প্রথম অধ্যায়।

মহতী বীণা[১]

 এই যন্ত্রটী অতি প্রাচীন ও সর্ব্বযন্ত্রপ্রধান, মহর্ষি নারদ-কর্ত্তৃক ইহা প্রথম সৃষ্ট হয়। সংস্কৃত শাস্ত্রকারেরা বলেন, এই যন্ত্র মনুষ্যদেহের অনুকৃত; মনুষ্যদেহে যে রূপ একটী মেরুদণ্ড আছে, ইহাতেও ঐ মেরুদণ্ডের পরিবর্ত্তে একটী বংশদণ্ড থাকে। মনুষ্যদেহে তিনটী স্বর স্থানের মধ্যে নাভি এবং মস্তক এই দুইটীই যেমন প্রধান স্বরস্থান, ইহাতেও তদনুযায়ী বংশ দণ্ডের উভয়পার্শ্বে দুইটী অলাবু যোজিত থাকে। দেহের পরিমাণানুরূপে নাভিস্থানহইতে তারস্থান পর্য্যন্ত নবমুষ্টিপরিমিত স্বরস্থান রাখিবার সচরাচর বিধি আছে। নারদ-নির্ম্মিত এই জাতীয় বীণাকে মহতী বীণা বলা যায়। এই বীণাতে সচরাচর তিনটী লৌহের এবং চারিট পিত্তলের সকল্যে সাতটী তার আবদ্ধ থাকে[২] ঐ সাতটী তার সহজে বুঝাইবার জন্য এক দুই করিয়া সাত পর্য্যন্ত চিহ্নে চিহ্নিত করা হইয়াছে যথা—

তা
 
মু
 

 
                                                                                                                                          সা          

                                                                                                                                                 সা                        
                                                                                               সা                                                                      

অতিরিক্তরেখা
 
                         নি                                   নি                    নি                                                                                

 উপরি লিখিত একচিহ্নবিশিষ্ট লৌহ তারটী উদারা সপ্তকের মধ্যম করিয়া বাঁধা যায় এবং ঐটীকেই নায়কী তার বলে। সার্‌ উইলিয়ম্ জোন্স মহোদয় ঐ তারকে পিত্তলতার বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন। বরঞ্চ কুতূহলী পাঠক এসিয়াটিক্ রিসার্চেস্‌ প্রথম বালম ২২৬ পৃষ্ঠায় “আর” চিহ্নবিশিষ্ট তারটীর প্রতি দৃষ্টি করিবেন। ঐটী আমাদের এক্ষণকার ব্যবহারগত নায়কীতার, তিনিও উহাকে নায়কীতার বলিয়াছেন বটে, কিন্তু আমাদের এক্ষণকার প্রচলিত রীতির সহিত ধাতুগতভেদ দেখা যায়। বস্তুতঃ বিবেচনা করিয়া দেখিলে মূর্চ্ছনা এবং গমকাদি পিত্তলতারে সুন্দররূপে নিঃসরণ করিতে গেলে ক্রমশঃ ঐ তার বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া সুরভ্রষ্ট করে ও ছিন্ন হইয়া যায়। আমরা ঐ তারকে মধ্যম করিয়া বাঁধিয়া থাকি, তিনি স্বরগ্রাম বিভিন্নতায় উহাকে অন্যবিধ নিয়মে বাঁধিবার বিধি করিয়াছেন, ইহার এবং অন্যান্য তার বন্ধন বিভেদ বিষয়ক বিশেষ বিবরণ পরে লিখিত হইবে।

 দুই চিহ্ন বিশিষ্ট পিত্তল-তার উদারার ষড়্জ করিয়া বাঁধাই প্রসিদ্ধ, কথিত মহোদয় উক্ত পুস্তকের উক্ত পৃষ্ঠায় ঐ দ্বিতীয় তারটী “এস্” চিহ্নে চিহ্নিত করিয়াছেন, আমাদের সহিত এইটীর ধাতুগতভেদ কিছুই নাই, পরন্তু গ্রাম বিভেদ কল্পনা জনিত সুরবন্ধনগতভেদ লক্ষিত হয়। তিনচিহ্ন-বিশিষ্ট-তারটীও পিত্তলের, ঐ তারটী অবলম্বিত উদারার নিম্নসপ্তকের পঞ্চম করিয়া বাঁধার ব্যবহার আছে এবং সেই জন্য উহার স্বরলিপি অতিরিক্ত রেখাতে অর্থাং (উদারা সপ্তক অপেক্ষা আরও নিম্ন সপ্তক স্বরলিপি করিতে গেলে আমাদিগের সঙ্গীতে অতীব প্রয়োজনীয় উদারা, মুদারা এবং তারা এই তিনটী সপ্তকের স্বরলিপিজন্য যে তিনটী সরলরেখা নির্দ্দিষ্ট আছে ঐ তিনটী রেখা ব্যতীত অপর একটী অতিরিক্ত রেখা ব্যবহার করিতে হয়, যেমন উপরে তদুদাহরণ লিখিত হইয়াছে) আর নিম্ন সপ্তক জ্ঞাপনজন্য ঐ সুরটীর মস্তকে (নি) দেওয়া আছে। ফলতঃ হিন্দু সঙ্গীতে উদারা, মুদারা এবং তারা এই তিনটী সপ্তক ব্যতীত নিম্ন সপ্তক কেবল সুরের সহযোগ ব্যতীত অন্য বিষয়ে প্রায় ব্যবহৃত হইতে দেখিতে পাওয়া যায় না। সার্‌ উইলিয়ম্ জোন্স মহোদয় ঐ পিত্তলের তারটীকে “টী” চিহ্নে চিহ্নিত করিয়াছেন এবং “এ”[৩] অর্থাৎ ধৈবতকে ষড়্‌জ শব্দের সমান অর্থ বোধক করিয়া উক্ত তারকে উহার ধৈবত গ্রামের উদারা সপ্তকের পঞ্চমে বাঁধিয়াছেন, সুতরাং তাহার সহিত এটীতেও গ্রামভেদ-জনিত সুরভেদ লক্ষিত হয়; আমরা উদারা সপ্তক হইতে নিম্ন সপ্তকের পঞ্চম করিয়া বাঁধিয়া থাকি। তিনি উহাকে মান্তরের উদার সপ্তকের পঞ্চমে বাঁধিয়াছেন, কাযেই এই তারটী বাঁধা সম্বন্ধে তাঁহার সহিত আমাদের এক্ষণকার প্রচলিত রীতির সপ্তকগতভেদও লক্ষিত হয়। চারি এবং পাঁচচিহ্নবিশিষ্ট পিত্তলের তারদ্বয় উদারার নিম্ন সপ্তকের ষড়্‌জ করিয়া বাঁধিবার রীতি আছে। ছয় এবং সাত-চিহ্ন-বিশিষ্ট তার দুইটী লৌহনির্ম্মিত, তন্মধ্যে প্রথমেরটা মুদারা সপ্তকের ষড়্‌জ এবং পরেরটী তারা সপ্তকের ষড়্জ করিয়া বাঁধার নিয়ম আছে। সার্‌ উইলিয়ম্ জোন্স মহোদয় চারি-চিহ্ন বিশিষ্ট পিত্তলের তারটীকে “ইউ” এবং পাঁচ-চিহ্নবিশিষ্ট পিত্তলের তারটকে “ভি” এই দুই চিহ্নে চিহ্নিত করিয়াছেন। কথিত কারণ বশতঃ এই দুইটী তারবন্ধনেরও এক্ষণকার প্রচলিত বন্ধনরীতির সহিত তাঁহার মতের অনৈক্য আছে। ছয় এবং সাত-চিহ্ন-বিশিষ্ট তারদ্বয়কে তিনিও লৌহ তার বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া প্রথমেরটী “পি” এবং শেষেরটী “কিউ” এই দুই চিহ্নে চিহ্নিত করিয়াছেন। পরন্তু উক্ত মহোদয় গ্রামভেদবন্ধন কল্পনা করাতেই উক্ত তারদ্বয় অন্যবিধ রীতিতে বাঁধা হইয়া থাকে। ছয় এবং সাতচিহ্নবিশিষ্টলৌহ তারদ্বয়কে সংস্কৃত-সঙ্গীত-গ্রন্থকর্ত্তারা ক্ষুদ্রতন্ত্রিকা বলেন, সচরাচর যাহা পারস্য ভাষায় চিকারি বলিয়া ব্যবহৃত হয়। ফলতঃ একচিহ্নবিশিষ্টলৌহনির্ম্মিত এবং দুইচিহ্নবিশিষ্টপিত্তলনির্ম্মিত তার ব্যতীত অপর পাঁচটী তারই সহযোগিতারূপে মাত্র সময়ে সময়ে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। বংশ-দণ্ডের উপরে স্বরস্থানে ঊনবিংশতি হইতে ত্রয়োবিংশতিপর্য্যন্ত ইস্‌পাতাদিধাতুনির্ম্মিতসারিকা মম্ দ্বারা জমাইত থাকে। এই যন্ত্রের সারিকা-বিন্যাসবিকৃত স্বরগ্রামানু্যায়িক, সচরাচর যে প্রকার স্বরগ্রাম প্রণালীকে হিন্দিভাষায় অচল ঠাট বলে এবং ইউরোপীয়েরা যাহাকে ক্রোমেটিক্‌ স্কেল্‌ বলেন। সারিকাবিন্যাসসম্বন্ধে সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্স মহোদয়ের সহিত আমাদের মতের ঐক্য আছে। বীণাযন্ত্র স্কন্ধে স্থাপিত এবং বামহস্তের তর্জ্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলী সারিকায় সারিকায় সঞ্চালন করত দক্ষিণহস্তের তর্জ্জনী এবং মধ্যমাঙ্গুলীদ্বারা বাদিত হইয়া থাকে, এই দুইটী অঙ্গুলীই অঙ্গুলীত্র অর্থাৎ “মিজ্‌রাপ” দ্বারা বাদনকালে আবরণ রাখার রীতি আছে, দক্ষিণ হস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলী সুরযোগ দিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। আর পাঁচচিহ্ন বিশিষ্ট তারটীও সুরযোগ দিবার জন্য বামহস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলীযোগে কখন কখন ধ্বনিত হইয়া থাকে। এই যন্ত্রে অনামিকা অঙ্গুলীর প্রয়োজন প্রায় দেখা যায় না। নিম্নলিখিতনিয়মে সাৰ্দ্ধদ্বিসপ্তকমাত্র বীণাতে প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। যথা—

দুইচিহ্নবিশিষ্ট পিত্তল
তার খুলিয়া।

একচিহ্নবিশিষ্ট লৌহ
তার খুলিয়া।

তা
 
মু
 

 
                                                                                                                                                                                                  সা ^      ঋ ^        প       

                                                                                                        সা ^      ঋ ^         গ ম ^     প ^     ধ ^নি                             নি                            
          সা ^      ঋ ^        গ ম ^     প ^      ধ ^নি                                                                    নি                                                                        
          ১ ২  ৩ ৪     ১ ২ ৩ ৪ ৫  ৬ ৭৮৯১০১১১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০২১২২২৩

 সার্‌ উইলিয়ম্ জোন্স মহোদয় ঊনবিংশতি খানি সারিকা নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন, তাঁহার মতানুযায়ি বীণায় উদারা সপ্তকের স্বরগ্রাম দ্বাদশ খানি বিকৃতস্বরোৎপাদিকা সারিকা দ্বারা মণ্ডিত আছে। এটীর সহিত আমাদের অধুনাতন প্রস্তাবিত বীণাটীরও উদারা-গ্রামের ঐক্য দেখা যায়; মুদারা সপ্তকে কোমল নিষাদ পরিত্যাগে উক্ত মহাত্মা একাদশ খানি সারিকা দিয়াছেন, কিন্তু আমাদের কথিত বীণার স্বরগ্রামে মুদারা-গ্রামের কোমল নিষাদ অপরিত্যক্তরূপে ১২ খানি সারিকা দেওয়া আছে, সুতরাং এই সপ্তকের এক খানি সারিকা আমাদের অপেক্ষা তাঁহার বীণায় ন্যূন আছে, তিনি তারা সপ্তকের ষড়্‌জ এবং প্রকৃত ঋষভ মাত্র উল্লেখ করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন, কাযেই তাঁহার বীণাতে পূর্ণ সাৰ্দ্ধ দ্বিসপ্তক পর্য্যন্ত পাওয়া যায় না। আমাদের অধুনাতন প্রচলিত বীণাটীতে তারাসপ্তকের স্বরগ্রামে কোমল ঋষভ, কোমল গান্ধার এবং প্রকৃত গান্ধার এই তিন খানি সারিকা জোন্স মহোদয়ের বীণার সারিকা অপেক্ষা অধিক আছে, সেই হেতু তাৎকালিক বীণাতে মুদারা সপ্তকের এক খানি এবং তারা সপ্তকের তিন খানি সাকল্যে এই চারি খানি সারিকা অধুনাতন বীণা অপেক্ষা ন্যূন প্রতিপন্ন হয়, ফলতঃ ইহাতে কার্য্যগত কোন বিশেষ হানি হইতে পারে না। ঊনবিংশতি খানি সারিকাবিশিষ্ট বীণাতে মূর্চ্ছনাদ্বারা অপর অতিরিক্ত সারিকা চারি খানির কার্য্য অনায়াসে সম্পাদিত হইতে পারে, সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্স মহোদয়ও ইহা প্রতিপন্ন করিয়াছেন।

 কথিত হইল সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্স মহোদয় এসিয়াটিক্‌ রিসার্চেস্‌ প্রথম বালমে যে রূপ বীণায়ন্ত্রের তারবন্ধনপ্রণালী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন সেই প্রণালীর সহিত আমাদের মতের অনেক বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়; তাহার কারণ এই, উক্ত মহোদয় স্বরগ্রামের প্রথম স্বর ষড়্‌জকে ইটালীয় “লা” অথবা ইংরাজি “এ” বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। বস্তুতঃ গ্রাম আরম্ভক ষড়্‌জের সহিত স্বরগ্রাম আরম্ভক ইটালীয় “অট” অথবা ইংরাজী “সি”র সাদৃশ্য লিখিলে যুক্তিযুক্ত বোধ হইত, হিন্দু সঙ্গীতবিষয়ক অন্যতর গ্রন্থকর্ত্তা উইলার্ড সাহেবের সহিত সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্স মহোদয়ের মতবিরুদ্ধতায় আমাদের মতের সহিত বিশেষ ঐক্য দেখা যায়, বরঞ্চ সঙ্গীত কুতূহলী মহাশয়েরা উইলার্ড্‌ সাহেরের ট্রিটিজ্‌ অন দি হিন্দু মিউজিক্‌ গ্রন্থে ২৭ পৃষ্ঠায় দেখিবেন। আরও ষড়্‌জের সহিত “এ”র ঐক্য করিলে, হিন্দু-সঙ্গীত-শাস্ত্রানুযায়িক শ্রুতিগত বিশেস দোষ স্পর্শে। “লা” অথবা “এ” যদ্যপি চারি শ্রুতি বিশিষ্ট পূর্ণ ষড়্‌জ হয়[৪] সুতরাং “লা”র পর সুর “ষি” অর্থাৎ ইংরাজি “বি” আমাদের ঋষভ হইবে, এবং তাহর অব্যবহিত পর স্বর “অট্‌” অর্থাৎ ইংরাজি “সি” আমাদের গান্ধার হইবে, সংস্কৃতসঙ্গীতগ্রন্থকারেরা ঋষভ এবং গান্ধারের মধ্যে তিনটী শ্রুতিবিশিষ্ট পূর্ণ স্বরস্থান নির্ণয় করেন, কিন্তু ইটালীয় “ষি” এবং “অট্‌” অর্থাৎ ইংরাজি “বি” এবং “সি” ইহাদের মধ্যে যে পরিমাণে স্থান আছে, ইউরোপীয়সঙ্গীতগ্রন্থকর্ত্তারা উহাকে অৰ্দ্ধস্বরস্থান বলিয়া প্রতিপন্ন করেন, তাহা হইলে চারি শ্রুতিবিশিষ্ট ষড়্‌জকে “লা” অর্থাৎ ইংরাজি “এ”র সহিত একার্থ বোধক করিলে ইটালীয় “ষি” অথবা ইংরাজি “বি” অর্থাৎ সার্‌ উইলিয়ম্ জোনস মহোদয় (যাহাকে আমাদের ঋষভ বলিয়া স্থির করিয়াছেন) এবং “অট” অর্থাৎ ইংরাজী “সি” যেটী উক্ত মহোদয়ের মতে আমাদের গান্ধার বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে এবং ইটালীয় “ষি” অথবা অৰ্দ্ধস্বর-স্থান-বিশিষ্ট ইংরাজি “বি”র সহিত সার্‌ উইলিয়ম্ জোনস মহোদয়ের মতে পূর্ণ স্বরস্থান বিশিষ্ট ঋষভকে একার্থ প্রতিপাদক করিলে সে কতদূর শ্রুতিদৃষ্ট হয়, তাহা উইলার্ড সাহেবের ২৯ পৃষ্ঠায় শ্রুতিবিবেকপ্রণালী কুতূহলী পাঠক দেখিলে অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। ফলতঃ “অট্‌” অর্থাৎ ইংরাজি “সি” হইতে ষড়জাদির আরম্ভ করিলে আমাদের মতে শ্রুতিগত এবং যুক্তিগত কোন দোষই স্পর্শে না, উইলার্ড্‌ সাহেবও এ বিষয়ের পোষকতা করিয়াছেন।


হি

ইং

পূর্ণস্বর
ষড়্‌জ
অট্‌
সি

পূর্ণস্বর
ঋষভ
রি
ডি
'

অর্দ্ধস্বর
গান্ধার
মি

পূর্ণস্বর
মধ্যম
ফা
এফ

পূর্ণস্বর
পঞ্চম
সো
জি

পূর্ণস্বর
রৈবত
লা

অর্দ্ধস্বর
নিষাদ
ষি
বি

 ইউরোপীয়েরা যে যে স্বরমধ্যস্থানকে পূর্ণতা এবং অৰ্দ্ধতানুসারে যেরূপ (Diatonic) ডায়'টনিক্ স্কেল সিদ্ধান্ত করেন, আমাদের দেশেও শ্রুতিগত তদনুযায়িকস্বরস্থানের পূর্ণতা এবং অৰ্দ্ধতানুসারে প্রকৃত স্বরগ্রাম স্থিরীকৃত হইয়া থাকে। আরও ইহার প্রমাণ জন্য বলিতেছি যে, পিয়ানো যন্ত্রে সন্নিহিত দুইটী কৃষ্ণসারিকার অব্যবহিত পূর্ব্বে যে শ্বেতসারিকা আছে, সেই শ্বেতসারিকাটী হইতে সি, ডি, ই, এফ্‌, জি, এ, বি, অথবা ইটালীয় অট্, রি, মি, ফা, সো, লা, ষি, ইত্যাদি সাতটী সুরের ক্রমান্বয়ে নাম উল্লেখ করিয়া অরিচ্ছেদে পর সপ্তকের “সি” অথবা “অট” পর্য্যন্ত গণনা করিয়া যাইলে একটী ও কৃষ্ণসারিকার আশ্রয় না লইয়া যেমন একটী ইংরাজি (Diatonic) ডায়'টনিক্ স্কেল সুসম্পাদিত করে, তদ্রূপ ঐ কথিত “সি” অথবা “অট্‌” নামক শ্বেতসারিকা হইতে যদ্যপি আবার আমাদের ষড়্‌জ ইত্যাদি সাতটী সুর কথিত সারিকায় সারিকায় নাম উচ্চারণ করত যথাক্রমে পর সপ্তকের “সি” পর্য্যন্ত গণনা করা যায়, তাহ হইলে আমাদের ও প্রকৃত স্বরগ্রাম কৃষ্ণসারিকার আশ্রয় ব্যতীত বিনা শ্রুতিদুষ্টতায় সুন্দররূপে নিষ্পন্ন হইবে, কিন্তু অন্যতর শ্বেতসারিকা “এ” অথবা “অট” হইতে ষড়্‌জাদির নাম উল্লেখে কৃষ্ণ সারিকার আশ্রয় বিনা কথিত পর সপ্তকের এ পর্য্যন্ত গণনা করিলে সঙ্গীতকুতূহলী মহোদয় শুনিবেন যে প্রকৃত স্বরগ্রাম শ্রুতির ন্যূনাধিক্যজনিতশ্রবণদুষ্ট হইবেই হইবে। ইটালীয় “অট্‌” ইংরাজি “সি” এবং আমাদের ষড়্‌জ এই তিনই একার্থপ্রতিপাদক তাহার সন্দেহ নাই, বস্তুতঃ ইটালীয় “লা” ইংরাজি “এ” এবং আমাদের ধৈবত, কখনই ষড়্‌জ বোধক নহে।

 বীণার স্বর অতীব মধুর সুতরাং সুশ্রাব্য, প্রিয়ানো প্রভৃতি ইউরোপীয় যন্ত্রে যে সকল কার্য্য সম্পন্ন হয় তাহার অধিক ভাগই বীণায় নিষ্পাদিত হইতে পারে, বরঞ্চ মূর্চ্ছনা, কৃন্তন-প্রভৃতি যাবতীয় সঙ্গীতোপযোগী উৎকট উৎকট কার্য্য যাহা এই যন্ত্রে সুচারু রূপে সহজে প্রতিপন্ন হয়, সে সমুদায় কার্য্য ইউরোপীয় যন্ত্রে অতীব দুঃসাধ্য। বীণার বাদন-পারিপাট্য, মধুরতা এবং উৎকৃষ্টতা সম্বন্ধে উইলার্ড এবং সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্‌স প্রভৃতি হিন্দু সঙ্গীতজ্ঞ মহোদয়গণ অত্যুৎকৃষ্ট পিয়ানোর সহিত তুল্যতা স্থাপন করেন। ইংরাজি সংস্কৃত-অভিধানকর্তা মণিয়র উইলিয়ম্‌স্‌ সাহেব ইউরোপীয় “লায়ার যন্ত্র এবং বীণা এই উভয় যন্ত্রকে এক জাতীয় বলিয়া স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছেন। আমাদের বীণাতে যেমন সাতটী তার আবদ্ধ থাকে প্রাচীন গ্রীক্‌ জাতীয় লায়ার যন্ত্রেও সেইরূপ সাতটী তার আবদ্ধ থাকিত, গ্রীক্ এবং রোমীয়দের পুরাবৃত্তকর্ত্তা উইলিয়ম্‌ স্মিথ্‌ সাহেব উক্ত গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, গ্রীক্‌জাতিরা যখন “লায়ার” এবং তজ্জাতীয় অন্যান্য যন্ত্রের বিষয় কিছুই জানিত না, তাহার পূর্ব্বেও আসিয়াস্থ নানা দেশে এবং মিশরে লায়ার প্রভৃতি যন্ত্রের বহু প্রচলন ছিল, কিছু কাল পরে গ্রীক্‌জাতিরা “লায়ারের” উৎকর্ষতা দর্শনে গ্রীস্‌দেশে প্রথমে উহা আনয়ন করেন। এতদ্বিষয়ের পোষকতা হকিন্‌ সাহেব, বার্ণি সাহেব এবং কার্‌লেন্‌জেল্‌ সাহেব-কৃত সঙ্গীতগ্রন্থে ভূরি প্রমাণে দেখিতে পাত্তয়া যায়। ফলতঃ বীণা যে অতি প্রাচীন এবং ভারতবর্ষ যে ইহার প্রথম জন্মস্থান তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নই, তবে দেশভেদে অবয়বভেদ এবং নামভেদ হইয়া থাকিবে এই মাত্র। সংস্কৃত-সঙ্গীত-গ্রন্থ কর্ত্তারা নানা জাতীয় বীণার নাম বিধিবদ্ধ করেন তন্মধ্যে বল্লরী নামে এক জাতীয় বীণা পূর্ব্বে ভারতবর্ষে বিলক্ষণ প্রচলিত ছিল, মণিয়র্‌ উইলিয়ম্‌ সাহেব তাহাকে “হার্প” বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। হার্প যন্ত্র ব্রহ্মদেশে “শন্‌” এবং চীন্‌ দেশে “কীণ্‌” বলিয়া ব্যবহৃত হয়। ইজিপ্ট দেশে বীণাকে “বেণ্‌” বলিয়া ব্যবহার করিত। “বীণ” এবং “বেণ্‌” এই দুইটী নামে কতক অংশে শব্দগত ঐক্য দেখা যাইতেছে। “বল্লরী” এবং “হার্প” এক বিধ যন্ত্র নাই হউক, বস্তুতঃ “হার্প” “বল্লরী”র অনুকৃত যন্ত্র বটে, বোধ করি এ বিষয়ে আর কেহ সন্দেহ করিতে না পারেন।

  1. প্রাচীন-সঙ্গীত-শাস্ত্র-কর্ত্তারা তারযন্ত্র মাত্রেরই প্রথমে সামান্যতঃ বীণা” এই ব্যাপক আখ্যা নির্দ্দেশ করিয়া পরে বিশেষ বিশেষ আকার ও প্রকৃতি অনুসারে মহতী বীণ, রুদ্র বীণা, সারস্বত বীণা, রঞ্জনী বীণা, কচ্ছপী বীণা ও স্বরবীণা প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ ব্যাপ্য নামও প্রদান করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু সম্প্রতি আমরা মহতী বীণার বিষয় বিবৃত করিতে প্রবত্ত হইয়াছি, সুতরাং এ স্থলে বীণা-সম্বন্ধে যাহা কিছু বলিব, কুতুহলী পাঠকগণ তৎ সমুদয়ই মহতী বীণা-সম্বন্ধীয় জানিবেন। এই যন্ত্রটী ভারতবর্ষীয় সর্ব্বপ্রকার বাদ্যযন্ত্র অপেক্ষা অধিকতম প্রাধান্য লাভ করিলেও যে, ইহার বাদক সংখ্যা অধিক পরিমাণে দেখিতে পাওয়া যায় না, বোধ হয় ইহার বাদন-ক্রিয়ার কাঠিন্য ও অতিরিক্ত-পরিশ্রম-সাধ্যত্বই তাহার অদ্বিতীয় কারণ; তজ্জন্যই সঙ্গীত কুতুহলীদিগের মধ্যে অনেকেই অগ্রসর হইতে পারেন না। বিশেষতঃ উক্ত যন্ত্র বাদনাভ্যাসে যেরূপ পরিশ্রমের আবশ্যক, তদপেক্ষা অল্পায়াসে কচ্ছপী বীণা বাদমে সমধিক পটুতা জন্মিতে পারে এবং কচ্ছপী বীণাতেও প্রায় বীণার যাবতীয় কার্য্যকৌশল প্রদর্শিত হইয় থাকে। বীণাবাদন এতদূর দুরূহ ব্যাপার যে, এই বিস্তীর্ণ ভারতভূমিতে সঙ্গীতের এত অধিক চর্চ্চা সত্ত্বেও আমরা নিম্ন লিখিত কয়েক ব্যক্তি মাত্র বীণা বাদকের নাম অবগত হইতে পারিয়াছি, যথা—জীবনসা, নির্ম্মল সা, মহম্মদ আলি, নসির আহম্মদ, সজ্জু খাঁ, গোলাপ খাঁ, গোলাম রসুল, করিম খাঁ, ওস্তাদজী লছ্‌মী প্রসাদ মিশ্র, ফিরজ খাঁ, নহবৎ খাঁ, প্রভৃতি (ইঁহারা বর্ত্তমান নাই) গোলাম হুসেন খাঁ, মেহদি হুসেন খাঁ, ওয়ারিস খাঁ ইত্যাদি (এই কয়েক ব্যক্তি মাত্র অদ্যাপি বর্ত্তমান আছেন।) পরিশেষে বক্তব্য যে, পূর্ব্বে ওস্তাদজী লছ্‌মী প্রসাদ মিশ্র মহাশয়ের নিকট বীণার অনেক বিষয় জ্ঞাত হই, সম্পতি বাবু অভয়াচরণ মল্লিকের নিকটেও তৎসম্বন্ধীয় কোন কোন বিষয় অবগত হইয়াছি। মহতী বীণার লক্ষণ এই, যথা—

    দণ্ডং বংশময়ং কাণ্ডং বর্ত্তুলং তুম্বযুগ্মকং।
    নবমুষ্টি স্বরস্থানং চাত্র যত্নেন কারয়েৎ॥
    তস্মিন্‌দণ্ডে সপ্তসংখ্যানাটনীং সনিবেশয়েৎ।
    দক্ষিণে বিন্যাসদ্বন্যৎ ক্ষুদ্রতন্ত্রীদ্বয়ং ক্রমাৎ॥
    বৃক্ষবজ্রময়ী কার্য্যা মোটনী দণ্ডরঞ্জিকা।
    তাবচ্চ ভ্রাময়েৎ পূর্ব্বাৎ নোটনীঞ্চ শনৈঃ শনৈঃ॥
    অস্যান্ত্বাস্টাদশ প্রোক্তাঃ সারিকাঃ পূর্ব্বশূরিভিঃ।
    এতাস্তু তারবাদিন্যস্তিষ্ঠন্তি পদিকোপরি॥
    মদনস্য চ সিক থস্য যোগেন সুদৃঢ়ীকৃতাঃ।
    মহত্যা নাম বীণায় এতদক্ষণমুচ্যতে॥

    ইতি কোহলীয়ে॥
  2. এসিয়াটিক্‌ রিসার্চেস্‌ প্রথম বালম পঞ্চম এডিশনের ২১৬ পৃষ্ঠায় সার উইলিয়ম জোন্স মহোদয় তাঁহার বীণা বিষযক প্রস্তাবে বলেন যে, প্রসিদ্ধ মুসলমান বৈণিকদ্বয় পিয়ার খাঁ এবং জীবন সাহা তাঁহাদের বীণাতে দুইটা লৌহ এবং পাঁচটী পিত্তল তার ব্যবহার করিতেন, পরন্তু অধুনাতনবৈণিকেরা তিনটি লৌহ এবং চারিটি পিত্তল তার ব্যবহার করিয়া থাকেন।
  3. “এ” কে ষড়জের সমান অর্থ বোধক বুঝায় না, বৈধত এবং “এ” এইদুইটী একার্থবোধক বটে, ইহার কারণ পরে বিবৃত হইবে, এই কারণ বশতঃ মহোদয় সার্‌ উইলিয়ম্‌ জোন্সের সহিত গ্রামভেদ কল্পনা জনিত তারবন্ধনগত স্বরভেদ লক্ষিত হয়।
  4. চারিটী শ্রুতিবিশিষ্ট ষড়্‌জের বিষয় উইলাড সাহেবের ট্রিটিজ অন্‌ দি হিন্দু মিউজিক্‌ গ্রন্থে ২৯ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য।