য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/সপ্তম পত্র

সপ্তম পত্র

দেখো, তোমাকে যে পত্র লিখেছি তা ভারতীতে আমার ইচ্ছামতে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে এক জায়গায় স্ত্রীস্বাধীনতা সম্বন্ধে আমার মত প্রকাশ করেছিলুম, সম্পাদক-মহাশয় তার বিরুদ্ধে এক নোটের বাণ বর্ষণ করেছেন। কিন্তু সেটা সম্পাদক-মহাশয়ের লেখা কি না সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ বর্তমান। তিনি যে সেটা লেখেন নি তার প্রধান প্রমাণ হচ্ছে এই যে, সম্পাদকমহাশয়ের গাম্ভীর্য এতদূর বিচলিত হতে আর কখনো দেখি নি; দ্বিতীয়তঃ যে-সকল যুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে তা সম্পাদকমহাশয়ের লেখনীর অযোগ্য। খুব সম্ভব, কোনো উদ্ধত যুবক সম্পাদকের ক্ষমতা নিজের তরুণ স্কন্ধে গ্রহণ করে ভারতীর এক কোণে অলক্ষিত ভাবে এই নোটটি গুঁজে দিয়েছেন। নোটে খোঁচা মারার প্রধান গুণ হচ্ছে যে, তার উত্তর দিতে বসতে প্রবৃত্তি হয় না। একটা নোটের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধং দেহি’ ব’লে কোমর বেঁধে আড়ম্বর করা শোভা পায় না। গোলা দিয়ে ওড়াতে এলে রীতিমত যুদ্ধসজ্জা করতে হয়, কিন্তু তুড়ি দিয়ে ওড়াতে এলে আর কথাটি নেই। যা হোক, নানা কারণে একটা উত্তর দিতে প্রবৃত্ত হলুম। লেখক-মহাশয় আমার মুখে কতকগুলো কথা গুঁজে দিয়েছেন, যা আমি একেবারেই বলি নি;[১] তিনি কতকগুলো কথা নিয়ে অনর্গল বকাবকি করে গিয়েছেন যা একেবারে উত্থাপন করবারই কোনো আবশ্যক ছিল না।[২] তিনি অনেক জায়গায় তলোয়ার নিয়ে তুমুল আস্ফালন করেছেন, কিন্তু তার ঘা লেগেছে বাতাসের গায়ে। আবার অনেক জায়গায় তিনি আমার লেখার বিরুদ্ধে বন্দুক ছুঁড়েছেন; তার থেকে আগুনও ছুটেছে, ধোঁওয়াও বেরিয়েছে, শব্দও হয়েছে, কিন্তু তাতে গুলি নেই, ফাঁকা আওয়াজ; ধোঁওয়ার প্রাচুর্য ও শব্দের প্রাখর্য থেকে পাঠকেরা কল্পনা করবেন যে, যার প্রতি লক্ষ করা হয়েছে সে ব্যক্তি বাসায় গিয়ে মরে থাকবে—কিন্তু সে ব্যক্তির কানে তালা ধরা ও নাকে ধোঁওয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো রকম সাংঘাতিক অপকার হয় নি।[৩] লেখক-মশায় বলেছেন যে, ‘শুধু কেবল স্বাধীনতা হইলেই যদি স্ত্রীলোকদের আর কোনো গুণের প্রয়োজন না হইত, তাহা হইলেই আমরা লেখকের মতে সম্পূর্ণ মত দিতে পারিতাম। কিন্তু তাহা তো নহে— যেমন স্বাধীনতা চাই তেমনি তাহার সঙ্গে শোভন লজ্জাশীলতা, বিনয়, সরলতা, উচ্চের প্রতি ভক্তিমত্তা, নীচের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য ইত্যাদি অনেক গুণ থাকা চাই।’ ইত্যাদি। কিন্তু এতটা হাঙ্গামা কেন? বাংলা বা সংস্কৃত, আর্য বা অনার্য, সাধু বা অসাধু কোনো ভাষার অভিধানে যদি স্বাধীনতা অর্থে বেহায়ামো,; অবিনয়, অসরলতা, উচ্চের প্রতি অ-ভক্তিমত্তা, নীচের প্রতি অ-দয়াদাক্ষিণ্য লেখা থাকত তা হলে এতটা বাক্যব্যয় শোভা পেত; নইলে সরলহৃদয় পাঠকদের চোকে ধুলো দেওয়া ছাড়া লাথি মেরে মেরে এতটা বাক্যের ধুলো ওড়ানোর আর তো কোনো ফল দেখি নে।[৪] এই-সকল বকাবকির পর লেখকমহাশয় যেখানে ‘প্রকৃত কথা’ বলেছেন সেইখানেই আমি সব চেয়ে কম আয়ত্ত করতে পেরেছি। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত কথা এই যে, আমাদের দেশে এক্ষণে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতা, রুচিবিষয়ক স্বাধীনতা ইত্যাদি অনেক স্বাধীনতার অভাব আছে, তাহার সঙ্গে কী মাত্রায় স্ত্রী-স্বাধীনতা ভালোয় ভালোয় টেঁকিয়া থাকিতে পারে তাহাই এখন বিবেচনাস্থলে।’ প্রথমতঃ, ‘শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতা’ ‘রুচিবিষয়ক স্বাধীনতা’ ও ‘ইত্যাদি অনেক স্বাধীনতা’র অর্থ আমি তো ভালো করে বুঝতেই পারলুন না;[৫] দ্বিতীয়তঃ, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে স্ত্রীস্বাধীনতার কোন‍্খনটা যোগ আছে তাই আমি ভালো করে দেখতে পেলেম না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই বললে এই বোঝায় যে, আমরা ইংরেজদের অধীনে বাস করছি;[৬] যদি এমন হত যে, স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত বলিষ্ঠ জাতি, তাদের অন্তঃপুর থেকে মুক্ত করে দিলে ইংরাজদের রাজত্ব লোপ হবার সম্ভাবনা, তা হলে বুঝতাম যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলে আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতার ঘোরতর ব্যাঘাত বর্তমান। একটা স্বাধীনতা নেই বলে পৃথিবীতে যদি আর কোনো রকম স্বাধীনতা না থাকে, তা হলে আমাদের দেশে পুরুষদের স্বাধীনতা আছে কী করে? আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই, অতএব পুরুষরা অন্তঃপুরে প্রবেশ করে না কেন?[৭] রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে স্ত্রীস্বাধীনতার যদি কোনো যোগ থাকে, তবে পুরুষস্বাধীনতার সঙ্গেও তার সেই পরিমাণে যোগ আছে সন্দেহ নাই। দেশীয় রাজার অধীনে থাকলে স্ত্রীস্বাধীনতা বিষয়ে আমাদের এখনকার চেয়ে কী সুবিধা হত ও কোন্ সুবিধা হত সেইটে বললেই আমি চুপ করব।[৮] লেখক-মহাশয় হয়তো বলবেন, এখনো আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতার সময় আসে নি, সময় এলে স্বাধীনতা আপনা-আপনিই আসত। হঠাৎ যদি আজই সমস্ত স্ত্রীলোকেরা স্বাধীন হয়, তা হলে তার থেকে খারাপ ফল হতে পারে। খুব সম্ভব আমাদের দেশে আজও স্ত্রীলোকদের স্বাধীন হবার সময় হয় নি, কিন্তু আমি তো আর তলবার হাতে করে স্ত্রীস্বাধীনতা প্রচার করছি নে; কিম্বা আমি তো আজই ভারতবর্ষের Governor General হয়ে আইন বের করছি নে যে, যারা স্ত্রী-কন্যাদের স্বাধীনতা না দেয়, তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। আমি একটা কাগজে স্ত্রীস্বাধীনতা প্রার্থনীয় কি না সে বিষয়ে আমার মত প্রকাশ করেছি; আমার আশাও ছিল না উদ্দেশ্যও ছিল না যে, আমার প্রবন্ধটি পড়বামাত্র অমনি ভারতবর্ষের বিংশতি কোটি লোক তৎক্ষণাৎ তাদের স্ত্রী কন্যা ভগ্নীদের অন্তঃপুর থেকে মুক্ত করে তাঁদের অসূর্যম্পশ্যরূপত্বের গর্ব থেকে বঞ্চিত করবে। আমি বিলক্ষণ জানতেম, সূর্যের এত সৌভাগ্য আজও হয় নি যে, এত সহজে তার যুগযুগান্তরের আশা পূর্ণ হবে। আমার অভিপ্রায় এই ছিল যে, যদি বা স্ত্রীস্বাধীনতার সময় আমাদের দেশে এখনও না এসে থাকে তবে সেই সময় যত শীঘ্র আসে আমাদের তার চেষ্টা করা উচিত।[৯] প্রথমে আন্দোলন, তার পরে কাজ, তার পরে সিদ্ধি। সময় আসে নি বলে যদি মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হয় তা হলে সময় কোনো কালে আসে না। পৃথিবীতে কোন্ দেশে এমন কোন্ বৃহৎ সমাজসংস্কার হয়েছে যা আন্দোলন না করেই হয়েছে? অত কথায় কাজ কী? আমাদের বাংলাদেশে অতি অল্প দিন পূর্বে যে ধর্মসংস্কারের আরম্ভ হয় ও আজ পর্যন্ত যার আন্দোলন চলছে সেই বিষয়ে উদাহরণ দিলেই আমার যুক্তি অতি সহজে বোধগম্য হবে।[১০] ভারতবাসীদের মন এখনও অজ্ঞতাকুসংস্কারাচ্ছন্ন আছে, নিরাকার ঈশ্বরের ভাব তারা বুঝতে পারবে না, সুতরাং এখনও সত্যধর্মপ্রতিষ্ঠার সময় হয় নি বলে যদি রামমোহন রায় নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতেন, যদি তখনকার বৃদ্ধ পৌত্তলিক সমাজের সঙ্গে ঘোরতর সংগ্রাম না করতেন—সময়ের অভাব— সময়ের শূন্য ভিক্ষার ঝুলি পূর্ণ করবার চেষ্টা না করে তিনি যদি ভিক্ষুক ভাবে, অঞ্জলি পেতে সময়ের মুখপ্রতীক্ষা করে বসে থাকতেন, তা হলে আজকের এই ব্যাপ্যমান ব্রাহ্মধর্ম কোথায় থাকত?[১১] আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতার অভাব লোকে এখনও ভালো করে অনুভব করতে পারে নি, কিন্তু তাই বলে কি চুপ করে বসে থাকতে হবে? ব্যক্তিবিশেষের যদি অস্বাভাবিক কারণে ক্ষিদে আদবে না থাকে তা হলে তাকে খেতে দিয়ো না, কেননা, সে হজম করতে পারবে না; কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাকে কবিরাজ দেখানো কর্তব্য, যাতে তার ক্ষিদে হয় এমন বটিকা সেবন করানো আবশ্যক। আমি তাই ভেবে-চিন্তে ভারতীতে সমাজের জন্যে এক রতি বটিকার ব্যবস্থা করেছিলুম; কিন্তু রোগ এমন বদ্ধমূল ও কবিরাজের সাধ্যমত বটিকার মাত্রা এমন যৎসামান্য যে, তাতে উপকার হবার সম্ভাবনা অতি অল্প। কিন্তু আমাদের দেশের সকল কবিরাজ মিলে যদি এই রকম বটিকা সেবন আরম্ভ করান তা হলে অচিরাৎ রোগীর ক্ষুধার সঞ্চার হবে। লেখক-মহাশয় বলেন—‘ ‘উঃ ইনি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছেন’ এরূপ কেউ যদি মনে করেন, তবে তাঁহাদের জানা উচিত যে, এ স্বাধীনতা দেশেরও স্বাধীনতা নহে, আত্মারও স্বাধীনতা নহে, কেবল পরপুরুষগণের সহিত স্ত্রীলোকগণের আমোদপ্রমোদে মেলামেশা!’ কথাগুলো এমন করে বসানো হয়েছে যে, শুনলে অনেক পাঠকের গা শিউরে উঠবে। ‘পরপুরুষ’! ‘আমোদপ্রমোদ’!! ‘মেলামেশা’!!! কী সর্বনাশ! আমাদের ভাষায় ‘পরপুরুষ’ কথাটার সঙ্গে একটা দারুণ বিভীষিকা লিপ্ত আছে, লেখক-মহাশয় সেই সুবিধা পেয়ে কথাটা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি জানতে চাই, গরিব ‘পরপুরুষ’ কথাটি কী অপরাধ করেছে, যে, সে বেচারির ওপরে এত নিগ্রহ! পর বলেই কি তার এত দোষ?[১২] কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে বলে মহাত্মা লোকদের ‘বসুধৈব কুটুম্বকং’। ‘আমোদ-প্রমোদ’ ও ‘মেলা-মেশা’ কথ। দুটো এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে তার মধ্যে থেকে একটা ঘোরতর রহস্যপূর্ণ অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আমি আশা করি, আমাদের দেশের রুচি এখনও এমন বিকৃত হয়ে যায় নি, দেশীয় লোকের মন এমন পশুত্বে পরিণত হয় নি, তাঁদের দৃষ্টি এমন ‘পিঙ্গল’ হয়ে যায় নি ও তাঁদের ‘কল্পনার দূরবীক্ষণ’ এত দূর পর্যন্ত বিগড়ে যায় নি যে তাঁরা ‘আমোদ-প্রমোদ’ ও ‘মেলা-মেশা’ মাত্রেরই মধ্যে একটা হীন, একটা জঘন্য, একটা বীভৎস ভাব দেখতে পান।[১৩] অতএব যদি ‘আমোদ-প্রমোদ’ ও ‘মেলা-মেশা’ মাত্রেরই খারাপ অর্থ না থাকে ও ‘পরপুরুষ’ মাত্রেই যদি বাঘ ভাল্লুক বা চোর ডাকাত না হয় তা হলে ‘পরপুরুষের’ সঙ্গে ‘আমোদ-প্রমোদ’ ‘মেলা-মেশায়’ কী দোষ আছে? একজন অন্যায়রূপে কারাবদ্ধ ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেবার বিরুদ্ধে তুমি তো বলতে পারো যে, ‘এ স্বাধীনতা আত্মারও স্বাধীনতা নহে, দেশেরও স্বাধীনতা নহে, কেৱল স্বজাতিবর্গের সহিত এক ব্যক্তির আমোদ-প্রমোদে মেলা-মেশা— এ কতদূর স্বাধীনতা নামের যোগ্য তাহাই সন্দেহস্থল!’ আত্মার স্বাধীনতা ও দেশের স্বাধীনতা ব্যতীতও আরও অসংখ্য স্বাধীনতা আছে যা প্রার্থনীয়।[১৪] উপসংহারে সম্পাদক-মহাশয় বলেছেন যে, স্ত্রীগণকে অন্তঃপুরে রাখা পুরুষদের স্বার্থপরতার ফল নয়, সাংসারিক কাজকর্মের অনুরোধে তা স্বভাবতই হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্ত্রীস্বাধীনতাবিরোধীদের এই এক অতি পুরোনো যুক্তি আছে; কিন্তু আমার বোধ হয় এটা আর কারও চক্ষে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে না যে, প্রাচীরবদ্ধ অন্তঃপুরের মধ্যে চিরকালের জন্যে প্রবেশ করা ও সমস্ত পৃথিবীর থেকে আপনাকে রুদ্ধ করে রাখা স্বাভাবিক হওয়াই নিতান্ত অস্বাভাবিক।[১৫] যদি সত্যই স্বাভাবিক হত তা হলে য়ুরোপে কেন এ স্বভাবের নিয়মের পরিবর্তন হল? এখানে কি স্ত্রীলোকদের স্বামী নেই, না সন্তান হলেই তারা গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দিয়ে আসে? লেখক-মহাশয় বলেন ‘কুলরমণীরা যে যে-সে পুরুষের সঙ্গে আমোদ করিয়া বেড়ায় না, সে কেবল পতির শাসনভয়ে নহে, পতির প্রতি ভালোবাসাই তাহার কারণ।’ ও হরি! আমি কি বলেছি যে কুলরমণীরা ‘যে-সে’ পুরুষের সঙ্গে কেবল ‘আমোদই’ করে বেড়াবে? রেখাগুলিকে ঈষৎ বেঁকিয়ে-চুরিয়ে বাড়িয়ে-কমিয়ে একটি সুশ্রী ছবিকেও কদর্য করা যায়, শিবকেও বাঁদর গড়ে তোলা যায়। কোনে। পাঠক-মহাশয় কি আমার লেখা থেকে মনে করেছেন যে আমাদের কুলরমণীরা পথে ঘাটে যাকে তাকে দেখবে তারই সঙ্গে আমোদ করে বেড়াবে?[১৬] অত কথায় কাজ কী, কোন্ দেশের পুরুষেরাই ‘যে-সে’ পুরুষের সঙ্গে ‘আমোদ’ করে বেড়ায়? আমরা তো অনেক লোকের সঙ্গে মিলে থাকি, আমরা কি কেবলমাত্র আমোদ করবার জন্যেই মিলি? আমরা কাজ-কর্মের জন্যে মিলি, ভদ্রতার খাতিরে মিলি, বন্ধুভাবে মিলি, সাহায্য করতে মিলি, সাহায্য গ্রহণ করতে মিলি এবং মেলবার আরও অসংখ্য উপলক্ষ আছে। পৃথিবীতে শত সহস্র মানুষ আছে ও মানুষ সামাজিক জীব, সুতরাং মানুষে মানুষে পরস্পর দেখাসাক্ষাৎ হওয়াই স্বাভাবিক। নিতান্ত চোকে ঠুলি দিয়ে না বেড়ালে বা অন্তঃপুরের সিন্ধুকে চাবিবন্ধ না থাকলে এ রকম দেখাসাক্ষাৎ নিবারণের আর তো কোনো উপায় নেই। তা ছাড়া অন্য লোকের সঙ্গে মেশা কি স্বামীর প্রতি অপ্রীতির চিহ্ন? আমি তো তার একটা অর্থ খুঁজে পাই নে।[১৭] তোমার একটি নিতান্ত অন্তরঙ্গ প্রাণের বন্ধু আছে, কিন্তু তাই বলে কি তুমি ঘোমটা টেনে বসে থাকবে,[১৮] ও পরপুরুষের (অর্থাৎ বন্ধু ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের) মুখ দেখবে না বা তাদের সঙ্গে কথা কবে না?[১৯] তাদের মুখ দেখলে বা তাদের সঙ্গে কথা কইলে কি তোমার বন্ধুর ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া হল না? এমন বন্ধুর সঙ্গে আমি তো কোনো কারবার রাখি নে।[২০]

যা হোক— ‘এই-সকল যৎপরোনাস্তি দুরূহ বিষয়ের তত্ত্ব’ এই বাঙালিকে শিক্ষা দেবার জন্যে লেখক-মহাশয় একটা নূতন বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করবার পরিশ্রম স্বীকার না করে যদি তাঁর অবসরমত এই ভারতীতে এ বিষয়ে মাঝে মাঝে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন, তা হলে এই য়ুরোপ-প্রবাসী বঙ্গযুবক গুরুদক্ষিণা-স্বরূপ তাঁর নোটানলের ইন্ধনযোগ্য আরও কতকগুলো সৃষ্টিছাড়া সমাজসংস্কারক মত পাঠিয়ে দেবে।












বিলাতে রবীন্দ্রনাথ
  1.   যথার্থ যদি এরূপ হইয়া থাকে তবে সে কথাগুলা লেখকের উচিত ছিল উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া। ভা. স.
  2.   কেন যে আবশ্যক ছিল না তাহা আমরা বুঝিতে পারিলাম না। লেখক আমাদের নিরীহ দেশটির প্রতি স্বচ্ছন্দে ধিক্কারের খরশাণ কৃপাণ এবং উপহাসের তীক্ষ্ণ বাণ অনর্গল চালাইতে পারেন, আর-এক ব্যক্তি ঢাল দিয়া তাহা আটকাইতে গেলে সে তাহা পারিবে না— কেননা লেখকের মতে তাহা অনাবশ্যক। এমন-কি হইতে নাই যে, লেখক এক পক্ষে বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তাঁহার চক্ষে তিনিই দেখিতেছেন যে, তাঁহার বিরোধী পক্ষের কথাগুলি উত্থাপনেরই যোগ্য নহে? ভা.স.
  3.   লেখক কী ভাবে কী কথা বলিতেছেন তাহার প্রতি তত আমাদের লক্ষ নহে যত— পাঠকেরা তাঁহার কথা কী ভাবে গ্রহণ করিবেন, তাহার প্রতি। আজিকার কালের কৃতবিদ্য ব্যক্তি মাত্রেরই লক্ষ দেশীয় কুসংস্কারের উপর— যিনি একটু কলম ধরিতে জানেন তিনি সর্বাগ্রে তাহার উপরেই আপনার গোলোন্দাজির পরীক্ষা করিতে যান, কিন্তু তাহার বন্দুকের গুলিগুনো লাগে কোথায়? না, দেশীয় রীতি নীতি প্রথা যত-কিছু আছে সকলেরই গাত্রে— তা সে সু-ই হউক আর কু-ই হউক তার আর বাকৃবিচার নাই। আমাদের দেশের ভালো রীতি ভালো প্রথা ইংরাজি রীতি-নীতি-প্রথার সহিত না মিলিলেই আজকের কালের কৃতবিদ্য লোকেরা সমস্তগুলিকেই কুসংস্কারের কোটায় ফেলিয়া দেন—সেইগুলিকে বাঁচানোই আমাদের লক্ষ্য। পাছে লোকের মনে এই একটি কুসংস্কার জন্মে যে, বিবিদিগের চাল-চোল ধরণধারণের নামই স্ত্রীস্বাধীনতা, আর আমাদের কুলস্ত্রীদিগের চাল-চোল ধরণধারণের নামই হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ি, অধুনা কেবল তাহারই প্রতিবাদ করা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। ভা. স.
  4.   অবশ্য কোনো অভিধানে স্ত্রীস্বাধীনতার ওরূপ অর্থ পাওয়া যায় না, কিন্তু কাজে কী দেখা যায়? লেখক যদি বিলাতি বিবিদিগকে আদর্শ না করিয়া বিশুদ্ধরূপে স্ত্রীস্বাধীনতা-বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখিতেন, তাহ! হইলে স্ত্রীস্বাধীনতার অতগুলি পার্ষ্ণিরক্ষক (body-guard) আবশ্যক হইত না; কিন্তু লেখক বিলাতি বিবিদিগের চাল-চোল ধরণ-ধারণের আনুষঙ্গিক রূপে স্ত্রীস্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন, এজন্য বিলাতানভিজ্ঞ অধিকাংশ লোকের মনে সহসা এইরূপ একটা কুসংস্কার জন্মিতে পারে যে কার্যতঃ স্ত্রীস্বাধীনতা আর-কিছুই নহে— কেবল বিবিদিগের চাল-চোল ধরণ-ধারণ ইত্যাদি। ইহা একটি লোকবিখ্যাত বিষয় যে, বিবিদিগের shoppingএর জ্বালায়, নির্দোষ (?) আমোদাসক্তির জ্বালায়, তাহাদের স্বামীরা ধনে প্রাণে মারা যায়; অথচ স্ত্রীস্বাধীনতার একটু কোথাও পাছে আঁচড় লাগে এই ভয়ে তাঁহারা সকল অত্যাচার ঘাড় পাতিয়া লন, সকল বিষ হজম করিয়া ফেলেন। ইউরোপ ভিন্ন আর কোথাও যে স্ত্রীস্বাধীনতা নাই এমন নহে— জাপানে আছে, বোম্বাইয়ে আছে, কিন্তু সে-সকল নিয়ে আলোচনা করা লেখকের উদ্দেশ্য নহে, সর্বদেশসম্মত স্ত্রীস্বাধীনতার বিশুদ্ধ আদর্শ নিয়ে আলোচনা করাও লেখকের উদ্দেশ্য নহে, ইংলন্‌ডে যেরূপ স্ত্রীস্বাধীনতা প্রচলিত তাই যা কেবল লেখকের একমাত্র আলোচ্য বিষয়; এরূপ যখন—তখন ইংলন‍্ডের প্রচলিত স্ত্রীস্বাধীনতা যে কী ভয়ানক বস্তু, তাহা যে শত সহস্র স্থানে নামে স্বাধীনতা কাজে স্বৈরচারিতা— তাহা যে ঔদ্ধত্য, প্রগল্‌ভতা, গুরুজনের প্রতি অবজ্ঞা, দেহ-পীড়ন-বেশ-বাহুল্য এরূপ কত শত দোষে দূষিত, Saturday Review প্রভৃতি কাগজে যাহার চীৎকার কাঁদুনি মধ্যে মধ্যে ভুক্তভোগী জনের বুক ফাটিয়া বাহির হইয়া পড়িতে শুনা গিয়া থাকে, লেখক সে-সকল কথার একটুও উল্লেখ না করাতে দেশীয় লোকের চক্ষে একরূপ ধূলি দেওয়া হইয়াছে— প্রকারান্তরে বলা হইয়াছে যে, বিবিদিগের অনুকরণ করিলেই আমাদের কুলরমণীরা নিষ্কণ্টকে স্বাধীনতাপথে বিচরণ করিতে পারিবেন। আমরা সেই ধূলি অপনয়ন করিবার জন্যই বলিতেছি যে, যখন স্বাধীনতার সঙ্গে শোভন লজ্জাশীলতা, বিনয়, সরলতা, গুরুজনের প্রতি ভক্তি, নীচের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য, অপ্রগল্‌ভতা, ঔদ্ধত্যবিহীনতা ইত্যাদি গুণসমূহ থাকিবে তখনই জানিবে যে তাহা প্রকৃত স্বাধীনতা— ইংলন‍্ডীয় স্ত্রীস্বাধীনতা তাহা হইতে বহুদূরে স্থিতি করে। বোম্বাই দেশে যেমন স্ত্রীস্বাধীনতা আছে সেরূপ তীব্রতাবিহীন নির্বিষ স্ত্রীস্বাধীনতা যদি লেখকের অভিপ্রেত হইত তবে তাহার প্রতিবাদ করা দূরে থাকুক তাহা আমরা অতি আদরের সহিত গ্রহণ করিতাম। যে স্ত্রীস্বাধীনতার নামের দোহাই দিয়া শত সহস্র স্বেচ্ছাচারিতা নিত্য নিত্য পার পাইয়া যাইতেছে সে স্ত্রীস্বাধীনতার নাম শুনিলেই আমাদের আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠে। ভা. স.
  5.   অর্থাৎ, আমাদের আপনার দেশের রাজ্যশাসন-প্রণালী স্বদেশীয় লোকের আয়ত্তাধীন নহে। তাহা যদি আমাদের আপনাদের আয়ত্তাধীন হয়, তাহা হইলে আমরা রাজনীতিবিষয়ক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হই। শূন্যগর্ভ উপাধির টানে পড়িয়া আমাদের দেশের লোক স্বাভিপ্রেত শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয় ও যেরূপ শিক্ষা তাহাদিগকে জোর করিয়া গিলাইয়া দেওয়া হয় তাহাই তাহারা কণ্ঠস্থ করে। শিক্ষাদান যদি আমাদের আপনাদের অভিপ্রায়-মাফিক হয় তবেই আমরা শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হই।
     কোট হ্যাট পরিলে কালোয় কালোয় মিশিয়া বাঙালিকে ভূতের মতো দেখিতে হয়, তবু তাহা ভালো— কেন? না, যেহেতু তাহা ইংরাজ-পছন্দ! রুচিরও কখনও কখনও দাসত্বশৃঙ্খল পরিতে সাধ যায়। রুচি যদি আমাদের আপনাদের আদর্শ-মাফিক হয়, অন্যের ধামা-ধরা না হয়, তবেই আমরা রুচিবিষয়ক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হই। ভা. স.
  6.   বটেই তো; ইংরাজদের অধীনে বাস করছি বলেই তো আমরা আমাদের স্ত্রীদিগকে তাহাদের সমক্ষে বাহির করিতে সংকুচিত হই। আমাদের দুই দিকেই সংকট; যদি আমরা ইংরাজদিগকে জেতৃজাতীয় লোক মনে করিয়া তাহাদের নিকটে কুঁকড়িয়া-সুঁকড়িয়া থাকি তবে তাহারা আমাদের অতি অপদার্থ জ্ঞান করিবে ও আমাদের স্ত্রীগণকে আয়াদিগের হইতে এক ধাপ নয় উঁচু মনে করুক— কিন্তু ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ সম্মানচক্ষে দেখিতে হয় তাহা তাহারা কখনোই করিবে না; ক্রমাগতই শুনা যায় যে, বাঙালির স্ত্রীস্বাধীনতা রেল-গাড়িতে ইংরাজের পুরুষস্বাধীনতার হস্তে যার পর নাই অপমানিত হইয়া থাকে। এই এক দিক, আর-এক দিক এই যে, যদি আমরা ইংরাজদিগের সহিত সমকক্ষভাব ধারণ করিতে যাই তবে প্রথম-প্রথম হয়তো তাহারা মুখে একটু আপ্যায়িত করিবে এই পর্যন্ত, ভিতরে ভিতরে যে আমাদের স্পর্ধা-নিবারণের উপায় চিন্তা করিবে ইহাতে আর কিছুমাত্র ভুল নাই। ইংরাজেরা কত বাঙালিকে খুন করিয়া স্বচ্ছন্দে পার পাইয়া যাইতেছে আর একজন স্ত্রীলোকের প্রতি হস্তক্ষেপ করিতে ভয় পাইবে—ইহার কি কোনো অর্থ আছে? যদি পরিশেষে বাঙালি বিচারকর্তার হস্তে পড়িবার সম্ভাবনা থাকিত তবেই যা তাহাদের ভয়ের কারণ হইত— কিন্তু আমাদের দেশীয় বিচারালয়ের বিচার যেরূপ ইংরাজ-ঘেঁষা, তাহাতে আমাদের দেশের যেমন না কেন রাজরানী হউন-না, একজন সামান্য ইংরাজ তাঁহার যথেষ্ট অপমান করিলেও আদালতের সূক্ষ্ম বিচারে দাঁড়াইবে যে, বরং বাদিনীর দোষ, কেন সে প্রতিবাদীকে রাগাইয়া দিল—প্রতিবাদীর কোনো দোষ নাই। আবার, আমাদের দেশের এমন কতকগুলি ভাব আছে যাহা বিদেশীয় বিচারকের আমলেই আসিতে পারে না; আমাদের দেশীয় স্ত্রীলোকের গায়ে সামান্য একটু অপমানের আঁচ লাগিলে তাহা যে কত অধিক বলিয়া বোধ হয় তাহা বিদেশীয় সর্বসহনক্ষম কঠোর মনে এক মুহূর্তও স্থান পাইতে পারে না। আমাদের দেশীয় লোকেরা আমাদের দেশীয় স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ সম্মানচক্ষে দেখে ইংরেজেরা কখনোই সেরূপ দেখে না, ইহারও আবার প্রমাণ দিতে হইবে না কি? এই সেদিন একজন ইংরাজ বিচারকর্তা প্যায়দাকে দিয়া একজন দেশীয় স্ত্রীলোকের ঘোমটা খোলাইলেন— এ কী বলো দেখি! একজন বাঙালি বিচারকর্তা যদি ইউরোপীয় কোনো স্ত্রীলোকের প্রতি ওরূপ ব্যবহার করিত, তবে কাণ্ডটা কী হইত বলো দেখি। এই সব বিচারকর্তার হস্তে যখন আমাদের ধন প্রাণ মান নির্ভর করিতেছে তখন স্ত্রীস্বাধীনতাতে কি আর রুচি হয়? বরং একজন কেরানির পক্ষে বহুমূল্য ইংরাজি আসবাব কেনা শোভা পায়, কেননা তাহাতে সে কেবল ধনে এবং পরিশেষে প্রাণে মারা যায় মাত্র; কিন্তু একজন রাজরানীর পক্ষেও স্ত্রীস্বাধীনতা শোভা পায় না, কেননা অমূল্য কুলমানের বিনিময় ভিন্ন আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতা কিনিতে পাওয়া যায় না। ইহার কারণ আর কিছুই নহে— জেতজাতি জিতজাতির কুলমানের মূল্য অতি যৎসামান্য মনে করে; আমাদের ভদ্রলোকের স্ত্রীদিগকে আয়াদেরই সামিল মনে করে— তা চেয়ে নিচু বৈ উঁচু মনে করে না। কোনো বাঙালি ভদ্রঘরের স্ত্রী দুর্ভাগ্যবশতঃ কতিপয় সভ্য ইংরাজমণ্ডলীর সঙ্গে এক টেবিলে খানা খাইতে বসিয়াছিল, সেই সভ্যমণ্ডলীর মধ্যে কেহ কেহ বলা কহা করিতে লাগিলেন যে, ‘শেষকালে মেৎরানির সঙ্গে আমাদের এক টেবিলে খানা খাইতে হইল!’ বিদেশীয় রাজ্যে বাস করাতেই আমাদের ভাগ্যে সময়ে সময়ে ঐরূপ ঘটে; ম্যাঞ্চেস্টরের একজন তাঁতির ছেলে যেখানে আমাদের দেশের ভদ্রবংশীয় কায়স্থকন্যাকে মেৎরানি বলিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না, সেখানে ভদ্রবংশীয় স্ত্রীলোকদিগকে কত সাবধানে আগলিয়া রাখা কর্তব্য তাহা কি আর বলিবার কহিবার বিষয়? ঠিক বিপরীত পৃষ্ঠ দেখিতে চাও তো বলি শুন— আমাদের জ্ঞাতসারে একবার কোনো নৌকাযাত্রী-ভদ্রলোকের নৌকার তলা ফুটা হইয়া যাওয়াতে তিনি স্ত্রী-পুত্র-সমভিব্যাহারে তাড়াতাড়ি ডাঙায় উঠিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; ডাঙায় কতকগুলি কুঁড়েঘর ও চাল-ডালের দোকান ছিল; তথাকার সকল লোকে মিলিয়া অতি যত্ন-পূর্বক স্ত্রীলোকটির সম্মান রক্ষার জন্য একটি কুঁড়ে ঘরের চার দিকে ঘের-ঘার দিয়া দিব্য একটি নিভৃত স্থান নির্দেশ করিয়া দিল এবং আবশ্যক যত-কিছু সকলেরই সহায়তা করিল, পারিতোষিকের কথা একবার মুখেও আনিল না; যে ব্যক্তি ঘর ছাড়িয়া দিয়াছিল সে ঘরভাড়া-স্বরূপ যাহা পাইল তাহাতেই সন্তুষ্ট। দেখো আমাদের দেশের চাষাভুষা ইতর লোকেরাও কুলস্ত্রীকে কিরূপ সম্মানচক্ষে দেখে; ইহা ইউরোপ দেশের অতি ভক্তিপূর্ণ গ্যালান্‌ট্রি, নহে, ইহা আর এক বস্তু— কী? না, পরস্ত্রীকে মাতৃবৎ পরিত্র ভাবে দেখা। স্ত্রীলোকদিগকে মাতৃসম্বোধনে সম্মান করিবার প্রথা আমাদের দেশের যেটি আছে তাহার সহিত এবং ইউরোপ-দেশীয় gallantryর সহিত তুলনা করিয়া দেখিলে দুয়ের মধ্যে স্বর্গ-নরক-প্রভেদ দেখিতে পাওয়া যায়। দেশীয় কুলরমণীর যে-একটি পবিত্র মর্যাদা তাহা কি gallantry-পরায়ণ ব্যক্তিরা জানে? না, তাহাদিগকে তাহা বলিয়া বুঝানো যাইতে পারে? কিন্তু গ্যালান্‌ট্রি যে কী বস্তু তাহা আমরা বিলক্ষণ বুঝি— তাহার বশবর্তী হইয়া একটি সুন্দরী মিস তাহার গুরুজনকে পশ্চাতে ফেলিয়া আপনি স্বচ্ছন্দে হই হই করিয়া প্রধান আসন গ্রহণ করেন— আমাদের দেশে এই-সকল চাল-চোল শিক্ষা হইলেই সর্বনাশ! ইংরাজেরা যখন জেতৃজাতি এবং তাহারা আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদিগের কুলমর্যাদার কোনো তক্কাই রাখে না তখন আমাদের কী-এত দায় পড়িয়াছে যে তাহাদের সমক্ষে আমাদের স্ত্রীলোকদিগকে বাহির না করিলেই নয়! ভা. স.
  7.   পুরুষের অপমানিত হওয়া এবং স্ত্রীলোকের অপমানিত হওয়া যদি একই কথা হইত তাহা হইলে লেখক ঠিকই বলিতেছেন যে, স্ত্রীজাতিকে যেরূপ সাবধানে রক্ষা করা হয় পুরুষজাতিকে সেরূপ রক্ষা করা হয় না কেন? কিন্তু বিলাতি গ্যালান্‌ট্রি-শাস্ত্রেওতো আছে যে স্ত্রীর গায়ে আঘাত লাগিলে যত লাগে পুরুষের গায়ে আঘাত লাগিলে উহার তুলনায় তাহা কিছুই নহে। ভা.স.
  8.   আমাদের দেশে পূর্বকালে অতি এক নির্বিষ নিষ্কণ্টক স্ত্রীস্বাধীনতা প্রচলিত ছিল ইহা কাহারও অবিদিত নাই। বোম্বাই প্রদেশে এখনও তাহার কতকটা আভাস দেখিতে পাওয়া যায়; ইহাতেই যথেষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে স্বদেশীয় স্ত্রীস্বাধীনতা স্বদেশীয় রাজ্যশাসনপ্রণালীর আয়ত্তাধীনেই সুন্দর শোভায় পরিস্ফুট হইতে পারে। যেমন মুসলমানদিগের বাহুবল তেমনি ইংরাজদিগের বাহুবলতিরস্করিণী মন্ত্রবিদ্যা সর্বাঙ্গসুন্দর দিশি স্ত্রীস্বাধীনতার বিরোধী। ভা. স.
  9.   ‘যত শীঘ্র আসে’ এ চেষ্টা অপেক্ষা যত শোভনভাবে নির্বিষভাবে নিরুপদ্রবভাবে আসে, এই চেষ্টা অধিক প্রার্থনীয়। যদি বলো যে শেষোক্ত চেষ্টা বৃথা হইবে, তবে আর-একজন বলিবে পূর্বোক্ত চেষ্টাও বৃখা হইবে; প্রকৃত কথা এই যে দুই চেষ্টারই ফলের আশা এত অল্প যে, আমাদের ভাগ্যে উভয়ই এক প্রকার দুরাশা; কিন্তু যদি ‘যত্নে কৃতে যদি ন সিদ্ধাতি কোহত্র দোষঃ’ এই ভাবিয়া কোমর বাঁধিয়া চেষ্টা করিতে হয় তবে শেষোক্ত প্রকারের চেষ্টাই সর্বতোভাবেই শ্রেয়। ভা স.
  10.   আন্দোলন যাহাতে রীতিমত হয় অর্থাৎ এক-দিক-ঘেঁষা না হয় এই জন্যই বর্তমান প্রস্তাবটির পদে পদে টিপ্পনী-সংযোগের এত আয়াস পাওয়া যাইতেছে। ভা. স.
  11.   রামমোহন রায়ের কথা ছাড়িয়া দেওয়া হোক— তিনি যেরূপ দেশীয় আকারে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করিয়াছেন, স্ত্রীস্বাধীনতা সে ভাবে প্রচারিত হইলে আমরা তো বাচিয়া ষাই— কিন্তু এ তো তা নয়— এ হচ্ছে বিবিদের গৌনের আঁচল ধরিয়া চলা, আয়া-গিরি করা। বোম্বাই দেশেও তো স্ত্রীস্বাধীনতা আছে— স্বাধীন যুক্তি ও রুচি -সহকারে স্ত্রীস্বাধীনতার ভালো একটা আদর্শ দাঁড় করাও, তাহা আমরা মাথায় করিয়া লইব; কিন্তু তাহা বলিয়া স্ত্রীস্বাধীনতার নামের খাতিরে তাহার একটা অন্তঃসারশূন্য চিকন-চাকন আদর্শকে ‘এই উচ্ছিষ্টই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট’ বলিয়া গলাধঃকরণ করিতে পারি না। ভা.স.
  12.   একজন পর-মানুষ কিছু দোষ করে নাই বলিয়া তাহার সহিত আত্মীয়স্বজনের মতো ব্যবহার করিতে হইবে, তাহাকে ঘরের স্ত্রীলোকদিগের সহিত মেলা-মেশা করিতে দিতে হইবে, ইহা কোন্ ইংরাজি আইনে পাওয়া যায়? ভা.স.
  13.   লেখকের মত এই যে, যেমন পুরুষে পুরুষে আমোদ-প্রমোদে মেলামেশা নিষ্কণ্টকে চলিতে পারে, পরপুরুষে পরস্ত্রীতেও তাহা তেমনিই নিষ্কণ্টকে চলিতে পারে। কিন্তু, কাজে কী দেখা যায়? দুইজন পুরুষমানুষের মধ্যে যতই কেন বন্ধুতা ও ঘনিষ্ঠতার মাত্রা বাড়ুক-না তাহাতে বিশেষ কাহারও কিছু আইসে যায় না; কিন্তু পরস্ত্রী এবং পরপুরুষের মধ্যে নির্দোষ বন্ধুতার মাত্রা বাড়িলে অনেকেরই তাহা শঙ্কার বিষয় হয় কেন? ইংরাজ-সমাজের বিধানানুসারে পরপুরুষদের সঙ্গে পরস্ত্রীদের হাত ধরাধরি করিয়া নাচিতে পর্যন্ত কোনো দোষ নাই, কিন্তু আমাদের চক্ষে ওটা কিছু আমোদ-প্রমোদ মেলা-মেশার আতিশয্য বলিয়াই ঠেকে। আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতা ছিল না এমন নহে এবং এখনও তাহা কোথাও কোথাও আছে, কিন্তু তথাপি স্ত্রীলোকেরা আমাদের এমনি সম্মানের পাত্রী যে পর-কেহ তাহাদিগকে স্পর্শ করিবে ইহা আমরা দেখিতে পারি না। সখ্য এবং দাম্পত্য দুয়ের মধ্যে কেবল একটা বালির বাঁধ সংস্থাপন করিয়া যাহারা নিশ্চিন্ত থাকেন তাঁহারাই বলিতে পারেন - এতে দোষ কী, তাতে দোষ কী। কিন্তু যাঁহারা স্ত্রীস্বাধীনতা চান অথচ সখ্য ও দাম্পত্য দুইকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিতে চান, তাঁহারা ঐ স্থানে প্রস্তরের বাঁধ ভিন্ন আর-কিছুতেই সন্তুষ্ট হইতে পারেন না। লেখক যে বলিবেন— সুচক্ষে দেখিলে সকলই সু, কু-চক্ষে দেখিলে সকলই কু, তাহার জো নাই; সহস্র বন্ধুনী হউন-না কেন, তাঁহার বাড়িতে যদি পুরুষ-মানুষ কেহ না থাকে তবে ইংরাজি শাস্ত্রে তাঁহার ঘরে গিয়া তাঁহার সহিত সখ্যালাপ করা অবিধি হুইল কেন? সু-চক্ষে দেখিলে তাহাতে তো কোনো দোষ নাই। ভা.স.
  14.   আত্মার স্বাধীনতা সকল অবস্থাতেই নির্দোষ, কিন্তু স্ত্রীস্বাধীনতা যে অংশে বুঝায় ‘পরপুরুষগণের সহিত একত্রে আমোদ-প্রমোদে মেলা-মেশা’ সে অংশে তাহা নির্দোষ হইতেও পারে না হইতেও পারে; কে বলিতে পারে যে তাহা নির্দোষ ভিন্ন আর-কিছুই হইতে পারে না? সুতরাং আমরা এখনও বলিতেছি যে, পরপুরুষদিগের সহিত আমোদ-প্রমোদে মেলা-মেশা আত্মার স্বাধীনতার ন্যায় দোষাশঙ্কার সীমা-বহির‍্ভূত এমন কোনো বস্তু নহে যে, তাহা স্ত্রীলোকের অবশ্যকর্তব্য কর্মের মধ্যে গণ্য হইবে; উহা অপেক্ষা বরং আপনাদিগকে মিথ্যা অপবাদ নিন্দা-গ্লানি প্রভৃতি হইতে রক্ষা করা স্ত্রীলোকদিগের বেশি কর্তব্য কর্ম। স্ত্রীস্বাধীনতা প্রার্থনীয় নহে— ইহা আমরা কোনো কালে বলিও নাই বলিবও না, কিন্তু যে প্রকার স্ত্রীস্বাধীনতা হুইতে সুফল অপেক্ষা কুফলেরই অধিক সম্ভাবনা সে স্ত্রীস্বাধীনতা থাকা অপেক্ষা না থাকা-ই অধিক প্রার্থনীয়। যে দেশে বুদ্ধিমান লোকের নিকট বিবাহ বিভীষিকা-বিশেষ সে দেশের স্ত্রীস্বাধীনতার অনুকরণ করিবার জন্য হিন্দুসমাজের কী যে দায় পড়িয়াছে তাহা তো বুঝা যায় না। বোম্বাই দেশে কি স্ত্রীস্বাধীনতা নাই? মহারাষ্ট্রীয় দেশে কি স্ত্রীস্বাধীনতা নাই? সে-সব অগ্রাহ্য করিয়া ভয়ানক উৎপেতে য়ুরোপীয় স্ত্রীস্বাধীনতাকে আদর্শ করিয়া চলিতে আমাদের যে এত ব্যগ্রতা তাহার অর্থ আর কিছুই নয়, খালি— বিধাতার বিড়ম্বনা। তাহার অর্থ, অর্থের অপব্যয়, সময়ের অপব্যয়, শরীরের কষ্ট, মনের কষ্ট আর মেম-সাহেবি একটা তমো— এই ষা-কিছু। ভা. স.
  15.   স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের সহিত এখানকার সম্পর্কই নাই— এখনকার যা-কিছু বিচার তা কেবল সুবিধা অসুবিধা নিয়ে। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থাতে স্ত্রীলোকদের অন্তঃপুরবাস-প্রথা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ বলিয়াই তাহা প্রার্থনীয়। যদি চতুর্দিকে মানহানির ভয় সত্যসত্যই বিদ্যমান না থাকিত তাহা হইলে অন্তঃপুরকে কারাগারের সহিত তুলনা করিলে দোষের হইত না; কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করিয়া দেখিলে নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে যে, অন্তঃপুর কুলস্ত্রীদিগের কঠোর কারাগার নহে— তাহা তাহাদের নিরাপদ-দুর্গ, অভয়নিকেতন। আগে যথার্থ ধর্ম-প্রচার-দ্বারা চারি দিকের জঞ্জাল পরিষ্কার করো, তাহার পরে অন্তঃপুরপ্রথা অল্পে অল্পে পরিবর্তন করো— তাহাতে আমাদের কিছুমাত্র অমত নাই। কিন্তু তাও বলি অস্তঃপুরপ্রথা একেবারেই উচ্ছেদ করা কখনোই হইতে পারেও না, পারিবেও না; এমন-কি ইউরোপেও অন্তঃপুরপ্রথা একেবারে যে নাই তাহা বোধ হয় না। ও দেশে যদি পুরুষদিগের মেলা-মেশা করিবার স্বতন্ত্র স্থান ও স্ত্রীলোকদের মেলা-মেশা করিবার স্বতন্ত্র স্থান নির্দিষ্ট না থাকে তবে সে অভাব যত শীঘ্র পূরণ হয় ততই ভালো। boudoir বোধ হয় কতকটা আমাদের অবরোধের কাছাকাছি যায়। যাহা হউক—আমাদের দেশের অন্তঃপুরপ্রথা পরিবর্তন করিবার যদি আবশ্যক হয় তবে আমাদের আপনাদের রকমে তাহা করা উচিত। ‘আপনাদের রকমে’ কাহাকে বলে তাহার একটা দৃষ্টান্ত—আমাদের দেশের অতিথিসেবা যেমন স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা যত্নের সহিত অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে তাহাকে আদর্শ করিয়া আমাদের অন্তঃপুরপ্রথা পরিবর্তন করা যাইতে পারে, এমন-কি অন্তঃপুরের গৃহিণী কোনো অভ্যাগত ব্যক্তির অতিথিসৎকার করিলে তাহা আমাদের দেশাচারের চক্ষে ভালো বৈ মন্দ দেখিতে হয় না। বোম্বাই প্রদেশে এইরূপ প্রথা অদ্যাপি প্রচলিত আছে। ভা. স.
  16.   যে-সে লোকের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিয়া বেড়ানো, সর্বদাই হউক আর কদিচ কখনোই হউক, তাহা কুলস্ত্রীকে শোভা পায় না— যে-সে লোক বলিলে সুদ্ধ যে কেবল দুষ্ট লোকই বুঝায়, সুদ্ধ যে কেবল অভদ্র লোকই বুঝায়, সুদ্ধ যে কেবল পথের লোকই বুঝায় তাহা নহে। শান্তশিষ্ট লোক বলো, ভদ্র লোক বলো, পরিচিত লোক বলো, অবস্থা-বিশেষে সকলেই যে-সে লোকের মধ্যে পরিগণিত হইতে পারেন। লোকটি ভদ্রবংশীয়, লেখাপড়া জানে, কথাবার্তা বেশ, ভদ্র আচার ব্যবহার, আমার পরিচিত এই পর্যন্ত— কিন্তু আমি তাহার ধর্মাধর্ম এবং চরিত্রের জন্য দায়ী নহি—এমন যে ব্যক্তি ইনিও এক হিসাবে যে-সে লোকের মধ্যে ধর্তব্য। কোন্ হিসাবে? না, যখন তাঁহাকে অন্তঃপুরের স্ত্রীগণের সহিত আলাপ করাইয়া দিবার কথা। যাহার সহিত সবে নূতন আলাপ হইয়াছে তাহার সহিত হাত ধরাধরি করিয়া নাচিতে স্ত্রীজনের যদি কোনো বাধা না থাকে তবে যে-সে লোকের সহিত আমোদপ্রমোদ করিয়া বেড়াইতে যে কিসের বাধা, তাহা বুঝা যায় না— সকল সময়েই তো কিছু আর আমোদ-প্রমোদ দোষে কলঙ্কিত হয় না। ভা স.
  17.   কুলস্ত্রীরা যে পরপুরুষদিগের সহিত বেশি মেলা-মেশা ও আমোদপ্রমোদ করে না তাহার কারণ অনেকগুলি। যথা—
     ১ পাছে কুলোকে কু ভাবে, যাহাকে খুব ভালো বলিয়া জানা আছে তাঁহারও অন্তঃকরণ কু হইবার আটক নাই।
     ২ পাছে সুলোকে কু ভাবে, ইহাতেও আটক নাই। পরস্ত্রী পরপুরুষে মেলা-মেশা কতটুকু পর্যন্ত শোভা পায় তাহার একটা মাত্রা রাজনিয়ম-দ্বারা আজি পর্যন্তও নির্ধারিত হয় নাই। আমি যাহা দেখিয়া বলিব ‘ইহাতে দোষ নাই’ আর-একজন বলিবে ‘এতটা ভালো নয়’। সেক্সপিয়রের উইণ্টরস্ টেলের হরমিওনী বেচারির ও তাঁহার স্বামীর দুর্দশা বিবিসাহেবদিগকে বিলক্ষণই ভোগ করিতে হয়, কিন্তু কী করিবেন? দুর্জয় দেশাচার—সুতরাং নাচার!
     ৩ পাছে স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পায়। স্বামীর মনে হয়তো এইরূপ একটা মাত্রা নির্ধারিত আছে যে, পরপুরুষদের সহিত স্ত্রীলোকের এইটুকু পর্যন্ত মেলা-মেশাই ভালো, তাহা অপেক্ষা বেশি ঘনিষ্ঠতা ভালো না। যে স্ত্রী স্বামীকে ভালোবাসে সে স্ত্রী সেই মাত্রাটি অতিক্রম করিয়া স্বামীর মনে আঘাত দিতে কুণ্ঠিত হইবে না তো আর কে হইবে? সে মাত্রা কতটুকু স্বামীই তাহা জানে, স্ত্রী তাহা জানে না, সুতরাং যদি স্বামীর মনঃপীড়া জন্মানো স্ত্রীর প্রার্থনীয় না হয় তবে শেষোক্তের উচিত পরপুরুষদের সহিত আমোদ-প্রমোদে মেলা-মেশা না করা— যে স্ত্রী স্বামীকে অধিক ভালোবাসে তাহার তাহাতে প্রবৃত্তিই হয় না। সেক‍্স‍্পিয়রের উইণ্টরস্ টেলে লিয়ণ্টীসের স্ত্রী হর‍্মিওনী যখন লিয় টসের একজন বন্ধুর সহিত সেক্‌হ্যাণ্ড্, করিতেছেন তখন লিয়ণ্টীস আপন মনে বলিতেছেন—

    Too hot, too hot!
    To mingle friendship far is mingling bloods.
    I have tremor cordis [হৃৎকম্প] on me; my heart dances,
    But not for joy, not joy. This entertainment
    May a free face put on; derive a liberty
    From heartiness, from bounty, fertile bosom,
    And well become the agent. ‘T’ may, I grant;
    But to be paddling palms and pinching fingers,
    As now they are, and making practis’d smiles
    As in a looking-glass; and then to sigh, as ’twere
    The mort o ‘th’ deer. [হরিণের মরণকালীন দীর্ঘনিশ্বাস]
    O, that is entertainment
    My bosom likes not, nor my brows!

    এই তো গেল সেক‍্স‍্পিয়র—আমাদের কোনো সুবিচক্ষণ সাহেব-বন্ধুর মুখে আমরা স্বকর্ণে এইরূপ শুনিয়াছি—‘কী! আমার স্ত্রীর গাত্র অন্য লোকে স্পর্শ করিবে, আমি অন্য লোকের স্ত্রীর গাত্র স্পর্শ করিব—ছি!’

     ৪ স্বামী মনে করিতে পারে যে, আমি আমার স্ত্রীর চরিত্র যেরূপ জানি তাহাতে সে পরপুরুষদের সহিত সহস্র মেলা-মেশা করিলেও কোনো দোষের সম্ভাবনা নাই, কিন্তু সেরূপ করিলে অমুক অমুক ব্যক্তিরা কু মনে করিতে পারে—মিছামিছি একটা কলঙ্ক কুড়াইয়া প্রয়োজন কী? এরূপ যখন হইতেও পারে, হইয়াও থাকে, তখন পরপুরুষদিগের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিবার কী এমন মূল্য যে, তাহার জন্য স্ত্রী স্বামীর মনে এক মুহূর্তেও ঐরূপ দুর্ভাবনা উদ্দীপন করিয়া তাহাকে ব্যতিব্যস্ত করিবে! ভা স.

  18.   অত্যুক্তি। অন্তরঙ্গ লোকের নিকট কে ঘোমটা টানিয়া বসিয়া থাকে? ঘোমটা যা দেওয়া থাকে তাই থাকে, টানিয়া বেড়াইবার প্রয়োজনাভাবে শুধু-শুধু কেন তাহা করিবে? অন্তরঙ্গ—প্রাণের কেন, মুখের বন্ধুর সঙ্গেও সকল স্ত্রীলোকেরই তো সহজভাবে কথাবার্তা চলিয়া থাকে। তবে যদি বলো যে ঘোমটা দেওয়াটাই অন্যায়, তবে সে কোনো কাজের কথা নহে। কেননা, তাহা ন্যায়ও নহে অন্যায়ও নহে, তাহা দেশাচার মাত্র। তাহা দেখিতেও ভালো বৈ মন্দ নহে। যদি ঘোমটা না দেওয়া প্রথা থাকিত তাহা হইলে কালিদাসের এই সুন্দর কবিতাটি আমরা দেখিতে পাইতাম না— কেয়মবগুণ্ঠনবতী নাতিপরিস্ফুটশরীরলাবণ্যা! অতিপরিস্ফুট লাবণ্যের তীব্রতাও নহে, অপরিস্ফুট লাবণ্যের মন্দতাও নহে, কিন্তু উভয়ের মাঝামাঝি অনতিপরিস্ফুট লাবণ্যের যে-একটি মাধুর্য তাহা কেবল অবগুণ্ঠন-দ্বারাই রক্ষিত হইতে পারে। ভা. স.
  19.   মুখ দেখিতেও দোষ নাই, কথা কহিতে দোষ নাই, আলাপ করিতেই দোষ— সুতরাং এটাও অত্যুক্তি। ভা. স.
  20.   আমার বন্ধুর সহিত আমি কোনো কারবার রাখিব না, এমন-কি তাহার মুখ দর্শন করিব না— অপরাধ? না, তিনি তাঁহার স্ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ করাইয়া দেন নাই। একটা ব্র্যাঘ্রের মুখ হইতে আমিষ কাড়িয়া লইলে তাহারই বটে ঐরূপ ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। কিন্তু লেখকের অতবড়ো রাগের তেমন তো কোনো গুরুতর কারণ দেখা যায় না। ইংরাজেরা দেখো কেমন ধীরপ্রকৃতির লোক, তাঁহাদের স্ত্রীরা পরপুরুষদিগের সহিত নাচিলেও তাঁহাদের ধৈর্য লোপ হয় না। ভা. স.