য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি/গ্রন্থপরিচয়

গ্রন্থপরিচয়

রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইংলন্‌ড-যাত্রা করেন সতেরাে বৎসর বয়সে (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮), প্রায় দেড় বার কাল প্রবাসে অতিবাহন করিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ১৮৮০ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই সময় বিলাত হইতে প্রেরিত তাঁহার ‘পত্র’-প্রবন্ধাবলী ‘য়ুরােপ-প্রবাসীর পত্র’ নামে ভারতী পত্রে ও পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। জীবনস্মৃতি গ্রহেও এই প্রবাসযাপনের বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে।

 দ্বিতীয়বার তিনি বিদেশযাত্রা করেন ১৮৯০ সনের অগস্টে। এবার বিলাতে থাকা অল্পকালের জন্য, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই দেশে ফিরিয়া আসেন। এই ‘দুই মাস এগারো দিন’ সমুদ্রপারে যাওয়া-আসার ও বিলাতে থাকার যে দিনলিপি রাখা হইয়াছিল তাহারই সাহায্যে প্রথম বর্ষের সাধনা পত্রে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’ নিম্নমুদ্রিত ক্রমে ও শিরােনামে ক্রমশ প্রকাশিত হয়—

সাধনার রচনার নাম
যাত্রা আরম্ভ
আমার সহযাত্রী
তরী পরিবর্ত্তন
লোহিত সমুদ্রে
ভূমধ্যসাগরে
রেলপথের দুই পার্শ্বে
প্যারিস্ হইতে লণ্ডনে
লণ্ডনে
ভাসমান
জাহাজের কাহিনী
যাত্রা-সমাপন

দিনলিপির তারিখ
২২-২৩ অগস্ট্ ১৮৯০
২৬ অগস্ট্
২৭-২৯ অগস্ট্
৩০ আগস্ট্
৩১ অগস্ট্ - ৬ সেপ্টেম্বর
৭ সেপ্টেম্বর
৮-১১ সেপ্টেম্বর
১২ সেপ্টেম্বর-২ অক্টোবর
৬-১০ অক্টোবর
১৪-২৪ অক্টোবর
২৬ অক্টোবর-৪ নবেম্বর

সাধনা
১২৯৮ অগ্রহায়ণ
পৌষ
মাঘ
ফাল্গুন
চৈত্র
১২৯৯ বৈশাখ
জ্যৈষ্ঠ
আষাঢ়
শ্রাবণ
ভাদ্র-আশ্বিন
কার্তিক

য়ুরোপে তথা ইংলন্‌ডে যাওয়া-আসায় পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসিয়া রবীন্দ্রনাথের মনে যে চিন্তাধারায় উদ্ভব হইয়াছিল তাহাও তিনি স্বতন্ত্র প্রবন্ধকারে গ্রথিত করেন এবং ‘চৈতন্য লাইব্রেরি’র এক ‘বিশেষ অধিবেশনে’ পাঠ করেন। ইহাতে আলোচিত কোনো কোনো বক্তব্যবিষয় সংক্ষিপ্তভাবে মূল দিনলিপিতেও লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবন্ধ ‘য়ুয়োপযাত্রীর ডায়ারি। (ভূমিকা) প্রথম খণ্ড’ আখ্যায় স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়; বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত প্রকাশকাল— ১৬ বৈশাখ ১২৯৮ (১৮৯১)।

 সাধনায় ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত ভ্রমণবৃত্তান্তটি ‘য়ুয়োপ-যাত্রীর ডায়ারি। দ্বিতীয় খণ্ড’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশলাভ করে; আখ্যাপত্রে মুদ্রিত প্রকাশ কাল—৮ আশ্বিন ১৩০০ (১৮৯৩)।

 মূল দিনলিপি[] শ্রীমতী ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীর নিকট বহুকাল সংরক্ষিত ছিল; তিনি উহা শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রসদনে উপহার দেন। উহাতে বহু অপ্রকাশিত বিবরণ পরিলক্ষিত হওয়ায় ত্রৈমাসিক বিশ্বভারতী পত্রিকার অষ্টম ও নবম বর্ষের পাঁচটি সংখ্যায় (শাবণ ১৩৫৬-পৌষ ১৩৫৭) ধারাবাহিকভাবে উহা প্রকাশিত হয়; পুনর্বার পাণ্ডুলিপির সহিত মিলাইয়া বর্তমানে এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে সংকলিত হইল।

 মূল দিনলিপি বা ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি: খসড়া’ ব্যতীত বর্তমান গ্রন্থের পরিশিষ্টে রবীন্দ্রনাথের পাঁচখানি চিঠি ও জীবনতির প্রথম পাণ্ডুলিপির কিয়দংশ সংকলিত হইল। পাঁচখানি চিঠির প্রথম তিনখানি এ যাত্রায় ইংলন্‌ড্‌ যাইবার পথে কবিপত্নী মতী মৃণালিনীদেবীকে লেখা হয় আর ইংলন্‌ডে পৌঁছিয়া কবি অন্য দুইখানি লেখেন শ্রমতী ইন্দিরাদেবীকে। বহু পরবর্তী জীবনস্মৃতির পাণ্ডুলিপি হইতে যে রচনা সংকলিত হইল তাহাতে কেবল যে এই বিদেশযাত্রার বিশেষ উল্লেখ আছে তাহাই নয়, পাশ্চাত্য জীবনযাত্রা-প্রণালী সম্পর্কে রবীন্দ্র-চিত্তের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যাত হইয়াছে আর আভাসে প্রাচ্য জীবনযাত্রা বা জীবনাদর্শের সহিত উহার তুলনাও দেখা যায়— এ রচনা ‘য়ুরোপ-যাত্রী’র অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতার ও মূল বক্তব্যের ভাষ্য বা টীকা রূপে গ্রহণ করা যায় সন্দেহ নাই।

 শ্রদ্ধেয়া ইন্দিরাদেবী -কর্তৃক রবীন্দ্রসদনে উপহৃত মূল দিনলিপির ন্যায় বর্তমান গ্রন্থে সংকলনযােগ্য মনে না হইলেও, উপস্থিত প্রসঙ্গে আর-একখানি রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপির অবশ্যই উল্লেখ করিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপি কবি যতীন্দ্রমােহন বাগচীর নিকট হইতে সংগৃহীত; মনে হয়, ইহা মূল দিনলিপি ও ‘সাধনা’ পত্রে ‘ডায়ারি’র আংশিক প্রকাশ উভয়ের অন্তর্‌বর্তীকালীন। এই খাতাখানির প্রথমাবধি যােলােটি পাতায়, বত্রিশ পৃষ্ঠায়, মুদ্রিত ‘ডায়ারি’র প্রথম খণ্ডের প্রায় পূর্ণ পরিণত রূপ অবিচ্ছেদে পাওয়া যাইতেছে; রচনাশেষে কবির হস্তাক্ষরে তারিখ দেখা যায়: ১৫ই মাঘ। মঙ্গলবার। ১৮৯১।— পরবর্তী বাইশটি পাতায় বা চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠায় ডয়ারির দ্বিতীয় খণ্ডের পূর্ণতর (মূল দিনলিপির তুলনায়) পাঠ লিপিবদ্ধ রহিয়াছে; ইহারও সব-শেষে কবি স্থানকালের নির্দেশ দিয়াছেন: ১৪ ফেব্রুয়ারি, শিলাইদহ। ১৮৯১। ৩ ফাল্গুন।—অর্থাৎ, ১৮৯০ নভেম্বরে কবি দ্বিতীয়বারের বিলাত-যাত্রা হইতে ফিরিবার সঙ্গে সঙ্গে যে ডায়ারি লেখা সমাপ্ত হয়, ১৮৯১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ তাহার প্রকাশযােগ্য রূপান্তর সমাধা করেন আর ঐ বৎসরেই নভেম্বর-ডিসেম্বরে (বাংলা অগ্রহায়ণ ১২৯৮) ‘সাধনা’ আত্মপ্রকাশ করিলে উহার প্রথম সংখ্যা হইতেই আরও রূপান্তরিত করিয়া ‘ডায়ারি’র কিয়দংশ (দ্বিতীয় খণ্ড} ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিতে থাকেন। ‘ডায়ারি’র প্রথম খণ্ড -স্বরূপ ভূমিকা’টি, সাধনার সুচনা না হইতেই ১২৯৮ বৈশাখে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়— ইহা আমাদের জানা আছে।

 মূল দিনলিপি বা ‘খসড়া’, মুদ্রণপূর্ব অন্য পাণ্ডুলিপি, ‘সাধনা’য় মুদ্রিত পাঠ এবং প্রথম-প্রচারিত দুই খণ্ড গ্রন্থ— কোনাে একটি পাঠ অন্যান্যের যথাযথ প্রতিরূপ বা প্রতিলিপি বলা যায় না— বিষয়ে বা বক্তব্যে মূলতঃ ঐক্য থাকিলেও, ভাষায় ভঙ্গীতে শব্দচয়নে এবং বক্তব্যের সংক্ষেপণে বা অলংকরণে পদে পদেই ভিন্নতা দেখা যায়। ‘খসড়া’র কথা ছাড়িয়া দিলেও, রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকবারই রচনায় কিছু না-কিছু যোগ বিয়ােগ ও পাঠপরিবর্তন করিয়াছেন। যতীন্দ্রমােহন বাগচীর নিকট হইতে সংগৃহীত, অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির যে-দুটি অংশের প্রতিরূপ এই গ্রন্থে মুদ্রিত হইল, তাহার প্রথমটি যেমন মুদ্রিত পাঠের (বর্তমান গ্রন্থের পৃ ৪৯) প্রায় অনুরূপ, দ্বিতীয়টি যে পূর্বমুদ্রিত গ্রহের পাঠ (বর্তমান গ্রন্থে পৃ ১৩৩-৩৪) এবং ‘খসড়া’র পাঠ (বর্তমান গ্রন্থে পৃ ২৪৩-৪৫) উভয় হইতেই বহুশঃ পৃথক তাহা স্পষ্টই দেখা যাইবে।


 ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’র কোনো খণ্ডই বহুকাল গ্রন্থাকারে পুনর্‌মুদ্রিত হয় নাই। ১৯০৭-১৯০৯ খৃস্টাব্দে ষোলো খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের ‘গদ্য গ্রন্থাবলী’ প্রকাশিত হয়; এই উপলক্ষ্যে ‘ডায়ারি’র বিভিন্ন অংশ উহার বিভিন্ন খণ্ডে বিভিন্ন গ্রন্থে প্রচুর সম্পাদন ও সংক্ষেপণ -পূর্বক গৃহীত হয়। ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়রি’র ‘ভূমিকা’ বা ‘প্রথম খণ্ড’ দুইটি প্রবন্ধে ভাগ করিয়া সুচনাংশ ‘নূতন ও পুরাতন’ নামে ‘স্বদেশ’ গ্রন্থে আর পরবর্তী অংশ ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ নামে ‘সমাজ’ গ্রন্থে সংকলন করা হয়। ভ্রমণবৃত্তান্তু অংশ বা ‘দ্বিতীয় খণ্ড’ গৃহীত হয় ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থে, অর্থাৎ গদ্য গ্রন্থাবলীর প্রথম খণ্ডে।

 ১৯৩৬ খৃস্টাব্দে (আশ্বিন ১৩৪৩) প্রকাশিত ‘পাশ্চাত্যভ্রমণ’ গ্রন্থে সংশোধিত আকারে ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ গ্রন্থের সহিত ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’র ‘দ্বিতীয় খণ্ড’ মুদ্রিত হয় এবং ঐভাবেই রবীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম খণ্ডে (আশ্বিন ১৩৪৬) পুনর্‌মুদ্রিত হইয়াছে।

 উল্লেখ করা যাইতে পারে রবীন্দ্রনাথ-সংকলিত বিদ্যালয়-পাঠ্য পাঠসঞ্চয় (১৩১৯) বিচিত্রপাঠ (১৯১৫) বা চতুর্থ পাঠপ্রচয় (চৈত্র ১৩৩৬) গ্রন্থে ‘য়ুরোপের ছবি’ শিয়োনামে “সাধু” ভাষায় রচিত যে ক্ষুদ্র নিবন্ধটি আছে তাহাও ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’র অল্প কয়েক দিনের বিবরণীর আংশিক সংকলন ও রূপান্তর মাত্র।

 বর্তমান গ্রন্থে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম-প্রকাশিত গ্রন্থ-যুগলের পাঠের অনুসরণে মুদ্রিত হইল।

 উভয় খণ্ডের উৎসর্গপত্র অবিকল একরূপ ছিল— বর্তমান গ্রন্থের সপ্তম পৃষ্ঠায় সংকলিত।


  1. ইহাই বর্তমান গ্রন্থের পরিশিষ্টে মুদ্রিত: য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি: খসড়া