য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি/প্রাসঙ্গিক সংকলন

প্রাথমিক সংকলন
শ্রীমতী মৃণালিনী দেবীকে লিখিত পত্র

আজ আমরা এডেন বলে এক জায়গায় পৌঁছব। অনেক দিন পরে ডাঙা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে নাবতে পারব না, পাছে সেখান থেকে কোনাে রকম ছোঁয়াচে ব্যামাে নিয়ে আসি। এডেনে পৌঁছে আর-একটা জাহাজে বদল করতে হবে, সেই একটা মহা হাঙ্গাম রয়েছে। এবারে সমুদ্রে আমার যে অসুখটা করেছিল সে আর কী বলব— তিন দিন ধরে যা একটু কিছু মুখে দিয়েছি অমনি তখনি বমি করে ফেলেছি— মাথা ঘুরে গা ঘুরে অস্থির— বিছানা ছেড়ে উঠি নি—কী করে বেঁচে ছিলুম তাই ভাবি। রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়াে খাটে এক ধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তােমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তােমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বললুম, ছােটোবউ, মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তােমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম— বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না। তার পরে বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম। যখন ব্যামাে নিয়ে পড়ে ছিলুম তােমরা আমাকে মনে করতে কি? তােমাদের কাছে ফেরবার জন্যে ভারী মন ছট্‌ফট্ করত। আজকাল কেবল মনে হয় বাড়ির মতাে এমন জায়গা আর নেই— এবারে বাড়ি ফিরে গিয়ে আর কোথাও নড়ব না। আজ এক হপ্তা বাদে প্রথম স্নান করেছি। কিন্তু স্নান করে কোনাে সুখ নেই— সমুজের নােনা জলে নেয়ে সমস্ত গা চট্‌চট্‌ করে মাথার চুলগুলাে এক রকম বিশ্রী আটা হয়ে জটা পাকিয়ে যায়— পা কেমন করে। মনে করছি যতদিন না জাহাজ ছাড়ব আর স্নান করব না। ইউরােপে পৌঁছতে এখনাে হপ্তাখানেক আছে— একবার সেইখানে পৌঁছে ডাঙায় পা দিয়ে বাঁচি। এই দিন-রাত্রি সমুদ্র আর ভালাে লাগে না। আজকাল যদিও সমুদ্রটা বেশ ঠাণ্ডা হয়েছে, জাহাজ তেমন দুলছে না, শরীরেও কোনাে অসুখ নেই―সমস্ত দিন জাহাজের ছাতের উপরে একটা মস্ত কেদারায় উপরে প’ড়ে হয় লােকেনের সঙ্গে গল্প করি নয় ভাবি, নয় বই পড়ি। রাত্তিরেও ছাতের উপরে বিছানা করে শুই, পারৎপক্ষে ঘরের ভিতরে ঢুকি নে। ঘরের মধ্যে গেলেই গা কেমন করে ওঠে। কাল রাত্তিরে আবার হঠাৎ খুব বৃষ্টি এল— যেখানে বৃষ্টির ছাঁট নেই সেইখানে বিছানাটা টেনে নিয়ে যেতে হল। সেই অবধি এখন পর্যন্ত ক্রমাগতই বৃষ্টি চলছে। কাল বেড়ে রোদ্‌দুর ছিল। আমাদের জাহাজে দুটো-তিনটে ছােটো ছটো মেয়ে আছে—তাদের মা মরে গেছে, বাপের সঙ্গে বিলেত যাচ্ছে। বেচারাদের দেখে আমার বড়াে মায়া করে। তাদের বাপটা সর্বদা তাদের কাছে কাছে নিয়ে বেড়াচ্ছে— ভালাে করে কাপড়-চোপড় পরাতে পারে না, জানে না কিরকম করে কী করতে হয়। তারা বৃষ্টিতে বেড়াচ্ছে, বাপ এসে বারণ করলে, তারা বললে আমাদের বৃষ্টিতে বেড়াতে বেশ লাগে’— বাপটা একটু হাসে, বেশ আমােদে খেলা করছে দেখে বারণ করতে বােধ [হয়] মন সরে না। তাদের দেখে আমার নিজের বাচ্ছাদের মনে পড়ে। কাল রাত্তিরে বেলিটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম— সে যেন স্টী‌মারে এসেছে তাকে এমনি চমৎকার ভালাে দেখাচ্ছে সে আর কী বলব— দেশে ফেরবার সময় বাচ্ছাদের জন্যে কিরকম জিনিস নিয়ে যাব বলো দেখি। এ চিঠিটা পেয়েই যদি একটা উত্তর দাও তা হলে বােধ হয় ইংলন্‌ডে থাকতে থাকতে পেতেও পারি। মনে রেখো মঙ্গলবার দিন বিলেতে চিঠি পাঠাবার দিন। বাচ্ছাদের আমার হয়ে অনেক হামি দিয়ো··· ···

‘শ্যাম’। শুক্রবার [২৯ অগস্ট্ ১৮৯০]

পরশু তােমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছি— আজ আবার আর-একটা লিখছি— বােধ হয় এ দুটো চিঠি এক দিনেই পাবে— তাতে ক্ষতি কী? কাল আমরা ডাঙায় পৌঁছব তাই আজ তােমাকে লিখে রাখছি। আবার সেই ইংলন্‌ডে পৌঁছে তােমাদের লেখবার সময় পাব। যদি যাতায়াতের গােলমালে এর পরের হপ্তায় চিঠি ফাঁক যায় তা হলে কিছু মনে কোরাে না। জাহাজে চিঠি লেখা বিশেষ শক্ত নয়—কিন্তু ডাঙায় উঠে যখন ঘুরে বেড়াব, কখন্ কোথায় থাকব তার ঠিকানা নেই, তখন দুই-একটা চিঠি বাদ যেতেও পারে। আমরা ধরতে গেলে পরশু থেকে য়ুরােপে পৌঁচেছি। মাঝে মাঝে দূর থেকে য়ুরোপের ডাঙা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাহাজটা এখন ডান দিকে গ্রীস আর বাঁ দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্ছে—কতকগুলাে পাহাড়, তার মাঝে মাঝে বাড়ি, এক জায়গায় খুব একটা মস্ত শহর— দূরবীন দিয়ে তার বাড়িগুলাে বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলুম—সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে শাদা শহরটি বেশ দেখাচ্ছে। তােমার দেখতে ইচ্ছে করছে না ছুট্‌কি? তােমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জানাে? তা মনে করে তােমার খুশি হয় না? যা কখনাে স্বপ্নেও মনে কর নি সেই সময় দেখতে পাবে। দুদিন থেকে বেশ একটু ঠাণ্ডা পড়ে আসছে—খুব বেশি নয়—কিন্তু যখন ডেকে বসে থাকি এবং জোরে বাতাস দেয় তখন একটু শীত-শীত করে। অল্পস্বল্প গরম কাপড় পরতে আরম্ভ করেছি। আজকাল রাত্তিরে ডেকে শােওয়াটাও ছেড়ে দিতে হয়েছে। জাহাজের ছাতে শুয়ে লােকেনের দাঁতের গােড়া ফুলে ভারী অস্থির করে তুলেছিল। আমরা যে সময়ে এসেছি নিতান্ত অল্প শীত পাব— দার্জিলিঙে যে রকম শীত ছিল তার চেয়ে ঢের কম। ছাড়বার সময়-সময় একটু শীত হবে হয়তাে। আমি অনেকগুলাে অদরকারী কাপড়-চোপড় এবং সেই বালাপােষখানা মেজবােঠানের হাত দিয়ে তােমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি― সেগুলাে পেয়েছ তো? না পেয়ে থাক তো চেয়ে নিয়ে। সেগুলাে একবার লক্ষ্মীর হাতে পড়লে সমস্ত মেজবােঠানের আলমারির মধ্যে প্রবেশ করবে। বেলির জন্যে আমি একটা কাপড় আর পাড় কিনে মেজবােঠানদের সঙ্গে পাঠিয়েছি— সেটা এতদিনে অবিশ্যি পেয়েছ— খুব টুক টুকে লাল কাপড়— বােধ হয় বেলিবুড়িকে তাতে বেশ মানাবে— পাড়টাও বেশ নতুন রকমের— না? মেজবােঠানও বেলির জন্যে তার একটা প্রাইজের কাপড় নিয়েছেন— নীলেতে শাদাতে—সেটাও বেলুরানুকে বেশ মানাবে। সেটা যে রকমের ভাবুনে, নতুন কাপড় পেয়ে বােধ হয় খুব খুশী হয়েছে। আমাকে কি সে মনে করে? খােকাকে ফিরে গিয়ে কিরকম দেখব কে জানে। ততদিনে সে বােধ হয় দুটো-চারটে কথা কইতে পারবে। আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারবে না। হয়তাে এমন ঘাের সাহেব হয়ে আসব তােমরাই চিনতে পারবে না। আমার সেই আঙুল কেটে গিয়েছিল, এখন সেরে গেছে, কিন্তু খুব দুটো গর্ত হয়ে আছে— ভয়ানক কেটে গিয়েছিল। অনেক দিন বাদে কাল-পরশু দুদিন স্নান করেছি— আবার পরশু দিন প্যারিসে পৌঁছে নাবার বন্দোবস্ত করতে হবে। সেখানে ‘টার্কিশ বাথ’ ব’লে এক রকম নাবার বন্দোবস্ত আছে, তাতে খুব করে পরিষ্কার হওয়া যায়— বোধ হয় আমার ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ তার বিষয় পড়েছ— যদি সময় পাই তো সেইখেনে নেয়ে নেব মনে করছি। আমার শরীর এখন বেশ ভালো আছে—জাহাজে তিন বেলা যে রকম খাওয়া চলে তাতে বোধ হচ্ছে আমি একটু মোটা হয়ে উঠেছি। আমি ফিরে গিয়ে তোমাকে যেন বেশ মোটাসোটা সুস্থ দেখতে পাই ছোটোবউ। গাড়িটা তো এখন তোমারই হাতে প’ড়ে রয়েছে— রোজ নিয়মিত বেড়াতে যেয়ো, কেবলই পরকে ধার দিয়ো না। কাল রাত্তিরে আমাদের জাহাজের ছাতের উপর স্টেজ খাটিয়ে একটা অভিনয়ের মতো হয়ে গেছে— নানা রকমের মজার কাণ্ড করেছিল, একটা মেয়ে বেড়ে নেচেছিল। তাই কাল শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আজ জাহাজে শেষ রাত্তির কাটাব।··· ···

 [৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯০]

ভাই ছোটোবউ—আমরা ইফেল টাউয়ার বলে খুব একটা উঁচু লৌহস্তম্ভের উপর উঠে তোমাকে একটা চিঠি পাঠালুম। আজ ভোরে প্যারিসে এসেছি। লন্‌ডনে গিয়ে চিঠি লিখব। আজ এই পর্যন্ত। ছেলেদের জন্যে হামি।

প্যারিস ৯ সেপ্টেম্বর। মঙ্গলবার। ১৮৯০

এ দেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি সত্যি আমার মা ব’লে মনে হয়। এ দেশের মতাে তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালােবাসে। আমার আজন্মকালের যা-কিছু ভালােবাসা, যা-কিছু সুখ, সমস্তই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনােই ভােলাতে পারবে না— আমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি। সমস্ত সভ্যসমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতাে আপনার মৌচাকটি ভরে ভালােবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাই নে।

লন্‌ডন ৩ অক্টোবর ১৮৯০

মানুষ কি লােহার কল, যে, ঠিক নিয়ম-অনুসারে চলবে? মানুষের মনের এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত কাণ্ড-কারখানা—তার এত দিকে গতি—এবং এত রকমের অধিকার যে, এ দিকে - ও দিকে হেলতেই হবে। সেই তার জীবনের লক্ষণ, তার মনুষ্যত্বের চিহ্ন, তার জড়ত্বের প্রতিবাদ। এই দ্বিধা, এই দুর্বলতা যার নেই তার মন নিতান্ত সংকীর্ণ এবং কঠিন এবং জীবনবিহীন। যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্বদাই কটুভাষা প্রয়ােগ করি সেই আমাদের জীবনের গতিশক্তি— সেই আমাদের নানা সুখদুঃখ পাপপুণ্যের মধ্যে দিয়ে অনন্তের দিকে বিকশিত করে তুলছে। নদী যদি প্রতি পদে বলে ‘কই সমুদ্র কোথায়, এ যে মরুভূমি, ঐ যে অরণ্য, ঐ যে বালির চড়া, আমাকে যে শক্তি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝি আমাকে ভুলিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে’—তা হলে তার যে রকম ভ্রম হয়, প্রবৃত্তির উপরে একা অবিশ্বাস করলে আমাদেরও কতকটা সেই রকম ভ্রম হয়। আমরাও প্রতিদিন বিচিত্র সংশয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছি, আমাদের শেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি নে, কিন্তু যিনি আমাদের অনন্ত জীবনের মধ্যে প্রবৃত্তি-নামক প্রচণ্ড গতিশক্তি দিয়েছেন তিনিই জানেন তার দ্বারা আমাদের কিরকম করে চালনা করবেন। আমাদের সর্বদা এই একটা মস্ত ভুল হয় যে, আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের যেখেনে নিয়ে এসেছে সেইখানেই বুঝি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে― আমরা তখন জানতে পারি নে সে আমাদের তার মধ্যে থেকে টেনে তুলবে। নদীকে যে শক্তি মরুভূমির মধ্যে নিয়ে আসে সেই শক্তিই সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে যায়। ভ্রমের মধ্যে যে ফেলে ভ্রম থেকে সেই টেনে নিয়ে যায়। এই রকম করেই আমরা চলেছি। যার এই প্রবৃত্তি অর্থাৎ জীবনী শক্তির প্রাবল্য নেই, যার মনের রহস্যময় বিচিত্র বিকাশ নেই সে সুখী হতে পারে, সাধু হতে পারে এবং তার সেই সংকীর্ণতাকে লােকে মনের জোর বলতে পারে, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয় তার বেশি নেই।···

লন্‌ডন ১০ অক্টোবর ১৮৯০

আরও তো অনেক জায়গায় ঘুরিয়াছি― ভালাে জিনিস, প্রশংসার জিনিস অনেক দেখিয়াছি; কিন্তু সেখানে তাে আমার এই মা’র মতাে আমাকে কেহ অন্ন পরিবেশন করে নাই। আমার কড়ি যে হাটে চলে না সেখানে কেবল সকল জিনিসে চোখ বুলাইয়া ঘুরিয়া দিনযাপন করিয়া কী করিব! যে বিলাতে যাইতেছিলাম সেখানকার জীবনের উদ্দীপনাকে কোনােমতেই আমার হৃদয় গ্রহণ করিতে পারে নাই। আমি আর-একবার বিলাতে যাইবার সময় পত্রে লিখিয়াছিলাম—

 ‘নীচেকার ডেকে বিদ্যুতের প্রখর আলােক, আমােদপ্রমােদের উচ্ছ্বাস, মেলামেশার ধুম, গানবাজনা এবং কখনাে কখনাে ঘূর্ণিনৃত্যের উৎকট উন্মত্ততা। এ দিকে আকাশের পূর্বপ্রান্তে ধীরে ধীরে চন্দ্র উঠছে, তারাগুলি ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। সমুদ্র প্রশান্ত ও বাতাস মৃদু হয়ে এসেছে; অপার সমুদ্রতল থেকে অসীম নক্ষত্রলােক পর্যন্ত এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা, এক অনির্বচনীয় শান্তি নীরব উপাসনার মতাে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। আমার মনে হতে লাগল— যথার্থ সুখ কাকে বলে এরা ঠিক জানে না। সুখকে চাব্‌কে চাব্‌কে যতক্ষণ মত্ততার সীমায় না নিয়ে যেতে পারে ততক্ষণ এদের যথেষ্ট হয় না। প্রচণ্ড জীবন ওদের যেন অভিশাপের মতাে নিশিদিন তাড়া করছে; ওরা একটা মস্ত লােহার রেলগাড়ির মতাে চোখ রাঙিয়ে, পৃথিবী কাঁপিয়ে, হাঁপিয়ে, ধুঁইয়ে, জ্ব’লে, ছুটে প্রকৃতির দুই ধারের সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে হুস্ করে বেরিয়ে চলে যায়। কর্ম বলে একটা জিনিস আছে বটে, কিন্তু তারই কাছে আমাদের মানবজীবনের সমস্ত স্বাধীনতা বিকিয়ে দেবার জন্যেই আমরা জন্মগ্রহণ করি নি— সৌন্দর্য আছে, আমাদের অন্তঃকরণ আছে; সে দুটো খুব উঁচু জিনিস।’

 আমি বৈলাতিক কর্মশীলতার বিরুদ্ধে উপদেশ দিতেছি না। আমি নিজের কথা বলিতেছি। আমার পক্ষে বাংলাদেশের এই আকাশ-ভরা আলাে, এই দক্ষিণের বাতাস, এই গঙ্গার প্রবাহ, এই রাজকীয় আলস্য, এই আকাশের নীল ও পৃথিবীর সবুজের মাঝখানকার দিগন্তপ্রসারিত উদার অবকাশের মধ্যে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ— তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার অন্নের মতোই আবশ্যক ছিল। যদিও খুব বেশিদিনের কথা নহে তবু ইতিমধ্যে সময়ের অনেক পরিবর্তন হইয়া গেছে। আমাদের তরুছায়াপ্রচ্ছন্ন, গঙ্গাতটের নীড়গুলির মধ্যে কলকারখানা ঊর্ধ্বফণা সাপের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সোঁ সোঁ শব্দে কালাে নিশ্বাস ফুঁসিতেছে। এখন খরমধ্যাহ্নে আমাদের মনের মধ্যেও বাংলাদেশের স্নিগ্ধচ্ছায়া খর্বতম হইয়া আসিয়াছে— এখন দেশে কোথাও অবসর নাই। হয়তাে সে ভালােই, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভালাে এমন কথাও জোর করিয়া বলিবার সময় হয় নাই।

 বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিবার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে আরএকখানি পুরাতন চিঠি হইতে উদ্‌ধৃত করিয়া দিই—

 ‘যৌবনের আরম্ভ-সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেম। সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিনে বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে চারি দিক থেকে প্রসারিত সহস্র বন্ধন, সেই সুদীর্ঘ অবসর, কর্মহীন কল্পনা, আপন-মনে সৌন্দর্যের মরীচিকা-রচনা, নিষ্ফল দুরাশা, অন্তরের নিগূঢ় বেদনা, আত্মপীড়ক অলস কবিত্ব—এই-সমস্ত নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে পড়ে আছি। আজ আমার চার দিকে নবজীবনের প্রবলতা ও চঞ্চলতা দেখে মনে হচ্ছে আমারও হয়তাে এ রকম হতে পারত। কিন্তু আমরা সেই বহুকাল পূর্বে জন্মেছিলেম তিনজন বালক― তখন পৃথিবী আর-এক রকম ছিল। এখনকার চেয়ে অনেক বেশি অশিক্ষিত, সরল, অনেক বেশি কাঁচা ছিল। পৃথিবী আজকালকার ছেলের কাছে Kindergartenএর কর্ত্রীর মতো―কোনাে ভুল খবর দেয় না, পদে পদে সত্যকার শিক্ষাই দেয়― কিন্তু আমাদের সময়ে সে ছেলে ভােলাবার গল্প বলত, নানা অদ্ভুত সংস্কার জন্মিয়ে দিত, এবং চারি দিকের গাছপালা প্রকৃতির মুখশ্রী কোনাে-এক প্রাচীন বিধাতৃমাতার বৃহৎ রূপকথা-রচনারই মতাে বােধ হত; নীতিকথা বিজ্ঞানপাঠ বলে ভ্রম হত না।’

 এই উপলক্ষ্যে এখানে আর-একটি চিঠি[১] উদ্‌ধৃত করিয়া দিব। এ চিঠি অনেক দিন পরে আমার ৩২ বছর বয়সে গােরাই নদী হইতে লেখা, কিন্তু দেখিতেছি সুর সেই একই রকমের আছে। এই চিঠিগুলিতে পত্রলেখকের অকৃত্রিম আত্মপরিচয়, অন্তত বিশেষ সময়ের বিশেষ মনের ভাব প্রকাশ পাইবে। ইহার মধ্যে যে ভাবটুকু আছে তাহা পাঠকদের পক্ষে যদি অহিতকর হয় তবে তাঁহারা সাবধান হইবেন; এখানে আমি শিক্ষকতা করিতেছি না।

 ‘আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো জন্মগ্রহণ করব। যদি করি আর কি কখনাে এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গােরাই নদীটির উপরে বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে··· পড়ে থাকতে পারব? হয়তাে আর-কোনাে জন্মে এমন একটি সন্ধেবেলা আর কখনাে ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে, আর কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি, কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না। আশ্চর্য এই আমার সব চেয়ে ভয় হয় পাছে আমি য়ুরোপে গিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কেননা, সেখানে সমস্ত চিত্তটিকে এমন উপরের দিকে উদ্‌ঘাটিত রেখে পড়ে থাকবার জো নেই, এবং পড়ে থাকাও সকলে ভারী দোষের মনে করে। হয়তো একটা কারখানায় নয়তো ব্যাঙ্কে নয়তো পার্লামেণ্টে সমস্ত দেহ মন প্রাণ দিয়ে খাটতে হবে। শহরের রাস্তা যেমন ব্যাবসা-বাণিজ্য গাড়িঘোড়া চলবার জন্যে ইঁটে-বাঁধানো কঠিন, তেমনি মনটা স্বভাবটা বিজ্‌নেস চালাবার উপযোগী পাকা করে বাঁধানো— তাতে একটি কোমল তৃণ, একটি অনাবশ্যক লতা গজাবার ছিদ্রটুকু নেই। ভারী ছাঁটাছোঁটা গড়াপেটা আইনে-বাঁধা মজবুত রকমের ভাব। কী জানি, তার চেয়ে আমার এই কল্পনাপ্রিয় আত্মনিমগ্ন বিস্তৃত-আকাশ-পূর্ণ মনের ভাবটি কিছুমাত্র অগৌরবের বিষয় বলে মনে হয় না।’

 এখনকার কোনো কোনো নূতন মনস্তত্ত্ব পড়িলে আভাস পাওয়া যায় যে একটা মানুষের মধ্যে যেন অনেকগুলো মানুষ জটলা করিয়া বাস করে, তাহাদের স্বভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।··· আমার মধ্যে অন্য ব্যক্তিও আছে— যথাসময়ে তাহারও পরিচয় পাওয়া যাইবে।


  1. ছিন্নপত্র। ১৬ মে ১৮৯৩ তারিখের চিঠি।