ম্যালেরিয়া/ম্যালেরিয়া

 ম্যালেরিয়া এক প্রকার দুষ্ট বায়ু বিশেষ। ইহার যথার্থ প্রকৃতি কি, তাহা এপর্যন্ত নিরূপিত হয় নাই। কত শত বৎসর হইতে জগতে ইহার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে তাহা নির্ণয় করা কঠিন। হিপক্রেটিসের পূর্ব হইতে পালাজ্বর প্রভৃতি ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত নানাবিধ পীড়ার পরিচয় পাওয়া যায়। হিপক্রেটিসের সময় হইতে বহুসংখ্যক চিকিৎসাশাস্ত্র-বিশারদ পণ্ডিতদিগের পুস্তকাদি পাঠ দ্বারা অবগত হওয়া যায় যে, যে দেশে যত জলাশয় অধিক এবং জল বহির্গমণ-প্রণালীর অভাব সেই দেশ তত অস্বাস্থ্যকর ও সবিরাম জ্বরাদি পরিপূর্ণ। জগদ্বিখ্যাত পুরাতন রোম নগর কএকবার সংক্রামক জ্বরে একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। পেলেটাইন, এভেনটাইন, এবং টারপিয়ান পর্বত হইতে জলরাশী নিপতিত হইয়া ঐ নগরস্থ নিম্নভূমিসমূহ সমাকীর্ণ করতঃ স্থানে স্থানে জলাশয় নির্মাণ করে এবং তথা হইতে দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর বায়ু উত্থিত হইয়া পীড়ার কারণীভূত হয়। মনুষ্যজাতি যখন বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ থাকে তখন নানাবিধ কল্পিত দেব দেবীর আরাধনার দ্বারা পীড়া নিবারণ করিতে চেষ্টা করে। ফেব্রিস দেবীকে মহামারী জ্বরের কারণ জানিয়া রোমকেরা জ্বর নিবারণ করিবার জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করতঃ উপাসনা করিত। অস্মদ্দেশীয় অজ্ঞ ব্যক্তিদিগের অদ্যাপি জ্বরাশ‍ূর নামক এক অসুরের অস্তিত্বে বিশ্বাস আছে। জ্যেষ্ঠ টারকুইন রোমনগরস্থ জলাভূমি সকল সংস্কার করেন। তিনি অগণ্য অন্তর্ভৌম জলপ্রণালী (under ground drainage) ও শাখা প্রণালী সকল ভূমির মধ্যে নির্ম্মণ করাইয়া তদ্বারা জলাশয়ের ও নগরস্থ অস্বাস্থ্যকর স্থানের আবদ্ধ জল সমূহ টাইবার নদীতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন, তাহাতেই নাগরিকদিগের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং ঐ ব্যবস্থা সীজার নামধেয় অব্যাহত রাখাতেই রোমীয় অধিপতিদিগের সময় পর্যন্ত। রোমনগর ক্রমাগত স্বাস্থ্যসুখ সম্ভোগ করিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া আসিতেছিল। পরে গথ জাতিরা রোম নগর আক্রমণ করিয়া উহার শ্রীসৌষ্ঠব নষ্ট করিয়াছে। রাজকীয় প্রাসাদ সমূহ ও অপর সাধারণ বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকা সকল নষ্ট করে। টাইবার নদীর সেতু ভঙ্গ এবং জল ও মল প্রণালী সকল রুদ্ধ করিয়া ফেলে। এই রূপ হওয়ায় টাইবার নদী উচ্ছ্বসিত হইয়া নগর প্লাবিত হইয়া যায়। এবং তজ্জন্য এই সময় হইতে আবার প্রতি বৎসর বর্ষান্তে সংক্রামক জ্বর উপস্থিত হইয়া পূর্ব্ববৎ ঐ নগরস্বাস্থ্য নাশের অনুকূল হইয়া উঠে। ইটালী দেশে রোম নগরের নিকট পন‍্টিল জলা বহুকালাবধি জ্বরের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বৎসর তথা হইতে এত দূষিত বায়ু উৎপন্ন হয় এবং তদ্দ্বারা তথাকার এত লোক জ্বর-পীড়ায় পীড়িত হইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হয় যে, পরিশেষে সেই স্থান একেবারে জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। এই কারণে এমেরিকায় অনেক স্থান প্রায় একবারে জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। চিকিৎসা সম্বন্ধীয় ইতিবৃত্ত পাঠ দ্বারা এই রূপ অনেক দৃষ্টান্ত দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবিক জলাই কি জ্বরের প্রধান কারণ? যিনি বঙ্গদেশের ম্যালেরিয়ার বিষয় কিছু মাত্র অনুসন্ধান করিয়াছেন তিনিই এই প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর প্রদানে সমর্থ। জলা ভূমির সহিত সংক্রামক জ্বরের বিশেষ কোন নিকটবর্ত্তী সম্বন্ধ নাই তাহা দার্শনিকদিগের বিশেষ জানা আছে। আমি এইরূপ বলিনা যে, জলা ভূমির জ্বরোৎপাদনশক্তি কিছু মাত্র নাই। কতিপয় বৎসর অতীত হইল প্রসিদ্ধ ডানকুনি জলা সংস্কার করিবার জন্য মনস্থ করিয়া গবর্ণমেণ্ট করন‍েল্ হেগ্ সাহেবকে এই জলার সমস্ত অনুসন্ধান করিয়া রিপর্ট করিতে আজ্ঞা দেন। বিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা হেগ সাহেব জানিয়াছেন যে, ঐ জলার সহিত সমীপবর্ত্তী পল্লি সকলের জ্বরের কোন নিগ‍ূঢ় সম্পর্ক নাই। যে সমস্ত গ্রাম জলার প্রায় গর্ভে অথবা অত্যন্ত নিকটে তথায় পীড়া অতি সামান্য, কিন্তু তথা হইতে যে সকল গ্রাম যত দূরে অবস্থিত তথায় সবিরাম ও স্বল্পবিরাম জ্বরের প্রকোপ ততই ভীষণ। অতএব জল ভূমিই যে জ্বরের ও পীড়ার একমাত্র কারণ নহে তাহা এক প্রকার সপ্রমাণ হইল। যে সমস্ত পীড়া এককালে বহু স্থান ব্যাপিয়া প্রচার হইয়া মহামারি উপস্থিত করে তাহাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া মনুষ্যের স্বাভাবিক আশক্তি। এই জন্যই সংক্রামক জ্বর বহুকালাবধি আলোচনার বিষয় হইয়া পড়িয়াছে।

 কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আমাদিগের নিকট এপর্যন্ত উহার নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুই প্রকাশিত হয় নাই। এমন কি এই জ্বরের কারণ আবিষ্কার করিতে গিয়া গ্রন্থকর্ত্তারা যাঁহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই বলিয়া গিয়াছেন। আপনার মত সম্পূর্ণ সত্য বলিয়। প্রতিপন্ন ও প্রচার করিবার ইচ্ছা প্রায় সকলেরই হইয়া থাকে। যাঁহারা দর্শনশাস্ত্রবিৎ, সত্য অন্বেষণ করাই যাঁহাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য, তাঁহাদের মন প্রশস্ত ও উদার হইয়াও কখন কখন সংকীর্ণ ভাব ধারণ করে। আমার প্রিয় মতটি মিথ্যা বলিয়া কেহ প্রতিবাদ করিলে আমার মন কিছু বিষণ্ণ হয়, এবং কি প্রকারে আমার মতটি সত্য বলিয়া রক্ষা করিব তাহার চেষ্টা পাই। দোষ বুঝিয়াও দোষ গ্রহণ এবং মুক্ত কণ্ঠে তাহা স্বীকার করিতে ইচ্ছা হয় না। সত্য হউক আর মিথ্যা হউক আমার যাহা সত্য বলিয়া বোধ হইয়াছে তাহাই প্রকৃত সত্য, এবং পৃথিবীর সকলে তাহাই সত্য বলিয়া গ্রহণ করুক—এই রূপ অনেকের স্বভাব। তাহা না হইলে নাস্তিকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অপ্রমাণ করিবার জন্য এবং তাহাদের ন্যায় সকলকে নাস্তিক করিবার নিমিত্ত নানাবিধ পুস্তক রচনা করিয়া প্রচার করে কেন? সকলেই নাস্তিক হউক এরূপ ইচ্ছায় তাহার কি ফলোদয় হইবে। যাহা হউক এরূপ বাদ প্রতিবাদ স্বীয় স্বীয় প্রিয় সত্য মত রক্ষা করিবার জন্য পরস্পর বিতণ্ডা ও কলহ শাস্ত্রের উন্নতির কারণ হইয়াছে। স্বর্ণ—যেমন যত বার দগ্ধ হয় ততই বিশুদ্ধ হয়, সেইরূপ কারণতত্ত্ব বিষয়ে যতই বিতণ্ডা হইতে থাকে ততই অসারাংশ পরিত্যক্ত হইয়া সার ও যথার্থ কারণ প্রকাশিত হয়। ম্যালেরিয়া সম্বন্ধেও এইরূপ হইয়া আসিতেছে। কেহ বলিলেন অপরিস্কৃত দুর্গন্ধ জলই ম্যালেরিয়ার কারণ। কেহ কেহ বলেন জলের কোন দোষ নাই বায়ুই অনিষ্টের মূল। অপর কেহ জল বায়ু উভয়কেই আক্রমণ করিলেন, একটীকে লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে পারিলেন না।

 ম্যালেরিয়ার উৎপত্তি সম্বন্ধে এপর্যন্ত দুইটি মত প্রচলিত ছিল। প্রথমতঃ বৃক্ষ লতাদির পত্র জলে বিগলিত হইয়া জল দূষিত করা; দ্বিতীয় জলাভূমির অবস্থান্তর প্রাপ্তি প্রযুক্ত দূষিত বায়ুর উদ্ভব। যাঁহারা প্রথম মতটী প্রতিপন্ন করেন তাহারা বলেন যে, যেদেশে বন জঙ্গল নাই এবং যেখানে কৃষিকার্য্য উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে তথায় ম্যালেরিয়া জ্বর দেখিতে পাওয়া যায় না। যদি কখন তথায় জ্বর উপস্থিত হয় তাহা শস্য কর্তনের পর—তাহার মূল জলে গলিত হওয়া প্রযুক্ত। কারণ, যত দিন না ঐ সকল মূল, ও শস্য-কর্ত্তনাবশিষ্ট বিগলিত হয় ততদিন পীড়ার উদয় হয় না। বর্ষাতে মূল সমুদয় বিগলিত হয় এই জন্য বর্ষান্তেই জ্বরের প্রকাশ হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। ইটরিয়া (Etruria) (Orbs Vetus) নগরে জ্বর উপস্থিত হইয়া উহা জনশূন্য হইয়া যায়। ল্যানসেসাই ইহার কারণ অনুসন্ধান করিয়া এই বলিয়াছেন যে নগরের সমীপে পাট পচাইতে দেওয়াতে এইরূপ ঘটিয়াছিল। কোন কোন নীলকর বলিয়াছেন যে নীল বাহির করিয়া লওয়ার পর শীটাগুলিকে কুটীরের বাহিরে সারের জন্য নিক্ষিপ্ত করিয়া রাখিলে উহা পচিয়া বর্ষার পর তথায় জ্বর প্রকাশিত হইবার হেতুভূত হয়।

 এই মতটী এখন পর্যন্ত এত প্রচলিত যে, বঙ্গদেশীয় জ্বর নিবারণের জন্য অদ্যাপি বন জঙ্গল কাটিবার রাজার আদেশ আছে। যদিও বৃক্ষ লতা প্রভৃতি উদ্ভিদ্ বিগলিত হওয়াই জ্বরের কারণ না হয়, তথাপি তদ্দ্বারা যে স্বাস্থ্যের পক্ষে অনিষ্ট হয় তাহার আর সন্দেহ নাই। বঙ্গদেশীয় গবর্ণমেণ্ট আমাদের মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া এই অনিষ্ট উৎপাদন করিতেছেন যে, মাজিষ্ট্রেটদের আদেশে বন, জঙ্গল, লতা, পাতা, প্রভৃতি কর্ত্তন হইতেছে, কিন্তু কর্ত্তিত উদ্ভিদ সকল তত্তৎ স্থানেই নিপাতিত থাকিয়া তাহার পত্র সকল সেই সেই স্থানেই পচিতেছে, সুতরাং তাহাই আবার অস্বাস্থ্যের কারণ হইতেছে। বন ও লতা সকল যদি উৎপাটিত করত অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করাইত তাহা হইলে বর্ষাকালে কর্তিত মূল হইতে পুনর্ব্বার বৃক্ষ লতা উৎপন্ন হইত না ও পাতা পচিতে পাইত না। যে দেশে তাপ ও ভূমির আর্দ্রতা অধিক তথায় উদ্ভিদের উৎপত্তি ও বিনাশও অধিক। প্রথম মতাবলম্বীদিগের এই ধ্রুব বিশ্বাস যে, বঙ্গদেশের ম্যালেরিয়ার কারণ বিষয়ে তাঁহারা যাহা নির্দ্দেশ করেন তাহা ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না, কিন্তু যদিও ম্যালেরিয়াক্রান্ত বঙ্গদেশে বৃক্ষলতাদি পচিতে দেখা যায়, এজন্য উহাই যে জ্বরের কারণ এমত নহে। নিম্নে কয়টী দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হইতেছে যদ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে, উদ্ভিদ্ বিনাশের সহিত ম্যালেরিয়ার জ্বরের বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই। সুলতানগাছা ও তপনপুর, মেড়িয়া, খেঁই শোনাটিক‍্রি, মনিপুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রামের ভূমি বালুকাময়, কেবল সামান্য অংশ কর্দ্দমবিশিষ্ট, এপ্রযুক্ত উদ্ভিদের উৎপত্তি ও বিনাশ অতি সামান্য। তপনপুর, প্রশস্ত ধান্য ভূমির মধ্যবর্ত্তী এবং ইহার ভূমি প্রায় সম্পূর্ণ বালুকাময়। ১৮৭১ খৃঃ অব্দ পর্যন্ত শেষোক্ত স্থানে ধান্য ভিন্ন অন্য কোন প্রকার বৃক্ষ লতা দেখিতে পাওয়া যাইত না, তথাপি ঐ বৎসর উল্লিখিত সমস্ত গ্রামের কোন গৃহই জ্বর শূন্য ছিল না। মনিপুর হইতে দুই ক্রোশ অন্তরে রাজহাট, পাঁচরকী, অমরপুর, সুগন্ধা প্রভৃতি কয় খানি গ্রামে ঐ বৎসর জ্বরের প্রাদুর্ভাব প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় নাই। শেষোক্ত গ্রামগুলি বন উপবন বৃক্ষ লতা গুল্ম দ্বারা পরিপূর্ণ এবং উহাদের ভূমি সম্পূর্ণ কর্দ্দমময় সুতরাং উদ্ভিদের বিনাশও অধিক। পূর্ব্ব কয় বৎসর এই গ্রামগুলিতে জ্বরের প্রাবল্য অধিক হইয়াছিল, কিন্তু ১৮৭১ খৃ অব্দে জ্বর অতি সামান্য রূপেই দেখা গিয়াছিল।

 এই শতাব্দীর প্রথমে ইংরাজেরা যুদ্ধ উপলক্ষে ওয়াল কেবাণ যাত্রা করে। তথাকার ভূমি বালুকাময়, কেবল মাত্র তৃতীয়াংশের একাংশ কর্দ্মমবিশিষ্ট। বর্ষাকালের প্রথমেই সৈন্য মধ্যে জ্বরের প্রাদুর্ভাব হইয়া এত সৈন্য নষ্ট হয়, সার গিল‍্বার্ট লিখিয়াছেন যে, কোন যুদ্ধে কোন কালে একবারে এত সৈন্য বিনষ্ট হয় নাই।

 টেলেভারার যুদ্ধ শেষ হইলে সৈন্যেরা গোয়াডিনা (Guadina) নদীর কূল দিয়া ষ্ট্রিমণ্ডার (Estremond) ময়দানে হাঁটিয়া যায়। বৃষ্টি অভাবে ঐ স্থান সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়, এবং গোয়াডিনা ও অন্যান্য নদী শুকাইয়া গিয়া স্থানে স্থানে পুষ্করিণীবৎ হয়। এই স্থানে জ্বরে এত সৈন্য বিনষ্ট হয় যে, শত্রু পক্ষেরা ও সমস্ত ইউরোপবাসিরা বিশ্বাস করিয়াছিল যে সমস্তু ইংরাজ সৈন্যদল নিঃশেষিত হইয়াছে। ১৮০৯ খৃঃঅব্দে ইংরাজদের কতিপয় পলটন স্পেনের এক পাহাড় স্থিত বিলের নিকট তাঁবু ফেলিয়া অবস্থিতি করে। ঐ বিল কিছু পূর্ব্বে জলপ্রণালী ছিল। এই সময় উহা শুকাইয়া মধ্যে মধ্যে পুষ্করিণীর ন্যায় হয়। ইহাদের জল এমন নির্ম্মল ও স্বচ্ছ যে সৈন্যেরা তাহা ব্যবহার করিবার জন্য সমস্ত রাত্র তথায় প্রহরীর কার্যে ব্যাপৃত থাকে। পর দিন প্রাতঃকালে সৈন্যগণ প্রহরীর কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিতে না করিতে ভয়ানক জ্বরাক্রান্ত হয়। ডাং ফারগুসন বলিয়াছেন যে এই ঘটনার পূর্ব্বে আমরা সকলেই বিশ্বাস করিতাম যে উদ্ভিদ্ বিনাশই ম্যালেরিয়ার উৎপত্তির প্রধান কারণ। কিন্তু এ সমস্ত স্থলে উদ্ভিজ্জের উৎপত্তির নামমাত্র নাই অথচ জ্বরের ন্যুনতাও নাই। লিস‍্বণ (Lisbon) নগরে টেগস নদী প্রায় এক ক্রোস প্রশস্ত। নদী একটী পীড়াময় ও পীড়াশূন্য স্থানের মধ্যবর্ত্তী। নদীর এক দিগের স্থান পার্ব্বতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জল প্রণালী বিশিষ্ট এবং জলের নিম্নস্থিত ভূমি প্রস্তরময়। এই কূলস্থিত স্থান স্বাস্থ্যকর। অপর কূলস্থিত স্থান সমস্ত যদিও সম্পূর্ণ শুষ্ক এবং সম উচ্চ ও বালুকাময় তথাচ অত্যন্ত সাংঘাতিক। তাপ ও গ্রীষ্মকালীন তিন মাস জল শুকাইয়া যাইবার আশঙ্কায় লিস‍্বণে ও তন্নিকটস্থ উদ্যান সমস্তে প্রস্তরের চৌবাচ্চায় জল রক্ষা করা হয়। এই আবদ্ধ জল কিছু দিনের মধ্যে সাতিশয় অপরিষ্কৃত ও দুর্গন্ধ বিশিষ্ট হয়। অধিবাসিরা দিবা রাত্র ঐ জল ব্যবহার করে কিন্তু এই জল হইতে জ্বর উৎপন্ন হইতে কেহ কখন শুনে নাই। এই কুল অতিক্রম পূর্ব্বক নদীর অপর পার কেহ যাইলে বিনা জ্বরে কাহাকেও প্রত্যাগত হইতে দেখা যায় না। যদিও এপার বালুকাময় ও সম্পূর্ণ শুষ্ক এই সকল ঘটনার দ্বারা প্রমাণ হইতেছে যে বৃক্ষ লতাদি পচিয়া ম্যালেরিয়া উৎপন্ন হয় এমত নয়। যেখানে উদ্ভিদ বিগলিত হইতেছে তথায় হয়ত জ্বর নাই। আবার যেথানে বৃক্ষ লতাদির কোন সম্পর্কই নাই সেখানে হয়ত জ্বরের প্রাদুর্ভাবের পরিসীমা নাই। বঙ্গদেশের প্রায়ই সর্বত্রই অধুনা জ্বর। দৃষ্টিগোচর হয়, বঙ্গদেশের মধ্যে যে যে স্থল পূর্বে স্বাস্থ্যকর ও স্বাস্থ্যের আদর্শস্বরূপ ছিল, সে সে স্থানও সম্পূর্ণ পীড়াদায়ক হইয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, কি কারণ বশতঃ এই অনিষ্টকর পরিবর্ত্তন হইল তাহা আমাদের মধ্যে অল্প লোকই অনুসন্ধান করেন। পরাধীনতা প্রযুক্ত আমাদের স্বাধীন চিন্তারও বিলোপ হইয়াছে। ইংরাজরা আমাদের নাসিকা, কর্ণ, চক্ষু, জ্ঞান ও চিন্তার স্বরূপ হইয়াছেন। তাঁহারা যদি বলেন যে বন জঙ্গল না কার্টিলে আমাদের দেশীয় জ্বর তিরোহিত হইবে না, আমরা অমনি তাহাই বিশ্বাস করিলাম; আমরা একবারও ভাবিলাম না, বন জঙ্গল কেন জ্বরের কারণ হইল। বঙ্গদেশের পূর্ব্বকার অবস্থা যদি আমরা পর্য্যালোচনা করিয়া দেখি তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্রতীত হইবে যে ভারতবর্ষ ইংরাজদিগের শাসনাধীন হইবার পূর্ব্বে ইহার অনেক স্থান অপেক্ষাকৃত বনপূরিত ছিল। মুসলমানদিগের সময় অধিকাংশ বঙ্গবাসীরাই কৃষিজীবী ছিলেন এবং এখনকার ন্যায় পথ সমস্ত বিস্তীর্ণ পরিস্কৃত ও পল্লিসমূহ বন শূন্য ছিল না। শীতপ্রধান প্রদেশে জ্বর কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়। যে সমস্ত দেশ নিরক্ষ রেখার যত সন্নিকট ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব তথায় সেই পরিমাণে পরিদৃশ্যমাণ। প্রথমতঃ নানাবিধ পালাজ্বর, তাহার পর উক্ত বৃত্তের যত নিকটস্থ হইব ততই সল্পবিরাম জ্বর, পরিশেষে অবিরাম জ্বর দৃষ্টিগোচর হইবে। যেদেশে বায়ুর গড় স্বাভাবিক উত্তাপ চল্লিশ ডিগ্‌রির অপেক্ষা ন্যূন তথায় ম্যালেরিয়ার জ্বর নাই। কোন একটীমাত্র ভৌতিক নিয়মের বৈলক্ষণ্য ম্যালেরিয়া উৎপত্তির কারণ নহে। কতকগুলি ঘটনা একত্র সমবেত হইলে উহার উৎপত্তি হয়। ভূমির জলাকর্ষণী-শক্তি, সেই ভূমি জল দ্বারা অভিষিক্ত হওয়া, ৪০ ডিগ্‌রির উপর তাপ, এবং সূর্যকিরণ দ্বারা ভূমির উপরিস্থ ও অভ্যন্তরস্থ জল শুষ্ক হইয়া বাম্পাকারে উর্দ্ধে আকৃষ্ট হওয়া, এই সমস্ত একত্রিত হইয়া পরস্পর কার্য্য করিলে উহার উদ্ভব হয়। কেবল মাত্র সূর্য্যকিরণ অথবা কেবল মাত্র জল পৃথক্ পৃথক্‌ রূপে কার্য্য করিলে কিছুমাত্র অনিষ্ট সাধন করিতে পারে না। আমাদের দেশে চৈত্র বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাসে সূর্য্যের কিরণ ও উত্তাপ যেমন প্রখর হয়, বৎসরের মধ্যে এমন আর অন্য কোন সময় হয় না। কিন্তু এই কয় মাসই বৎসরের মধ্যে স্বাস্থ্যকর। আবার বর্ষাকালে ভূমি নিয়ত জলসিক্ত থাকে তথাপি বর্ষা শেষ হইয়া কিছুদিন গত না হইলে জ্বরোদয় হয় না। বর্ষান্তে ভূমির উপরিস্থিত জল সমস্ত নিম্ন ভূমির দ্বারা আকৃষ্ট ও শোষিত হইয়া গেলে যখন সূর্যের প্রখর উত্তাপ দ্বারা ভূমির গর্ভস্থ বিকৃত জল বাম্পাকারে উর্দ্ধে আকৃষ্ট হইতে থাকে তখনই পীড়া উপস্থিত হয়। ভূম্যাকৃষ্ট জল ভূমিগর্ত্তে থাকিয়া কিরূপ রূপান্তর হয় তাহা আমরা জানি না। কিন্তু তাহা যে স্বাভাবিক না থাকিয়া বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হয় তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

 এই বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হইলে ভূমির ভৌতিক গঠনের বিকৃতি ও রূপান্তর আবশ্যক, কারণ তাহা না হইলে সকল স্থানেরই ম্যালেরিয়া উৎপাদিক শক্তি থাকিত। ভূতত্ত্ববিৎপণ্ডিতেরা (Geologists) রসায়ন বিদ্যা জ্ঞাত হইয়া ম্যালেরিয়া গ্রস্ত ভুমির গর্ব্ভ বিশেষ সূক্ষ্মরূপ অনুসন্ধান করিলে বোধ হয় এ বিষয়ের তত্ত্বাবিষ্কার করিতে পারেন।

 বর্ষান্তে জ্বর উপস্থিত হইয়া কেবল যে মনুষ্যজাতিরই অনিষ্ট সাধন করে এমন নহে। পশু পক্ষীরাও এই সময়ে শঙ্কিত হয়। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ভ্রমণ সম্বন্ধে পাদ‍রি হিবার সাহেব যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠ করিলে চমৎকৃত হইতে হয়। তিনি শুনিয়াছিলেন যে যে সময়ে ভারতবর্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলস্থিত টেরাইতে জ্বর উপস্থিত হয়, তথাকার বানরেরা তৎস্থানের বন পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করে। এই বিষয় নিশ্চয় জানিবার জন্য বোল‍্ডারসন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন। বোল‍্ডারসন সাহেব বলেন কেবল বানরেরা কেন জ্যৈষ্ঠ হইতে অগ্রহায়ণ পর্য্যন্ত জীবমাত্রেই স্বভাব বশতঃ ঐ বন সকল পরিত্যাগ করে। ব্যাঘ্রেরা তথা হইতে পর্ব্বতোপরি উত্থিত হয়। কৃষ্ণসার ও শূকরেরা অবাদিত ভূমিতে প্রস্থান করিয়া ফসল বিনষ্ট করে। ডাকবেহারা ও সৈনিক পুরুষেরা কার্য্যোপরোধে কখন ঐ স্থান দিয়া গমনাগমন করিতে বাধ্য হইয়া দেখিয়াছে ঐ অরণ্য মধ্যে এই সময় একটী পশু পক্ষীর ও. কলরব শুনিতে পাওয়া যায় না। যখন শস্য বর্দ্ধিত ও জল প্রচুর পরিমাণে পতিত হইতে থাকে এবং গগনমণ্ডল মেঘাচ্ছন্ন হইয়া সূর্য্যের জলাকর্ষণী-শক্তিকে নিবারণ করিয়া রাখে তখন ঐ অরণ্য পীড়াদায়ক থাকে না। বর্ষা শেষ হইলে কিছুদিন পরে আবার কিছুমাত্র অনিষ্টকর থাকে না। পশু পক্ষীগণ এই সময়ে ঐ অরণ্য মধ্যে প্রত্যাগমন করে। কাঠুরিয়া ও রাখালগণ পুনর্ব্বার বন প্রবেশ করিতে সাহস করে, এবং চৈত্র বৈশাখ মাস পর্যন্ত সৈন্যগণ ঐ স্থান দিয়া নিঃশঙ্কায় যাতায়াত করে।

 কিছু দিন পূর্ব্বে যখন দামোদর নদের বাঁদ বন্ধন হয় নাই, উহার জল উচ্ছ্বসিত হইয়া হুগলীও বর্ধমান জেলার কতকগুলি গ্রাম প্লাবিত করিত। এমন কি, কোন কোন পল্লীতে এত জল হইত যে নৌকা ভিন্ন গ্রামের এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইবার সম্ভাবনা থাকিত না। প্রায় ৬।৭ দিবস এই রূপ থাকিত। এই সময়ের মধ্যে যে উদ্ভিদের পত্রাদি বিগলিত হইত তাহাতে আর সন্দেহ নাই। সূর্য্যোত্তাপ দ্বারা ভূম্যপরি ও ভূম্যভ্যন্তরস্থ জলরাশী উর্দ্ধে আকৃষ্ট হইত। কিন্তু তখন আমরা আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া দেখিতে পাই নাই। যদি উদ্ভিদ বিগলিত এবং বর্ষান্তে ভূগর্ভস্থিত জল বাষ্পাকারে সূর্য্যকিরণে উত্থিত হওয়াই ম্যালেরিয়ার কারণ হইত, তাহা হইলে এখন অপেক্ষা তখন পীড়া আর ও অধিক প্রবল হইত। যখন তাহা হয় নাই তখন কি প্রকারে উদ্ভিদ বিনাশ প্রভৃতিকে জ্বরের কারণ বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারি? এই সমস্ত দ্বারা যদি জ্বর উৎপন্ন না হইল তবে জ্বরের কারণ কি? কেহ কেহ স্থির করিলেন যখন বর্ষান্তে জ্বরোদয় হয় তবে জল সম্বন্ধীয় কোন কারণ অবশ্যই থাকিবে। অতএব ভূনিম্ন আর্দ্রতা (subsoil moisture or humidity) ইহার কারণ হইল। যৎকালে হুগলী ও বর্ধমান জেলায় ম্যালেরিয়া জন্মে নাই তখন ভূনিম্ন আর্দ্রতা উহার কারণ হইতে কে বারণ করিয়াছিল? তখন ও বর্ষাকাল ছিল, সূর্যকিরণ ও ভূনিম্ন আর্দ্রতা ছিল। এক্ষণকার বর্ষা, সূর্য্য, ভূনিম্ন আর্দ্রতা কিছু নূতন প্রকার নয়। কিন্তু নদী হইতে জল উচ্ছসিত হইয়া গ্রাম সকলকে প্লাবিত এবং বর্ষাদ্বারা উহাদিগকে আবৃত করা ভিন্ন অন্য প্রকার ভূনিম্ন আর্দ্রতা উৎপাদিত হইতে পারে। যদি কোন জল প্রণালী রূদ্ধ হয় বা করা যায় উহার জল স্রোত প্রবাহিত হইতে না পাইয়া নিকটব র্ত্ত স্থান সকলকে আদ্র অর্থাৎ স্যাঁতসেতিয়া করিতে পারে এবং এমন দেখা হইয়াছে যে ইহা দ্বারা তত্তৎ স্থানে জ্বর উৎপন্ন হইয়াছে। আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি যে গথ জাতিরা রোম নগর আক্রমণ করিয়া উহার রাজকীয় প্রাসাদ ও অপর সকল অট্টালিকা নষ্ট করে। টাইবর নদীর সেতু ভঙ্গ এবং জলও মল প্রণালী সকল রুদ্ধ করিয়া ফেলে। এজন্য ঐ মহানগরীতে বর্ষান্তে সংক্রামক জ্বর উপস্থিত হয়। জল প্রণালী অবরূদ্ধ হওয়া যে ম্যালেরিয়ার একটী কারণ তাহা স্বীকার করিতে হইবে।

 বোধ হয় ভূমির সাময়িক রাসায়নিক ও সূক্ষ্ম গঠনাকৃতির (chemical and structural composition of the earth) সহিত ম্যালেরিয়ার বিশেষ কোন সম্বন্ধ আছে। ভূমির গঠনের কিরূপ অবস্থা হইলে ম্যালেরিয়া উৎপন্ন হয় তাহা আমরা জানি না। এরূপ দৃষ্টান্ত দেখান যাইতে পারা যায়, যে ভূমির গঠন প্রভেদে (dissimilarity in the Geological constitution of the earth) নানাবিধ ভিন্ন ভিন্ন পীড়া উপস্থিত হয়। আল্প‌্স এবং পিরানিজপর্ব্বত বাসীদিগের অনেকেরই গলগণ্ড এবং কৃটিনিজ‍্ম (Cretinism) দেখিতে পাওয়া যায়। এই পর্ব্বতদ্বয় যে পরমাণুতে নির্ম্মিত হিমালয়ের ও কিয়দংশ তাহাতেই নির্ম্মিত। এই জন্য হিমালয়ের ঐ রূপ স্থানে গলগণ্ড ও কৃর্টিনিজম দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রেনাইট পর্ব্বতে জ্বর দেখিতে পাওয়া যায় না। যেখানে গ্রেনাইট পর্বত আছে সে, সমস্ত স্থানে জ্বর নাই। এই জন্য বলিতেছি যদি কেহ ম্যালেরিয়ার কারণ আবিষ্কার করিতে চাহেন তবে তিনি ম্যালেরিয়াগ্রস্ত স্থানের ভূমির সূক্ষ্ম গঠন অনুসন্ধান করুন।

 জ্বরোৎপত্তির আরও কতকগুলি সামান্য কারণ আছে, কিন্তু তাহারা আনুসঙ্গিক, সাহায্যকারি, ও উদ্দীপক কারণ মাত্র। যথা (১) অপরিস্কৃত পুষ্করিণী ও জলাভূমি। যখন আমরা স্বাধীন অথবা মুসলমানদের অধীন ছিলাম পৌরাণিক ধর্ম্মে আমাদের বিশ্বাস ছিল। পৌরাণিক ধর্ম্মাদেশে তখন নূতন নূতন পুষ্করিণী খাদিত হইয়া সাধারণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইত। যাহার কিছু সঙ্গতি হইত নূতন পুষ্করিণী খাদিত করিয়া প্রতিষ্ঠা করত তিনি ধর্ম্ম লাভ করিতেন। এই জন্য নির্ম্মল জল সকলে ব্যবহার করিতে পাইত। আবার তখন দামোদর বন্ধন না হওয়াতে হুগলী বর্দ্ধমানের অনেকাংশ প্লাবিত হইয়া পুষ্করিণীর পুরাতন জল প্রতি বৎসর নূতন হইয়া যাইত। এক্ষণে আর তাহা হয় না। (২)আলস্য-যিনি যত অলস তিনি তত পীড়ার অধীন। আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষেরা পরিশ্রমী ছিলেন। রৌদ্রে চলিলে তাঁহাদিগের মস্তকের পীড়া উপস্থিত হইত না। সঙ্গতি পন্ন ব্যক্তিরাও বিনা পাদুকায় দুই তিন ক্রোশ চলিলে অবসন্ন হইতেন না। মান মর্যাদা রক্ষার জন্য এক্ষণকার ন্যায় তাঁহাদিগকে বিপদগ্রস্ত হইতে হইত না। বিদেশীয় সভ্যতার দোষাংশ তাঁহারা অনুকরণ করিতেন না। সুরা পান না করিলে সভ্য হওয়া যায় না এবং দুর্বল হইতে হয়, এরূপ বোধ তাঁহাদের ছিল না। সুতরাং সবল থাকা প্রযুক্ত এক্ষণকার ন্যায় সামান্য কারণে জ্বর হইত না। এক্ষণে যিনি বিদেশীয় বিদ্যালাভ করিয়া কিছু অর্থ সঙ্গতি করিতে পারিয়াছেন তিনি প্রায় পদশূন্য হইয়াছেন। গাড়ি কিম্বা পাল্কি ভিন্ন তিনি একক্রোশ পথ ও চলিতে অশক্ত। তাকিয়া ভিন্ন তিনি বসিতে পারেন না। অসভ্য ইতর ব্যক্তিদিগেরই দৈহিক বলের প্রয়োজন এবং ব্যায়ামাভ্যাস তাহাদেরই আবশ্যক, এই তাঁহার বিশ্বাস। সুতরাং এইরূপ ব্যক্তি যদি একবার জ্বরগ্রস্ত হইলেন, ছয়, সাত দিন তাঁহাকে ঐ জ্বর ভোগ করিতে হইলে তিনি একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়েন, এবং তৎকালে জ্বর হইতে চিকিৎসার দ্বারা মুক্ত হইয়াও দুর্ব্বলতা বশতঃ মধ্যে মধ্যে জ্বরের আক্রমণ এড়াইতে পারেন না। আমি অনেক দৃষ্টান্ত দর্শাইতে পারি যে দুর্ব্বল অলস ব্যক্তিদিগের দেহ জ্বরের যেমন প্রিয়বাসস্থান সবলের তেমন নয়।

 বর্ষান্তে আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া জ্বর উপস্থিত হইলে মধ্যম শ্রেণীর ব্যক্তিরাই অধিকাংশ রোগগ্রস্ত ও মৃত্যু গ্রাসে নিপাতিত হয়। ধনী ব্যক্তিরা উপযুক্ত চিকিৎসা ও পথ্য দ্বারা পীড়া হইতে নিষ্কৃৃতি পায়, কৃষিজীবি ও পরিশ্রমী ইতর ব্যক্তিরা পরিশ্রম দ্বারা জ্বরের প্রভাবকে উপেক্ষা করে। কিন্তু মধ্যম শ্রেণীর ব্যক্তিরা অর্থাৎ নিষ্কর্ম্মা দুঃখী ভদ্র লোকেরা পীড়ার উপযুক্ত চিকিৎসা করাইতে অক্ষম এবং ভদ্র বংশজাত বলিয়া কৃষি প্রভৃতি দৈহিক পরিশ্রমের কার্য্যে অপারক। এ জন্য এই শ্রেণীর ব্যক্তিরাই কর্ম্মশূন্য হইয়া বসিয়া থাকিলে জ্বর দ্বারা আক্রান্ত হন। বর্ষাকালে ও বর্ষান্তে কৃষকেরা ধান্যক্ষেত্রের পঙ্ক ও জল মধ্যে নিমগ্ন হইয়া। কৃষিকার্য্য করিতে থাকে। প্রখর সূর্যকিরণ তাহাদেয় মস্তক ও শরীরকে দগ্ধ করিতে থাকে অথচ তাহাদের সর্ব্বদা জ্বর হয় না। আট বৎসর ধরিয়া আমি দেখিতেছি এই প্রদেশস্থ চাসা যেমন স্বাস্থ্য সম্ভোগ করিতেছে এমন আর কোন শ্রেণীরই ব্যক্তিরা নয়। আলস্থ্য যেমন জ্বরের কারণ অপরিমিত পরিশ্রম যাহাতে শরীর অবসন্ন হয় তাহাও আবার জ্বর আনয়ন করিতে পারে।

 (৩) রাত্রি জাগরণ, অতিরিক্ত স্ত্রীসঙ্গ, অসার ও অনিয়ম ভোজন প্রভৃতি বল-হানিকর কার্য্য সকল জ্বরের উদ্দীপক কারণ।

 উল্লিখিত হইয়াছে যে, ম্যালেরিয়া যথার্থ যে কি তাহা এপর্য্যন্ত নির্দ্ধারিত হয় নাই। ম্যালেরিয়া আমাদের ইন্দ্রিয়ের অগোচর, কেবল ইহার কার্য্য দ্বারা ইহা আমাদিগের নিকট পরিচিত। ইহার কার্য্যের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনাও আমরা এপর্য্যন্ত সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত নহি। অনেক সময়ে কল্পনা ও বিবেচনা দ্বারা ইহার কার্য্যের বিষয় সিদ্ধান্ত করি, যে স্থানে ইহার পরমাণু ষত অধিক সেখানে জ্বর তত শীঘ্র উৎপন্ন ও অনিষ্টকর হয়। ব্যক্তি বিশেষে ইহার ক্ষমতার হ্রাস বৃদ্ধি দেখিতে পাওয়া যায়। ডাং ফারগুসন সাহেব বলেন, নিগ্রোরা কোন বিশেষ স্বাভাবিক গুণ অথবা ত্বকের বিশেষ কোন অবস্থা বশতঃ ম্যালেরিয়া হইতে মুক্ত থাকে। জলাভূমিতে যে বিষ উৎপন্ন হয় তাহা তাহাদের পক্ষে অনিষ্টকর নয়। বৃক্ষ লতাদি পচিয়া যে সকল নিম্ন ভূমি হইতে অপকারক বাষ্প নিষ্ক্রান্ত হইতে থাকে সেই সকল স্থান তাহাদের পক্ষে স্বাস্থ্যকর। এমত স্থানে তাহারা আনন্দে থাকে এবং স্ফুর্ত্তি সহকারে দীর্ঘ কাল জীবিত থাকে। যে সময় বসন্তানিল প্রবাহিত হইয়া শ্বেতচর্ম মনুষ্যদিগকে পীড়া সম্বন্ধে অভয় দান করে, তখন তাহাদিগের মনে স্ফুর্ত্তি থাকে না। ইংরাজও নিগ্রো সম্বন্ধে ডাং ফারগুসন এই রূপ লিখিয়াছেন।

 ভূমির উচ্চতা ও নিন্নতানুসারে জ্বরের হ্রাস ও বৃদ্ধি দেখিতে পাওয়া যায়। উচ্চ স্থানে জল অধিকক্ষণ থাকিতে না পাইয়া নিম্নভূমিতে গিয়া অবস্থিতি করে। যে নিম্নভূমি হইতে ম্যালেরিয়া বহিষ্কৃত হইতে থাকে, তাহা জল দ্বারা আবৃত হইলে আর তখন পীড়া থাকে। কিন্তু উর্দ্ধস্থিত স্থান সকল তৎকালে তৎপরিবর্ত্তে পীড়াদায়ক হয়। অর্থাৎ যখন যেখানে জল শুকাইয়া জমির গর্ভস্থিত রস সকল আকৃষ্ট হইতে থাকে, তখন সেইখানে জ্বর প্রকাশিত হয়। এই জন্য নদী কিম্বা জলার গর্ভের উপরকার স্থান হইতে যত জল শুষ্ক হইতে থাকে ততই সেই সকল স্থান বিঘ্নযুক্ত হয়। ম্যালেরিয়া জ্বর সমস্ত বৎসর সমভাবে থাকে না। শীত কালের শেষ হইতে বর্ষাকালের শেষ পর্যন্ত ম্যালেরিয়াক্রান্ত স্থান সকলে নূতন জ্বর অতি সামান্য দেখিতে পাওয়া যায়, শরতের শেষ হইতে শীতকালের প্রারম্ভ পর্যন্ত জ্বরের আর পরিসীমা থাকে না, তবে কোন বৎসর অধিক কোন বৎসর অল্প। যে বৎসর বর্ষাও তাপ অধিক সেই বৎসর জ্বরও অধিক হয়।

 ম্যালেরিয়া শরীরে প্রবেশ করিবামাত্রেই যে জ্বর প্রকাশিত হয় এমত নহে। ইহার আধিক্য ও শরীরের অবস্থানুসারে জ্বরের প্রকাশ শীঘ্র কিম্বা বিলম্বে হয়। ইহা শরীরে প্রবিষ্ট হইলে কখন্ অথবা কয়দিন পরে জ্বর উপস্থিত হইবে তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু এই মধ্য সময়ে শরীর স্ফুর্ত্তি বিহীন ও অলস হয়। পরিশ্রম করিতে ইচ্ছা হয় না, স্বাভাবিক বলের হ্রাসতা জন্মে এবং প্রায় অপরাহ্নে মস্তিষ্ক ভারি হয়। তদনন্তর স্থানের উচ্চতা ও তাপানুসারে সবিরাম কিম্বা অবিরাম জ্বর প্রকাশিত হয়। এমন অনেক সবল এবং ব্যায়ামনুরক্ত অথবা কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তিদিগকে দেখিতে পাওয়া যায়, যাহারা তিন চার বৎসর পর্যন্ত ম্যালেরিয়ার ক্ষমতাকে উপেক্ষা করিয়াছে, কিন্তু সেই ব্যক্তিরাই আবার কোন কারণ বশতঃ একবার দুর্ব্বল হইয়া পড়িলে আর উহার হস্ত এড়াইতে পারে না।

 অভ্যাস এক প্রকার দ্বিতীয় স্বভাব। কোন স্থানের জল বায়ু কোন ব্যাক্তিকে প্রথমতঃ সহ্য হইতে না পারে, কিন্তু কিছুদিন তথায় বাস করিলে তথাকার জল বায়ু অভ্যস্ত হইয়া যায় এবং পীড়াদায়ক হয় না। যাহারা ম্যালেরিয়াক্রান্ত দেশে কখন বাস করে নাই, তাহারা প্রথমতঃ তেমন স্থানে আসিয়া অল্পদিন থাকিতে না থাকিতেই ভয়ানক পীড়াগ্রস্ত হয়। ১৮৭০ খৃঃ অব্দে কানপুর হইতে কোন স্ত্রীলোক দুইটী কন্যা ও একটী পুত্র সহিত হুগলি জেলার অন্তর্গত অমর-পুর গ্রামে আসিয়া প্রায় এক বৎসর বাস করে। এই সময়ের মধ্যে ম্যালেরিয়ার দ্বারা দুইটী কন্যা বিনষ্ট হয় বালকটী যদিও অনেক চেষ্টার দ্বারা রক্ষা পায়, কিন্তু প্লীহা ও যকৃৎ পীড়াগ্রস্ত হইয়া প্রায় মৃতবৎ হয়। মাতা প্লীহা জ্বরে বহু কষ্ট ভোগ করিয়া পুত্রটীকে লইয়া কানপুর প্রত্যাগমন করেন। কিছু দিন থাকিয়া উভয়ে পীড়ার হস্ত হইতে মুক্তি লাভ করেন। যৎকালে এই স্ত্রীলোকটী তাহার পুত্র কন্যার সহিত জ্বর ভোগ করেন তখন তাঁহার বাটীর অপর কাহারও কিম্বা প্রতিবাসীদিগের মধ্যে জ্বর প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় নাই। এই রূপ উদাহরণ আরও অনেক দেখান যাইতে পারে। ওয়ালকেরণ যুদ্ধোপলক্ষে গিয়া যাহারা জ্বরের প্রথম কোপ এড়াইতে পারিয়াছিল, পর বৎসর তাহারা তত জ্বরাক্রান্ত হয় নাই। ফরাসীস সেনাপতি মনেট এই সমস্ত অবগত হইয়া এই পরামর্শ দেন যে, ওয়ালকেরণে সর্ব্বদা সৈন্য পরিবর্ত্তন না করিয়া সৈন্যদিগের জন্য একটী স্থায়ী বাসগৃহ নির্মাণ হয় এবং তথায় তাহারা বাস করে। ইহা হইলে সৈন্যেরা তথাকার জল বায়ুতে অভ্যস্ত হইবে। মনেট সাহেব লিখিয়াছেন যে, একদল ফরাসীস সৈন্য তথায় কয়বৎসর বাস করে। প্রথম বৎসর অপেক্ষা দ্বিতীয় বৎসরে তাহাদের মধ্যে মৃত্যু সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমিয়া যায়। তৃতীয় বৎসর তাহা দিগের মধ্যে প্রায় পীড়া দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

 ম্যালেরিয়া নামটী বঙ্গদেশে প্রায় সকলেই অবগত আছেন, কিন্তু ইহার গুণ এবং কি প্রকারে ইহা অনিষ্ট সাধন করে তাহা সাধারণের জানা আবশ্যক, কেন না তদ্দ্বরা অনেক প্রতিকারের সম্ভাবনা। যতদূর পর্যন্ত এ বিষয় জানা গিয়াছে তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাইতেছে।

 ম্যালেরিয়া ভূমি প্রিয়। ইহা ভূমির সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া থাকিতে ভালবাসে। ভূমির আকর্ষণী শক্তি দ্বারাই হউক, কিম্বা ইহার গুরুত্ব অথবা অন্য কোন কারণ বশতই হউক, ইহা কেন যে ভূমির সহিত মিলিত হইয়া থাকে তাহা এপর্যন্ত স্থিরীকৃত হয় নাই। যাহা হউক এই জন্য যাহারা খোলা ভূমিতে নিদ্রা যায় তাহারা শীঘ্র জ্বরে পতিত হয়। সেই জন্যই ধনী অপেক্ষা ইতর ও দুঃখীদিগের পীড়া অধিক এবং উপরকার ঘর অপেক্ষা। নিম্নকার ঘর অস্বাস্থ্যকর।

ম্যালেরিয়া অধিক উর্দ্ধে উত্থিত হইতে পারে না। ডাক্তার হণ্টার সাহেব জেমেকাতে সৈন্যদিগের পীড়া সম্বন্ধে যে পুস্তক লিখিয়াছেন তাহা হইতে নিম্ন বিষয়টা অনুবাদ করিতেছি! স্পেনদেশে বারিক ঘর সকল দুই তলা। এই দুই তলায় সৈন্যদের স্বাস্থ্যের এত ভিন্নতা হয় যে, উহা কর্ত্তৃপক্ষদের মনযোগ আকর্ষণ করে এবং অনুসন্ধান দ্বারা ইহা স্থির হয় যে নীচেকার ঘরে যাহারা বাস করিত, তাহাদের তিন জন পীড়িত হইলে উপর তলার এক জন পীড়িত হইত। এই অনুসন্ধানের পর অবধি নীচেকার ঘরে আর সৈন্য রাখা হইত না। বারবেডোজ প্রদেশের বারিক সকলের স্বাস্থ্যের বিষয় অনুসন্ধান করিয়া রালফ সাহেব লিখিয়াছেন বারিকের উপরকার ঘর অপেক্ষা নীচেকার ঘর সকল দ্বিগুণ অস্বাস্থ্যকর।

 ম্যালেরিয়া, বায়ু দ্বারা ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হয়। ইহার এই শক্তি থাকা প্রযুক্ত যে খানে ইহা উৎপন্ন হয় না সেখানেও ইহার গমন হওয়ায় সে স্থান ও অস্বাস্থ্যকর করে। ইহা কখন কখন বাস্পের সহিত সংমিলিত হইয়া বায়ুযোগে চালিত হয়। কেহ কেহ বলেন কুজ্ঝটিকার ন্যায় ইহা পরিদৃশ্যমান হইয়া বৃক্ষ লতাদি পত্রে সংলগ্ন থাকে। পাদরি হিবার সাহেব লিখিয়াছেন “চিটাতেলেও হইতে আমাদের পথ একটী নিবিড় কানন দিয়া যায়। ঐ কাননের নিম্ন ভাগে শ্বেত বাষ্পে ইতস্ততঃ দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। টেরাএতে যে প্রকার বাম্প দেখিয়াছিলাম এখানেও সেইরূপ”। পূর্ব্বে এক স্থানে লেখা হইয়াছে যে বর্ষার শেষে টেরা-এর জঙ্গলে কোন জীব বাস করে না। ল্যানসেসাই লিখিয়াছেন, কোন সময়ে ৩০ জন স্ত্রীপুরুষে বাম্পীয় যানে আমোদ উপলক্ষে টাইবার নদীর শেষ ভাগে যাত্রা করেন। ১০।১২ দিবস গমন করিতে করিতে তাঁহারা দেখিলেন বায়ু পরিবর্ত্তিত হইয়া দক্ষিণাভিমুখে প্রবাহিত হইতে লাগিল। এই দক্ষিণ বায়ু একটী জলাভূমি অতিক্রম করিয়া তাঁহাদিগের গাত্র স্পর্শ করিতে লাগিল। এই বায়ু কিছু ক্ষণ বহিতে না বহিতেই ২৯ জন সবিরাম জ্বর দ্বারা আক্রান্ত হইলেন। কেম্পোনার লেগুনা হইতে ম্যালেরিয়া উখিত হয়। উতর-পশ্চিম বায়ুর দ্বারা ইহা সঞ্চালিত হইয়া কেরিয়েকো নগর ভয়ানক হইয়া উঠে।

 ম্যালেরিয়াক্রান্ত দেশ সমূহে দিন অপেক্ষা রাত্র অনিষ্টকর। রাত্রিকালে শীতল বায়ু প্রযুক্ত সূর্যোত্তাপ বিক্ষিপ্ত ম্যালেরিয়া ঘনীভূত হওয়ার জন্যই হউক কিম্বা রাত্রিকালে উহা অধিক পরিমাণে উত্থিত হওয়া প্রযুক্তই হউক, অথবা সময়ে শরীর অধিক পরিমাণে উহার ক্ষমতাধীন হয় বলিয়াই হউক, নিশাকালে ম্যালেরিয়ার ক্ষমতা ও অনিষ্টকারিতা অধিক। অনাবৃত স্থানে রাত্রিকালে নিদ্রা যাইলে নিশ্চয় জ্বর উপস্থিত হয়। ইহা পুনঃপুনঃ দেখা হইয়াছে যে জাহাজস্থ যে নাবিকেরা কাষ্ঠাহরণ জন্য দিবা ভাগে ম্যালেরিয়াক্রান্ত সমুদ্রতীরে গিয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে জাহাজে প্রত্যাগত হয় তাহাদের মধ্যে প্রায় কাহারও জ্বর হয় না। কিন্তু যাহারা কার্য্যবশতঃ রাত্রে তীরে থাকিত তাহারা প্রায় সকলেই জ্বরশূন্য হইয়া ফিরিয়া আসিতে পারিতনা। ১৭৭৬ খৃঃ অব্দে ফিনিক্স নামক একখানি যুদ্ধের জাহাজ গিনি হইতে প্রত্যাগত হইতেছিল। যত দিন পর্যন্ত উহা সেণ্টটমাস উপদ্বীপে আসিয়া না পৌছিল তত দিন জাহাজস্থ ব্যক্তি সকলের কোন পীড়া হয় নাই। এই স্থানে জাহাজ নঙ্গর করিয়া উহা হইতে সকলে দ্বীপে অবতরণ করে। ইহাদের মধ্যে ১৬ জন কয়েক রাত্র ভূমিতে ছিল। ঐ ১৬ জনই ভয়ানক জ্বরগ্রস্ত হয় এবং উহার মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। জাহাজস্থ অপরাপর লোকেরা, যাহাদের সংখ্যা ২৮০ সকলেই স্বতন্ত্র২ দলবদ্ধ হইয়া আমোদ ও শিকার উপলক্ষে দিবাভাগে ঐ উপদ্বীপের নানা স্থান পর্যটন করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে সকলেই জাহাজে উপস্থিত হইত। ইহাদের মধ্যে এক জনেরও কোন পীড়া হয় নাই। ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে ঐ জাহাজ পুনর্ব্বার ঐ স্থান দিয়া গমন করিবার সময় তথায় কয়েক দিন অবস্থিতি করে। অজ্ঞানতা বশতঃ দশ জন সমস্ত রাত্র উপদ্বীপে থাকে উহাদের মধ্যে ৮ জনের মৃত্যু হয়। জাহাজস্থ অপর সমস্ত ব্যক্তিরা সমস্ত দিন ঐ উপদ্বীপে অতিবাহিত করিয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে জাহাজে প্রত্যাগত হইত। ইহাদের মধ্যে সকলেই সুস্থ ও স্বচ্ছন্দে ছিল।

 ম্যালেরিয়া সহজে জল অতিক্রম করিয়া আসিতে পারে না, এই দুষ্ট বায়ু রোধ হয় জল দ্বারা আকৃষ্ট হয়। এস্থলে ম্যালেরিয়ার গুরুত্ব ও নিম্নগমন বিষয়ে আরও প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে।

 পূর্ব্বে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দর্শিত হইয়াছে যে, জাহাজে গমন করিতে করিতে ম্যালেরিয়া উৎপাদিক তীরের নিকট উহা কিয়দ্দিবসের জন্য অবস্থিতি করায়, যাহারা উহা হইতে অবতরণ করিয়া তীরে নিশাযাপন করিয়াছে তাহারা প্রায় সকলই পীড়িত হইয়াছে। কিন্তু যাহারা রাত্রে জাহাজ পরিত্যাগ করিত না তাহারা সকলে নিরাপদে থাকিত। সার গিলবার্ট ব্রেন লিখিয়াছেন ফুনিং, রাজ পথে যে সকল জাহাজ অবস্থিতি করিতেছিল তাহাদের অভ্যন্তরস্থ লোক সকলই যে কেবল পীড়া শূন্য ছিল এমত নহে। কিন্তু ওয়েলকেরণ এবং বেভিলাণ্ড মধ্যস্থ ক্ষুদ্র প্রণালীতে যে সকল প্রহারক জাহাজ থাকিত তদ্বাসিরাও সম্পূর্ণ নিরোগ ছিল। এই প্রণালীর পরিসর ৬০০০ হাজার ফিট্। যদিও এই সংকীর্ণ প্রণালীর কিনারার নিকট অনেকগুলি জাহাজ ছিল, তথাচ উহাদের মধ্যে কেহই জ্বর কাহাকে বলে জানিতে পারে নাই। এ স্থলে অনেকে মনে করিতে পারেন যে এই দূষিত বায়ু জন্মস্থান পরিত্যাগ করিয়া ভূমির উপর দিয়াও গমন করিতে অশক্ত। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাহা নহে। যদিও নদী কিম্বা প্রণালী ইহার গতিকে অবরোধ করিতে পারে বটে, ভূমিতে বায়ুর দ্বারা তাড়িত হইয়া ইহা দূর পর্যন্ত সঞ্চালিত হয়। কতদূর পর্যন্ত যে ইহা দোষ বিহীন হইয়া গমনে সক্ষম তাহা এপর্য্যন্ত নির্দ্ধারিত হয় নাই। ডাং মেক‍্লাক্ দেখিয়াছেন হুগ‍্লীতে ইহা তিন মাইল পর্যন্ত গমন করিয়াছে।

 কথিত হইয়াছে যে, জল ম্যালেরিয়া বায়ুকে আকর্ষণ করে। ইহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে ঐ জল অস্বাস্থ্যকর ও পীড়াদায়ক হইবার সম্ভাবনা। নিম্নলিখিত ঘটনা গুলি পাঠ করিলে এ বিষয়ের সত্যাসত্য বোধগম্য হইবে। ১৮৪৫ খৃঃঅব্দে বেড‍্ফোর্ড নিবাসী ডাক্তার ইভান ও মাষ্টার ইভান যৎকালে কার্য্যবশতঃ ভারসেলিসে অবস্থিতি করিতেছিলেন, উভয়েই পালা জ্বরাক্রান্ত হন। তৎকালে মালিস্থিত সীন নদী মইতে জল আনাইয়া গৃহ কার্যের জন্য তত্রস্থ সকলে ব্যবহার করিত। এই জল এককালে নদী হইতে সকলে প্রাপ্ত হইত না। একটা বৃহৎ পুষ্করিণীতে উহা সঞ্চয় করিয়া প্রথমতঃ রাখা হইত এবং তৎপরে ঐ স্থান হইতে নানা স্থানে প্রেরিত হইত। ঐ পুষ্করিণীটী দৈবাধীন এই সময়ে নষ্ট হইয়া যায় এবং তথাকার নগরাধ্যক্ষ তত্রস্থ জলার জল সংগ্রহ করেন। ভারসেলিস নিবাসীরা কেহই এই নূতন জল ব্যবহার করেন নাই। কিন্তু পূর্বোক্ত সাহেবদ্বয় ও একদল অশ্বারোহী সৈন্য কেবল উহা পান করিত বলিয়া ইহারা সকলেই জ্বরগ্রস্ত ও অনেকেই মৃত্যু গ্রাসে পতিত হয়।

 ১৮৩৪ খৃঃ অব্দে জুলাই মাসে তিন শত সৈন্য সুস্থ শরীরে একদিনে তিনভাগে বিভক্ত হইয়া বোনা হইতে তিনচালানে প্রেরিত হয়। একদিনেই সকলে মারসেলিসে একত্র আসিয়া উপস্থিত হয়। এই তিন খানি জাহাজস্থ লোক এক প্রকার নিয়মে সুরক্ষিত হয় এবং একই প্রকার খাদ্য ভক্ষণ ও বায়ু সেবন করে। ইহার মধ্যে এক খানি জাহাজে ১২০ একশত কুড়ি জন সৈন্য ছিল। তন্মধ্যে ১৩ জন কঠিন জ্বরাক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করে ৮৮ জন পীড়িত হওয়ায় মারসেলিসের হাঁসপাতালে প্রেরিত হয়। অনুসন্ধানে প্রকাশিত হইয়াছিল যে ঐ পীড়িত জাহাজ শীঘ্র যাত্রা করিবার জন্য বোনার নিকটস্থ একটী জলা হইতে পানীয় জল সংগ্রহ করিয়া লয়। অপর দুইখানি জাহাজের জন্য নির্মল জল গ্রহণ করা হয়, এবং ইহাদের কোন আরোহীর পীড়া হয় নাই। জাহাজস্থ পীড়িত সৈন্যদিগের মধে ৯ জন কেবল পীড়া শূন্য ছিল, এবং ইহারা নাবিকদিগের নিকট হইতে নির্ম্মল জল ক্রয় করিয়া পান করিত।

 ম্যালেরিয়া শরীর মধ্যে প্রবিষ্ট হইবামাত্রেই যে পীড়া উপস্থিত হয় এমন নহে। পীড়া প্রকাশ হইবার পূর্ব্বে শরীর দুর্ব্বল ও অলস এবং মস্তিষ্ক কিঞ্চিত ভারি হয়। এই রূপ হইতে হইতে জ্বর প্রকাশিত হয়। ম্যালেরিয়া হইতে যে যে পীড়া উৎপন্ন হইতে পারে তাহাদের বিষয় ও চিকিৎসা নিম্নে লিখিত হইল।

 বিষমজ্বরে (Intermittent fever) কম্প, দাহ, ও ঘর্ম্ম পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। এই জ্বরের বিষয় ও চিকিৎসা স্থানান্তরে আনুপূর্ব্বিক সুন্দররূপে লিখিত থাকায় এক্ষণে তদালোচনার আবশ্যকতা নাই। এই স্থলে কেবল দ্বৌকালীন বিষম জ্বরের (Double quotidian ague) বিষয় কিছু লেখা যাইতেছে। এই জ্বর সম্প্রতি যেমন সর্ব্বদা দৃষ্টিগোচর হয়, এমন পূর্ব্বে ছিল না। ঐকাহিক জ্বর যেমন নিয়মিতরূপে প্রতিদিন প্রায়ই এক সময়ে উপস্থিত হয়, ইহাও সেই রূপ দুইবার করিয়া প্রতিদিন নির্দ্ রিত সময়ে প্রকাশিত হইয়া থাকে। ইহার সমস্ত লক্ষণ ঐকাহিক জ্বরের ন্যায়, কেবল একবারের স্থলে ইহা দুইবার প্রকাশিত হয়। প্লীহা কিম্বা যকৃত অথবা উভয়ের পীড়ার সহিত এই জ্বর সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়। কুইনাইন দ্বারা ইহার কিছু মাত্র উপশম হয় না, বরং কুইনাইন অধিক মাত্রায় সেবন করাইলে অনিষ্ট হয়। নিম্নলিখিত রোগীটির বিষয় অধ্যয়নে এই পীড়ার চিকিৎসার বিষয় অনেক অবগত হওয়া যাইবে।

 নং ১। দ, চ, বন্দ্যোপাধ্যায়—১৮৭৩ সালের ১২ই চৈত্র দ্বৌকালীন বিষম জ্বরের চিকিৎসার জন্য আমার নিকট উপস্থিত হন। প্রথম তিন মাস এই ব্যক্তি এক জন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকেন। দ্বৌকালীন জ্বর বন্ধ করিবার জন্য এই চিকিৎসক প্রতি দিবস ১০ গ্রেন করিয়া কুইনাইন সেবন করান। তাহাতে কৃতকার্য্য না হওয়ায় ২০ গ্রেন করিয়া কুইনাইন প্রায় ১৫ দিবস ব্যবহার করেন। পীড়া কিছু উপশম না হওয়ায় রোগী এক জন বিজ্ঞ কবিরাজের চিকিৎসায় থাকেন। কয় দিবস কবিরাজি ঔষধ সেবন করিয়া, জ্বর এক দিবস দুই বার ও দ্বিতীয় দিবস তিন বার করিয়া প্রকাশিত হইতে লাগিল। প্রায় তিন মাস এই রূপ হওয়ায় আমার নিকট রোগী উপস্থিত হইলেন। রোগীর প্লীহা নাভিগহ্বর পর্যন্ত অবতীর্ণ হইয়াছিল, প্রথম তিন দিবস কোন ওষধি না দিয়া কেবল রোগীর সমস্ত শারীরিক অবস্থা দেখিলাম। আমার রোগবিবরণপুস্তক হইতে নিম্ন বৃত্তান্ত অনুবাদিত হইল।

 ১৩ই চৈত্র—বেলা দুই প্রহর একটার সময় অত্যন্ত কম্প সহকারে জ্বর উপস্থিত হইল। কম্প প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থিতি করে। তৎপরে দাহ ও ঘর্ম্ম উপস্থিত হইয়া অপরাহ্নে ৬টার সময় জ্বর সম্পূর্ণ মগ্ন হয়। জ্বর মগ্নে ধমনী মিনিটে ৬৫ বার প্রবাহিত হয়। ঐ দিবস রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আবার অধিকতর কম্প হইয়া জ্বর আক্রমণ করে, পর দিন প্রাতে ৬টার সময় সম্পূর্ণ মগ্ন হয়।

 ১৪ই চৈত্র—বেলা ১১টার সময় জ্বর আসিয়া দুই প্রহর দুইটার সময় মগ্ন হয়। অপরাহ্ন ৬টার সময় জ্বর কম্প দিয়া আসিয়া প্রায় রাত্রি দশটার সময় মগ্ন হয়। রাত্রি ২টার সময় আসিয়া প্রাতঃকালে ৫॥ টার সময় সম্পূর্ণ মগ্ন হয়। জ্বর মগ্ন হইলে শরীরে কোন গ্লানি থাকে না, এবং রোগী এক ক্রোশ পথ যাতায়াত করিতে পারেন। দাস্ত পরিষ্কার।

 ১৫ই চৈত্র—প্রাতঃ ৭টার সময় ধমনী ৬৬। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ।

টিংচর কুইনি ১ ড্রাম্
লাইকর আর্সেনিক ৫ বিন্দু
লাইকর ষ্ট্রিক্‌নিয়া ২ মিনিম
টিংচর সিন্‌কোনা কম্পাউণ্ড ৩০ বিন্দু
ডিকক্‌শন সিন্‌কোনা ১ ঔন্স

একত্র মিশ্রিত করিয়া দিবসে তিনবার সেব্য। পথ্য মৎস্যের ঝোল অন্ন ও দুগ্ধ।

 ১৬ই চৈত্র—প্রাতঃ ৭টা। গত দিবস বেলা দুই প্রহর একটার সময় কম্প সহকারে জ্বর উপস্থিত হইয়াছিল, ৬টার সময় ঘর্ম্ম হয়। আবার রাত্রি দুইটার সময় জ্বর আসিয়া প্রাতঃ ৬টার সময় মগ্ন হয়। ওষধি ও পথ্য পূর্ব্বমত।

 ১৭ই চৈত্র—প্রাতঃ ৮টা। গত দিবসে পূর্বের ন্যায় তিনবার জ্বর হয়। ওষধি ও পথ্য ঐরূপ। বৈকাল ৫টার সময় জ্বর ত্যাগ হইতেছে, ঘর্ম্ম বিন্দু বিন্দু ললাটে ও কণ্ঠদেশে দেখা যাইতেছে, ওষধি ও পথ্য। ঐরূপ।

 ১৮ই চৈত্র—প্রাতঃ ৯টা। গত দিবস জ্বর দুইবার ইইয়াছিল, জ্বরান্তে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন, ক্ষুধা বড় ভাল নয়।

 ১৯শে—চৈত্র—প্রাতঃ ৮টা। গত দিবস জ্বর তিন বার প্রকাশিত হয়। অদ্য পূর্ব্বকার ওষধি বন্ধ রহিল; জ্বর মগ্নে অদ্য ২০ গ্রেন করিয়া দুই বারে ৪০ গ্রেন কুইনাইন সেবন করান হইবে; পথ্য পূর্ব্বমত।

 ২০শে চৈত্র—প্রাতঃকাল ৮টা। পুর্ব্বদিন রাত্রিতে জ্বর অতি সামান্য রূপ হইয়াছিল, রোগী এক্ষণে সচ্ছন্দ আছেন। কুইনাইন্ অদ্য দুইবারে ৪০ গ্রেন্ দেওয়া হইবেক।

 ২১চৈত্র প্রাতঃকাল ১০ টা। গত কল্য জ্বর তিনবার হইয়াছিল, জ্বরকালে গাত্রের উত্তাপ, দাহ এবং পিপাসা অন্যদিনাপেক্ষা বৃদ্ধি হইয়াছিল। রোগী কহিল অদ্য আমার কিছু মাত্র ক্ষুধা নাই, এবং মস্তক অল্প ভারি বোধ হয়।

টিংচর ফেরি পারক্লোরাইড্ ৫ মিনিম্
টিংচর্ কলম্ব ৩০ মিনিম্
লাইকর ষ্ট্রীক্‌নিয়া ২ মিনিম্
ইন্‌ফিউজন্ কোয়াসিয়া ১ ঔন্স

একমাত্রা, এই রূপ দিবসে তিনবার সেবন করাইবে। পথ্য অন্ন, মৎস্যের ঝোল, দুগ্ধ।

 এই রূপ চিকিৎসায় রোগীকে ৭ দিবস রাখা হয়। কিন্তু ইহাতে কিছু মাত্র উপকার দর্শিল না। এক দিবস ২ বার ও তাহার পর দিন ৩ বার করিয়া জ্বর হওয়া কোন প্রকারেই নিবারিত হইল না। এই সময়ে রোগীর দক্ষিণ দিকের পঞ্জরের নিম্নে অল্প বেদনা অনুভব হওয়ায় তথায় লাইকর্ লিটির ব্লিষ্টার্ দেওয়া হইল, কিন্তু তাহাতে জ্বরের কিছু মাত্র হ্রাস কিম্বা পালার ব্যতিক্রম হইল না। এক মাসের অতিরিক্ত চিকিৎসা হওয়ায় পীড়ার কিছু মাত্র উপশম না হওয়াতে সমস্ত ওষধি বন্ধ করা হইল, এবং যষ্টিমধু ৬০ গ্রেন্ ও খর্জুরের পত্র ৬০ গ্রেন, ৮ ঔন্স জলে সিদ্ধ করিয়া ৪ ঔন্স থাকিতে নামাইয়া দুই ঔন্স প্রাতে এবং দুই ঔন্স বৈকালে সেবন করান হইল[]। ইহাতে কয় দিবস জ্বরের হ্রাস হয় কিন্তু উহার আক্রমণ বন্ধ হয় না। ৭ দিবসের জন্য এক্ষণে সমস্ত ওষধি বন্ধ করা হইল এবং রোগীকে তাহার ইচ্ছা মত স্নানাহার করিতে দেওয়া হইল। ইহাতেও কোন ফলোদয় হইল না। এই সময় পরীক্ষা করিবার জন্য সিবিল্ সার্জনের নিকট হইতে কতকগুলি কার্ব্বনেট্ অব আয়র্ণের মোড়া ক্ষেতপাপড়া, গোলঞ্চ ও চিরেতার ডিকক‍্সমের সহিত পুরাতন জ্বরে ব্যবহার করিবার জন্য ব্যবস্থা পত্র সহকারে আমার নিকট প্রেরিত হয়। যে রূপ নিয়মে ব্যবহার করিতে হয়, তাহা চিকিৎসা-দর্পণের পঞ্চম খণ্ডের ৪৫ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে দেখিলাম। অতএব তাহা দৃষ্টে সবিশেষ জানিতে পারা যাইবেক। এই ওষধি ২ দিবস সেবনে রোগীর জ্বর তিন দিবসের জন্য একবারে বন্ধ হইল। এই তিন দিবস একবারও জ্বর প্রকাশিত হয় নাই। কিন্তু এই তিন দিন দিবসান্তে পূর্ব্বমত জ্বর হইতে লাগিল, উক্ত ঔষধি ব্যবহারে আর কোনও ফল দর্শিল না। এতদবলোকনে রোগী বাটী গমন করিল। এবং শুনিয়াছি কিয়দ্দিবস পরেই তাহার মৃত্যু হয়।

 নং ২। যজ্ঞেশ্বর কেওরা, বয়ঃক্রম ২৬ বৎসর, ১৮৭৫ সালের ২১ জুনে দ্বৌকালীন বিষম জ্বরের চিকিৎসার জন্য শুলতানগাছার আউট‍্ডোের ডিস‍্পেনসরিতে উপস্থিত হয়। জ্বর প্রতি দিন প্রাতে এবং সন্ধ্যার সময় কম্প দিয়া প্রকাশিত হইত। শরীর অত্যন্ত শীর্ণ, দুর্ব্ব লতা বশতঃ প্রত্যহ চিকিৎসালয়ে যাতায়াত্ করিতে অপারক্ বিবেচনায় তাহাকে একবারে চারি দিবসের উপযুক্ত যষ্ঠিমধু খর্জুরের পত্রের সহিত ডিকক্সন প্রস্তুত করিয়া সেবন করিবার জন্য দেওয়া হইল। ৪ দিবস গত হইলে রোগী চিকিৎসালয়ে উপস্থিত হইয়া কহিল যে, দুই বার জ্বর না হইয়া এক্ষণে একবার করিয়া হইতেছে। ৪ দিবসের জন্য পুনর্ব্বার ঐ ওষধি দেওয়া। হইল। ইহা সেবনে জ্বর একবারে নিবারণ না হইয়া প্রত্যহ এক বার করিয়াই হইতে লাগিল। এই জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে এক্ষণে উদরাময় উপসর্গ উপস্থিত হওয়ায়। নিম্নমত ওষধি দেওয়া হইল।

পলভ ইপিকাকুয়ানা ৬ গ্রেন্
কুইনি সল‍্ফেটিস্ ২ গ্রেন্
য়্যাটীস্ ১ গ্রেন্

একত্র মিশ্রিত কর, এই রূপ দিবসে তিন বার সেবন করিবে। ৮ দিবস উল্লিখিত ওষধি সেবনে, উদরাময় প্রায় আরোগ্য হইল, জ্বরের কোপও অনেক কমিয়া গেল। এই মোড়া ওষধি আরও এক সপ্তাহ সেবনে উদরাময় সম্পূর্ণ আরোগ্য হইল এবং জ্বর প্রায় নিবারণ হইল। যকৃতের অল্প প্রদাহ ও প্লীহার বিবৃদ্ধতা থাকায় উহাদিগের জন্য স্বতন্ত্র চিকিৎসা হওয়ায় রোগী এক্ষণে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছে।

 নং ৩। তালচিনান নিবাসী কোন ভদ্রলোক তাঁহার পুত্ত্রের দ্বৌকালীন জ্বর, শোথ, যকৃৎ ও প্লীহার চিকিৎসার জন্য আমাকে গত বৈশাখ মাসে তাঁহার বাটীতে আহ্বান করেন। বালকটীর বয়ঃক্রম ১০ বৎসর। প্রথমতঃ শোথের জন্য চিকিৎসা করায় উহা আরোগ্য হইল। তৎপরে দ্বৌকালীন জ্বর নিবারণ করিবার প্রত্যাশায় যষ্টিমধু ও খর্জুর পত্র পূর্ব্বমত দেওয়া হইল, কিন্তু তাহাতে কিছু মাত্র উপকার হইল না। ক্ষেতপাপড়া গোলঞ্চ ও চিরেতার ডিকক্‌সনের সহিত কার্ব্বনেট্ অব্ আয়রন্ সেবন করিতে দেওয়া হইল। ১২ দিবস সেবনে ইহার কার্য্যকারিতার কিছু মাত্র পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গেল না। ক্ষুধামান্দ্য হওয়ায় রোগী দিন দিন দুর্ব্বল হইতে লাগিল এবং দাস্ত বন্ধ হইয়া পদদ্বয় অল্প অল্প ফুলিতে লাগিল। কয়েক দিবস পরে এই অবস্থা দেখিয়া নিম্ন মত ওষধি ও পথ্য ব্যবস্থা করা হইল।

ফেরি আওডিড্ ২ গ্রেন্
পড্‌ফিলিন / গ্রেন্
এক্সট্রাক্ট জেনেসিয়ান্ ১ গ্রেন্

 একত্র মিশ্রিত করিয়া একটী বটিকা প্রস্তুত কর এই রূপ প্রাতে ও অপরাহ্ণে একটী করিয়া সেবন—

য়্যাসিড হাইড্রক্লরিক ডিল্ ৩০ মিনিম
য়্যামন মিউরিয়াট ৩০ গ্রেন্
টিংচর সিনকোনা কোঃ ৩ ড্রাম
ডিকক্সন্ সিন্‌কোনা ৩ ঔন্স
 এক কাঁচ্চা দিবসে তিনবার সেবন—

 পথ্য—অন্ন, দুগ্ধ, মৎস্য এবং মাংসের ঝোল এবং পোর্ট। এই রূপ ওষধি ও পথ্যে জ্বরের হ্রাস হইল, দাস্ত পরিষ্কার ও ক্ষুধা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। প্রায় এক মাস এই রূপ ব্যবস্থায় রোগীকে রাখা হয় এবং যকৃৎ ও প্লীহার উপর কম্পাউণ্ড্ অয়েণ্টমেণ্ট অব আওডিন্ মালিস করিতে দেওয়া হয়। যদিও এতদ্দারায় রোগী অনেক সবল হইল এবং জ্বর একবার করিয়া হইতে লাগিল বটে কিন্তু এক্ষণে জ্বরের আর বিরাম রহিল না। মৃদু মৃদু জ্বর দিবারাত্র ভোগ হইতে লাগিল। কুইনাইন দেওয়াতে জ্বরের বৃদ্ধি হওয়ায় উহা বন্ধ রাখিয়া এখন মিউরিয়াট ৬ গ্রেন্ প্রাতে এবং রাত্রে—

ফেরি এট্ কুইনি সাইট্রাট্ ২০ গ্রেন্
পটাস ব্রোমিড্‌ ৩০ গ্রেন্
টিংচর কলম্ব ৩ ড্রাম্
লাইকর ষ্ট্রীক্‌নিয়া ১২ মিনিম
ইন্‌ফিজন্‌ কোয়াসিয়া ৩ ঔন্স

এক কাঁচ্চা দিবসে তিন বার করিয়া সেবন করান হইতে লাগিল। এই রূপ ওষধি দুইমাস সেবনে জ্বর আরোগ্য হইল এবং যকৃত ও প্লীহা অনেক কমিয়া গেল।

 নং ৪। স্ত্রীলোক বয়ক্রম ১৫ বৎসর অত্যন্ত দুর্ব্বল এবং শয্যা হইতে উত্থিত হওনে অপারক। দন্ত মাড়ি হইতে অনবরত শোণিত নির্গত হইতেছিল। প্লীহা নাভি হইতে ২ ইঞ্চ নিন্ন পর্য্যন্ত বৃদ্ধি হইয়াছিল। জ্বর দিবা রাত্র ভোগ হইত কিন্তু প্রাতঃ ৯টা এবং রাত্র ৮-ট। হইতে ১২টার মধ্যে স্পষ্টাকারে প্রতিদিন কম্প দিয়া প্রকাশিত হইত। কুম্প অল্পক্ষণ থাকিত এবং তৎপরে পিপাসা গাত্রের উত্তাপ ও দাহ অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইত এবং দীর্ঘ স্থায়ী হইত। রোগীর এই রূপ অবস্থায় তাহার স্বামি আমাকে চিকিৎসা করিবার জন্য নিযুক্ত করিলেন। দন্ত মাড়ি স্থানে স্থানে পচিয়া ঝুলিতেছিল এবং ক্ষত স্থল হইতে রক্ত নির্গত হইতে ছিল দেখিয়া ব্রাণ্ডী ১ ঔন্স, এলম সল‍্ফ ১ ড্রাম, টিংচ মার ২ ড্রাম, জল ৯ ঔন্স একত্র মিশ্রিত করিয়া কুল্লি করিতে এবং জ্বরের জন্য জ্যেষ্ঠমধু ও খর্জুর পত্রের ডিকক্সন্ সেবন করিতে দিলাম রক্ত নির্গমন নিবারণ হইল কিন্তু জ্বরের কিছুই হইল না। কার্ব্বনেট অব আয়র্ণ, ক্ষেতপাপড়া, গুলঞ্চ ও চিরেতার ডিকক্সনের সহিত তৎপরে দেওয়া হইল। ইহাতেও কোন উপকার দর্শিল না। রোগীর স্বামীর কাবিরাজিক চিকিৎসার উপর ভক্তি থাকায় এক জন কলিকাতার প্রসিদ্ধ কবিরাজকে চিকিৎসার জন্য নিযুক্ত করিলেন। প্রায় এক মাস কবিরাজ চিকিৎসা করিলেন। রোগী নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িল, জ্বর বৃদ্ধি হইল, ক্ষুধা প্রায় একবারে বিনষ্ট হইল; দন্তমাড়ি হইতে পুনর্ব্বার রক্তস্রাব হইতে লাগিল, এবং উদরাময় উপস্থিত হইল, এই সময় আবার আমাকে দেখিতে হইল। রোগীকে কোন স্বাস্থ্যকর স্থানে লইয়া যাইবার জন্য পরামর্শ দেওয়ায় রোগী আপত্তি করিলেন এবং কহিলেন যে আমি শয্যায় পার্শ্ব পরিবর্ত্তন করিতে পারি না, কি রূপে স্থানান্তর যাইব। উদরাময় আরোগ্য এবং অল্প বলাধান যদি হয়, রোগীকে কাটওয়া লইয়া যাওয়া হইবে এই রূপ স্থির হইল। পোর্ট, ব্রথ এবং ফেরিসাইট্রেট্ অব কুইনাইন্‌ ইন্‌ফিউজন্ কলম্বর সহিত দেওয়া হইতে লাগিল। উদরাময় জন্য ডোভার্শ পাউডর ১০ গ্রেন করিয়া দিবসে ২ বার সেবন করান হইতে লাগিল, উদরাময় অনেক উপশম হইল। আমার অনুরোধে রোগীকে এই সময় তাঁহার পিত্রালয় কাটোয়া পাঠান হইল। সঙ্গে কেবল দুই ডজন নিম্ন মত পিল্‌ দেওয়া হইল।

ফেরি এট্ কুইনি সাইট্রাট্ ২ ড্রাম্
কুইনি সল্‌ফ ২৪ গ্রেন্
একষ্ট্রাক্ট্ জেনসিয়ান্ ১ ড্রাম্

একত্র মিশাইয়া ২৪টী পিল হইবে—কাটোয়া যাইয়া এই ওষধি সেবন করাতে রোগীর অত্যন্ত ক্ষুধা বৃদ্ধি হইল এবং ৬মাস তথায় অবস্থিতি করিয়া রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছেন। ম্যালেরিয়া জ্বরের নিদান, পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে ম্যালেরিয়া শরীর মধ্যে প্রবিষ্ট হইবামাত্রেই পীড়া প্রকাশিত হয় না। শরীরের প্রবণতা ও ম্যালেরিয়ার আধিক্যানুসারে ইহা অধিক কিম্বা অল্প দিবস পরে স্নায়ুকেন্দ্রের কার্য্যবিকার (Functional disorders of the nervous centers) উপস্থিত করিয়া সবিরাম, ক্ষণবিরাম (Remittent fever) অথবা ইয়লো জ্বরে পরিণত হয়। এই সকল জ্বর কখন কখন এত অল্প সময়ের মধ্যে জীবন বিনষ্ট করে যে, শারিরীক কোন যান্ত্রিক বিধান পরিবর্ত্তন বা বিকার (Organic structu- ral alteration or disease) হইবার সময় থাকে না। কিন্তু এরূপ সর্ব্বদা ঘটে না। এই সকল পীড়া উপস্থিত হইয়া ক্রমে ক্রমে নানা যন্ত্র এবং বিধানোপাদানের ক্রিয়া ও নির্ম্মণকে দূষিত করে। যকৃত, প্লীহা, ফুসফুস হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, মাস্তুক, ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর ক্রিয়া এবং বিধান পরিবর্ত্তন করিয়া ফেলে। শরীর মধ্যে ম্যালেরিয়া অধিক প্রবিষ্ট হইলে রিমিটেণ্ট‌্, এবং ইয়লো জ্বর প্রকাশিত হয়। ম্যালেরিয়োৎপাদ্য ইয়লো জ্বর আমাদের দেশে কদাচিৎ দেখিতে পাওয়া যায়। দেশকালভেদে যকৃত ও প্লীহার পীড়ার ন্যূনাধিক্য হয়। ভারতবর্ষের কোন কোন স্থানে প্লীহার এবং অপর স্থানে যকৃতের পীড়া, জ্বরে আনয়ন করে। বোধ হয় ভূমির স্থানিক গঠন ও স্বভাব বশতঃ এই রূপ বিভিন্নতা দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে।

 ম্যালেরিয়া জ্বরের প্লীহার সহিত যে কি নৈকট্য সম্বন্ধ আছে তাহা বলিতে পারি না, কিন্তু প্রায়ই আমাদের দেশে অন্য কোন যান্ত্রিক পরিবর্ত্তন হইবার পূর্ব্বে প্লীহা হয়। প্রথম প্রথম জ্বরের কম্পাবস্থায় ত্বকের এবং উপরস্থ স্থান সমূহের রক্ত আভ্যন্তরিক যন্ত্রাদিতে উপস্থিত হয়। এই সময়ে ত্বকের উষ্ণতা বড় অধিক বোধ হয় না, এবং উহা কুঞ্চিত হয়। দাহাবস্থায় অভ্যন্তরস্থ রক্ত আবার ত্বকে প্রত্যাগমন করে এবং গাত্রের উত্তাপ বৃদ্ধি হয়। জ্বর নিবারণ না হইলে প্রতিবার কম্পের সময় উপরস্থ রক্ত এই রূপে প্লীহাতে গমন করে এবং জ্বর ত্যাগে রক্ত যথা স্থানে প্রত্যাগত হয়। এইরূপ কিছুদিন হইলেই প্লীহার স্থিতিস্থাপকতা বিনষ্ট হইতে থাকে, এবং উহা আর সহজে স্বাভাবিক অবয়ব প্রাপ্ত হয় না, রক্ত দ্বারা কতক পরিমাণ স্ফীত হয়। এই অবস্থাকেই প্লীহার কন‍্জেশ্চন্ অর্থাৎ রক্তাবরোধ কহে। রক্তাবরোধ বশতঃ কখন কখন প্লীহা এত বৃহৎ হয় যে, উহা নাভিদেশ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। কিছু দিবস জ্বর না হইলে এই রূপ প্রকাণ্ড আয়তন বিশিষ্ট প্লীহা আবার স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া থাকে। রক্ত অবরোধে প্লীহার সূক্ষ্ম গঠনের কিছু মাত্র পরিবর্ত্তন হয় না, কেবল যন্ত্রটী রক্ত দ্বারা স্ফীত হয়। যদি প্লীহার স্থিতি স্থাপকতা না থাকিত, এবং তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে রক্ত ধারণ করিয়া রাখিতে সক্ষম না হইত, কেবলমাত্র সবিরাম জ্বরেরদ্বারাই আমাদের মহানিষ্ট সাধিত হইত। ইহা আমাদের অনায়াসে অনুভব আয়ত্ব যে, যকৃত, অন্ত্র, মূত্র গ্রন্থি, হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসকে প্লীহার পরিবর্ত্তে এই কার্য্যটী করিতে হইলে আর ও কত ভয়ানক উৎকট পীড়া হইত। বাস্তবিক তাহা হইলে আমাদের দেশ এত দিনে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছিন্ন হইত।

 প্লীহাতে সর্ব্বদা রক্ত গমনাগমন করাতে উহার স্থিতিস্থাপকতা ক্রমশঃ বিনষ্ট হইয়া যায়, উহার ট্রেবোকউলি এবং বাহ্য আবরণীর দৃঢ়তা এবং কাঠিন্য বৃদ্ধি হইয়া সমস্ত যন্ত্রের বিবৃদ্ধতা উৎপাদন করে। বিবৃব্ধতাতে প্লীহার কোন নূতন ঝিল্লীর উৎপত্তি হয় না, যাহা কিছু আছে তাহারই পরিমাণের ও অবয়বের বৃদ্ধি হয়। যখন দৈহিক কোন অংশ বা যন্ত্র অতিরিক্ত কোন কার্য্য করিতে বাধ্য হয়, তখন উহাতে অধিক পরিমাণে রক্তের সমাগম হইয়া উহা স্ফীত ও দৃঢ় হয়। যে পরমাণু-সমষ্টিতে উহা নির্ম্মিত তাহারই আধিক্য হয়, নূতন পরমাণুর সমাবেশ হয় না। হৃৎপিণ্ডের শোণিত-প্রবাহ প্রবহণের প্রতিরোধ (obstruction) পীড়া উপস্থিত হইলে বেনট্রিকেল‍্দ্বয়ের যে রূপ বিবৃদ্ধতা হইয়া থাকে, প্লীহার বিবৃদ্ধতাও সেই রূপ। সূক্ষ্ম দর্শন করিলে প্লীহার এই বিবৃদ্ধতাকে স্বাস্থ্যের বিশেষ বিরোধী বলিয়া বোধ হয় না। যখন বিবৃদ্ধতার আধিক্য বশতঃ প্লীহার পরিমাণ অত্যন্ত বৃদ্ধি হইয়া য়্যাব‍্ডোমেন্ অর্থাৎ উদর গহ্বর স্থিত অন্যান্য যন্ত্রের বা নির্ম্মাণের (structure) কার্য্য র বিঘ্নতা উপস্থিত করে তখনই বিবৃদ্ধতা বিপদুৎপাদন করে।

 ম্যালেরিয়া-প্রপীড়িত দেশে কখন কখন প্লীহাতে প্রদাহ হইয়া স্ফোটক (abscess) উপস্থিত হয়। এইরূপ ঘটনা কদাচিৎ। আট বৎসরের মধ্যে কেবল দুইটী এইরূপ রোগী আমি দেখিতে পাইয়াছি; একটী শুলতানগাছার চিকিৎসালয়ে, অপরচী আমার বাহিরের চিকিৎসায়। এই দুইটীরই পরিণাম মৃত্যু। যে বালকটিকে চিকিৎসালয়ে দেখা যায় তাহার বয়ঃক্রম ১০ দশ বৎসর। যংকালে বালকটীর মাতা উহাকে চিকিৎসালয়ে লইয়া আইসে তখন উহার নাভি-গহ্বর হইতে পূযনির্গত হইতে ছিল। প্লীহাটী নাভির নিম্নে এক ইঞ্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছিল। প্রথমতঃ আমার বোধ হইয়াছিল যে পূয কেবল অধস্ত্বচ মাংসপেশীর সন্নিকট হইতে বহির্গত হইতেছে, কিন্তু প্রোব ও অণুবীক্ষণ দ্বারা পরীক্ষা করিয়া জানিতে পারা গেল যে উহা প্লীহা হইতে। প্লীহার যে অংশ হইতে পূ্য নির্গত হইতেছিল তাহা য়্যাব‍্ডোমিনেল ওয়ালেতে সংযুক্ত হইয়াছিল।

 আমাদের প্রদেশে প্লীহার পীড়া যত সাধারণ যকৃতের তত নয়। সবিরাম জ্বর যেমন প্লীহার পীড়ার কারণ, ক্ষণবিরাম (remittent fever) জ্বর যকৃতের পক্ষে তদ্রুপ। সাধারণতঃ সবিরাম ও ক্ষণবিরাম জ্বরের উপর প্লীহা ও যকৃতের পীড়া নির্ভর করে। অধুনা বঙ্গদেশীয় ম্যালেরিয়া জ্বরে যকৃতের প্রদাহ প্রথমতঃ দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রায়ই প্লীহাব পীড়া কিছুদিন অগ্রে হইয়া উহার বিবৃদ্ধতা স্থিত হয়, তাহার পর এক প্রকার মৃদু অবিরাম জ্বরের সহচর বা অনুগামী হইয়া যকৃতের রক্তাবরোধ বা প্রদাহ প্রকাশিত হয়। প্রথমতঃ প্রদাহের লক্ষণ বিশেষ কিছু স্পষ্টাকারে প্রকাশিত হয় না, এমন কি অনেক সময়ে কিছু মাত্র লক্ষণই বুঝিতে পারা যায় না। ক্রমশঃ যত বৃদ্ধি হইতে থাকে হস্তের দ্বারা অনুভূত হয়। কিন্তু এই রূপ অজ্ঞাতসারেই সর্ব্বদা যকৃতের প্রদাহ হইয়া উহার আয়তন বৃদ্ধি হইতে থাকে এমন নহে। কখন২ প্রদাহের লক্ষণ সকল প্রথম হইতেই উত্তমরূপ লক্ষিত হয়। অজ্ঞাত ও মৃদু রূপে যে প্রদাহ চলিতে থাকে তাহা যদি বিশেষ যত্ন ও চিকিৎসার দ্বারা নিবারিত না হয় তাহা হইলে প্রদাহ বৃদ্ধি হইয়া যকৃতে পূযাধান (suppuration) হয়। পূর্যাধানে যকৃতের এক প্রকার পরিমিত স্ফোটকোদয় হয়। বিস্তৃত পূযাধন (diffuse suppuration) অবস্থা প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না। পরিমিত স্ফোটক সংখ্যার তিনাংশের দুই অংশ বাহিরের দিকে মুখ প্রদর্শন করে। যকৃতের বিবৃদ্ধতায় উহার রক্তসঞ্চালন (portal circulation) কার্য্য র প্রতিবন্ধকতা হইয়া য়্যাসাইটিস্ (জলোদরি) উপস্থিত হয়। প্লীহা ও যকৃতের বিবৃদ্ধতা বশতঃ যে ড্রপ্সী উপস্থিত হয় তাহা দ্বিবিধ, এক প্রকার স্থানিক, অপর সাধারণ। স্থানিক ড্রপ্সী যকৃতের বিবৃদ্ধত। ও কিরোসিশের ফল এবং উহা উদর-গহ্বর মধ্যেই আবদ্ধ। এই স্থানিক ড্রপ্সী বড় অনিষ্টকর, ইহা প্রায়ই আরোগ্য হয় না। রোগীর ইহাতে যন্ত্রণার পরিসীমা থাকে না। চক্ষুর্দ্বয় অর্বিট কোটর মধ্যে বসিয়া যায়, হস্ত পদ কেবল চর্ম্মাছাদিত অস্থি মাত্র দেখায়, বক্ষঃস্থল সংকীর্ণ ও শুষ্ক, কেবল য়্যাব‍্ডোমেন প্রকাণ্ড এবং বিস্তৃত। য়্যাবডোমেন গহ্বর মধ্যে মস্তু যতই জমিতে থাকে ততই যন্ত্রণা বৃদ্ধি হয়। রোগী শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতে পারে না কারণ শয়ন করিলে নিঃসৃত সীরম ডায়াফ্রাম মাংসপেশীর উপর চাপিয়া ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কার্য্যের বিঘ্নতা উৎপাদন করত শ্বাস যন্ত্রণা আনয়ন করে। এই জন্য রোগী দিবারাত্রি তাকিয়া নির্ভর করিয়া অতিবাহিত করে। রাত্রে নিদ্রার পরিবর্ত্তে যন্ত্রণা ও কুস্বপ্ন উপস্থিত হয়। পাকস্থলীর আয়তন সংকীর্ণ হইয়া আইসে, এজন্য রোগীর বোধ হয় যেন পাকস্থলী সর্ব্বদা পরিপূর্ণ, যদি কিছু ভক্ষণ করে তাহা হইলে হাঁপ বৃদ্ধি হয়, এজন্য ক্ষুধা সত্বেও ভয় প্রযুক্ত ভক্ষণ করিতে চাহে না। শ্বাসকার্য্য (respiration) সম্পূর্ণরূপে সম্পাদিত হইতে না পাওযাতে রক্ত যথাবশ্যক অম্লজানবায়ু (oxygen) গ্রহণ করিতে পায় না, ইহার জন্য উহা দূষিত হইতে থাকে। এই জন্য এবং নিরশন বশতঃ ক্রমে ক্রমে প্রাণ বিনষ্ট হয়। পুনঃ পুনঃ জ্বর দ্বারা যাহাদের রক্ত দূষিত ও স্বাস্থ্যাপকৃষ্ট হইয়াছে তাহাদের অদৃষ্টেই সাধারণতঃ ড্রপ্সী ঘটিয়া থাকে। সাধারণ ড্রপ্সী ঘটিবার জন্য যে প্লীহার অথবা যকৃতের অত্যন্ত বিবৃদ্ধতা আবশ্যক তাহা নহে, সামান্য বিবৃদ্ধতার সঙ্গে২ ও ইহা উৎপন্ন হইয়া থাকে। ইহাতে য়্যাবডোমেন গহ্বর অত্যন্ত স্ফীত হয় না, কিন্তু অধস্তাচ কৌষিক ঝিল্লী সমস্তে মস্তু সাধারণতঃ নিসৃত হইয়া থাকে। রক্তের জলীয়াংশ ও শ্বেতকণার অংশ বৃদ্ধি হয়। লোহিত কণার সংখ্যা কমিয়া যায়। সাধারণ ড্রপ্সীর সহিত কখন ২ উদরাময় উপস্থিত হয়।

 উল্লিখিত হইয়াছে যে জ্বরের কম্পাবস্থায় ত্বক্ ও উপরস্থ স্থান (superficial structures) সমূহের রক্ত আভ্যন্তরিক যন্ত্রাদিতে গমন করে। যখন কোন কারণ বশতঃ যকৃত ও প্লীহা এই প্রেরিত শোণিত ধারণ করিতে অশক্ত হয়, তখন উহা অন্ত্রেতে (Intestine) গিয়া অজীর্ণ ও উদরাময় এবং কখন কখন রক্তামাশয় (Dysentery) উৎপাদন করে। ম্যালেরিয়া সম্বন্ধীয় পীড়াতে প্লীহা এক প্রকার মঙ্গলকর কার্য্য সাধন করে। যখন প্লীহা ও যকৃতের সাতিশয় বিবৃদ্ধতা হয়, শোথ ও উদরাময় অতি ভয়াবহ।

 যকৃত এবং প্লীহার বিবৃদ্ধতা প্রযুক্ত যাহাদের স্বাস্থ্য ও জীবনীশক্তির অত্যন্ত অবসাদ জন্মায় তাহারাই মুখরোগ (cancrumoris) প্রবণ। এইটি অতি ভয়ানক ব্যাধি শরীরের মধ্যে যে সমস্ত স্থানে রক্ত গণ্ডাপেক্ষা অল্প সে স্থান না পচিয়া কেন যে ঐ স্থানই পচে (mortify) তাহা বলিতে পারি না। যে স্থানে রক্তাভাব সেই স্থান বরঞ্চ পচিতে পারে, কিন্তু যেখানে রক্ত শিরা প্রচুর পরিমাণে বিন্যস্ত সেস্থান পচিতে দেখা যায় না। ক্যাংক্রম ওরিসের কারণ এই সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত। মুখরোগ কাহারও২ এত শীঘ্র প্রবলরূগপ বিস্তৃত হয় যে, দুই কিম্বা তিন দিবসের মধ্যেই সমস্ত গণ্ড পচিয়া যায়। সাধারণতঃ এই রোগ ক্রনিক অর্থাৎ প্রাচীন, অল্পে অল্পে আরম্ভ হয় এবং কিছু দিন স্থায়ী হইয়া প্রাণ বিনষ্ট করে। জ্বর, প্লীহা এবং যকৃতের পীড়ার দ্বারা রক্ত তরল ও দূষিত হইয়া কখন কখন স্রাবস্বভাব (Hemorrhagic diathesis) প্রাপ্ত হয়। এই জন্য নাসিকা কর্ণ, মূত্রাশয় ও দন্তমাড়ি হইতে রক্তস্রাব সর্ব্বদা ঘটিয়া থাকে। পাকাশয় এবং অন্ত্র হইতে রক্তস্রাব কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়। রজোনিঃসরণ কখন কখন অসময়ে আনয়ন করে।

 উপর্য্যুক্ত ভিন্ন ম্যালেরিয়া দ্বারা আরও কতকগুলি পীড়া উৎপন্ন হয়। ম্যালেরিয়া ক্রান্ত দেশ সমূহে কখন কখন মৃগী রোগ পর্য্যায় ভাব ধারণ করে, তজ্জন্য ম্যালেরিয়াই এই পীড়ার একটি কারণ বলিয়া অনেকে বিশ্বাস করেন। আমি একটি মৃগী রোগগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঐ রোগের নানাবিধ ঔষধি সেবন করাইয়া আরোগ্য করিতে পারি নাই, যতই ঔষধি সেবন করান হইত পীড়া ততই বৃদ্ধি হইত, এমন কি ক্রমশঃ এরূপ হইয়াছিল যে, দিবারাত্রের মধ্যে কোন কোন দিন ১০ হইতে ২৬ বার পর্যন্ত মূর্চ্ছা হইত। কুইনাইন্ ব্যবহার করাতে রোগী এই রোগ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়াছে। যে দিবস হইতে কুইনাইন সেবন করিতে দিলাম সেই দিবস হইতে পীড়া উপশম হইতে লাগিল। প্রায় এক বৎসর হইল ঐ পীড়া এক দিবসের জন্য ও আর উপস্থিত হয় নাই।

 স্নায়ুশূল (neuralgia), শিরঃশূল, এক প্রকার গোদ ও কুরন্দ যাহা পর্য্যায়-নিয়ম বশীভূত হইয়া প্রকাশিত হয়, ম্যালেরিয়া হইতে তাহা উৎপন্ন, এবং কুইনাইন্ প্রয়োগে আরোগ্য হয়।


  1. ইহা কাবিরাজিক টোট্‌কা। দ্বৌকালীন জ্বরে অনেক স্থলে বিশেষ উপকার দর্শায়।