ম্যালেরিয়া/রেমিটেণ্ট অর্থাৎ সল্প বিরাম জ্বর

রেমিটেণ্ট অর্থাৎ সল্প বিরাম জ্বর।

 দেশ কাল ও বায়ু ভেদে পীড়ার অবস্থার পরিবর্ত্তন হয়। ২৫ বৎসর পূর্ব্বে যে রূপ জ্বরের চিকিৎসা আমাদের দেশে সচরাচর প্রচলিত ছিল সে রূপ এখন পর্য্যন্ত থাকিলে বঙ্গ দেশ এত দিন জন শূন্য হইয়া পড়িত। ইউরোপীয় চিকিৎসা তখন এখানে সাধারণতঃ প্রচলিত ছিল না, কেবল অস্ত্র চিকিৎসার জন্য ডাক্তার কখন কখন আহূত হইতেন। সামান্য কবিরাজ প্রায় সকল পল্লীতেই পাওয়া যাইত। তাঁহাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় উপবাস ও সামান্য পাঁচনাদি দ্বারা ৮। ১০ দিবস অতিবাহিত হইত। যদি মস্তিষ্কে রক্তাবরোধ (congestion) হওয়া প্রযুক্ত প্রলাপ লক্ষণ উপস্থিত হইত খোলাপোড়া এবং মস্তকে উত্তপ্ত বালুকা সেক দ্বারা কবিরাজেরা তাহা নিবারণ করিতে চেষ্টা করিতেন। বস্তুত সবল থাকা প্রযুক্ত রোগী প্রদাহনাশক (antiphlogestic) চিকিৎসা সহ্য করতে সমর্থ হইত। কিন্তু এক্ষণে সকলেই বলহীন হইয়া পড়িয়াছেন, সুতরাং সামান্য জ্বরেও শরীর অবসন্ন হইয়া পড়ে। বিশেষতঃ দেশ কাল ভেদে পীড়ার স্বভাব যে পরিবর্ত্তন হয় এই নিয়মটী জগৎব্যাপী। চিরকাল নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য সমভাবে সম্ভোগ কোন দেশের পক্ষে ঘটে না। এলিসন, কৃষ্টীসন, ওয়াটসন, ষ্টোক্স প্রভৃতি বিজ্ঞ অধ্যাপকগণ এই মত প্রতিপন্ন করেন। অধ্যাপক অটেনরিথ্ লিখিয়াছেন যে “সকল প্রকার পীড়া, তরুণই (acute) হউক বা পুরাতন (chronic) স্পর্শক্রামকই (contagious) হউক অথবা অস্পর্শাক্রামক, কিছুকাল তাহাদের স্বভাবকে সমভাবে ক্রমাগত রক্ষা করে, কিন্তু আবার কিছু দিন পরে পরিবর্ত্তিত হইয়া ভিন্ন স্বভাবাপন্ন হয়।” ডাক্তার ওয়াটসন এক স্থলে লিখিয়াছেন “আমার নিজের দর্শন ও চিকিৎসা শাস্ত্র ইতিবৃত্ত পাঠ দ্বারা জানিতে পারিয়াছি যে সময় রূপ তরঙ্গের সহিত পীড়ার বলিষ্ঠ (sthenic-স্থেনিক) ও বলাভাবাপন্ন (asthenic-য়্যাসস্থেনিক) অবস্থা পর পর প্রবাহিত হইতেছে এবং আমরা এক্ষণে বলভাবাপন্ন অবস্থা মধ্যে বাস করিতেছি”।

 পীড়ার স্বভাব পরিবর্ত্তন হওয়া প্রযুক্ত এক্ষণে পীড়া মাত্রেই প্রায় বলাভাবাপন্নতা (asthenicity) প্রাপ্ত হইয়াছে। এই জন্যই প্রদাহ নাশক চিকিৎসায় যথা রক্ত মোক্ষণ, জোঁক প্রভৃতিতে পূর্ব্বে যেমন উপকার দর্শিত এক্ষণে ততোধিক অপকার আনয়ন করে। এই জন্যই এক্ষণে বলকারক ও উত্তেজক ওষধি এবং বলকারক পথ্য প্রায় প্রথম হইতেই রোগীর আবশ্যক হয়। পরাধীনতা ম্যালেরিয়া এবং মধ্যে মধ্যে দুর্ভিক্ষ ইহার মূলে অবস্থিতি করিতেছে। বলাভাবাপন্নতা (asthenia) আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে দুই প্রকারে বিরোধী, প্রথমতঃ ইহা স্বাস্থ্য নাশের পূর্ব্ববর্ত্তি প্রবণকর বা উন্মুখকর কারণ; দ্বিতীয়তঃ পীড়া আক্রমণ করিলে ইহা পীড়াকে বাধা দিতে অর্থাৎ পীড়া ভার অল্প দিনের জন্যও সহ্য করিতে অশক্ত। রেমিটেণ্ট জ্বর চিকিৎসা সম্বন্ধে এ সমস্ত বিষয় আমাদের স্থারণ রাখা উচিত।

 সল্পবিরাম জ্বর কখন কখন মৃদুরূপে প্রকাশিত হইয়া সামান্য চিকিৎসা দ্বারাই আরোগ্য হয়! কখন কখন এত কঠিন হয় যে বিশেষ যত্ন ও সাবধান পূর্ব্বক চিকিৎসা করিলেও কিছু মাত্র উপশম হয় না। এই জন্য ইহার একটি বিশেষ চিকিৎসা প্রণালী নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেওয়া অসম্ভব। প্রত্যেক রোগের অবস্থানুযায়িক চিকিৎসা বর্ণনা করাও দুরূহ ও অসম্ভব। এস্থলে কেবল সাধারণ প্রণালী দর্শিত হইতেছে। সবিরাম জ্বরে যেমন জ্বর ক্ষণ কাল থাকিয়া আপনাপনিই ছাড়িয়া যায় ইহাতে তাহা হয় না। ইহার বিরাম কাল অতিসামান্য এবং তাহা ও আবার উত্তমরূপ লক্ষিত হয় না। অধিক কাল জ্বর থাকার জন্য মস্তিষ্ক কার্য্যবিকারগ্রস্ত হয়। যাহাতে জ্বর কালের সল্পতা এবং মগ্ন(remission) কাল দীর্ঘ হয় প্রথমতঃ তাহারই চেষ্টা পাওয়া উচিত। যদি ভোজনের অব্যবহিত পরেই পীড়ারম্ভ হইয়া থাকে তাহা হইলে ঈষদুষ্ণ জলের সহিত কিঞ্চিৎ লবণ মিশ্রিত করিয়া রোগীকে পান করাইলে বমন দ্বারা পাকস্থলী শূন্য করা এবং পিপাসা ও বমনোদ্রেক নিবারণ জন্য মধ্যে মধ্যে শীতল বা বরফের জল সোডাওয়াটার ও লেমনেড পান করিতে দেওয়া আবশ্যক। সোডাওয়াটারের অভাবে কারবণেট অফ সোডা সহিত পাতি লেবুর রস মিশ্রিত করিয়া এফারভেসিং ড্রাফট্[১] প্রস্তুত করত সেবন করিতে দিলে রোগীর পক্ষে আরও প্রীতিকর হয় কারণ লেবুর সুগন্ধ স্পৃহণীয়। এই রোগের প্রথমাবস্থাতেই বিরেচক দ্বারা অন্ত্র পরিষ্কার রাখা নিতান্ত আবশ্যক, কারণ পীড়া বৃদ্ধি হইয়া রোগী অবসন্ন হইয়া পড়িলে আর বিরেচনের সময় থাকে না এবং মল আবদ্ধ হইয়া মস্তিষ্কের ও যকৃতের রক্তাবরোধ উৎপাদন করে। যদি প্লীহার কোন পীড়া না থাকে এবং রোগী সবল হয় তাহা হইলে নিম্ন লিখিত মত বিরেচক সেবনে মল পরিষ্কার রূপে নির্গত হয়—

পল্‌ভ স্কেমনিয়াই ১০ গ্রেন্
ক্যালমেল্ ১০ গ্রেন্
পল্‌ভ রিয়াই ২০ গ্রেন্

 একত্রে মিশ্রিত করিয়া ইহাতে ৫টী মোড়া করিবে যতক্ষণ বিরেচন কার্য্য সুসিদ্ধ না হয় ইহার এক একটী মোড়া তিন ঘণ্টাত্তর সেবন করাইতে হইবে।

 যদি যকৃতের স্থানে বেদনা থাকে তাহা হইলে সল্‌ফেট অফ ম্যাগ্‌নেসিয়া ৪ ড্রাম, সল্‌ফেট্ অফ সোডা ২ ড্রাম, ডিকক্‌সন ট্যারেকসেকম্ ৩ আউন্স একত্রে মিশ্রিত করিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমাণ ২ ঘণ্টান্তর সেবন দ্বারা মল নির্গত হইলে—

লাইকর এমনি এসিটেটীস্ ১ আউন্স
পটাস নাইট্যাট্ ১ ড্রাম্
স্পিরিট ইথার নাইট্রসাই ৩০-৬০ বিন্দু
পরিষ্কৃত জল ৫ আউন্স

 একত্র মিশ্রিত করিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমাণ তিন ঘণ্টান্তর সেব্য। দাহ ও যন্ত্রণা অধিক বোধ হইলে ইহার সহিত টিংচার অফ হায়েসায়েমস্ আবশ্যকমত উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করা যাইতে পায়ে। রোগী দুর্ব্বল ও জ্বরের কোপ সামান্য হইলে এন্‌টিমনি ব্যবহার করিবার আবশ্যক নাই। এই রূপ চিকিৎসায় জ্বরকাল সংকীর্ণ ও মগ্ন কাল কিছু অধিক ক্ষণ স্থায়ী হইলে কুইনাইন্‌ ৮/১০ গ্রেন্ এক মাত্রায় সেবন করাইতে হইবে। যদি তিন ঘণ্টার পর জ্বর প্রত্যাগত না হয় আরও ৫ গ্রেণ এক মাত্রায় দিবে। জ্বর পুনরাগত হইলে পূর্ব্বোক্ত লাইকর এমন এসিটেটীস্ মিক্‌সচর উল্লিখিত মতে মধ্যে মধ্যে সেবন করাইতে হইবে। জ্বর মগ্ন কালে পুনরায় কুইনাইন্ ৫ গ্রেন্ মাত্রায় দুই কিম্বা তিন বার সেবন করাইতে হইবে। এই রূপ চিকিৎসায় জ্বর নিবারিত হইলে অন্ততঃ এক সপ্তাহ কাল নিম্নমত ওষধি ব্যবহার করাইতে হইবে।

কুইনি সল্‌ফ ৫ গ্রেন্
এসীড নাইট্রীক্ ডাং ২০ মিনিষ্
টিং সিনকোনা কোং ১॥ ড্রাম্
ডিকক্‌টম্ সিনকোনি ৩ আউন্স
লাইকর ষ্ট্রীকনিয়া ৫ মিনিম্

একত্র মিশ্রিত করিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমাণে দিবসে তিন বার সেব্য।

 কঠিন সল্প বিরাম জ্বর এরূপ সহজ উপায়ে আরোগ্য হয় না। নানাবিধ উৎকট উপসর্গ উপস্থিত হইয়া অতি ভয়ানক হইয়। উঠে। যকৃতের রক্তাবরোধ অথবা প্রদাহ হইয়া জ্বরের মগ্ন কাল বিলুপ্ত করিয়া ফেলে এবং দিন দিন রোগীর বল ক্ষয় হইতে থাকে। এ অবস্থায় যকৃতের উপর ব্লিষ্টার প্রয়োগ, পিত্ত নিঃসারক এবং নিম্ন ব্যবস্থামত ওষধিতে উপকার দর্শে।

লাইকর এমন্ এসিটেটীস্ ১ অউন্স
এমোনি মিউরিয়াট্ ৩০ গ্রেন্
টিং হায়েসায়েমাই ১॥৹ ড্রাম্
জল ৫ আউন্স

 অর্দ্ধ ছটাক তিন ঘণ্টা অন্তর।

 কখন ২ এই জ্বরের প্রারম্ভে অথবা দুই চারি দিবস পরে উদরাময় উপস্থিত হইয়া রোগীকে শীঘ্র অবসন্ন করে, এমন কি তিন চারি দিবসের মধ্যেই জীবনীশক্তির এত হ্রাসতা জন্মায় যে রোগী পার্শ্ব পরিবর্ত্তন করিতে স্বয়ং অপারক হয়। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলীর নিস্তেজতা বশতঃ বাক্‌শক্তি, শ্রবণশক্তি ও জ্ঞানের ব্যতিক্রম ঘটে। রোগী চক্ষুরুন্মীলন কি চক্ষু মুদ্রিত বা অর্দ্ধ মুদ্রিত করিয়া থাকে, কোন প্রশ্ন করিলে যদিও শুনিতে পায় কিন্তু উত্তর প্রদানে অশক্ত অথবা অনিচ্ছুক। কখন কখন স্বরের এরূপ জড়তা জন্মে যে রোগীর কথা কিছুই বুঝিতে পারা যায় না। এই রূপ অবস্থা হইতে কোমা (মস্তিষ্কের অবসাদ) উপস্থিত হয়। এরূপ রোগীর পক্ষে প্রথম হইতেই উত্তেজক ওষধি এবং মাংসের ঝোল, দুগ্ধ প্রভৃতি বলকারক পথ্য আবশ্যক। এমোনিয়া, সলফিউরিক্ ইথার, মৃগনাভী ব্রাণডী প্রথম হইতেই আবশ্যক মত মাত্রায় ব্যবহার না করিলে রোগীকে রক্ষা করিতে পারা যায় না। প্রথম প্রথম ডিকক্‌সন্ সিনকোনার সহিত স্পিরিট্ এমনি য়্যারোম্যাট্ এবং লাইকর এমনি এসিটেটীস্ প্রয়োগ করিবে, তাহার পর ধমনীর ও সাধারণ লক্ষণের আবশ্যকানুসারে উত্তেজক ওষধি বিবেচনা পূর্ব্বক দিতে হইবেক। উদরাময় নিবারণ করিবার জন্য খটিকা মিশ্র (chalk mixture) টিংচার ক্যাটিকিউ ও টিংচার কাইনো সহকারে অথবা গ্যালিক এসীডের সহিত প্রয়োগ করিতে হইবে এবং মাংসের ঝোল ও ব্রাণ্ডী দ্বারা রোগীর বল রক্ষা করিতে চেষ্টা করিবে।

 ফুসফুস প্রদাহ, বায়ুনলীভূজপ্রদাহ অথবা উভয়ই অনেক সময়ে এই জ্বরের আনুসঙ্গিক হয়। প্রত্যেক অবস্থার চিকিৎসা স্বতন্ত্র, কিন্তু সকল অবস্থাতেই রোগীর বল রক্ষা করিয়া চিকিৎসা করিতে হইবে। এজন্য বলকারক পথ্য এবং পোর্ট অথবা ব্রাণ্ডী আবশ্যকমত সর্ব্বদা দিতে হইবে। এই সকল উপসর্গের প্রথম অবস্থায়।

লাইকর এমনি এসিটেটীস ১ আউন্স্
স্পিরিট ক্লোরফর্ম ৩ ড্রাম্
এমনি: কারবন: ২০ গ্রেন্
ভাইনম্ কলচিসাই ২০ মিনিম্
অ্যাকুয়া মিউসিলেগো ৭ আউন্স্


একত্রে মিশাইবে। অর্দ্ধ ছটাক ৪ ঘণ্টান্তর সেবন করাইলে বিশেষ উপকার দর্শে। বক্ষঃস্থল সর্ব্বদা ফোমেণ্ট করিবে এবং মধ্যে মধ্যে বক্ষের উপর তিশির পুলটিশ দিবে।

 ফুসফুস মথ্যে শ্লেষ্মা সঞ্চিত না হইলে শ্লেষ্মা নিঃসারক ওষধি ব্যবহার করিবার আবশ্যক নাই। ফুসফুস প্রদাহে এইটী বিশেষ স্মরণ রাখা উচিত, কারণ বক্ষঃ মধ্যে অল্প শ্লেষ্মা সঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে বলিয়া তাহা নিঃসারণ করিবার জন্য শ্লেষ্মা নিঃসারক প্রয়োগ করিলে কাশ বৃদ্ধি হইয়া ফুসফুস প্রদাহ অধিক ব্যাপ্ত করে। উল্লিখিত মিক‍্স‍্চরের সহিত কারবনেট অফ্ এমোনিয়া থাকাতেই সঞ্চিত শ্লেষ্মা দ্রবীভূত অর্থাৎ তরল হইয়া বহির্গত হয় অথচ কাশ অধিক বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু অধিক শ্লেষ্মা ফুসফুস মধ্যে সঞ্চিত এবং তজ্জন্য রোগীর ক্লেশানুভব হইতে থাকিলে উত্তেজক শ্লেষ্মা নিঃসারক যথা স্কুইল্, কারবনেট অফ্ এমোনিয়া, সেনেগা প্রভৃতি ঔষধ আবশ্যক হয়। এস্থলে উরঃকোষ্টীর পীড়া সমূহের চিকিৎসা বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নহে কেবল নিতান্ত আবশ্যকীয় দুই একটী বিষয়ের সঙ্কেত মাত্র করিলাম। কিন্তু এই সকল উপসর্গের (Complications) জন্য চিকিৎসা করিতে হইলে পূর্ব্বেই ফুসফুস সম্বন্ধীয় পীড়া সকলের চিকিৎসার বিষয় চিকিৎসকের পরিজ্ঞাত হওয়া উচিত।

 মস্তিষ্কে রক্তবিরোধ সল্প বিরাম জ্বরের আর একটী ভয়ানক উপসর্গ। ইহাতে রোগী জ্ঞানশূন্য হয় এবং প্রলাপ বা অর্থশূন্য বাক্য কহিতে থাকে। প্রলাপ দ্বিবিধ, প্রথম রোগী সবল থাকিলে উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করে অর্থাৎ বল প্রকাশ, চীৎকার এবং নিবারণ করিলেও শয্যা হইতে উথিত হইতে চেষ্টা করে। চক্ষুঃ দ্বয় আরক্তিম এবং কপালের শীরা সকল স্ফীত হয়। এ প্রকার প্রলাপ যদিও দেখিতে ভয়ানক বটে কিন্তু চিকিৎসার দ্বারা প্রায়ই আরোগ্য হয়। শীতল জল অথবা বরফ মস্তকে নিয়ত দেওয়া, যদি মলবদ্ধ থাকে মৃদু বিরেচক ওষধি বা পিচকারি দ্বারা মল নিঃসরণ করা এবং ঘাড়ে বিষ্টার ও পদ এবং হস্তদ্বয়ে উত্তাপ দেওয়া দ্বারা লক্ষণ সকল উপশমিত হইতে পারে। নাড়ীর (radial pulse) অবস্থানুসারে য়্যারমেটিক স্পিরিট অফ্ য়্যামোনিয়া, সলফিউরিক ইথার, মস্ক, ব্রাণ্ডী প্রভৃতি উত্তেজক ওষধি সকল প্রয়োগ করিতে হইবেক। প্লীহার বিশেষ কোন পীড়া না থাকিলে বিরেচনার জন্য, ক্যালমেল্, ষ্কমেনি এবং রূবার্ব একত্রিত করিয়া দিলে বদ্ধ মল নির্গত হইয়া মাস্তিষ্কীয় রক্তাবরোধের প্রবলতা হাস করে। যদি রোগীর বল থাকে বিরেচক সেবন করানই ভাল কারণ তদ্দ্বরা ক্ষুদ্র অন্ত্রের মল পর্যন্ত বহিস্কৃত হয় কিন্তু যদি রোগী অত্যন্ত দুর্বল হয় এবং বিরেচক ওষধি সেবনে আশঙ্কা থাকে অথচ মল নির্গত করান আবশ্যক বোধ হয় ক্যাষ্টার অয়েল, অয়েল অফ্ টারপেন টাইন্ এবং টিঞ্চার অফ্ য়্যাসাফিটিডা মিশ্রিত করিয়া উষ্ণ জলের সহিত পিচকারি প্রয়োগ করাই বিধেয়। পিচকারির দ্বারা কেবল বৃহদন্ত্রের মল বহিষ্কৃত হয়। ব্রোম হিড্রিক্ এসিড এই প্রকার প্রলাপের পক্ষে বিশেষ ফলোপধায়ী। ৫ গ্রেন্ মাত্রায় ব্রোমাইড অফ পটাসিয়ম এক বিন্দু টিঞ্চার অফ বেলেডনার সহিত অর্দ্ধছটাক পরিষ্কৃত জলের সহযোগে তিন ঘণ্টান্তর সেবন করাইলে ও মস্তিষ্কে রক্তাবরোধ জনিত প্রলাপের সমতা সম্পাদন করে।

 দ্বিতীয় প্রকার প্রলাপ বলহীনতা প্রকাশক। ইহাতে রোগীর দৌরাত্ম্য থাকে না কিন্তু নিশ্চেষ্ট ভাবে অস্ফুট ও অতিমৃদু স্বরে অর্থশূন্য ও অসংলগ্ন কথা কহিতে থাকে। রোগীর হস্ত কম্পন হইতে থাকে এবং জ্ঞান কিছু মাত্র থাকে কি না সন্দেহ। শয্যাবস্ত্র আকর্ষণ করা এবং চক্ষুঃ অর্দ্ধ নিমীলিত ও জ্যোতি বিহীন হওয়া এই অবস্থার লক্ষণ। পূর্ব্ব প্রকার প্রলাপ অবস্থাতে রোগী যে রূপ শয্যা হইতে উথিত হইতে চেষ্টা করে ইহাতে সে রূপ করে না। এই দ্বিতীয় প্রকার প্রলাপ অত্যন্ত অনিষ্টকর এবং ইহাতে চিকিৎসকের বিশেষ মনোেযোগী হওয়া আবশ্যক। ঘাড়ে বিষ্টার এৱং হস্ত পদে মসটার্ড্ প্রয়োগ ও যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজক ওষধি সেবন এস্থলে নিতান্ত আবশ্যক। রোগীর বল রক্ষা করাই এ অবস্থার। প্রধান চিকিৎসা, এজন্য মাংসের ঝোল এবং ব্রাণ্ডী বিশেষ উপযোগী।

 পূর্ব্বোক্ত প্রকার চিকিৎসার দ্বারা রোগীর চৈতন্য হইলেই কুইনাইন্ দিতে হইবেক। কুইনাইন্ দিতে বিলম্ব করিলে হয়ত জ্বর আসিয়া আবার প্রলাপ উপস্থিত হইবে এবং কুইনাইন্ দিবার আর সময় পাওয়া যাইবে না। এই জ্বর মগ্নই হয়ত পৃথিবীতে রোগীর শেষ দিন আনয়ন করিবে। কিছু দিবস গত হইল মেড়িয়া নিবাসী কোন ব্রাহ্মণের সল্প বিরাম জ্বর জনিত মস্তিষ্কে রক্তবরোধ হইয়া প্রলাপ উপস্থিত হয়। তাঁহার আত্মীয়েরা ভীত হইয়া পীড়ার পঞ্চম দিবসে সন্ধ্যার সময় আমাকে আহ্বান করেন। রাত্রে ওষধি সেবনে, পর দিন প্রাতে জ্বর মগ্ন হইয়া জ্ঞানোদয় হয়। রোগী এ দিবস পরিবারদের সহিত সংসারের ও আহারের নানাবিধ কথা কহিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন যে দুর্ব্বলতা ভিন্ন তাঁহার আর কোন পাড়া নাই। তাঁহার আত্মীয়েরা রোগী আরোগ্য হইয়াছে মনে করিয়া আমাকে আর সে দিবস কোন সংবাদ দেন নাই এবং কোন ওষধিও ব্যবহার করান নাই। রাত্রে জ্বর প্রত্যাগত হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রলাপ উপস্থিত হইল এবং পীড়ার অষ্টম দিবসে রোগীর মৃত্যু হয়। যদি জ্বর মগ্নে ষষ্ঠ দিবসে কুইনাইন্ দেওয়া হইত, বোধ হয় জ্বর আর প্রত্যাগত হইতে পারিত না এবং সম্ভবতঃ রোগী রক্ষা পাইতেন। এরূপ ঘটনা আরও তিন চারিটি আমার স্মরণ হইতেছে। অতএব প্রলাপ অবস্থার পর চৈতন্যোদয় হইলেই কাল বিলম্ব না করিয়া কুইনাইন্ সেবন করা উচিত। একেবারে ৮ কিম্বা ১০ গ্রেন্ জল মিশ্র নাইট্রমিটরিয়াটিক্ এসিড, বা অন্য দ্রাবক দ্বারা দ্রবীভূত করিয়া এক মাত্রায় সেবন করাইতে হইবেক। যদি ২। ৩ ঘণ্টার মধ্যে জ্বর পুনঃ প্রকাশ না হয়, ৪ গ্রেন্ কিম্বা ৫ গ্রেন্ আর এক মাত্রা ঐ রূপ করিয়া দিতে হইবেক। উত্তেজক ওষধিও মধ্যে মধ্যে আবশ্যকমত দেওয়া উচিত। এই প্রকারে কুইনাইন্ সেবন করাইলে সে দিবস অল্প জ্বর হইতে পারে কিন্তু এই জ্বর মগ্নে পুনরায় দুইবারে ১২ গ্রেন কুইনাইন্ দিলে আর জ্বর হইবে না। যত দিন রোগী উত্তমরূপ আরোগ্য না। হয়, অল্প মাত্রায় কুইনাইন্, সিনকোনা পোর্ট এবং বলকারক পথ্য ব্যবহার করাইতে হইবেক।

 সল্প বিরাম জ্বরে অতিরিক্ত ওষধি সেবন সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিতেছি, আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া উচিত। রোগীকে অত্যন্ত দুর্ব্বল ও অবসন্ন দেখিলে আমরা ভীত হইয়া উত্তেজক ওষধি সমস্ত অধিক মাত্রায় শীঘ্র শীঘ্র প্রয়োগ করিয়া থাকি। রোগী চৈতন্য শূন্য, উহার ধমনী নিতান্ত নিস্তেজ এবং ইন্দ্রিয় সকল অবশ প্রায় দেখিয়াই বা কোন্ চিকিৎসক উত্তেজক ওষধি ব্যবহার করিতে নিবৃত্ত হইতে পারেন। তিন ঘণ্টা অন্তর উত্তেজক সেবনে ধমনীর পুষ্টী ও বল হইল না দেখিয়া আমরা উহা দুই ঘণ্টা অন্তর ব্যবহার করিলাম। ইহাতেও বাঞ্ছনীয় উত্তেজনা সাধিত হইল না, এক ঘণ্টা অন্তর য়্যামোনিয়া, স্পিরিট্ অফ ইথর ব্রাণ্ডী প্রভৃতি উত্তেজক ওষধি পূর্ণ মাত্রায় প্রযোজ্য হইল। এই রূপে অর্ধ ঘণ্টা, হয়ত ১০ মিনিট অন্তর প্রয়োগ করিতে লাগিলাম। ইহাতে দেখিলাম কিছু ফল দর্শিল না, কি করি, যত পারিলাম ওষধিতে পাকস্থলি পূর্ণ করিতে লাগিলাম। যদি এরূপ করিয়াও রোগীর মৃত্যু হয় বুঝিলাম ও সকলকে বুঝাইলাম যে পরমায়ু ছিল না। আমাদের ও রোগীর আত্মীয়দিগের আশা ও ভাবনা নিবৃত্ত ছুইল।

 আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি যে এক্ষণকার রোগীদিগের বলাভাবাপন্নতা বশতঃ প্রথম হইতেই বলকারক ও উত্তেজক ঔষধির আবশ্যক। কিন্তু সেই জন্যই যে, সকল রোগীর পক্ষে ইহা বিধি, এরূপ স্থির করা উচিত নহে। প্রত্যেক ব্যক্তির ধাতু, বল, এবং শরীরের ও পীড়ার অবস্থানুসারে উত্তেজক ঔষধির মাত্রা ও আবশ্যকতা বিবেচনা পূর্ব্বক স্থির করিতে হইবে। ক্রমাগত অধিক মাত্রায় উত্তেজক ঔষধি সেবনে শরীর অবসন্ন, রক্ত বিষাক্ত ও মৃত্যু নিকটাগত হয়। অতএব উত্তেজক প্রয়োগ সম্বন্ধে দুইটি প্রশ্ন উত্থিত হইতেছে। প্রথম, সল্প বিরাম জ্বরের বিকারাবস্থায় কতক্ষণ পর্যন্ত উত্তেজক ব্যবহার্য্য, দ্বিতীয়, কখনই বা উহা হইতে নিবৃত্ত হওয়া উচিত। এই প্রশ্নদ্বয় মিমাংসা করা অতি কঠিন। এই রোগের চিকিৎসায় বহুদর্শিতা লাভ ভিন্ন কথায় বুঝাইয়া দেওয়া অসম্ভব। তবে দুই একটি কথা না বলিয়াও নিবৃত্ত হইতে পারি না। যদি মল মূত্র, ঘর্ম্ম প্রভৃতি নিঃস্রাবাদি অতিরিক্ত পরিমাণে নিঃসৃত না হইয়া অকস্মৃাৎ অথবা এই সকল উপসর্গ দ্বারা হঠাৎ রোগী অবসন্ন হইয়া পড়ে এবং ধমনী নিতান্ত হীনবল বা অপ্রকাশিত হয়, প্রলাপ থাক্ বা না থাক্‌, অস্থায়ী উত্তেজক (Diffusible Stimulants) পূর্ণ মাত্রায় ঘন২ দেওয়া আবশ্যক। কিন্তু যদি পীড়া ক্রমশঃ বৃদ্ধি হইয়া অনেক উত্তেজক সেবনেও ধমনীর বল বৃদ্ধি না হইয়া ক্রমশঃ বিষম (Irregular) বা ক্ষণ বিলুপ্ত (Intermittent) হয় অথচ রোগীর ঔষধি সেবন করিবার ক্ষমতা থাকে এবং যদি অজ্ঞানতা ও প্রলাপ ৫।৬ দিবস স্থায়ী হয়, অনেক উত্তেজক ঔষধি সেবনে ও পীড়ার সমতা বোধ না হয়, রোগীর বাহ্য লক্ষণ সকল অত্যন্ত মন্দ হইয়াও সমভাবে থাকে অথবা উত্তেজক সেবন সত্তে ও রোগী কেবল মাত্র অল্প ২ করিয়া অবসন্ন হইতে থাকে এবং নাড়ী একে বারে বিলুপ্ত না হইয়! অত্যন্ত ক্ষীণ ভাবে ও প্রবাহিত হয় তাহা হইলে অস্থায়ী উত্তেজক ঔষধি সকল রোগীর শয্যাপার্শ্বে রক্ষা করিয়া চিকিৎসক, পোর্ট কিম্বা ব্রাণ্ডী ও মাংসের ক্কাথ কেবল রোগীকে খাওয়াইবে। ইহাতে যদি দুই কিম্বা তিন ঘণ্টা নাড়ীর অবস্থা সমভাবে থাকে উত্তেজক ঔষধি সেবন করাইতে আর ও অপেক্ষা করিতে হইবেক। আট ঘণ্টা যদি বিনা উতেজক ঔষধিতে রোগীর নাড়ীর কিছু মন্দাবস্থা না হয় এবং পীড়া সমভাবে থাকে, উত্তেজক ঔষধির কোন আবশ্যক নাই, কেবল পথ্যের ব্যবস্থায় রোগী আরোগ্য হইবেক। এরূপ অবস্থায় উত্তেজক ঔষধি সেবনে আরোগ্য হইবার সম্ভাবনা নাই এবং এই রূপ অবস্থায় হোমিও পাথিক চিকিৎসায় অথবা বিনা ঔষধিতে রাখা রোগীর জীবন রক্ষা করিবার একমাত্র উপায়। প্রমাণ জন্য কেবল এখানে আমি দুইটী রোগীর চিকিৎসা দর্শাইতেছি।

 ১ম।—রোগীনীর বয়ক্রম ১৩ বৎসর, নিবাস আক্‌না। সপর্য্যায় জ্বর (Intermittent fever) হইতে আরোগ্য হইবার জন্য বিস্মৃতি ক্রমে জ্বর মগ্নে ফিবার মিক্‌শ্চার এবং জ্বর কালে কুইনাইন্ মিক্‌শ্চার সেবন করা হয়। ইহাতে জ্বর আরোগ্য না হইয়া সল্পবিরাম রূপ (Remittent) ধারণ করে। রোগীনীর আত্মীয়েরা গরমে এই রূপ হইয়াছে স্থির করিয়া স্নান ও অন্নাহার করিতে দেন, তাহাতে জ্বর বৃদ্ধি হইয়া অত্যন্ত ভেদ ও কাশীর সঞ্চার হয় এই অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আমি আহুত হই। ক্লোরডাইন্ সেবনে ভেদ নিবারণ হইল। পর দিন প্রাতে দেখিলাম জ্বরের কিছুমাত্র হ্রাসতা হয়নাই এবং বায়ুনলীভূজ প্রদাহ বৃদ্ধি হইয়াছে এজন্য।

লাইকর এমন্ এসিটেট্ ১ আউন্স
স্পিরিট্ ক্লোরফর্ম্ ২ ড্রাম্
এমনি কার্ব্ব ১০ গ্রেন্
একুই মিউসিলেগো ৭ আউন্স

একত্রে মিশ্রীত করিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমান দিবসে চারিবার সেবন করিতে দেওয়া হইল এবং বক্ষঃ স্থল সর্ব্বদা ফোমেণ্ট করিতে পরামর্শ দেওয়া গেল। পথ্য দুগ্ধ সাগু। তিন দিবস এই মত চিকিৎসায় অতিবাহিত হইলেপর চতুর্থ দিবস প্রাতঃ কালে জ্বর মগ্ন হইল, কিন্তু দুই ঘণ্টা মগ্ন থাকিয়া জ্বর প্রত্যাগত হইল এবং পঞ্চম দিবসে জ্বর আর মগ্ন হইল না। রোগীণী অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িলেন। উক্ত মিক্‌শ্চারের কারবনেট, অফ এমনিয়া প্রতিমাত্রায় আরও তিন গ্রেন্ করিয়া দেওয়া হইল। ক্লোরডাইন্ সেবনাবধি আর রেচন হয় নাই। বায়ু নলীভূজ প্রদাহ এবং জ্বর বৃদ্ধি হইয়া প্রলাপ উপস্থিত হওয়ায় পিচ্‌কারির দ্বারা মল বহিষ্কৃত করা হইল। ঘাড়ে ব্লিষ্ঠার ও

এমনকার্ব্ব ২৪ গ্রেন্
স্পিরি: এমন: য়্যারম্যাট্ ১॥ ড্রাম্
ক্লোরিক ইথার ১ ড্রাম্
কর্পুরের জল ৬ আউন্স

একত্র মিশ্রিত কবিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমান তিন ঘণ্টা অন্তর সেবন করিতে দেওয়া হইল। পথ্য দুগ্ধ সাগু, মাংসের ক্বাথ এবং ব্রাণ্ডী। বক্ষেঃ এমোনিয়া লিনিমেণ্ট মালিষ, ফোমেণ্টেসন্ এবং গমের ভুষীর পুল্‌টীস। দশম দিবসে দেখিলাম রোগীণী সম্পূর্ণ জ্ঞান শূন্য হইয়াছেন। প্রস্রাব অজ্ঞাতসারে শয্যায় হইয়াছে, হস্ত কম্পন, ওষ্ঠে ও দন্তে কৃষ্ণবর্ণ সরডিজ অর্থাৎ ক্লেদ, শ্বাস ঘন ঘন এবং নাড়ী অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত। দুই ঘণ্টান্তর স্পিরিট্ এমন্ য়্যারম্যাট, ২০ মিনিম্ সলফিউরিক ইথার ১৫ মিনিম্, ব্রাণ্ডী ১ ড্রাম, অর্ধ ছটাক কর্পূরের জলের সহিত সেবন করিতে দেওয়া হইল। পরদিন অর্থাৎ একাদশ দিবসে রোগীণীর অবস্থা আরও মন্দ হওয়াতে ঐ মিক্‌শ্চার ১॥ ঘণ্টান্তর ব্যবহার করাণ হইল। ইহাতে ও কিছু মাত্র উপকার দর্শিল না। দ্বাদশ দিবসে রোগীণী মৃত প্রায়, নাড়ী বিষম (irregular) এবং মধ্যে মধ্যে ক্ষণ বিলুপ্ত (intermittent pulse)। ঘণ্টায় ৪ বার করিয়া ঐ ঔষধি অনেক কষ্টে রোগীণী গলাধঃকরণ করিতে লাগিলেন। উত্তেজক ঔষধি সেবনে কোন ফল দর্শিল না দেখিয়া উহা নিষেধ করিয়া কেবল মাংসের ক্কাথ এবং পোর্ট পান করাইতে বলিলাম। ইহাতে ও পীড়া সমভাবে রহিল। পরদিন নাড়ী সূত্রবৎ কিন্তু যথানুক্রম (regular) পূর্ব্বক প্রবাহিত হইতে লাগিল। ক্রমাগত উত্তেজক ঔষধি সেবনে যে ফল পাওয়া যায় নাই বিনা ঔষধিতে তাহা হইল। রোগীণীর অবস্থা ক্রমশঃ ভাল হইতে লাগিল কিন্তু তাঁহার আত্মীয়েরা বিনা ঔষধিতে তাহাকে রাখিতে ভীত হওয়ায় হোমিওপ্যাথিক আরসেনিক এক বিন্দুর চতুর্থাংশের একাংশ দিবসে দুইবার করিয়া সেবন করিতে দিলাম। তিন দিবস পরে রোগীণীর চৈতন্যোদয় হইল এবং ইহার ২২ দিবস পরে পীড়া সম্পূর্ণ আরগ্য হইল।

 দ্বিতীয়—রোগীণীর বয়ঃক্রম আন্দাজ ২০ বৎসর, নিবাস মালীপাড়া। সল্প বিরাম জ্বরের অষ্টম দিবসে আমি চিকিৎসার জন্য আহুত হই। যদি ও বৎসরের মধ্যে কখন২ সামান্য জ্বর হইত, কিন্তু তজ্জন্য রোগীণী স্বাস্থ্যহীণ হন নাই। দেহ পরিমিত স্থূল এবং আভ্যন্তরিক যন্ত্রের কোন পীড়া ছিল না। পীড়া অষ্টম দিবসে নিম্ন ঔষধ দেওয়া হইয়াছিল।

লাইকর এমন্ এসিটেটিস্ ১ আউন্স
পটাসি নাইট্রাট্ ২ ড্রাম্
স্পিরিট্ ইথার নাইট্রসাই ১॥৹ ড্রাম্
জল ৬ আউন্স

একত্রে মিশ্রিত কর। অর্দ্ধ ছটাক তিন ঘণ্টাত্তর সেবন করাইবে। উক্ত ঔষধ তিন দিবস সেবনান্তর জ্বর ত্যাগ হওয়ায় এবং অন্ত্র পরিষ্কার না থাকায় পীড়ার একাদশ দিবসে সলফেট্ অফ ম্যাগনেসিয়ার সহিত কুইনাইন্ দেওয়া হইল। ইহাতে যদিও বিরেচন কার্য্য সুন্দররূপ হইল বটে কিন্তু জ্বর নিবারিত হইল না, অধিক বলের সহিত প্রকাশিত হইল। এই সময় দেখা হইল যে যকৃতের রক্তাবরোধ উপস্থিত হইয়াছে এজন্য যকৃতের স্থানে ব্লিষ্টার ও উক্ত ফিবার মিক্‌শ্চরের সহিত মিউরিয়েট্ অফ এমোনিয়া ৫ গ্রেন্ প্রতি মাত্রায় সেবন করিতে দেওয়া হইল। ইহাতে পীড়ার কিছু মাত্র হ্রাস হইল না। পীড়ার পঞ্চদশ দিবস হইতে দুই দিবস কেবল লাইকর এমন্ এসিটেটিসের সহিত ডিকক‍্সন্ সিন্‌কোনা দেওয়া হইল। প্রলাপ উপস্থিত ও রোগীনীর নাড়ী অত্যন্ত বলহীন হওয়ায় উহার সহিত প্রতি মাত্রায় ১৫ মিনিম্ করিয়া এরমেটিক্ স্পিরিট্ অফ এমোনিয়া ও মস্তকে বরফের জল প্রয়োগ করা হইতে লাগিল। ইহাতে রোগীনী উত্তেজিত না হইয়া ক্রমশঃ অবসন্ন হইতে লাগিলেন এজন্য প্রতি মাত্রায় স্পিরিট্ এরোমেটিক্ ৩০ মিনিম্ ইথার সল‍্ফ ১০ মিনিম্ স্পিরিট ক্লোরফর্ম ২০ মিনিম্ কর্পূরের জল অর্দ্ধ ছটাকের সহিত তিন ঘণ্টান্তর এবং ব্রাণ্ডী ও মাংসের ক্কাথ আবশ্যক মত সেবিত হইতে লাগিল। অবসাদ বৃদ্ধি বোধ হওয়ায় ঐ উত্তেজক মিশ্র অবস্থানুসারে, দুই, এক, অর্দ্ধ এবং সিকি ঘণ্টান্তর দেওয়া হইতে লাগিল। শ্বাস, নাড়ীক্ষয়, গলার ঘড়ঘড়ানি প্রভৃতি আসন্ন মৃত্যু লক্ষণ সকল প্রকাশিত হইল। রোগীনীর আর ঔষধ কি জল পান করিবার সমর্থ রহিল না এবং বোধ হইল যে আর ৫ কিম্বা ৭ মিনিট মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হইবে। তাঁহার আত্মীয়েরা এতদবস্থায় তাঁহাকে বাটীর উঠানে বাহির করিলেন। রোগীনীর ভ্রাতার সহিত আমার সৌহার্দ্দ থাকায় তিনি অনুরোধ করিলেন যে তাঁহার ভগ্নীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত আমি তথায় অপেক্ষা করি। আমি নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক এই অনুরোধ রক্ষা করিতে বাধ্য হইলাম। রোগীনীকে বাহির করার পর এক ঘণ্টা আমি তথায় ছিলাম কিন্তু এ সময় মধ্যে কিছুই পরিবর্ত্তন দেখিলাম না কেবল সকলে ভাবিতে লাগিলাম মৃত্যুর আর বিলম্ব নাই। আমি আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া বলিয়া আসিলাম যে মস্তকে জল এবং যদি পারা যায় পূর্ব্বোক্ত উত্তেজক মিশ্র সেবন করাইবেন। যদি রোগীনী জীবিত থাকেন আমার নিকট সংবাদ পাঠাইবেন। তাঁহার অপর কোন আত্মীয় ঔষধ গলাধঃকরণ করাইতে অপারক হইয়া এবং আর জীবনাশ কিছু মাত্র নাই স্থির করিয়া গাড়ু ও ঘটী দ্বারায় রোগীনীর মস্তকে ক্রমাগত জল প্রক্ষেপ করিতে লাগিলেন প্রায় দুই ঘণ্টা এইরূপ হইয়াছিল এবং ইহাতে আপাদমস্তক সমস্ত শরীর জলে অভিষিক্ত হইয়াছিল। জল ঢালিতে২ রোগীনীর মধ্যে এক২ বার চিনির পানা গলাধঃকরণ হইয়াছিল। আমি সন্ধ্যার সময় দেখিলাম তিনি অতি কষ্টে জলীয় দ্রব্য পান করিতে পারিতেছেন এবং চৈতন্যশূন্য হইয়া আদ্র বস্ত্রে আবৃতা আছেন। গলার ঘড়ঘড়ানী পূর্ব্বাপেক্ষা বৃদ্ধি হইয়াছে। নাড়ী বিষম এবং ক্ষণ বিলুপ্ত। চক্ষের ভিতর অঙ্গুলি দিলে রোগীনী চক্ষু পত্র নিমীলিত করিলেন কিন্তু প্রাতে তাহা করিতেন না। ষ্টিমিউলেণ্ট্ মিক‍্শ্চার সেবন করাইতে ব্যবস্থা করিয়া বলিয়া আসিলাম যে যদি উহা ৩ কিম্বা ৪ মাত্রা সেবনে নাড়ীর বল বৃদ্ধি হয়, নিয়মিত রূপ ব্যবহার করাইবেন এবং যদি তাহাতে অবস্থার কোন উত্তম পরিবর্ত্তন না হয় সমস্ত ঔষধি বন্ধ রাখিবেন, কেবল মধ্যে মধ্যে মাংসের ক্কাথ ও ব্রাণ্ডী দিবেন। পর দিবস প্রাতে সংবাদ পাইয়া রোগিণীকে দেখিতে যাইলাম এবং তথায় শুনিলাম যে গত রাত্রে ৫ মাত্রা ষ্টিমিউলেণ্ট্ মিশ্চার সেবনে কোন উপকার দর্শিল না দেখিয়া ঔষধ বন্ধ আছে। এই দিবস পীড়ার দ্বাবিংশ দিবস, পূর্ব্ব দিবসের অপেক্ষা কিছুই ভাল দেখিলাম না। সন্ধ্যার সময় দেখিলাম ঔষধ বন্ধ করিয়া নাড়ী অপেক্ষাকৃত সবল হইয়াছে এবং পূর্বাপেক্ষা পথ্য সহজে গলাধঃকরণ হইতেছে। কেবল মাত্র মাংসের ক্কাথ, দুগ্ধ ও অল্প মাত্রায় ব্রাণ্ডী এক্ষণে দেওয়া হইতে লাগিল। আরোগ্য হইবার জন্যই ব্রাণ্ডী ও ডিম্ব মিশ্র এবং পরে বলকারক ঔষধ ভিন্ন আর কিছুই আবশ্যক হয় নাই।


  1. কারবনেট অফ সোডা ১৫ গ্রেন্ অর্দ্ধ ছটাক জলে দ্রবীভূত করিয়া, ২ ড্রাম পাতিলেবুর রস তাহাতে প্রক্ষেপ করত অবিলম্বে পান করিবে।