য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/পঞ্চম পত্র
পঞ্চম পত্র
প্রাণীবৃত্তান্তের সূচিপত্রে ইঙ্গবঙ্গ-নামক এক অদ্ভুত নতুন জীবের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়—তাদের ক’টা ক্ষুর ক’ পাটি দাঁত ও সিংহচর্ম তাদের গায়ে ঢিলে হয় কি কষা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ -সমেত একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখবার বাসনা আছে, সকলে অবধান করো। ‘এই বেড়াল বনে গেলেই বনবেড়াল হয়।’ তোমাদের সেই বন্ধু, যে ‘হংসমধ্যে বকো যথা’ হয়ে তোমাদের মধ্যে থাকত, যার বুদ্ধির অভাব দেখে তোমরা অত্যন্ত ভাবিত ছিলে, ইস্কুলের মাস্টাররা যাকে পিটিয়ে পিটিয়ে ঘোড়া করবার আশা একেবারে পরিত্যাগ করেছিলেন, সেই যখন এ বন থেকে ফিরে যাবে তখন তার ফুলোনো লেজ, বাঁকানো ঘাড়, নখালো থাবা দেখে তোমরা আধখানা হয়ে পিছু হ’টে হ’টে দেয়ালের এক কোণে গিয়ে আশ্রয় নেবে। এ বিলেত-রাজ্য থেকে ফিরে গেলে পর বিক্রমাদিত্যের সিদ্ধ-বেতালের মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে একটি ‘Oberon’ ফিরবে, সে তোমাদের প্রতি লোকের চোখে এমন একটি মায়া-রস নিংড়ে দেবে যে, আমাকে যদি গর্দভ-মুখোষিত ‘Bottom’এর মতোও দেখতে হয়, তবু তোমরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।
বিলেতে নতুন এসেই বাঙালিদের চোখে কোন্ জিনিস ঠেকে, বিলিতি সমাজে নতুন মিশে প্রথমে বাঙালিদের কিরকম লাগে, সে-সকল বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আপাততঃ কিছু বলব না। কেননা, এ-সকল বিষয় আমার বিচার করবার অধিকার নেই, যাঁরা পূর্বে বিলেতে অনেক কাল ছিলেন ও বিলেত যাঁরা খুব ভালো করে চেনেন তাঁরা আমাকে সঙ্গে করে এনেছেন ও তাঁদের সঙ্গেই আমি বাস করছি। বিলাতে আসবার আগেই বিলেতের বিষয় তাঁদের কাছে অনেক শুনতে পেতেম, সুতরাং এখানে এসে খুব অল্প জিনিস নিতান্ত নতুন মনে হয়েছে, এখানকার লোকের সঙ্গে মিশতে গিয়ে প্রতি পদে হুঁচট খেয়ে খেয়ে আচার ব্যবহার আমাকে শিখতে হয় নি। এখানকার সমাজের স্ফটিকশালায় প্রবেশ ক’রে যখনি জল মনে করে কাপড় তুলতে গিয়েছি তখনি আমার সঙ্গী আমাকে চোখ টিপে বলে দিয়েছেন, ‘এ জল নয়, এ মেজে।’ সুতরাং আমাকে অপ্রস্তুত হতে হয় নি। এখানকার চাকচিক্যময় সমাজের দেয়াল-ব্যাপী আয়না দেখে আমি দরজা মনে করে যেমন সেই দিকে যাবার উদ্যোগ করেছি আমার সঙ্গী অমনি আমার কানে কানে বলে দিয়েছেন যে, ‘এ দরজা নয়, এ দরজা নয়, এ দেয়াল।’ সুতরাং মাথা ঠুকে ঠুকে আমাকে শিখতে হয় নি যে, সেটা দরজা নয়, দেয়াল। অন্ধকারে প্রথম এলে কিছু দেখা যায় না, অনেক ক্ষণ থাকলে—অন্ধকার চোখে অনেকটা সয়ে গেলে তার পরে চার দিকের জিনিস দেখা যায়। কিন্তু আমাকে সে রকম করে দেখতে হয় নি, আমার সঙ্গেই আলো ছিল। আমি তাই ভাবছি যে, আমার নিজের অভিজ্ঞতার বিষয় আপাততঃ তোমাদের কিছু বলব না। এখানকার দুই-এক জন বাঙালির মুখে তাঁদের যে রকম বিবরণ শুনেছি তাই তোমাদের লিখছি।
জাহাজে তো তাঁরা উঠলেন। যাত্রীদের সেবার জন্যে জাহাজে অনেক ইংরেজ চাকর থাকে, তাদের নিয়েই এঁদের প্রথম গোল বাধে। এঁরা অনেকে তাদের ‘সার-সার’ (Sir) বলে সম্বোধন করতেন, তাদের কোনো কাজ করতে হুকুম দিতে তাঁদের বাধোবাধো করত। জাহাজে তাঁরা অত্যন্ত সসংকোচভাবে থাকতেন। ‘কোথায় কী করতে হবে রে বাপু! গোরা-কাপ্তেন গোরা-মাঝি পাছে রুখে দু কথা শুনিয়ে দেয়, নিতান্তই তাদের আশ্রয়ে আছি— কালো মানুষ দেখেও যে টিকিট কিনতে দিয়েছেন এই তাঁদের যথেষ্ট অনুগ্রহ!’ তাঁরা বলেন, সকল বিষয়েই তাঁদের-যে ও রকম সংকোচ বোধ হত তার আর একটা কারণ ছিল—‘এক জন ইংরাজ যাত্রীর চেয়ে আমাদের ও রকম সংকোচের ত্রস্ত অবস্থা কেন হয় জানো? সেটা কেবল ভয়ে নয়, তার সঙ্গে কতকটা লজ্জাও আছে। আমাদের কপালে নেটিব ব’লে একেবারে মার্কা মারা ছিল; আমরা যদি একটা কোনো দস্তুরবিরুদ্ধ কাজ করি তা হলে সাহেবরা হেসে উঠবেন, বলবেন ওটা অসভ্য—কিছু জানে না। তাই জন্যে যে কাজ করতে যাই, মনে হয়, পাছে এটা বেদস্তুর হয়ে পড়ে, আর বেদস্তুর কাজ করলে তারা হুট করে তাড়িয়েই বা দেয়, আর যদি বা তাড়িয়ে না দেয়, নেটিব ব’লে হেসেই বা ওঠে!’ জাহাজে ইংরাজদের সঙ্গে মেশা বড়ো হয়ে ওঠে না। যে সাহেবেরা তখন জাহাজে থাকেন তাঁরা টাটকা ভারতবর্ষ থেকে আসছেন; সে ‘হুজুর ধর্মাবতার’গণ কৃষ্ণবর্ণ দেখলে নাক তুলে, ঠোঁট ফুলিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে চলে যান ও এই ঘোরতর তাচ্ছিল্যের স্পষ্ট লক্ষণগুলি সর্বাঙ্গে প্রকাশ ক’রে কৃষ্ণচর্মের মনে দারুণ বিভীষিকা সঞ্চার করেছেন জেনে মনে মনে পরম সন্তোষ উপভোগ করেন। মাঝে মাঝে ভদ্র ইংরাজ দেখতে পাবে, তাঁরা হয়তো তোমাকে নিতান্ত সঙ্গীহীন দেখে তোমার সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করবেন। জানবে তাঁরা যথার্থ ভদ্র, অর্থাৎ ভদ্র ও উচ্চ পরিবারের লোক, বংশাবলীক্রমে তাঁরা ভদ্রতার বীজ পেয়ে আসছেন, তাঁরা এখানকার কোনো অজ্ঞাত কুল থেকে অখ্যাত নাম নিয়ে ভারতবর্ষে গিয়ে হঠাৎ ফেঁপে ফুলে ফেটে আটখানা হয়ে পড়েন নি। এখানকার গলিতে গলিতে যে ‘জন জোন্স্ টমাস’-গণ কিলবিল করছে, যাদের মা বাপ বোনকে একটা কসাই একটা দরজী ও এক জন কয়লা-বিক্রেতা ছাড়া আর কেউ চেনে না, তারা ভারতবর্ষের যে অঞ্চলে পদার্পণ করে সে অঞ্চলে ঘরে ঘরে তাদের নাম রাষ্ট্র হয়ে যায়—যে রাস্তায় তারা চাবুক হস্তে ঘোড়ায় চড়ে যায় (হয়তো সে চাবুক কেবল মাত্র ঘোড়ার জন্যেই ব্যবহার হয় না) সে রাস্তা-সুদ্ধ লোক শশব্যস্ত হয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়— তাদের এক-একটা ইঙ্গিতে ভারতবর্ষের এক-একটা রাজার সিংহাসন কেঁপে ওঠে— এ রকম অবস্থায় সে ভেকদের পেট উত্তরোত্তর ফুলতে ফুলতে যে হস্তীর আকার ধারণ করবে আমি তো তাতে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাই নে। তারা রক্তমাংসের মানুষ বৈ তো নয়। যে দেশেই দেখো-না কেন, ক্ষুদ্র যখনি মহান পদ পায় তখনি সে চোক রাঙিয়ে, বুক ফুলিয়ে, মহত্ত্বের একটা আড়ম্বর আস্ফালন করতে থাকে। এর অর্থ আর কিছু নয়— তারা মহত্ত্বের শিক্ষা পায় নি। যে সাঁতার জানে না তাকে জলে ছেড়ে দেও, সে অবিশ্রান্ত হাত পা ছুঁড়তে থাকবে; তার কারণ, সে জানে না যে ভেসে থাকবার জন্যে অন্য কৌশল আছে। যে কোনো জন্মে ঘোড়া চালায় নি তাকে ঘোড়া চালাতে দেও, ঘোড়া বিপথে গেলে সে চাবুক মেরে মেরেই তাকে জর্জরিত করবে; কেননা, সে জানে না যে একটু লাগাম টেনে দিলেই তাকে সোজা পথে আনা যায়। কিন্তু ভদ্র ইংরেজদের দেখো, তাঁদের কী সুন্দর মন! মাঝে মাঝে এক-একটি ভদ্র সাহেবকে দেখা যায়, তাঁরা আংগ্লো-ইন্ডিয়ানত্বের ঘোরতর সংক্রামক রোগের মধ্যে থেকেও বিশুদ্ধ থাকেন, অপ্রতিহত প্রভুত্ব ও ক্ষমতা পেয়েও উদ্ধত গর্বিত হয়ে ওঠেন না। সমাজশৃঙ্খলচ্ছিন্ন হয়ে সহস্র সহস্র সেবকদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভারতবর্ষে থাকা —উন্নত ও ভদ্র মনের এক প্রকার অগ্নিপরীক্ষা। দূর হোক্গে, আমি কী কথা বলতে কী কথা পাড়লেম দেখো!— যা হোক, এতক্ষণে জাহাজ সাউথ্হ্যাম্প্টনে এসে পৌঁচেছে, বঙ্গীয় যাত্রীরা বিলেতে এসে পৌঁছলেন। লন্ডন-উদ্দেশে চললেন। ট্রেন্ থেকে নাববার সময় একজন ইংরাজ গার্ড্ এসে উপস্থিত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তাঁদের কী প্রয়োজন আছে, কী করে দিতে হবে। তাঁদের মোট নাবিয়ে দিলে, গাড়ি ডেকে দিলে। তাঁরা মনে মনে বললেন, ‘বাঃ! ইংরেজরা কী ভদ্র!’ ইংরেজরা যে এত ভদ্র হতে পারে তা তাঁদের জ্ঞান ছিল না। অবিশ্যি তার হস্তে একটি শিলিং গুঁজে দিতে হল; কিন্তু তা হোক, আমাদের দেশে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে একটু আদর ও ভদ্রতা পাবার প্রত্যাশে রাজা-রায়বাহাদুররা কত হাজার হাজার টাকা খরচ করছেন, তবুও ভালো করে কৃতকার্য হতে পারছেন না। এ জেনে এক জন নবাগত বঙ্গযুবক এক জন যেকোনো শ্বেতাঙ্গের কাছ থেকে একটি মাত্র সেলাম পেতে অকাতরে এক শিলিং ব্যয় করতে পারেন। যা হোক, বিলেতে প্রথম পদার্পণ করবামাত্রেই তাঁরা এই অতি নতুন ও আশ্চর্য জ্ঞান লাভ করেন যে, ইংরাজরা কী ভদ্র! আমি ধাঁদের বিষয় লিখছি তাঁরা অনেক বৎসর বিলাতে আছেন, বিলেতের নানা প্রকার ছোটোখাটো জিনিস দেখে তাঁদের কিরকম মনে হয়েছিল তা তাঁদের স্পষ্ট মনে নেই। যে-সব বিষয় তাঁদের বিশেষ মনে লেগেছিল তাই এখনও তাঁদের মনে আছে। তাঁরা বিলেতে আসবার পূর্বে তাঁদের বিলিতি বন্ধুরা এখানে তাঁদের জন্যে ঘর ঠিক করে রেখেছিলেন। ঘর ঢুকে দেখেন— ঘরে কার্পেট পাতা, দেয়ালে ছবি টাঙানো, একটা বড়ো আয়না এক জায়গায় ঝোলানো রয়েছে, কৌচ, কতকগুলি চৌকি, দুই-একটা কাঁচের ফুলদানি, এক পাশে একটি ছোটো পিয়ানো। কী সর্বনাশ! তাঁদের বন্ধুদের ডেকে বললেন, ‘আমরা কি এখেনে বড়োমানুষি করতে এসেছি? আমাদের, বাপু, বেশি টাকাকড়ি নেই; এ রকম ঘরে থাকা আমাদের পোষাবে না!’ তাঁদের বন্ধুরা অত্যন্ত আমোদ পেলেন; কারণ, তখন তাঁরা একেবারে ভুলে গেছেন যে বহুপূর্বে তাঁদেরও এক দিন এই রকম দশা ঘটেছিল। নবাগতদের নিতান্ত অন্নজীবী বাঙালি মনে করে অত্যন্ত বিজ্ঞতার স্বরে সেই বন্ধুরা বললেন, ‘এখানকার সকল ঘরই এই রকম।’ তাঁরা বললেন, ‘বটে!’ দেশের উপর বৈরাগ্যের এই তাঁদের প্রথম সূত্রপাত হল। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দেশে সেই একটা স্যাঁৎসেঁতে ঘরে একটা তক্তা ও তার উপরে একটা মাদুর পাতা, ইতস্ততঃ হুঁকোর বৈঠক রয়েছে, কোমরে একটুখানি কাপড় জড়িয়ে জুতো জোড়া খুলে দু চার জনে মিলে শতরঞ্চ খেলা যাচ্ছে, বাড়ির উঠোনে একটা গোরু বাঁধা, দেয়ালে গোবর দেওয়া, বারান্দা থেকে ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে ইত্যাদি। সেখান থেকে এসে এ কার্পেট-মোড়া চিত্রিত-দেয়াল চৌকি-টেবিল-সমাকুল ঘরে বাস করতে পাওয়া অনেক জন্মের অনেক তপস্যার ফল বলে মনে হয়।’ তাঁরা বলেন— প্রথম প্রথম দিনকতক তাঁদের সে ঘর কেমন আপনার মতো মনে হত না; চৌকিতে বসতে, কৌচে শুতে, টেবিলে খেতে, কার্পেটে বিচরণ করতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ হত। কৌচে বসতে হলে অত্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে বসতেন; ভয় হত, পাছে কৌচ ময়লা হয়ে যায় বা কোনো প্রকার হানি হয়। তাঁদের মনে হত, কৌচগুলো কেবল ঘর সাজাবার জন্যেই রেখে দেওয়া হয়েছে, ওগুলো ব্যবহার করতে দিয়ে মাটি করা কখনই ঘরের কর্তার অভিপ্রেত হতে পারে না। ঘরে এসে প্রথম মনের ভাব তো এই। তার পরে আর-একটি প্রধান কথা বলা বাকি আছে।
বিলেতে ছোটোখাটো বাড়িতে ‘বাড়িওয়ালা’ বলে একটা জীবের অস্তিত্ব আছে হয়তো; কিন্তু যাঁরা বাড়িতে থাকেন, ‘বাড়িওয়ালী’র সঙ্গেই তাঁদের সমস্ত সম্পর্ক। ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া, কোনো প্রকার বোঝাপড়া আহারাদির বন্দোবস্ত করা, সে-সমস্তই বাড়িওয়ালীর কাছে। আমার বন্ধুরা যখন প্রথম বাড়িতে পদার্পণ করলেন, দেখলেন, এক বিবি এসে অতি বিনীত স্বরে তাঁদের ‘সুপ্রভাত’ অভিবাদন করলে; তাঁরা নিতান্ত শশব্যস্ত হয়ে ভদ্রতার যথাযোগ্য প্রতিদান দিয়ে অতি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন তাঁদের অন্যান্য ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ তার সঙ্গে অতি অসংকুচিত স্বরে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন, তখন আর তাঁদের বিস্ময়ের আদি অন্ত রইল না। মনে করো একটা জীবন্ত বিবি— জুতো-পরা, টুপি-পরা, গাউন-পরা! তখন সে ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুদের উপর সেই নবাগত বঙ্গযুবকের অত্যন্ত ভক্তির উদয় হল, কোনো কালে যে এই অসমসাহসিকদের মতো তাঁদেরও বুকের পাটা জন্মাবে তা তাঁদের সম্ভব বোধ হল না। যা হোক, এই নবাগতদের যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ স্ব স্ব আলয়ে গিয়ে সপ্তাহকাল ধরে তাঁদের অজ্ঞতা নিয়ে অপর্যাপ্ত হা্যকৌতুক করলেন। পূর্বোক্ত গৃহকর্ত্রী প্রত্যহ নবাগতদের অতিবিনীতভাবে কী চাই কী না চাই জিজ্ঞাসা করতে আসত। তাঁরা বলেন, এই উপলক্ষে তাঁদের অত্যন্ত আহ্লাদ হত। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, প্রথম দিন, যে দিন তিনি এই বিবিকে একটুখানি ধমকাতে পেরেছিলেন, সে দিন সমস্ত দিন তাঁর মন অত্যন্ত প্রফুল্ল ছিল। জীবনের মধ্যে এই প্রথম একজন ইংরেজকে একজন বিবিকে ধমকাতে পেরেছিলেন, অথচ সে দিন সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে নি, পর্বত চলাফেরা করে বেড়ায় নি, বহ্নিও শীতলতা প্রাপ্ত হয় নি!
কার্পেট-মোড়া ঘরে তাঁরা অত্যন্ত সুখে বাস করছেন। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দেশে ‘আমার নিজের ঘর’ বলে একটা স্বতন্ত্র পদার্থ ছিল না। আমি যে ঘরে বসতেম সে ঘরে বাড়ির দশজনে যাতায়াত করছে; আমি এক পাশে বসে লিখছি, দাদা এক পাশে একখানা বই হাতে করে ঢুলছেন, আর-এক দিকে মাদুর পেতে গুরুমশায় ভুলুকে উচ্চৈঃস্বরে সুর করে করে নামতা পড়াচ্ছেন। এখানে আমার নিজের ঘর আমার নিজের মনের মতো করে সাজালেম, সুবিধামত করে বইগুলি এক দিকে সাজালেম, লেখবার সরঞ্জাম এক দিকে গুছিয়ে রাখলেম, কোনো ভয় নেই যে একদিন পাঁচটা ছেলে মিলে সে-সমস্ত ওলটপালট করে দেবে, আর-এক দিন দুটোর সময় কালেজ থেকে এসে দেখব তিনটে বই পাওয়া যাচ্ছে না— অবশেষে অনেক খোঁজ্ খোঁজ্ ক’রে দেখা যাবে বাড়ির ভিতরে মেঝমাসিমার কুলুঙ্গির উপর একখানা, দাদার বালিশের নীচে একখানা, আর-একখানি নিয়ে আমার ছোটো ভাগ্নীটি তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহচরীদের ডেকে ছবি দেখতে ঘোরতর ব্যস্ত আছেন। এখানে তোমার নিজের ঘরে তুমি বসে থাকো— দরজাটি ভেজানো, সট্ করে না বলে কয়ে কেউ ঘরের মধ্যে এসে পড়ে না, ঘরে ঢোকবার আগে দরজায় শব্দ করে, ছেলেপিলেগুলো চারি দিকে চেঁচামেচি কান্নাকাটি জুড়ে দেয় নি, নিরিবিলি নিরালা, কোনো হাঙ্গাম নেই।’ স্বদেশের উপর ঘৃণা জন্মাবার সূত্রপাত এই রকম করে হয়। তার পরে একবার যখন তোমার মন বিগড়ে যায় তখন তুমি খিট্খিটে হয়ে ওঠ, দেশের আর কিছুই ভালো লাগে না, নানাপ্রকার খুঁটিনাটি ধরতে প্রবৃত্তি হয়। তার পরে যখন বিবিদের সমাজে মিশতে আরম্ভ কর তখন দেশের উপর ঘৃণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। প্রায় দেখা যায়, আমাদের দেশের পুরুষরা এখানকার পুরুষসমাজে বড়ো মেশেন না; তার কতকগুলি কারণ আছে। এখানকার পুরুষসমাজে মিশতে গেলে এক রকম বলিষ্ঠ স্ফূর্তির ভাব থাকা চাই; মাথা চুলকোতে চুলকোতে বাধো-বাধো নাকি-সুরে দু-চারটে সসংকোচ ‘হাঁ না’ দিয়ে গেলে চলে না, খুব প্রাণ খুলে কথা কওয়া চাই, পাঁচটা লোক দেখেই একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছি —এ রকম ভাব প্রকাশ না পায়। রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে অবাধে তোমার স্বাধীন মত ব্যক্ত করবে; তোমাকে কেউ ঠাট্টা করলে তুমি অমনি শরমে মরে যেয়ো না, তুমিও তোমার আলাপীর সঙ্গে ঠাট্টা করে মজা করে ঘর সরগরম করবে। বহুদিনের পর তোমার পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে ‘Hallo my old boy’ বলে খুব সবল সেক্হ্যাণ্ড্ করবে আর খুব গড়্গড়্ কথা কয়ে যাবে। কিন্তু বাঙালিদের এ রকম ভাব প্রায় দেখা যায় না। বাঙালি অভ্যাগত ডিনার-টেবিলে তার পার্শ্বস্থ মহিলাটির কানে কানে অতি মৃদু ধীর স্বরে মিষ্টি-মিষ্টি টুকরো-টুকরো দুইএকটি কথা আধো-আধো গলানো সুরে কইতে পারেন, কোমল মধুর হাসি হাসতে হাসতে দুটো রসগর্ভ বাক্য বলতে পারেন, আর সে মহিলার সহবাসে তিনি যে স্বর্গসুখ উপভোগ করছেন তা তাঁর মাথার চুল থেকে বুট-জুতোর আগা পর্যন্ত প্রকাশ হতে থাকে— সুতরাং, বিবি-সমাজে বাঙালিরা খুব পসার করে নিতে পারেন। এখানকার পুরুষসমাজে মিশতে গেলে অনেক পড়াশুনো থাকা চাই, নইলে অনেক কথায় অপ্রস্তুত হতে হয়। একটা বড়ো কথা পড়লে আমরা আমাদের পুরাতন চাণক্য ঋষির উপদেশ স্মরণ করি— অর্থাৎ, ‘তাবচ্চ শোভতে মূর্খো যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে’। কিন্তু পুরুষ সঙ্গীদের কথাবার্তায় খুব যোগ না দিলে তেমন মেশামেশি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। মহিলাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে আমাদের বড়ো শিক্ষার দরকার করে না, সে বিষয়ে আমাদের অশিক্ষিতপটুত্ব। আমাদের দেশের ঘোমটাচ্ছন্ন-মুখচন্দ্র-শোভী অনালোকিত অন্তঃপুর থেকে এখানকার রূপের মুক্তজ্যোৎস্নায় এসে আমাদের মন-চকোর প্রাণ খুলে গান গেয়ে ওঠে।
একদিন আমাদের নবাগত বঙ্গযুবক তাঁর প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছেন। নিমন্ত্রণসভায় বিদেশীর অত্যন্ত সমাদর। তিনি গৃহস্বামীর যুবতী কন্যা Miss অমুকের বাহুগ্রহণ করে আহারের টেবিলে গিয়ে বসলেন। মিসের প্রতি হাসি প্রতি কথা তাঁর হৃদয়ের সমুদ্রে এক-একটা বিপর্যয় তরঙ্গ তুলতে লাগল। আমরা আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে, তার পরে নতুন-নতুন এসে এখানকার স্ত্রীলোকদের ভাবও ঠিক বুঝতে পারি নে। আমরা কোনো অপরিচিত মহিলার মুখ থেকে কথা শুনতে পেলে আহ্লাদে গ'লে পড়ি, সামাজিকতার অনুরোধে তারা আমাদের মনোরঞ্জন করবার জন্যে যে-সকল কথাবার্তা হাস্যালাপ করে আমরা তার ঠিক মর্মগ্রহণ করতে পারি নে, আমরা হঠাৎ মনে করি—আমাদের ওপরেই এই মহিলাটির বিশেষ অনুকূল দৃষ্টি, নইলে এত হাসি এত কথা কেন? যা হোক, আমাদের বঙ্গযুবকটি তাঁর এই প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে এক জন মহিলা, বিশেষতঃ এক জন বিবির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টহাসি ও মিষ্টালাপ পেয়ে অত্যন্ত উল্লসিত আছেন। তিনি মিস্কে ভারতবর্ষ-সংক্রান্ত অনেক কথা বললেন; বললেন— তাঁর বিলেত অত্যন্ত ভালো লাগে, ভারতবর্ষে ফিরে যেতে তাঁর ইচ্ছে করে না, ভারতবর্ষে অনেক প্রকার কুসংস্কার আছে। কথা বলার অভিপ্রায় এই যে, বিবিটির মনে বিশ্বাস হবে যে তিনি নিজে সমস্ত কুসংস্কার হতে মুক্ত। শেষকালে দুই-একটি মিথ্যে কথাও বললেন; বললেন, তিনি সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে গিয়েছিলেন, একবার নিতান্ত মরতে মরতে কেবল অসমসাহসিকতা করে বেঁচে গিয়েছিলেন। মিস্টি অতি সহজে বুঝতে পারলেন যে, এই যুবকের তাঁকে অতি ভালো লেগেছে, তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন ও তাঁর মিষ্টতম বাক্যবাণ যুবকের প্রাণে হানতে লাগলেন।—‘আহা কী গোছালো কথা! কোথায় আমাদের দেশের মেয়েদের মুখের সেই নিতান্তশ্রমলভ্য দুই-একটি ‘হাঁ না’— যা এত মৃদু যে ঘোমটার সীমার মধ্যেই মিলিয়ে যায়— আর কোথায় এখানকার বিম্বৌষ্ঠনিঃসৃত অজস্র মধুধারা যা অযাচিত ভাবে মদিরার মতো মাথার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে।'—প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে আমাদের বঙ্গযুবকের মনে এই কথাগুলি ওঠে। সেই দিনেই তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে চিঠি লেখা স্থগিত করলেন!
এখন তোমরা হয়তো বুঝতে পারছ, কী কী মশলার সংযোগে বাঙালি বলে একটা পদার্থ ক্রমে বেঙ্গো।—অ্যাঙ্গিক্যান কিম্বা ইঙ্গবঙ্গ নামে একটা খিচুড়িতে পরিণত হয়। আমি অতি সংক্ষেপে তার বর্ণনা করেছি, সমস্ত প্রক্রিয়াটি বিস্তারিত করে লিখতে পারি নি। আমি তার বড়ো বড়ো দুই-একটা কারণ দেখিয়েছি, কিন্তু এত-সব ছোটো ছোটো বিষয়ের সমষ্টি মানুষের মনে অলক্ষিত পরিবর্তন উপস্থিত করে যে, সে-সকল খুঁটিনাটি করে বর্ণনা করতে গেলে আমার পুঁথি বেড়ে যায় আর তোমাদের ধৈর্যও কমে যায়। সুতরাং এইখানেই সে-সকল বর্ণনা সমাপ্ত করা যাক।
এখন মনে করো, এক বৎসর বিলেতে থেকে বাঙালি তাঁর দেহের ও মনের প্রথম খোলস পরিত্যাগ করেছেন ও হ্যাট-কোট পরিধান করে দ্বিজত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন ও মনে মনে কল্পনা করছেন যে, এতদিনে তিনি গুটিপোকাত্ব ত্যাগ করে প্রজাপতিত্বে উপস্থিত হয়েছেন। এই অবস্থায় তাঁকে একবার আলোচনা করে দেখা যাক। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মহা চটে উঠেছ; তুমি বলছ, ‘বিলেতে গিয়ে বাঙালিদের বর্ণনা করতে বসাও যা আর গোলকুণ্ডায় গিয়ে রানীগঞ্জের পাথুরে কয়লার বিষয় লেখাও তাই।’ কিন্তু স্থির হও. আমি তোমাকে কারণ দেখাচ্ছি। আমি তোমার গা ছুঁয়ে বলতে পারি, বিলাতী বাঙালির চেয়ে নতুন দ্রব্য বিলেতে খুব কম আছে। ইংরাজ ও আঙ্গ্লো-ইন্ডিয়ান যেমন দুই স্বতন্ত্র জাত, বাঙালি ও ইঙ্গবঙ্গও তেমনি দুই স্বতন্ত্র জীব। এই জন্য ইঙ্গবঙ্গদের বিষয়ে তোমাদের যত নতুন কথা ও নতুন খবর দিতে পারব, এমন বিলেতের আর খুব কম জিনিসের উপর দিতে পারব। ইঙ্গবঙ্গদের সংখ্যা এত সামান্য যে তুমি মনে করতে পারে।, আমি ব্যক্তিবিশেষদের উপর কটাক্ষ করে বলছি। কিন্তু তা নয়— আমি ইঙ্গবঙ্গ দলের একটা সাধারণ আদর্শ কল্পনা করে নিয়েছি, আমার চার দিককার অভিজ্ঞতা থেকে স্বভাবতঃ ও সাধারণতঃ বাঙালিদের বিলেতে এলে কী কী পরিবর্তন হতে পারে তাই ঠিক করেছি ও সেইগুলি সমষ্টিবদ্ধ করে একটা সমগ্র চিত্র আঁকতে চেষ্টা করছি।
ইঙ্গবঙ্গদের ভালো করে চিনতে গেলে তাঁদের তিন রকম অবস্থায় দেখতে হয়। তাঁরা ইংরাজদের সুমুখে কিরকম ব্যবহার করেন, বাঙালিদের সুমুখে কিরকম ব্যবহার করেন ও তাঁদের স্বজাত ইঙ্গবঙ্গদের সুমুখে কিরকম ব্যবহার করেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলবেন, ‘আমরা তিন জায়গায় সমান ব্যবহার করি, কেননা আমাদের একটা principle আছে।’ কিন্তু সেটা একটা কথার কথা মাত্র, আমি সে কথা বড়ো বিশ্বাস করি নে। একটি ইঙ্গবঙ্গকে এক জন ইংরেজের সুমুখে দেখো, তাঁকে দেখলে তোমার চক্ষু জুড়িয়ে যাবে। কেমন নম্র ও বিনীত ভাব! ভদ্রতার ভারে প্রতি কথায় ঘাড় নুয়ে নুয়ে পড়ছে, মৃদু ধীর স্বরে কথাগুলি বেরচ্ছে; তর্ক করবার সময় অতিশয় সাবধানে নরম করে প্রতিবাদ করেন ও প্রতিবাদ করতে হল বলে অপর্যাপ্ত দুঃখ প্রকাশ করেন, অসংখ্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, এবং তাঁর অজস্র ভদ্রতা দেখে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সন্তুষ্টমনে প্রার্থনা করতে থাকেন যে তিনি যেন জন্ম-জন্ম এই রকম প্রতিবাদ করেন। কথা ক’ন আর না ক’ন, এক জন ইংরেজের কাছে এক জন ইঙ্গবঙ্গ চুপ করে বসে থাকলেও তাঁর প্রতি অঙ্গভঙ্গী প্রতি মুখের ভাবে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু, তাঁকেই আবার তাঁর স্বজাতিমণ্ডলে দেখো, দেখবে তিনিই একজন মহা তেরিয়া-মেজাজের লোক। বিলেতে যিনি তিন বৎসর আছেন, এক-বৎসরের-বিলেত-বাসীর কাছে তাঁর অত্যন্ত পায়া ভারী! এই ‘তিন বৎসর’ ও ‘এক বৎসরের’ মধ্যে যদি কখনও তর্ক ওঠে, তা হলে তুমি ‘তিন বৎসরের’ প্রতাপটা একবার দেখতে পাও। তিনি প্রতি কথা এমন ভাবে এমন স্বরে বলেন যে, যেন সেই কথাগুলি নিয়ে সরস্বতীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ বোঝাপড়া হয়ে একটা স্থিরসিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। যিনি প্রতিবাদ করছেন তাঁকে তিনি স্পষ্টাক্ষরে বলেন ‘ভ্রান্ত’, কখনও বা মুখের ওপর বলেন ‘মূর্খ!’ তাঁর ভদ্রতা একটি গণ্ডীর মধ্যে বাস করে, তার বাইরে প্রায় পদার্পণ করে না। ব্যক্তিবিশেষের জন্যে তিনি তাঁর ভদ্রতার বিশেষ বিশেষ মাত্রা স্থির করে রেখেছেন। ইংলন্ডে যারা জন্মেছে তাদের জন্যে বড়ো চামচের এক চামচ— ইংলন্ডে যারা পাঁচ বৎসর আছে তাদের জন্যে মাজারি চামচের এক চামচ ইংলন্ডে যারা সম্প্রতি এয়েছে তাদের জন্যে চায়ের চামচের এক চামচ ও ইংলন্ডে যারা মূলে যায় নি তাদের জন্যে ফোঁটা দুইতিন ব্যবস্থা! ইংলণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কের ন্যূনাধিক্য নিয়ে তাঁদের ভদ্রতার মাত্রার ন্যূনাধিক্য হয়। তাঁদের মাপাজোকা ভদ্রতার পায়ে গড় করি, তাঁদের ‘principle’এর পায়ে গড় করি।
বিলেতে এলে লোকে ‘principle’ ‘principle’ করে মহা কোলাহল করতে থাকে, কিন্তু আমি ও রকম বাক্যের আড়ম্বর সইতে পারি নে। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে চাই, ‘বাস্তবিক কি তোমরা একটা স্থির মত বেঁধেছ? আর সে মতগুলি বাঁধবার আগে কেন যে সেগুলি গ্রহণ করলে তা কি বিচার করে দেখেছ?’ তাঁরা সকলেই বলে উঠবেন ‘হাঁ’; কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি, তাঁদের মধ্যে শতকরা নিরেনব্বই জন তা করেন নি। ইংরেজরা তাঁদের যদি বলে যে কাকে তাঁদের কান উড়িয়ে নিয়ে গেছে তা হলে কানে হাত না দিয়ে তাঁরা কাকের পশ্চাতে পশ্চাতে ছোটেন। সে দিন একজন গল্প করছিলেন যে তাঁকে আর এক জন বাঙালি জিজ্ঞাসা করেছিেলেন যে, ‘মশায়ের কী কাজ করা হয়?’ এই গল্প শুনবামাত্র আমাদের একজন ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু নিদারুণ ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘দেখুন দেখি, কী barbarous!’ আমি আর থাকতে পারলেম না— আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘কেন barbarous বুঝিয়ে দিন তো মশায়!’ তিনি কোনো মতে বোঝাতে পারলেন না; তাঁর ভাবটা এই যে, যেমন মিথ্যে কথা না বলা, চুরি না করা নীতিশাস্ত্রের কতকগুলি মূল নিয়ম, তেমনি অন্য মানুষকে তার জীবিকার কথা জিজ্ঞাসা না করাও একটা মূল নিয়মের মধ্যে, তার জন্যে অন্য কারণ অনুসন্ধানের আবশ্যক করে না। আমি তাঁকে বললেম যে, ‘দেখুন মশায়, ইংরেজরা একটা জিনিস মন্দ বলে ব’লে আপনি অবিচারে অকাতরে সেটাকে মন্দ বলবেন না। কেন ইংরেজরা মন্দ বলছে সেটা আগে বিচার করে দেখবেন, তার পরে যদি যুক্তিসিদ্ধ মনে হয় তা হলে নাহয় মন্দ বলবেন। চাকরির কথা জিজ্ঞাসা কর। ইংরাজেরা যে কেন মন্দ বলে তার অবিশ্যি কারণ আছে— অল্প বেতনে আপনি হয়তো অতি সামান্য চাকরি করছেন, আপনাকে চাকরির কথা জিজ্ঞাসা করলে আপনার হয়তো উত্তর দিতে সংকোচ বোধ হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন barbarous বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন তখন এ-সকল কারণ বিবেচনা করেন নি।’ এর থেকে বেশ বুঝতে পারবে যে, যে ইঙ্গবঙ্গগণ আমাদের দেশীয় সমাজে নানা প্রকার কুসংস্কার আছে বলে নাসা কুঞ্চিত করেন, বিলেত থেকে তাঁরা তাঁদের কোটের ও প্যাণ্টলুনের পকেট পূরে রাশি রাশি কুসংস্কার নিয়ে যান। কুসংস্কার আর কাকে বলে বলো। যতক্ষণে তুমি তোমার বিশেষ সংস্কারের একটা সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পারো ততক্ষণ আমি তাকে কুসংস্কার বলব। অতএব, হে ইঙ্গবঙ্গ, তুমি ভারতবর্ষের প্রতি সামাজিক আচার ব্যবহারকে যে prejudice বলে ঘৃণা কর, সেই ঘৃণা করাটাই হয়তো এক প্রকার prejudice। তুমি হয়তো জান না যে তুমি কেন ঘৃণা করছ। তোমার হয়তো একটা দারুণ কুসংস্কার আছে যে তুমি ব্যতীত তোমার স্বদেশজাত আর-সমস্ত দ্রব্যই মন্দ। আমি এক-এক সময়ে ভাবি, একজন বুদ্ধিমান প্রাণীর মনে কিরকম করে এ রকম অন্ধ কুসংস্কার জন্মাতে পারে। সে দিন এক জায়গায় আমাদের দেশের শ্রাদ্ধের কথা হচ্ছিল— বাপ-মা’র মৃত্যুর পর আমরা হবিষ্য করি, বেশভূষা করিনে ইত্যাদি। শুনে এক জন ইঙ্গবঙ্গ যুবক অধীরভাবে আমাকে বলে উঠলেন যে, ‘আপনি অবিশ্যি, মশায়, এ-সকল অনুষ্ঠান ভালো বলেন না।’ আমি বললেম, ‘কেন নয়? মৃত আত্মীয়ের জন্যে শোক প্রকাশ করাতে আমি তো কোনো দোষ দেখি নে। ভিন্ন ভিন্ন দেশে শোক প্রকাশ করবার ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম আছে। ইংরাজেরা কালো কাপড় প’রে শোক প্রকাশ করে ব’লে শাদা কাপড় পরে শোক প্রকাশ করা অসভ্যতার লক্ষণ মনে কোরো না। আমি দেখছি ইংরেজরা যদি আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষে হবিষ্যান্ন খেত, আর আমাদের দেশের লোকেরা না খেত, তা হলে হবিষ্যান্ন খায় না ব’লে আমাদের দেশের লোকের ওপর তোমার দ্বিগুণতর ঘৃণা হত ও মনে করতে হবিষ্যান্ন খায় না ব’লেই আমাদের দেশের এই দুর্দশা, আর হবিষ্যান্ন খেতে আরম্ভ করলেই আমাদের দেশ উন্নতির চরমশিখরে উঠতে পারবে।’ এর চেয়ে কুসংস্কার আর কী হতে পারে! ইঙ্গবঙ্গরা বলেন, দেশে গিয়ে দেশের লোককে সন্তুষ্ট করবার জন্যে দেশের কুসংস্কারের অনুবর্তন করা ভীরুতা— শুদ্ধ তাই নয়, তাঁদের মহামান্য principleএর বিরুদ্ধাচরণ। এ কথা শুনতে বেশ, কিন্তু এই মহাবীরদের একবার জিজ্ঞাসা করো তাঁরা বিলেতে কী করেন। তাঁরা ঘাড় নত করে ইংরাজদের কুসংস্কারের অনুসরণ করেন কি না? তাঁরা জানেন সেগুলি কুসংস্কার, তবু জেনে-শুনে সেগুলি পালন করেন কি না? তুমি হয়তো জানো ইংরেজেরা এক টেবিলে তেরো জন খাওয়া অত্যন্ত অলক্ষণ মনে করেন, তাঁদের বিশ্বাস তা হলে এক বৎসরের মধ্যে তাঁদের একজনের মৃত্যু হবেই। এক জন ইঙ্গবঙ্গ যখন নিমন্ত্রণ করেন তখন কোনোমতে তেরো জন নিমন্ত্রণ করেন না; জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘আমি নিজে অবিশ্যি বিশ্বাস করি নে, কিন্তু যাঁদের নিমন্ত্রণ করি তাঁরা পাছে কষ্ট পান তাই জন্যে বাধ্য হয়ে এ নিয়ম পালন করতে হয়।’ খুব উদারহৃদয় বটে! কিন্তু দেশে গিয়ে এ উদারতা কোথায় থাকে? তুমি হয়তো একটি সামান্য দেশাচার পালন করলে তোমার বাপ মা, ভাই বোন, তোমার সমস্ত দেশের লোক অত্যন্ত আহ্লাদিত হন; তখন কি তুমি তাঁদের সকলের মনে কষ্ট দিয়ে সেই দেশাচারের উপর তোমার বুট-সুদ্ধ পদাঘাত কর না? এইরূপ পদাঘাত করতে পারলে ব’লে কি সমস্ত বৎসরটা অত্যন্ত মনের আনন্দে থাক না? সে দিন এক জন ইঙ্গবঙ্গ একটি বালককে রবিবার দিনে রাস্তায় খেলা করতে যেতে বারণ করছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘রাস্তার লোকেরা কী মনে করবে?’ রাস্তার লোকের কুসংস্কারের অনুবর্তন করে তিনি যদি রবিবারে খেলা না করেন, তবে আত্মীয়স্বজনের কুসংস্কার বা সুসংস্কার বা নির্দোষ সংস্কার হুট করে রামনবমীর দিনে তিনি দেশে গোমাংস ভক্ষণ করেন কেন? Principle!!!
কুসংস্কার মানুষকে কতদূর অন্ধ করে তোলে তা বাঙলার অশিক্ষিত কৃষীদের মধ্যে অনুসন্ধান করবার আবশ্যক করে না, ঘোরতর সভ্যতাভিমানী বিলিতি বাঙালিদের মধ্যে তা দেখতে পাবে। হঠাৎ বিলেতের আলো লেগে তাঁদের চোখ একেবারে অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিলেতের কী দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে পড়েন? আমি অনুসন্ধান করে দেখেছি— কেবল বাহ্য-চাকচিক্য। এ বিষয়ে তাঁরা ঠিক বালকের মতো। একখানি বই দেখলে তাঁরা তার সোনারজলের-চিত্র-করা বাঁধানো মলাট দেখে হাঁ করে থাকেন, তার ভিতরে কী লেখা আছে তার বড়ো খবর রাখেন না। কতকগুলি বাঙালি বলেন, এখানকার মতো ঘর ভাড়া দেবার প্রথা তাঁরা আমাদের দেশে প্রচলিত করবেন। তাঁদের সেই একটিমাত্র সাধ আছে। তাঁদের চোখে বিলেতের আর-কিছু তেমন পড়ে নি, যেমন, বিলেতের ঘর ভাড়া দেবার প্রথা! আর এক জন বাঙালি, তিনি আমাদের বাঙালা সমাজসংস্কার করতে চান, তাঁর প্রধান বাতিক— তিনি আমাদের দেশের মেয়েদের নাচ শেখবার বন্দোবস্ত করে দেবেন। বিলেতের সমাজে মেয়েদের পুরুষদের সঙ্গে একত্রে নাচাটাই তাঁর চোখে অত্যন্ত ভালো লেগেছে ও আমাদের সমাজে মেয়েদের না নাচাই তাঁর প্রধান অভাব বলে মনে হয়—তিনি এখানকার সমাজসমুদ্র মন্থন করে ঐ নাচটুকুই পেয়েছেন। এই রকম বিলেতের কতকগুলি ছোটোখাটো বিষয়ই তাঁদের চোখে পড়ে। তাঁরা বিশেষ কী কী কারণে বিলেতের ওপর এত অনুরক্ত ও আমাদের দেশের ওপর এত বিরক্ত হয়ে ওঠেন তা যদি দেখতে যাও তো দেখবে সে-সকল অতি সামান্য—আমি পূর্বেই তা সংক্ষেপে বলেছি। প্রথমতঃ, এখানকার সুসজ্জিত পরিষ্কার পরিপাটী নিরিবিলি বাসস্থানে স্বাধীনভাবে বাস করবার বন্দোবস্ত। দ্বিতীয়তঃ, এখানকার মহিলাদের সঙ্গে মেশামেশি; তাদের মৃদুহাসি মিষ্টালাপ শিষ্টাচার এক জন বঙ্গযুবকের মাথা অতি শীঘ্র ঘুরিয়ে দেয়। তিনি আমাদের দেশের মেয়েদের সঙ্গে এখানকার মেয়েদের তুলনা করতে থাকেন। দেখেন, এখানকার মেয়েরা কেমন স্পষ্ট ও মিষ্ট কথা কয়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তর পাবার জন্যে বছর পাঁচেক অপেক্ষা করতে হয় না; তাদের মুখের উপরও যেমন ঘোমটার আবরণ নেই তেমনি তাদের প্রতি আচার ব্যবহারের উপরে এক প্রকার কষ্টকর সংকোচের আবরণ নেই। এই রকম কতকগুলি সাধারণ বিষয়ে আমাদের দেশের ও এ দেশের মেয়েদের অমিল দেখে তার পরে তিনি কতকগুলি বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে ছেলেমানুষের মতো খুঁতখুঁৎ করতে থাকেন। যে বালকের মাটির পুতুল আছে সে আর-একটি বালকের কাঠের পুতুল দেখে প্রথমতঃ তার নিজের কাঠের পুতুল নেই বলে কাঁদতে বসে; এই রকমে তার নিজের পুতুলের ওপর যখন একবার বৈরাগ্য জন্মায় তখন সেই কাঠের পুতুলের কানে একটা মাকড়ি দেখে তার খুঁতখুঁৎ দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে; তখন বিবেচনা করে না যে, সেই কাঠের পুতুলের কানে যেমন একটা মাকড়ি আছে তেমনি তার মাটির পুতুলের গলায় একটা হার আছে। তার মা এসে বলে, ‘আচ্ছা বাপু, তোর পুতুলের হাতে একটা বালা পরিয়ে দিচ্ছি।’ সে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘না, আমার মাকড়ি চাই!’ তার মা বলে, ‘আচ্ছা বাপু, একটা মল দিচ্ছি নাহয়!’ সে দ্বিগুণ পা ছুঁড়ে বলে ওঠে, ‘না, আমাকে মাকড়ি দে।’ ইঙ্গবঙ্গের কতকটা এই রকম করেন। এক জন ইঙ্গবঙ্গ মহা খুঁৎখুঁৎ করছিলেন যে, আমাদের দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজাতে পারে না ও এখানকার মতো visitorদের সঙ্গে দেখা করতে ও visit প্রত্যর্পণ করতে যায় না। হরি হরি! তুমি কী করে আশা করতে পারো যে আমাদের মেয়েরা পিয়ানো বাজাতে পারবে? তা হলে এক জন বাঙালি এখানে এসে খুঁতখুঁৎ করতে পারে যে, এ দেশের মেয়েরা পান সাজতে পারে না। দেশে থাকতে একবার শুনেছিলেম যে, আমাদের দেশের মেয়েদের উপর এক জন বাঙালির অভক্তি জন্মাবার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, ‘ইংরাজের মেয়েরা এমন সরেশ লেবুর আচার তৈরি করতে পারে যে তার ভিতরে বিচি থাকে না, কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েরা তো তা পারে না।’ এ গল্পটা আমার নিতান্ত জনশ্রুতি মনে হয় না। কেননা, মানুষের স্বভাবই এই যে, সাধারণতঃ এক জনের ওপর চটে গেলে তার পরে তার খুঁটিনাটি ধরতে আরম্ভ করে। সে দিন এক জন বাঙালি এখানকার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের দেশের ভোজের প্রথা যে নিতান্ত barbarous তাই প্রমাণ করবার জন্যে বললেন যে, আমাদের দেশে খাবার সময় মাছি ভ্যান্ ভ্যান্ করে। আর আমাদের দেশের লোকেরা যে barbarous তাই প্রমাণ করবার জন্যে বললেন যে, সেখেনে জুতো খুলে খেতে বসলে জুতো চুরি করে নিয়ে যায়। জানি নে হয়তো তাঁর বিশ্বাস যে, মাছি যদি বিলেতে আসত তো এত সভ্য হয়ে যেত যে খাবার সময় আর ভ্যান্ ভ্যান্ করত না। আর তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, এ দেশের লোকেরা জুতো খুলে খায় না। খুলে খেলে এখানে চুরি যেত কি না সে বিষয়ে বলা ভারী শক্ত; অতএব সে বিষয়ে কোনো প্রকার তুলনা উত্থাপন না করাই শ্রেয়। এই রকম ক্রমাগত প্রতি ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে এ দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করে করে তাঁদের চটা ভাব চটনমান যন্ত্রে blood heat ছাড়িয়ে ওঠে। এক জন ইঙ্গবঙ্গ তাঁর সমবেদক বন্ধুদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বলছিলেন যে, যখন তিনি মনে করেন যে দেশে ফিরে গেলে তাঁকে চারি দিকে ঘিরে মেয়েগুলো প্যান্ প্যান্ করে কাঁদতে আরম্ভ করবে তখন আর তাঁর দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না! অর্থাৎ তিনি চান যে, তাঁকে দেখবামাত্রেই ‘dear darling’ বলে ছুটে এসে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে তাঁর কাঁধে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এইটুকু অভিনয়ের ওপর তাঁর দেশে ফিরে যাওয়া নির্ভর করছে। তিনি তাঁর বাড়ির লোকদের ভালোবাসার তত মূল্য দেখেন না, যত তাদের ভালোবাসার অভিনয়ের। তিনি তাঁর স্বীয় পরিবারদের কত ভালোবাসেন, এর থেকে একবার বিবেচনা করে দেখো। তাঁদের একটিমাত্র আচারের পরিবর্তন না হলে তিনি বাড়ি ফিরে যেতে পারেন না, না জানি সে কী পরিবর্তন! সে পরিবর্তনে হয়তো চন্দ্রসূর্যের উদয়াস্তের বন্দোবস্ত একেবারে উলটে যেতে পারে, প্রকৃতির একটা মহা বিপ্লব বাধতে পারে। সে পরিবর্তন কী? না, S. K. Nandi Esqr.এর স্ত্রী পরিবারেরা যদি তাঁকে দেখে আনন্দের অশ্রু বর্ষণ না করে ছুটে তাঁকে আলিঙ্গন করতে আসে! আমি আগেই বলেছি, বিলেতের কতকগুলি বাহ্যিক ছোটোখাটো বিষয় বাঙালির চোখে পড়ে। তাঁরা যখন সাহেব হতে যান তখন সাহেবদের ছোটোখাটো আচারগুলি নকল করতে যান। ছোটোখাটো বিষয়ে তাঁদের খুঁটিনাটি যদি দেখো,তবে একেবারে আশ্চর্য হয়ে যাও। ডিনারের টেবিলে কাঁটা ছুরি উলটে ধরতে হবে কি পালটে ধরতে হবে তাই জানবার জন্যে তাঁদের প্রাণপণ যত্ন অন্বেষণ ও ‘গবেষণা’ দেখলে তোমার তাঁদের উপর ভক্তির উদয় হবে। কোটের কোন্ ছাঁটটা fashionable হয়েছে, আজকাল nobilityরা আঁট প্যাণ্টলুন পরেন কি ঢলকো প্যাণ্টলুন পরেন, waltz নাচেন কি polka নাচেন, মাছের পর মাংস খান কি মাংসের পর মাছ খান, সে বিষয়ে তাঁরা অভ্রান্ত খবর রাখেন। তুমি যদি দস্তানা পরবার সময় আগে থাকতে বুড়ো আঙুল গলিয়ে দেও তিনি তৎক্ষণাৎ বলে দেবেন— ও রকম দস্তুর নয়। ঐ রকম ছোটোখাটো বিষয়ে এক জন বাঙালি যত দস্তুর বেদস্তুর নিয়ে নাড়াচাড়া করেন এমন এক জন জন্বুল করেন না। তুমি যদি মাছ খাবার সময় ছুরি ব্যবহার কর[১] তবে এক জন ইংরাজ তাতে বড়ো আশ্চর্য হবেন না, কেননা, তিনি জানেন তুমি বিদেশী; কিন্তু এক জন ইঙ্গবঙ্গ সেখানে উপস্থিত থাকলে তাঁর স্মেলিং সল্টের আবশ্যক করবে। তুমি যদি শেরী খাবার গ্লাসে শ্যাম্পেন খাও তবে এক জন ইঙ্গবঙ্গ তোমার দিকে তিন দণ্ড হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন, যেন এমন জানোয়ার তিনি কখনো দেখেন নি—যেন একটা অভূতপূর্ব নিদারুণ বিপ্লব বেধে গেল— যেন তোমার এই একটি অজ্ঞতার জন্যে সমস্ত পৃথিবীর সুখশান্তি নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। সন্ধ্যে বেলায় তুমি যদি morning-coat পরো তা হলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হলে যাবজ্জীবন তোমাকে দ্বীপান্তরবাসের আজ্ঞা দেন।
এক জন বিলাত-ফেরতা কাউকে মটন দিয়ে রাই দিয়ে[২] খেতে দেখলে বলতেন, ‘তবে কেন মাথা দিয়ে চল না?’ তাঁর চক্ষে রাই দিয়ে মটন খাওয়াও যা আর মাথা দিয়ে হাঁটাও তাই! এই রকম সব ছোটোখাটো বিষয়েই ইঙ্গবঙ্গদের যত দৃষ্টি। ছোটোখাটো বিষয়ে এত খুঁটিনাটি কেন, যদি জিজ্ঞাসা করো তবে তার একটা কারণ দেখাতে পারি। বাঙালি হয়ে সাহেবের মুখোষ পরতে গেলে প্রতি পদে ভয় হয় পাছে বাঙালিত্ব বেরিয়ে পড়ে; সুতরাং প্রতি সামান্য বিষয়ে সাবধান হওয়া স্বাভাবিক। তোমার বুকটা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কালো হলেও হানি নেই, কেননা সে-সব কাপড়ে ঢাকা থাকে, কিন্তু মুখটা এমন সাবধানে চুনকাম করা আবশ্যক যে কোনো জায়গায় কালো বেরিয়ে না থাকে। তুমি, যদি সাহেব হতে চাও, তবে সাহেবদের যতখানি বাইরে চর্মচক্ষে দেখা যায় ততখানি নকল করলেই যথেষ্ট। যে বাঙালিরা বিলেতে আসেন নি তাঁরা তোমার বাঁকানো ইংরিজি সুর, তোমার হ্যাট কোট ও তোমার উদগ্র মূর্তি দেখে তাক হয়ে থাকবেন। কিন্তু একটা মজা দেখেছি, ইঙ্গবঙ্গেরা পরস্পর আপনাদের চেনেন; তাঁরা দলবহির্ভূত লোকদের কাছে যথেষ্ট আস্ফালন করেন বটে, কিন্তু তাঁদের পরস্পরের কাছে কিছু গোপন নেই, তাঁরা নিজে বেশ জানেন যে—
কাকস্য পক্ষৌ যদি স্বর্ণযুক্তৌ
মাণিক্যযুক্তৌ চরণৌ চ ত্যস্য
একৈকপক্ষে গজরাজমুক্তা
তথাপি কাকো ন চ রাজহংসঃ।
সোনা দিয়ে বাঁধা হোক কাকটার ডানা,
মাণিকে জড়ানো হোক তার পা-দুখানা,
এক এক পক্ষে তার গজমুক্তা থাক্—
রাজহংস নয় কভু, তবুও সে কাক।
আমি আর একটি আশ্চর্য লক্ষ্য করে দেখেছি যে, বাঙালিরা ইংরাজদের কাছে যত আপনাদের দেশের লোকের ও আচারব্যবহারের নিন্দে করেন এমন এক জন ঘোর ভারতদ্বেষী অ্যাংগ্লো-ইন্ডিয়ান করেন না। তিনি নিজে ইচ্ছে করে কথা পাড়েন ও ভারতবর্ষের নানা প্রকার কুসংস্কার প্রভৃতি নিয়ে প্রাণ খুলে হাস্য পরিহাস করেন। তিনি গল্প করেন যে, আমাদের দেশে বল্লভাচার্যের দল বলে এক প্রকার বৈষ্ণবের দল আছে— তাদের সমস্ত অনুষ্ঠান সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকেন। তিনি বলেন, ভারতবর্ষীয়েরা অত্যন্ত অসভ্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন; তিনি ভারতবর্ষীয়দের ‘নেটিব নেটিব’ করে সম্বোধন করেন। সভার লোকদের হাসাবার অভিপ্রায়ে নেটিব nautch girlরা কিরকম করে নাচে অঙ্গভঙ্গী করে তার নকল করা হয় ও তাই দেখে সকলে হাসলে পরম আনন্দ উপভোগ করেন। তাঁরা যখন ভারতবর্ষীয়দের নিন্দে করতে থাকেন তখন তাঁরা মনে মনে কল্পনা করেন তাঁরা নিজে ‘নেটিব’ দলের বহির্ভূত! তিনি হয়তো মনে করেন, তাঁর শ্রোতারা অন্যান্য ভারতবর্ষীয়দের সঙ্গে তুলনা করে তাঁকে পচাপুকুরের পদ্ম— কাঁটাবনের গোলাপ ব’লে মাথায় করে নেবে। তাঁর বিশ্বাস, তিনি যখন ভারতবর্ষীয়দের প্রেজুডিসের উপর কটাক্ষপাত করে অপর্যাপ্ত হাস্যকৌতুক করেন তখন সকলে তাঁকে অবিশ্যি সে-সকল ‘প্রেজুডিস’ হতে মুক্ত বলে গ্রহণ করবেন। তাঁর নিতান্ত ইচ্ছে, তাঁকে কেউ ভারতবর্ষীয় দলের মধ্যে গণ্য না করে। আমার মনে আছে, আমি দেশে থাকতে এক জন সুশিক্ষিত উড়িষ্যাবাসী আমার কাছে কথায় কথায় বলেছিলেন যে, ‘উড়ে-মেড়ারা বড়ো মূর্খ!’ শুনে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল। আমার এক বন্ধু পূর্বাঞ্চলে তাঁর জমিদারি দেখতে গিয়েছিলেন, এক জন মুসলমান তাঁকে কথা-প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘মশায়, নেড়েদের কখনো বিশ্বাস করবেন না।’ এই উড়িষ্যাবাসীর মনোগত ভাব এই যে, ‘আমি মূর্খ নই।’ আর এই মুসলমানটি জানাতে চান যে, তিনি বিশ্বাসপাত্র। কেননা, নিজে মূর্খ হলে এই উড়িষ্যাবাসী কখনও অন্যের মূর্খতা নিয়ে বিদ্রূপ করতেন না, আর এই মুসলমানটির যখন স্বজাতির অবিশ্বাসিতার ওপর এত ঘৃণা তখন তিনি নিজে বিশ্বাসী না হয়ে যান না। এই রকম দেখতে পাবে যে, সাহেব-সাজা বাঙালিদের প্রতি পদে ভয় পাছে তাঁরা বাঙালি বলে ধরা পড়েন। এক জন বাঙালি একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর কৃষ্ণ চর্ম দেখে আর একজন ভারতবর্ষীয় এসে তাঁকে হিন্দুস্থানিতে দুই-এক কথা জিজ্ঞাসা করে— তিনি মহা খাপা হয়ে তার কথার উত্তর না দিয়ে চলে যান। কিন্তু এত রাগ করবার তাৎপর্য কী? তাঁর ইচ্ছে, তাঁকে দেখে কেউ মনে না করতে পারে যে তিনি হিন্দুস্থানি বোঝেন। তাঁর মা-বাপেরা যে বাঙালি ও সে হতভাগ্যেরা যে বাংলায় কথা কয় এতে তিনি নিতান্ত লজ্জিত আছেন। আহা, যদি টেম্সের জলে স্নান করলে রঙটা বদলাত তবে কী সুখেরই হত! এক জন ইঙ্গবঙ্গ একটি ‘জাতীয় সংগীত’ রামপ্রসাদী সুরে রচনা করেছেন; এই গানটার একটু অংশ পূর্ব পত্রে লিখেছি, বাকি আর-একটু মনে পড়েছে— এই জন্য আবার তার উল্লেখ করছি। যদিও এটা কতকটা ঠাট্টার ভাবে লেখা হয়েছে, কিন্তু আমার বোধ হয় এর ভিতরে অনেকটা সত্যি আছে। এ গীত যাঁর রচনা তিনি রামপ্রসাদের মতো শ্যামার উপাসক নন, তিনি গৌরীভক্ত। এই জন্যে গৌরীকে সম্বোধন করে বলছেন—
মা, এবার মলে সাহেব হব
রাঙা চুলে হ্যাট বসিয়ে পোড়া নেটিব নাম ঘোচাব!
শাদা হাতে হাত দিয়ে, মা, বাগানে বেড়াতে যাব—
আবার কালো বদন দেখলে পরে ‘ডার্কি’ বলে মুখ ফেরাব।
আমি পূর্বেই বিলেতের landlady (বাড়িওয়ালী) শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছি। তারা বাড়ির লোকদের আবশ্যকমত সেবা করে। অনেক ভাড়াটে থাকলে তারা চাকরানী রাখে, এবং অনেক সময়ে তাদের আপনাদের মেয়ে বা অন্য আত্মীয়েরা তাদের সাহায্য করবার জন্যে থাকে। এই landlady শ্রেণীরা আমাদের বিদেশী ইঙ্গবঙ্গদের প্রবাসদুঃখ অনেক পরিমাণে দূর করে, কিম্বা প্রবাসসুখ অনেক পরিমাণে বর্ধিত করে। অনেক ইঙ্গবঙ্গ সুন্দরী landlady দেখে ঘর ভাড়া করেন। এতে তাঁদের সময় কাটাবার যথেষ্ট সুবিধে হয়। বাড়িতে পদার্পণ করেই তাঁর ল্যান্ড্লেডির যুবতী কন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে নেন। দু-তিন দিনের মধ্যে তার একটি আদরের নামকরণ করা হয়, সপ্তাহ অতীত হলে তার নামে হয়তো একটা কবিতা রচনা করে তাকে উপহার দেন। কোনো সন্ধ্যে বেলায় হয়তো রান্নঘরে গিয়ে ল্যান্ড্লেডি তার কন্যা ও ঘরের দাসীটিকে বিজ্ঞান দর্শন ও মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে দুই-একটা বাঁধা গত শোনাতে থাকেন। তারা তাঁর লম্বাচৌড়া কথাগুলো হজম করতে না পেরে হাঁ করে ভাবে, ইনি একজন কেষ্টবিষ্টুর মধ্যে হবেন। কিন্তু kitchen অঞ্চলে তিনি তাঁর গম্ভীর পাণ্ডিত্যের জন্যে তত বিখ্যাত নন; তাঁর নিজের বাড়ির ও পাশাপাশি দু-একটি বাড়ির দাসী-শ্রেণীর মধ্যে তাঁর রসিকতার অত্যন্ত নামডাক শোনা যায়। এই রকম জনশ্রুতি যে, সে দিন সন্ধ্যে বেলায় সিঁড়ির কাছে তিনি বাড়ির kitchen-maid Pollyর দাড়ি ধরে এমন একটি ঠাট্টা করেছিলেন যে, সে হাসতে হাসতে ছুটে পালিয়ে যায়। সে দিন landladyর মেয়ে তাঁকে এক পেয়ালা চা এনে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, চায়ে কি চিনি দিতে হবে? তিনি হেসে বললেন, ‘না নেলি, তুমি যখন ছুঁয়ে দিয়েছ, তখন আর চিনি দেবার আবশ্যক দেখছি নে।’ ইঙ্গবঙ্গগণ বিলেতের এই দাসী-শ্রেণীর বিমল সংসর্গে দিনদিন উন্নতিলাভ করতে থাকেন। আচ্ছা, মেয়েদের সঙ্গে যদি মিশতে চাও, তবে ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে মেশ না কেন? কিন্তু কতকগুলি কারণ আছে, যে জন্যে ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে তত মেশা হয় না। বাঙালিদের উদ্যমের অভাব ও আলস্য বিলেতে এসেও ভালো করে ঘোচে না। তারা যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শ্রম স্বীকার করে একজনের বাড়ি গিয়ে দেখা করে দুদণ্ড কথা কয়ে আসবে তা বড়ো হয়ে ওঠে না। তার পরে আবার অনেক পড়াশুনো করে দেখাশুনো করতে যাবার বড়ো সময় পেয়ে ওঠেন না। তা ছাড়া আমি দেখেছি, এক জন ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে ভদ্র স্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করা ও তাদের সঙ্গে নানা সামাজিক ভদ্রতার নিয়ম পালন করে চলা অনেক বাঙালির পুষিয়ে ওঠে না। অনেকের দেখেছি, এক জন ভদ্র স্ত্রীর কাছে সংকোচে মুখ ফোটে না, কিন্তু এক জন নীচশ্রেণীর মেয়ের কাছে তার অনর্গল কথা ফুটতে থাকে। কিন্তু সকলের চেয়ে প্রধান কারণ এই যে, ভদ্রলোকের স্ত্রীদের সঙ্গে তাঁরা তেমন মনের মতো স্বাধীন ব্যবহার করতে পারেন না, ও রকম নিরামিষ মেশামেশি তাঁদের বড়ো মনঃপুত নয়। দাসীদের সঙ্গে তাঁরা বেশ অসংকোচে অভদ্রতাচরণ করতে পারেন। আসল কথা কী জানো? শাদা চামড়ার গুণে তাঁরা দাসীদের যথেষ্ট নীচ শ্রেণীর লোক বলে কল্পনা করতে পারেন না; এক জন বিবি দাসী বলে মনে করতে পারেন না। একটা শাড়িপরা ঝাঁটা-হস্ত কালো-মুখ দেখলে তবে তাঁদের দাসীর ভাব ঠিক মনে আসে। আমি জানি, এক জন ইঙ্গবঙ্গ তাঁর বাড়ির দাসীদের মেজদিদি সেজদিদি বলে ডাকতেন। শুনলে কি গা জ্বলে ওঠে না? তাঁর বাড়িতে হয়তো তাঁর নিজের মেজদিদি সেজদিদি আছেন; যখন কতকগুলো নীচ শ্রেণীর দাসীকে সেই নামে ডাকছেন তখন হয়তো তাঁর বিকৃত মনে একটু লজ্জা, একটু কষ্ট, একটু সংকোচও উপস্থিত হচ্ছে না। হা দুর্ভাগ্য! ছেলেবেলা থেকে যাঁদের দেখে আসছি, যাঁদের ভালোবাসা পেয়ে আসছি, বিলেতে এমন কী জিনিস থাকতে পারে যা দেখে তাঁদের ভুলে যাব, তাঁদের ওপর থেকে ভালোবাসা চলে যাবে— সুদ্ধ তাই নয় তাঁদের ওপর ঘৃণা জন্মাবে! এই কতকগুলি; নীচ শ্রেণীর দাসী, কতকগুলি হীনস্বভাব ল্যান্ড্লেডির সঙ্গে বৎসরদুয়ের হীন আমোদে কাটিয়ে যদি তুমি তোমার স্ত্রীর ভালোবাসা তোমার বোনের স্নেহ ভুলে যেতে পারো, কত বৎসরের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারো, বাড়ির সমস্ত টান ছিঁড়ে ফেলতে পারো, তবে তুমি কী না করতে পারে বলো দেখি।
আমি এক জনকে জানি, তিনি তাঁর ‘মেজদিদি’ ‘সেজদিদি’ -বর্গকে এত মান্য করে চলতেন যে, তাঁর কৃষ্ণবর্ণ গুরুজনকে তার অর্ধেক মান্য করলে তাঁরা তাঁকে কুলের প্রদীপ ছেলে বলে মাথায় করে রাখতেন। তাঁর ঘরে বা তাঁর পাশের ঘরে যদি এই দাসীদের মধ্যে কেউ উপস্থিত থাকত তা হলে তিনি সসম্ভ্রম সংকোচে শশব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সে রকম অবস্থায় যদি তাঁর কোনো ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু গান করতেন বা হাস্যপরিহাস করতেন তা হলে তিনি অমনি মহা অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠতেন, ‘আরে চুপ করো, চুপ করো, মিস এমিলি কী মনে করবেন?’ বিলেতে এসে এঁরা এই রকম কতকগুলি নীচ শ্রেণীর মেয়েদের সঙ্গে মিশে বিবিদের সঙ্গে আলাপ করছি মনে করে মহা পরিতোষ লাভ করেন। আমার মনে আছে, দেশে থাকতে একবার এক ব্যক্তি বিলেত থেকে ফিরে গেলে পর আমরা তাঁকে খাওয়াই; খাবার সময় তিনি নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘এই আমি প্রথম খাচ্ছি যেদিন আমার খাবার টেবিলে কোনো লেডি নেই।’ শুনে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেম; আমি জানতেম যে, কোনো ভদ্র বিবি এক জন অস্ত্রীক পুরুষের বাড়িতে দেখা করতে বা খেতে আসেন না। তবে এ ব্যক্তি বলে কী! এ বিলেতে যত দিন ছিল নিমন্ত্রণ খেয়ে কাটিয়েছিল নাকি? যা হোক, তখন মনে করেছিলেম এ ব্যক্তি বিলেত থেকে আসছে, অবিশ্যি সেখেনে এমন কিছু দস্তুর আছে যা আমি ঠিক জানি নে। ও মা! এখেনে এসে সব বুঝতে পারছি ব্যাপারখানা কী! এই সমস্ত ল্যান্ড্লেডিবর্গের সঙ্গে প্রত্যহ আহার করা হত, আর দেশে নিরীহ বঙ্গবাসীদের নিকট ‘প্রত্যহ বিবিদের সঙ্গে খেয়েছি’ বলে জাঁক করা হত! এক জন ইঙ্গবঙ্গ একবার তাঁর কতকগুলি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন, খাবার টেবিলে কতকগুলি ল্যান্ড্লেডি ও দাসী উপবিষ্ট ছিল, তাদের এক জনের ময়লা কাপড় দেখে নিমন্ত্রণকর্তা তাকে কাপড় বদলে আসতে অনুরোধ করেছিলেন; শুনে সে বললে, ‘যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ময়লা কাপড়েও ভালোবাসা যায়!’ যে দাসী এ রকম করে উত্তর দিতে পারে তাকে কতদুর স্পর্ধা দেওয়া হয়েছে মনে করে দেখো। এ-সকল দেখে এখানকার ইংরাজদের আমাদের বাঙালিদের উপরে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা হয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সে দিন মিসেস উড্রো (পূজনীয় মৃত উড্রো সাহেবের বিধবা পত্নী) আমাকে বলছিলেন, ‘শোনা যায়, এখানকার বাঙালিরা অত্যন্ত ছোটোলোকদের সঙ্গে মেশে ও একত্রে খায়। একবার মনে করে দেখো দেখি, কতকগুলো বেহারা ও দরোয়ানের সঙ্গে তোমরা একাসনে বসে খাচ্ছ— সে কী বিশ্রী দেখায়!’ শুনে লজ্জায় আমার শির একেবারে নত হয়ে গেল! হে ইঙ্গবঙ্গ, যদি ইংরাজদের মুখ থেকে এ বিষয়ে উপদেশ না শুনলে তোমাদের চৈতন্য না জন্মায় তবে Thackeray এ বিষয়ে কী বলেন শোনো।—
‘It may safely be asserted that the persons who joke with servants or barmaids at lodgings are not men of a high intellectual or moral capacity. To chuck a still-room maid under the chin, or to send Molly the cook grinning, are not, to say the least of them, dignified act of any gentleman.’
অতএব যারা ভদ্রসমাজে মিশতে চান ও ভদ্র বলে আত্মপরিচয় দিতে চান তাঁরা যেন কতকগুলো রাঁধুনি ঘরঝাঁটুনি দাসীদের সঙ্গে অযোগ্য ঘনিষ্ঠতা না করেন। বিলেতের kitchen-রাজ্যে যাঁরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন তাঁরা যেন দেশে গিয়ে না বলেন যে, ‘বিলেত থেকে শিক্ষা পেয়ে এলেম।’ এইরূপ নীচ শ্রেণীর মেয়েদের উপরে ভালোবাসা দেখিয়ে রুটি ও কয়লা -ওয়ালা যুবক বেচারিদের মনে ঈর্ষা জন্মিয়ে কষ্ট দেওয়া কি সদয়হৃদয় ভদ্রলোকের কাজ? শোনা যায়, এখেনে যখন অল্পস্বর বাঙালির আমদানি ছিল তখন এখানকার সমাজে তাঁদের অত্যন্ত মান ছিল। অনেক ভদ্রলোক আলাপ না থাকলেও তাঁদের নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিতেন। এখানকার অনেক Lord ও Duke -গণ তাঁদের সান্ধ্যসমাগমে আহ্বান করতেন। এখানকার ধনীলোকদের নিমন্ত্রণসভায় তাঁদের সমাদরের সীমা ছিল না। কিন্তু এখন সে-সব নেই। এখন তুমি বিলেতে এলে তোমার ভাড়া-করা ক্ষুদ্র ঘরটিতে দিন-রাত বসে থাকো, ডাক্তারি ও আইনের কেতাবের লম্বা লম্বা পরিচ্ছেদগুলো গলাধঃকরণ করো, Polly Molly Nelly -বর্গের সঙ্গে রসিকতার আদান-প্রদান করো ও রাত্রি আড়াইটার পর বিছানায় গিয়ে নিদ্রা দাও। যদি তুমি স্বভাবতঃ মিশুক লোক হও তবে জোগাড়জাগাড় করে দুচারটে পরিবারের সঙ্গে কোনো উপায়ে আলাপ করে নেও, কিন্তু পূর্বকার মতো সে রকম সমাদর আর নাই, ও ক্রমে ক্রমে হয়তো এমন দিন আসতে পারে যে দিন ভারতবর্ষের ইংরাজদের মতো এখানকার ইংরাজেরাও আমাদের ঘৃণার চক্ষে দেখবেন— কিন্তু যদি সে দিন আসে তবে ইংরাজদের দোষ দিয়ো না। অনেক ভারতবর্ষীয় এখেনে এসে যে রকম অন্যায় ব্যবহার করে গেছেন তা আমি লিখতে চাই নে। ভারতবর্ষীয়দের সংখ্যা এখানে অত্যন্ত অল্প বলে সে-সকল কথা অধিক লোকের কানে ওঠে না। কিন্তু যখন ক্রমেই ভারতবর্ষ থেকে এখেনে যুবকদের যাতায়াত বৃদ্ধি পেতে লাগল, যখন ক্রমেই তাঁদের দল পুষ্ট হতে চলল, তখন তাঁদের গুণাগুণ প্রকাশ হবার সম্ভাবনা বাড়তে লাগল। এখন যেন তাঁরা মনে করেন যে, তাঁরা যে-সকল অন্যায়াচরণ করবেন তাতে যে কেবল মাত্র তাঁদের যশোহানি হবে তা নয়, তাঁরা তাঁদের স্বদেশ ও স্বজাতির ওপরে কলঙ্ক আনয়ন করবেন।
এইবার ইঙ্গবঙ্গদের একটি অতি অসাধারণ ও বিশেষ গুণ তোমাকে বলছি। এখানে যাঁরা যাঁরা আসেন প্রায় কেউ কবুল করেন না যে তাঁরা বিবাহিত। যুবতী কুমারী -সমাজে বিবাহিতদের দাম অত্যন্ত অল্প। অবিবাহিত না হলে কোনো যুবতীর উপরে তুমি ভালোবাসা দেখাতে পারো না, সুতরাং বিলাতের অর্ধেক আমোদ ভোগ করতে পারো না। অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে এখানকার অবিবাহিতদের সঙ্গে মিশে অনেক যথেচ্ছাচার করা যায়, কিন্তু বিবাহিত বলে জানলে তোমার অবিবাহিত সঙ্গীরা তোমাকে ও রকম অনিয়ম করতে দেয় না। সুতরাং অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে অনেক লাভ আছে।
যা হোক, এই-সকল তো ইঙ্গবঙ্গদের আচরণ। অনেক ইঙ্গবঙ্গ দেখতে পাবে তাঁরা হয়তো আমার এই বর্ণনার বহির্গত। কিন্তু সাধারণতঃ ইঙ্গবঙ্গত্বের লক্ষণগুলি আমি যত দূর জানি তা লিখেছি। আমার নিতান্ত ইচ্ছা, ভবিষ্যতে যে-সকল বাঙালিরা বিলেতে আসবেন তাঁরা যেন আমার এই পত্রটি পাঠ করেন। বাঙালিদের নামে যথেষ্ট কলঙ্ক আছে; কিন্তু তাঁরা যেন সে কলঙ্ক আর না বাড়ান, তাঁরা যেন সে কলঙ্ক এ সাত সমুদ্র -পারে আর রাষ্ট্র না করেন। জ’ন্মে অবধি শত শত নিন্দা গ্লানি অপমান নতশিরে সহ্য করে আসছি— এই দূর দেশে এসে একটু মাথা তোলবার অবকাশ পাওয়া যায়; এখানকার লোকেরা আমাদের অনেকটা সমান ভাবে ব্যবহার করে বলেই আমাদের পদাঘাতজর্জরিত মন একটু বল পেয়ে আত্মনির্ভর স্বাধীনতাপ্রিয়তা প্রভৃতি অনেকগুলি পৌরুষিক গুণ শিক্ষা করবার সুবিধে পায়; কিন্তু এখানেও দলে দলে এসে তোমরা যদি হীন ও নীচ ব্যবহার করতে আরম্ভ করো, এখানকার লোকের মনেও বাঙালিদের ওপর ঘৃণা জন্মিয়ে দেও, তা হলে এখেনেও তোমাদের কপালে সেই উপেক্ষা সেই নিদারুণ ঘৃণা আছে! যে পথে যাবে বাঙালি বলে তোমাদের দিকে সকলে আঙুল বাড়াবে, যে সভায় যাবে সভাস্থ লোকেরা তোমাদের দিকে তাচ্ছিল্যের ভ্রূকুঞ্চিত কটাক্ষ বর্ষণ করবে। বিলেতের কুহকগুলি আগে থাকতে তোমাদের চক্ষে ধরলেম; যখন বিলেতে আসবে তখন সাবধানে পদক্ষেপ কোরো। ইঙ্গবঙ্গদের দোষগুলিই আমি বিস্তৃত করে বর্ণনা করলেম—কেননা, লোকে গুণের চেয়ে দোষগুলিই অতি শীঘ্র ও সহজে অনুকরণ করে।
যা হোক, বাঙালিরা বিলাতের কামরূপে রূপান্তর ধারণ করে দেশে ফিরে চললেন। এখন তাঁদের একটা ভয় হচ্ছে, পাছে বিলাতে আসবার আগে তাঁদের যে-সকল বন্ধু ছিলেন তাঁরা কাছে ঘেঁষে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে আসেন। দেশে গিয়ে তাই তাঁদের বিশেষ উগ্রমূর্তি ধারণ করতে হয়। কারও বা অত্যন্ত ভাবনা হচ্ছে, দেশে গিয়ে কাকাকে কী করে প্রণাম করব? কারও বা তাঁর স্ত্রীর ঘোমটাচ্ছন্ন মুখ কল্পনায় এসে আপাদমস্তক জ্বলতে আরম্ভ করেছে। যা হোক, দেশে তো পৌঁছলেন। তাঁর স্ত্রীকে যথাসাধ্য পালিশ ও বার্নিষ করে ‘নেটিব’ কাকেদের দল ছেড়ে ইংরেজ ময়ূরের দলে মিশতে চললেন। আগে কে জানত বলো যে সেখানে গিয়ে অত ঠোকর খাবেন! ভারতীতে ‘ভারতবর্ষীয় ইংরাজ’ বলে প্রবন্ধের এক জায়গায় লেখা আছে—
‘আমরা বিলাতে যে, এই-সকল চাকচিক্য দেখিয়। মুগ্ধ হইয়া যাই, তাহা আশ্চর্য নহে। এ দেশে আমাদের চক্ষে এ-সকল সচরাচর পতিত হয় না বলিয়া আমরা এক প্রকার সুস্থির থাকি; ইংলন্ডে গিয়া ইংরেজ-মহলে প্রবেশ করিয়া আমাদের মস্তক এমন ঘূর্ণিত হইয়া যায় যে, আপনাকে আপনারা স্থির রাখিতে পারি না। স্বদেশের প্রতি মমতা চলিয়া যায়, দেশীয়দিগের উপর অসভ্য বর্বর বলিয়া ঘৃণা জন্মে। যাহা ইংরাজি তাহাই সেব্য, যাহা দেশীয় ত্যাজ্য! হায়! ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিয়া আমাদের চক্ষু ফোটে, আমরা দেখিতে পাই—এ জাদুর রাজ্য আমাদের নহে। আমরা যে ইংরাজের পদধূলি লইতে যাই, তাহাদের পদাঘাত পাইয়া অবশেষে আমাদের চৈতন্য হয়।’
ভারতবর্ষে গিয়ে ইঙ্গবঙ্গদের কিরকম অবস্থা হয় সে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতাও নেই, বক্তব্যও নেই। কিন্তু কিছু কাল ভারতবর্ষে থেকে তার পরে ইংলন্ডে এলে কিরকম ভাব হয় তা আমি অনেকের দেখেছি। তাঁদের ইংলন্ড আর তেমন ভালো লাগে না; অনেক সময়ে তাঁরা ভেবে পান না—ইংলন্ড বদলেছে কি তাঁরা বদলেছেন। আগে ইংলন্ডের অতি সামান্য জিনিস যা-কিছু ভালো লাগত, এখন ইংলন্ডের শীত ইংলন্ডের বর্ষা তাঁদের ভালো লাগছে না— এখন তাঁরা ভারতবর্ষে ফিরে যেতে হলে দুঃখিত হন না। তাঁরা বলেন, আগে তাঁদের ইংলন্ডের straw-berry ফল অত্যন্ত ভালো লাগত, এমন-কি তাঁরা যত রকম ফল খেয়েছেন তার মধ্যে straw-berryই তাঁদের সকলের চেয়ে স্বাদু মনে হত। কিন্তু এই কয় বৎসরের মধ্যে straw-berryর স্বাদ বদলে গেল না কী! এখন দেখছেন strawberryর চেয়ে অসংখ্য দিশি ফল তাঁদের ভালো লাগে। আগে Devonshireএর ক্ষীর তাঁদের এত ভালো লাগত যে তার আর কথা নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য! এখন দেখছেন আমাদের দেশের ক্ষীর তার চেয়ে ঢের ভালো লাগে। প্রথম বারে বিলেতের মুখ যে রকম দেখাচ্ছিল, এবারে ঠিক সে রকম দেখাচ্ছে না। কী আশ্চর্য পরিবর্তন! কিন্তু এর ভিতরে আমি তত আশ্চর্য কিছু দেখছি নে। এ রকম হবার কতকগুলি কারণ আছে। প্রধান কারণ হচ্ছে, বিলেত থেকে গিয়ে বিলেত-ফেরতেরা সম্পূর্ণ বিলিতি চালে চলেন। তাঁদের গৃহসজ্জা বিলিতি রকমের, বিলিতি বস্ত্র -পরিধান, দগ্ধ গোষ্পদ -সেবন, তাঁদের স্ত্রী-পরিবারদের ইংরিজি ভাবের আচার ব্যবহার; সুতরাং বিলেতের বাহ্য চাকচিক্য চোখে সয়ে গেলে এখেনে আর তেমন কিছু জিনিস থাকে না যা দেখে তাঁদের ধাঁধা লেগে যায়। তা ছাড়া তাঁরা ভারতবর্ষে গিয়ে স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে সংসারী হয়ে পড়েন, রোজগার করতে আরম্ভ করেন, ভারতবর্ষের মাটিতে তাঁদের শিকড় এক রকম বসে যায়। ভারতবর্ষীয়দের একটু বয়স হলেই তাঁদের মন কেমন শিথিল হয়ে যায়, তখন তাঁরা পায়ের ওপর পা দিয়ে টানাপাখার বাতাস খেয়ে কোনো প্রকারে দিন কাটিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত থাকেন। বিলেতে আমোদ ও বিলাস ভোগ করতে গেলেও অনেক উদ্যমের আবশ্যক করে। এখানে এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে হলে গাড়ি চলে না, হাত পা নাড়তে-চাড়তে দশটা চাকরের ওপর নির্ভর করলে চলে না। কেনন। এখানে গাড়িভাড়া অত্যন্ত বেশি, আর চাকরের মাইনে মাসে সাড়ে তিন টাকা নয়। এখানে একটা থিয়েটার দেখতে যাও—সন্ধ্যে বেলা বৃষ্টি পড়ছে, পথে কাদা, একটা ছাতা ঘাড়ে করে মাইল কতক ছুটোছুটি করে তবে ঠিক সময় পৌঁছতে পারবে। যখন রক্তের তেজ থাকে তখন এ-সকল পেরে ওঠা যায়। যখন ছোট্ট নৌকাটির মতো হালকা থাকা যায় তখন পালে একটু বাতাস লাগলেই, জলে একটু তরঙ্গ উঠলেই টল্মল্ করতে থাকা যায়; কিন্তু যখন স্ত্রী পুত্র কাজ কর্ম নিয়ে ভারগ্রস্ত হয়ে পড়া যায় তখন আর একটি অবলার একটি দীর্ঘনিশ্বাসে উলটে পড়তে হয় না ও একটি অশ্রুজলধারায় নৌকাডুবি হয় না।
আমার চিঠি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আমার স্কন্ধে যখন উপদেশদানেচ্ছা চাপে তখন আমি ঝট করে কলম থামাতে পারি নে; কিন্তু আর এক অক্ষরও লিখছি নে, এইখানেই থামা যাক। কিন্তু আর-একটি কথা না বলে থাকতে পারছি নে। দেশ থেকে আমার কোনো মান্য বন্ধু শিখরিণীচ্ছন্দে একটা কবিতা পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেইটে তোমাকে না শুনিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছি নে। সেইটে শোনা শেষ হলেই নিষ্কৃতি পাবে।—
‘বিলাতে পালাতে ছটফট করে নব্যগৌড়ে,
অরণ্যে যে জন্যে গৃহগবিহগপ্রাণ দৌড়ে।
স্বদেশে কাঁদে সে, গুরুজনবশে কিচ্ছু হয় না—
বিনা হ্যাট্টা কোট্টা ধুতি-পিরহনে মান রয়’ না।
পিতা মাতা ভ্রাতা নবশিশু অনাথা হুট্ কোরে
বিরাজে জাহাজে মসিমলিন কোর্তা বুট পোরে।
সিগারে উদ্গারে মুহু মুহু মহা ধূমলহরী,
সুখস্বপ্নে আপ্নে বড় চতুর মানে হরি হরি।
ফিমেলে ফী মেলে অনুনয় করে বাড়ি ফিরিতে—
কি তাহে, উৎসাহে মগন তিনি সাহেবগিরিতে।
বিহারে নীহারে বিবিজনসনে স্কেটিঙ করি,
বিষাদে প্রাসাদে দুখিজন রহে জীবন ধরি।
ফিরে এসে দেশে গলকলর (collar) -বেশে হটইটে—
গৃহে ঢোকে রোখে, উলগতনু দেখে বড় চটে।
মহা আড়ী শাড়ী নিরখি, চুল দাড়ী সব ছিঁড়ে,
দুটা-লাথে ভাতে ছরকট করে আসন পিঁড়ে।’
এ কবিতাটি যদি সংস্কৃত ছন্দে না পড়তে পারো, তা হলে এর মস্তক ভক্ষণ করা হবে। অতএব, নিতান্ত অক্ষম হলে বরঞ্চ একজন ভট্টাচার্যের কাছে পড়িয়ে নিয়ো, তা যদি না পারো তবে এ কবিতাটি তুমি না হয় পোড়ো না। ইতি।