য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/তৃতীয় পত্র

তৃতীয় পত্র

আমরা সে দিন ‘ফ্যান্সি বলে’ অর্থাৎ ছদ্মবেশ-নাচে গিয়েছিলেম―কত মেয়ে পুরুষ নানা রকম সেজেগুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল―সে দেখতে বেশ জমকালো। প্রকাণ্ড ঘর, গ্যাসের আলোয় আলোকাকীর্ণ, চার দিকে ব্যাণ্ড বাজছে―৬।৭০০ সুন্দরী, সুপুরুষ। ঘরে ন স্থানং তিলধারয়েৎ―চাঁদের হাট তো তাকেই বলে―যে দিকে পা বাড়াই বিবিদের গাউন, যে দিকে চোক ফেরাই চোক ঝলসে যায়। এক-একটা ঘরে দলে দলে স্ত্রী পুরুষে হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করেছে, দেখে মনে হয় যেন সবাই একেবারে আমোদে উন্মত্ত হয়ে গেছে। জ্ঞানশূন্য হয়ে যেন জোড়া জোড়া পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক-একটা ঘরে এমন ৭০।৮০ জন যুগল মূর্তি ঘুরছে―এমন ঘেঁষাঘেঁষি যে, কে কার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে তার ঠিক নেই। একটা ঘরে শ্যাম্পেনের কুরুক্ষেত্র পড়ে গিয়েছে, মদ্যমাংসের ছড়াছড়ি, সেখানে লোকে লোকারণ্য। এক-একটা বিবির খাবার বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার মুখ চলছে। এক-একটা বিবির নাচের বিরাম নাই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে। সকলেরই মুখে হাসি, মন অধিকার করবার যত প্রকার গোলাগুলি আছে বিবিরা তা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছেন। কিন্তু ভয় কোরো না, আমাদের মতো পাষাণ হৃদয়ে তার একটু আঁচড়ও পড়ে নি। একজন বিবি snow maiden অর্থাৎ নীহারকুমারী সেজে গিয়েছিলেন, তাঁর সমস্তই শুভ্র, সর্বাঙ্গে পুঁতির সজ্জা, আলোতে একেবারে ঝক্‌মক্‌ করছে। একজন মুসলমানিনী মেয়ে সেজে গিয়েছিলেন―একটা লাল ফুলো ইজের, ওপরে একটা রেশমের পেশোয়াজ, মাথায় টুপির মতো। এ কাপড়ে তাঁকে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। একজন আমাদের দিশি মেয়ে সেজে গিয়েছিলেন―একটা শাড়ি ও একটা কাঁচুলি তাঁর প্রধান সজ্জা, তার উপরে একটা চাদর পরেছিলেন, তাতে ইংরিজি কাপড়ের চেয়ে তাঁকে ঢের ভালো দেখাচ্ছিল। একজন বিলিতি দাসী সেজে গিয়েছিল, যে রকম তার চেহারা তাতে দাসীর পোশাক ছাড়া আর কিছুতে তাকে মানাতো না। এই রকম নানা লোক নানা রকম পোশাক প’রে গিয়েছিল। আমি বাঙালার জমিদার সেজেছিলেম; জরি-দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি-দেওয়া মখমলের পাগড়ি প্রভৃতি পরেছিলেম। জনকতক ব্যক্তি মিলে পীড়াপীড়ি করে আমাকে একটা দাড়ি গোঁপ পরালেন। দুই-এক জন মহিলা আমাকে দেখে বললেন যে, সে দাড়ি গোঁপে আমাকে ভারী ভালো দেখাচ্ছে। তাতে আমার স্বভাবতই ভারী গর্বের আবির্ভাব হল, আমি সেই দাড়ি গোঁপ পরেই ‘বলে’ গিয়ে উপস্থিত হলেম। কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন আছেন, আমি যে নাকালটা হলেম তা আর বক্তব্যও নয়, শ্রোতব্যও নয়। তা শুনলে পাষাণেরও চোখ ফেটে মুক্তার মতো ডাগর ডাগর অশ্রুবিন্দু দরদর ধারে বিগলিত হয়ে ধরণীতল অভিষিক্ত করবে। যে-সকল সুন্দরী বন্ধুদের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল, আমার দাড়ি গোঁপ দেখে তারা আর কেউ আমাকে চিনতে পারেন না। অমুকের সঙ্গে সকলেই সেক্‌হ্যান্‌ড্‌ করলে, অমুক বাবুর সঙ্গে সকলেই সেক্‌হ্যান্‌ড্‌ করলে―কিন্তু এ গরিবকে আর কেউ পোছে না। আমি যার কাছে যাই সেই সরে পড়ে। আমি তো রাগে দুঃখে অভিমানে বিরক্তিতে আত্মগ্লানিতে অভিভূত হয়ে সেই মুহূর্তেই দাড়ি গোঁপ উৎপাটন করে একেবারে পকেটে গুঁজলেম, তখন সমস্ত ভালোয় ভালোয় মীমাংসা হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে অমুক অযোধ্যার তালুকদার সেজে গিয়েছিলেন। শাদা রেশমের ইজের জরিতে খচিত, শাদা রেশমের চাপকান, শাদা রেশমের জোব্বা, জরিতে ঝক্‌মকায়মান পাগড়ি, জরির কোমরবন্দ―এই তো তাঁর সজা। অযোধ্যার তালুকদারেরা যে এই রকম কাপড় পরে তা মনেও কোরো না, কিন্তু বিচার করবার লোক কোথায়? ধরা পড়বার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের মধ্যে অমুকবাবু আফগান সেনাপতি সেজেছিলেন।

 গত মঙ্গলবারে আমরা অমুকের বাড়িতে নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেম। সন্ধ্যে বেলায় কোথাও নিমন্ত্রণে যেতে হলে কিরকম পোশাক পরতে হয় জানো? এখানে শীতের জন্য সচরাচর মোটা কাপড় পরতে হয়, কিন্তু evening party প্রভৃতিতে যেতে হলে পাৎলা কালো বনাতের কাপড় পরতে হয়, কেননা নিমন্ত্রণসভায় খুব গ্যাস জ্বলে, অনেক লোকের সমাগম হয়, তাতে ঘর বেশ গরম হয়ে ওঠে, তা ছাড়া যদি নাচতে হয় তা হলে অত্যন্ত গরম হবার কথা। সন্ধ্যেপরিচ্ছদের কামিজটি একেবারে নিষ্কলঙ্ক ধব্‌ধবে শাদা হওয়া চাই―তার ওপরে প্রায়-সমস্ত-বুক-খোলা এক বনাতের ওয়েস্ট্‌ কোট থাকবে, কালো ওয়েস্ট্‌ কোটের মধ্যে শাদা কামিজের সুমুখ দিকটা বেরিয়ে থাকবে, গলায় শাদা ফিতে (necktie) বাঁধা, সকলের ওপর একটি টেল-কোট (লাঙ্গুল-কোট)―টেল-কোটের সুমুখ দিকটা কোমর পর্যন্ত কাটা, আমাদের চাপকান প্রভৃতি পোশাকগুলি যেমন হাঁটু পর্যন্ত পড়ে এ তা নয়। এর সুমুখ দিকটার সীমা কোমর পর্যন্ত, কিন্তু পেছন দিকটা কাটা নয়, সুতরাং কতকটা ন্যাজের মত ঝুলতে থাকে। আমরা যখন ইংরাজদের হনুকরণ করি তখন বাধ্য হয়ে এই ল্যাজ-কোট পরতে হল, কেননা ল্যাজ-কোট না পরলে হনুকরণ সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। নাচ-পার্টিতে যেতে হলে হাতে এক জোড়া শাদা দস্তানা পরতে হয়, কারণ যে মহিলাদের হাতে হাত দিয়ে নাচতে হবে, তোমার খালি হাত লেগে তাঁদের হাত ময়লা হয়ে যেতে পারে কিম্বা তাঁদের হাতে যদি দস্তানা থাকে তাঁদের দস্তানা ময়লা হয়ে যেতে পারে। অন্য কোনো জায়গায় লেডিদের সঙ্গে সেক্‌হ্যান্‌ড্‌ করতে গেলে হাতের দস্তানা খুলে ফেলতে হয়, কিন্তু নাচের ঘরে তার আবশ্যক হয় না। যা হোক, আমরা তো সাড়ে নটার সময় তাঁদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেম। তখনও নাচ আরম্ভ হয় নি। ঘরের দুয়ারের কাছে গৃহকর্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বিশেষ পরিচিতদের সঙ্গে সেক্‌হ্যান্‌ড্‌ করছেন, অপরিচিতদের প্রতি শিরঃকম্পন করছেন, সকলকে অভ্যর্থনা করছেন। এ গোরাদের দেশে নিমন্ত্রণসভায় গৃহকর্তার বড়ো উঁচু পদ নেই, তিনি সভায় উপস্থিত থাকুন বা শয়নগৃহে নিদ্রা দিন তাতে কারও বড়ো কিছু এসে যায় না। আমরা ঘরে প্রবেশ করলেম, গ্যাসের আলোয় ঘর আলোকাকীর্ণ, কিন্তু শত শত রমণীদের রূপের আলোকে সে গ্যাসের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। চারি দিক উজ্জ্বল, হাস্যময়। রূপের উৎসব পড়ে গিয়েছে, ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবামাত্রই চোখে ধাঁধা লেগে যায়। ঘরের এক পাশে পিয়ানো বেহালা বাঁশি বাজছে, ঘরের চারি ধারে কৌচ চৌকি সাজানো রয়েছে। ইতস্ততঃ দেয়ালের আয়নার ওপর গ্যাসের আলো ও রূপের প্রতিবিম্ব পড়ে ঝক্‌মক্‌ করছে। নাচবার ঘরের মেজে কাঠের, তার ওপর কার্পেট প্রভৃতি কিছু পাতা নেই, সে কাঠের মেজে এমন পালিশ-করা যে পা পিছলে যায়। এখানে ঘর যত পিছল হয় ততই নাচবার উপযুক্ত হয়। কেননা, পিছল ঘরে নাচের গতি খুব সহজ ও সুন্দর হয়, পা কোনো বাধা পায় না, আর আপনা-আপনি পিছ্‌লে আসে। ঘরের চারি দিকে আশে-পাশে যে-সকল বারান্দার মতো আছে, তাই একটু ঢেকে ঢুকে, গাছপালা দিয়ে, দুই-একটি কৌচ চৌকি রেখে lover's bower (প্রণয়ীদের কুঞ্জ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। সেইখানে নাচে শ্রান্ত হয়ে বা কোলাহলে বিরক্ত হয়ে দুই-একটি যুবক যুবতী নিরিবিলি মধুরালাপে মগ্ন থাকতে পারেন। ঘরে ঢোকবার সময় সকলের হাতে সোনার অক্ষরে ছাপা এক-একখানি কাগজ দেওয়া হয়, সেই কাগজে কী কী নাচ হবে তাই লেখা থাকে। ইংরাজি নাচ দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়―এক রকম হচ্ছে স্ত্রী পুরুষে মিলে ঘুরে ঘুরে নাচা, তাতে কেবল দুজন লোক এক সঙ্গে নাচে; আর-এক রকম হচ্ছে চারটি জুড়ি নর্তক নর্তকী চতুষ্কোণ হয়ে সুমুখা-সুমুখী দাঁড়ায় ও হাত-ধরাধরি করে নানা ভঙ্গীতে চলাফেরা করে বেড়ায়, কোনো কোনো সময় চার জুড়ি না হয়ে আট জুড়িও হয়। ঘুরে ঘুরে নাচাকে round dance বলে ও চলা-ফেরা করে বেড়ানোর নাম square dance। নাচ আরম্ভ হবার পূর্বে গৃহকর্ত্রী মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে আলাপ করে দেন; অর্থাৎ পুরুষ-অভ্যাগতকে সঙ্গে করে কোনো এক অভ্যাগত মহিলার কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘মিস অমুক, ইনি হচ্ছেন মিস্টার অমুক।’ অমনি মিস ও মিস্টার পরস্পর পরস্পরকে শিরঃকম্পন করেন। কোনো মিসের সঙ্গে পরিচয় হবার পর তুমি যদি তাঁর সঙ্গে নাচতে ইচ্ছে কর তা হলে পকেট থেকে সেই সোনার জলে ছাপানো programmeটি বের করে তাকে জিজ্ঞাসা করো, ‘আপনি কি অমুক নৃত্যে বাক্‌দত্তা হয়ে আছেন?’ অর্থাৎ ‘আর কেউ কি আগে থাকতে আপনার সঙ্গে অমুক নাচের বন্দোবস্ত করে গেছেন।’ তিনি যদি ‘না’ বলেন তা হলে তাঁকে বোলো, ‘তা হলে কি আমি আপনার সঙ্গে নাচবার সুখ ভোগ করতে পারি?’ তিনি তোমাকে ‘thank you' বললে তুমি বুঝলে যে, তোমার কপালে তাঁর সঙ্গে নাচবার সুখ আছে। অমনি সেই কাগজটিতে সেই নাচের পাশে তার নাম লিখে রেখো, এবং তাঁর কাগজে তোমার নাম লিখে দিয়ো। কাগজটা এই রকম―

নাচের নাম

PROGRAMME
I. Lancers
II. Valse
III. Quadrille
IV. Gallop
V. Polka
 ইত্যাদি

যাদের সঙ্গে নাচবর বন্দোবস্ত হল
তাদের নাম
ENGAGEMENTS

Miss Gordon

Mrs. Egincourt

 ইত্যাদি

 এক পাশে নৃত্যের নাম, অপর এক পাশে নর্তক বা নর্তকীর নাম। নাচের বাজনা বেজে উঠল। অমনি শত শত যুগলমূর্তি হাত ধরাধরি করে নাট্যগৃহে নাচের জন্যে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালেন। নাচ আরম্ভ হল। ঘুর-ঘুর-ঘুর। একটা ঘরে মনে করো, চল্লিশ-পঞ্চাশ জুড়ি নাচছে, ঘেঁষাঘেঁষি, ঠেলাঠেলি, এ ওর ঘাড়ে পড়ছে, এ ওর গাউন মাড়িয়ে দিচ্ছে, জুড়িতে জুড়িতে ধাক্কাধাক্কি, কিন্তু তবু ঘুর-ঘুর-ঘুর। মনে হয় যেন আাহ্লাদে পাগল হয়ে সবাই মিলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তালে তালে বাজনা বাজছে, তালে তালে পা পড়ছে, ঘর গরম হয়ে উঠেছে, আর সে যে কী একটা উত্তেজনার তরঙ্গ উঠেছে সে কী বলব! কোনো নর্তকযুগলের দুজনের দুজনকেই হয়তো খুব ভালো লেগেছে, তাদের দুজনের ঠোঁটে হাসি একেবারে ফেটে পড়ছে। কোনো যুবতীর ভাগ্যে এক বৃদ্ধ কুরূপ নর্তক জুটেছে, তার মুখে আর হাসি নেই, সে অতি আড়ষ্ট ভাবে যন্ত্রের মতে নাচছে। কোনো লেডি partner (সহনর্তক) পান নি, তিনি দেয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে সদ্বেষনয়নে হাসিমুখ ঘূর্ণমান নর্তকযুগলকে নিরীক্ষণ করছেন, আর বিফলে প্রফুল্লতার ভাণ করতে চেষ্টা করছেন। তাঁর নাম wallflower, অর্থাৎ ‘দেয়ালকুসুম’; তিনি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে নাট্যশালার দেয়ালের শোভা বর্ধন করেন। একটা নাচ শেষ হল, বাজনা থেমে গেল, নর্তক মহাশয় তাঁর শ্রান্তসহচরীকে আহারের ঘরে নিয়ে গেলেন; সেখানে টেবিলের উপর ফল মূল মিষ্টান্ন মদিরার আয়োজন। হয়তো আহার পান করলেন, নাহয় দুজনে নিভৃত কুঞ্জে বসে রহস্যালাপ করতে লাগলেন। আমি নতুন লোকের সঙ্গে বড়ো মিলে মিশে নিতে পারি নে, যে নাচে আমি একেবারে সুপণ্ডিত সে নাচও নতুন লোকের সঙ্গে নাচতে পারি নে, প্রতিপদে ভুল হয়, লোকের গাউন মাড়িয়ে দিই, প্রতি লোককে ধাক্কা দিই, বেতালে পা ফেলি, কখনো বা অসাবধানে আমার সহনর্তকীর পাও মাড়িয়ে দিই―আর এই রকম নানা-প্রকার গলদ করে অবশেষে নাচের মাঝখানে থেমে পড়ি ও আমার সহচরীর কাছ থেকে মার্জনা ভিক্ষা করে সে দিক থেকে আস্তে আস্তে পিট্টান দিই। সত্যি কথা বলতে কী, আমার নাচের নেমন্তন্নগুলো বড়ো ভালো লাগে না। অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে ও রকম পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতে আমার আদবে ভালো লাগে না। যাদের সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ আছে, তাদের সঙ্গে নাচতে আমার মন্দ লাগে না। Miss অমুকের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ ছিল, আর তাকে বেশ দেখতে, তার সঙ্গে আমি gallop নেচেছিলেম, তাই জন্যে তাতে আমার কিছু ভুল হয় নি। কিন্তু Miss অমুকের সঙ্গে আমি lancers নেচেছিলেম, তার সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না, আর তাঁকে অতি বিশ্রী দেখতে―তাঁর চোখ দুটো বের-করা, তাঁর গাল দুটো মোটা, দাড়ির দিকটা অত্যন্ত ছোটো, সব চেয়ে তাঁর স্বভাব খিট্‌মিটে―তাঁর সঙ্গে নাচতে গিয়ে যত প্রকার দোষ হওয়া সম্ভব তা ঘটেছিল। যেমন তাস খেলবার সময়ে খারাপ partner পেলে তার ’পরে তার দলের লোক চটে যায়, তেমনি নাচের সময় খারাপ partner পেলে মেয়েরা ভারী চটে যায়। তিনি বোধ হয় নাচবার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন। নাচ ফুরিয়ে গেলে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেম, তিনিও নিস্তার পেলেন। আমি একবার একটি সুন্দরী partner পেয়েছিলেম। তাঁর সঙ্গে না নাচতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেম। কিন্তু গৃহকর্ত্রী আমাকে বিশেষ করে নাচতে অনুরোধ করলে, পীড়াপীড়ির পর নাট্যশালায় অবতরণ করলেম―কোনো মতে নাচটা সমাপন করে দে ছুট! প্রথমে নাচের ঘরে ঢুকেই আমি একেবারে চমকে উঠেছিলেম। দেখি যে, শত শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে আমাদের একটি ভারতবর্ষীয়া শ্যামাঙ্গিনী রয়েছেন। দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নেচে উঠেছিল। আমার তাকে এমন ভালো লাগল যে কী বলব! তার সঙ্গে কোনো মতে আলাপ করবার জন্যে আমি তো ছটফট করে বেড়াতে লাগলেম্‌। কতদিন মনে করো কালো মুখ দেখি নি। আর, তার মুখে আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভালোমানুষি নম্রভাব এমন মাখানো যে কী বলব! আমি অনেক ইংরেজ মেয়েদের মুখে ভালোমানুষি নরম ভাব দেখেছি, কিন্তু এর সঙ্গে তার কী একটা তফাত আছে বলতে পারি নে। তার চুল বাঁধা আমাদের দেশের মতো, শাদা মুখ দেখে দেখে আর উগ্র অসংকোচ সৌন্দর্য দেখে দেখে আমার মনটা ভিতরে ভিতরে বড়ো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল―এতদিনে তাই বুঝতে পারলেম। সেই শ্বেতাঙ্গিনীদের সভায় একটি কালো মিষ্টি মুখ দেখে আমার মনটা চুম্বকের মতো সেই দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। আমার বোধ হয় এ রকম হবার মানে আছে―হাজার হোক, ইংরেজ মেয়েরা সম্পূর্ণ আলাদা জাত, তারা আমাদের কথাবার্তা ভাবভঙ্গী আচারব্যবহারের মর্মের ভিতরে ঢুকতে পারে না। আমি এতদূর ইংরিজি ভাব শিখি নি যে তাদের সঙ্গে বেশ খোলাখুলি পরিচিত ভাবে কথাবার্তা কইতে পারি। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কথাবার্তা কবার যে-সকল বাঁধি গৎ আছে সেগুলি খুব ঝাড়তে পারি―আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, সম্প্রতি অপেরায় যাওয়া হয়েছিল কি না, অমুক থিয়েটরে অমুক অভিনেতার অভিনয় কেমন লাগল, আজ ভারী ভালো দিন ইত্যাদি―এই-সকল বাঁধি গতের সীমা লঙ্ঘন করতে সাহস হয় না। ইংরিজি মনের ভাবগতি খুব ভালো রকম জানলে তবে নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে দুই-একটা কথাবার্তা কওয়া যেতে পারে। ভারতবর্ষীয়েরা আমাদের আপনাদের লোক, তাদের কাছে আমাদের অধিকার অনেকটা বিস্তৃত, চন্দ্রলোকের একটা মেয়ে মনে করে তাদের কাছে ঘেঁষতে তেমন একটু ইতস্ততঃ করবার ভাব আসে না। যা হোক, দুঃখের কথা বলব কী, যখন আমি একেবারে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি তখন শোনা গেল যে, সে একটি ফিরিঙ্গি মেয়ে। শুনে আমার মনটা একেবারে বিগড়ে গেল, আর তার সঙ্গে আলাপ করা গেল না, কিন্তু কালো মুখের ছাপ আমার মনে রয়ে গেল।

 আজ ব্রাইটনের অনেক তপস্যার ফলে সূর্য উঠেছেন। এ দেশে রবি যে দিন মেঘের অন্তঃপুর থেকে বের হন সে দিন এ দেশে একটি লোকও কেউ অন্তঃপুরে থাকে না―সে দিন লোকেরা একটু বেড়িয়ে বাঁচে। সে দিন সমুদ্রের ধারে বেড়াবার রাস্তায় লোক কিল্‌বিল্‌ করতে থাকে―এ দেশে যদিও ‘বাড়ির ভিতর’ নেই, তবু এ দেশের মেয়েরা যেমন অসূর্যম্পশ্যরূপা এমন আমাদের দেশে নয়―এ দেশের সূর্যই যখন অনেত্রম্পশ্যরূপ তখন এ দেশের মেয়েরাও তো অসূর্যম্পশ্যরূপা হবেই।

 সাড়ে আটটার কমে আমাদের বিছানা থেকে ওঠা হয় না। ছটার সময় বিছানা থেকে উঠলে এ দেশের লোকেরা এত আশ্চর্য হয় যে, দিন-দুপরে একটা স্কন্ধকাটা দেখলেও তারা সে রকম আশ্চর্য হয় না। তার পরে উঠেই আমি বোজ ঠাণ্ডা জলে স্নান করি। এ দেশের লোকেরা যাকে স্নান বলে আমি সে রকম স্নানের বিড়ম্বনা করি নে। আমি মাথায় জল ঢেলে স্নান করি; গরম জল নয়―এখানকার এই বরফের মতো ঠাণ্ডা জল। মাথায় জল ঢেলে স্নান করাকে এ দেশের লোকে অসাধারণ বীরত্ব মনে করে। আমার নাম যে কেন এখনও ছাপার কাগজে উঠে যায় নি আমি তাই ভাবছি। নটার সময় আমাদের খাবার আসে। এখানকার ৯টা আর সেখানকার ৬টা সমান। আমাদের আরএকটি খাওয়া দেড়টার সময়, সেইটিই প্রধান খাওয়া―মধ্যাহ্নভোজন। প্রত্যহ ... পার করছি তাতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই, মাঝে মাঝে ভেড়ার পদসেবাও করে থাকি। মধ্যে একবার চা রুটি প্রভৃতি আসে, তার পরে রাত আটটার সময় আর-একটি সুপ্রশস্ত ভোজনের আয়োজন হয়ে থাকে―এই রকম আমাদের দিনের প্রধান কার্য হচ্ছে খাওয়া।

 অন্ধকার হয়ে আসছে, চারটে বাজে ব’লে, চারটে বাজলে পরে আলো না জ্বেলে পড়া দুষ্কর। এখানে প্রকৃত পক্ষে ৯টার সময় দিন আরম্ভ হয়, কেননা গড়ে রোজ আটটার কমে ওঠা হয় না। এখানকার লোকের ছটার সময় হয়তো দুপর রাত্তির, এ দেশের প্যাঁচারা ছাড়া আর কেউ তখন জেগে নেই। তার পরে আবার বৈকাল চারটের সময়েই এখানকার দিনের আলো নিভে যায়, তাই এখানকার দিনগুলো এমন ছোটো মনে হয় যে কী বলব। এখানকার দিনগুলো যেন দশটার সময় আপিস করতে আসে, আর চারটের সময় বাড়ি ফিরে যায়। এখানে কাজ ক’রে অবসর পাওয়া দূরে থাক্‌, কাজ করবার অবসর পাওয়া যায় না। সন্ধ্যের পর আমার মনের জড়-অবস্থা হয়, এমন জড়-অবস্থা হয় যে তখন আর কোনো কাজ করবার শক্তি থাকে না। সুতরাং আমার এ রকম ছোটো দিনের সঙ্গে কারবার করা পুষিয়ে উঠছে না―ট্যাঁক-ঘড়ির ডালা খুলতে খুলতেই এ দেশের দিন চলে যায়। এখানকার রাত্তির তেমনি ঘোড়ায় চড়ে আসে, আর পায়ে হেঁটে চলে যায়―সে আর ফুরোয় না। এখানকার দিনগুলি যে কেবল অচিরস্থায়ী তা নয়, যতক্ষণ থাকে তাই নাহয় একটু ভদ্রলোকের মতো থাক্‌, তা নয়―মুখ ভার করে খুঁৎখুঁৎ করতে করতেই তাঁর সমস্ত সময় চলে যায়।

 মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত―এ আর এক দণ্ডের তরে ছাড়া নেই। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয় তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়―তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে। এখানে এ তা নয়, এ টিপ্ টিপ্ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই―সে কেমন একটা ভিজে-ভিজে ভাব। রাস্তায় কাদা, পত্রহীন গাছগুলো স্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, কাঁচের জানলার উপর টিপ্ টিপ্ করে জল ছিটিয়ে পড়ছে, কেমন একটা অন্ধকার-অন্ধকার করে এসেছে। আমাদের দেশে যেমন স্তরে স্তরে মেঘ করে, এখানে আকাশ সমতল―মনে হয় না যে মেঘ করেছে, মনে হয় কোনো কারণে আকাশের রঙটা ঘুলিয়ে গিয়েছে। সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবর জঙ্গমের যে কী-একটা অবসন্ন মুখশ্রী দেখা যায় তা বর্ণনা করা যায় না। লোকের মুখে সময়ে সময়ে শুনতে পাই বটে যে কাল বজ্র হয়েছিল, কিন্তু বজ্রের নিজের এমন গলার জোর নেই যে তাঁর মুখ থেকেই সে খবরটা পাই—এখানকার বজ্রধ্বনি শুনতে গেলে বোধ হয় microphone ব্যবহার করতে হয়। সূর্য তো এখানে গুজবের মধ্যে হয়ে পড়েছে। যদি অনেক ভাগ্যবলে সকালে উঠে সূর্যের মুখ দেখতে পাই, তবে তখনি আবার মনে হয়—

‘এমন দিন না রবে— তা জানো’।

 এই অন্ধকার দেশে আমার বুদ্ধি-শুদ্ধি সমস্ত যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে—কিছু লেখা বেরোয় না, এমন-কি গুছিয়ে একটা চিঠিও লিখতে পারি নে। চিঠি লেখবার বা অন্য কিছু লেখবার কথা মনে হলেই আমার কেমন হাই উঠতে থাকে। দেশের সে সূর্যালোক ও জ্যোৎস্না কেমন সুখস্বপ্নের মতো মনে পড়ে। আমাদের দেশে সেই সকাল-সন্ধ্যার ও জ্যোৎস্নারাত্রির মর্যাদা এ দেশে এসে বিশেষ করে বুঝতে পেরেছি।

 দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে। লোকে বলছে, কাল পরশুর মধ্যে হয়তো আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব। তাপমান যন্ত্র ৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেবে গিয়েছে— সেই তো হচ্ছে freezing point, অল্পস্বল্প frost দেখা দিয়েছে। রাস্তার মাটি খুব শক্ত হয়ে গিয়েছে, কেননা তার মধ্যে যা জল ছিল সমস্ত জমাট হয়ে গিয়েছে, রাস্তার মাঝে মাঝে কাচের টুকরোর মত শিশির খুব শক্ত হয়ে জমে গিয়েছে, দুই-এক জায়গায় ঘাসের মধ্যে কে যেন চুন ছড়িয়ে দিয়েছে— বরফের এই প্রথম সূত্রপাত দেখছি। খুবই শীত পড়েছে, এক-এক সময়ে হাত পা এমন ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে জ্বালা করতে থাকে। সকালে লেপ থেকে বেরোতে যত ভাবনা হয়, সহমরণে যেতে হলেও আমার তত ভাবনা হয় না। কিন্তু আমার বীরত্বের কাহিনী শুনলে হয়তো তুমি অবাক হয়ে যাবে। সেই সকালে উঠেই আমি বরফের মত ঠাণ্ডা জল মাথায় ঢেলে স্নান করি। মনে হয় মাথাটা যেন খসে পড়ল, সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে যায়―কিন্তু তার পরেই যে প্রতিক্রিয়া উপস্থিত হয় তাতে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যেতে হয়।

 আমাদের দিশি কাপড় দেখে রাস্তার এক-এক জন সত্যি-সত্যি হেসে ওঠে, এক-এক জন এত আশ্চর্য হয়ে যায় যে তাদের আর হাসবার ক্ষমতা থাকে না। কত লোক আমাদের জন্যে গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছে, তারা আমাদের দিকে এত হাঁ ক’রে চেয়ে থাকে যে পেছনে গাড়ি আসছে হুঁশ নেই। প্যারিসে আমাদের গাড়ির পিছনে পিছনে এক দঙ্গল ইস্কুলের ছোকরা চীৎকার করতে করতে ছুটেছিল, আমরা তাদের সেলাম করলেম। এক-এক জন আমাদের মুখের উপর হেসে ওঠে, এক এক জন চেঁচাতে থাকে―'Jack, look at the blackies!' কিন্তু আমি সে-সব কিছুই গ্রাহ্য করি নি, আমার এক তিলও লজ্জা করে না।