যন্ত্রকোষ/রুদ্র-বীণা বা রবাব
সংখ্যা ৬।
রুদ্র-বীণা বা রবাব।
ভারতবর্ষে যবনাধিকারের পূর্ব্বে এই যন্ত্রটী রুদ্র-বীণা বলিয়াই প্রসিদ্ধ ছিল, অনন্তর বিজয়ী যবনরাজগণকর্ত্তৃক রবাবনামে বিখ্যাত হয়। রবাব-যন্ত্রও সেতারাদির ন্যায় একটী খোল ও দণ্ডদ্বারা প্রস্তুত হইয়া থাকে; বিশেষের মধ্যে এই যে, ঐ খোল ও দণ্ড এ উভয়ই একখানি অখণ্ডকাষ্ঠদ্বারা নির্ম্মিত এবং খোলটী গোধাচর্ম্ম অথবা ছাগাদির পাতলাচর্ম্মদ্বারা আচ্ছাদিত। মহতী প্রভৃতি বীণার ন্যায় ইহাতেও একখানি হস্তিদন্তের তন্ত্রাসন আছে। রবাবঘন্ত্রে ছয়টী কীলকে অর্থাৎ কাণে ছয় গাছি তন্তু অর্থাৎ তাঁত আবদ্ধ থাকে। এই যন্ত্রে লৌহাদিধাতুনির্ম্মিত তার ব্যবহৃত হয় না এবং নিম্নলিখিত নিয়মে ঐ ছয় গাছি তন্তু বাঁধা যায়। যথা—
তা মু উ |
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ প ঋ সা |
রবাবযন্ত্রে সারিকাবিন্যাস থাকে না, যন্ত্রটী স্কন্ধে স্থাপনপূর্ব্বক বামহস্তের কেবল তর্জ্জনীতে মৎস্যের একখানি মোটা শল্ক অর্থাৎ আঁইস এক গাছি সূত্রদ্বারা বন্ধন করিয়া তৎসহকরে তারের উপরে উপরে স্বরস্থানে ঘর্ষণ এবং দক্ষিণহস্তের তর্জ্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির টীপযোগে চন্দনকাষ্ঠের বা বংশনিৰ্ম্মিত একটা কোণস্ (অর্থাৎ ত্রিভুজাকৃতি একখণ্ড ক্ষুদ্র ফলক, পারস্য ভাষায় ইহাকে জওয়া বলে) ধারণ করিয়া তাহার আঘাতযোগে বাজাইতে হয়। ইহার আঘাত গুলি কোলের দিকে না হইয়া তদ্বিপরীত দিকেই হইয়া থাকে, অর্থাৎ কেবল উল্টা আঘাতদ্বারাই ইহার বাদনক্রিয়া নিষ্পন্ন করিতে হয়। রবাবযন্ত্রের এইটী বিশেষ নিয়ম। বীণাজাতীয় অন্যান্য হিন্দু যন্ত্রের ন্যায় রবাবেও সাৰ্দ্ধদ্বিসপ্তক স্বর সুন্দররূপে প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। রবাবের যে যে তন্তু হইতে যে যে স্বর নির্গত হয়, তাহা নিম্নে প্রদর্শিত হইতেছে। যথা—
রবাবের ছয়টী তন্তুই নিয়মিতরূপে বাজিয়া থাকে। পশ্চিম হিন্দুস্থানের রামপুরপ্রভৃতি অঞ্চলে ইহার বহুলপ্রচার দেখিতে পাওয়া যায়। আফ্গানস্থান ও পারস্যপ্রভৃতি দেশেও এই যন্ত্রটী রবাব নামেই প্রসিদ্ধ। আরবীয়েরা ইহাকে “রুবেব্” বলিয়া ব্যবহার করে। প্রসিদ্ধ আরবীয় শব্দশাস্ত্র-বেত্তা ফিরোজ বাদী মজদ্অল্দীন তাঁহার বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থে (কামুস্) লিখিয়াছেন যে, প্রায় সত সহস্ৰ বৎসর অতীত হইল বসুদ্ গ্রাম-নিবাসী সঙ্গীত কুশলী আব্দুলা এই যন্ত্রের প্রথম সৃষ্টি করিয়া “রুবেব” এই নামকরণ করেন। উইলার্ড সাহেব বলেন, স্পেনিস্ গীটারের অবয়বের সহিত রবাবের অনেকাংশে সমতা আছে। ইউরোপীয় ম্যাণ্ডলিন্ প্রভৃতি প্রাচীন যন্ত্রসমুদয়ের সহিত ঐক্য করিয়া দেখিলে ইহার অবয়বের অনেক সৌসাদৃশ্য দেখা যায়, বোধ হয় রুদ্র-বীণাই স্পেনিস্ গীটার ও ম্যাণ্ডলিন্ প্রভৃতি যন্ত্রের আদর্শ; যেহেতু রুদ্র-বীণা ইউরোপীয় উক্ত যন্ত্রসমূহ অপেক্ষা অনেক প্রাচীন।