটী পরাণি॥”

কন্যারে দেখিয়া সাধু মন হইল পাগল।
মাঝিমাল্লায় ডাক দিয়া কয় সদাগর॥
কুলেতে ভিরায় নাও উঠে দুইজন।
চলিল সাধুর নাও পবনগমন॥ ১—২২

(১৮)

সাধুর ডিঙ্গায়

এদিকে হইল কিবা শুন বিবরণ।
কন্যারে পাইতে সাধু চিন্তে মনে মন॥
দেখিয়া কন্যার রূপ সাধু পাগল হইল।
মাঝিমাল্লায় ডাক দিয়া সাধু সল্লা[১৯০] যে করিল॥
উজান পাকে সাধুর ডিঙ্গা উজাইয়া যায়।
জলে ভাসে নদ্যার ঠাকুর ঘট্‌লো একি দায়॥
বানের মুখে কালা ঢেউ পাক দিয়া করে তল।[১৯১]
ঢেউয়ের পাকে[১৯২] ন্যার ঠাকুর পইড়া হইল তল॥

“না দেখিল[১৯৩] বাপে আরে না দেখিল মায়।
পড়িয়া দুষ্মনের হাতে আমার প্রাণ যায়॥
বিদায় দেও কন্য। আরে এই না বিদায় মাগি।
তোমার আমার শেষ দেখা ইহ জন্মের লাগি॥”

“যে ঢেউয়ে ভাসাইয়া নিল আমার নদীয়ার চান।
সেই ঢেউয়ে পড়িয়া আমি তেজিবাম পরাণ॥”
ঝম্প দিতে সুন্দর কন্যা মাঝিমাল্লায় ধরে।
কি কাম করিল হায় দুষ্মন সদাগরে॥

“কাল না ডাঙ্গর আঁখি লম্বা মাথার চুল।
বিধি আইজ মিলাইল মধুভরা ফুল॥
এমন যৌবন কন্যা যায় অকারণ।
আমারে ভজহ কন্যা রাখহ মোর মন॥
এমন সোনার পান্‌সী তাতে মাঝি নাই।
যৌবন চলিয়া গেলে কেউ না দিব ঠাই॥
ফুলে ভরা মধু কন্যা ফির একেশ্বরী।
তোমারে পাইলে আমি বাঞ্ছা পূর্ণ করি॥
বসনভূষণ দিব আমি দিব নীলাম্বরী।
নাকে কানে দিব ফুল কাঞ্চা[১৯৪] সোনায় গড়ি॥
গন্ধতৈল দিয়া তোমার বাইন্ধা দিবাম কেশ।
ঘরে আছে দাসীবান্দী তোমার নাই ক্লেশ॥
শয্যা তারা পাইতা দিব চরণ দিব ধুইয়া।
সুবর্ণ পালঙ্কে তুমি থাকবা কন্যা বইয়া[১৯৫]
শীতের রাইতে দুঃখ নাই লেপ তুলভরা।
মন যোগাইতে দাসী তোমার সাম্‌নে থাক্‌ব খারা॥
হাতীঘোড়া আছে আমার লোকলস্কর।
সবার ঠাকুরাইন[১৯৬] হইয়া থাকবা আমার ঘর॥
বাড়ী পাছে শানে বান্ধা চারি কোনা পুষ্কুনি।
সেই ঘাটেতে আমার সঙ্গে সাঁতার দিবা তুমি।
অন্দর ময়ালে[১৯৭] আমার ফুলের বাগান।
দুইজনে তুলিব ফুল সকাল ও বিয়ান[১৯৮]

রাত্রিকালে শুইব দোয়ে জোর মন্দির ঘরে[১৯৯]
শীতের রজনীতে কন্যা থাকবা আমার উরে॥
শয্যায় পাইলে বেথা শুইবা আমার বুকে।
বানাইয়া পানের খিলী তুইল্যা দিবাম মুখে॥
আমি খাইবাম তুমি খাইবা কন্যা থাকবাম দুইজনে
তোমায় লইয়া যাইবাম বাণিজ্যকারণে॥
হীরামণি যথায় পাইবাম ভালা বান্যা[২০০] দিয়া।
লক্ষ টাকার হার তোমায় দিবাম গড়াইয়া॥
আর যে কত দিবাম কন্যা নাহি লেখাযোখা।
সোনাতে বান্ধাইয়া দিবাম কামরাঙ্গা শাখা[২০১]
উদয়তারা সাড়ী দিবাম লক্ষ টাকা মুল।
হীরামণি দিয়া তোমার জুইরা দিবাম চুল॥
চন্দ্রহার গড়াইয়া দিবাম নাকে দিবাম নথ।
নূপুরে ঝুনঝুনি কন্যা দিবাম শত শত॥”


এতেক শুনিয়া মহুয়া কি কাম করিল।
সাধুর লাগিয়া কন্যা পান বানাইল॥
পাহাড়ীয়া তক্ষকের বিষ শিরে বান্ধা ছিল।
চুন-খয়েরে কন্যা বিষ মিশাইল॥
হাসিয়া খেলিয়া কন্যা সাধুরে পান দিল মুখে।
রসের নাগইরা[২০২] পান খায় সুখে॥

“কি পান দিছলো কন্যা গুণের অন্ত নাই।
বাহুতে শুইয়া তোমার আমি সুখে নিদ্রা যাই॥”[২০৩]

পান খাইয়। মাঝিমাল্লা বিষে পরে ঢলি।
নৌকার উপরে কন্যা হাসে খলখলি॥
বিষলক্ষের ছুরি কন্যার কাকলে আছিল।
তা দিয়া ডিঙ্গার কাছি কাটিয়া ফেলিল॥
অচৈতন্য হইয়া সাধু পড়িয়াছে নায়।
কুড়াল মারিল কন্যা ডিঙ্গার তলায়॥
ঝম্প দিয়া পড়ে কন্যা জলের উপর।
ভরা সহ সাধুর নাও ডুইবা হইল তল॥ ১-৬৮

(১৯)

নদীর পরপারে বন, মহুয়ার নদের চাঁদকে খোঁজা

“কোন গইনে[২০৪] ফুটে ফুলরে কোথায় জ্বলে মণি।
বিধাতা শিরজিল কন্যা জনমদুঃখিনী॥
কও কও কও পঙ্কী আরে কও তরুলতা।
ঢেউয়ের কুলে[২০৫] পইড়া বন্ধু এখন গেল কোথা॥
শুন আরে বাঘ-ভালুক পরে আমার খাও।
বন্ধুর উদ্দেশ মোরে পরখাইয়া[২০৬] জানাও॥
জলে থাক জলের কুম্ভীর সদা দেখতে পাও।
কোথায় ভাস্যা গেল বন্ধু খবর দিয়া যাও॥
আছিলাম বাদ্যার নারী ভরমিতাম দেশ দেশ।
পরদেশী বন্ধুরে লইয়া ছাড়িলাম দেশ॥

ডালেতে বসিয়া আছ ময়ূরাময়ুরী।
তোমরা কি জানহ কথা কহ সত্য করি॥
দরিয়ায় গলিয়া পড়ে আমার গলার হার।[২০৭]
বিধাতা করিল দুঃখী দুষ[২০৮] বা দিয়াম কার॥  ১—১৪

(২০)

পর্ববতে বনপথ; অদূরে ভগ্ন দেবমন্দির

সন্ন্যাসীর পালা।

“গাছে না পাইলাম ফল দুরে নদীর পানি।
খিদায় অবশ অঙ্গ না বাঁচে পরাণি॥
বড় বড় বাঘভালুক দূরে সইরা[২০৯] যায়।
অভাগ্যা মহুয়ায় দেখ্যা ফিইরা নাহি চায়॥
আকাল মাকাল[২১০] অজগইরা[২১১] হরিণ ধইরা খায়।
দুঃখিনী মহুয়ায় দেখ্যা দূরে চল্যা যায়॥
“জমিনে না গছে[২১২] মোরে নদীতে নাই ঠাই।
এমন প্রাণের বন্ধু আমি কোথায় গেলে পাই॥
আমার লাগিন ছাড়ল সে যে সুখের ঘর বাসা।
আমার লাগিন লইল নদীর কূলে বাসা॥
দুষমন হইল সাধু আমার লাগিয়া।
পরাণ হারাইল বন্ধু জলেতে ডুবিয়া॥
এইনা নদীর জলে ডুবিয়া মরিব।
বৃক্ষ ডালে ফাঁস দিয়া পরাণ তেজিব।

“না দিব না দিব পরাণ আরও দেখি শুনি[২১৩]
জঙ্গলার মধ্যে কার কাতর পরাণি॥”

ভাঙ্গা মন্দিরের মাঝে সাপে করে বাসা।
সন্ধ্যাবেলা যায় কন্যা রাইত থাকবার আশা॥
শুকাইয়া গেছে মাংস পইড়া রইছে হাড়।
মন্দিরের মাঝে দেখে কন্যা মড়ার আকার॥
চিনিতে না পারে কন্যা সুন্দর বয়ান।
লক্ষিয়া দেখিল কন্যা এই ঠাকুর নদ্যার চান্॥

শিরে বান্দা জটা চুল লম্বা মুছ[২১৪] দাড়ি।
আইল সন্ন্যাসী এক হাতে লইয়া খড়ি[২১৫]
কন্যা দেখি সন্ন্যাসী যে ভাবে মনে মন।
এ কোন বিধির কাম ঘটিল এমন॥
“শুন শুন কন্যা আরে বলি যে তোমারে।
কোন দেশ ছাড়িয়া তুমি আইলা এমন দূরে॥
কোন বা রাজার কন্যা দিলা বনবাসে।
কিবা পাপ কইরা ছিলা নবীন বয়সে॥
কঠিন তোমার মাতাপিতা শানে বান্দা হিয়া।
প্রাণে কেমনে বাইচা আছে তোমারে বনে দিয়া॥”

(আরে ভালা) এই কথা শুনিয়া কন্যা কি কাম করিল।
সন্ন্যাসীর পায় ধরি কান্দিতে লাগিল।
হিঙ্গলা পিঙ্গলা জটা কটা মুছ দাড়ি[২১৬]
সন্ন্যাসীর পায় কন্যা যায় গড়াগড়ি॥
আগগুড়ি[২১৭] যত কথা জানায় সন্ন্যাসীরে।
শুনিয়া সন্ন্যাসী তবে লাগে কইবারে॥

“বনে আছে গাছের পাতা তুইল্লা[২১৮] দিবাম আমি।
এই গাছে বাঁচিবে তোমার পতির পরাণী॥[২১৯]
দারুণ আকাল্যা জ্বর[২২০] হাড়ে লাগ্যা আছে।
পরাণে বাঁচিয়া আছে মইরা না সে গেছে॥
শ্বাসেতে ধরিয়া[২২১] পাতা আন নদীর পানি।
এই মন্ত্রে বাঁচাইব তাহার পরাণি॥”

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
চারি দিনে নদ্যার চান আঁখি মেলি চায়॥
ডাক দিয়া সন্ন্যাসী কয় অতি ভোরবেলা।
“আমার ফুল তুলবে কন্যা যাইও একেলা॥”
ফুল তুলিবারে কন্যা যায় দূর বনে।
নিত[২২২] নিত পূজার ফুল হাজি[২২৩] ভইরা আনে॥
উট্টা বসে নদ্যার চান খাইত চায় ভাত।
তা শুন্যা মহুয়া কান্দে শিরে দিয়ে হাত॥
“কোথায় পাইবাম ভাত আমি এই গইন বনে।”
ফুল নাহি তুলে কন্যা থাকে অন্যমনে॥[২২৪]

এদিকে হইল কিবা শুন দিয়া মন।
কন্যার যইবন[২২৫] দেখি মনির[২২৬] ভুলে মন॥
আট্‌কা টাট্‌কা পূজার ফুল হাজি ভরা থাকে।[২২৭]
নিশি রাত্রে[২২৮] মনি আইস্যা মহুয়ারে ডাকে॥

“উঠ উঠ কন্যা আরে কত নিদ্রা যাও।
পরাণে বাঁচাইলে পতি আমার কথা রাখ॥
আজি পূর্ণিমার নিশা আরে শনিবার দিনে।
ঔষধ তুলিতে কন্যা চল গহীন বনে॥”

আস্তে ব্যস্তে উঠি কন্যা চলে মুনির সাথে।
নদীর কিনারে কন্যা গেল গহীন পথে॥
মুনি বলে “কন্যা তুমি আমার কথা শুন দিয়া মন।
পায়ে ধরি মাগি কন্যা তোমার যইবন॥
তোমার রূপেতে আগে কন্যা যোগীর ভাঙ্গে যুগ[২২৯]
এমন ফুলের মধু করাও মোরে ভোগ॥”

আগল পাগল ভাঙ্গা মন খানি জুড়া।[২৩০]
সন্ন্যাসীর কথা শুন্যা শিরে পড়ে খাড়া[২৩১]
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কি কাম করিল।
সন্ন্যাসীরে বুজাইয়া কহিতে লাগিল॥
“স্বামীরে বাঁচাও আগে সত্য করি আমি।
যাহা চাও তাহা দিব বাঁচাইলে পরাণি॥”

এই কথা শুনিয়া মুনির মুখ হইল কালী।
ফিরিয়া কহিছে “কন্যা শুন তবে বলি॥
দুই দিন সময় দিলাম ভাবিয়া স্থির কর।
নিজে খাওয়াইয়া বিষ পতিকে না মার॥”

রাইক্ষসের[২৩২] হাতে পড়ি না দেখি উপায়।
মনে মনে চিন্তে কন্যা কিনতে পলায়॥

এক দিন যুক্তি করে নদের চালে লইয়া।
কিরূপে যাইবে কন্যা দূরে পলাইয়া॥
তেরালেঙ্গা[২৩৩] দেহখানি (আরে ভালা) জ্বরে করছে সাড়া।
হাটীয়া যাইতে নাই সে পারে উঠ্যা না হয় খাড়া॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কি কাম করিল।
আস্তে ব্যস্তে নদ্যার চান্দে কান্দে তুইলা লইল॥
নিশি কালে যায় কন্যা ফিরে ফিরে চায়।
দারুণ সন্ন্যাসী যদি পন্থে লাগাল পায়॥ ১-৮৮

(২১)

বনদস্পতি

এক দুই তিন করি ভালা[২৩৪] ছয় মাস গেল।
ভালা[২৩৫] হইয়া নদ্যার ঠাকুর উঠিয়া বসিল॥
ঝরনীর জন আনে কন্যা আনে বনের ফল।
তা খাইয়া নদীয়ার চান্দের গায়ে হইল বল॥
পার ডিঙ্গাইয়া যায় নদ্যার ঠাকুর সাথে।
অনক দূরতে দুই জনা গেল এই মতে॥

“বাড়ী নাইরে ঘর নাইরে বন্ধ্যে যথায় তথায় থাকি
উইরা[২৩৬] ঘুইরা[২৩৭] ফিরি যেমগ বনের পশুপংখী॥

সাম্‌নে পাহাড়ীয়া নদী সাঁতার দিয়া যায়।
বনের কোহিল পক্ষী ডালে বইসা গায়॥
“এইখানে বাঁধ কন্যা নিজের বাসা ঘর।
এইখানে থাকিয়া মোরা কাটাইব দিন॥
সাম্‌নে সুন্দর নদী ঢেউয়ে খেলায় পানি।
এইখানে বঞ্চিব মোরা দিবস রজনী॥
চৌদিকেতে রাঙ্গা ফুল ডালে পাকা ফল।
এইখানে আছয়ে কন্যা মিঠা ঝরনীর জল।”


নদ্যার ঠাকুর খাইতে বইছে গলায় লাগল কাটা।
বাদ্যার ছেরি[২৩৮] মান্যা থুইছে কালা ধলা পাঠা[২৩৯]
নদ্যার চান্দের জ্বর উঠ্‌ছে মাথায় বেদনা তাত[২৪০]
বাদ্যার ছেরি কাছে বস্যা শিরে বোলায়[২৪১] হাত।
হাটে যায় রে নদ্যার চান কোনাকুনি[২৪২] পথ।
বাদ্যার ছেরি ডাক্যা বলে “কিন্যা আইন নথ”[২৪৩]
বনের ফল তুইল্যা আনে দুইজনে খায়।
মালাম[২৪৪] পাথরে দুইয়ে শুয়ে নিদ্রা যায়॥
রাত্রিতে থাকয়ে ঠাকুর কন্যা লইয়া বুকে।
দিনেতে উঠিয়া দোহে ভরমে নানান সুখে॥
হস্ত ধরি সুন্দর কন্যা ফিরে বনে বন।
পাড়িয়া আনে বনের ফল করিতে ভইক্ষণ[২৪৫]

বাপে ভুলে মায় ভুলে ভুলে ঘর বাড়ী।
দেশ ভুলে বন্ধু ভুলে স্বজন পেয়ারী[২৪৬]
মনের সুখে দুইজনে কাটে দিন রাত।
শিরেতে পড়িল বাজ এই অকরসাত[২৪৭] ১—৩২

(২২)

বনে পর্য্যটন ও বিপদ

একদিন নদ্যার চান দিনের[২৪৮] সন্ধ্যাবেলা।
সঙ্গেতে সুন্দর কন্যা পথে করে মেলা[২৪৯]
কত দূরে দুইজনে গলায় ধরাধরি।
গহীন বনেতে গেল লয়ে সুন্দর নারী॥
পড়িয়াছে মালাম পাথর তাহার উপর।
সুন্দর কন্য। কোলে লইয়া বসিল ঠাকুর॥

কত দূরে নদী আরে ঢেউয়ে খেলায় পানি।
এমন সময় কন্যা শুনে বংশীর ধ্বনি॥
চমকিয়া উঠে কন্যা, কহিল ঠাকুর।
“কি কারণে কন্যা তুমি অইলা চঞ্চল॥
কি কারণে কন্যা তোমার বিরস বদন।
পরকাশ কইরা কহ কন্যা জন্ম-বিবরণ॥
কার কন্যা কোথায় বাড়ী কোথায় বাস কর।
বাদিয়ার সঙ্গেতে কেন দেশে দেশে ফির॥
পুইধ[২৫০] করিয়া আমি উত্তর না পাই।
আজি দিনে এই কথা শুন্তে আমি চাই॥

জিজ্ঞাসা করিলে কেন মুছ চক্ষের পানি!
দরদ লাগিছে তোমার কাতরা হইছে প্রাণী॥
অৰ্দ্ধেক শুনাইলে কথা সেদিন বিয়ানে[২৫১]
ছুটু[২৫২] কালে হুমরা বাইদ্যা চুরি কইরা আনে॥
ওই শুন বাজে বাশী দূরে শুনা যায়।
সন্ধ্যা গুঞ্জরীয়া গেল চল বাসে যাই॥”

“কাইলী[২৫৩] যদি বাচিরে বন্ধু কইবাম সেই কথা।
আজি কেন উঠ্‌লরে বন্ধু দারুণ মাথার ব্যথা॥”
বায়েতে হেলিয়া যেমন লতা পড়ে ঢলি।
নদ্যার চান্দের কান্ধে কন্যা পইরা[২৫৪] গেল এলি[২৫৫]
“কোন সাপেরে জানি কন্যা করিল দংশন।
আজি কেন কন্যা তোমার এমন হইল মন॥”
শুকনা পাতার বাসর[২৫৬] ভাঙ্গে মড়মড়ি।
তাহার মধ্যে বসে কন্যা মহুয়া সুন্দরী॥
আতঙ্কে কন্যার গায়ে কাল্যাজ্বর[২৫৭] আসে
চলিয়া পড়িল কন্যা দারুণ মাথার বিষে॥

“একটুখানি শুয় কন্যা লইয়া আসি জল
অবশ হইল কন্যা অঙ্গে নাই সে বল॥
কান্দিয়া মহুয়া কয় “এই শেষ দিন।
সাপে নাহি খাইছে মোরে গেছে সুখের দিন॥
দূর বনে বাজন বাশী শুন্যাছ যে কানে।
আসিছে বাদ্যার দল বধিতে পরাণে॥
আমারও পালং সই বাশী বাজাইল।
সামাল[২৫৮] করিতে পরাণ ইসারায কহিল॥

আইজ নিশি থাকরে বন্ধু আমার বুকে শুইয়া।
আর না দেখিব মুখ পরভাতে উঠিয়া॥
বনের খেলা সাঙ্গ হল যাব যমের দেশ।
এই কথা কহি আমি শুনহ বিশেষ।”

রজনী হইল শেষ আশমানে মিলায় তারা।
প্রভাতে উঠিয়া দোয়ে[২৫৯] বায়রে[২৬০] দিল পারা॥ ১-৪৬

(২৩)

হুমরার দল

চৌদিকেতে চাইয়া দেখে শিকারী কুকুর।
সন্ধান করিয়া বাদ্যা আইল এত দূর॥
সামনেতে হুমরা বাদ্যা যম যেন খারা।
হাতে লইয়া দাঁড়াইয়াছে বিষলক্ষের ছুরা।
আক্ষিতে জালিছে তার জ্বলন্ত আগুনি।
নাকের নিশ্বাস তার দেওয়ার[২৬১] ডাক শুনি॥
“প্রাণে যদি বাঁচ কন্যা আমার কথা ধর
বিশলক্ষের ছুরি দিয়া দুষ্মনেরে[২৬২] মার॥
আমার পালক পুত্রু সুজন খেলোয়ার।
বিয়া তারে কর কন্যা চল মোদের সাথ॥”

“কেমনে মারিব আমি পতির গলায় ছুরি।
খারা থাক বাপ তুমি আমি আগে মরি॥”

“সুজন খেলোয়ার আরে সুন্দর যোয়ান[২৬৩]
এমন পতি পাইয়া তুমি কি করিলে কাম॥

ইয়ার[২৬৪] সঙ্গে দিবাম বিয়া দেশে চল যাই।
খুজিয়া হয়রাণ হইলাম তোমারে না পাই॥”

“কেমন করি যাইবাম দেশে বন্ধুরে মারিয়া।
তোমার সুজনে আমি না করবাম বিয়া॥
আমার বন্ধু চান্দ-সুরুজ কাঞ্চা সোনা জ্বলে।
তাহার কাছে সুজন বাদ্যা জ্যোনি[২৬৫] যেমন জ্বলে॥
সোণার তরুয়া বন্ধু একবার পেখ।
আমার চক্ষু তুমি নিয়া নয়ান ভইরা[২৬৬] দেখ॥”

গর্জিয়া উঠে কালা দেওয়া[২৬৭] হাতে লইয়া ছুরি।
মহুয়ার হাতেতে দিল বিষলক্ষের ছুরি॥
একবার চায় কন্যা পালং সইয়ের পানে।
একবার চাহিল কন্যা পতির বদনে॥

“শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে।
জন্মের মতন বিদায় দেও এই মহুয়ারে॥
শুন শুন পালং সই শুন বলি কথা।
কিঞ্চিৎ বুঝিবে তুমি আমার মনের বেথা।
শুন শুন নাও বাপ বলি হে তোমায়।
কার বুকের ধন তোমরা আইনাছিলা[২৬৮] হায়॥
ছুট[২৬৯] কালে মা-বাপের কুল[২৭০] শুন্য করি।
কার কুলের ধন তোমরা কইরে ছিলে চুরি॥
জন্মিয়া না দেখলাম কভু বাপ আর মায়।
কর্ম্মদোষে এত দিনে প্রাণ মোর যায়॥”

* * *

( মহুয়ার নিজ বক্ষে ছুরিকা-আঘাত ও পতন। হুমরার আদেশে বেদের দল কর্তৃক নদের চাঁদের প্রাণবধ )

( ২৮ )

হুমরার অনুতাপ; পালঙ্কের স্নেহ

“ছয় মাসের শিশু কন্যা পাইল্যা করলাম বর।
কি লইয়া ফিরবাম দেশে আর না যাইবাম ঘর॥
শুন শুন কন্যা আরে একবার আখি মেইলা চাও।
একটি বার কহিয়া কথা পরাণ জুড়াও॥
আর না ফিরিব আমি আপনার ভবনে।
তোমরা সবে ঘরে যাও আমি যাইবাম বনে॥”


হুমরা বাদ্যা ডাক দিয়া কয় “মাইন্‌ক্যা ওরে ভাই।
দেশেতে ফিরিয়া মোর আর কার্য্য নাই॥
কয়বর[২৭১] কাটীয়া দেও মহুয়ারে মাটী।
বাড়ীঘর ছাইড়া ঠাকুর আইল কন্যার লাগি।
দুইয়েই পাগল ছিল এই দুইয়ের লাগি॥”

হুমরার আদেশে তারা কয়বর কাটীল।
একসঙ্গে দুইজনে মাটী চাপা দিল॥
বিদায় হইল সব যত বাদ্যার দল।
যে যাহার স্থানে গেল শূন্য সেই স্থল॥

রইল তথা পালং সই সুখদুখের সাথী।
কান্দিয়া পোহায় কন্যা যায়রে দিনরাতি॥
অঞ্চল ভরিয়া কন্যা বনের ফুল আনে।
মনের গান গায় কন্যা বইসা বনে বনে॥
চক্ষের জলেতে ভিজায় কয়বরের মাটী।
শোকেতে পাগল কন্যা করে কান্দাকাটী॥
“উঠ উঠ সখী তুমি কত নিদ্রা যাও।
আমি ডাকি পালং সই একবার কথা কও॥

ফিইরা গেছে বাদ্যার দল আর না আইব তারা।
সুখেতে বাধিয়া ঘর কর তুমি বাসা॥
দুরন্ত দুষমন সেই যত বাদ্যার দল।
তোমারে ছাড়িয়া তারা গিয়াছে সকল॥
দুইয়ে সইয়ে কুলাকুলি গন্থি[২৭২] ফুলের মালা।
দুইয়ে জনে সাজাইব ঐ না নাগর কালা[২৭৩]॥”

পালং সইয়ের চক্ষের জলে ভিজে বসুমাতা।
এইখানে হইল সাঙ্গ নদীয়ার চান্দের কথা॥ ১—৩১

  1. ভানুশ্বর = ভানুর ঈশ্বর = (শিব?)
  2. পশর = প্রসার (?), প্রকাশ, আলোক।
  3. মালামের = পদচিহ্নের
  4. এন=হেন।
  5. উর্‌দিশে = উদ্দেশে।
  6. বাড়ায় = হাত বাড়াইয়া (সেলাম করা)।
  7. মমিন = বিদ্বান্।
  8. ইন্দু=হিন্দু
  9. কুনা=কোণা। ময়মনসিংহ প্রভৃতি কতকগুলি স্থানে “ও” কারের স্থানে “উ”কার-ব্যবহারের রীতি আছে, যথা চোর=চুর।
  10. পির্‌থিমি= পৃথিবী।
  11. বইন্ধ্যা = বন্দনা করিয়া
  12. সুন্দরবনের ব্যাঘ্রের দেব দক্ষিণরায়ের সঙ্গে গাজির যুদ্ধের কথা অনেক পুস্তকেই আছে। কুঞ্চরামের দক্ষিণরামের পালাতে এই যুদ্ধের বিশেষ বিবরণ আছে। পুথির নাম “রায় মঙ্গল”।
  13. সুরুয = সূর্য্য।
  14. আলাম-কালাম = ঈশ্বরের কথা। কুরাণ = কোরাণ।
  15. মিন্নতি = মিনতি।
  16. এই বন্দনাগীতিটি স্পষ্টই জনৈক মুসলমান গায়েনের রচিত।
  17. সমুদ্দর = সমুদ্র।
  18. চাঁন্দ সুরুয নাই = চন্দ্র ও সূর্য্য নাই।
  19. ‌আন্দারিতে=আন্ধারে
  20. বইসে=বাস করে
  21. মাইন্‌সের=মনুষ্যের।
  22. লরাচরা=নড়াচড়া।
  23. বাইদ্যা=বেদে
  24. ইন্দু=হিন্দু
  25. ছুড়ু=ছোট
  26. অচরিত=অপূর্ব্ব।
  27. ভর্‌মিতে=ভ্রমণ করিতে।
  28. আচিল = আছিল, ছিল।
  29. বির্দ্দ=বৃদ্ধ
  30. বরাম্মন=ব্রাহ্মণ
  31. কইন্যা=কণ্যা
  32. ছার‍্যা=ছাড়িয়া
  33. বচ্ছরের=বৎসরের (এক বৎসরের)।
  34. পঙ্খী=পক্ষী (এই শব্দ এখনও ‘ময়ূর-পঙ্খী’ কথায় ব্যবহৃত হয়)।
  35. শুল=ষোল
  36. কছরত=কৌশল
  37. থাইক্যা=থাকিয়া
  38. ফুট্টা=ফুটিয়া
  39. আগল ডাগল = সুদীর্ঘ। কোন কোন স্থলে ‘আগল দীঘল’ কথা পাওয়া যায়।
  40. পাশুরা = পশিরা = বিস্মরণ হওয়া। “পাশরিতে করি মনে গো না যায় পাশরা”—চণ্ডীদাস।
  41. এরূপ ঐকার অনেক শব্দেই পাওয়া যায়, যথা—বৈদেশ, যৈবন।
  42. শুক্কুর বাইর‍্যা = শুক্রবার।
  43. গাট্টীবুচ্‌কা= গাঠ্‌রি বোচকা।
  44. ইহার পরে একটা ছত্র পাওয়া যায় নাই।
  45. দইয়ল = দয়েল। এই পাখীর চঞ্চু স্বর্ণ বর্ণ, এজন্য ইহাকে সোণামুখী বলা হইয়াছে।
  46. রাও চণ্ডালের হাড় = রাজ-চণ্ডালের হাড় (চণ্ডালদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির হাড়?) বেদেরা তাহাদের বাজি করিবার সময় একটা হাড় লইয়া তাহাদের দ্রব্যাদিতে ঠেকাইয়া নানারূপ অদ্ভুত ক্রিয়া করিয়া থাকে। সেই হাড়ই সম্ভবত এই “রাও চণ্ডালের” হাড় হইবে
  47. হেজা=সেজা=শজারু।
  48. গুয়াইল=গোয়াইল=অতীত হইল।
  49. নদ্যার চান = নদের চাঁদ। এই নামটিতে বুঝা যায় যে গানটি ৩০০ বৎসর পূর্ব্বে রচিত হইলেও তদুর্দ্ধ কালের নহে, ইহা চৈতন্য প্রভুর পরবর্ত্তী, কারণ, চৈতন্য প্রভুর পূর্ব্বে কাহারও নাম নদের চাঁদ হইতে পারিত না।
  50. লেংরা = ‘তেরা’ ‘লেংড়া’ প্রভৃতি শব্দ ময়নামতীর গান ও পূর্ব্ববর্তী অনেক পুস্তকে পাওয়া যায়। ‘লেংড়া = খোঁড়া’; টেরা= বক্রচক্ষু। পূর্ব্বকালে রাজ-অন্তঃপুরে যাতায়াতের জন্য বিকলাঙ্গ ব্যক্তি নিযুক্ত হইত।
  51. কাডি= কাটি, শর।
  52. ডুলে = ঢোলে
  53. আই = আসি।
  54. চাইর= চারি।
  55. বইয়া = বসিয়া।
  56. ছেরি=বালিকা।
  57. যে মুহূর্ত্তে বেদের মেয়ে বাঁশ ধরিয়া লাড়া দিল।
  58. নদের চাঁদ উঠিয়া বলিল, ‘পাছে উঁচু হইতে পড়িয়া মারা যায়৷’ দর্শকের কৌতূহল দূর হইয়া অন্তরঙ্গের মত আশঙ্কা জন্মিয়াছে; প্রেমের সূত্রপাত।
  59. কর্ত্তালের ঝুনঝুনু শব্দের সঙ্গে বেদে-বালিকা ঢোলে তাল দিল।
  60. মুখে পুরস্কার পাওয়ার কথা বলিল, কিন্তু মনে মনে নদের চাঁদের মন প্রার্থনা করিল।
  61. এই ছত্রের কতকটা পাওয়া যায় নাই। পাতা == পাট্টা, কইলৎ = কবুলিয়ত।
  62. বামুনকান্দা গ্রামের নিকট উলুয়াকান্দা এখনও আছে।
  63. জুইতের =খুব পছন্দসই।
  64. লীলুয়া বয়ারে = ক্রীড়াশীল বায়ুতে।
  65. বাইঙ্গন= বেগুন।
  66. হুমরা বেদে মহুয়াকে লোভ দেখাইয়া সেখানে রাখিতে চাহিতেছে।
  67. উরি=শিম।
  68. চৌকারী=চৌয়ারী ঘর, চৌচালা।
  69. কইতর = পারা।
  70. বাচ্যা =বাছিয়া (উৎকৃষ্ট দেখিয়া)। এই শব্দ পূর্ব্ববঙ্গে এখনও প্রচলিত আছে
  71. মেলা=যাত্রা করা, (কৃত্তিবাসে “মেলাণি” =বিদায়; এই শব্দ পূর্ব্ববঙ্গে এখনও প্রচলিত আছে— “মেলা করিল” অর্থ রওনা হইল)।
  72. কুনায়=কোণায়।
  73. চান্নি = চাঁদিনী।
  74. সূর্য্য পাটে বইসে, অস্ত যায়।
  75. “পঙ্খীর” মত “কাঙ্কে” শব্দের “ঙ” কিরূপে আসিল বুঝা যায় না, কাঙ্কে = কক্ষে।
  76. চান = চাঁদ।
  77. ভিন দেশী=ভিন্নদেশী।
  78. কইছলা=করেছিলে।
  79. যইবন = যৌবন।
  80. ভুলা=ভোলা, যাহার ভুল বা বিস্মৃতি হয়।
  81. রাতিরে = রাত্রিতে।
  82. সুদর = সহোদর। এখানে গর্ভ কথাটা দ্বিরুক্তি।
  83. সূতের হেওলা = স্রোতের শেওলা।
  84. অইয়া=হইয়া।
  85. পুইর‍্যা=দগ্ধ হইয়া।
  86. দরদী=মর্ম্ম বুঝে যে এমন লোক।
  87. হালে = আপনার অবস্থা অনুসারে, নিজের ইচ্ছামত।
  88. শানে = পাষাণে, প্রস্তরে।
  89. তর= তোমার।
  90. গহীন = গভীর।
  91. পূর্ব্ববঙ্গে নদীমাত্রকেই “গাঙ্গ” (গঙ্গা) বলা হয়।
  92. বইন=বোন, ভগিনী।
  93. সইন্ধ্যা = সন্ধ্যা।
  94. পুয়াও = পোহাও।
  95. চউক্ষে= চোখে।
  96. হাইম= দীর্ঘনিশ্বাস।
  97. অইছে=হইয়াছে।
  98. দিয়াম= দিব।
  99. মুরতেক=মুহূর্তের জন্য।
  100. বান্‌ধ্যা = বান্ধিয়া।
  101. অইবাম=হইব।
  102. তোমাই = তোমাকে।
  103. খাইবাম=খাব।
  104. লাগে = লাগিয়া।
  105. মাইন্‌কিয়া = মান্‌কে (মানিক= হোমড়ার ভাই)।
  106. পাইক্যা = পক্ব হইয়া।
  107. আইছে = আসিয়াছে।
  108. কিরা = শপথ
  109. সোনার = স্বর্ণের মত আদরের, অর্থাৎ স্বর্ণ বর্ণ।
  110. কুইল=কোকিল।
  111. কু ডাকে = কুহু শব্দে ডাকে।
  112. আগ রাঙ্গিয়া—পাকিয়া = শালি ধানের অগ্রভাগ রঞ্জিত হইয়া (রাঙ্গিয়া) পক্ব হইয়া উঠিয়াছে।
  113. আড়, যে বাঁশী হেলাইয়া ধরিয়া বাজাইতে হয়—কৃষ্ণের বাঁশীর মত।
  114. ঠার দিয়া = সঙ্কেত করিয়া।
  115. চৈতার বউ = পাপিয়া, আমরা যে পাখীকে “বউ কথা কও” বলিয়া থাকি।
  116. নয়া = নূতন।
  117. ছাড়বাম=ছাড়িব।
  118. অইয়াম = হইব।
  119. ছেড়ী=মেয়ে।
  120. পাগলা পঙ্খিনী = পাগলা পাখীকে
  121. ছাপাই= ঢাকিয়া।
  122. ঝাইড়িয়া=ঝাড়িয়া
  123. বানতাম = বান্ধিতাম।
  124. ঘাঘুরী=গাগরি (হিন্দী), কলসী।
  125. সন্দে=সন্দেহ।
  126. গুচ্যা = ঘুচিয়া।
  127. থাকবাম = থাকিয়া।
  128. থাক্য=থাকিও।
  129. আইন্ধ্যারিয়া = আঁধার।
  130. এই কথা —- চমক তারা=এই কথা শুনিয়া সকল লোক চমৎকৃত হইল।
  131. খাইতে বইয়া=খাইতে বসিয়া।
  132. গরাস = গ্রাস।
  133. রাইন্দো = রন্ধন করিও।
  134. ফালাইও = ফেলিও।
  135. বৈদেশে = বিদেশে।
  136. খাইয়াম = খাইব।
  137. উরের ধন—ছাড়িয়া=আমার বক্ষের রত্ন পুরে ফেলিয়া দিব, তবু তোমাকে ছাড়িয়া দিব না।
  138. আধ পিঠ—শীতে=ছেলের মলমূত্রে মাতার অর্ধেক পৃষ্ঠদেশ ক্ষয় হইল (খাইল)। বাকী পৃষ্ঠদেশ মাঘ মাসের শীতে ক্ষয় পাইল। এত কষ্টে তোষাকে পালন করিয়াছি।
  139. বিদেশে—যায়=বিদেশে বিপদে পড়িয়া যদি পুত্র মারা পড়ে, তবে দেশের কোন লোক তাহা জানিবার পূর্ব্বে মায়ের মনে তাহা আগেই টের পায়। মাতৃহৃদয় এতটা স্নেহপ্রবণ ও শঙ্কাতুর
  140. পরবুধ=প্রবোধ।
  141. থাকবাম=থাকিব।
  142. উরদিশে = উদ্দেশে।
  143. সুদুর = সহোদর।
  144. তিরভুবন = ত্রিভুবন।
  145. “জইতার পাহাড়ের” কথা মহুয়া নদের চাঁদকে যাইবার পূর্ব্বে বলিয়া গিয়াছিল। ইহা গারো পাহাড়ের অন্তর্গত।
  146. পুছ করে=জিজ্ঞাসা করে। পূর্ববঙ্গের অনেক স্থলে মুসলমানেরা “পুছ করে” কথা ব্যবহার করিয়া থাকে; “পৃচ্ছ” শব্দের অপভ্রংশ।
  147. রাউখাল=রাখাল।
  148. লড়ালড়ি=ছুটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি।
  149. দেখ্‌ছ=দেখেছ
  150. ভালা=ভাল
  151. দেখতামরে=দেখিতাম রে (আমি যদি কাছে থাকিতাম)
  152. উইড়া = উড়িয়া।
  153. চইতের=চৈত্রের।
  154. ঘোড়ার পায়ের - - - মাস = বেদেদের ঘোড়ার খুরের চিহ্ন ও ছাগলে খাওয়া ঘাস দেখিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, বেদের দল ফাল্‍গুন ও চৈত্র মাস সেইখানে কাটাইয়াছে।
  155. ভায়= ‘ভাতি’ শব্দ হইতে; প্রকাশ পায়।
  156. দায় = জন্য।
  157. মেঘে—পোয়াই = বৃষ্টিতে ভিজিয়া ও রৌদ্রে পুড়িয়া রজনী যাপন করে
  158. বরত=ব্রত।
  159. আক্ষি ঘোর=চক্ষু ঘোর অর্থ নিষ্প্রভ হইল।
  160. আগুণ = অগ্রহায়ণ।
  161. পাড়ি = পাড়ে।
  162. ভাবিয়া—খারা = ভাবিতে ভাবিতে মহুয়ার রং কাল হইয়া গিয়াছে। বেদের দলের লোকেরা বলাবলি করিতেছে, ‘মহুয়ার কি ভয়ানক শিরঃপীড়া হইয়াছে যে, সে রাত্রে ঘুমায় না। অন্নজল সে ত্যাগ করিয়াছে। তাহার সর্ব্বাঙ্গে এমনই ব্যথা হইয়াছিল যে, গত ছয় মাস সে একরূপ আঁচল (আইঞ্চল) পাতিয়া শুইয়া থাকিত। সে আর নিজে ভাত রান্না করিত না—বেদেদের খেলায়, তাহার আর আগ্রহ দেখা যাইত না। আজ কেন অকস্মাৎ এমন হইল, যে ব্যক্তি ছয় মাস কাল মৃতবৎ পড়িয়াছিল সে হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল?’
    [এতদ্দ্বারা অতিথির (নদের চাঁদের) আগমনজনিত মহুয়ার আনন্দ সূচিত হইতেছ।]
  163. ভোঞ্জন = ভোজন। জাতি—ভোঞ্জন = আজ নদের চাঁদ ব্রাহ্মণ হইয়া মহুয়ার রাঁধা ভাত খাইয়া জাতি নষ্ট করিলেন।
  164. পরখাই =পরীক্ষা।
  165. ঘুইরা =ঘুরিয়া।
  166. মইতানা = মত্ত হইয়া, বহু দিনান্তে মহুয়ার দর্শন পাইয়া আনন্দে মত্ত হইয়া ঘুমাইয়া আছে।
  167. শিওরা = শিওরে।
  168. বইক্ষেতে= বক্ষে।
  169. সাওরে = সাগরে, নদীতে।
  170. সুনালী=সোণালী।
  171. চান্নীর = চাঁদিনী, জ্যোৎস্নাময়ী।
  172. আবে=অভ্রে, পাতলা মেঘে।
  173. চিন্তিয়া = চিন্তা করিতে করিতে (কিছু স্থির করিতে না পারিয়া)।
  174. বিষলক্ষের=যাহার অগ্রভাগ বিষাক্ত।
  175. জ্বালিয়া—নিবাই= ঘি দিয়া পবিত্র দীপ জ্বালিয়া নিজেই ফুঁ দিয়া নিবাইব? (নিজেই নিজেদের এই পবিত্র প্রেমের ধ্বংস করিব?)
  176. তুমারে = তোমাকে।
  177. পিওয়া =প্রিয়া। মহুয়া নিজেকেই কঠিন বলিতেছে।
  178. বরামণের = ব্রাহ্মণের।
  179. অরদিশ = দিশাহারা।
  180. মাও ছাড়ছি—এই স্থান হইতে নদের চাঁদের উক্তি।
  181. এই ছত্র হইতে মহুয়ার উক্তি।
  182. আবে করে ঝিলীমিলী = অভ্রের (পাতলা মেঘের) উপর কিরণ-রেখা ঝিকিমিকি করিতেছিল।
  183. শণেতে = শূন্যেতে।
  184. জংলার = জঙ্গলের।
  185. থাপা = থাপর।
  186. দফা= (বেদেদিগের) অশ্ব রাখিবার স্থান।
  187. বিস্তার = প্রশস্ত।
  188. পক্ষী নয় — পাল = নৌকার পাল দেখিয়া প্রথমতঃ দূরত্ববশতঃ পক্ষী বলিয়া ভ্রম হইয়াছিল, তারপর সেই ভ্রম দূর হইল।
  189. গইন = গহীন (গভীর)।
  190. সল্লা = পরামর্শ (সাধারণত: ‘কুপরামর্শ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়)।
  191. বানের মুখে—তল=প্রবল বানের সম্মুখে কালো বর্ণ ঢেউ চক্রের সৃষ্টি করিয়া যাহা পড়ে তাহা তল করিয়া ফেলে। পাক = চক্র, এখনও ‘পাকচক্র' শব্দ কথায় ব্যবহৃত হয়।
  192. পাকে = ঘূর্ণিতে, চক্রেতে।
  193. দেখিল = দেখিলাম।
  194. কাঞ্চা=কাঁচা
  195. বইয়া = বসিয়া।
  196. ঠাকুরাইন = ঠাকুরাণী।
  197. ময়ালে = মহলে।
  198. সকাল ও বিয়ান = খুব ভোরে ও প্রাতঃকালে।
  199. প্রাচীন বাঙ্গালায় এই “জোর মন্দির” শব্দ অনেক স্থলেই পাওয়া যায়, গোবিন্দচন্দ্রের গান দেখ।
  200. বান্যা = বায়না, দাম। ভালা বান্যা = বেশী মজুরী দিয়া।
  201. কামরাঙ্গা শাখা = কামরাঙ্গা ফলের মত পলকাটা শাঁখা।
  202. রসের নাগইরা = রসপূর্ণ নাগরিয়া, রসিক নাগর।
  203. কি পান—যাই = সদাগরের উক্তি, পানের এরূপ গুণপনা যে আমার এমন নেশা লাগিয়াছে যে আমি আর বসিতে পারিতেছি না—তোমার বাহুর উপর মাথা রাখিয়া নিদ্রা যাইব।
  204. গইনে = গহন বনে।
  205. কুলে = কোলে।
  206. পরখাইয়া = প্রত্যক্ষ করিয়া বা পরীক্ষা করিয়া।
  207. দরিয়ার—হার = নদীর মধ্যে আমার গলার হার ডুবিয়া পড়িয়াছে (নদের চাঁদ জলে ডুবিয়াছে)।
  208. দুষ = দোষ।
  209. সইরা = সরিয়া।
  210. আকাল মাকাল = বিপরীত আকার, প্রকাণ্ড।
  211. অজগইরা = অজগর সাপ।
  212. গছে = গ্রহণ করে।
  213. আরও দেখি শুনি = আরও ভাল করিয়া সন্ধান করিব।
  214. মুছ = মোছ, গোঁফ।
  215. খড়ি = লাঠি।
  216. কটা মুছ দাড়ি=গোঁফ ও দাড়ি কটাবর্ণ।
  217. আগগুড়ি = আগাগোড়া।
  218. তুইল্লা = তুলিয়া।
  219. এই গাছে - - - পরাণী = এই যে গাছের পাতা আমি তুলিয়া দিতেছি, তাহাতেই তোমার পতির জীবন বাঁচিবে।
  220. আকাল্যা জ্বর = কাল-জ্বর, বিষম-জ্বর।
  221. শ্বাসেতে ধরিয়া = নিশ্বাস রোধ করিয়া।
  222. নিত=নিত্য।
  223. হাজি = সাজি।
  224. ফুল - - - অন্যমনে = নদের চাঁদকে ভাত দিতে না পারিয়া মহুয়া ফুল তুলিতে যায় না, বিমর্ষভাবে ও অন্যমনস্ক হইয়া থাকে।
  225. যইবন= যৌবন।
  226. মনির = মুনির।
  227. আট্‌কা - - - থাকে =যদিও সদ্য তোলা ফুলে সাজি পূর্ণ, তথাপি।
  228. নিশি রাত্রে = গভীর রাত্রিতে।
  229. যুগ= যোগ।
  230. আগল পাগল - - - জুড়া = মহুয়ার মন জুড়িয়া স্বামীর চিন্তা—তজ্জন্য সে পাগলের মত হইয়া আছে ও তাহার মন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।
  231. খাড়া =খড়্গ।
  232. রাইক্ষস = রাক্ষস, এই ‘ই’কার পূর্ববঙ্গের অনেক স্থলে প্রচলিত আছে, যথা ‘রাত’-স্থলে ‘রাইত’, ‘কাল’ স্থলে ‘কাইল’ ‘আজ' স্থলে ‘আইজ’।
  233. “তেরালেঙ্গা”=তিন ঠাঁই ভাঙ্গা, এই শব্দটিও প্রাচীন অনেক কাব্যেই পাওয়া যায়। পূর্ব্বে
    বড়লোকেরা খোঁড়া ও বিকলাঙ্গ লোক অন্তঃপুরে রাখিতেন। খোজাদের মত তাহাদেরও খবরাখবরের জন্য অন্তঃপুরে গতাগতি ছিল। এখানে অবশ্য দলের তাঁদের পীড়া হেতু।
  234. এই ভালা শব্দ গানের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়, ইহা গানের মাঝখানে একটা অবকাশসূচক অর্থশূন্য শব্দ, গানের ছন্দ রক্ষার জন্য ইহার প্রয়োজন। ইহার সাধারণ অর্থ “ভাল"।
  235. এই “ভালা” অর্থ ‘সুস্থ’, ‘ভাল’।
  236. উইরা =উড়িয়া।
  237. ঘুইরা = ঘুড়িয়া।
  238. ছেরি = মেয়ে।
  239. নদের চাঁদের গলায় মাছের কাঁটা বিধিয়াছে, মহুয়া তাঁহার জন্য দেবতাকে কালো ও ধবল পাঠা মানত করিতেছে।
  240. তাত= তদ্দরুন।
  241. বোলায়=বুলায়।
  242. কোনাকুনি = সোজা।
  243. শেষ ছয় ছত্রে প্রণয়ীদের গৃহস্থালীর কয়েকটি মনোজ্ঞ বিভিন্ন দৃশ্য দেখান হইয়াছে।
  244. মালাম = পদচিহ্নযুক্ত।
  245. ভইক্ষণ=ভক্ষণ
  246. পেয়ারী = প্রিয়জনদিগকে।
  247. অকরসাত=অকস্মাৎ।
  248. দিনের = এই শব্দটি এখানে বিশেষ এক দিনের।
  249. বেলা = রওনা হওয়া, এই “মেলা করা” কথাটা এখনও পূর্ব্ববঙ্গে খুব প্রচলিত। এই শব্দের রূপান্তর “মেলানি” কথা কৃত্তিবাস প্রভৃতি প্রাচীন লেখকদের কাব্যে বিস্তর পাওয়া যায়।
  250. পুইধ = প্রশ্ন।
  251. বিয়ানে=প্রভাতে।
  252. ছুটু=ছোট।
  253. কাইলী =কা’ল।
  254. পইরা = পড়িয়া
  255. এলি== এলাইয়া।
  256. বাসর =শুক্‌না পাতা দিয়া দম্পতির যে শয্যা তৈরী হইয়াছিল।
  257. কাল্যাজ্বর=কালাজ্বর
  258. সামাল = সাবধান, রক্ষা
  259. দোয়ে=দোহে, দুইজনে।
  260. বায়রে = বাহিরে।
  261. দেওয়ার = মেঘের, (দেব শব্দ হইতে দেওয়া, যথা দেবগর্জন)।
  262. দুষ্মনেরে=শত্রুকে, নদের চাঁদকে।
  263. যোয়ান = যুবক।
  264. ইয়ার= ইহার।
  265. জ্যোনি = জোনাকি পোকা।
  266. ভইরা = ভরিয়া।
  267. কালা দেওয়া কালো মেঘ, এখানে হুমরা বেদে।
  268. আাইনাছিলা = আনিয়াছিল।
  269. ছুট=ছোট।
  270. কুল=কোল
  271. কয়বর = কবর।
  272. গন্থি = গাঁথি।
  273. নাগর কালা = কালিয়া নাগরকে এস্থলে, নদের চাঁদকে।