য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/প্রথম পত্র
য়ু রাে প - প্র বা সী র প ত্র
প্রথম পত্র
বিশে সেপ্টেম্বরে আমরা ‘পুনা’ স্টীমারে উঠলেম। পাঁচটার সময় জাহাজ ছেড়ে দিলে। আমরা তখন জাহাজের ছাতে দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনে ভারতবর্ষের শেষ তটরেখা মিলিয়ে গেল। চারি দিকের লোকের কোলাহল সহিতে না পেরে আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেম। গোপন করবার বিশেষ প্রয়োজন দেখছি নে, আমার মনটা বড়োই কেমন নির্জীব অবসন্ন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দূরে হোক্গে―ওসব করুণরসাত্মক কথা লেখবার অবসরও নেই ইচ্ছেও নেই; আর লিখলেও, হয় তোমার চোখের জল থাকবে না, নয় তোমার ধৈর্য থাকবে না।
সমুদ্রের পায়ে দণ্ডবৎ। ২০শে থেকে ২৬শে পর্যন্ত যে ক'রে কাটিয়েছি তা আমিই জানি! সমুদ্রপীড়া কাকে বলে অবিশ্যি জাননা, কিন্তু কিরকম তা জানো না। আমি সেই ব্যামোয় পড়ে ছিলেম, সে কথা বিস্তারিত করে লিখলে পাষাণেরও চোখে জল আসবে। ৬টা দিন, মশায়, শয্যা থেকে উঠি নি। যে ঘরে থাকতেম সেটা অতি অন্ধকার, ছোটো; পাছে সমুদ্রের জল ভিতরে আসে তাই চারি দিকের জানলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। অসূর্যম্পশ্যরূপ ও অবায়ুস্পর্শদেহ হয়ে ছয়টা দিন কেবল বেঁচে ছিলেম মাত্র। প্রথম দিন সন্ধ্যে বেলায় আমাদের একজন সহযাত্রী আমাকে জোর করে বিছানা থেকে উঠিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। যখন উঠে দাঁড়ালেম তখন আমার মাথাটার ভিতর যেন একটা বিপর্যয় ব্যাপার বেধে গেল; মাথার ভিতর যা-কিছু আছে সবাই মিলে যেন মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলে; চোখে দেখতে পাই নে, পা চলে না, সর্বাঙ্গ টলমল করে। দু পা গিয়েই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লেম। আমার সহযাত্রীটি আমাকে ধরাধরি করে জাহাজের ‘ডেকে’ অর্থাৎ ছাতে নিয়ে গেলেন। একটা রেলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেম। তখন অন্ধকার রাত। আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। আমাদের প্রতিকূলে বাতাস বইছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে সেই নিরাশ্রয় অকূল সমুদ্রে দুই দিকে অগ্নি উৎক্ষিপ্ত করতে করতে আমাদের জাহাজ একলা চলেছে, যেখানে চাই সেই দিকেই অন্ধকার, সমুদ্র ফুলে ফুলে উঠছে―সে এক মহা গম্ভীর দৃশ্য। জাহাজ যখন চলে তখন তার দুই দিকে যেন আগুন ভেঙে পড়ে, অন্ধকার রাত্রে সে বড়ো সুন্দর দেখায়। একেই phosphorescence বলে।
সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেম না। ভয়ানক মাথা ঘুরতে লাগল। ধরাধরি করে আবার আমার ক্যাবিনে (ঘরে) এলেম। সেই-যে বিছানায় পড়লেম, ছ দিন আর এক মুহূর্তের জন্যও মাথা তুলি নি। আমাদের যে স্টুয়ার্ড্ ছিল (যাত্রীদের সেবার জন্য জাহাজে যেসব চাকর থাকে)―কারণ জানি নে―আমার উপর তার কেমন বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন-তখন সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে উপস্থিত করত; না খেলে কোনো মতেই ছাড়ত না। সে বলত, না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat)। সে বলত সে আমার জন্যে সব কাজ করতে পারে। আমি তাকে যথেষ্ট সাধুবাদ দিতেম, এবং জাহাজ ছেড়ে আসবার সময় সাধুবাদের চেয়ে আরও কিঞ্চিৎ সারবান পদার্থ দিয়েছিলেন।
ছ দিনের পর আমরা যখন এডেনের কাছাকাছি পৌঁছলেম, তখন সমুদ্র কিছু শান্ত হল। সে দিন আমার স্টুয়ার্ড্ এসে ন’ড়ে চ’ড়ে বেড়াবার জন্যে আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল। আমি তার পরামর্শ শুনে বিছানা থেকে তো উঠলেম, উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথাটা যেন ধারকরা, কাঁধের সঙ্গে তার ভালোরকম বনে না; চুরি-করা কাপড়ের মতো শরীরটা যেন আমার ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেক দিনের পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম। দুপুর বেলা দেখি একটা ছোটো নৌকা সেই সমুদ্র দিয়ে চলেছে। চার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত আর ডাঙা নেই, জাহাজ-সুদ্ধ নোক অবাক। তারা আমাদের স্টীমারকে ডাকতে আরম্ভ করলে; জাহাজ থামল। তারা একটি অতি ছোটো নৌকায় করে কতকগুলি লোক জাহাজে পাঠিয়ে দিলে। এরা সকলে আরব-দেশীয়, এডেন থেকে মস্কটে যাচ্ছে। পথের মধ্যে দিক্ভ্রম হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে যা জলের পিপে ছিল তা ভেঙে গিয়ে জল সমস্ত নষ্ট হয়ে গেছে, অথচ যাত্রী অনেক। আমাদের জাহাজের লোকেরা তাদের জল দিলে। একটি ম্যাপ খুলে কোন্ দিকে ও কত দূরে মস্কট তাদের দেখিয়ে দিলে, তারা আবার চলতে লাগল। সে নৌকো যে মস্কট পর্যন্ত পৌঁছবে, তাতে সকলেই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল।
২৮শে সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, আমাদের সম্মুখে সব পাহাড় পর্বত উঠেছে। অতি সুন্দর পরিষ্কার প্রভাত; সূর্য সবে মাত্র উঠেছে, সমুদ্র অতিশয় শান্ত। দূর থেকে সেই পর্বতময় ভূভাগের প্রভাত এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে কী বলব। পর্বতের উপর রঙিন মেঘগুলি এমন নত হয়ে পড়েছে যে মনে হয় যেন, অপরিমিত সূর্যকিরণ পান করে তাদের আর দাঁড়াবার শক্তি নেই, পর্বতের উপরে যেন অবসন্ন হয়ে পড়েছে। আয়নার মতো পরিষ্কার শান্ত সমুদ্রের উপর ছোটো ছোটো পাল-তোলা নৌকোগুলি আবার কেমন ছবির মতো দেখাচ্ছে!
এডেনে পৌঁছে বাড়িতে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেম কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি যে, এই ক’দিন নাড়াচাড়া খেয়ে মাথার ভিতরে যেন সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে, বুদ্ধির রাজ্যে একটা অরাজকতা ঘটেছে―কী করে লিখব ভালো মনে আসছে না। ভাবগুলো যেন মাকড়সার জালের মতো, ছুঁতে গেলেই অমনি ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে। কিসের পর কী লিখব তার একটা ভালো রকম বন্দোবস্ত করতে পারছি নে। এই অবস্থায় লিখতে আরম্ভ করলেম, এমন বিপদে পড়ে তোমাকে যে লিখতে পারি নি তাতে তোমার ক্ষোভের কারণ কিছুই নেই।
দেখো, সমুদ্রের উপর আমার কতকটা অশ্রদ্ধা হয়েছে। কল্পনায় সমুদ্রকে যা মনে করতেম, সমুদ্রে এসে দেখি তার সঙ্গে অনেক বিষয় মেলে না। তীর থেকে সমুদ্রকে খুব মহান্ বলে মনে হয়, কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এলে আর ততটা হয় না। তার কারণ আছে। আমি যখন বম্বের উপকূলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতাম তখন দেখতেম, দূর দিগন্তে গিয়ে নীল জল নীল আকাশে মিশিয়ে গিয়েছে; কল্পনায় মনে করতেম যে, একবার যদি ঐ দিগন্তের আবরণ ভেদ করতে পারি―ঐ দিগন্তের যবনিকা উঠাতে পারি―অমনি আমার সুমুখে এক অকূল অনন্ত সমুদ্র একেবারে উথলে উঠবে। ঐ দিগন্তের পর যে কী আছে তা আমার কল্পনাতেই থাকত, তখন মনে হত না ঐ দিগন্তের পরে আর-এক দিগন্ত আসবে। কিন্তু যখন সমুদ্রের মধ্যে এসে পড়ি তখন মনে হয় যে, জাহাজ যেন চলছে না, কেবল একটি দিগন্তের গণ্ডীর মধ্যে বসে আছে। আমাদের কল্পনার পক্ষে সে দিগন্তের সীমা এত সংকীর্ণ যে মন কেমন তৃপ্ত হয় না। কিন্তু দেখো, এ কথা বড়ো গোপনে রাখা উচিত। বাল্মীকি থেকে বায়্রন্ পর্যন্ত সকলেরই যদি এই সমুদ্র দেখে ভাব লেগে থাকে, তবে আমার না লাগলে দশজনে যে হেসে উঠবে; গ্যালিলিওর সময়ে এ কথা বললে হয়তো আমাকে কয়েদ যেতে হত। এত কবি সমুদ্রের স্তুতিবাদ করেছেন যে, আজ আমার এই নিন্দায় তাঁর বোধ হয় বড়ো একটা গায়ে লাগবে না। যখন তরঙ্গ ওঠে তখন বোধ করি সমুদ্র বেশ দেখায়, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যক্রমে সমুদ্রে তরঙ্গ উঠলেই আমার এমন মাথা ঘুরতে থাকে যে আমার দেখাশুনো সব ঘুরে যায়।
আমি যখন ঘর থেকে বেরোতে আরম্ভ করলেম তখন জাহাজের যাত্রীদের উপর আমার নজর পড়ল ও আমার উপর জাহাজের যাত্রীদের নজর পড়ল। আমি স্বভাবতই ‘লেডি’-জাতিকে বড়ো ডরাই। তাঁদের কাছে ঘেঁষতে গেলে এত প্রকার বিপদের সম্ভাবনা যে, চাণক্য পণ্ডিত থাকলে ‘লেডি’দের কাছ থেকে দশ সহস্র হস্ত দূরে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এক তো মনোরাজ্যে নানাপ্রকার শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা―তা ছাড়া সর্বদাই ভয় হয় পাছে কী কথা বলতে কী কথা বলে ফেলি, আর আমাদের অসহিষ্ণু কোমলস্বভাব লেডি তাঁদের আদব-কায়দার তিলমাত্র ব্যতিক্রম সইতে না পেরে দারুণ ঘৃণায় ও লজ্জায় একেবারে মূর্ছা যান, আর দশ দিক থেকে দশটা জেণ্ট্ল্ম্যান একেবারে হাঁ হাঁ করে এসে পড়েন। পাছে তাঁদের গাউনের অরণ্যের মধ্যে পথহারা হয়ে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, পাছে রাস্তায় পা ফেলতে তাঁদের গাউনের উপর পা ফেলি―পাছে আহারের সময় তাঁদের মাংস কেটে দিতে হয়, পাছে মুরগীর মাংস কাটতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে বসি―এই রকম সাত পাঁচ ভেবে আমি জাহাজের লেডিদের কাছ থেকে অতি দূরে থাকতেম। আমাদের জাহাজে লেডির অভাব ছিল না, কিন্তু জেণ্ট্ল্ম্যানেরা সর্বদা খুঁৎখুঁৎ করতেন যে, তার মধ্যে অল্পবয়স্কা বা সুশ্রী একজনও ছিল না। একজন এত লম্বা, তাঁর ঠোঁট এত বন্ধুর, তাঁর মুখে এত দাগ, তাঁর দাঁতের এত দৈর্ঘ্য, তাঁর আহারের পরিমাণ এত অপরিমিত যে, তেমন দুটো পুরুষ সচরাচর খুঁজলে পাওয়া যায় না। একজন আছেন তাঁকে জ্যামিতিশাস্ত্রের রেখা (length without breadth) বলা যেতে পারে। তার শরীর লম্বা, মুখ লম্বা, হাত লম্বা, পা লম্বা, চোখ ছোটো, নাক ছোটো, মাথা ছোটো। একজনের দাঁতের সম্পূর্ণরূপে অভাব ছিল, কিন্তু আহারকালে দন্তবান ব্যক্তিরা তাঁর কাছে পরাস্ত মানত। জাহাজে কেবল একজন যুবতী আছেন মাত্র, কিন্তু জেণ্ট্ল্ম্যানদের পোড়া অদৃষ্টবশতঃ যাঁরা অধিকবয়স্কা ছিলেন তাঁরাই যৌবনের মুখোষ প’রে নানাপ্রকার হাবভাব করে পুরুষদের হৃদয়রাজ্যে একটা গোলমাল বাধাবার জন্যে যথাসাধ্য বলপ্রয়োগ করতেন, আর যুবতীটি ছিব্লামির বয়স গিয়েছে মনে করে ঘোমটা (veil) টেনে এক প্রান্তে সারাদিন বাইবেল পড়তেন। পুরুষদের মন লুটপাট করবার জন্য এই দিদিমার বয়সী লেডিগণ যে রকম প্রাণপণে যত্ন করতেন তা দেখলে তোমার মায়া হত। পুরুষের কাছে তাঁদের সেই অতিমধুর ললিতগলিত ভাবের হাসি, অতি ঢলঢল ভাবের অঙ্গভঙ্গী দেখে আমার প্রচুর পরিমাণে হাস্য ও করুণ রসের আবির্ভাব হত। কাপড়ে-চোপড়ে রঙে-চঙে তাঁরা তাঁদের ভাঙাচুরো রূপকে কোনো প্রকারে ঠেকো দিয়ে রেখেছেন মাত্র।
পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছিল। ব―মহাশয়ের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তিনি লোক বড়ো ভালো। এমন ধাঁচের লোক বড়ো সচরাচর দেখা যায় না। তাঁর কথা অনর্গল, হাসি অজস্র, আহার অপরিমিত। সকলের সঙ্গেই তাঁর আলাপ, সকলের সঙ্গেই তিনি হাসি-তামাসা করে বেড়ান। তাঁর একটা গুণ আছে, তিনি কখনও বিবেচনা ক’রে, ভেবে-চিন্তে, মেজে-ঘ’ষে কথা কন না; ঠাট্টা করেন, সকল সময়ে তার মানে না থাকুক তিনি নিজে হেসে আকুল হন। তিনি তাঁর বয়সের ও পদমানের গাম্ভীর্য বুঝে হিসাব করে কথা কন না, মেপেজুকে হাসেন না ও দু দিক বজায় রেখে মত প্রকাশ করেন না―এই-সকল কারণে তাঁকে আমার বড়ো ভালো লাগত। তাঁর মনটা এখনও হামাগুড়ি দিচ্ছে―কত প্রকার যে ছেলেমানুষি করেন তার ঠিক নেই; ঘোরতর বিজ্ঞতার আতিশয্যে মুখটা অন্ধকার করে তাঁকে মোটা গলায় কথা কইতে কখনও শুনি নি। বৃদ্ধত্বের বুদ্ধি ও বালকদের শাদাসিদা নিশ্চিন্ত ভাব একত্রে দেখলে আমার বড়ো ভালো লাগে। তাঁর একটা স্বভাব আছে যে কাকেও তিনি তার পিতা-মাতা-প্রদত্ত নাম ধরে ডাকেন না―তিনি নিজে স্বতন্ত্র নামকরণ করেন। আমাকে তিনি ‘অবতার’ বলতেন, Gregory সাহেবকে ‘গড়গড়ি’ বলতেন, জাহাজের আর-এক যাত্রীকে ‘রুহিমৎস্য’ বলে ডাকতেন―সে বেচারির অপরাধ কী তা জানো? সাধারণ মানুষদের চেয়ে তার ঘাড়ের দিকটা কিছু খাটো ছিল, তার মাথা ও শরীরের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র যোজকপদার্থ ছিল না বললেও হয়। এই জন্যে ব―মহাশয় তাকে মৎস্যশ্রেণীভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু আমি যে কেন অবতার-শ্রেণীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেম তার কারণ সহজে নির্দেশ করা যায় না। খাবার সময়ে তাঁর এক গল্প ছিল যে, একজন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল, তার অপরিমিত আহার দেখে তার পাশের এক জন ভদ্রলোক বললেন―‘মহাশয়, পরের খরচে আহার কচ্ছেন অতএব বড়ো ভাবনার বিষয় নেই বটে, কিন্তু মনে রাখবেন পেটটি আপনার।’ কিন্তু ব―মহাশয় নিজে সকল সময় সেইটি মনে রাখেন না।
আমাদের জাহাজের T―মহাশয় কিছু নূতন রকমের লোক। তিনি ঘোরতর ফিলজফর মানুষ। তাঁকে কখনো চলিত ভাষায় কথা কইতে শুনি নি। তিনি কথা কইতেন না, বক্তৃতা দিতেন। এক দিন আমরা দুই চার জনে মিলে জাহাজের ছাতে দুই দণ্ড আমোদ-প্রমোদ করছিলেম, এমন সময়ে দুর্ভাগ্যক্রমে ব―মহাশয় তাঁকে বললেন ‘কেমন সুন্দর তারা উঠেছে’। এই আমাদের ফিলজফর মহাশয় তারার সঙ্গে মনুষ্যজীবনের সঙ্গে একটা উৎকট সম্বন্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শুরু কল্লেন―আমরা বেচারিরা ‘মুর্খেতে চাহিয়া থাকে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া’ রইলেম। গল্পসল্প ঘুচে গেল, গানবাজনা থেমে গেল, জন দুয়েক ঢুলতে আরম্ভ করলেন, জন দুয়েক হাই তুলতে আরম্ভ করলেন―সমস্ত মাটি হয়ে গেল।
আমাদের জাহাজে একটি আস্ত জনবূল ছিলেন। তাঁর তালবৃক্ষের মতো শরীর, ঝাঁটার মতো গোঁফ, সজারুর কাঁটার মতো চুল, হাঁড়ির মতো মুখ, মাছের চোখের মতো ভাববিহীন ম্যাড়্মেড়ে চোক, তাঁকে দেখলেই আমার গা কেমন করত, আমি পাঁচ হাত তফাতে সরে যেতেম। এক-এক জন কোনো অপরাধ না করলেও তার মুখশ্রী যেন সর্বদা অপরাধ করতে থাকে। প্রত্যহ সকালে উঠেই শুনতে পেতেম তিনি ইংরিজি ফ্রেঞ্চ্ হিন্দুস্থানি প্রভৃতি যত ভাষা জানেন সমস্ত ভাষায় জাহাজের সমস্ত চাকর-বাকরদের অজস্র গাল দিতে আরম্ভ করেছেন ও দশ দিকে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে কখনো হাসতে দেখি নি; কারও সঙ্গে কথা নেই বার্তা নেই, আপনার ক্যাবিনে গোঁ হয়ে বসে আছেন। কোনো-কোনো দিন ‘ডেকে’ বেড়াতে আসতেন, বেড়াতে বেড়াতে যার দিকে একবার কৃপাকটাক্ষে নেত্রপাত করতেন তাকে যেন পিঁপড়াটির মতো মনে করতেন।
প্রত্যহ খাবার সময়ে ঠিক আমার পাশেই B― বসতেন। তিনি একটি ইয়ুরাসীয়। কিন্তু তিনি ইংরাজের মতো গান গাইতে, শিষ দিতে, পকেটে হাত দিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়াতে সম্পূর্ণরূপে শিখেছেন। তিনি আমাকে বড়োই অনুগ্রহের চোখে দেখতেন। এক দিন এসে মহা গম্ভীর স্বরে বললেন―‘Young man, তুমি Oxford-এ যাচ্ছ? Oxford University বড়ো ভালো বিদ্যালয়।’ এ কথা তিনি না বললে Oxford University যেন মাটি হয়ে যেত। আমি একদিন ট্রেঞ্চ সাহেবের ‘Proverbs and Their Lessons’ বইখানি পড়ছিলেম, তিনি এসে বইটি নিয়ে শিষ দিতে দিতে দু-চার পাত উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ―ভালো বই বটে’। ট্রেঞ্চের শুভাদৃষ্ট! আমার উপর তাঁর কিছু মুরব্বিয়ানা ব্যবহার ছিল।
এডেন থেকে সুয়েজে যেতে দিন পাঁচেক লেগেছিল। যারা ব্রিন্দিশি-পথ দিয়ে ইংলন্ডে যায় তাদের জাহাজ থেকে নেমে সুয়েজে রেলওয়ের গাড়িতে উঠে অ্যালেক্জান্দ্রিয়াতে যেতে হয়; অ্যালেক্জান্দ্রিয়ার বন্দরে তাদের জন্যে একটা স্টীমার অপেক্ষা করে―সেই স্টীমারে চ’ড়ে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইটালিতে পৌঁছিতে হয়। আমরা overland যাত্রী, সুতরাং আমাদের সুয়েজে নাবতে হল। আমরা তিনজন বাঙালি ও একজন ইংরাজ একখানি আরব নৌকা ভাড়া করলেম। মানুষের ‘divine’ মুখশ্রী কতদূর পশুত্বের দিকে নাবতে পারে, তা সেই নৌকার মাজিটার মুখ দেখলে জানতে পারতে। তার চোক দুটো যেন বাঘের মতো, কালো কুচ্কুচে রঙ, কপাল নিচু, ঠোট পুরু, সবসুদ্ধ মুখের ভাব অতি ভয়ানক। অন্যান্য নৌকার সঙ্গে দরে বনল না, সে একটু কম দামে নিয়ে যেতে রাজি হল। ব―মহাশয় তো সে নৌকায় বড়ো সহজে যেতে রাজি নন; তিনি বললেন আরবদের বিশ্বাস করতে নেই, ওরা অনায়াসে গলায় ছুরি দিতে পারে। তিনি সুয়েজের দুই-একটা ভয়ানক ভয়ানক অরাজকতার গল্প করলেন। কিন্তু যা হোক আমরা সেই নৌকায় তো উঠলেম। মাজিরা ভাঙা ভাঙা ইংরিজি কয় ও অল্প স্বল্প ইংরিজি বুঝতে পারে। আমরা তো কতক দূর নির্বিবাদে গেলেম। আমাদের ইংরাজ যাত্রীটির সুয়েজের পোস্ট আফিসে নাববার দরকার ছিল। পোস্ট্-আফিস অনেক দূর এবং যেতে অনেক বিলম্ব হবে, তাই মাঝিটি একটু আপত্তি করলে; কিন্তু শীঘ্রই সে আপত্তি ভঞ্জন হল। তার পরে আবার কিছু দূরে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে ‘পোস্ট্-অফিসে যেতে হবে কি? সে দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া অসম্ভব’―আমাদের রুক্ষস্বভাব সাহেবটি মহা ক্ষাপা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন 'your grandmother'। এই তো আমাদের মাঝি রুখে উঠলেন, 'What? mother? mother? what mother? don't say mother.' আমরা মনে করলুম সে সাহেবটাকে ধরে বুঝি জলেই ফেলে দিলে! আবার জিজ্ঞাসা করলে, 'What did say?' (অর্থাৎ, কী বললি?) আমরা রয়েছি বলেই বোধ হয় সাহেব তাঁর রোখ ছাড়লেন না। আবার বললেন 'your grandmother'। এই তো আর রক্ষা নেই। মাঝিটা মহা তেড়ে উঠল। সাহেব গতিক ভালো নয় দেখে নরম হয়ে বললেন, 'You don't seem to understand what I say!' অর্থাৎ তিনি তখন grandmother বলাটা যে গালি নয় তাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তখন সে মাঝিটা ইংরাজি ভাষা ছেড়ে ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বস্―চুপ!’ সাহেব থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, আর তার বাক্যস্ফূর্তি হল না! আবার খানিক দূর গিয়ে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কতদূর বাকি আছে?’ মাঝি অগ্নিশর্মা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, 'Two shillings give, ask what distance! এই অপূর্ব ইংরাজির ভাষান্তর হচ্ছে: সবে দু শিলিং মাত্র ভাড়া দেবেন, তা আবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে কতদূর! আমরা এই রকম বুঝে গেলেম যে, দু শিলিং ভাড়া দিলে সুয়েজ রাজ্যে এই রকম প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা আইনে নেই বুঝি। মাঝিটা যখন আমাদের এই রকম ধমক দিচ্ছে তখন অন্য অন্য দাঁড়িদের ভারী আমোদ বোধ হচ্ছে, তারা তো পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুচকি মুচকি হাসি আরম্ভ করলে। মাঝি মহাশয়ের বিষম বদ মেজাজ দেখে তাদের হাসি সামলানো দায় হয়ে উঠেছিল। এক দিকে মাঝি ধমকাচ্ছে, এক দিকে দাঁড়িগুলো হাসি জুড়ে দিয়েছে, আমরা নিরুপায় রাগে ও লজ্জায় পুড়ছিলেম। মাঝিটির উপর প্রতিহিংসা তোলবার আর কোনো উপায় না দেখে আমরাও তিন জনে মিলে হাসি জুড়ে দিলেম―ও মনে মনে একটা সান্ত্বনা পেলেম যে ‘নীচ যদি উচ্চ ভাষে সুবুদ্ধি উড়ায় হেসে’। এ রকম সুবুদ্ধি অনেক স্থলে দায়ে পড়ে খাটাতে হয়। মানে মানে সুয়েজ শহরে গিয়ে তো পৌঁছিলেম। আমার চক্ষে সুয়েজ শহরের নূতনত্ব এইটুকু লাগল যে, এর চেয়ে খারাপ শহর আমি আর দেখি নি। সুয়েজ শহর সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার অধিকার নাই, কারণ আমি সুয়েজের আদ মাইল জায়গার বেশি আর দেখি নি। শহরের চারিদিকে একবার প্রদক্ষিণ করবার বাসনা ছিল, কিন্তু আমার সহযাত্রীদের মধ্যে যাঁরা পূর্বে সুয়েজ দেখেছিলেন তাঁরা বললেন, ‘এ পরিশ্রমে শ্রান্তি ও বিরক্তি ছাড়া অন্য কোনো ফললাভের সম্ভাবনা নেই।’ তাতেও আমি নিরুৎসাহ হই নি, কিন্তু শুনলেম গাধায় চড়ে বেড়ানো ছাড়া শহরে বেড়াবার আর কোনো উপায় নেই। শুনে শহরে বেড়াবার দিকে টান আমার অনেকটা কমে গেল। তার পর শোনা গেল এ দেশের গাধাদের সঙ্গে চালকদের সকল সময়ে মতের ঐক্য হয় না, চালক যে দিকে যাবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন গাধাটির সকল সময়ে সে দিকে যাবার ইচ্ছে হয় না― তাঁরও একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন ইচ্ছে আছে―এই জন্যে সময়ে সময়ে দুই ইচ্ছের বিরোধ উপস্থিত হয়, কিন্তু প্রায় দেখা যায় গাধার ইচ্ছে পরিণামে জয়ী হয়। সুয়েজে এক প্রকার জঘন্য চোকের ব্যামোর অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব―রাস্তায় অমন শত শত লোকের চোখ ঐ রকম রোগগ্রস্ত দেখতে পাবে। এখানকার মাছিরা ঐ রোগ চারি দিকে বিতরণ করে বেড়ায়। রোগগ্রস্ত চোখ থেকে ঐ রোগের বীজ আহরণ করে তারা অরুগ্ন চোখে গিয়ে বসে, এই রকমে চার দিকে ঐ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
সুয়েজে আমরা রেলোয়ে উঠলেম। এ রেলগাড়ির অনেক প্রকার রোগ আছে। প্রথমতঃ শোবার কোনো বন্দোবস্ত নেই, কেননা বসবার জায়গাগুলি অংশে অংশে বিভক্ত। দ্বিতীয়তঃ এমন গজগামিনী রেলগাড়ি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় না। সমস্ত রাত্রিই গাড়ি চলেছে। দিনের বেলা যখন জেগে উঠলেম তখন দেখলেম ধুলোয় আমাদের কেবল গোর হয় নি, আর সব হয়েছে। চুলে হাত দিতে গিয়ে দেখি, চুলে এমন এক স্তর মাটি জমেছে যে মাথায় অনায়াসে ধান চাষ করা যায়। এই রকম ধুলোমাখা সন্ন্যাসীর বেশে আমরা অ্যালেক্জান্দ্রিয়াতে গিয়ে পৌঁছলেম। রেলের লাইনের দু পারে সবুজ শস্যক্ষেত্র। জায়গায় জায়গায় খেজুরের গাছে থোলো থোলো খেজুর ফ’লে রয়েছে। মাঠের মাঝে মাঝে কুয়ো। মাঝে মাঝে দুই-একটা কোঠাবাড়ি―বাড়িগুলো চৌকোনা, থাম নেই, বারান্দা নেই―সমস্তটাই দেয়ালের মতো, সেই দেয়ালের মধ্যে মধ্যে দুই-একটা জানলা। এই-সকল কারণে বাড়িগুলোর যেন শ্রী নেই। যা হোক আমি আগে আফ্রিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত যে রকম অনুর্বর মরুভূমি মনে করে রেখেছিলুম, চার দিক দেখে তা কিছুই মনে হল না। বরং চার দিককার সেই হরিৎক্ষেত্রের উপর খেজুরকুঞ্জের মধ্যে প্রভাতটি আমার অতি চমৎকার লেগেছিল। অ্যালেক্জান্দ্রিয়া বন্দরে আমাদের জন্যে ‘মঙ্গোলিয়া’ স্টীমার অপেক্ষা করছিল। এইবার আমরা ভূমধ্যসাগরের বক্ষে আরোহণ করলেম, আমার একটু-একটু শীত-শীত করতে লাগল। জাহাজে গিয়ে খুব ভালো করে স্নান করলেম, আমার তো হাড়ে হাড়ে ধুলো প্রবেশ করেছিল। স্নান করবার পর অ্যালেক্জান্দ্রিয়া শহর দেখতে গেলেম। জাহাজ থেকে ডাঙা পর্যন্ত যাবার জন্যে একটা নৌকা ভাড়া করলেম। এখানকার একটা-একটা মাঝি সার উইলিয়ম জোন্সের দ্বিতীয় সংস্করণ বললেই হয়। তারা গ্রীক ইটালিয়ান ফ্রেঞ্চ্ ইংরিজি প্রভৃতি অনেক ভাষায় চলনসই রকম কথা কইতে পারে। শুনলেম ফ্রেঞ্চ্ ভাষাই এখানকার সাধারণ ভাষা। রাস্তা ঘাটের নাম, সাইন্বোর্ডে দোকানগুলির আত্মপরিচয়, অধিকাংশই ফরাসী ভাষায় লেখা। অ্যালেক্জান্দ্রিয়া শহরটি সমৃদ্ধিশালী মনে হল। এখানে যে কত জাতের লোক ও কত জাতের দোকান-বাজার আছে তার ঠিকানা নেই। রাস্তাগুলি পাথর দিয়ে বাঁধানো―তাতে বেশ পরিষ্কার থাকে, কিন্তু গাড়ির শব্দ বড়ো বেশি রকম হয়। খুব বড়ো বড়ো বাড়ি―বড়ো বড়ো দোকান―শহরটি খুব জমকালো বটে। অ্যালেক্জান্দ্রিয়ার বন্দর খুব প্রকাণ্ড। অসংখ্য অসংখ্য জাহাজ এখানে আশ্রয় পায়। ইয়ুরোপীয়, মুসলমান, সকল প্রকার জাতিরই জাহাজ এ বন্দরে আছে; কেবল দুঃখের বিষয় হিন্দুদের জাহাজ নেই।
চার পাঁচ দিনে আমরা ইটালিতে গিয়ে পৌঁছলেম। তখন রাত্রি একটা-দুটো হবে। গরম বিছানা ত্যাগ করে জিনিসপত্র নিয়ে আমরা জাহাজের ছাতে গিয়ে উঠলেম। জ্যোৎস্না রাত্রি, খুব শীত; আমার গায়ে বড়ো-একটা গরম কাপড় ছিল না, তাই ভারী শীত কচ্ছিল। আমাদের সুমুখে নিস্তব্ধ শহর, বাড়িগুলির জানেলা দরজা সমস্ত বন্ধ―সমস্ত নিদ্রামগ্ন। আমাদের যাত্রীদের মধ্যে ভারী গোল পড়ে গেল―কখনো শুনি ট্রেন পাওয়া যাবে, কখনো শুনি পাওয়া যাবে না। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে কী করা যাবে ভেবে পাওয়া যায় না, জাহাজে থাকব কি বেরোব কিছুই স্থির নেই। একজন Italian Officer এসে আমাদের গুনতে আরম্ভ করলে―কিন্তু কেন গুনতে আরম্ভ করলে তা ভেবে পাওয়া গেল না। জাহাজের মধ্যে এই রকম একটা অস্ফুট জনশ্রুতি প্রচারিত হল যে, এই গণনার সঙ্গে আর আমাদের ট্রেনে চড়ার সঙ্গে একটা বিশেষ যোগ আছে। কিন্তু সে রাত্রে মূলেই ট্রেন পাওয়া গেল না। শোনা গেল, তার পর দিন বেলা তিনটের আগে ট্রেন পাওয়া যাবে না। যাত্রীরা মহা বিরক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে সে রাত্রে ব্রিন্দিশির হোটেলে আশ্রয় নিতে হল।
এই তো প্রথম য়ুরোপের মাটিতে আমার পা পড়ল। জানোই তো আমি কিরকম কাল্পনিক, মনে করেছিলেম য়ুরোপে পৌঁছিয়েই কী-এক অপূর্ব দৃশ্য চোখের সুমুখে খুলে যাবে। সে যে কী তা কাল্পনাতেই থাকে, কথায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি কল্পনার সঙ্গে সত্যরাজ্যের প্রায় বনে না। আমার স্বভাবদোষে অনেক জিনিস ভালো করে ভোগ করতে পারি নে। কোনো নূতন দেশে আসবার আগেই আমি তাকে এমন নূতনতর মনে করে রাখি যে, এসে আর তা নূতন বলে মনেই হয় না; কোনো মহান্ দৃশ্য দেখবার আগেই আমি তাকে এমন মহান্-তর মনে করে রাখি যে, তা দেখে আর মহান বলে মনে হয় না। ইউরোপ আমার তেমন নতুন মনে হয় নি শুনে সকলেই অবাক।
আমরা রাত্রি তিনটের সময় ব্রিন্দিশির হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়লেম। সকালে একটা আধ-মরা ঘোড়া ও আধ-ভাঙা গাড়ি চড়ে শহর দেখতে বের হলেম। সারথির সঙ্গে আর গাড়িঘোড়ার সঙ্গে এমন অসামঞ্জস্য যে কী বলব! সারথির বয়স চোদ্দ হবে, কিন্তু ঘোড়াটির বয়স পঞ্চাশ হবে―আর গাড়িটি পৌরাণিক যুগের মনে হল। ছোটোখাটো শহর যেমন হয়ে থাকে ব্রিন্দিশিও তাই। কতকগুলি কোঠাবাড়ি, দোকান বাজার, রাস্তাঘাট আছে; হাঁ করে দেখবার জিনিস একটিও নেই। ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা করে ফিরছে, দু-চার জন লোক মদের দোকানে বসে গল্প-গুজব করছে, দু-চার জন রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে হাসি-তামাসা করছে, লোকজনেরা অতি নিশ্চিন্তমুখে গজেন্দ্রগমনে গমন করছে―যেন কারও কোনো কাজ নেই, কারও কোনো ভাবনা নেই―যেন শহর-সুদ্ধ ছুটি। রাস্তায় বড়ো গাড়িঘোড়ার সমারোহ নেই, লোকজনের সমাগম নেই। আমরা খানিক দূর যেতেই রাস্তা থেকে একজন ছোকরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে হাতে একটা তরমুজ নিয়ে গাড়োয়ানের পাশে গিয়ে বসল। ব―মহাশয় বললেন, ‘বিনা আয়াসে এঁর কিছু রোজগার করবার বাসনা আছে।’ তিনি এসে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে মাঝে মাঝে আমাদের দেখিয়ে দিতে লাগলেন, ঐটে চর্চ, ঐটে বাগান, ঐটে মাঠ ইত্যাদি। তাতে যে আমাদের বিশেষ কিছু উপকার হয়েছিল তা নয়―তাঁর টীকাতে আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানবৃদ্ধি হয় নি আর তাঁর টীকা না হলেও আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানের ব্যাঘাত হত না। তাঁকে কেউ আমাদের গাড়িতে উঠতে বলে নি, কেউ তাঁকে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসাও করে নি, কিন্তু তবু এই অযাচিত অনুগ্রহের জন্যে তাঁর যাচ্ঞা পূর্ণ করতে হল। তারা আমাদের একটা ফলের বাগানে নিয়ে গেল। সেখানে যে কত প্রকার ফলের গাছ তার সংখ্যা নেই। চারি দিকে আঙুরে আঙুরে আচ্ছন্ন। থোলো থোলো আঙুর ফলে রয়েছে। দু রকম আঙুর আছে―কালো আর শাদা। তার মধ্যে কালোগুলিই আমার বেশি মিষ্টি লাগল। বড়ো বড়ো গাছে আপেল পিচ প্রভৃতি অনেক প্রকার ফল ধরে আছে। এক জন বুড়ি (বোধ হয় উদ্যানপালিকা) কতকগুলি ফল ফুল নিয়ে উপস্থিত করলে, আমরা সে দিকে বড়ো নজর করলেম না। কিন্তু ফল বিক্রয় করবার উপায় সে বিলক্ষণ জানে। আমরা ইতস্ততঃ বেড়াচ্ছি এমন সময়ে দেখি একটি সুন্দরী মেয়ে কতকগুলি ফল আর ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের সুমুখে হাজির হল, তখন আর অগ্রাহ্য করবার সাধ্য রইল না।
ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রঙ, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ, আর মুখের গড়ন অতি চমৎকার। আমরা রাস্তায় ঘাটে কেবল ছোটোলোকদের মেয়েদের দেখেছি মাত্র, কিন্তু তাদেরই এমন ভালো দেখতে যে কী বলব!
তিনটের ট্রেনে আমরা ব্রিন্দিশি ছাড়লেম। রেলোয়ের পথের দু ধারে আঙুরের ক্ষেত্র, সে চমৎকার দেখতে। চার দিকের দৃশ্য এমন সুন্দর যে কী বলব। পর্বত নদী হ্রদ কুটির ক্ষেত্র ছোটো ছোটো গ্রাম প্রভৃতি যত-কিছু কবির স্বপ্নের ধন সমস্ত চারি দিকে শোভা পাচ্ছে। গাছপালার মধ্যে থেকে যখন কোনো-একটি দূরস্থ নগর―তার প্রাসাদচূড়া, তার চর্চের শিখর, তার ছবির মতো বাড়িগুলি আস্তে আস্তে চোখে পড়ে তখন বড়ো ভালো লাগে। এক-একটি দৃশ্য আমার এত ভালো লেগেছিল যে তা বর্ণনা করতে আমার ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যে বেলায় একটি পাহাড়ের নীচে অতি সুন্দর একটি হ্রদ দেখেছিলেম, তা আর আমি ভুলতে পারব না। তার চারি দিকে গাছপালা, সন্ধ্যার ছায়া জলে পড়েছে। সে অতি সুন্দর, তা আমি বর্ণনা করতে চাই নে।
রেলোয়ে করে যেতে যেতে আমরা Mont Cenisএর বিখ্যাত tunnel দেখলেম। এই পর্বতের এ পাশ থেকে ফরাসীরা, ও পাশ থেকে ইটালিয়নরা এক সঙ্গে খুদতে আরম্ভ করে; কয়েক বৎসর খুদতে খুদতে দুই যন্ত্রীদল ঠিক মাঝামাঝি এসে পরস্পরের সমুখা-সমুখী উপস্থিত হয়। এই গুহা অতিক্রম করতে রেলগাড়ির ঠিক আধ ঘণ্টা লাগল। সে অন্ধকারে আমরা যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেম। এখানকার রেলগাড়ির মধ্যে দিনরাত আলো জ্বালাই আছে; কেননা, এক-এক স্থানে প্রায় পাঁচ মিনিট অন্তর একএকটা পর্বতগুহা ভেদ করতে হয়―সুতরাং দিনের আলো খুব অল্পক্ষণ পাওয়া যায়। ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা―নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম। এই রাস্তাটুকু আমরা যেন একটি কাব্য পড়তে পড়তে গিয়েছিলেম।
সকাল বেলায় প্যারিসে গিয়ে পৌঁছলেম। কী জমকালো শহর। সেই অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যের মধ্যে গিয়ে পড়লে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। মনে হয় প্যারিসে বুঝি গরিব লোক নেই। আমার মনে হল, এই সাড়ে তিন হাত মানুষের জন্যে এমন প্রকাণ্ড জমকালো বাড়িগুলোর কী আবশ্যক! একটা হোটেলে গেলেম, তার সমস্ত এমন প্রকাণ্ড কাণ্ড যে, ঢিলে কাপড় পরে যেমন সোয়াস্তি হয় না সে হোটেলে থাকতে গেলেও আমার বোধ হয় তেমনি অসোয়াস্তি হয়। একটা ঘরের মধ্যে কোথায় মিশিয়ে যাই তার ঠিক নেই। স্মরণস্তম্ভ, উৎস, বাগান, প্রাসাদ, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া, জনকোলাহল প্রভৃতি দেখে অবাক্ হয়ে যেতে হয়। প্যারিসে পৌঁছিয়েই আমরা একটা ‘টার্কিশ বাথে’ গেলেম। প্রথমতঃ আমরা একটা খুব গরম ঘরে গিয়ে বসলেম। সে ঘরে অনেক ক্ষণ থাকতে থাকতে কারও কারও ঘাম বেরোতে লাগল; কিন্তু আমার তত বেরোল না, আমাকে তার চেয়ে আর-একটা গরম ঘরে নিয়ে গেল। সে ঘরটা আগুনের মতো। চোক মেলে থাকলে চোক জ্বালা করতে থাকে, মিনিট কতক থেকে সেখানে আর থাকতে পারলেম না, সেখান থেকে বেরিয়ে আমার খুব ঘাম হতে লাগল। তার পরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে শুইয়ে দিলে, তার পরে ভীমকায় এক ব্যক্তি এসে আমার সর্বাঙ্গ ডলতে লাগল। তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর আমি আর কখনো দেখি নি। ব্যূঢ়োরস্কো বৃষস্কন্ধঃ শালপ্রাংশুর্মহাভুজঃ। আমি মনে মনে ভাবলেম, ক্ষীণকায় এই মশকটিকে দলন করার জন্যে এমন প্রকাণ্ড কামানের কোনো আবশ্যক ছিল না। সে আমাকে দেখে বললে―আমার শরীর বেশ লম্বা আছে, এখন পাশের দিকে বাড়লে আমি একজন সুপুরুষের মধ্যে গণ্য হব। আধ ঘণ্টা ধরে সে আমার সর্বাঙ্গ অবিশ্রান্ত দলন করলে; ভূমিষ্ঠকাল থেকে আমি যত ধুলো মেখেছি, আমার শরীর থেকে সব যেন উঠে গেল। শরীরটিকে যথেষ্টরূপে দলিত করে আমাকে আর-একটি ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে গরম জল দিয়ে, সাবান দিয়ে, স্পঞ্জ দিয়ে শরীরটা বিলক্ষণ করে পরিষ্কার করলে। পরিষ্করণপর্ব শেষ হলে আরএকটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বড়ো পিচকিরি করে গায়ে গরম জল ঢালতে লাগল―হঠাৎ গরম জল দেওয়া বন্ধ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল বর্ষণ করতে লাগল―এই রকম কখনো ঠাণ্ডা কখনো গরম জলে স্নান করে একটা জলযন্ত্রের মধ্যে গেলেম―তার উপর থেকে, নীচে থেকে, চার পাশ থেকে, জল বাণের মতো গায়ে বিঁধতে থাকে―সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা বরুণবাণ-বর্ষণের মধ্যে খানিক ক্ষণ থেকে আমার বুকের রক্ত পর্যন্ত যেন জমাট হয়ে গেল। রণে ভঙ্গ দিতে হল, হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এলেম। তার পরে এক জায়গায় পুকুরের মতো আছে, আমি সঁতার দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে। আমি সাঁতার দিলেম না, আমার সঙ্গী সাঁতার দিলেন; তাঁর সাঁতার দেওয়া দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল, ‘দেখো দেখো এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাঁতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো।’ এতক্ষণে স্নান শেষ হল। আমি দেখলেম, টার্কিশ বাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপর বাড়ি দেওয়া এক কথা। তার পরে সমস্ত দিনের জন্য এক পাউন্ড্ দিয়ে এক গাড়ি ভাড়া করা গেল। প্যারিস্ এক্জিবিশন দেখতে গেলেম। তুমি এইবার হয়তো খুব আগ্রহের সঙ্গে কান খাড়া করেছ, ভাবছ আমি প্যারিস এক্জিবিশনের বিষয় কী না জানি বর্ণনা করব। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী বলব, কলকাতার য়ুনিবর্সিটিতে বিদ্যাশেখার মতো আমি প্যারিস এক্জিবিশনের সমস্ত দেখেছি কিন্তু কিছুই ভালো করে দেখি নি। এক দিনের বেশি আমাদের প্যারিসে থাকা হল না―সে বৃহৎকাণ্ড এক দিনে দেখা কারও সাধ্য নয়। সমস্ত দিন আমরা দেখলেম, কিন্তু সে রকম দেখায় দেখবার একটা তৃষ্ণা জন্মালো কিন্তু দেখা হল না। সে একটা নগরবিশেষ। এক মাস থাকলে তবে তা বর্ণনা করবার দুরাশা করতেম। প্যারিস এক্জিবিশনের একটা স্তূপাকার ভাব মনে আছে, কিন্তু শৃখলাবদ্ধ ভাব কিছুই মনে নেই। সাধারণতঃ মনে আছে যে, চিত্রশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য চমৎকার ছবি দেখেছি―স্থাপত্যশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য প্রস্তরমূর্তি দেখেছি―নানা দেশবিদেশের নানা জিনিস দেখেছি―কিন্তু বিশেষ কিছু মনে নেই। তার পর, প্যারিস থেকে লন্ডনে এলেম। এমন বিষণ্ণ অন্ধকার পুরী আর কখনো দেখি নি। ধোঁওয়া, মেঘ, বৃষ্টি, কোয়াশা, কাদা আর লোকজনের ব্যস্ত-সমস্ত ভাব―এই হচ্ছে লন্ডনের যথাসর্বস্ব। আমি দুই-এক ঘণ্টা মাত্র লন্ডনে ছিলেম, যখন লন্ডন পরিত্যাগ করলেম তখন নিশ্বাস পরিত্যাগ করে বাঁচলেম। আমার বন্ধুরা আমাকে বললেন, লন্ডনের সঙ্গে প্রথম দৃষ্টিতেই ভালোবাসা হয় না; কিছুদিন থেকে, তাকে ভালো করে চিনলে তবে লন্ডনের মাধুর্য বোঝা যায়।