যন্ত্রকোষ/কচ্ছপী বা কচুয়া সেতার
কচ্ছপী বা
কচুয়া সেতার।আমাদের দেশে কচ্ছপী নামক অপর একবিধ বীণার বহু প্রচলন আছে, অধুনাতন লোকেরা তাহাকে “কচুয়াসেতার” বলিয়া ব্যবহার করেন। “সেতার” এই শব্দটী পারসিক ভাষা; খ্রীঃ ১৩ শতাব্দীতে পাঠান বংশীয় রাজা গয়েস্ উদ্দিন্ বুল্বানের রাজত্বকালে আমীর খস্রু নামে যে বিখ্যাত কবিপ্রধান রাজসভাসদ্মধ্যে পরিগণিত ছিলেন তিনিই কচ্ছপী, ত্রিতন্ত্রী ইত্যাদি বীণাকে সামান্যতঃ “সেতার” এই আখ্যা প্রদান করেন। বস্তুতঃ ত্রিতন্ত্রী নামের সহিত “সেতার” এই সংজ্ঞার অর্থগত কোন বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হয় না, যেহেতু পারস্যভাষায় “সে” শব্দে তিন বুঝায়, সুতরাং “সে—তার” আর “ত্রি—তন্ত্রী” উভয়েই একার্থবাচক অর্থাৎ তিনতারবিশিষ্ট যন্ত্র। ত্রিতন্ত্রী বীণার আকারও প্রায় কচ্ছপী বীণার মত, তবে বিশেষের মধ্যে এই যে, কচ্ছপী বীণার খোলটী অলাবুনির্ম্মিত এবং তাহাতে পাঁচ হইতে সাতটী পর্য্যন্ত তার আবদ্ধ থাকে, কিন্তু ত্রিতন্ত্রীর খোল প্রায়ই কাষ্ঠনির্ম্মিত[১], আর তাহাতে তিনের অধিক তার দৃষ্টিগোচর হয় না। যাহাই হউক, এক্ষণে কচ্ছপীজাতীয় ত্রিতন্ত্রী প্রভৃতি যন্ত্রমাত্রই প্রায় “সেতার” এই নামে প্রচলিত হইয়াছে। কচ্ছপী বীণার খোল কচ্ছপের পৃষ্ঠের ন্যায় চেপ্টা বলিয়াই ইহাকে কচ্ছপী বা কূৰ্ম্মী বীণা বলে। কচ্ছপীর দৈর্ঘ্য সচরাচর প্রায় চারি ফুটই হইয়া থাকে। তবে বাদকগণ স্বেচ্ছানুসারে ইহার ন্যূনাতিরেকও করিয়া থাকেন, কিন্তু রাগ বাজাইবার কচ্ছপী আকারে অপেক্ষাকৃত কিঞ্চিৎ বৃহৎ হওয়া নিতান্ত আবশ্যক, তাহা না হইলে আলাপের সময় মূর্চ্ছনা-কৌশল সুন্দর রূপে প্রদর্শিত হইতে পারে না। কচ্ছপীর দৈর্ঘ্য চারিফুট হইলে তাহার পন্থী হইতে পাঁচ ইঞ্চ ঊর্দ্ধে তন্ত্রাসন এবং তিনফুট পাঁচ ইঞ্চ ঊৰ্দ্ধে আড়ি সন্নিবেশিত করা কর্ত্তব্য। পরিমাণে চারি ফুটের ন্যূনাধিক হইলে ইহারই সমানুপাত অনুসারে তন্ত্রাসন ও আড়ি স্থাপিত করিতে হইবে। শাস্ত্রকারেরা কচ্ছপী বীণাকেই বাগ্দেবী সরস্বতীর হাতের যন্ত্র বলিয়া ব্যাখ্যা করেন; আমাদিগের বর্ণ্যমান কচ্ছপী বীণাটীতে যে সাতটী তার আবদ্ধ আছে, তন্মধ্যে চারিটী লৌহের এবং তিনটী পিত্তলের। যথা—
একচিহ্ন-বিশিষ্ট লৌহতারটীকে নায়কী অথবা প্রধান তার বলে। নায়কী তারটী লৌহনির্ম্মিত, সুতরাং অতি দৃঢ় বলিয়া বাদনকালে ইহারই বিশেষ প্রয়োজন হইয়া থাকে। এই তারটী সচরাচর উদারা সপ্তকের মধ্যম করিয়া বাঁধা যায়। দুই ও তিনচিহ্নবিশিষ্ট পিত্তল তারদ্বয় উদারা সপ্তকের ষড়্জ, চারিচিহ্নবিশিষ্ট লৌহ তারটী উদারার পঞ্চম, পাঁচচিহ্নবিশিষ্ট পিত্তলতার নিম্নসপ্তকের ষড়্জ, ছয়চিহ্নবিশিষ্ট লৌহতার মুদারার ষড়্জ ও সাতচিহ্নবিশিষ্ট লৌহতারটী মুদারার পঞ্চম করিয়া বাঁধার রীতি আছে। ছয় ও সাতচিহ্নবিশিষ্ট ক্ষুদ্র তারদ্বয় কচ্ছপী যন্ত্রের পার্শ্বে আবদ্ধ থাকে, ঐ দুইটী তারকে সচরাচর “ক্ষুদ্রতন্ত্রিকা” বা “চিকারি” বলে। নায়কী ও দুইচিহ্নবিশিষ্ট তার ব্যতীত অপর কয়েকটী তার কেবল সুরযোগ দিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে ক্ষিপ্রহস্ত নিপুণ কাচ্ছপিকেরা ক্ষুদ্র তন্ত্রিকা ভিন্ন অবশিষ্ট তার গুলিতে বামহস্তের অঙ্গুলী সারিকায় সারিকায় সঞ্চালন করত সংযোগাদি নানাবিধ স্বরকৌশল দর্শাইয়া থাকেন। ইচ্ছা করিলে কচ্ছপী বীণাতেও ইউরোপীয়গিটার যন্ত্রের ন্যায় দুই তিনটী সুর একত্র ধ্বনিত করা যাইতে পারে। কিন্তু ভারতীয়সঙ্গীতে এরূপ রীতির বড় একটা ব্যবহার নাই। কচ্ছপী বীণার কাষ্ঠদণ্ডের উপরে সতরখানি লৌহাদিধাতুনির্ম্মিত সারিকা তন্তুদ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং তাহাতে সাৰ্দ্ধদ্বিসপ্তকমাত্র স্বর প্রতিপন্ন করা যায়। কচ্ছপী এতৎসম্বন্ধে মহতী বীণার সহিত প্রায়ই তুল্য। তবে তাহার সারিকাবিন্যাস বিকৃতস্বরগ্রামানু্যায়িক, আর ইহার সারিকা গুলি কেবল ব্যবহারগত তীব্রমধ্যম ও কোমলনিষাদযোগে প্রকৃতস্বরগ্রামানুসারে বিন্যস্ত, এইমাত্র বিশেষ। যথা—
তা মু উ |
সা ঋ গ ম সা ঋ গ ম ^ ম প ধ নি |
কচ্ছপীযন্ত্রবাদনকালে তাহার পশ্চাদ্ভাগ বাদকের সম্মুখে স্থাপনপূর্ব্বক অলাবুটীর পার্শ্বদিক্ দক্ষিণহস্তের কব্জী সহকারে চাপিয়া, দাণ্ডাটী বামহস্তে আলগোছা ঠেশ রাখিয়া ধরিতে হয়। পরে স্বরস্থানস্থ প্রতি সারিকায় বামহস্তের তর্জ্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলিকে তারের উপর সঞ্চালিত করত দক্ষিণহস্তের মৃজাপাবৃততর্জ্জনী দ্বারা সারিকাশূন্য প্রদেশে সেই তারের উপর আঘাত দিলে উল্লিখিত সাৰ্দ্ধদ্বিসপ্তক উত্তম রূপে প্রকাশ পাইবে। কচ্ছপী বীণার ধ্বনিবিষয়ে মহতী বীণার সহিত অনেকাংশে সমতা দেখিতে পাওয়া যায়; মহতী বীণাতে যে সকল উৎকট উৎকট কার্য্য অধিক আয়াসে সম্পাদিত হয়, কচ্ছপী বীণাতে তৎসমুদায় কার্য্য অতি সহজে, অল্প পরিশ্রমে এবং সুচারুরূপে নিষ্পন্ন হইতে পারে। গ্রীক্ এবং রোমান্জাতীয়পুরাবৃত্তবিষয়ক অভিধানকর্ত্তা উইলিয়ম্ স্মিথ্ সাহেবের মতে লায়ার, টেস্টীডো ও কচ্ছপী এই তিনই এক জাতীয় যন্ত্র। অধুনাতন ইউরোপীয় গীটার যন্ত্রেরও সহিত কচ্ছপীর অনেক সৌসাদৃশ্য লক্ষিত হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া-প্রণেতা রিজ্ সাহেব বলেন কচ্ছপী হইতেই গীটারের উৎপত্তি। স্কুল অব্ ইউনিভর্ষেল মিউজিক্গ্রন্থকার ডাক্তার এডল্ফ মার্কস্ সাহেবের মতে গীটার কচ্ছপীর অবয়বভেদমাত্র, জর্ম্মান্ জাতীয়েরা তাহাকে জিতার বলিয়া ব্যবহার করেন। বস্তুতঃ কচ্ছপী বীণা সামন্যের “সেতার” এই নাম ভারতবর্ষে আমীর খস্রুর দিবার অনেক পূর্ব্বে অন্যান্য দেশেও উক্তবিধ যন্ত্র ঐ নামেই প্রচলিত ছিল। বৃটানিকাকর্ত্তা বলেন যে, আরবদেশ হইতেই কচ্ছপী অবয়বভেদে গীটার নামে বিখ্যাত হয়। অতি প্রাচীন কালে যখন পারসিকদিগের সহিত ভারতবর্ষীয়দিগের বাণিজ্যাদি ঘটিত বিশেষ সংস্রব ছিল, তৎকালে পারসিকেরা ভারতবর্ষহইতে কচ্ছপীকে স্বদেশে লইয়া গিয়া “সেতার” নাম প্রদান করে। পরন্তু বিখ্যাত পারসিককবি আমীর খস্রু যে পর্য্যন্ত ভারতবর্ষে না আসিয়াছিলেন তদবধি এতদ্দেশে কচ্ছপী নামই অবিচলিতভাবে প্রচলিত ছিল। পরে উক্ত যন্ত্র পারস্যদেশ হইতে আরবে গিয়া কিঞ্চিৎ অবয়বভেদে গীটার, এসিরিয়া দেশে এসোর্, প্রাচীন গ্রীশে খিতারা, ইহুদীদিগের দেশে কিমোর, নিউবিয়ায় কিশোর এবং অপরাপর দেশে বিভিন্ননামে প্রসিদ্ধ হয়। আরব্যদেশহইতেই যে, গীটার নামের উৎপত্তি, ডাক্তার বার্ণিসাহেবও একথা স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। রিজ্ সাহেবকৃত এনসাইক্লোপিডিয়ায় লিখিত আছে যে, খ্রীঃ নবম শতাব্দীতে আরবীয়েরা যখন স্পেন্ দেশে আপনাদিগের আধিপত্য স্থাপন করে, সেই সময়ে তাহাদিগের দ্বারাই গীটার যন্ত্র উক্তদেশে নীত এবং স্থাপিত হয়। অনন্তর কালসহকারে ঐ গীটার যন্ত্র ইউরোপের যাবতীয় দেশে অবয়বভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে; ফলতঃ ভারতবর্ষীয় কচ্ছপী বা কূর্ম্মী বীণাই বোধ হয় তৎসমুদায় যন্ত্রের মূল।
- ↑ ইহার বিশেষ বিবরণ তৃতীয় সংখ্যক যন্ত্রে দ্রষ্টব্য।