মোগল-বিদুষী/জেব্-উন্নিসা


শাহ্‌জাদী জেব্-উন্নিসা
(দিল্লী মিউজিয়মে রক্ষিত প্রাচীন চিত্র হইতে)

জেব-উন্নিসা

কবি গাহিয়াছেন:—

 The paths of glory lead but to the grave.

 নরগরিমার শেষ—শ্মশান-সৈকত। এ কথার জ্বলন্ত সাক্ষী—মোগল-মহিমার মহাশ্মশান ঐ দিল্লী, ঐ আগ্রা! সবই গিয়াছে,—আছে শুধু হৃদয়-মনোমোহন স্মৃতি! এই দিল্লী আগ্রার বাদ্‌শাহী-উদ্যান, একদিন একটি অতুলনীয় সুষমাময়ী প্রসূনের সুবাসে আমোদিত হইয়াছিল,—যাহার পবিত্র সুরভি এখনও তেমনই স্নিগ্ধ, তেমনই মনোমদ। সেই পবিত্র কুসুম—‘রমণীরত্ন’, শাহানশাহ্‌ আওরংজীব-দুহিতা—জেব্‌ উন্নিসা!

 মোগল-সম্রাট্‌ আওরংজীবের জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম জেব্‌-উন্নিসা। তিনি দিলরস্‌ বানু বেগমের গর্ভে, ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারী দক্ষিণাপথের দৌলতাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। হাফিজা মরিয়ম্ নামে জনৈক বিদুষী মহিলার উপর জেবের শৈশব-শিক্ষার ভার অর্পিত হয়। অল্প বয়স হইতেই তাঁহার জ্ঞানার্জ্জন-স্পৃহা অতীব বলবতী ছিল। সেকালের প্রথানুসারে তিনি কোরাণ কণ্ঠস্থ করেন। একদিন পিতার নিকট সমস্ত কোরাণ আমূল আবৃত্তি করিয়া সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করিয়াছিলেন। কন্যার অনন্যসাধারণ স্মরণশক্তি-দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, আওরংজীব বালিকাকে ৩০ হাজার আশরফি পারিতোষিক প্রদান করেন। বলা বাহুল্য, জেব্‌-উন্নিসা। এই শিক্ষার সুফল সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করিতে কিছুমাত্র আলস্য করেন নাই। নস্তালিক্, নস্‌খ ও শিকাস্তা—এই তিন ছাঁদেই তাঁহার হাতের ফার্সী অক্ষর সুন্দর হইয়া উঠিয়ছিল। আর্বী ও ফার্সী উভয় ভাষাতেই তাঁহার যথেষ্ট অধিকার জন্মিয়াছিল। আরবীয় ধর্ম্মতত্ত্বে তিনি ব্যুৎপন্ন ছিলেন। বাদশাহ্‌ তাঁহার এই বিদুষী ধর্ম্মানুরাগিণী কন্যাটিকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। অনেক সময় জেবের সহিত তাঁহার ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা হইত। ঐ আলোচনা কিরূপ, তাহা জেব্‌-উন্নিসাকে লিখিত, আওরংজীবের একথানি পত্রপাঠে অবগত হওয়া যায়। পত্রখনির কিয়দংশ আর্বী ও কিয়দংশ ফার্সীতে লিখিত। ‘ফয়াজ্‌-উল্‌-কওয়ানীন পুঁথির ৩৬৯ পৃষ্ঠায় ইহার যে নকল দেওয়া হইয়াছে, তাহার মর্ম্মানুবাদ এইরূপ।—

“ভগবান্‌কে বন্দনা করিয়া ও প্রেরিত-পুরুষকে প্রণিপাত করিয়া (লিখিতেছি)।—খোদার আশীর্ব্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হউক। পুণ্য মাস রম্‌জান্‌ আসিয়াছে। পরমেশ্বর তোমার উপর উপবাসরূপ কর্ত্তব্যের ভর অর্পণ করিয়াছেন। এই মাসে স্বর্গদ্বার উদ্‌ঘাটিত ও নরকদ্বার রুদ্ধ হয়, বিপ্লবকারী শয়তানেরা কারানিবদ্ধ থাকে। রম্‌জানের ধর্ম্মনিয়মাদি প্রতিপালনের জন্য আমরা উভয়েই যেন ভগবানের আশীর্ব্বাদ লাভ করিতে সমর্থ হই।
“বৎসে! তোমার ও আমার মধ্যে যে পত্র-ব্যবহার হয়, তাহাতে যেন আমাদের আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধিত হইতে পারে। ঐহিক সুখরাশির নেশায় প্রমত্ত মূঢ় মানবের ন্যায় আর কতকাল আমরা পারত্রিক-ব্যাপারে উদাসীন হইয়া, ভগবানের সঙ্গ হইতে দূরে থাকিব?
“একমাত্র ভগবদনুগ্রহই আমাকে সুপথে পরিচালিত করিবার প্রেরণা দান করিতে পারে। সেই প্রকৃত মহান ঈশ্বর বলিয়াছেন,—আমি জীবন ও মৃত্যুর সৃষ্টি করিয়াছি।”

 যাঁহার প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্য্যের তুলনা নাই, জেব্‌-উন্নিসা সেই মহাভাগ্যবান্‌ ভারতেশ্বরের আদরিণী কন্যা,—ইচ্ছা করিলে যে-কোনরূপ বিলাসব্যসনে আমরণ নিমগ্ন থাকিতে পারিতেন। কিন্তু এই বিদুষী বাদশাহ্‌-দুহিতা সে সকলকে একান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে করিয়া, জ্ঞানানুশীলন ও সাহিত্যচর্চ্চাকেই তাহার পুণ্যময় জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। বহু মূল্যবান্‌ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ তাঁহার পুস্তকাগারের গৌরব বৃদ্ধি করিত। এরূপ উচ্চাঙ্গের পুস্তকাগার তখনকার দিনে খুব কমই ছিল। পুস্তকাগারে সংগৃহীত ধর্ম্ম ও সাহিত্য-সম্বন্ধীয় বহু গ্রন্থ তাঁহার জ্ঞানার্জ্জন-স্পৃহা ও পবিত্র জীবনযাপনের সাক্ষ্যস্বরূপ বিদ্যমান ছিল। আবার এই সাহিত্যচর্চা শুধু যে তাঁহার নিজের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল, এমন নহে; তিনি নিজেও যেমন সাহিত্যানুরাগিণী, সাহিত্যিকগণের সাহিত্যানুরাগেরও তেমনই উৎসাহদাত্রী। বহু দুঃস্থ গুণী লেখক তাঁহার নিকট সাহায্য পাইয়া সাহিত্য-সেবার সুযোগলাভ করিতেন। সাহিত্যের উন্নতিকল্পে জেব্‌ অনেক সুপণ্ডিত মৌলবীকে যোগ্য বেতনে নূতন পুস্তক-প্রণয়ণের জন্য, অথবা তাঁহার নিজের ব্যবহারার্থ দুষ্প্রাপ্য হস্তলিথিত পুঁথির নকলকার্য্যের জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। যে-সকল লেখক তাঁহার যত্ন ও চেষ্টায় যশস্বী হন, তন্মধ্যে মুল্লা সফী-উদ্দীন্‌ অর্দ্দবেলীর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যচর্চ্চার সুবিধার জন্য, সফী-উদ্দীন জেবের অর্থে আরামে কাশ্মীর-বাস করিতেন। তিনি ‘জেব্‌-উৎ-তফাসির’ নাম দিয়া কোরাণের আর্বী মহাভাষ্য ফার্সীতে অনুবাদ করেন। সফী-উদ্দীন গ্রন্থখানি জেব্‌-উন্নিসার নামে প্রচার করিয়াছিলেন। এইরূপ আরও কয়েকখানি গ্রন্থ জেবের নামে প্রচলিত; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজে ঐ সকল গ্রন্থ রচনা করেন নাই। লেখকগণ কৃতজ্ঞতা-প্রকাশের জন্য তাঁহার নাম ঐ সকল গ্রন্থে নিবদ্ধ করিয়াছিলেন।

 প্রকৃতি জেব্‌-উন্নিসাকে সৌন্দর্য্যের ললামভূতা করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলেন। বাহিরের রূপ, আর অন্তরের পাণ্ডিত্য ও কবিত্ব-প্রতিভা তাঁহার অসামান্য গৌরবের কারণ হইয়াছিল। মোগলের নিভৃত ঘনঘোর অন্তঃপুরে পর্দ্দার অন্তরালে বাস করিয়াও জেব্‌, পত্রাচ্ছাদিত, সুরভি-সৌন্দর্য্য-মণ্ডিত গোলাপ পুষ্পের ন্যায় আপনাকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে লুক্কায়িত রাখিতে পারেন নাই—দেশদেশান্তরে তাঁহার যশ পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল।

 কিন্তু বাদ্‌শাহী-অন্তঃপুরের নিভৃত মালঞ্চে, বাদ্‌শাহ্‌জাদীর মানস-লতিকায় যে-সকল কবিতাগুচ্ছের বিকাশ হইয়াছিল, আজ তাহা কোথায়? তাহার অধিকাংশই বিজনবনের ফুলের মত, লোকচক্ষুর অন্তরালে ফুটিয়া উঠিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাঁহার ক্ষীণ গন্ধটুকু আছে, পরিচয়ের ছিন্ন সূত্রটুকু কোথায় হারাইয়া গিয়াছে—খুঁজিয়া বাহির করিবার উপায় নাই। ‘দিউয়ান্‌-ই-মখ্‌ফী’তে তাঁহার রচিত অনেক কবিতা স্থান পাইয়াছিল সত্য; কিন্তু সে কোন ‘মখ্‌ফী’? যে-সমস্ত কবি গুপ্তভাবে কবিতা-রচনা ও প্রচার করেন, ফার্সীতে তাঁহাদের ছদ্মনাম ‘মখ্‌ফী’। ফার্সী ভাষায় মখ্‌ফী এক নহে—বহু। বাদশাহ্‌জাদীর হৃদয়ের অতুলনীয় ভাব-সম্পদ্‌ কোন্‌ মখ্‌ফীর সৃষ্টিপুষ্টি করিয়াছিল, তাহা আজ কে নিশ্চয় করিয়া বলিবে?

 সম্রাট্‌ আওরংজীব কবিতার পক্ষপাতী ছিলেন না। কবিদিগকে তিনি মিথ্যাবাদী চাটুকার, আর তাঁহাদের রচনাকে জলবুদ্বুদের মত ব্যর্থ বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিতেন। কোন কবিই তাঁহার দরবারে রাজ-অনুগ্রহ লাভ করিতে পারেন নাই। কিন্তু করুণারূপিণী জেবের করুণা হইতে যে অনেকেই বঞ্চিত হন নাই, তাহা বলা বাহুল্য। কন্যার করুণার ফল্গুধারা, আওরংজীবের আমলের সাহিত্যকে এইরূপে সঞ্জীবিত রাখিয়া ধন্য হইয়াছিল।

 দুঃখের বিষয়, ইতিহাসের নামে কোন কোন উর্ব্বরমস্তিষ্ক কল্পনাজীবি লেখক, এই বিদ্যাচর্চ্চা-নিরতা, নিষ্ঠাবতী, আজীবন-কুমারী, নির্ম্মলস্বভাবা জেব্‌-উন্নিসাকে, অসম্ভব কাল্পনিক কাহিনীর নায়িকারূপে চিত্রিত করিয়া জনসাধারণের মনোরঞ্জনের প্রয়াস পাইয়াছেন। গল্পের উৎকৃষ্ট পাত্রী বাদ্‌শাহী হারেমের কুমারী-কন্যার মত আর কি হইতে পারে? এরূপ চরিত্র-সম্বন্ধে যে অতি সহজেই সাধারণের শ্রুতিমধুর অবৈধ-প্রেমের অপরূপ কাহিনী সৃষ্ট হইতে পারে! তাহার উপর জেব্‌-উন্নিসা শুধু আজীবন-কুমারী নহেন;—বিদুষী, কবি এবং অসামান্য সৌন্দর্য্য-সম্পদ্‌শালিনী; অতএব কল্পনাজীবিরা শাহ্‌জাদী সম্বন্ধে গল্পরচনার সুযোগ কিরূপে পরিত্যাগ করিবেন? বড়ই দুঃখের বিষয়, তাহাদের অবাধ-কল্পনার ঘৃণিত তুলিকায়, জেব্‌-উন্নিসার অকলঙ্ক নির্ম্মল মূর্ত্তি ঘোর মসীবর্ণে চিত্রিত হইয়াছে।

 জেব্‌-উন্নিসা ভ্রাতা মুহম্মদ্ আক্‌বরকে নিরতিশয় স্নেহচক্ষে দেখিতেন। জ্যেষ্ঠা ভগিনীর প্রতি আক্‌বরেরও অগাধ বিশ্বাস, অপরিসীম শ্রদ্ধাভক্তি ছিল। আক্‌বর একখানি পত্রে জেব্‌কে লিখিয়াছেন,—

“যাহা তোমার, তাহাই আমার; এবং যাহা আমার তাহাতে সর্ব্বসময়ে তোমার অধিকার রহিয়াছে। * * * —দৌলৎ ও সাগরমলের জামাতাদিগকে কার্য্যে নিয়োগ বা কর্ম্মচ্যুত করা, তোমার ইচ্ছাধীন। তোমারই আদেশে আমি তাহাদিগকে কর্ম্মচ্যুত করিয়াছি। সমস্ত বিষয়েই তোমার আদেশ, আমি কোরাণ ও প্রেরিত-পুরুষের ‘হদীসের’ ন্যায় পবিত্র মনে করিয়া অবশ্যকর্ত্তব্যবোধে প্রতিপালন করি।”

ভগিনীর কিরূপ স্নেহ ও আন্তরিকতার জন্য আক্‌বর তাঁহাকে এত শ্রদ্ধা, এত নির্ভর করিতেন, তাহা সহজেই অনুমেয়। এই অকৃত্রিম ভ্রাতৃস্নেহই জেবের কালস্বরূপ হইয়াছিল।

 আক্‌বর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইলেন; কিন্তু রাজসৈন্যের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না; আজ্‌মীরের নিকট তাঁহার যে শিবির-সন্নিবেশ হইয়াছিল, তাহা পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে পলায়ন করিতে হইল। “বিদ্রোহের অব্যবহিতপূর্ব্বে, ভ্রাতা আক্‌বরকে জেব্‌-উন্নিসা যে-সকল গুপ্ত চিঠিপত্র লিখিয়াছিলেন, রাজসৈন্য শিবির অধিকার করিলে (১৬ই জানুয়ারী, ১৬৮১) তৎসমুদয় সম্রাটের করগত হইল। অপরাধী পুত্র তাঁহার হস্তচ্যুত, সুতরাং বিদ্রোহীর সহিত যড়্‌যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে, আওরংজীবের সমস্ত ক্রোধ পতিত হইল—জেব্‌-উন্নিসার উপর। ক্রোধান্ধ বাদশাহ্‌ কন্যার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত[] ও বার্ষিক চারি লক্ষ টাকা বৃত্তি বন্ধ করিয়া তাঁহাকে আমরণকালের জন্য (১৬৮১—১৭০২) দিল্লীর সলীম্‌গড়ে বন্দী করিলেন।”[]

 তাহার পর সুদীর্ঘ দ্বাবিংশতিবর্ষ স্নেহময়ী কুসুমকোমলা জেব্‌-উন্নিসাকে ঐস্থানে বন্দিনীর কঠোর জীবন যাপন করিতে হয়। কারাপ্রাচীরের আবেষ্টনের মধ্যে নিঃসঙ্গ বন্দী-দশায় তখন তাঁহার কবিচিত্তে বেদনাভরা কত ভাবের উদয় হইত, কত বিষাদগীতি মুকুলিত হইয়া ঝরিয়া পড়িত, তাহার ইয়ত্তা কে করিবে? মনে হয়, ঐ সময়েই তিনি খেদ করিয়া গাহিয়াছিলেন—

কঠিন নিগড়ে বদ্ধ, যতদিন চরণ-যুগল,
বন্ধু সবে বৈরী তোর, আর পর আত্মীয়-সকল।
সুনাম রাখিতে তুই করিবি কি, সব হবে মিছে,
অপমান করিবারে বন্ধু যে গো ফেরে পিছে পিছে।
এ বিষাদ-কারা হ’তে মুক্তি-তরে বৃথা চেষ্টা তোর,
ওরে মখ্‌ফী, রাজচক্র নিদারুণ, বিরূপ কঠোর;
জেনে রাখ্‌ বন্দী তুই, শেষ দিন না আসিলে আর,
নাই নাই, আশা নাই, খুলিবে না লৌহ-কারাগার।

 লৌহদ্বার সত্য সত্যই মুক্ত হয় নাই—হইয়াছিল একদিন, যেদিন মৃত্যুর ভবভয়হারী মহাবল আনন্দময় বাহু জেব্‌-উন্নিসাকে শান্তিপ্রদ মুক্তিরাজ্যে লইয়া যাইবার জন্য প্রসারিত হয় (২৬শে মে, ১৭০২)। বাদ্‌শাহের সমগ্র রাজ্য সেদিন শোকভারাক্রান্ত হইয়াছিল,—আর যে বাদ্‌শাহ্‌ এতদিন স্বার্থের অমানুষী মায়া ও রাজনীতির কুটিলচক্রে অপত্য-স্নেহ ভুলিয়াছিলেন, তিনিও শোকাবেগ সংবরণ করিতে পারেন নাই; প্রিয়কন্যার মৃত্যু-সংবাদশ্রবণে বৃদ্ধ আওরংজীবের পাষাণ চক্ষু ফাটিয়াও অশ্রুধারা বহিয়াছিল!

 সম্রাটের দারুণ ক্রোধবশে একটি অমূল্য জীবন অনাদৃতভাবে কারা-প্রাচীরমধ্যে অতিবাহিত হইয়াছিল। এই সুদীর্ঘকাল কর্ম্মক্ষেত্রে বিচরণ করিতে পারিলে জেব্‌-উন্নিসার জীবন-কাহিনী যে আরও কত সুন্দর হইত,—তাঁহার দীপ্ত প্রতিভা যে আরও কত সৌন্দর্য্যের বিকাশ-সাধন করিত, তাহা কে বলিতে পারে? যাঁহার জীবনের বিশিষ্ট সময়ই কঠোর কারাবাসে অতিবাহিত হইয়াছে, তাঁহার ইতিহাস আর কেমন করিয়া ঘটনাবহুল হইবে? কিন্তু যে অত্যল্পকাল তিনি স্বীয় প্রতিভা-বিকাশের অবসর পাইয়াছিলেন, তাহা হৃদয়বান্‌ ব্যক্তিগণ অতুল সম্পদ্‌ বলিয়া সাদরে বরণ করিয়া লইবেন, সন্দেহ নাই।

 বাদ্‌শাহ্‌জাদীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যে কোনরূপ ক্রটি হয় নাই, তাহা বলা বাহুল্য। এই উপলক্ষে সম্রাট্‌, কন্যার পরলোকগতআত্মার শান্তিবিধানের জন্য সৈয়দ আম্‌জাদ্‌ খাঁ, শেখ্‌ আতাউল্লা, এবং হাফিজ্‌ খাঁকে বহু মুদ্রা দান-খয়রাৎ করিতে আদেশ করেন। দিল্লীর কাবুলী-তোরণের বহির্ভাগে, জহান্‌-আরা-প্রদত্ত, ‘তিশ্‌হাজারী’ উদ্যানে জেব্‌কে সমাহিত করা হয়। (M. A., 462). কিন্তু এখন আর সে সমাধি-ভবনের অস্তিত্ব নাই,—রাজপুতানা-মাল্‌ওয়া রেলপথ-নির্ম্মাণকালে তাহা বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে।

‘দিউয়ান-ই-মখ্‌ফী’ কি জেব্‌-উন্নিসার?

 সেকালের রীতি অনুসারে মোগল-অন্তঃপুরচারিণীরা কবিতাদি রচনা করিতেন। কেবল জেব্‌-উন্নিসা কেন,—আক্‌বর-মহিষী সলীমা সুলতান বেগম্ ও সম্রাজ্ঞী নূরজহানও ‘মখ্‌ফী’ (গুপ্তব্যক্তি) ভণিতায় অনেক ফার্সী কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। বর্ত্তমানে যে ‘দিউয়ান-ই-মখ্‌ফী’ জেব্‌-উন্নিসার রচনা বলিয়া সাধারণতঃ আমাদের নিকট পরিচিত, তাহা প্রকৃতপক্ষে জেবের রচনা কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

 স্প্রেঙ্গার সাহেব এবং ডাক্তার রিউ[] উভয়েই বলেন, দিউয়ান্‌-ই-মখ্‌ফী জেব্‌-উন্নিসার লেখনী-প্রসূত। কিন্তু দিউয়ান্‌ পাঠ করিলে, একজন রাজপরিবারভুক্ত মহিলার নিকট হইতে এরূপ লিখনভঙ্গী ও বক্তব্য-বিষয় প্রকাশ করিবার পদ্ধতি যে কখনও আশা করা যায় না—সে কথা আপনা হইতেই মনে আসে। অধিকন্তু দিউয়ানে এমন কতকগুলি কবিতা স্থান পাইয়াছে, যাহা পাঠ করিলে স্প্রেঙ্গার ও রিউ সাহেবের মতের সমীচীনতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ হয়। দিউয়ান্‌-ই-মখ্‌ফীর অনেকস্থলে দেখা যায়, গ্রন্থকারের জন্ম খুরাসানে। তিনি তখন ভারতবর্ষে অবস্থান করিতেছিলেন মাত্র। ভারতবর্ষের উপর তাঁহার যে খুব কমই আকর্ষণ ছিল, তাহা এই কবিতাটিতে ফুটিয়া উঠিয়াছে—

দিল আশুফ্‌তা-ই-মখ্‌ফী বফন্‌-ই-খুদ্‌ আরস্তু ইস্ত্‌।
বহিন্দ উফ্‌তাদা আস্ত, আম্মা খুরাসানস্ত্ ইউনানশ্‌॥
দরী কিশ্‌ ওর্‌ জবুনীহাএ তালা নাকিসশ্‌ দারদ্‌।
ও গর্‌ না দর্‌ হুনর্‌মন্দী নবাশদ্‌ হীচ্‌ নুকসানশ্‌॥

মখ্‌ফীর উন্মত্ত হৃদয় নিজ বিদ্যায় স্বয়ং এরিষ্টটল্‌। (যদিও) সে হিন্দুস্থানে আসিয়া পড়িয়াছে (কিন্তু) খুরাসান্‌ তাহার পক্ষে গ্রীস। এই দেশে তাহার মন্দভাগ্য অনেক হীনতা (ক্ষতি) অনিয়া দিয়াছে। তাহা না হইলে, তাহার বুদ্ধির (ত) কোনই হ্রাস হয় নাই॥

অন্যত্র―

বুআলী-এ-রোজগারম্ আজ্‌ খুরাসান্‌ আমদা।
আজ্‌ পায়্‌ এজাজ্‌ বর্‌ দরগাহ্‌-ই-সুলতান্‌ আমদা॥
হয়রতে দারম্ কে চুঁইয়া রব্‌দরীঁ জুলমাৎ-ই-হিন্দ্‌।
তুতী এ ফিকরম্ পায়্‌-শক্বর্‌ জে রিজওয়ান্‌ আমদা॥

আমি বর্ত্তমান যুগের Avicenna (মহাপণ্ডিত),―খুরাসান হইতে আগত। ভক্তির চরণে সম্রাটের সভায় আসিয়াছি। হে ভগবান! ভাবিয়া আশ্চর্য্য হই, কেন মিছরী খণ্ডের মিষ্টতায় আকৃষ্ট শুকপাখীর মত আমার বুদ্ধি হিন্দুস্থানের এই গাঢ় তিমিরে আসিয়াছে।

সম্রাট শাহ্‌জহানের দরবারে প্রবেশ করিতে না পারায় গ্রন্থকার দুঃখে বলিতেছেন―

বর্ দর্-ই-সুলতান্-ই-আসর্ হএফ্ নাদারম্ কসে।
তা কে রসানদ্ বআর্জ-ই-মকসদ্ আর্কানে-উ।
সানি সাহিব্‌-ই-কিরাণ পাদিশাহে-ইন্‌স্ ও জান্।
আঁকে মুল্‌ক্‌ সর্ নেহদ্ বর্ খৎ ই ফর্মানে-উ॥

কি দুঃখ! এই যুগের সম্রাটের দরবারে আমার কেহ (বন্ধু) নাই। যে (আমার) প্রার্থনা তাঁহার শ্রুতিগোচর করিবে। দ্বিতীয় সাহিব্-ই-কিরাণ (=শাহ্‌জহান্) নরজাতি এবং জিনের সম্রাট্। যাঁহার আজ্ঞাপত্রের উপর জগৎ (ভক্তিভরে) মস্তক অবনত করে।

 ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, আলোচ্য দিউয়ান্-ই-মখ্‌ফীর লেখক ও জেব্‌ উন্নিসা একই ব্যক্তি নহেন। দিউয়ানের লেখক সম্রাট্ শাহ্‌জহানের দরবারে প্রবেশলাভে অসমর্থ হইয়া আক্ষেপ করিতেছেন। তিনি কখনও জেব্‌-উন্নিসা হইতে পারেন না। পিতামহ শাহ্‌জহানের দরবারে তাঁহার দ্রৌহিত্রী জেব্-উন্নিসার অবারিতদ্বার। এ ছাড়া আরও জানা যায় যে, ‘দিউয়ান্’-লেখকের জন্মভূমি—খুরাসান; কিন্তু জেবের জন্মস্থান—দৌলতাবাদ!

 দিউয়ান্-ই-মখ্‌ফীর শেষভাগের কতকগুলি কবিতা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, গ্রন্থকার প্রেরিত পুরুষ মুহম্মদের সমাধি দর্শন করিতে গিয়া, সেখানে ঐ কবিতাগুলি পাঠ করিয়াছিলেন।

 সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন, কবিতা রচনায় বিদুষী জেব্-উন্নিসার যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল; এবং কোন কোন লেখকের মতে তিনি একখানি দিউয়ানেরও রচয়িত্রী। বোধ হয়, এই কারণেই বর্ত্তমান দিউয়ান-ই-মখ্‌ফীকেই অনেকে জেব্‌-উন্নিসার রচনা বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। এই দিউয়ান্-ই-মখফীর কোন কোনখানিতে আবার এমন কতকগুলি কবিতা সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, যাহা জেবের কবিতা বলিয়াই সাধারণতঃ লোকের ধারণা। কলিকাতার এসিয়াটিক্ সোসাইটিতে ডাঃ রসের (Dr. Ross) সংগৃহীত, দিউয়ান্-ই-মখ্‌ফীর একখানি পুঁথি আছে। ইহাতে জেবের রচনা বলিয়া পরিচিত কতকগুলি কবিতা স্থানলাভ করিয়াছে; তাহার একটি এইরূপ:—

বেশেকনদ্ দস্তে কে খম্ দর্ গর্দন্-ই-ইয়ারে নাশুদ্।
কুর্ বা-চশ্‌মে কে লজ্জৎগীর-ই-দীদারে নাশুদ॥
সদ বহার্ আখির্ শুদ্ ও হর্ গুল্ বফর্কে জা গেরেফ্‌ৎ।
ঘুঞ্চা-এ-বাঘ্-ই-দিল্‌-ই-মা জেব্-ই-দস্তারে নাশুদ্॥

সে বাহু (ভগ্ন ছাড়া কিছুই নহে) যাহা প্রেমিকের কণ্ঠ বেষ্টন করে নাই। চক্ষু থাকিতেও অন্ধ যে (প্রেমাস্পদকে) দর্শনের রস আস্বাদন করে নাই। শত শত বসন্ত শেষ হইল, প্রতি ফুল মস্তকে স্থান পাইল। (কিন্তু) আমার হৃদয়-উদ্যানের কোরক কোন শিরস্ত্রাণের ভূষণ হইল না।

কথিত আছে, ইহার উত্তরে একব্যক্তি এই কবিতাটি রচনা করিয়াছিলেন:—

পীর্ শুদ্ জেব্-উন্‌-নিসা উ-রা খরিদারে নাশুদ্

অর্থাৎ—জেব্‌-উন্নিসা বৃদ্ধা হইল, কিন্তু তাহার ক্রেতা জুটিল না।

 এখন জিজ্ঞাস্য, বর্ত্তমান-প্রচলিত দিউয়ান-ই-মখ্‌ফীর গ্রন্থকার তবে কে? আমাদের মনে হয়, ইহার রচয়িতা গীলান্ প্রদেশের রশ্‌টু নগরের মখ্‌ফী,—জেব্‌-উন্নিসা নহেন। ইনি পারস্যের ফার্স প্রদেশের শাসনকর্তা ইমাম্ কুলী খাঁর (মৃত্যু ১০৪৩ হিঃ=১৬৩৩) কর্ম্মচারী—শাহ্‌জহানের আমলে (১৬২৮-১৬৫৭) ভারতে আসিয়াছিলেন। ১২৬৮ হিজ্‌রায় কানপুরে, এবং ১২৮৪ হিজ্‌রায় লক্ষ্মৌ শহরে দিউয়ান-ই-মখ্‌ফী লিথোগ্রাফে মুদ্রিত হয়।

জেব্‌-উন্নিসা কি কলঙ্কিনী?

 চিরকুমারী, মনস্বিনী জেব্-উন্নিসার কলঙ্ক-কাহিনীর মূলে কোন সত্য নিহিত আছে কি না, বিচার করিয়া দেখা দরকার। তাঁহার সহিত আকিল্ খাঁ বা অন্য কাহারও অবৈধ প্রণয়ের কথা, আওরংজীবের আমলে রচিত কোন ইতিহাসে নাই; তাঁহার মৃত্যুর অর্দ্ধশতাব্দী পরে লিখিত কোন ইতিহাসেও নাই। সরকারী ইতিহাসে বা রাজকর্ম্মচারী-লিখিত ইতিহাসে, রাজ-অন্তঃপুরের এরূপ কলঙ্ক-কথার স্থান হইতে পারে না; কেন না, এই শ্রেণীর ইতিহাস হংসের ন্যায় সারগ্রাহী,—দোষভাগ পরিত্যাগ করিয়া গুণভাগ গ্রহণ না করিলে, তাহাদের উপায় নাই; কিন্তু বে-সরকারী ইতিহাসের পক্ষে এ কথা খাটে না। সুতরাং আওরংজীবের আমলের বে-সরকারী ইতিহাসের সাক্ষ্য এস্থলে আমরা পরীক্ষা করিয়া অসঙ্কোচে গ্রহণ করিতে পারি। এই শ্রেণীর ঐতিহাসিকগণের মধ্যে ভীমসেন ও ঈশ্বরদাস নামক দুইজন হিন্দুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দুই হিন্দু-ঐতিহাসিক মুসলমান রাজপরিবারের সম্বন্ধে রাখিয়া-ঢাকিয়া কোন কথা বলেন নাই—স্বাধীনভাবেই ফার্সী ভাষায় লেখনী পরিচালনা করিয়াছেন। কিন্তু জেব্‌-উন্নিসার প্রেম-কাহিনী-বর্ণনায় তাঁহাদের রচিত ইতিহাস নীরব। তারপর খাফী খাঁর কথা। তিনি আওরংজীবের মৃত্যুর ২৮ বৎসর পরে ইতিহাস প্রণয়ন করেন। ইঁহার নির্ভীক-লেখনী জহাঙ্গীর ও নূরজহানের লজ্জাজনক কাহিনীও অসঙ্কোচে উদ্গার করিয়াছে, কিন্তু জেবের চরিত্রে বিন্দুমাত্র কলঙ্ক নিক্ষেপ করে নাই। তেমন কোন দোষের কথা থাকিলে যে খাফী খাঁর লেখনীর মুখে তাহা অপ্রকাশিত থাকিত না, ইহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।

 আবার ইহারও এক পুরুষ পরে, মোগল-অভিজাতবর্গের জীবন-কাহিনী-সম্বলিত অভিধান ‘মাসিস্-উল-উমারার’ উৎপত্তি। এই অভিধানও জেব-উন্নিসার তথাকথিত কলঙ্ক-কাহিনী কীর্ত্তন করিয়া অপক্ষপাত ইতিহাসের মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ করে নাই। বলা বাহুল্য, খাফী খাঁর ন্যায়, এই সুবৃহৎ গ্রন্থের লেখকও স্বাধীনভাবে ইতিহাস-চর্চ্চা করিয়া গিয়াছেন। অবশিষ্ট রহিল, ইউরোপীয় পর্য্যটক বার্ণিয়ে (Bernier) ও মানুষীর (Manucci) ভ্রমণ-কাহিনী। বিদেশী পর্য্যটকদ্বয়,—বিদেশীর চক্ষু লইয়াই এ দেশের পরিচয় লইয়াছেন; সেই দৃষ্টির মুখে এ দেশের ব্যাপার-সকল তাঁহাদের কাছে যেরূপ প্রতিভাত হইয়াছে, তাঁহারা সেইরূপই লিখিয়াছেন,—আওরংজীব বা তাঁহার বংশধরগণের ক্রোধভাজন হইবার ভয় তাঁহাদের ছিল না। তাঁহারা ভয় করিয়াও কোন কথা বলেন নাই; বরং ইঁহাদের মধ্যে মানুষী, ‘নিরঙ্কুশাঃ কবয়’ পর্য্যায়ভুক্ত বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। মানুষীর রচিত মোগল-ইতিহাস Storia de Mogor রাজ্যসংক্রান্ত এত অধিক মিথ্যা কুৎসায় পূর্ণ যে বিজ্ঞ সমালোচকগণ ইহাকে Chronique Scandalcuse অর্থাৎ ‘কলঙ্কের কেচ্ছা’ নামে অভিহিত করিয়া কিছু অন্যায় করেন নাই। জেব্‌-উন্নিসা-চরিত্রে তিল পরিমাণ দোষ পাইলে যে, তিনি তাহাকে তাল পরিমাণ না করিয়া ছাড়িতেন না, ইহা নিশ্চয়। তাঁহার কেচ্ছাতেও কিন্তু জেবৃ-উন্নিসার প্রণয়-কাহিনীর আভাসমাত্র নাই। এক কথায় ঐ প্রণয়-কাহিনী সত্য হইলে, উদ্ধৃত গ্রন্থনিচয়ের একখানিতেও অন্ততঃ তাহার উল্লেখ থাকিত। তাহা যখন নাই, তখন বুঝিতে হইবে উহা উর্ব্বর-মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত।

 জেব্‌-উন্নিসার কলঙ্ক-কাহিনী ঊনবিংশ শতাব্দীর উর্দ্দূ-লেখকগণের কুকীর্ত্তি! আধুনিক উর্দ্দূ-গ্রন্থকারগণের আখ্যায়িকা ব্যতীত ইহার সন্ধান আর কোথাও পাইবার সম্ভাবনা নাই, এবং সম্ভবতঃ লক্ষ্ণৌ শহরেই ইহার সৃষ্টি। লাহোরের মুনশী আহ্‌মদ্‌-উদ্দীন্‌, বি-এ মহাশয়ের ‘দুর্‌র্‌-ই-মক্‌তুম্’ নামে জেব্‌-উন্নিসার একখানি তথাকথিত জীবন-চরিত বর্তমানে প্রচলিত। এই গ্রন্থেই আমরা জেবের কলঙ্ক-কাহিনীর কথা প্রথম দেখিতে পাই। গ্রন্থকার আবার এই পুস্তকের জন্য মুন্‌শী মুহম্মদ-উদ্দীন্‌ খালিকের ‘হাইয়াৎ-ই-জেব্‌-উন্নিসা’ নামক গ্রন্থ হইতে উপাদান সংগ্রহ করেন।

 বিবি ওয়েষ্টব্রূক্‌ তাঁহার পুস্তকের ভূমিকায় (Diwan of Zeb-un-Nisa, pp. 14-17), জেবের প্রণয়-কাহিনীর এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়াছেন। কিন্তু উহা লেখিকার মৌলিক গবেষণার ফল নহে―স্পষ্টতঃ মুন্‌শী আহ্‌মদ্‌-উদ্দীনের উর্দ্দূ-গ্রন্থের চর্ব্বিতচর্ব্বণ! বিবরণটি এইরূপ:—

“১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভে আওরংজীব্‌ অসুস্থ হইয়া পড়েন। চিকিৎসকগণ বায়ু-পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ায় বাদ্‌শাহ, পরিবার, পরিজন ও পারিষদ্‌বর্গসহ লাহোরে গমন করেন। উজীর-পুত্র আকিল খাঁ তখন ঐস্থানের শাসনকর্ত্তা। তাঁহার যেমন রূপ, তেমনই বীরত্ব, আবার তেমনই কবিত্বের খ্যাতি। যোগ্যই যোগ্যের কদর বুঝে; আকিল্ জেব্-উন্নিসার রূপগুণের কথা শুনিয়া পূর্ব্বেই তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন; এইবার সেই সুদূরের বস্তু নিকটবর্ত্তী। আকিল্ স্থির থাকিতে পারিলেন না; নগর-রক্ষার ছলে অশ্বারোহণে রাজপ্রাসাদের চারিদিক পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন—উদ্দেশ্য যদি একবার জেবের সহিত সাক্ষাৎলাভের সুযোগ ঘটে। বলা বাহুল্য, সে সুযোগলাভেরও অধিক বিলম্ব হইল না। একদিন ঊষাকালে গুল্-আনার বর্ণের, অর্থাৎ ডালিম ফুলের রং-এর, বস্ত্রশোভিত বাদ্‌শাহ্-কন্যা প্রাসাদশিরে দণ্ডায়মান হইলেন—চারি চক্ষের মিলন হইল।
“উভয়েই কবি, অতএব প্রণয়ের মুখবন্ধ গদ্যে সুরু হইতে পারে না, পদ্যেই হইল। আকিল্ বলিলেন, ‘প্রাসাদ-শিরে রক্তিম স্বপ্নপ্রতিমা প্রকাশ পাইল।’ জেব্-উন্নিসা জবাব দিলেন, অনুনয়-বিনয়, জোর জবর্‌দস্তি, বা স্বর্ণমুদ্রা, কিছুতেই এ প্রতিমা লভ্য হইবার নহে।’
“লাহোরই জেব্‌-উন্নিসার মনের মত স্থান; এইস্থানে তিনি একটি উদ্যানও নির্ম্মাণ করাইতেছিলেন। একদিন নর্ম্মসখীগণের সহিত জেব্ উদ্যানের একটি মর্ম্মরগৃহের নির্ম্মাণ-কার্য্য দেখিতে আসিলে, আকিল্ মজুরের বেশে মাথায় চুণ-সুরকীর হাঁড়ি লইয়া হাজির! প্রেমিক-কবি উজীর-পুত্রের এই প্রেমভিক্ষার বেশ অতি অপূর্ব্ব সন্দেহ নাই; কিন্তু তিনি নিরুপায়। এই ছদ্মবেশ ধরিয়াই না কি তাঁহাকে প্রহরীর চক্ষে ধূলি দিয়া উদ্যানে প্রবেশ করিতে হ‍ইয়াছিল। বাদ্‌শাহ্‌জাদী তখন ‘চৌসার’ খেলায় মত্ত। আকিল্ নিকটবর্ত্তী হইয়া বলিলেন, ‘তোমার আশায় আমি ধূলিকণার ন্যায় হইয়া সারা পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতেছি।’ জেব্ বলিলেন, ‘তুমি বায়ুর আকার ধারণ করিলেও আমার কেশাগ্র স্পর্শ করিতে পারিবে না।’
“আকিলের সহিত জেবের ঘন ঘন সাক্ষাৎ হইতে লাগিল। সকল কথা গোপনে থাকিবার নহে,—বিশ্বদূত জনরবের মারফৎ দিল্লীতে গিয়া আওরংজীবের কর্ণে উঠিল। বাদশাহ্ কালবিলম্ব না করিয়া লাহোরে পৌঁছিলেন; স্থির হইল, অবিলম্বে কন্যার বিবাহ দিয়া গোলযোগের অবসান করিবেন। কন্যা পিতাকে জানাইলেন যে, তিনি স্বয়ংবরা হইবেন; অতএব যাঁহারা তাঁহার পাণিপ্রার্থী তাঁহারা যেন তাঁহাদের প্রতিকৃতি পাঠাইয়া দেন। বলা বাহুল্য, জেব্ অতঃপর আকিল্‌কেই স্বামিত্বে বরণ করিবার সঙ্কল্প করেন। আওরংজীব তদনুসারে আকিল্‌কে ডাকিয়া পাঠান। কিন্তু জেব্-উন্নিসার এক ব্যর্থ প্রেমিক মধ্য হইতে বিভ্রাট্ ঘটাইল; সে আকিল্‌কে লিখিয়া জানাইল যে, ‘সম্রাট্-কন্যার প্রণয়পাত্র হওয়া ছেলেখেলা নহে। বাদ্‌শাহ্, সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন; দিল্লী পৌঁছিলই, তুমি তোমার দারুণ পরিণাম বুঝিতে পারিবে।’ পত্রপাঠে আকিলের এই ধারণা হইল যে, বাদশাহ নিশ্চয়ই তাঁহাকে কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত করিবার মতলব করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার চিত্তে এতই আশঙ্কার সঞ্চার হইয়াছিল যে, তিনি বিবাহে অসম্মত হুইয়া বাদ্‌শাহের নিকট পদত্যাগ-পত্র পাঠাইয়া দিলেন।

* * *

“কিন্তু হতভাগ্য আকিল্ খাঁ জেব্‌কে বিস্মৃত হইতে পারিলেন না; তাঁহাকে দেখিবার জন্য আবার গোপনে দিল্লীতে আসিয়া উপস্থিত। আবার উদ্যান-বাটিকায় উভয়ের সাক্ষাৎ! সংবাদ পাইয়া বাদ্‌শাহ্, অতর্কিতভাবে কন্যার নিকট উপস্থিত হইলেন। জেব্ পিতাকে আসিতে দেখিয়া প্রেমাস্পদকে অবিলম্বে একটি বৃহৎ ডেক্‌চীর মধ্যে লুকাইয়া রাখিলেন। কিন্তু চতুর-চূড়ামণি বাদশাহের চক্ষে ধূলি দেওয়া অসম্ভব; তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই ডেক্‌চীর মধ্যে কি?’ জেব্ বলিলেন, ‘গরম করিবার জল।’ বাদ্‌শাহ্ হুকুম দিলেন, ‘অগ্নিসংযোগে জল গরম কর।’ তৎক্ষণাৎ বাদশাহের হুকুম তামিল করা হইল। জেব্ এই সময় স্বীয় প্রেমিকের জীবন অপেক্ষা আপনার যশোমানের জন্যই সমধিক ব্যাকুল হইয়াছিলেন। ডেক্‌চীর নিকট আসিয়া চুপি চুপি আকিল্‌কে বলিলেন, ‘যদি সত্যসত্যই তুমি আমাকে ভালবাসিয়া থাক, তাহা হইলে মৌনী হইয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।’ আকিল্ খাঁ এইরূপে অনলে সিদ্ধ হইয়া তাঁহার প্রেমের পরীক্ষা দিলেন। জেব্‌-উন্নিসার একটি কবিতায় আছে,—‘প্রকৃত প্রেমের পরিণাম কি?’ (উত্তর) ‘জগতের তৃপ্তির জন্য আত্মবলিদান।’ ইহার পর জেব্ সলীগড় দুর্গে বন্দী হন।”

বিবরণটি যে কতদূর বিশ্বাসযোগ্য, ইহার রচনাপ্রণালী দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তথাপি ইহার মূলে কোন ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে কি না, বিচার করিয়া দেখা কর্ত্তব্য।

 যাঁহারা মানুষী (i. 218) ও বার্ণিয়ের (p. 13) ভ্রমণ-কাহিনী পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন যে, লেখকদ্বয় জেবের পিতৃষ্বসা জহান্-আরার অবৈধ প্রেমের একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাহাতে প্রকাশ, ডেকচীর মধ্যে লুক্কায়িত জহান্-আরার প্রণয়ীকে সিদ্ধ করিয়া হত্যা করা হয়। এই বিবরণের সহিত উর্দ্দূ-লেখকগণের অত্যাশ্চর্য্য মিল। প্রকৃত কথা, মানুষী ও বার্ণিয়ের-রচিত ‘উদোর পিণ্ডী’ উক্ত লেখকেরা ‘বুদোর’ ঘাড়ে চাপাইয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছেন! লোক-মনোরঞ্জনের জন্য এই সকল লেখক রং-এর উপর রং ফলাইয়া ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই।

 আকিল খাঁ অবশ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তি; কিন্তু তাঁহার সম্বন্ধে ইতিহাস যাহা বলে, তাহা এই গল্পের সম্পূর্ণ বিরোধী। তাঁহার পূর্ব্ব নাম, মীর অস্করী,—জন্মস্থান পারস্যের খাফ্; কিন্তু তিনি দিল্লীর কোন উজীরের পুত্র নহেন। সম্রাট শাহ্‌জহানের রাজত্বকালে আকিল্ কুমার আওরংজীবের অধীনে কর্ম্মগ্রহণ করেন। কুমার যখন দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা (১৬৫২-৫৭), আকিল্ তখন তাঁহার ‘জিলৌদার’, অর্থাৎ অশ্বারোহী পার্শ্বচরের পদাভিষিক্ত। ইহার পূর্ব্বেই আকিলের কবিত্বের খ্যাতি হইয়াছিল; কবিতার ভণিতায় তিনি ‘রাজী’ নাম ব্যবহার করিতেন। দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করিয়া সিংহাসন-অধিকারার্থ যুদ্ধাভিযানকালে আওরংজীব তাঁহার পরিবারবর্গকে দৌলতাবাদের দুর্গে রাখিয়া যান। ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসকাল তাঁহারা ঐস্থানে অবস্থান করেন। আকিল্ খাঁ ৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে আওরঙ্গাবাদের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন, এবং ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট হইতে ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দের প্রায় শেষভাগ পর্যান্ত দৌলতাবাদ-দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারী তিনি দিল্লীতে গমন করেন, এবং তাহার দুই মাস পরেই গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী প্রদেশ—মীয়ান্-দুয়াবের—ফৌজদার নিযুক্ত হন; ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে এই পদ অন্য এক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়। পরবর্ত্তী নবেম্বর মাসে (১৬৬১ খ্রীঃ) শারীরিক অসুস্থতানিবন্ধন, আকিল্ খাঁ কিছুদিনের অবসরের জন্য দরখাস্ত করেন। এই ছুটি মঞ্জুর হইলে, তিনি মাসিক ৭৫০ টাকা বৃত্তি পাইয়া কিছুদিন লাহোরে অবস্থান করেন। আকিল খাঁর এই আবেদন পত্রে (Faiyyas-ul-Qawanin, 578) প্রকাশ তাঁহার বয়স তখন ৫০ বৎসরেরও বেশি।

 কাশ্মীর হইতে প্রত্যাবর্তনকালে আওরংজীব ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দের নবেম্বর মাসে যখন সপরিবারে লাহোর অতিক্রম করিতেছিলেন, সেই সময়ে (২রা নবেম্বর) আকিল খাঁ রাজদর্শনে উপস্থিত হন; সম্রাট্ তাঁহাকে সঙ্গে আনিয়া দেওয়ান-ই-খাসের দারোঘার পদ প্রদান করেন (জানুয়ারী ১৬৬৪)। এই সময় আকিল্ খাঁ যে নিশ্চয়ই সম্রাটের খুব অনুগ্রহভাজন ছিলেন, তাহা স্পষ্টই বুঝা যায়; কারণ ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাঁহার পদোন্নতি হয়, এবং পর বৎসর মে মাসে তিনি সম্রাটের নিকট হইতে উপহার লাভ করেন। ইহার পরে আকিল্ খাঁ ডাকচৌকীর দারোঘার পদলাভ করিয়াছিলেন। ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে উক্ত পদ ত্যাগ করার পর সাত বৎসর, অর্থাৎ ১৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর পর্যন্ত, তিনি কিরূপে কোথায় ছিলেন, তাহা আমাদের নিকট অজ্ঞাত। এই সময়ের পর হইতে আকিল্ খাঁ মাসিক ১০০০ টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হন এবং ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তিনি ‘দ্বিতীয় বখ্‌শী’র পদলাভ করেন। পরিশেষে ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাস হইতে ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু পর্য্যন্ত, আকিল খাঁ দিল্লীর সুবাদারের পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বে তিনি এই পদ ত্যাগ করিতে চাহিলে, বাদ্‌শাহ্ উত্তরে তাঁহাকে যে স্নেহসূচক পত্র লেখেন, তাহা বিদ্যমান আছে। ইহাই আকিল খাঁর জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

 তাহা হইলে আমরা নিঃসন্দেহরূপে জানিতে পারিতেছি যে, সম্রাটের আদেশে যুবা আকিল্ খাঁর পূর্ব্ববর্ণিত মৃত্যু-কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা। আওরংজীবের সিংহাসন অধিকারার্থ যুদ্ধগমনের পূর্ব্বে তাঁহার পরিবারবর্গ যে দুর্গে আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন, (৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে ডিসেম্বর ১৬৫৮) তাহার রক্ষণাবেক্ষণের ভার অন্ততঃ ৩০ অপেক্ষা কমবয়স্ক কোন লোকের উপর অর্পিত হওয়া কখনই সম্ভবপর নহে। আর পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে, ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে আকিল্ ছুটির জন্য যে আবেদন-পত্র প্রেরণ করেন, তাহাতে প্রকাশ, তৎকালে তাঁহার বয়ঃক্রম ৫০ বৎসরের ঊর্দ্ধ; সুতরাং ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুকালে আকিল্ খাঁর বয়ঃক্রম যে ৮৫ বৎসরের অধিক হইয়াছিল, তাহা নিঃসন্দেহ।

 এখন আকিল্ খাঁর জীবন-বিবরণ হইতে দেখা যাউক, কোন্ কোন্ সময়ে তিনি ও জেব্-উন্নিসা একই স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন—

 (১) ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে দৌলতাবাদে মাস-দশেকের জন্য।

 (২) ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে লাহোরে এক সপ্তাহের জন্য।

 (৩) ইহার পর হইতে ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে পদত্যাগ পর্য্যন্ত সময় দিল্লী ও আগ্রার রাজদরবারে।

 (৪) ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে জেব্‌-উন্নিসা দিল্লী হইতে আজ্‌মীরে পৌঁছেন। ইহার অনেক পূর্ব্বেই মারওয়াড় ও মিবারের সহিত যুদ্ধহেতু বাদ্‌শাহ্, আকিল খাঁ-সহ আজ্‌মীরে আগমন করেন; কাজেই ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের মে মাস হইতে ১৬৮১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে বন্দী হওয়া পর্য্যন্ত প্রায় ৮ মাস কাল আকিল্ খাঁ ও জেব্-উন্নিসা একই স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন।

 (৫) ১৬৮১ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী হইতে ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত দিল্লীতে।

 এখন দেখা যাইতেছে যে, যদি বাদ্‌শাহের অনুপস্থিতিতে আকিল্ খাঁ ও জেবের মিলন-সংঘটন ও প্রেমালাপ হইয়া থাকে, তবে তাহা প্রথম ও শেষোক্ত সময়ের অবকাশে ঘটিয়াছিল; কারণ এই সময়ে বাদ্‌শাহ্ অন্যত্র ছিলেন।

 আকিল খাঁর রাজকার্য্য হইতে অল্পদিনের জন্য অবসর গ্রহণ এবং লাহোরে অবস্থান (নবেম্বর ১৬৬১ হইতে অক্টোবর ১৬৬৩) সম্রাটের নিগ্রহের চিহ্ন হইতে পারে না; কারণ অবসরপ্রাপ্তিকালে আকিল্ খাঁ নিয়মিতরূপে বাদ্‌শাহের নিকট হইতে উপযুক্ত বৃত্তিলাভ করিয়াছিলেন; তবে রাজধানী ও সম্রাটের পারিষদবর্গ হইতে সুদীর্ঘ ১০ বৎসরকাল (১৬৬৯—১৬৭৯) দূরে অবস্থান, এবং এই দশ বৎসরের মধ্যে বিশেষতঃ প্রথম যে সাত বৎসর সম্রাটের কোনরূপ অনুগ্রহলাভে বঞ্চিত হ’ন, তাহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ এই সময়ে তিনি বাদ্‌শাহের বিরাগভাজন হইয়াছিলেন।

 তবে কি ইহা জেব্‌-উন্নিসার সহিত অবৈধ প্রেমালাপের শাস্তি? ১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে, অর্থাৎ বিদ্রোহী হইবার অনতিপূর্ব্বে, কুমার আক্‌বর ভগিনী জেব্‌কে এই মর্ম্মে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন—

“সম্রাট্ এক্ষণে আদেশ প্রচার করিয়াছেন যে, আকিলের মোহরযুক্ত কোন পুলিন্দা প্রাসাদস্থ ললনাগণের কক্ষে লইয়া যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ; কাজেই ইহা সুনিশ্চিত যে, এক্ষণে [আমাকে?] কাগজপত্র বিশেষ বিবেচনা করিয়া পাঠাইতে হইবে।”

 এই আকিল্‌ই কি তবে জেব-উন্নিসার প্রণয়াস্পদ কবি— আকিল্ খাঁ রাজী? না,—আমাদের মনে হয়, তাহা নহে। এই সময়ে কুমার আক্‌বরের শিবিরে মুহম্মদ আকিল্ নামে একজন মুল্লা অবস্থান করিতেন। ইনিই পরে আক্‌বরের স্বপক্ষে, আওরংজীবকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য ব্যবস্থা (‘ফতাওয়া’) দিয়াছিলেন এবং তাহার ফলে, আক্‌বরের পরাজয়ের পর বাদ্‌শাহ্ কর্তৃক কারাবদ্ধ হন ও প্রহারলাভ করেন। জেব্-উন্নিসা ধর্ম্মগ্রন্থ কোরাণে বিশেষভাবে ব্যুৎপন্ন ছিলেন; তাঁহারই পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমান-ধর্মগ্রন্থের কয়েকখানি ভাষ্য রচিত হইয়াছিল; কাজেই তাঁহার সহিত মুল্লা মুহম্মদ্ আকিলের ন্যায় একজন বিখ্যাত ধর্ম্মতত্ত্বালোচনাকারীর পত্র-ব্যবহার যে কেহ সন্দেহের চক্ষে দেখিত না, তাহা স্বাভাবিক। কুমার আক্‌বরের পত্রের মর্ম্ম এই যে, তাঁহার নিজের মোহরযুক্ত পুলিন্দা পাঠাইলে পাছে শত্রুহস্তে পতিত হয়, এই কারণে তিনি ভগিনী জেব্-উন্নিসাকে যে-সমস্ত গোপনীয় পত্র লিখিতেন, তাহা আকিলের পত্রের মধ্য দিয়া প্রেরিত হইত; কেন না, তাহা বিনা বাধাবিঘ্নে জেবের নিকট পৌঁছিত। পত্রখানির শেষাংশ হইতে এ কথা আরও পরিস্ফুট হইবে—

“তোমাকে পত্র লিখিতে বিলম্ব হওয়ার একমাত্র কারণ, ভয় হয়, পাছে আমার পত্র অন্য লোকের [অপরিচিত লোক, অর্থাৎ শত্রুর] হস্তে পতিত হয়।”

 যদি কেহ বলিতে চাহেন, কন্যার সহিত কবি আকিল খাঁ রাজীর প্রণয়-ব্যাপারের সন্ধান পাইয়া বাদশাহ্ উভয়ের মধ্যে পত্র-ব্যবহার বন্ধ করিয়া দেন, তাহা হইলে, তাহা একেবারে অযৌক্তিক হইবে; কারণ, ইহার কয়েক মাস পরেই আকিল্ খাঁ বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ দিল্লীর শাসনকর্ত্তার পদলাভ করিয়াছিলেন—এবং পর বৎসরের প্রারম্ভে জেব্ বন্দী হইয়া দিল্লীতেই প্রেরিতা হন।

 জেব্-উন্নিসা পিতার আদেশে ১৬৮১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে বন্দী হন। সরকারী ইতিহাসে অতি স্পষ্টই উল্লিখিত হইয়াছে যে, ভ্রাতা আকবরের বিদ্রোহ-ব্যাপারে লিপ্ত থাকাই তাঁহার বন্দীত্বের একমাত্র কারণ।

 জেব্-উন্নিসার এই কঠোর কারাবাসকালে যদি কেহ তাঁহাকে ও আকিল খাঁকে লইয়া মনে মনে একটি প্রেম-কাব্য রচনা করিতে চাহেন, তাহা হইলে তাহাও কতদূর স্বাভাবিক হইবে, বলা যায় না; কারণ জেব্-উন্নিসা তখন ৪৩ বৎসর বয়স্কা প্রৌঢ়া রমণী, এবং আকিল খাঁ ৭২ বৎসরের বৃদ্ধ।

 ইহার পর আরও একটা ভিত্তিহীন জনরব আছে। এই অমূলক জনপ্রবাদের সৃষ্টি মহারাষ্ট্রবীর ছত্রপতি শিবাজীকে লইয়া। প্রকাশ যে, ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই মে শিবাজী যখন বাদ্‌শাহের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আগ্রায় আসেন, সেই সময়ে জেব্ প্রথম দর্শনেই শিবাজীকে মনঃপ্রাণ অর্পণ করিয়াছিলেন। প্রণয়িযুগল কেমন করিয়া পরস্পর অঙ্গুরী-বিনিময় করিয়া বিদায়গ্রহণ করিয়াছিলেন, ৫০ বৎসর পূর্ব্বে ৺ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ উপন্যাসে তাহা বর্ণনা করেন। কিন্তু তাহা ঐতিহাসিক তত্ত্ব নহে;—গল্প। সমসাময়িক কোন ফার্সী ইতিহাস দূরে থাকুক, মারাঠী ভাষায় লিখিত শিবাজীর কোন জীবনচরিতও এ কথা সমর্থন করে না যে, একজন বাদশাহ্জাদী পিতৃরাজধানীতে বন্দী শিবাজীর দুর্ভাগ্যের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করিয়াছিলেন। অন্য কোন কারণেও না হউক, একমাত্র জেব্-উন্নিসার সুশিক্ষা, সুরুচি ও সৌন্দর্য্যবোধই যে তাহাকে শিবাজীর ন্যায় অশিক্ষিত, অভব্য, দক্ষিণী হিন্দুর সহিত প্রেমবিনিময়ে বিরত করিত,—ইহা স্বাভাবিক; সুতরাং এই কাহিনীটি কেবল অনৈতিহাসিক নহে, পরন্তু অস্বাভাবিক।


  1. এই বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ, ‘দস্তুর-উল্-আমল্‌’ পুঁথি (f. 94 b) অনুসারে ৬৩ মোহর, ৫৬৬৮৬৬ টাকা। কিন্তু ‘জওয়ারিৎ-ই-আলম্‌গীরি’ (f. 70 a) পুঁথির মতে ৭৩ মোহর, ৫৭৩৭৬৩ টাকা।
    ‘আলম্‌গীর-নামা’ গ্রন্থ-পাঠে (পৃ. ৮৩৬) জানা যায়, কাশ্মীরে জেব্‌-উন্নিসার একটি পরগণা ছিল। পরগণাটি জলপ্রপাতযুক্ত—নাম ‘বেগমাবাদ’ ওরফে ‘আচবল্‌’। এখানের জল ও দৃশ্য দুই-ই সুন্দর। পরগণাটিতে বাদশাহী প্রাসাদ ও উদ্যান ছিল।
  2. Masir-i-Alamgiri, p. 204.
  3. Oudh Nawab’s Catalogue—Sprenger, p. 480. Cat. of Pers. MSS. in the British Museum, by Dr. Rieu, ii. 702.