নবম পত্র

আর-বারে আমি অন্য লোকদের মুখ থেকে তাঁদের বিলেতের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে যে জ্ঞান লাভ করেছিলুম তোমাদের উপকারার্থে তা আমি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে যথা সময়ে পাঠিয়েছি। আমার যা কর্তব্য তা আমি করেছি, এখন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে সেটি আদ্যোপান্ত পাঠ করা ও সে বিষয়ে তোমাদের মতামত ব্যক্ত করে যত শীঘ্র পারো আমাকে একটা উত্তর লিখে পাঠানো। কেমন?

 এর আগে তোমাদের যে-সব চিঠি পাঠিয়েছি তাতে যখন যা মনে হয়েছে বলেছি, এখন সেইগুলোকে আর-একটু শৃঙ্খলবদ্ধ করে লিখতে চাই। এখেনে কী কী দেখে আমার মনে কিরকম সংস্কার হল, আমি কী নতুন জ্ঞান লাভ করলুম, আমার মনে কী নতুন মত গড়া হল ও কী পুরোনো মত ভেঙে গেল, তাই লিখতে চেষ্টা করব। অতএব এবারকার চিঠির প্রধান নায়ক হচ্ছেন ‘আমি’। প্রথম, থেকে শেষ পর্যন্ত— ‘আমি’। সুতরাং খুব সম্ভব যে, এই চিঠির কাগজের চার পৃষ্ঠা —পূর্ণ অহমিকা পড়তে পড়তে অর্ধ পথে তোমার গা ঝিমিয়ে আসবে, চোখের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে ও নাসারন্ধ্র হতে একটা বেসুরো কোলাহল উত্থিত হতে থাকবে। ‘আমি’ পদার্থের মতো প্রিয় ও আমোদজনক আর কী হতে পারে বলো। কিন্তু আমরা সকল সময়ে বিবেচনা করি নে যে, ‘আমি’ আমারই কাছে ‘আমি’, কিন্তু তোমার কাছে ‘তুমি’ বৈ আর কিছুই নয়। এই রকম সাত পাঁচ ভেবে ‘আমি’ বলে একটা বস্তুকে সহসা তোমাদের সভার মধ্যে নিয়ে গিয়ে বলপূর্বক খাড়া করে তুলতে আমার কেমন সংকোচ বোধ হচ্ছে। বিলেত সম্বন্ধে আমার নিজের যৎসামান্য অভিজ্ঞতার সারাংশ প্রকাশ করতে প্রস্তুত হয়েছি। এইখানে একটা কথা বলে রাখি, কথাটা কিছু গম্ভীর ছাঁচের। অভিজ্ঞতা বলতে কী বোঝায়? কতকগুলি বিশেষ ঘটনার বিষয়ে জ্ঞান সংগ্রহ করা ও তার থেকে একটা সাধারণ মত প্রতিষ্ঠা করে নেওয়া। আমি অতি বিনীত ভাবে নিবেদন করছি যে, যে দিক থেকে দেখো, আমার অভিজ্ঞতার মূল্য বড়ো অধিক নয়। প্রথমতঃ, আমি এখেনে এত অধিক দিন নেই ও এত বিশেষ সুবিধে পাই নি যা থেকে এখানকার সমাজের অনেক দেখে শুনে নিতে পারি; দ্বিতীয়তঃ, বিশেষ ঘটনাবলী থেকে একটি যথার্থ সাধারণ মত তৈরি করে নিতে যতটা বুদ্ধির আবশ্যক ততটা আপাততঃ আমার তহবিলে আছে কি না সে বিষয়ে আমার নিজের ও আমার আলাপী বন্ধুবর্গের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। অতএব আমার এই আধ-সিদ্ধ অভিজ্ঞতার ব্যঞ্জনগুলো তোমাদের পাতে দিচ্ছি, যদি রুচিজনক হয় ও তোমাদের পাকযন্ত্রের হানি-জনক বিবেচনা না করে। তা হলে সেবা কোরো। এইখানে আমার উদ্যোগপর্ব ও বিনয়পর্ব শেষ করে প্রবন্ধের যথাশাস্ত্র মুখবন্ধ করে প্রকৃত প্রস্তাব আরম্ভ করি।

 আমরা লণ্ডনে দুই-এক ঘণ্টা থেকেই ব্রাইটনে প্রস্থান করি। ব্রাইটন সমুদ্রের ধারে— একটা বড়ো শৌখিন (fashionable) শহর। দেখতে শুনতে আকারে ইঙ্গিতে লন‍্ডনেরই মতো, কেবল লন‍্ডনের মতো সে রকম অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন ভ্রূকুটিকুটিলমুখ নয়। আমাদের একটি বাঙালি পরিবার ব্রাইটনে বাস করেন, তাঁদের সেখেনে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। দেখি যে আমাদের গৃহিণী তাঁর দিশি বস্ত্র প’রে ছেলেপিলে নিয়ে ঘরে অন্নপূর্ণার মতো বিরাজ করছেন।

 তাঁর দিশি কাপড় দেখে তাঁর বিলিতি বন্ধুরা অত্যন্ত প্রশংসা করেন ও তাঁর দিশি বন্ধুরা সেই পরিমাণে খুঁৎখুঁৎ করেন। তাঁর দিশি কাপড় দেখে তাঁর বিলিতি বন্ধু Miss - বলেন ‘ঐ রকম ভাঁজভাঁজ কাপড়ে যে-একটি সুন্দুর শ্রী আছে, তা আঁট-সাঁট ছাঁটা-ছোঁটা গাউনে পাওয়া যায় না’; তাঁর দিশি বন্ধু Miss -(একজন বিলিতি বাঙালি) বলেন যে, ‘যে কাপড়টা পরা হচ্ছে সেটা একে তো সম্পূর্ণ দিশি নয় (অর্থাৎ ফিন্‌ফিনে শান্তিপুরে শাড়ি নয়) তার উপরে তাতে যদি এক রত্তি শ্রী থাকত তা হলেও নাহয় ভদ্রসমাজে পরা যেত, কিন্তু তাও নেই।’ এই রকম বিলিতি ও দিশি বন্ধুদের মধ্যে মতের আকাশ পাতাল তফাত দেখা যাচ্ছে। আমি তো আগে বলেছি যে, বাঙালি সাহেব হয়ে উঠলে তিনি সাহেবের ঠাকুরদাদা হয়ে ওঠেন; আপনার লোক পর হয়ে গেলে সে যেমন পর হয়ে যায় এমন আর কেউ হয় না। যা হোক, আমাদের দেবীর যে এখনো অনেকগুলি ‘কুসংস্কার’ আছে দেখে আমরা তৃপ্তি লাভ করলেম। এমন-কি তিনি বললেন যে, বিলেতে এসে তাঁর ‘কুসংস্কার’গুলি আরও বদ্ধমূল হচ্ছে। কী সর্বনাশ! দেশের উপর ভালোবাসা আরও বেড়েছে। কী আশ্চর্য! তিনি বললেন তাঁর মনের এতদূর পর্যন্ত উন্নতি হয় নি যে, সার্বভৌমিক ভাব তাঁর মনে বদ্ধমূল হতে পারে, বরঞ্চ সে বিষয়ে তাঁর মন আরও সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। তোমরাই বলো, বিলেতে এসেও এঁর যদি এই দুর্দশা তা হলে এঁর কি আর শোধরাবার উপায় আছে? ছেলেপিলেরা দেখলুম অত্যন্ত খুশিতে আছে, তাদের স্ফর্তি ও উদ্যম দেখে কে! সমস্ত দিনের মধ্যে লাফালাফি হুটোপাটির তিলেক বিশ্রাম নেই। এইমাত্র সু—এসে আমার লেখার সম্বন্ধে কত শত প্রকার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিল। জিজ্ঞাসা করছিল কী করে আমি এত বড়ো চিঠি বাড়িতে লিখি, সে এর অর্ধেকও লিখতে পারে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এত বড়ো চিঠি লেখবার আবশ্যক কী, ছোটো করে লিখলে তো সেই একই কথা। তৃতীয় প্রশ্ন হল, ‘অত কষ্ট করে হাতে করে না লিখে যদি ছাপিয়ে পাঠিয়ে দেও তা হলে কী হানি’ছাপিয়ে পাঠালে তার মতে কত প্রকার সুবিধে তাই একে একে বলতে লাগল। তার পরে আমার চিঠি পড়তে চেষ্টা করতে লাগল। তার পরে তার শেষ উপসংহার হচ্ছে যে আমার লেখা অত্যন্ত খিজিবিজি, বাঁকাচোরা, অপরিষ্কার (সে নিজে বুঝতে পারলে না ব’লে বোধ হয়) —মুক্ত কণ্ঠে এই মতটি ব্যক্ত করে টেবিলের চারি দিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করলে। ইতিমধ্যে কখন বি— এসে আমার চৌকির পিছন দিক থেকে আমার কাঁধে চড়ে বসবার বন্দোবস্ত করছে, তাকে কাঁধে চড়তে দেখে সু—র জেদ হল সেও কাঁধে চড়বে, অবশেষে দুজনে আমার দুই কাঁধে চড়ে বসেছে— আমি তো এই অবস্থায় লিখছি। তোমরা এ কথা শুনে হয়তো অবাক হয়ে গেছ— বিশেষতঃতুমি যে শাসনভক্ত, তোমার চুল হয়তো দাঁড়িয়ে উঠেছে। এ ছেলেদের পেলে তুমি দিন-কতক পিটিয়ে মনের সাধ মেটাও— না? দুরন্ত ছেলে তুমি দু চক্ষে দেখতে পারো না। তুমি চাও— ছেলেরা গুরুলোকদের কাছে চুপচাপ করে ঘাড়টি গুঁজে বসে থাকবে, কথা জিজ্ঞাসা করলে তবে কথা কবে, কথা কবার সময় গলার স্বর অত্যন্ত নিচু হবে, গুরুলোকদের সাক্ষাতে কোনো প্রকার নিজের মত ব্যক্ত করবে না,[] তাঁদের অত্যন্ত ভক্তি ও মান্য করবে ইত্যাদি। এ যে শুধু ছেলেপিলেদের প্রতিই খাটবে তা নয়, গুরুলোকদের কাছে লঘু লোক মাত্রেরই এই-সকল কর্তব্য। তোমার মত হচ্ছে: লালনে বহুবোদোষাস‍্তাড়নে বহুবোগুণাঃ, তস্মাৎ পুত্রঞ্চ ভৃত্যঞ্চ তাড়য়েন্নতু লালয়েৎ।[] যা হোক, এই ভক্তির বিষয়ে আমার অনেকটা মতপরিবর্তন হয়েছে, সে বিষয়ে তোমাদের একটুকু বিস্তৃত করে বলছি। আমাদের সমাজের পথে ঘাটে ভালোবাসার চেয়ে ভক্তির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আমাদের দেশে পরিবারের মধ্যে গুরুজনের সম্বন্ধে ভালোবাসার সম্পর্ক যেন একেবারে নেই;[] সমস্তই ভক্তি ও স্নেহ। বয়সের অতি সামান্য তারতম্যে, সম্পর্কের অতি সামান্য উঁচু-নিচুতে, ভক্তি ও স্নেহের সম্পর্ক স্থাপিত হয়; অত কথায় কাজ কী, আমাদের তা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক মূলে নেই— কেবল যমজ সন্তানদের মধ্যে কিরকম হয় বলতে পারি নে। কিন্তু এ রকম ভক্তিকে ভক্তি নাম দিলে সে নামের অসদ‍্ব্যবহার করা হয়—এ এক রকম অস্বাভাবিক মনোবৃত্তি, এক রকম অস্বাভাবিক ভয়। বড়োদের আমরা স্বভাবতই ভক্তি করি, তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেখে আমরা স্বভাবতই তাঁদের উপর নির্ভর করি, কিন্তু আমাদের পরিবারের মধ্যে যে ভক্তি যে নির্ভরের ভাব বদ্ধমূল সে কি স্বাভাবিক? প্রতি পদে শিক্ষা শাসন ও অভ্যাসের প্রভাবেই কি তার জন্ম হয় না? ছেলেবেলা থেকে প্রতি পদে আমাদের কানে মন্ত্র দিতে হয় যে, পিতা দেবতুল্য, গুরু দেবতুল্য। কেন, দেবতুল্য কেন? দেবভাবের কঠোর ও সুদূর সম্ভ্রম কেন তাঁদের উপর অর্পণ করা হয়? তাঁরা আমাদের ভালোবাসার পিতা, ভালোবাসার মাতা, ভালোবাসার সঙ্গে আমরা তাঁদের মুক্ত আলিঙ্গনে গিয়ে বদ্ধ হব[] না যোড়হস্তে বিনীত ভাবে, আমাদের মানুষ পিতার কাছে না গিয়ে, আমাদের জাতের বহির‍্ভুক্ত কোনো দেবতুল্য ব্যক্তির কাছে গিয়ে অতি সন্তর্পণে বসে থাকব—অতি মৃতম্বরে কথা কব— অতি নত ভাবে আত্মনিবেদন করব? এর মধ্যে কোন্‌টা স্বাভাবিক?[] আমাদের পরিবারে গুরুলোকদের ’পরে এই রকম একটা অস্বাভাবিক ভক্তির উদ্রেক করে দেওয়া হয়, গুরুলোকেরাও সেই অন্ধ ভক্তির প্রভাবে বলীয়ান হয়ে ছোটোদের উপর যথেচ্ছব্যবহার করেন। তাঁরা চান, তাঁদের সমস্ত মত সমস্ত আজ্ঞা ছোটোরা অবিচারে শিরোধার্য করে নেয়, সে বিষয়ে তারা তিলমাত্র দ্বিরুক্তি বা দ্বিধা না করে; যেন ছোটোরা কতকগুলি কলের কাঠের পুতুল, তাদের মন নেই, তাদের মনোবৃত্তি নেই, তাদের ইচ্ছে নেই, তাদের বিচারশক্তি নেই! সংসারে তোমার যত প্রকার বড়ো আছে (কেবল লম্বায় ছাড়া) তাদের কাছে তোমার বিবেচনা ও ইচ্ছে কিছুমাত্র খাটিয়ো না, সেগুলি আপাততঃ সঞ্চিত করে রেখে দেও, অবসর পেলে তোমার ছোটোদের কাছে তা অন্ধভাবে খাটাতে পারবে; তাতে সমাজের কোনো আপত্তি নেই। আমাদের শাস্ত্রে বলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা[] পিতৃতুল্য, কনিষ্ঠ ভ্রাতা পুত্রতুল্য; শুনে শুনে অভ্যেস হয়ে গেছে বলে ও আমাদের দেশে এই রকম একটা ভাব বর্তমান আছে বলে এর হাস্যজনকতা ঘুচে গিয়েছে, নইলে এর চেয়ে অদ্ভুত আর কী হতে পারে? ভ্রাতা কি ভ্রাতার তুল্য হতে পারে না? সংসারে কি পিতা পুত্র ছাড়া আর কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই? ভাই ভাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃভাব বলে কি একটা ভাব বর্তমান নেই? কোনো প্রকারে কান ধরে ভাইয়ের সম্পর্ক কি পিতা পুত্রের সম্পর্কের সঙ্গে মেলাতে হবেই? এমন যন্ত্রণাও তো দেখি নি। তা হলে তো তুমি বলতে পারো হাত মাথার তুল্য; কিন্তু আমি বলি ও রকম তুলনার স্পৃহাটি পরিত্যাগ করে হাতকে হাতের স্থানে ও মাথাকে মাথার স্থানে স্ব স্ব কাজে বজায় রাখা হোক। প্রকৃতি যা করে দিয়েছে সেটাকে ভেঙেচুরে মুচড়ে একটা বিকৃতাকার করে তুলো না। আমাদের দেশের শাস্ত্র যেমন (শাস্ত্র বোধ হয় সকল দেশেই সমান) আজ্ঞা করে, বুঝিয়ে বলে না— ভয় দেখায়, কারণ দেখায় না— আমাদের গুরুলোকেরাও তাই করেন। তাঁরা প্রতিপদে কারণ না দেখিয়ে আজ্ঞা করেন, ছোটো যদি একবার জিজ্ঞাসা করে ‘কেন?’ তা হলে তাঁরা চোখ রাঙিয়ে বলেন, ‘হাঁ, এত বড়ো স্পর্ধা!’ এতে যে ছোটোদের মনের একেবারে সর্বনাশ হয় তা তাঁরা বোঝেন না। একটা ঘোড়া কিম্বা এক পাল গোরুকে অবিচারে যেখানে ইচ্ছে চালিয়ে বেড়াও তাতে হানি নেই, কেননা তাতে বড়ো জোর তাদের শরীরের কষ্ট হবে, কিন্তু তাতে তাদের মনোবৃত্তির বিকাশ ও বিচারশক্তি-পরিস্ফুটনের কোনো ব্যাঘাত হবে না। কিন্তু কোনো মানুষকে সে রকম কোরো না, বিশেষতঃ তোমার নিজের ভাই নিজের ছেলেকে। তুমি নিশ্চয় জেনো যে, ছেলেবেলা, আমাদের মন খুব কোমল থাকে, তখন থেকে যদি আমরা ক্রমাগত যুক্তিবিহীন আজ্ঞা পালন করে আসতে থাকি, বড়ো লোক বলছেন বলেই দ্বিরুক্তি না করে সব কথা আমাদের শিরোধার্য করে নিতে হয়, তা হলে বড়ো হলেও আমাদের মনের সে অস্বাভাবিক অভ্যাস দূর হয় না, প্রশ্ন করার স্বভাবটা একেবারে চলে যায় আর সে রকম মনে কুসংস্কার অতি শীঘ্র আপনার শিকড় বিস্তার করতে পারে।[] আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকদের একবার দেখো-না— তাঁরা অনেক পড়েছেন, কিন্তু তবু নিজের একটা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে তাঁদের কেমন সাহস হয় না। যদি মিল কিম্বা স্পেন‍্সেরের নাম করে তাঁদের নিতান্ত একটা আজগুবি কথা বলো, দ্বিরুক্তিমাত্র না করে তা তাঁরা মাথায় করে নেন; বিলিতি কেতাবে ইংরাজি ছাপার অক্ষরে যা লেখা আছে তা তাঁরা আর বুঝে হজম করতে শ্রম স্বীকার করেন না, শুক পাখির মতো মুখস্থ করে যান, কেননা বিলিতি ‘authority’র উপর তাঁদের এমন অটল ভক্তি যে বিচার না করেই ধরে নেন যে কথাগুলো সত্য হবেই। তাতে আমি তাঁদের দোষ দিতে পারি নে; কেননা ছেলেবেলা থেকে তাঁদের মন এমনি ছাঁচে গড়া যে, বড়ো লোকের মুখের সামনে একটা প্রশ্ন করতে তাঁদের বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করে, বড়ো লোক যা বলেছেন তার উপরে আর কথা নেই।[] তবে দুই বড়ো লোকের মধ্যে যখন মতের অনৈক্য হয়, তখন আমরা চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকি- আর-একজন বড়ো লোক এসে তার কী মীমাংসা করে দেন। আমরা বড়ো লোকের নামের ঢেউ দেখলেই যুক্তির হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি। কিন্তু এ রকম না হওয়াই আশ্চর্য। আমাদের নীতিশাস্ত্রে গুরুলোকের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মবিসর্জন করাই হচ্ছে পুণ্য।[] ছোটোদের পক্ষে গুরুদের আজ্ঞা পালন করা বাস্তবিকই ভালো, আমি ছোটোদের গুরুদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করতে বলছি নে, কিন্তু গুরুদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন যে তাঁরা যেন ছোটোদের আজ্ঞা না করেন; হয় অনুরোধ করেন নয় কারণ প্রদর্শন করেন, যখন কারণ প্রদর্শন করেও ফল হল না তখন একটুখানি গুরুত্ব প্রয়োগ করতে পারেন। কেননা, অপরিমিত ভক্তির রাজ্যে যুক্তির অত্যন্ত হীন পদ; তিনি ক্রমে এত মুষড়ে যেতে থাকেন যে অবশেষে তাঁর আর মাথা তোলবার শক্তি থাকে না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের আবার একটাআধটা গুরুলোক নয়, পদে পদে গুরুলোক। এই রকম ছেলেবেলা থেকে গুরুভারে অবসন্ন হয়ে একটি মুমূর্ষু, জাতি তৈরি হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে বলের অন্ধ দাসত্ব করে আসছে, সুতরাং বড়ো হলে সে অবস্থা তার নতুন বা অরুচিজনক বলে ঠেকে না, তার কাছে এ অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আজ্ঞা[১০] পালন করে করে তার এমন অবস্থা হয়ে যায় যে, আজ্ঞা করে বললেই তবে সে একটা কথা গ্রাহ্য করে, বুঝিয়ে বলতে গেলেই বেঁকে দাঁড়ায়। এখনকার বিখ্যাত বাংলা-লেখকদের লেখায় কেমন একটা আজ্ঞার ভাব দেখতে পাওয়া যায়— কথাগুলি অসন্দিগ্ধ, স্পষ্ট, জোর-দেওয়া; পাঠকদের সঙ্গে সমান আসনে বসে যে বিচার করছেন তা মনে হয় না কিম্বা কথা কয়ে কয়ে যে চিন্তা করছেন তাও মনে হয় না, তাঁরা কতকটা গুরুমহাশয়ের মতো কথা কন; মনে হয় হাতে একটা বেত আছে, চোখে একটা চশমা আছে, মুখে একটা কঠোর স্বাতন্ত্র্যের ভাব বর্তমান—ইংরাজিতে যাকে dogmatic বলে তাঁদের লেখার আপাদমস্তক সেই রকম। তাতে তাঁদের দোষ নেই, নইলে পাঠকেরা তাঁদের কথা মানে না; পাঠকেরা যেই দেখেছেন তুমি একটু ইতস্ততঃ করছ কিম্বা একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলছ না, কিম্বা তােমার উচ্চ আসন থেকে এতদুর পর্যন্ত নেবে এসেছ যে তাঁদের সঙ্গে সমান ভাবে বিচার করতে প্রবৃত্ত হয়েছ, তা হলেই তােমার কথা একেবারে অগ্রাহ্য হয়ে দাঁড়ায়। তুমি যুক্তি না দেখিয়ে একটা কথা জোর করে বলো (অবিশ্যি তােমার একটু নাম থাকা দরকার) তাঁরা মনে করেন ‘এটা বুঝি একটা ধরা-কথা, কেবল অজ্ঞতাবশতঃ আমরা জানি নে’; তাঁরা অপ্রস্তুত হয়ে সমস্বরে সবাই মিলে বলে ওঠেন, ‘হাঁ এ কথা সত্য, এ কথা সত্য।’ যুক্তি দেখাতে গেলেই তাঁরা মনে করেন তবে বুঝি এটাতে কোনাে প্রকার সন্দেহ আছে, এটা একটা স্থির সিদ্ধান্ত নয়; অমনি তাঁরা চোখ-টেপাটেপি করতে থাকেন; অত্যন্ত অবিশ্বাসের ভাব দেখান; মনে করেন এ বিষয়ে অনেক কথা ওঠানাে যেতে পারে, অর্থাৎ আমি যদি বা না পারি আমার চেয়ে আর কোনাে বুদ্ধিমান জীব হয়তাে পারেন, যুক্তিটা নেই যে আমি বলে যাব ‘হাঁ সত্যি’— আবার দুদণ্ড বাদে যদি ওর একটা ভুল বেরিয়ে পড়ে তা হলে কি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ব? পাঠকেরা যে লেখকের কথা পালন করতে চান সে লেখকের পাঠকদের চেয়ে একটা স্বতন্ত্র প্রাণী হওয়া আবশ্যক; পাঠকদের কাছে এমন বিশ্বাস জমিয়ে দিতে হবে যে তিনি সব জানেন, তাঁর উপরে আর কারও কিছু বলবার কথা নেই। বলবার কথা থাকলেই তিনি একেবারে মাটি হয়ে গেলেন। তার মূল কারণ, ছেলেবেলা থেকে আমরা শাসনের বশ, যুক্তির রামরাজ্যে আমরা বাস করি নি। তুমি ঘর থেকে গ’ড়ে-পিটে তৈরি করে আমাদের একটা অসন্দিগ্ধ আজ্ঞা দেও আমরা পালন করব, কিন্তু তােমার ঝুড়ি থেকে তােমার যুক্তির মালমশলাগুলি বের করে আমাদের সুমুখে একটি পরামর্শ তৈরি করো যে কোনো কাজে লাগবে না। কেননা আমরা ছেলেবেলা থেকে আমাদের গুরুলোকদের অভ্রান্ত বুদ্ধির উপর নির্ভর করছি, আমরা যেখেনেই আমাদের নিজের মত খাটাতে গিয়েছি সেইখেনেই তাঁরা ছেলেমানুষ বলে আমাদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কখনো যুক্তি দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করেন নি। ছেলেমানুষের কাছে যুক্তি প্রয়োগ করা তাঁরা বৃথা পরিশ্রম মনে করেন। আমাদের শাস্ত্রকারেরাও এক কালে তাই মনে করতেন; তাঁরা শ্রম সংক্ষেপ করবার জন্যে সত্যকথাগুলিও মিথ্যার আকারে প্রচার করেছেন ও যুক্তির বদলে বিভীষিকা দেখিয়ে লোকের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে দিয়েছেন। যদি বলো গুরুলোকেরা আমাদের চেয়ে জ্ঞানী, সুতরাং তাঁদের হাতে আপনাকে সম্পূর্ণরূপে গচ্ছিত রাখা আমাদের পক্ষে ভালো— তা যদি বলো তা হলে ইংরাজদের কাছ থেকে কতকগুলি স্বাধীনতা পাবার জন্যে আমরা খবরের কাগজে দাপাদাপি করে মরি কেন? ইংরাজরা যে আমাদের চেয়ে জ্ঞানে ও গুণে শ্রেষ্ঠ সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। সম্পর্কে-বড়ো কিম্বা বয়সে-বড়োর চেয়ে গুণে-বড়োর কাছে আত্মবিসর্জন করা ঢের বেশি যুক্তিসিদ্ধ।[১১] তবে কেন তাঁদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে আমরা নিজের হাতে কতকগুলি স্বাধীনতা নিতে চাই? তুমি বলবে, যাঁদের আমাদের উপরে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তাঁদের কাছে আমরা সর্বতোভাবে আজ্ঞাবহ হয়ে থাকব। তা থাকো-না কেন। কিন্তু ফলে যে সমানই কথা। তোমার চড় মারবার অধিকার আছে বলে যে ব্যক্তি চড় খাবে তার যে কিছু কম লাগবে তা তো নয়। যেখানেই অন্ধ একাধিপত্য সেইখানেই খারাপ। যখন গুরুলোকেরা আপনার ইচ্ছা ও সংস্কার এমন-কি কুসংস্কারের বিরোধী হল ব’লে ছোটোর প্রত্যেক ইচ্ছা অবিচারে দলন না করবেন, তখন অনেক উপকার হবে।[১২] আমাদের দেশের অশুভের মূল ঐখান থেকে অনেকটা পােষণ পাচ্ছে। এখানকার তুলনায় আমি সেইটি ভালাে করে বুঝতে পেরেছি। সু-বি—দের দেখাে, তাদের উদ্যম উৎসাহ, অধীর বাল্যভাব ও স্বাধীনতাস্পৃহার সঙ্গে আমাদের দেশের ছেলেদের শুষ্ক মলিন গম্ভীর ধীর ভাব[১৩] ও সম্পূর্ণরূপে পরনির্ভরতার তুলনা করে দেখাে― সে কী অনৈক্য! আমি ইংরেজের ছেলেদের সঙ্গে তুলনা করলুম না, পাছে তুমি বল তাদের জাতিগত স্বভাবের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বভাবের ভিন্নতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশীয় ছেলেই যথােপযুক্ত স্বাধীনতার সঙ্গে পালিত হলে তার কিরকম স্ফূর্তি হয়, তার মনের স্বাস্থ্য কিরকম অক্ষুন্ন থাকে তাই দেখাে। ছেলেদের স্বাভাবিক ভাব হচ্ছে প্রশ্ন করা, একটা জানবার ইচ্ছে। এখানকার ছেলেরা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ক’রে ক’রে সারা হয়। সু― আমাকে প্রশ্ন করে করে অস্থির করে তােলে; আকাশের তারা থেকে পৃথিবীর তৃণ পর্যন্ত এমন কোনাে পদার্থ নেই, বৈজ্ঞানিক খুটিনাটি করে সে যার ঘরের খবর না জানতে চায়। আমি যখন টর্কিতে ছিলুম তখন একটি ছেলে আমার সঙ্গে খুব ভাব করে নিয়েছিল; পৃথিবীর যা-কিছু দেখত তাই যেন তার ভারী আশ্চর্য লাগত, প্রতি পদে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে আমাকে ভারী মুশকিলে ফেলত― তার কৌতূহলের আর আদি অন্ত নেই। তা ছাড়া এখানকার ছেলেদের এক রকম স্বাধীন ও পৌরুষের ভাব দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। তার প্রধান কারণ, এখানকার গুরুলোকেরা তাদের প্রতি পদে বাধা দেয় না, আর অনেকটা সমান সমান ভাবে রাখে। আমি এখানকার একটা প্রাইবেট স্কুল দেখেছিলেম—মাস্টার ছেলেদের সঙ্গে ঠাট্টাঠুট্টি করেন, খেলা করেন, কত যে স্বাধীনতা দেন তার ঠিক নেই; অথচ তাতে কিছু তাদের ‘মাথা-খাওয়া’ হয় নি, পড়াশুনোতে তাদের কিছু মাত্র ত্রুটি নেই।[১৪] এই তো গেল ছেলেদের কথা। আর বড়োরা যে গুরুর সঙ্গে খুব কম সম্পর্ক রাখে তা বলাই বাহুল্য। এখানে এমন স্বাধীনভাব বর্তমান যে, প্রভু ভৃত্যের মধ্যেও সে রকম আকাশ-পাতাল সম্পর্ক নেই।[১৫] এখানে চাকরকে গালাগালি দেওয়া ও মারাও যা একজন বাইরের লোককে গালাগালি দেওয়া ও মারাও তাই। আমাদের দেশের মতো চাকরদের বেঁচে থাকা ছাড়া অন্য সমস্ত অধিকার মনিবদের হাতে নেই। চাকর কোনো কাজ করে দিলে ‘thank you’ ও তাকে কিছু আজ্ঞা করবার সময় ‘please’ বলা আবশ্যক।[১৬] একবার কল্পনা করে দেখো দেখি, আমরা চাকরদের বলছি ‘অনুগ্রহ করে জল এনে দেও’ বা ‘মেহেরবানি করকে পানি লে আও’ ও জল এনে দিলে বলছি ‘বাধিত রইলুম’।[১৭] তুমি হয়ত বলবে ‘thank you’ ও ‘please’ —ও কেবল একটা মুখের কথা মাত্র। কিন্তু জাতীয় আচার ব্যবহার প্রতি পদে যে কথা-দুটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় জাতীয় হৃদয়ে তার কারণ নিশ্চয়ই বর্তমান আছে। কিন্তু এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে হয়তো জোর করে তর্ক করছি, তুমি হয়তো মানো যে হৃদয়ের মাটিতে শিকড় না থাকলে একটা কথা তিন দিনে শুকিয়ে মারা যায়। এখানে মনিবরা টাকা দেন ও চাকরেরা কাজ করে দেয়, উভয়ের মধ্যে কেবল এইটুকু বাধ্যবাধকতা আছে। তুমি টাকা না দিলে চাকর কাজ করবে না, চাকর কাজ না করলে তুমি টাকা দেবে না। কিন্তু একটুখানি কাজের ত্রুটি হলে তাকে ও তার অনুপস্থিত নির্দোষ পিতা পিতামহ বেচারিদের সম্পর্কবিরুদ্ধ বিশেষণ প্রয়োগ করবার কী অধিকার আছে? এখানে চাকরদের মধ্যে দাসত্বের ভাব যে কত কম তা হয়তাে তুমি না দেখলে ভালাে করে বুঝতে পারবে না। আমি একটি পরিবার জানি, সেখানে মনিবরা রান্না ঘরে যেতে হলে রাঁধুনির অনুমতি চেয়ে পাঠাতেন, পাছে তার কাজের মধ্যে intrude করলে সে বিরক্ত হয়ে ওঠে! এই থেকে কতকটা বুঝতে পারবে। এই রকম এখানকার পরিবারে স্বাধীনতা মূর্তিমান, কেউ কাউকে প্রভুভাবে আজ্ঞা করে না ও কাউকে অন্ধ আজ্ঞা পালন করতে হয় না। এমন না হলে একটা জাতির মধ্যে এত স্বাধীনভাব কোথা থেকে আসবে? কিম্বা হয়তো আমি উলটো বলছি, একটা জাতির হৃদয়ে স্বভাবতঃ এতটা স্বাধীনভাব না থাকলে এমন কী করে হবে? যাদের হৃদয়ে স্বাধীনভাব নেই তারা যেমন অম্লানবদনে নিজের গলায় দাসত্বের রজ্জু বাঁধতে পারে, একটু অবসর পেলেই পরের গলায়ও তেমনি অকাতরে দাসত্বের রজ্জু বাঁধতে ভালােবাসে। আমাদের সমাজের আপাদমস্তক দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ। আমরা পারিবারিক দাসত্বকে দাসত্ব নাম দিই নে; কিন্তু নামের গিলটি করে আমরা বড়ােজোর দাসত্বের লােহার শৃঙ্খলকে সােনার আকার ধরাতে পারি, কিন্তু তার শৃঙ্খলত্ব ঘােচাতে পারি নে, তার যা কুফল তা থেকে যায়। আমি আগে মনে করতুম যে হিন্দুদের মনে একটা সহজ স্বাভাবিক ভাব আছে, কোনাে প্রকার অস্বাভাবিক বাঁধাবাঁধি আইন-কানুন নেই। কিন্তু কোন্ লজ্জায় আর তা বলব বলো। হিন্দুদের মধ্যে অস্বাভাবিক আইন-কানুন নেই? তাদের পরিবারের মধ্যে দেখাে! আপনার ভাই-বােন পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্রের মধ্যে কতটা বাঁধাবাঁধি আছে একবার দেখাে। ভাইয়ের প্রতি কিরকম ব্যবহার করতে হবে তা কোন্ দেশে শেখাতে হয় বলো দেখি। তবে যদি বলো যে, ভাইয়ের প্রতি পিতা বা পুত্রের মতাে ব্যবহার করতে হবে, তা হলে শেখাবার খুব আবশ্যক করে বটে,[১৮] কোনো মানুষের সহজ অবস্থায় আত্মপ্রত্যয় থেকে ও কথা মনে আসবার কোনো সম্ভব নেই। গুরুলোকদের কাছে বেশি কথা কওয়া বা হাসা পর্যন্ত নিষেধ। কী ভয়ানক! যাদের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা[১৯] অনবরত থাকতে হবে তাদের সঙ্গে যদি মন খুলে কথাবার্তা না কবে, প্রাণ খুলে না হাসবে, তাদের কাছেও যদি জিবের মুখে লাগাম লাগিয়ে, হাস্যোচ্ছ্বাসের মুখে পাথর চাপিয়ে আর মুখের ওপর একটা সম্ভ্রমের মুখস প’রে দিন রাত্রি থাকতে হয় তা হলে কোথায় গিয়ে আর রিশ্রাম পাবে?[২০] ইনি দাদা, উনি কাকা, তিনি মামা, এ ছোটো ভাই, ও ভাইপো, সে ভাগ্নে, কারু কাছে ভালো করে মুখ খোলবার জো নেই।[২১] কী করা যায়? বাড়ি থেকে বেরিয়ে বোসেদের চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে আড্ডা গাড়তে হয়, সেখানে পাঁচ জনে মিলে তামাক খাওয়া, দাবা খেলা ও হাসি তামাসা করা যায়। এ দুর্দশা কেন বলো দেখি! আফিস থেকে এসে যেমন আফিসের কাপড়চোপড় ছেড়ে হাঁফ ছাড়া যায় তেমনি বাড়িতে প্রবেশ করেই লৌকিক ব্যবহারের খোলষ পরিত্যাগ করে মনটাকে কেন একটুখানি হাত পা ছড়াতে দেওয়া হয় না? তখনো কেন আমি স্ত্রীর সঙ্গে চুপিচুপি ফিস্ ফিস্ করে কথা কব, পাছে পাশের ঘর থেকে শ্বশুর ভাসুর বা ঐ রকম একটা কোনো মান্যবর পূজনীয় সম্পর্কের ব্যক্তি আমার স্ত্রীর গলা শুনতে পায়? স্ত্রীর গলা বা হাসি শুনলে কার কী সর্বনাশ হয় বলো দেখি। একেই কি সহজশোভন ভাব বলে? এর মধ্যে সহজ ভাবট। কোন্‌খানে বলো দেখি। বিলিতি-বাঙালিরা যে দেশে ফিরে গিয়ে খুঁৎ খুঁৎ করেন ও বলেন আমাদের দেশে ‘home' নেই, বিলেতেই যথার্থ ‘home' আছে, তাঁরা বোধ হয় তার এই অর্থ করেন যে -বিলাতের পরিবারে একটা স্বাধীন-উচ্ছ্বাসের ভাব আছে।[২২] বাপ-মা ভাই-বোন স্ত্রী-পুত্রে মিলে হাসি গল্প গানে অগ্নিকুণ্ডের চার ধার উচ্ছ্বাসময় করে তোলে। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর বাড়িতে এসে একটা উল্লাস—একটা মেশামেশির ভাব দেখতে পাওয়া যায়।[২৩] এক ঘরে শ্বশুর তাঁর দুই চারটি বৃদ্ধ বন্ধু জুটিয়ে তামাক খেতে খেতে এখনকার ছেলেপিলেদের অশাস্ত্রীয় ব্যবহারে কলির দ্রুত উন্নতির আশঙ্কা করছেন, আরএক ঘরে বউ সাত হাত ঘোমটা টেনে তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে নীরবে তাঁর দৈনিক তিরস্কার সেবন করছেন, আরএক ঘরে স্বামী তাঁর দুই-একটি যুবা বন্ধু জুটিয়ে নিন্দালাপ[২৪] করছেন —এ রকম চিত্র এখানকার কেউ কল্পনা করতে পারে না। আমাদের মুখ খোলবার জায়গা পরের কাছে। বউয়ের দুই-চারটি সমবয়সী সই আছে, তাদের কাছে অবসরমত স্বামীর ভালোবাসার গল্প করে; শাশুড়ির কতকগুলি প্রৌঢ়া প্রতিবাসিনী আছে, সকলে মিলে পাড়ার অন্তঃপুরের সুস্বাদ গুপ্ত খবরের আলোচনা করা হয়; স্বামীর কতকগুলি যুবা বন্ধু আছে তাদের সঙ্গে কালেজীয় অশাস্ত্র আলোচনা চলে; আর শ্বশুরের চণ্ডীমণ্ডপে পাড়ার কতকগুলি খুড়ো ও দাদা-মহাশয়ের আমদানি হয়, ও ঐ সকল পাকা বুদ্ধিতে মিলে ইহকাল ও পরকালের অনেক কঠিন বিষয় মীমাংসা করেন। আমাদের পরিবারে পরকে আপনার করে নিতে হয়, কেননা আপনার সকলে পর।[২৫] অসদ‍্ব্যবহার বা পাপকার্যে লোকের স্বাধীনতা যত কমাও ততই ভালো, কিন্তু নির্দোষ এমন-কি উপকারজনক বিষয়ে স্বাধীনতা যত কম ছাঁটা যায় ততই ভালো। শ্বশুরে স্ত্রীর গলা শুনলে পৃথিবীর কী হানি ও নরকের কী শ্রীবৃদ্ধি হয় বলো দেখি। আপনার লোক সকলে মিলে মিশে গল্পসল্প করলে উপকার ছাড়া অপকার কী হয় বলে। দেখি। অনেকে সমাজের অনেক রকম বড়ো বড়ো সংস্কারের কথা পাড়েন, আমি একটা ছোটোখাটো পরামর্শ দিচ্ছি শোনো দেখি—আমাদের পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যজনক স্বাধীনতা সঞ্চার করে দেও দেখি, টানাটানি বাঁধাবাঁধি শাসন ও পরনির্ভরতা কমিয়ে দেও দেখি। তুমি হয়তো ভারী চটে উঠেছ; তুমি বলছ যে, ‘তুমি বিলেতে কী দেখেছ শুনেছ তাই বলো, আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি; কিন্তু এ রকম যদি বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করো তা হলে তো আর আমাদের ধৈর্য থাকে না।’ কিন্তু তোমাকে এইখেনে বলে রাখছি, আমি এ চিঠিতে টেম্‌স‍্টানেল ও ওয়েস্ট‍্ মিনিস্টর হলের বর্ণনা করতে বসি নি। বিলেতের সমাজ আদি দেখে আমার কী মনে হল ও আমার কিরকমে মত পরিবর্তন ও গঠিত হল তাই বলব। আজ আমার যে মত তোমাদের বিস্তৃত করে লিখলুম তা এখানকার সমাজ দেখে আস্তে আস্তে আমার মনে বদ্ধমূল হয়েছে। একটা সমাজের ভিতরে না থেকে, বাইরে থেকে তা আলোচনা করলে তার অনেক বিষয় যথার্থরূপে চোখে পড়ে; ভিতরে থাকলে খুব কম বিষয় আমাদের চোখে পড়ে, সকলই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আমার তাই একটি মহা সুবিধে, আর-একটি সমাজের সঙ্গে তুলনা করতে পারছি। তোমার নিজের মতের সঙ্গে মিলল না ব’লে তুমি হয়তো বলবে ‘বিলেতে গিয়ে লোকটার মাতা ঘুরে গিয়েছে’। এ কথা বললে কোনো যুক্তি না দেখিয়ে আমার সমস্ত কথাগুলো এক তোপে উড়িয়ে দিতে পারো। কিন্তু আমি তোমাদের বিশেষ করে বলছি, বিলেতে এসে কারু যদি মাথা না ঘুরে থাকে তো সে তোমাদের এই বিনীত দাসের।















  1.   এ জায়গাটা ভারী গোলমেলে—ছোটো ছেলেরা ঘাড় গুঁজে বসে থাকবে এটি আমাদের দেশের কোন্ পিতা বা কোন্ হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি চক্ষে দেখিতে পারে? আর, ছেলেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহারা বিনয় নম্রতা ও ভদ্রতা শিক্ষা না করিয়া ভদ্রসমাজে পুৎলোবাজির ন্যায় ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইবে ইহাই বা কোন্ পিতা সভ্যতার চরম সীমা জ্ঞান করিতে পারে? আমাদের দেশের কোন্ পিতার মন এরূপ কঠিন তাহা জানি না যে প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র তাঁহার কোনো কথার উত্তর না দিয়া ঘাড় গুঁজিয়া বসিয়া থাকিলে তিনি মনে মনে বড়োই আহ্লাদিত হন—আহ্লাদের কারণ শুধু এই যে, পুত্রের উপর দেখো কেমন আমার প্রভুত্ব! এ-সকল অত্যুক্তির প্রতিবাদ করিতে হইতেছে, ইহাতে হাসিও পায় কান্নাও পায়। ভা.স.
  2.  

    লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
    প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ॥

  3.   ভালোবাসা ব্যতীত ভক্তি হতেই পারে না। ভক্তি হতে যদি ভালোবাসা উঠাইয়া লওয়া যায় তবে শুদ্ধ কেবল শাসনভয় মাত্র অবশিষ্ট থাকে। ভালোবাসা পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে। দম্পতি-ভালোবাসা পুত্রকন্যার প্রতি কিছু অর্শিতে পারে না; পুত্রবাৎসল্য কিছু বন্ধুবর্গের প্রতি অর্শিতে পারে না; ভ্রাতৃসৌহার্দ্য কখনো গুরুজনের প্রতি অর্শিতে পারে না। দম্পতির ভালোবাসাকে দম্পতিপ্রেম কহে, পুত্রকন্যার প্রতি যে ভালোবাসা তাহাকে স্নেহ কহে, বন্ধুবর্গের ভালোবাসাকে বন্ধুতা সখ্য প্রণয়, ইত্যাদি কহা যায়, উচ্চের প্রতি যে ভালোবাসা তাহাকে ভক্তি কহে; অতএব ভক্তি ভালোবাসা হইতে স্বতন্ত্র একটি বস্তু নহে— তবে কি-না ভক্তির ভালোবাসা প্রণয়ের ভালোবাসা নহে, স্নেহের ভালোবাসা নহে, দম্পতিপ্রেমের ভালোবাসা নহে, উহা অপেক্ষা আর একটু উচ্চ দরের ভালোবাসা। যাঁহারা কেবল যাত্রার গীতেরই মর্মজ্ঞ, উচ্চ অঙ্গের গীত তাঁহাদের কাছে গীতই নহে; তেমনি শুদ্ধ যাহারা কেবল সখ্যরসেরই মর্মজ্ঞ, ভক্তি তাঁহাদের চক্ষে ভালোবাসাই নহে— সথ্যকে ধরিয়া বাঁধিয়া ভক্তির সিংহাসনে বসাইলে তবেই তাঁহাদের মনঃপূত হয়। কিন্তু তাঁদের জানা উচিত যে, যাত্রার সুরে খেয়াল ধ্রুপদ গান করা আর ভক্তিভাজন ব্যক্তির সহিত সখ্যরসের আলাপ করা উভয়ই সমান— বেসুরো, বেতালা, বেমানান— সমজদার ব্যক্তি তাহা শুনিবা মাত্র কানে হাত দেন। ভা. স.
  4.   অবশ্য, শৈশবকালে এইরূপ আচরণই স্বাভাবিক, কিন্তু একজন ষোলো-বর্ষ-বয়স্ক পুত্র ওরূপ ব্যবহার করিলে সেটা অত্যন্ত বেতালা ও বেসুরো হয় কি না একবার ভাবিয়া দেখা হউক— একটু যাহার বুদ্ধি হইয়াছে সে পুত্র শুধু-শুধু কেনই বা ওরূপ করিবে! ষোলো বর্ষের বালক পিতার নিকট পাঁচ বর্ষের শিশুর ভাণ করিয়া, অথবা দম্পতিপ্রেমোচিত অধীর ভালোবাসার ভাণ করিয়া দৌড়াদৌড়ি পিতাকে আলিঙ্গন করিলে সে যে কী এক অদ্ভুত দৃশ্য হয় তাহা বর্ণনাতীত। ভা. স.
  5.   গুরুজনের সঙ্গে সখ্যরসের আলাপ করা অস্বাভাবিক কি স্বাভাবিক ইহা হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করো—যিনি সর্বতোভাবে ভালো চান তাঁকে কোনোরূপে কোনো পীড়া দিতে তুমি চাও না; তুমি জানো যে তোমার কোনো বিষয়ে একটু কিছু ত্রুটি দেখিলে তাঁহার মনে যত লাগিবে এত আর কাহারও মনে লাগিবে না— এইজন্য তাঁর কাছে তুমি ভয়-ভয় করিয়া চল। ইহা নিশ্চয় জানিয়ো এরূপ ভয় ভালোবাসা হইতেই জন্মগ্রহণ করে; পুত্র যদি পিতাকে ভালো না বাসে তবেই সে তাহার পিতার মনে আঘাত দিতে কিছুমাত্র ভীত বা সংকুচিত হয় না—সুতরাং সে-তাহার-ভয় কঠোর শাসন-ভয় হওয়া দূরে থাকুক, তাহা অতি সুকোমল ভালোবাসার ভয়, সুতরাং অতি সন্তর্পণে রাখিবার সামগ্রী। বন্ধুবর্গের সহিত যখন আমরা সখ্যরসে মিলিত হই তখন আমরা অনেকটা অসংকোচ ভাবে চলা-বল। করি— কেন? না, বন্ধুরা পিতার ন্যায় আমাদের মঙ্গলের জন্য একান্ত লালায়িত নহে; বন্ধুদিগের লক্ষ্য আমোদপ্রমোদের দিকে— আমোদ-প্রমোদের পক্ষে ঢিলাঢালা ভাব যেমন আবশ্যক মঙ্গলের পক্ষে সংযত ভাব তেমনি আবশ্যক। বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে মনের শৈথিল্য স্বভাবতঃ শোভা পায়, গুরুজন-সন্নিধানে মনের সংযত ভাব স্বভাবতঃ শোভা পায়— তা যদি না বলো তবে ভক্তি শব্দটাকে অভিধান হইতে উঠাইয়া দেও। ভা. স.
  6.   ইহা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, শাস্ত্রের অভিপ্রায় এরূপ নয় যে একআধ বৎসরের ছোটো বড়ো ধর্তব্য; এখানে এই ইংরাজি প্রবাদটি স্মরণ করা উচিত: Letter killeth but spirit giveth life। [টীকাকার-মহাশয় এই বচনটি উপদেশ না দিয়া যদি নিজের দৃষ্টান্তের দ্বারা সমর্থন করিতেন তবে লেখকের পাঠকদের যথার্থ উপকার হইত। —লেখক।] জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে জন্মিতে দেখিয়াছে; পিতা মাতা যেমন তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া আদর করে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও তাহাকে সেইরূপ আদর করিয়াছে, তাহার পাঠাদি শিক্ষার সহায়তা করিয়াছে, তাহার যাহাতে প্রকৃত মঙ্গল হয় তাহাতে সচেষ্ট হইয়াছে, বন্ধুবর্গ যেমন বন্ধুবর্গের সহিত আমোদ করিতে পারিলেই পরস্পরের মঙ্গলামঙ্গলের অতি অল্পই খোঁজ-খবর রাখে— জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ভাব সেরূপ নহে; কনিষ্ঠ ভ্রাতার যদি কোনো অমঙ্গলের সূত্রপাত হয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অমনি তাহার প্রতিবিধানের জন্য সচেষ্ট হয়; এ-সকল আমলে না আনিয়া কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বলে যে ‘তুমি কেবল বয়সেই জ্যেষ্ঠ’, এরূপ কথাতে ভ্রাতৃভাব না ভ্রাতৃভাবের অভাব কোন্‌টি প্রকাশ পায়? ইংরাজরা যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হুট্‌ করিয়া উড়াইয়া দেয় অথবা তাহার সহিত বয়োবিরুদ্ধ সখ্যভাবের কথাবার্তা কহিতে লজ্জা বোধ না করে তাই ব’লে আমাদেরও কি সেইরূপ না করিলেই নয়? ইংরাজদিগের সভ্যতার ছোবড়া ভক্ষণ করিতে যাঁহারা ভালোবাসেন তাঁহাদের কথা ছাড়িয়া দেও— তাঁহারা দেখেন স্বাধীনতা, শেখেন পরজাতির দাসত্ব; দেখেন civilization, শেখেন devilization; দেখেন স্বদেশানুরাগ, শেখেন স্বদেশের প্রতি নির্মমতা; দেখেন দেশীয় পরিচ্ছদ, স্বদেশীয় আচার ব্যবহার, স্বদেশীয় চালচলন ইত্যাদি, সকলের প্রতি ন্যায়সংগত পক্ষপাত, শেখেন কী?— না, স্বদেশীয় পরিচ্ছদের প্রতি, স্বদেশীয় আচার ব্যবহারের প্রতি, স্বদেশীয় সুরীতি-সকলের প্রতি ন্যায়বিরুদ্ধ বিরাগ! ভা.স.
  7.   গুরুজনের প্রতি ভক্তি-অভক্তি ও শিক্ষার সু-প্রণালী কু-প্রণালী এ দুটি বিষয় স্বতন্ত্ররূপে বিচার্য। ভা. স.
  8.   আমরা আমাদের নিজের জীবনের পরীক্ষাতে দেখিয়াছি যে, লেখক যে কারণ নির্দেশ করিয়াছেন তাহা ঠিক নহে। আমরা দেখিয়াছি যে, যাঁহারা যথার্থ ভক্তির পাত্র তাঁহাদিগকে ভক্তি করিলে মনুষ্যের স্বাধীনতা বৃদ্ধি হয় বৈ হ্রাস হয় না। শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুজনের প্রতি, জননী জন্মভূমির প্রতি, মনুষ্যের প্রকৃত মহত্ত্বের প্রতি যদি ভক্তি সমর্পণ না করো, তবে কাজেই চটক লাগানো মন-ভোলানো ভড়ঙ-দেখানো যা-তা তোমার চক্ষের সামনে পড়িলেই তারই কাছে ভক্তির অপব্যয় করিতে মন তোমার ধাবিত হইবে; আমি বিশেষ এক ব্যক্তিকে জানি যাহার স্বদেশের প্রতি ও গুরুজনদিগের প্রতি ভক্তি থাকাতেই সে এতগুলি মহাপ্রভুর দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে রক্ষা পাইয়াছে— ১ মিল প্রভৃতি পণ্ডিতগণের অতিবাদ ২ রঙচঙে ইংরাজী সভ্যতা ৩ হুটপেটে ইংরাজী চাল-চলন ৪ সুরুচিবিরুদ্ধ সংক্ষিপ্তসার ইংরাজী ঢঙের কোর্তা যাহা তাহারা নিজেই তাহাদের স্বদেশীয় বড়ো লোকদের প্রস্তর মূর্তির গায়ে পরাইতে নারাজ ৫ দেশীয় ভাষার প্রতি অবহেলা ইত্যাদি।
     সার কথা এই যে, গুরুভক্তি (অর্থাৎ শুভাকাঙ্ক্ষী উচ্চ উচ্চ লোকদের প্রতি ভক্তি) এবং সর্বোচ্চ ধরিতে গেলে ঈশ্বরভক্তি স্বাধীনতার প্রাণ; স্বাধীনতা হইতে ভক্তিটিকে তফাত করো, অমনি তা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হইবে।
    ভা. স.
  9.   মস্তিষ্কের গুরুলোককে আমি মস্তিষ্কের ভক্তি করিব, হৃদয়ের গুরুলোককে হৃদয়ের ভক্তি করিব, এ কথাটি লেখক বোধ হয় বিশ্বত হইয়াছেন। কার্লাইলের মতের সহিত আমার মতের অনৈক্য হইলে আমি তাঁহার সহিত কঠোর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইব, তাহাতে তাঁহার মনে আঘাত লাগিবে কি নালাগিবে তাহা আমি একবার মনেও করিব না, কিন্তু গুরুজনের সহিত কোনো বিষয়ের তর্ক করিবার সময় একেবারেই তাঁহার বিরোধী পক্ষ অবলম্বন করিতে মনের প্রবৃত্তিই হইবে না— ভালোবাসার রীতিই এইরূপ। যদি গুরুজন অপেক্ষা কোনো বিষয় আমি ভালো বুঝি তাই বলিয়া কি সেই ভালোবোঝাটুকুর মূল্য এতই অধিক যে— ‘এ বুদ্ধির কাছে কে বা কোথা আছে’! যদি বুদ্ধি জারি করা নিতান্তই প্রয়োজন হয় তবে তার দেশ-কাল-পাত্র আছে, তার প্রথা আছে— তর্কের অনুরোধে গুরুজনের মনে পীড়া দিতেই হইবে, কোনো মতে ছাড়া হইবে না, কোনো দেশের কোনো শাস্ত্রে এরূপ লেখে না। ভ. স.
  10.   পুত্র বড়ো ও উপযুক্ত হইলে গুরুজনেরা কখনোই তাহাকে বলপূর্বক পরিচালন করেন না। গুরুজনেরা সত্য-সত্যই কিছু এরূপ বোধশূন্য পাষাণঅবতার নহেন যে, ছেলেপিলেদের উপর ক্ষমতা জারি করিবার জন্য তাহাদের উপর তাঁহারা প্রভুত্ব করেন; আর ছেলেপিলেরাও পেটে থেকে পড়েই কিছু এতদূর বুদ্ধিবিদ্যার বৃহস্পতি হয় না যে গুরুজনের কথা শুনিয়া চলিলে তাহাদের উপকার না হইয়া অপকার হয়—তাহার স্বাধীনবুদ্ধি খেলিতে পায় না, বুদ্ধিবৃত্তি দমনে থাকে, মন দমিয়া যায় ইত্যাদি। প্রকৃত কথাটা এই, ছোটো বালকদিগের পক্ষে শরীর-চালনা ও সামান্য স্মরণশক্তি-চালনাই যথেষ্ট, বালকদিগকে অতিশয় বুদ্ধি-চালনা শিক্ষা দিয়া তাহাদের অল্প বয়সেই প্রবীণ করিয়া তুলিলে তাহাদের মূলে আঘাত করা হয়। প্রকৃতি এইরূপ শিক্ষা দেন যে শরীরের স্ফূর্তি প্রথমে, মনের স্ফূর্তি তাহার পরে এবং বুদ্ধির স্ফূর্তি সবাকার শেষে হইলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হয়; এমন-কি নিউটন রাফেএল প্রভৃতি অসাধারণ লোকেরাও তাঁহাদের গুরুদিগকে দেবতুল্য (অর্থাৎ আপনা হইতে অনেক বড়ো) জ্ঞান করিতেন। আগে যাহারা শ্রদ্ধাবান ভক্তিমান আজ্ঞাকারী সাকরেত না হয় পরে তাহারা কখনোই ওস্তাদ হইতে পারে না— ইহা বেদবাক্য। ভা.স.
  11.   এ কথাটি হৃদয়শূন্য মস্তিষ্কের কথা। সম্পর্কের বড়োর সঙ্গে হৃদয়ের যেমন যোগ, জ্ঞানে ও গুণে বড়োর সঙ্গে সেরূপ হওয়া দুর্ঘট। ভা. স.
  12.   পুত্র পিতার অসম্মতিতে বিবাহ করাতে পিতা তাহাকে দূর করিয়া দিয়াছে— ইংলন্‌ডে তো সর্বদাই এরূপ ঘটিতে দেখা যায়। ভা. স.
  13.   রুগ্ন ছেলে ভিন্ন অন্য কোনো ছেলেকে আমি তো আজ পর্যন্ত শুষ্ক মলিন ধীর গম্ভীর দেখি নি। যে বয়সের যেটি স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম তাহা এখানেও যেমন বিলাতেও তেমনি— বিলাতে নয় ব্যাট-বল খেলে, আমাদের দেশে নয় গুলিডাণ্ডা খেলে; বিলাতে হাইড-অ্যাণ্ড্-সীক খেলে, আমাদের দেশে নয় লুকাচুরি খেলে— প্রভেদের এই পর্যন্ত সীমা। ভা. স.
  14.   আমাদের দেশের টোলে এইরূপ প্রথাতেই শিক্ষা দেওয়া হইত, এক্ষণকার ইংরাজী বিদ্যালয়ের ‘routine business' প্রণালীতে বালকদিগের মন দমিয়া যায় ইহা আমি সম্পূর্ণ শিরোধার্য করি। ভা.স.
  15.   আমাদের দেশের পাড়াগাঁ অঞ্চলেও এইরূপ দেখা যায়—লেখক শহরে Lord-দের ঘরে স্বতন্ত্ররূপ প্রথা দেখিবেন ইহা আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি। ভা.স.
  16.   লেখক এইমাত্র বলিলেন চাকর মনিবে বেশি তফাত ভাব নাই, ইহাতে বুঝায় যে তাহারা বাড়ির লোকেরই সামিল; আমাদের দেশের গৃহস্থ মানুষদের ঘরেও চাকর মনিবের মধ্যে ঐরূপ ভাব দৃষ্ট হয়—তাহার সাক্ষী চাকরানিকে ঝি বলিয়া সম্বোধন করিবার প্রথা। কিন্তু চাকরদের সঙ্গে পদে পদে সম্মানসূচক ব্যবহার করা— আষ্টে-পৃষ্টে কাষ্ঠসভ্যতার ভার বহন করা—আমাদের দেশের সহজসভ্য লোকদিগের পোষায় না। গর্দভও ভার বহন করিতে ভার বোধ করে, আমরা মনুষ্য হইয়া যদি ইচ্ছাপূর্বক আপন স্বন্ধে আপনি ভার চাপাই তবে তার চেয়ে আমরা বড়ো কিসে? ভা.স.
  17.   এ-সকল কৃত্রিম সভ্যতার না আছে অর্থ, না আছে কিছু। আমাদের দেশে এরূপ মৌখিক ভদ্রতার যত কম আমদানি হয় ততই ভালো। মনে করো ছেলের জ্বর হয়েছে আর যেই তার বাপ একটা হাতপাখা তুলে নিয়ে তার গায়ে বাতাস দিতে লাগল অমনি ছেলে বলে উঠলেন ‘thank you বাবা’— এরূপ কাষ্ঠসভ্যতা কাষ্ঠহৃদয়ের উপরেই গুণ করিতে পারে, সহজ হৃদয়কে আগুন করিয়া তোলে। ভা.স.
  18.   মনে করো একটি বড়ো পুত্র এবং একটি ছোটে পুত্র রাখিয়া পিতা মাতা লোকাত্তর গমন করিয়াছেন, এখন ছোটোটিকে তাহার পিতা যেমন যত্ন করিতেন তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাহাকে সেইরূপ যত্ন না করিলে তাহার পক্ষে তাহা কর্তব্যবিরুদ্ধ হৃদয়বিরুদ্ধ ও নিন্দনীয় হয় কি না? পিতার অবর্তমানে যাহা এইরূপ অবশ্যম্ভাবী, পিতা বর্তমানে তাহা হইলে আরও ভালো হয় কি না? যে যাহাকে পুত্রের মতো যত্ন করে তাহাকে সে পিতার মতো ভক্তি করিবে কি না? ধাত্রীকে তাহার দুগ্ধপোষ্য শিশু স্বভাবতই মাতার মতো এবং স্থল- বিশেষে তাহা অপেক্ষা অধিক ভালোবাসে কি না? ধাত্রী পর হইয়াও যদি মাতার ন্যায় হইতে পারে তবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আপনার হইয়া কেননা পিতৃতুল্য হইতে পারিবে? বড়োর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা করিবে না তো কাহার প্রতি করিবে? ভা.স.
  19.   চব্বিশ ঘণ্টা গুরুলোকের সঙ্গে থাকলে ছেলেরা দু দিনে বুড়িয়ে যায়— কোনো ছেলেকে আজ পর্যন্ত ওরূপ করিতে দেখি নাই। ভা.স.
  20.   গুরুলোকেরা শিক্ষার স্থান, ভক্তিশ্রদ্ধার স্থান— বিশ্রামের স্থান বা বিনোদের স্থান নহেন। তাঁহারা যদি বিনোদের স্থান হইবেন তবে সমবয়স্কেরা কী করিতে রহিয়াছে? ক্ষুধার জন্য অন্ন রহিয়াছে, তৃষ্ণার জন্য জল রহিয়াছে, ইহা বিস্মৃত হইয়া ক্ষুধা পাইলে যে ব্যক্তি জল খায় ও তৃষ্ণা পাইলে ভাত খায়, সেই ব্যক্তিরই কর্ম— বিনোদ-ইচ্ছা হইলে গুরুলোকের নিকট যাওয়া ও সদুপদেশ এবং উচ্চ সহবাসের ইচ্ছা হইলে সমবয়দিগের নিকট যাওয়া। ভক্তিভাজন ব্যক্তির সম্মুখে মন স্বভাবতই প্রশান্ত সংরত ভাব ধারণ করে—মনঃসংঘম যাহা অনেক শিক্ষার ফল তাহা আপনা-আপনি হয়, এ কিছু কম কথা নহে। ভা.স.
  21.   কেন মুখ খুলিবার জো নাই? অবশ্য মুখ খুলিবার জো আছে— কেবল এলোমেলো যা ইচ্ছা তাই বকিবার জো নাই। গুরুজনদিগের কথাবার্তা রীতি-চরিত্র দেখিয়া শুনিয়া বালকেরা কথাবার্তা কহিতে, বসিতে, দাঁড়াইতে যত দিন না শেখে ততদিন তাহারা অসম্বদ্ধ প্রলাপ করিলে আদর বৈ ভর্ৎসনা লাভ করে না এবং বালকদের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের চাপল্য হ্রাস পায় ও গুরুজনদিগের প্রতি ভক্তিভাবের উদয় হয়—ইহা সকল দেশেই সমান। ভা.স.
  22.   এইরূপ স্বাধীন উচ্ছ্বাসের ভাব দেখিবার জন্য বিলাতে যাইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, একজন সামান্য খৃস্টান বাঙালির ঘরেও ঐরূপ স্বাধীন উচ্ছ্বাসের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেরূপ উচ্ছ্বাস বাস্তবিক স্বাধীন উচ্ছ্বাস কিম্বা প্রবৃত্তির অন্ধ উত্তেজনা, এইটির প্রতি একটু মনোযোগ করিলে ভালো হয়। দেশকালপাত্রোচিত কর্তব্যাকর্তব্য বিবেচনা করিয়া যে কার্য করা হয় তাহাই স্বাধীন নামের যোগ্য; স্বাধীন, কি-না স্ববশ। কিন্তু স্ববশ দূরে থাকুক, আমি যখন এরূপ অবশ হইয়া পড়িয়াছি যে গুরুজনের প্রতি একটুও দৃক‍্পাত নাই, আপনার সুখেই আপনি অচেতন, তখনকার সে মূঢ় ভাবকে স্বাধীনতা বলা আর পা’কে মাথা বলা উভয়ই সমান। স্ত্রীর সহিত যেরূপ মন-খোলাখুলি করিয়া কথাবার্তা কহা যায় তাহা কি গুরুজনের শ্রুতিযোগ্য না গুরুজনেরা তাহা শুনেন ইহা কাহারও প্রার্থনীয়? স্ত্রী পুরুষদের নির্জনে কথাবাতা কহিবার রীতি সকল দেশেই প্রচলিত আছে, কেবল আমাদের দেশে নহে। ইহার কারণ এই যে, পতিপত্নীর মধ্যে এরূপ অভেদ সম্বন্ধ যে উভয়ের মধ্যে গোপনীয় কিছুই নাই, সুতরাং পতিপত্নী নির্জনে যেরূপ কথাবার্তা কহে গুরুজন-সমক্ষে তাহারা সেরূপ কথাবার্তা কহিলে তাহাদের পতি-পত্নীত্ব ভূত-পেত্নীত্বে পরিণত হয়। পতি-পত্নী যখন গুরুজনসমক্ষে সর্বান্তঃকরণে আলাপ করিতে পারে না তখন সে জায়গায় আলাপ না করাই তো ভালো, যে জায়গায় আমি মন খুলিয়া হাসিতে না পারি সেখানে না হাসাই তো ভালো—এই-সকল সোজা বিষয়কে নানা রূপে বাঁকাইয়া তাহা কোনো জন্মে যা নয় তাই করিয়া তোলা বক্তৃতাশক্তির অপব্যবহার ভিন্ন আর-কিছুই নহে। ভা. স.
  23.   একটা গল্প মনে পড়িল— একজন সহস্রমারী দলের কবিরাজ রোগীকে দেখিতে আসিয়া তাহার ঘরের লোকদের জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আর কোনো চিকিৎসককে কি দেখানো হইয়াছিল?’ তাঁহারা বলিলেন, ‘অমুক চিকিত্সককে দেখানো হইয়াছিল।’ কবিরাজ বলিলেন, ‘তিনি কী বলিয়াছেন?’ তাঁহারা বলিলেন তিনি বলিয়াছেন যে, ‘নাড়ীতে এখনো একটু বেগ আছে, আজকের দিন স্নানটা স্থগিত রাখিলে ভালো হয়।’ কবিরাজ ক্রোধান্বিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, ‘আরে, আমি কি বলছি ওকে অষ্টগ্রহর জলে চুবিয়ে মেরে ফেল্! আর কী বললেন?’ উত্তর- ‘আর বলেছেন আজকের দিন ভাত না দিয়ে খই বাতাসা এমনি-সকল সামগ্রী খেতে দেওয়া হয়।’ কবিরাজ বলিলেন, ‘আরে, আমি কি বলছি ওকে গাণ্ডে-পিণ্ডে যা-তা খাইয়ে ওকে একেবারে শেষ করে ফেল্‌!’ ইত্যাদি। বিলাতি শাস্ত্র বলছেন— লোকজন মিলে মিশে আমোদ করা ভালো; আরে, আমাদের শাস্ত্র কি বলছে যে, দুজন লোককে এক ঠাই মিলে আমোদ করতে দেখেছ কি আর অমনি মারো লাঠি! আমাদের দেশে কি বন্ধুবর্গেরা একত্র মিলে মিশে আমোদ করে না? বাপ-মার কাছে ছেলেরা বসিয়া কি কখনও সুখের আস্বাদ পায় না? না স্ত্রী পুরুষেরা পরস্পরের সহবাসে সুখভোগ করে না? না ছেলেপিলেরা আপনাদের মধ্যে বাল্যক্রীড়া করিয়া সুখী হয় না? অপরাধের মধ্যে পতিপত্নীরা পিতা মাতা শ্বশুর শাশুড়ির সমক্ষে পরস্পরের সহিত বাক্যালাপ করে না। না করিল তাহাতে কাহার কী ক্ষতি হইল? পতিপত্নীর পরস্পর হৃদয়বিনিময়ের কিছু ব্যাঘাত জন্মিল, না বন্ধুজনগণের আমোদের কিছু ব্যাঘাত জন্মিল, না পিতা-পুত্রের স্নেহভক্তির কোনো ব্যাঘাত জন্মিল! যাহা ঠিক, যাহা স্বাভাবিক, যাহা সভ্যোচিত, যাহা শোভন তাহাই হইল— যাহা বেঠিক বেচাল অসভ্যোচিত অশোভন তাহাই হইল না। অন্তঃপুরবাসিনীরা আপনাদের মধ্যে যেমন সখ্যরসের আলাপ করিতে পারে পুরুষদের সঙ্গে কখনোই তেমন পারে না। যেখানে পাঁচজন স্ত্রীলোকে মিলিয়া সখ্যরসের আলাপে নিমগ্ন হয় সেখানে পুরুষমানুষ গেলে তাহাদের আমোদে ব্যাঘাত পড়ে। এজন্য সথায় সখায় সম্মিলনের জন্য বহিরালয় এবং সখীতে সখীতে সম্মিলনের জন্য অন্তঃপুর সৃষ্ট হইয়াছে। ইহাতে পরিবারের স্ত্রীলোকদের এবং পুরুষদের সম্মিলনের কোনো বাধা নাই, দুই-এক স্থলে যা বাধা আছে তাহা দেশাচারের কোটায় ফেলিয়া দেওয়া উচিত (কোন্ দেশের দেশাচার একেবারেই কুসংস্কারবিহীন?)। ‘বাধা নাই’ কেবল নহে, পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদের পুরুষদের মধ্যে সম্মিলনঘটনার সময়ও নির্ধারিত হইতে পারে, যেমন মধ্যাহ্নভোজনের সময় ইত্যাদি। স্ত্রীলোকেরা আপনাদের মধ্যে যেমন অসংকোচে সখ্যরসের আলাপ করিতে পারে, পুরুষদের সঙ্গে তাহারা তেমনটি পারে না বলিয়া সখ্যালাপহলে এ দেশে স্ত্রীলোকদের পুরুষদের একত্র সম্মিলনের প্রথা নাই। যদি কেবল অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে পুরুষেরা সন্ধ্যাযাপন করে তবে তাহারা বাহিরের বন্ধুদিগের সঙ্গে মিলিয়া প্রকৃতপক্ষে সখ্যরস উপভোগ করিবে কখন? যদি বলো যে ‘সখারা এবং সখীরা সকলে একত্রে মিলিয়া বন্ধুতালাপ করিতে হানি কী’ তাহার এই উত্তর যে তাহা হইলে ক্রমে এইরূপ দাঁড়াইবে যে, সখার সঙ্গে সখার কিংবা সখীর সঙ্গে সখীর বন্ধুতা অতি নিচু-দরের বন্ধুতা—দখাসথীর মধ্যে চখা-চখীর ভাবই আসল বন্ধুতা। তাহার সাক্ষী—বল্-মজলিশে পরপুরুষদের সঙ্গে নাচিবার জন্য ইউরোপবাসিনীদের মন কেমন নাচিয়া উঠে! ভা.স.
  24.   ইহাতে বুঝাইতেছে এই যে, নিন্দালাপই আমাদের একমাত্র আলাপ ও ইংরাজেরা সে রসে বঞ্চিত। gossiping শব্দের অর্থ তবে কী? বিবিদের সম্মিলনে নিন্দাবাদের ফোয়ারা কেমন খুলিয়া যায় তাহার একটি জাজল্যমান ছবি লেখকের হস্ত দিয়া ভারতীতে পূর্বে একবার বাহির হইয়া গিয়াছে।
  25.   বিলাত থেকে ফিরে এলে অধিকাংশেরই এইরূপ দশা ঘটে।