যন্ত্রকোষ/শারদীয় বীণা বা শরদ
শারদীয়-বীণার দণ্ড হইতে খোল পর্য্যন্ত প্রায় সমুদায় অবয়বটী একখানি অখণ্ড কাষ্ঠদ্বারা প্রস্তুত হইয়া থাকে, খোলটী আবার রবাবের মত গোধাদির চর্ম্মদ্বারা আচ্ছাদিত। এই যন্ত্রেও রুদ্র-বীণার ন্যায় সারিকাবিন্যাস থাকে না এবং ইহাতে ছয়টী কীলকে বা কাণে ছয়গাছি তন্তু যথারীতি আবদ্ধ থাকে। বাদকগণ স্বেচ্ছানুসারে ইহাতে তন্তুর পরিবর্ত্তে লৌহাদিধাতুনির্ম্মিত তারও সময়ে সময়ে যোজনা করিয়া থাকেন, কিন্তু সচরাচর এরূপ পদ্ধতির বড় একটা ব্যবহার নাই। যন্ত্রদণ্ডের পার্শ্বে সাত হইতে একাদশ পর্য্যন্ত ইচ্ছাধীন অপর কয়েকটী অতিরিক্ত কীলক সংযোজন করা হয় এবং প্রত্যেকে পিত্তলাদি-ধাতু-নির্ম্মিত-তার আবদ্ধ থাকে, সেই তার গুলিকে পারস্য ভাষায় “তরফ্” ও সংস্কৃত ভাষায় “পার্শ্বতন্ত্রিকা” বলে। এই পার্শ্বতন্ত্রিকা গুলি নিয়মিত আঘাত দ্বারা বাদিত হয় না, কেবল পূর্ব্বোক্ত প্রধান ছয়টী তারবাদন-কালে তাহাদিগের কম্পনেই এই অতিরিক্ত তারগুলি ঝঙ্কারিত বা প্রতিধ্বনিত হয়। শরদের প্রধান তার ছয়টী। নিম্ন লিখিত নিয়মে তাহাদের বাঁধিবার রীতি দেখা যায়। যথা—
তা মু উ |
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ম ম সা সা ম |
শরদ-যন্ত্র ক্রোড়ে স্থাপন করত সেতারাদি যন্ত্রের ন্যায় বামহস্তে আলগোছা ঠেস্ রাখিয়া সারিকারহিত দণ্ডস্থ-কাষ্ঠ পটকের (পারস্য ভাষায় ইহাকে পট্রি কহে) স্বর-স্থানে তারের উপরে উপরে বামহস্তের অঙ্গুলি ঘর্ষণ এবং দক্ষিণহস্তের তৰ্জ্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির টীপসহকারে রবাবাদিতে ব্যবহৃত জওয়ার ন্যায় আস্থর,কাষ্ঠের অথবা বংশদ্বারা-নির্ম্মিত একটা জওয়া ধারণ করিয়া তাহার আঘাতে ইহা বাজাইতে হয়। শরদ বাদন-কালে বামহস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি ব্যতীত অপর চারিটী অঙ্গুলিরই ব্যবহার হইয়া থাকে। পরন্তু তর্জ্জনী ও মধ্যমা এই দুইটী অঙ্গুলিরই অধিক ব্যবহার দেখা যায়। শরদে নিম্নলিখিত নিয়মে সাৰ্দ্ধদ্বিসপ্তক স্বর প্রতিপন্ন হয়। যথা—
অন্যান্য যন্ত্রপেক্ষা শরদ-যন্ত্রের তার-যোজনায় কিঞ্চিৎ বিশেষ আছে। ইহার এক ও দুইচিহ্নবিশিষ্ট দুইটী তার এবং তিন ও চারিচিহ্নবিশিষ্ট দুইটী তার ইহার পরস্পর সন্নিকটে ও সমসুরে আবদ্ধ থাকে। সমসুরে আবদ্ধ এই দুই দুইটী তার একত্র অঙ্গুলি-ঘর্ষণে ব্যবহৃত হয়। পাঁচ ও ছয়চিহ্নবিশিষ্ট তারদ্বয় পৃথগ্ভাবে যোজিত ও বদিত হইয়া থাকে। সুতরাং ইহাতে ছয়টী তার সত্ত্বেও এক ও দুইচিহ্নবিশিষ্ট তার দুইটী সমসুরে বদ্ধ এবং একত্র ধ্বনিত হয় বলিয়া একটীরই ন্যায় কার্য্যকারী হয় এবং তিন ও চারিচিহ্নবিশিষ্টতার দুইটীও এই রূপ। সুতরাং এই চারিটী তারে দুই তারের কার্য্য সম্পন্ন করে। বস্তুগত্যা ইহার চারিটী মাত্র তারই কাৰ্য্যোপযোগী। প্রয়োজনীয় এই চারিটী তারের মধ্যে আবার ছয়চিহ্নবিশিষ্ট তারটী কেবল সুর-যোগ দিবার জন্য ব্যবহৃত হইয়া থাকে। উপরে এই প্রকার রীতিতেই স্বরলিপি প্রদর্শিত হইয়াছে। বঙ্গদেশে সেতারাদির ন্যায় শরদ-যন্ত্রের বড় অধিক ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায় না, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম-প্রদেশেই ইহার সমধিক আদর আছে। যবন-রাজাদিগের রাজত্বকালে এই যন্ত্রটী যাত্রিক যন্ত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল, যখন রাজগণ বায়ু সেবন বা অন্য কোন কার্য্য নিবন্ধন বহির্গমন করিতেন, সেই সময়ে হস্তী বা উষ্ট্রের-পৃষ্ঠে শরদ যন্ত্র স্থাপিত ও তাঁহাদিগের অগ্রে অগ্রে বাদিত হইত। পরন্তু এক্ষণে এই যন্ত্রটী তৎপরিবর্ত্তে সভ্য-যন্ত্র-মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। কখন কখন এমনও হয় যে, শারদিকেরা ইহার সমসুরে কণ্ঠ মিলাইয়া সভাতে গানও করিয়া থাকেন। শরদ-যন্ত্র কি স্বতঃসিদ্ধ, কি অনুগতসিদ্ধ উভয় ভাবেই এক প্রকার বড় মন্দ লাগে না। তবে মহতী, কচ্ছপী বা রুদ্র-বীণার সদৃশ নহে, শরদের ধ্বনি অপেক্ষাকৃত কিছু নীরস ও কর্কশ বোধ হয়। আফ্গানস্থান ও আরব প্রভৃতি আসিয়াস্থ অনেক দেশে শরদ প্রচলিত আছে, কিন্তু আরবীয়শরদ ভারতবর্ষীয়শরদ অপেক্ষা আকারে কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্র এবং উভয়ের অবয়বগতও কিঞ্চিৎ তারতম্য আছে, সংজ্ঞাগত কোন বৈলক্ষণ্য নাই। শরদ-যন্ত্র কিঞ্চিম্মাত্র অবয়ব ভেদে মিশর দেশে গুস্যা নামে প্রচলিত আছে।
- ↑ এই শব্দে পারস্য ভাষার গান করা বুঝায়।