য়ু রাে প - যা ত্রী র ডা য়া রি

ভূমিকা

অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল য়ুরোপীয় সভ্যতার ঠিক মাঝখানটাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে একবার তার আঘাত আবর্ত এবং উন্মাদনা, তার উত্তাল তরঙ্গের নৃত্য এবং কলগীতি, অট্টহাস্য করতালি এবং ফেনোচ্ছ্বাস, তার বিদ্যুৎবেগ, অনিদ্র উদ্যম এবং প্রবল প্রবাহ সমস্ত শিরা স্নায়ু ধমনীর মধ্যে অনুভব করে আসব। বহুকাল তীরে বসে বসে বালির ঘর গড়ছি এবং ভাঙছি, এবং ভাবছি, ইতিমধ্যে বন্ধুবান্ধবেরা একে একে অনেকেই নিজ নিজ শক্তি অনুসারে সমুদ্রমন্থন সমাপন করে এলেন; এমনি উৎসাহ যে শুষ্কতীরে ফিরে এসেও তাঁরা হস্তপদ-আস্ফালন কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারছেন না। আমিও তাই দেখে কৌতূহলবশতঃ একদিন অপরাহ্ণে ঐ তরঙ্গিত অগাধ রহস্যরাশির মধ্যে আনন্দে অবতরণ করেছিলুম, মুহূর্তের মধ্যে খুব খানিকটা নাড়াচাড়া হাবুডুবু এবং লোনা জল খেয়ে অচিরাৎ উঠে এসেছি। এখন কিছুদিন ভাঙার উপরে সর্বাঙ্গ বিস্তারপূর্বক চক্ষু মুদ্রিত করে রোদ পোহাব মনে করছি।

 আমরা পুরাতন ভারতবর্ষীয়; বড়ো প্রাচীন, বড়ো শ্রান্ত। আমি অনেক সময়ে নিজের মধ্যে আমাদের সেই জাতিগত প্রকাণ্ড প্রাচীনত্ব অনুভব করি। মনোযোগপূর্বক যখন অন্তরের মধ্যে নিরীক্ষণ করে দেখি তখন দেখতে পাই, সেখানে কেবল চিন্তা এবং বিশ্রাম এবং বৈরাগ্য। যেন অন্তরে বাহিরে একটা সুদীর্ঘ ছুটি। যেন জগতের প্রাতঃকালে আমরা কাছারির কাজ সেরে এসেছি, তাই এই উত্তপ্ত মধ্যাহ্নে যখন আর সকলে কার্যে নিযুক্ত তখন আমরা দ্বার রুদ্ধ করে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করছি; আমরা আমাদের পূরা বেতন চুকিয়ে নিয়ে কর্মে ইস্তাফা দিয়ে পেন্‌সনের উপর সংসার চালাচ্ছি। বেশ আছি।

 এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বহুকালের যে ব্রহ্মত্রটুকু পাওয়া গিয়েছিল তার ভালো দলিল দেখাতে পারি নি বলে নূতন রাজার রাজত্বে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ আমরা গরিব। পৃথিবীর চাষারা যে রকম খেটে মরছে এবং খাজানা দিচ্ছে আমাদেরও তাই করতে হবে। পুরাতন জাতিকে হঠাৎ নূতন চেষ্টা আরম্ভ করতে হয়েছে।

 অতএব চিন্তা রাখো, বিশ্রাম রাখো, গৃহকোণ ছাড়ো, ব্যাকরণ ন্যায়শাস্ত্র শ্রুতিস্মৃতি এবং নিত্যনৈমিত্তিক গার্হস্থ্য নিয়ে থাকলে আর চলবে না; কঠিন মাটির ঢেলা ভাঙো, পৃথিবীকে উর্বরা করো এবং নব মানব-রাজার রাজস্ব দাও; কালেজে পড়ো, হোটেলে খাও এবং আপিসে চাকরি করো।

 উঠেছি তো, চলেওছি, দেখাচ্ছি আমরা খুব কাজের লোক―কিন্তু ভিতরে ভিতরে কতটা নিরাশ্বাস, কতটা নিরুদ্যম!

 হায়, ভারতবর্ষের পুরপ্রাচীর ভেঙে ফেলে এই অনাবৃত বিশাল কর্মক্ষেত্রের মধ্যে আমাদের কে এনে দাঁড় করালে! আমরা চতুর্দিকে মানসিক বাঁধ নির্মাণ ক’রে, কালস্রোত বন্ধ করে দিয়ে, সমস্ত নিজের মনের মতো গুছিয়ে নিয়ে বসে ছিলুম। চঞ্চল পরিবর্তন ভারতবর্ষের বাহিরে সমুদ্রের মতো নিশিদিন গর্জন করত, আমরা অটল স্থিরত্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে গতিশীল নিখিল সংসারের অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে বসেছিলুম। এমন সময়ে কোন্ ছিদ্রপথ দিয়ে চির-অশান্ত মানবস্রোত আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে সমস্ত ছারখার করে দিলে! পুরাতনের মধ্যে নূতন মিশিয়ে, বিশ্বাসের মধ্যে সংশয় এনে, সন্তোষের মধ্যে দুরাশার আক্ষেপ উৎক্ষিপ্ত করে দিয়ে সমস্ত বিপর্যস্ত করে দিলে!

 মনে করো আমাদের চতুর্দিকে হিমাদ্রি এবং সমুদ্রের বাধা যদি আরও দুর্গম হত তা হলে একদল মানুষ একটি অজ্ঞাত নিভৃত

বেষ্টনের মধ্যে স্থির শান্তভাবে একপ্রকার সংকীর্ণ পরিপূর্ণতা-লাভের অবসর পেত। পৃথিবীর সংবাদ তারা বড়ো একটা জানতে পেত না এবং ভূগোলবিবরণ সম্বন্ধে তাদের নিতান্ত অসম্পূর্ণ ধারণা থাকত; তাদের বিজ্ঞানশাস্ত্র বিচিত্র কল্পনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত, কোন্‌টা সত্য কোন্‌টা মিথ্যা বৃহৎ জগৎ থেকে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যেত না; কেবল তাদের কাব্য, তাদের সমাজতন্ত্র, তাদের ধর্মশাস্ত্র, তাদের দর্শনতত্ত্ব অপূর্ব শোভা সুষমা এবং সম্পূর্ণতা লাভ করতে পেত; তারা যেন পৃথিবী-ছাড়া আর-একটি ছোটো গ্রহের মধ্যে বাস করত; তাদের ইতিহাস, তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান সুখ সম্পদ তাদের মধ্যেই পর্যাপ্ত থাকত। সমুদ্রের এক অংশ কালক্রমে মৃত্তিকাস্তরে রুদ্ধ হয়ে যেমন একটি নিভৃত শান্তিময় সুন্দর হ্রদের সৃষ্টি হয়, সে কেবল নিস্তরঙ্গভাবে প্রভাত সন্ধ্যার বিচিত্র বর্ণচ্ছায়ায় প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে, এবং অন্ধকার রাত্রে স্তিমিত নক্ষত্রালোকে স্তম্ভিতভাবে চিররহস্যের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকে।

 কালের বেগবান প্রবাহে, পরিবর্তন-কোলাহলের কেন্দ্রস্থলে, প্রকৃতির সহস্র শক্তির রণরঙ্গভূমির মাঝখানে সংক্ষুব্ধ হয়ে খুব একটা শক্তরকম শিক্ষা এবং সভ্যতা লাভ হয় সত্য বটে, কিন্তু নির্জনতা নিস্তব্ধতা গভীরতার মধ্যে অবতরণ করে যে কোনো রত্ন সঞ্চয় করা যায় না তা কেমন করে বলব!

 এই মধ্যমান সংসারসমুদ্রের মধ্যে সেই নিস্তব্ধতার অবসর কোনো জাতিই পায় নি; মনে হয় কেবল ভারতবর্ষই এক কালে দৈবক্রমে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে সেই বিচ্ছিন্নতা লাভ করেছিল এবং অতলস্পর্শের মধ্যে অবগাহন করেছিল। জগৎ যেমন অসীম, মানবের আত্মাও তেমনি অসীম; যাঁরা সেই অনাবিষ্কৃত অন্তর্দেশের পথ অনুসন্ধান করেছিলেন তাঁরা-যে কোনো নূতন সত্য এবং

কোনো নূতন আনন্দ লাভ করেন নি তা নিতান্ত অবিশ্বাসীর কথা।

 ভারতবর্ষ তখন একটি রুদ্ধদ্বার নির্জন রহস্যময় পরীক্ষাকক্ষের মতো ছিল―তার মধ্যে এক অপরূপ মানসিক সভ্যতার গোপন পরীক্ষা চলছিল। য়ুরোপের মধ্যযুগে যেমন আল্‌কেমিতত্ত্বান্বেষীরা গোপন গৃহে নিহিত থেকে বিবিধ অদ্ভুত যন্ত্রতন্ত্রযোগে চিরজীবনরস (elixir of life) আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের জ্ঞানীরাও সেইরূপ গোপন সতর্কতা সহকারে আধ্যাত্মিক চিরজীবনলাভের উপায় অন্বেষণ করেছিলেন। তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’, এবং অত্যন্ত দুঃসাধ্য উপায়ে অন্তরের মধ্যে সেই অমৃতরসের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

 তার থেকে কী হতে পারত কে জানে! আল্‌কেমি থেকে যেমন ব্যবহারিক কেমিস্ট্রির উৎপত্তি হয়েছে তেমনি তাঁদের সেই তপস্যা থেকে মানবের কী-এক নিগূঢ় নূতন শক্তির আবিষ্কার হতে পারত তা এখন কে বলতে পারে!

 কিন্তু হঠাৎ দ্বার ভগ্ন করে বাহিরের দুর্দান্ত লোক ভারতবর্ষের সেই পবিত্র পরীক্ষাশালার মধ্যে বলপূর্বক প্রবেশ করলে এবং সেই অন্বেষণের পরিণামফল সাধারণের অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। এখনকার নবীন দুরন্ত সভ্যতার মধ্যে এই পরীক্ষার তেমন প্রশান্ত অবসর আর কখনো পাওয়া যাবে কি না কে জানে!

 পৃথিবীর লোক সেই পরীক্ষাগারের মধ্যে প্রবেশ করে কী দেখলে! একটি জীর্ণ তপস্বী; বসন নেই, ভূষণ নেই, দেহে বল নেই, পৃথিবীর ইতিহাস সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নির্জন আশ্রমের মধ্যে যে ব্যক্তি আপন অন্তরের তেজে তেজস্বী বাহিরে সে কী দরিদ্র, কী দুর্বল! এই-সমস্ত বলিষ্ঠ কর্মপটু উৎসাহী

ধনসম্পদ্‌শালী নবযুবকদের মধ্যে এসে আজ তার কী দুর্দশা, কী লজ্জা! সহসা দেখলে সে কী নিরুপায়, নিঃসহায়; বহুকাল মনোযোগ না দেওয়াতে পৃথিবীর বৈষয়িক বিষয়ে ক্রমে তার অধিকার কত হ্রাস হয়ে গেছে। সে যে কথা বলতে চায় এখনো তার কোনো প্রতীতিগম্য ভাষা নেই, প্রত্যক্ষগম্য প্রমাণ নেই, আয়ত্তগম্য পরিণাম নেই।

 অতএব, হে বৃদ্ধ, হে চিন্তাতুর, হে উদাসীন, তুমি ওঠো―পোলিটিকাল অ্যাজিটেশন করো অথবা দিবাশয্যায় পড়ে পড়ে আপনার পুরাতন যৌবনকালের প্রতাপ ঘোষণা-পূর্বক জীর্ণ অস্থি আস্ফালন করো। দেখো, তাতে তোমার লজ্জা নিবারণ হয় কি না।

 কিন্তু আমার ওতে প্রবৃত্তি হয় না। কেবলমাত্র খবরের কাগজের পাল উড়িয়ে এই দুস্তর সংসারসমুদ্রে যাত্রা আরম্ভ করতে আমার সাহস হয় না। যখন মৃদু মৃদু অনুকূল বাতাস দেয় তখন এই কাগজের পাল গর্বে স্ফীত হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু কখন সমুদ্র থেকে ঝড় আসবে এবং দুর্বল দম্ভ শতধা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

 এমন যদি হ’ত―নিকটে কোথাও উন্নতি-নামক একটা পাকা বন্দর আছে সেইখানে কোনোমতে পৌঁছলেই তার পরে দখি এবং পিষ্টক, দীয়তাং এবং ভুজ্যতাং, তা হলেও বরং একবার সময় বুঝে আকাশের ভাবগতিক দেখে অত্যন্ত চতুরতা-সহকারে পার হবার চেষ্টা করা যেত। কিন্তু যখন জানি উন্নতিপথে যাত্রার আর শেষ নেই, কোথাও নৌকা বেঁধে নিদ্রা দেবার স্থান নেই, ঊর্ধ্বে কেবল ধ্রুবতারা দীপ্তি পাচ্ছে এবং সম্মুখে কেবল তটহীন সমুদ্র, বায়ু অনেক সময়েই প্রতিকূল এবং তরঙ্গ সর্বদাই প্রবল, তখন কি বসে বলে কেবল ফুল্‌স্ক্যাপ কাগজের নৌকা নির্মাণ করতে প্রবৃত্তি হয়?

 অথচ তরী ভাসাবার ইচ্ছা আছে। যখন দেখি মানবস্রোত চলেছে―চতুর্দিকে বিচিত্র কল্লোল, উদ্দাম বেগ, প্রবল গতি, অবিশ্রাম কর্ম, তখন আমারও মন নেচে ওঠে; তখন ইচ্ছা করে বহু বৎসরের গৃহবন্ধন ছিন্ন করে একেবারে বাহির হয়ে পড়ি। কিন্তু তার পরেই রিক্ত হস্তের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি পাথেয় কোথায়? হৃদয়ে সে অসীম আশা, জীবনে সে অশ্রান্ত বল, বিশ্বাসের সে অপ্রতিহত প্রভাব, সে নিষ্ঠা, সে সত্যপ্রিয়তা, মিথ্যার প্রতি সে বিজাতীয় ঘৃণা কোথায়! অবশেষে হবে এই―গৃহও ছাড়ব, পথে চলবারও শক্তি থাকবে না। তার চেয়ে পৃথিবীপ্রান্তে এই অজ্ঞাতবাসই ভালো, এই ক্ষুদ্র সন্তোষ এবং নির্জীব শান্তিই আমাদের যথালাভ।

 তখন বসে বসে মনকে এই বলে বোঝাই যে, আমরা যন্ত্র তৈরি করতে পারি নে, জগতের সমস্ত নিগূঢ় সংবাদ আবিষ্কার করতে পারি নে, কিন্তু ভালোবাসতে পারি, ক্ষমা করতে পারি, পরস্পরের জন্যে স্থান ছেড়ে দিতে পারি। অপেক্ষা করে দেখা যাক পৃথিবীর এই আধুনিক নবসভ্যতা কবে আমাদের কোমলতা দেখে আমাদের ভালোবাসবে, কবে আমাদের দুর্বলতা দেখে অবজ্ঞা করবে না, কবে তাদের উন্নতিযৌবনের প্রখর বলাভিমান এবং জ্ঞানাভিমান কালক্রমে নম্র হয়ে আসবে এবং আমাদের স্নেহশীলতা দেখে আমাদের প্রতি স্নেহ করবে, আমাদের প্রেমপরায়ণ হৃদয়ের প্রভাবে মানবপরিবারের মধ্যে একটুখানি সমাদরের স্থান লাভ করতে পারব।

 গোরাদের মোটা মোটা মুষ্টি, প্রচণ্ড দাপট এবং নিষ্ঠুর অসহিষ্ণুতা দেখে আপাতত সে দিন কল্পনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আচ্ছা নাহয় তাই হল; দুঃসাধ্য দুরাশা নিয়ে অস্থির হয়ে বেড়াবার আবশ্যক কী! নাহয় এক পাশেই পড়ে রইলুম, টাইম্‌সের জগৎপ্রকাশক স্তম্ভে আমাদের নাম নাহয় নাই উঠল; আপনা-আপনি ভালোবেসেই কি যথেষ্ট সুখ পাব না?

 কিন্তু দুঃখ আছে, দারিদ্র্য আছে, প্রবলের অত্যাচার আছে, অসহায়ের ভাগ্যে অপমান আছে, কোণে বসে কেবল গৃহকর্ম এবং আতিথ্য করে তার কী প্রতিকার করবে?

 হায়, সেই তো ভারতবর্ষের দুঃসহ দুঃখ! আমরা কার সঙ্গে যুদ্ধ করব? রূঢ় মানবপ্রকৃতির চিরন্তন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। যিশু খৃস্টের পবিত্র শোণিতস্রোত যে অনুর্বর কাঠিন্যকে আজও কোমল করতে পারে নি সেই পাষাণের সঙ্গে! প্রবলতা চিরদিন দুর্বলতার প্রতি নির্মম, আমরা সেই আদিম পশুপ্রকৃতিকে কী করে জয় করব? সভা ক’রে? দরখাস্ত ক’রে? আজ একটু ভিক্ষা পেয়ে কাল একটা তাড়া খেয়ে? তা কখনোই হবে না।

 তবে, প্রবলের সমান প্রবল হয়ে? তা হতে পারে বটে। কিন্তু যখন ভেবে দেখি য়ুরোপ কতখানি প্রবল, কত দিকে প্রবল, কত কারণে প্রবল―যখন এই দুর্দান্ত শক্তিকে একবার কায়মনে সর্বতোভাবে অনুভব করে দেখি, তখন কি আর আশা হয়। তখন মনে হয়, এসো ভাই, সহিষ্ণু হয়ে থাকি এবং ভালোবাসি। পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যসত্যই করি, ভাণ না করি। অক্ষমতার প্রধান বিপদ এই যে, সে বৃহৎ কাজ করতে পারে না বলে বৃহৎ ভাণকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে, মনুষ্যত্বলাভের পক্ষে বড়ো মিথ্যার চেয়ে ছোটো সত্য ঢের বেশি মূল্যবান।

 কিন্তু উপদেশ দেওয়া আমার অভিপ্রায় নয়। প্রকৃত অবস্থাটা কী তাই আমি দেখতে চেষ্টা করছি। তা দেখতে গেলে যে পুরাতন বেদ পুরাণ সংহিতা খুলে বসে নিজের মনের মতো শ্লোক সংগ্রহ করে একটা কাল্পনিক বর্তমান রচনা করতে হবে তা নয়, কিম্বা অন্য জাতির প্রকৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনাযোগে আপনাদের বিলীন করে দিয়ে আমাদের নবশিক্ষার ক্ষীণভিত্তির উপর প্রকাণ্ড দুরাশার দুর্গ নির্মাণ করতে হবে তাও নয়; দেখতে হবে এখন আমরা কোথায় আছি। আমরা যেখানে অবস্থান করছি এখানে পূর্ব দিক থেকে অতীতের এবং পশ্চিম দিক থেকে ভবিষ্যতের মরীচিকা এসে পড়েছে। সে দুটোকেই সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য সত্যস্বরূপে জ্ঞান না করে একবার দেখা যাক আমরা যথার্থ কোন্ মৃত্তিকার উপরে দাঁড়িয়ে আছি।

 আমরা একটি অত্যন্ত জীর্ণ প্রাচীন নগরে বাস করি। এত প্রাচীন যে, এখানকার ইতিহাস লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে; মনুষের হস্তলিখিত স্মরণচিহ্নগুলি শৈবালে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে; সেইজন্যে ভ্রম হচ্ছে যেন এ নগর মানব-ইতিহাসের অতীত, এ যেন অনাদি প্রকৃতির এক প্রাচীন রাজধানী। মানবপুরাবৃত্তের রেখা লুপ্ত করে দিয়ে প্রকৃতি আপন শ্যামল অক্ষর এর সর্বাঙ্গে বিচিত্র আকারে সজ্জিত করেছে। এখানে সহস্র বৎসরের বর্ষা আপন অশ্রুচিহ্নরেখা রেখে গিয়েছে এবং সহস্র বৎসরের বসন্ত এর প্রত্যেক ভিত্তিছিদ্রে আপন যাতায়াতের তারিখ হরিদ্‌বর্ণ অঙ্কে অঙ্কিত করেছে। এক দিক থেকে এ’কে নগর বলা যেতে পারে, এক দিক থেকে এ’কে অরণ্য বলা যায়। এখানে কেবল ছায়া এবং বিশ্রাম, চিন্তা এবং বিষাদ বাস করতে পারে। এখানকার ঝিল্লিমুখরিত অরণ্য-মর্মরের মধ্যে, এখানকার বিচিত্রভঙ্গী জটাভারগ্রস্ত শাখা প্রশাখা ও রহস্যময় পুরাতন অট্টালিকা-ভিত্তির মধ্যে শতসহস্র ছায়াকে কায়াময়ী ও কায়াকে মায়াময়ী বলে ভ্রম হয়। এখানকার এই সনাতন মহাছায়ার মধ্যে সত্য এবং কল্পনা ভাই বোনের মতো নির্বিরোধে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ প্রকৃতির বিশ্বকার্য এবং মানবের মানসিক সৃষ্টি পরস্পর জড়িত বিজড়িত হয়ে নানা আকারের ছায়াকুঞ্জ নির্মাণ করেছে। এখানে ছেলেমেয়েরা সারাদিন খেলা করে কিন্তু জানে না তা খেলা, এবং বয়স্ক লোকেরা নিশিদিন স্বপ্ন দেখে কিন্তু মনে করে তা কর্ম। জগতের মধ্যাহ্নসূর্যালোক ছিদ্রপথে প্রবেশ করে কেবল ছোটো ছোটো মানিকের মতো দেখায়, প্রবল ঝড় শত শত সংকীর্ণ শাখাসংকটের মধ্যে প্রতিহত হয়ে মৃদু মর্মরের মতো মিলিয়ে আসে। এখানে জীবন ও মৃত্যু, সুখ ও দুঃখ, আশা ও নৈরাশ্যের সীমাচিহ্ন লুপ্ত হয়ে এসেছে; অদৃষ্টবাদ এবং কর্মকাণ্ড, বৈরাগ্য এবং সংসারযাত্রা এক সঙ্গেই ধাবিত হয়েছে। আবশ্যক এবং অনাবশ্যক, ব্রহ্ম এবং মৃৎপুত্তল, ছিন্নমূল শুষ্ক অতীত এবং উদ্ভিন্নকিশলয় জীবন্ত বর্তমান সমান সমাদর লাভ করেছে। শাস্ত্র যেখানে পড়ে আছে সেইখানে পড়েই আছে এবং শাস্ত্রকে আচ্ছন্ন করে যেখানে সহস্র প্রথাকীটের প্রাচীন বল্মীক উঠেছে সেখানেও কেহ অলস ভক্তিভরে হস্তক্ষেপ করে না। গ্রন্থের অক্ষর এবং গ্রন্থকীটের ছিদ্র দুই এখানে সমান সম্মানের শাস্ত্র। এখানকার অশ্বত্থবিদীর্ণ ভগ্ন মন্দিরের মধ্যে দেবতা এবং উপদেবতা একত্রে আশ্রয় গ্রহণ করে বিরাজ করছে।

 এখানে কি তোমাদের জগৎযুদ্ধের সৈন্যশিবির স্থাপন করবার স্থান! এখানকার জন্মভিত্তি কি তোমাদের কল-কারখানা তোমাদের অগ্নিশ্বসিত সহস্রবাহু লৌহদানবদের কারাগার নির্মাণের যোগ্য! তোমাদের অস্থির উদ্যমের বেগে এর প্রাচীন ইষ্টকগুলিকে ভূমিসাৎ করে দিতে পারে বটে, কিন্তু তার পরে পৃথিবীর এই অতিপ্রাচীন শয্যাশায়ী জাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! এই নিশ্চেষ্টনিবিড় মহা নগরারণ্য ভেঙে গেলে সহস্র মৃতবৎসরের যে-একটি বৃদ্ধ ব্রহ্মদৈত্য এখানে চিরনিভৃত আবাস গ্রহণ করেছিল সেও যে সহসা নিরাশ্রয় হয়ে পড়বে!

 এরা বহুদিন স্বহস্তে গৃহনির্মাণ করে নি, সে অভ্যাস এদের নেই, এদের সমধিকচিন্তাশীলগণের সেই এক মহৎ গর্ব। তারা যে কথা নিয়ে লেখনীপুচ্ছ আস্ফালন করে সে কথা অতি সত্য, তার প্রতিবাদ করা কারও সাধ্য নয়। বাস্তবিকই অতি প্রাচীন আদিপুরুষের বাস্তুভিত্তি এদের কখনো ছাড়তে হয় নি। কালক্রমে অনেক অবস্থাবৈসাদৃশ্য অনেক নূতন সুবিধা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সবগুলিকে টেনে নিয়ে মৃতকে এবং জীবিতকে, সুবিধাকে এবং অসুবিধাকে, প্রাণপণে সেই পিতামহ-প্রতিষ্ঠিত এক ভিত্তির মধ্যে ভুক্ত করা হয়েছে। অসুবিধার খাতিরে এরা কখনো স্পর্ধিতভাবে স্বহস্তে নূতন গৃহ নির্মাণ বা পুরাতন গৃহ সংস্কার করেছে এমন গ্লানি এদের শত্রুপক্ষের মুখেও শোনা যায় না। যেখানে গৃহছাদের মধ্যে ছিদ্র প্রকাশ পেয়েছে সেখানে অযত্নসম্ভূত বটের শাখা কদাচিৎ ছায়া দিয়েছে, কালসঞ্চিত মৃত্তিকাস্তরে কথঞ্চিৎ ছিদ্ররোধ করেছে।

 এই বনলক্ষ্মীহীন ঘন বনে, এই পুরলক্ষ্মীহীন ভগ্ন পুরীর মধ্যে আমরা ধুতিটি চাদরটি প’রে অত্যন্ত মৃদুমন্দভাবে বিচরণ করি, আহারান্তে কিঞ্চিৎ নিদ্রা দিই, ছায়ায় বসে তাস পাশা খেলি, যা-কিছু অসম্ভব এবং সাংসারিক কাজের বাহির তাকেই তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করতে ভালোবাসি, যা-কিছু কার্যোপযোগী এবং দৃষ্টিগোচর তার প্রতি মনের অবিশ্বাস কিছুতে সম্যক দূর হয় না, এবং এরই উপর কোনো ছেলে যদি শিকিমাত্রা চাঞ্চল্য প্রকাশ করে তা হলে আমরা সকলে মিলে মাথা নেড়ে বলি: সর্বমত্যন্তং গর্হিতং।

 এমন সময় তোমরা কোথা থেকে হঠাৎ এসে আমাদের জীর্ণ পঞ্জরে গোটা দুই-তিন প্রবল খোঁচা দিয়ে বলছ, ‘ওঠো ওঠো― তোমাদের শয়নশালায় আমরা আপিস স্থাপন করতে চাই। তোমরা ঘুমচ্ছিলে বলে যে সমস্ত সংসার ঘুমচ্ছিল তা নয়। ইতিমধ্যে জগতের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ঐ ঘণ্টা বাজছে―এখন পৃথিবীর মধ্যাহ্নকাল, এখন কর্মের সময়।’

 তাই শুনে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ধড়্‌ফড়্‌ করে উঠে ‘কোথায় কর্ম’ ‘কোথায় কর্ম’ করে গৃহের চার কোণে ব্যস্ত হয়ে বেড়াচ্ছে, এবং ওরই মধ্যে যারা কিঞ্চিৎ স্থূলকায় স্ফীতস্বভাবের লোক তারা পাশ-মোড়া দিয়ে বলছে, ‘কে হে! কর্মের কথা কে বলে! তা, আমরা কি কর্মের লোক নই বলতে চাও! ভারী ভ্রম! ভারতবর্ষ ছাড়া কর্মস্থান কোথাও নেই। দেখো-না কেন, মানবইতিহাসের প্রথম যুগে এইখানেই আর্যবর্বরের যুদ্ধ হয়ে গেছে; এইখানেই কত রাজ্যপত্তন, কত নীতিধর্মের অভ্যুদয়, কত সভ্যতার সংগ্রাম হয়ে গেছে! অতএব কেবলমাত্র আমরাই কর্মের লোক! অতএব আমাদের আর কর্ম করতে বোলো না। যদি অবিশ্বাস হয় তবে তোমরা বরং এক কাজ করো―তোমাদের তীক্ষ্ণ ঐতিহাসিক কোদালখানা দিয়ে ভারতভূমির যুগসঞ্চিত বিস্মৃতিস্তর উঠিয়ে দেখো মানবসভ্যতার ভিত্তিতে কোথায় কোথায় আমাদের হস্তচিহ্ন আছে। আমরা ততক্ষণ অমনি আর-একবার ঘুমিয়ে নিই।’

 এই রকম করে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্ধ-অচেতন জড় মূঢ় দাম্ভিক ভাবে, ঈষৎ উন্মীলিত নিদ্রাকষায়িত নেত্রে, আলস্যবিজড়িত অস্পষ্টরুষ্ট হুঙ্কারে জগতের দিবালোকের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করছে; এবং কেউ কেউ গভীর আত্মগ্লানি-সহকারে শিথিলস্নায়ু অসাড় উদ্যমকে ভূয়োভূয় আঘাতের দ্বারা জাগ্রত করবার চেষ্টা করছে। এবং যারা জাগ্রতস্বপ্নের লোক, যারা কর্ম ও চিন্তার মধ্যে অস্থিরচিত্তে দোদুল্যমান, যারা পুরাতনের জীর্ণতা দেখতে পায় এবং নূতনের অসম্পূর্ণতা অনুভব করে, সেই হতভাগ্যেরা বারম্বার মুণ্ড আন্দোলন করে বলছে―

 ‘হে নূতন লোকেরা, তোমরা যে নূতন কাণ্ড করতে আরম্ভ করে দিয়েছ, এখনো তো তার শেষ হয় নি, এখনো তো তার সমস্ত সত্য মিথ্যা স্থির হয় নি, মানব-অদৃষ্টের চিরন্তন সমস্যার তো কোনোটারই মীমাংসা হয় নি।

 ‘তোমরা অনেক জেনেছ, অনেক পেয়েছ, কিন্তু সুখ পেয়েছ কি? আমরা যে বিশ্বসংসারকে মায়া বলে বসে আছি এবং তোমরা যে এ’কে ধ্রুব সত্য বলে খেটে মরছ, তোমরা কি আমাদের চেয়ে বেশি সুখী হয়েছ? তোমরা যে নিত্য নূতন অভাব আবিষ্কার করে দরিদ্রের দারিদ্র্য উত্তরোত্তর বাড়চ্ছ, গৃহের স্বাস্থ্যজনক আশ্রয় থেকে অবিশ্রাম কর্মের উত্তেজনায় টেনে নিয়ে যাচ্ছ, কর্মকেই সমস্ত জীবনের কর্তা করে উন্মাদনাকে বিশ্রামের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছ, তোমরা কি স্পষ্ট জান তোমাদের উন্নতি তোমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

 ‘আমরা সম্পূর্ণ জানি আমরা কোথায় এসেছি। আমরা গৃহের মধ্যে অল্প অভাব এবং গাঢ় স্নেহ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে নিত্যনৈমিত্তিক ক্ষুদ্র নিকটকর্তব্যসকল পালন করে যাচ্ছি। আমাদের যতটুকু সুখসমৃদ্ধি আছে ধনী দরিদ্রে, দূর ও নিকট-সম্পর্কীয়ে, অতিথি অনুচর ও ভিক্ষুকে মিলে ভাগ করে নিয়েছি। যথাসম্ভব লোক যথাসম্ভবমত সুখে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি, কেউ কাউকে ত্যাগ করতে চায় না এবং জীবনঝঞ্ঝার তাড়নায় কেউ কাউকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয় না।

 ‘ভারতবর্ষ সুখ চায় নি, সন্তোষ চেয়েছিল, তা পেয়েছে এবং সর্বতোভাবে সর্বত্র তার প্রতিষ্ঠা স্থাপন করেছে। এখন আর তার কিছু করবার নেই। সে বরঞ্চ তার বিশ্রামকক্ষে বসে তোমাদের উন্মাদ জীবন-উৎপ্লব দেখে তোমাদের সভ্যতার চরম সফলতা সম্বন্ধে মনে মনে সংশয় অনুভব করতে পারে। মনে করতে পারে, কালক্রমে অবশেষে তোমাদের যখন একদিন কাজ বন্ধ করতে হবে তখন কি এমন ধীরে এমন সহজে এমন বিশ্রামের মধ্যে অবতরণ করতে পারবে? আমাদের মতো এমন কোমল এমন সহৃদয় পরিণতি লাভ করতে পারবে কি? উদ্দেশ্য যেমন ক্রমে ক্রমে লক্ষ্যের মধ্যে নিঃশেষিত হয়, উত্তপ্ত দিন যেমন সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে অবগাহন করে, সেই রকম মধুর সমাপ্তি লাভ করতে পারবে কি? না, কল যে রকম হঠাৎ বিগড়ে যায়, উত্তরোত্তর অতিরিক্ত বাষ্প ও তাপ সঞ্চয় করে এঞ্জিন যে রকম সহসা ফেটে যায়, একপথবর্তী দুই বিপরীতমুখী রেলগাড়ি পরস্পরের সংঘাতে যেমন অকস্মাৎ বিপর্যস্ত হয়, সেই রকম প্রবল বেগে একটা নিদারুণ অপঘাত-সমাপ্তি প্রাপ্ত হবে?

 ‘যাই হোক, তোমরা এখন অপরিচিত সমুদ্রে অনাবিষ্কৃত তটের সন্ধানে চলেছ, অতএব তোমাদের পথে তোমরা যাও, আমাদের গৃহে আমরা থাকি এই কথাই ভালো।’

 কিন্তু মানুষে থাকতে দেয় কই? তুমি যখন বিশ্রাম করতে চাও, পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যে তখন অশ্রান্ত। গৃহস্থ যখন নিদ্রায় কাতর, গৃহছাড়ারা যে তখন নানা ভাবে পথে পথে বিচরণ করছে।

 তা ছাড়া এটা স্মরণ রাখা কর্তব্য পৃথিবীতে যেখানে এসে তুমি থামবে সেইখান হতেই তোমার ধ্বংস আরম্ভ হবে। কারণ, তুমিই কেবল একলা থামবে, আর কেউ থামবে না। জগৎপ্রবাহের সঙ্গে সমগতিতে যদি না চলতে পারো তো প্রবাহের সময় সচল বেগ তোমার উপর এসে আঘাত করবে―একেবারে বিদীর্ণ বিপর্যস্ত হবে কিম্বা অল্পে অল্পে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কালস্রোতের তলদেশে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। হয় অবিশ্রাম চলো এবং জীবনচর্চা করো, নয় বিশ্রাম করো এবং বিলুপ্ত হও―পৃথিবীর এই রকম নিয়ম।

 অতএব আমরা যে জগতের মধ্যে লুপ্তপ্রায় হয়ে আছি তাতে কারও কিছু বলার নেই। তবে, সে সম্বন্ধে যখন বিলাপ করি তখন এই রকম ভাবে করি যে―পূর্বে যে নিয়মের উল্লেখ করা হল সেটা সাধারণতঃ খাটে বটে, কিন্তু আমরা ওরই মধ্যে এমন একটু সুযোগ করে নিয়েছিলুম যে আমাদের সম্বন্ধে অনেক দিন খাটে নি। যেমন, মোটের উপরে বলা যায় জরামৃত্যু জগতের নিয়ম, কিন্তু আমাদের যোগীরা জীবনীশক্তিকে নিরুদ্ধ করে মৃতবৎ হয়ে বেঁচে থাকবার এক উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। সমাধি-অবস্থায় তাঁদের যেমন বৃদ্ধি ছিল না, তেমনি হ্রাসও ছিল না। জীবনের গতিরোধ করলেই মৃত্যু আসে, কিন্তু জীবনের গতিকে রুদ্ধ করেই তাঁরা চিরজীবন লাভ করতেন।

 আমাদের জাতি সম্বন্ধেও সেই কথা অনেকটা খাটে। জাতি যে কারণে মরে আমাদের জাতি সেই কারণকে উপায়স্বরূপ করে দীর্ঘজীবনের পথ আবিষ্কার করেছিলেন। আকাঙ্ক্ষার আবেগ যখন হ্রাস হয়ে যায়, শ্রান্ত উদ্যম যখন শিথিল হয়ে আসে, তখন জাতি বিনাশপ্রাপ্ত হয়। আমরা বহু যত্নে দুরাকাঙ্ক্ষাকে ক্ষীণ ও উদ্যমকে জড়ীভূত করে দিয়ে সমভাবে পরমায়ু রক্ষা করবার উদ্যোগ করেছিলুম।

 মনে হয় যেন কতকটা ফললাভও হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা যেখানে আপনি থেমে আসে সময়কেও কৌশলপূর্বক সেইখানে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবী থেকে জীবনকে অনেকটা পরিমাণে নির্বাসিত ক’রে এমন একটা মধ্য-আকাশে তুলে রাখা গিয়েছিল যেখানে পৃথিবীর ধুলো বড়ো পৌঁছত না; সর্বদাই সে নির্লিপ্ত, নির্মল, নিরাপদ থাকত।

 কিন্তু, একটা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে, কিছুকাল হল নিকটবর্তী কোন্‌-এক অরণ্য থেকে এক দীর্ঘজীবী যোগমগ্ন যোগীকে কলিকাতায় আনা হয়েছিল। এখানে বহু উপদ্রবে তার সমাধি ভঙ্গ করাতে তার মৃত্যু হয়। আমাদের জাতীয় যোগনিদ্রাও তেমনি বাহিরের লোক বহু উপদ্রবে ভেঙে দিয়েছে। এখন অন্যান্য জাতির সঙ্গে তার আর কোনো প্রভেদ নেই, কেবল প্রভেদের মধ্যে এই যে―বহুদিন বহির্বিষয়ে নিরুদ্যম থেকে জীবনচেষ্টায় সে অনভ্যস্ত হয়ে গেছে। যোগের মধ্যে থেকে একেবারে গোলযোগের মধ্যে এসে পড়েছে।

 কিন্তু কী করা যাবে! এখন উপস্থিতমত সাধারণ নিয়মে প্রচলিত প্রথায় আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘজটা ও নখ কেটে ফেলে নিয়মিত স্নানাহার-পূর্বক কথঞ্চিৎ বেশভূষা করে হস্তপদচালনায় প্রবৃত্ত হতে হবে।

 কিন্তু সম্প্রতি ব্যাপারটা এই রকম হয়েছে যে, আমরা জটা নখ কেটে ফেলেছি বটে, সংসারের মধ্যে প্রবেশ করে সমাজের লোকের সঙ্গে মিশতেও আরম্ভ করেছি, কিন্তু মনের ভাবের পরিবর্তন করতে পারি নি। এখনো আমরা বলি, আমাদের পিতৃপুরুষেরা শুদ্ধমাত্র হরীতকী সেবন ক’রে নগ্নদেহে মহত্ত্ব লাভ করেছিলেন, অতএব আমাদের কাছে বেশভূষা আহারবিহার চাল-চলনের এত সমাদর কেন? এই বলে আমরা ধুতির কোঁচাটা বিস্তারপূর্বক পিঠের উপর তুলে দিয়ে দ্বারের সম্মুখে বসে কর্মক্ষেত্রের প্রতি অলস অনাসক্ত দৃষ্টিপাত-পূর্বক বায়ু সেবন করি।

 এটা আমাদের স্মরণ নেই যে, যোগাসনে যা পরম সম্মানার্হ সমাজের মধ্যে তা কদর্য বর্বরতা। প্রাণ না থাকলে দেহ যেমন অপবিত্র, ভাব না থাকলে বাহ্যানুষ্ঠানও তদ্রূপ। সম্প্রতি আমাদের সমাজে তার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। একটা উল্লেখ করি।

 আজকাল কী একটা হাওয়া পড়বামাত্রই-যে সহসা চতুর্দিকে সন্ধা টিকি ও মোটা ফোঁটার প্রাদুর্ভাব হয়েছে তাতে আমার বেশি কিছু বলবার নেই। দেখেছি বটে, যাদের বহুকালের বনেদি টিকি তাদের শিখা বিনীত হ্রস্বতা অবলম্বন করে মস্তকের পশ্চাতে অনেকটা আত্মগোপন করে থাকে, কিন্তু বর্তমান কালের হঠাৎ টিকিগুলি দেখতে দেখতে অসম্ভব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পরম স্পর্ধাভরে দোদুল্যমান হতে থাকে। আশঙ্কা আছে, আবার কোন্‌দিন এইসকল চিন্তাশীল মস্তকের পশ্চাদ্দেশে সহসা টিকির মড়ক উপস্থিত হবে, তখন এই দম্ভদোলকগুলির চিহ্নমাত্র দেখা যাবে না।

 কিন্তু কেবলমাত্র একগুচ্ছ কেশসমষ্টির উপর এত কথা সয় না, এবং তার পক্ষে বা বিরুদ্ধে কোনো রকম নিগূঢ় ব্যাখ্যাও আমার মনে উদয় হয় নি।

 আমার বক্তব্য কেবল এই যে, এই নবাঙ্কুরিত টিকির সঙ্গে সঙ্গে যে-একটা মনের ভাব পরিপুষ্টি প্রাপ্ত হচ্ছে সেটা বর্তমানের প্রকৃতির সঙ্গে সুসংগত নয়। একে ছোঁব না, ওর সঙ্গে খাব না, অমুক ম্লেচ্ছ —তপোরনের বাহিরে এমন করে কাজ চলে না।

 তোমার আমার মতো লোক যারা তপস্যাও করি নে, হবিষ্যও খাই নে, জুতোমোজা প’রে ট্রামে চ’ড়ে পান চিবতে চিবতে নিয়মিত আপিসে ইস্কুলে যাই, যাদের আদ্যোপান্ত তন্ন তন্ন করে দেখে কিছুতেই প্রতীতি হয় না এরা দ্বিতীয় যাজ্ঞবল্ক্য বশিষ্ঠ গৌতম জরৎকারু বৈশম্পায়ন কিম্বা ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন—ছাত্রবৃন্দ, যাদের বালখিল্য তপস্বী ব’লে এ পর্যন্ত কারও ভ্রম হয় নি—একদিন তিন সন্ধ্যা স্নান করে একটা হরীতকী মুখে দিলে যাদের তার পরে একাদিক্রমে কিছুকাল আপিস কিম্বা কালেজ কামাই করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে― তাদের পক্ষে এ রকম ব্রহ্মচর্যের বাহ্যাড়ম্বর করা, পৃথিবীর অধিকাংশ যােগ্যতর মান্যজাতীয়ের প্রতি খর্ব নাসিকা সীট্‌কার করা কেবলমাত্র যে অদ্ভুত, অসংগত, হাস্যকর তা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ ক্ষতিজনক।

 বিশেষ কাজের বিশের ব্যৱস্থা আছে। পালােয়ান লেংটি প’রে মাটি মেখে ছাতি ফুলিয়ে চলে বেড়ায়, রাস্তার লােক বাহবা বাহবা করে— তার ছেলেটি নিতান্ত কাহিল এবং বেচারা, এবং এণ্ট্রেন্স্ পর্যন্ত পড়ে আজ পাঁচ বৎসর বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট আপিসের অ্যাপ্রেণ্টিস; সেও যদি লেংটি পরে, ধুলাে মাখে এবং উঠতে-বসতে তাল ঠোকে এবং ভদ্রলােক কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে ‘আমার বাবা পালােয়ান’, তবে অন্য লােকের যেমনি আমােদ বােধ হােক আত্মীয় বন্ধুরা তার জন্য সবিশেষ উদ্‌বিগ্ন না হয়ে থাকতে পারে না। অতএব হয় সত্যই তপস্যা করো, নয় তপস্যার আড়ম্বর ছাড়াে।

 পুরাকালে ব্রাহ্মণেরা একটি বিশেষ সম্প্রদায় ছিলেন, তাঁদের প্রতি একটি বিশেষ কার্যভার ছিল। সেই কার্যের বিশেষ উপযোগী হবার জন্য তাঁরা আপনাদের চারি দিকে কতগুলি আচরণঅনুষ্ঠানের সীমারেখা অঙ্কিত করেছিলেন। অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তাঁরা আপনার চিত্তকে সেই সীমার বাহিরে বিক্ষিপ্ত হতে দিতেন না। সকল কাজেই এইরূপ একটা উপযোগী সীমা আছে যা অন্য কাজের পক্ষে বাধা মাত্র। ময়রার দোকানের মধ্যে অ্যাটর্নি নিজের ব্যবসায় চালাতে গেলে সহস্র বিঘ্নের দ্বারা প্রতিহত না হয়ে থাকতে পারেন না এবং ভূতপূর্ব অ্যাটর্নির আপিসে যদি বিশেষ-কারণবশতঃ ময়রার দোকান খুলতে হয় তা হলে কি চৌকি টেবিল কাগজ পত্র এবং স্তরে স্তরে সুসজ্জিত ল-রিপোর্টের প্রতি মমতা প্রকাশ করলে চলে?

 বর্তমান কালে ব্রাহ্মণের সেই বিশেষত্ব আর নেই। কেবল অধ্যয়ন অধ্যাপনা এবং ধর্মালোচনায় তাঁরা নিযুক্ত নন। তাঁরা অধিকাংশই চাকরি করেন, তপস্যা করতে কাউকে দেখি নে। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ব্রাহ্মণেতর জাতির কোনো কার্যবৈষম্য দেখা যায় না। এমন অবস্থায় ব্রহ্মণ্যের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ থাকার কোনো সুবিধা কিম্বা সার্থকতা দেখতে পাই নে।

 কিন্তু সম্প্রতি এমনি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ব্রাহ্মণধর্ম যে কেবল ব্রাহ্মণকেই বদ্ধ করেছে তা নয়। শূদ্র, শাস্ত্রের বন্ধন যাঁদের কাছে কোনো কালেই দৃঢ় ছিল না, তাঁরাও কোনো-এক অবসরে পূর্বোক্ত গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করে বসে আছেন— এখন আর কিছুতেই স্থান ছাড়তে চান না।

 পূর্বকালে ব্রাহ্মণেরা শুদ্ধমাত্র জ্ঞান ও ধর্মের অধিকার গ্রহণ করাতে স্বভাবতঃই শুদ্রের প্রতি সমাজের বিবিধ ক্ষুদ্র কাজের ভার ছিল, সুতরাং তাঁদের উপর থেকে আচার বিচার মন্ত্র তন্ত্রের সহস্র বন্ধনপাশ প্রত্যাহরণ করে নিয়ে তাঁদের গতিবিধি অনেকটা অব্যাহত রাখা হয়েছিল। এখন ভারতব্যাপী একটা প্রকাণ্ড লূতাতন্তু-জালের মধ্যে ব্রাহ্মণ শূদ্র সকলেই হস্তপদবদ্ধ হয়ে মৃতবৎ নিশ্চল পড়ে আছেন। তাঁরা পৃথিবীর কাজ করছেন, না পারমার্থিক যোগসাধন করছেন। পূর্বে যে-সকল কাজ ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে, সম্প্রতি যে কাজ আবশ্যক হয়ে পড়েছে তাকেও পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

অতএব বোঝা উচিত এখন আমরা যে সংসারের মধ্যে সহসা এসে পড়েছি এখানে প্রাণ এবং মান রক্ষা করতে হলে সর্বদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আচার বিচার নিয়ে খুঁত খুঁত ক’রে, বসনের অগ্রভাগটি তুলে ধরে, নাসিকার অগ্রভাগটুকু কুঞ্চিত ক’রে, একান্ত সন্তর্পণে পৃথিবীতে চলে বেড়ালে চলবে না— যেন এই বিশাল বিশ্বসংসার একটা পঙ্ককুণ্ড, শ্রাবণ মাসের কাঁচা রাস্তা, আর্যজনের কমলচরণতলের অযােগ্য। এখন যদি প্রতিষ্ঠা চাও তো চিত্তের উদার প্রসারতা, সর্বাঙ্গীণ নিরাময় সুস্থভাব, শরীর ও বুদ্ধির বলিষ্ঠতা, জ্ঞানের বিস্তার, এবং বিশ্রামহীন তৎপরতা চাই।

 সাধারণ পৃথিবীর স্পর্শ সযত্নে পরিহার করে মহামান্স আপনাটিকে সর্বদা ধুয়ে-মেজে ঢেকেঢুকে অন্য-সমস্তকে ইতর আখ্যা দিয়ে ঘৃণা ক’রে আমরা যে রকম ভাবে চলেছিলুম তাকে আধ্যাত্মিক বাবুয়ানা বলে— এই রকম অতিবিলাসিতায় মনুষ্যত্ব ক্রমে অকর্মণ্য ও বন্ধ্যা হয়ে আসে।

 জড় পদার্থকেই কাঁচের আবরণের মধ্যে ঢেকে রাখা যায়। জীবকেও যদি অত্যন্ত পরিষ্কার রাখবার জন্য নির্মল স্ফটিক -আচ্ছাদনের মধ্যে রাখা যায় তা হলে ধূলি রােধ করা হয় বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যও রােধ করা হয়, মলিনতা এবং জীবন দুটোকেই যথাসম্ভব হ্রাস করে দেওয়া হয়।

 আমাদের পণ্ডিতেরা বলে থাকেন আমরা যে একটি আশ্চর্য আর্য পবিত্রতা লাভ করেছি তা বহু সাধনার ধন, তা অতি যত্নে রক্ষা করবার যােগ্য; সেইজন্যই আমরা ম্লেচ্ছ যবনদের সংস্পর্শ সর্বতােভাবে পরিত্যাগ করতে চেষ্টা করে থাকি।

 এ সম্বন্ধে দুটি কথা বলবার আছে। প্রথমত, আমরা সকলেই যে বিশেষরূপে পবিত্রতার চর্চা করে থাকি তা নয়, অথচ অধিকাংশ মানবজাতিকে অপবিত্র জ্ঞান করে একটা সম্পূর্ণ অন্যায় বিচার, অমূলক অহংকার, পরস্পরের মধ্যে অনর্থক ব্যবধানের সৃষ্টি করা হয়। এই পবিত্রতার দোহাই দিয়ে এই বিজাতীয় মানব -ঘৃণা আমাদের চরিত্রের মধ্যে যে কীটের ন্যায় কার্য করে তা অনেকে অস্বীকার করে থাকেন। তাঁরা অম্লানমুখে বলেন, কই, আমরা ঘৃণা কই করি?— আমাদের শাস্ত্রেই যে আছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকং’। অত্যন্ত পরুষভাষী রুক্ষস্বভাব ব্যক্তিও নিজ আচরণের প্রশংসাচ্ছলে বলতে পারেন, ‘আমার হৃদয় নিরতিশয় উদার, কারণ নিতান্ত নিঃসম্পর্ক ব্যক্তিকেও আমি সহজেই শ্যালক সম্ভাষণ করে থাকি। এবং সে হিসাবে গণনা করে দেখতে গেলে প্রায় আমার বসুধৈব কুটুম্বকং।’ শাস্ত্রে কী আছে, এবং বুদ্ধিমানের ব্যাখ্যায় কী দাঁড়ায় তা বিচার্য নয়, কিন্তু আচরণে কী প্রকাশ পায় এবং সে আচরণের আদিম কারণ যাই থাক্ তার থেকে সাধারণের চিত্তে স্বভাবতই মানবঘৃণার উৎপত্তি হয় কি না এবং কোনাে-একটি জাতির আপামর সাধারণে অপর সমস্ত জাতিকে নির্বিচারে ঘৃণা করবার অধিকারী কি না তাই বিবেচনা করে দেখতে হবে।

 আর-একটি কথা— জড়পদার্থই বাহ্য মলিনতায় কলঙ্কিত হয়। শখের পােষাকটি প’রে যখন বেড়াই তখন অতি সন্তর্পণে চলতে হয়। পাছে ধুলাে লাগে, জল লাগে, কোনাে রকম দাগ লাগে, অনেক সাবধানে আসন গ্রহণ করতে হয়। পবিত্রতা যদি পােষাক হয় তবেই ভায়ে ভয়ে থাকতে হয় পাছে এর ছােঁওয়া লাগলে কালাে হয়ে বায়, ওর হাওয়া লাগলে চিহ্ন পড়ে। এমন একটি পােযাকি পবিত্রতা নিয়ে সংসারে বাস করা কী বিষম বিপদ! জনসমাজের রণক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে এবং বঙ্গভূমিতে ঐ অতি পরিপাটী পবিত্রতাকে সামলে চলা অত্যন্ত কঠিন হয় ব’লে শুচিবায়ুগ্রস্ত দুর্ভাগা জীব আপন বিচরণক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ করে আনে; আপনাকে কাপড়টাচোপড়টার মতো সর্বদা সিন্ধুকের মধ্যে তুলে রাখে— মনুষ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনোই তার দ্বারা সম্ভব হয় না।

 আত্মার আন্তরিক পবিত্রতার প্রভাবে বাহ্য মলিনতাকে কিয়ৎপরিমাণে উপেক্ষা না করলে চলে না। অত্যন্ত রূপপ্রয়াসী ব্যক্তি বর্ণবিকারের ভয়ে পৃথিবীর ধুলামাটি জলরৌদ্র বাতাসকে সর্বদা ভয় করে চলে এবং ননীর পুঁতুলটি হয়ে নিরাপদ স্থানে বিরাজ করে; ভুলে যায় যে, বর্ণসৌকুমার্য সৌন্দর্যের একটি বাহ্য উপাদান, কিন্তু স্বাস্থ্য তার একটি প্রধান আভ্যন্তরিক প্রতিষ্ঠাভূমি— জড়ের পক্ষে এই স্বাস্থ্য অনাবশ্যক, সুতরাং তাকে ঢেকে রাখলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আত্মাকে যদি মৃত আত্মা জ্ঞান না করো, যদি সে জীবন্ত আত্মা হয়, তবে কিয়ৎপরিমাণে মলিনতার আশঙ্কা থাকলেও তার স্বাস্থ্যের উদ্দেশে, তার বল-উপার্জনের উদ্দেশে, তাকে সাধারণ জগতের সংস্রবে আনা আবশ্যক।

 আধ্যাত্মিক বাবুয়ানা কথাটা কেন ব্যবহার করেছিলুম এইখানে তা বোঝা যাবে। অতিরিক্ত বাহ্যসুখপ্রিয়তাকেই বিলাসিতা বলে, তেমনি অতিরিক্ত বাহ্যপবিত্রতাপ্রিয়তাকে আধ্যাত্মিক বিলাসিতা বলে। একটু খাওয়াটি শোওয়াটি বসাটির ইদিক ওদিক হলেই যে সুকুমার পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হয় তা বাবুয়ানার অঙ্গ। এবং সকল প্রকার বাবুয়ানাই মনুষ্যত্বের বলবীর্যনাশক।

 কিন্তু হিন্দুধর্ম আমাদের খাওয়া শোওয়া বসা চলাফেরা সমস্ত অধিকার করে আছে এই ব’লে আমরা গর্ব করে থাকি— আমরা বলি আর-কোনো দেশে মানুষের ছোটোবড়ো প্রত্যেক কাজে, সমাজের উচ্চনীচ প্রত্যেক বিভাগে ধর্মের হস্তক্ষেপ নেই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয় সেটা আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়।

 কারণ, তাতে করে হয় নির্বিকার ধর্মকে চঞ্চল পরিবর্তনের উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়, নয় পরিবর্তনধর্মী সমাজকে অপরিবর্তনীয় ধর্মনিয়মে বদ্ধ করে নির্জীব করে দেওয়া হয়। হয় ধর্ম সর্বদাই টলমল করে, নয় সমাজ চিরকাল হ্রাসবৃদ্ধিহীন পাষাণনিশ্চলতা লাভ করে।

 আমরা কী করে খাব, কী করে শােব, কাকে ছোঁব, কাকে ছোঁব না, এর মধ্যেও যদি মানুষের যুক্তির স্বাধীনতা না থাকে— সমস্ত বুদ্ধি যদি কেবল অক্ষরে অক্ষরে শাস্ত্রীয় শ্লোকের ব্যাখ্যাতেই নিযুক্ত থাকে এবং ঈশ্বররচিত এই মহা প্রকৃতিশাস্ত্রের নিয়ম-অনুসন্ধান ও তদনুসারে চলতে চেষ্টা করাকে অনাবশ্যক জ্ঞান করা হয়, তবে এমন একটি সমাজযন্ত্র নির্মিত হয় যেখানে শাস্ত্রের চাবি দম দিচ্ছে এবং কলের পুঁতুল একান্ত বিশুদ্ধ নিয়মে চলে বেড়াচ্ছে।

 এখনি তো দেখা যায়, কথায় কথায় রব উঠছে, হিঁদুয়ানি গেল হিঁদুয়ানি গেল। কলিকাতার পথপার্শ্বস্থ প্রত্যেক গৃহভিত্তি বড়ো বড়াে অক্ষরে ঘােষণা করছে, হিঁদুয়ানি যায়! হিঁদুয়ানি যায়! বাংলা দেশের গৃহে গৃহে সভায় সভায় বক্তারা কাষ্ঠমঞ্চের উপর চড়ে জগতের কানের কাছে প্রাণপণে চীৎকার করছেন, হিঁদুয়ানি থাকে না! হিঁদুয়ানি থাকে না! ‘কী হয়েছে কী হয়েছে’ শব্দে সবাই ছুটে বেরিয়ে এল— উত্তর শুনতে পেলে বারাে বৎসরের অপরিণত বালিকাকে যদি বালিকার ভাবে না দেখতে পারাে তবে হিঁদুয়ানি আর থাকে না। প্রথাটা ভালাে কি মন্দ, সাধু কি অসাধু, মনুষ্যোচিত কি পাশব, যুক্তি এবং স্বাধীন ধর্মবুদ্ধি দ্বারা তার কোনাে মীমাংসাচেষ্টা অনাবশ্যক, কেবল কথাটা এই সে না থাকলে হিঁদুয়ানি থাকে না! তাই শুনে, হিন্দুধর্মের মহত্বের প্রতি যাদের বিশ্বাস আছে তারা লজ্জায় নতশির হয়ে রইল। শুনে, হিন্দুধর্ম এবং হিঁদুয়ানি এই দুটো শব্দকে স্বতন্ত্র জাতিতে পৃথক করে রাখতে ইচ্ছা করে।

 যাই হােক, আমরা আপনাকে বােঝাতে পারি যে, হিঁদুয়ানির সমস্তই ভালাে, কারণ হিঁদুয়ানির সমস্তই ধর্মনিয়ম; যুক্তির দ্বারা যদি বা কারও বিশ্বাস জন্মে যে কোনাে-একটা সমাজপ্রথা সমাজের পক্ষে অমঙ্গলজনক তথাপি সেটা পালন করা ধর্ম, কারণ আমাদের সমস্ত সমাজনিয়মই ধর্মানুগত অতএব যুক্তি এবং দৃষ্টান্ত দ্বারা ধর্মকে অধর্ম বলে দাঁড় করানো যেতে পারে না; আপনাকে এবং আপনার শিষ্যদের বােঝাতে পারি যে, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্য-নামক এক প্রকার অ্যানিম্‌ল্-ম্যাগ্নেটিস্‌ম্‌, অথবা আধ্যাত্মিক তেজ অথবা কী-একটা অনির্বচনীয় শক্তি রক্ষার পক্ষে জাতিভেদ একান্ত আবশ্যক— কিন্তু প্রকৃতিকে এরূপ বিপরীত ব্যাখ্যায় ভােলাতে পারব না। সে কোনাে উত্তর দেবে না, কেবল মনে মনে বলবে— ‘ভালাে, তবে আধ্যাত্মিক তেজ রক্ষা করো এবং― মরো।’

 কিন্তু এখন সমস্ত জাতিকে রক্ষা করতে হবে, কেবল টিকি এবং পৈতেটুকুকে নয়। আপনার সমগ্র মনুষ্যত্বকে মানবের সংস্রবে আনতে হবে, কেবল প্রাণহীন কঠিন ব্রহ্মণ্যের মধ্যে তাকে আগলে রেখে অজ্ঞতা এবং অন্ধ দাম্ভিকতার দ্বারা তাকে বনেদি বংশের অত্যন্ত আদুরে ছেলেটির মতাে স্থূল এবং অকর্মণ্য করে তুললে আর অধিক দিন চলবে না।

 কিন্তু সংকীর্ণতা এবং নির্জীবতা অনেকটা পরিমাণে নিরাপদ সে কথা অস্বীকার করা যায় না। যে সমাজে মানবপ্রকৃতির সম্যক্‌ স্ফূর্তি এবং জীবনের প্রবাহ আছে সে সমাজকে বিস্তর উপদ্রব সইতে হয় সে কথা সত্য। যেখানে জীবন অধিক সেখানে স্বাধীনতা অধিক, এবং সেখানে বৈচিত্র অধিক। সেখানে ভালাে মন্দ দু’ই প্রবল। যদি মানুষের নখদন্ত উৎপাটন করে আহার কমিয়ে দিয়ে দুই বেলা চাবুকের ভয় দেখানাে হয় তা হলে এক দল চলৎশক্তিরহিত অতি নিরীহ পােষা প্রাণীর সৃষ্টি হয়, জীবস্বভাবের বৈচিত্র্য একেবারে লােপ হয়, দেখে বােধ হয় ভগবান এই পৃথিবীকে একটা প্রকাণ্ড পিঞ্জররূপে নির্মাণ করেছেন― জীবের আবাসভূমি করেন নি।

 কিন্তু সমাজের যে-সকল প্রাচীন ধাত্রী আছেন তাঁরা মনে করেন সুস্থ ছেলে দুরন্ত হয়, এবং দুরন্ত ছেলে কখনাে কাঁদে, কখনাে ছুটোছুটি করে, কখনাে বাইরে যেতে চায়, তাকে নিয়ে বিষম ঝঞ্ঝাট, অতএব তার মুখে কিঞ্চিং অহিফেন দিয়ে তাকে যদি মৃতপ্রায় করে রাখা যায় তা হলেই বেশ নির্ভাবনায় গৃহকার্য করা যেতে পারে।

 বালিকাকে যদি কিশােরী করে বিবাহ দেওয়া যায় তবে তার অনেক বিপদ, বালককে যদি যৌবনকাল পর্যন্ত অবিবাহিত রাখা যায় তবে তার অনেক আশঙ্কা, জ্ঞানশিক্ষার দ্বারা স্ত্রীলােকদের যদি চিত্তস্ফূর্তির উপায় করে দিতে হয় তবে তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিস্তর ভাবনা। তার চেয়ে বালক-বালিকার বিবাহ দিয়ে, স্ত্রীলোেকদের অশিক্ষিত রেখে, অনেক সতর্কতা সংযম এবং পরিশ্রমের হাত এড়ানাে যেতে পারে।

 তা ছাড়া, স্ত্রীলােকদের লেখাপড়া শেখাবার আবশ্যক কী? লেখাপড়া না শিখে তারা কি এতকাল ঘরকন্নার কাজ চালায় নি? তাদের যে কাজ তাতে সম্পূর্ণ চিত্তবিকাশের কোনাে প্রয়ােজন করে না। রন্ধনকার্যে রসায়নবিদ্যা যে অত্যাবশ্যক তা বলা যায় না, এবং গর্ভধারণে তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি কোনাে সহায়তা করে না।

 বিশেষতঃ যদি স্ত্রীলােক হঠাৎ জানতে পায় বাসুকীর মাথার উপর পৃথিবী নেই, পৃথিবী সূর্যের চারি দিকে প্রদক্ষিণ করছে, তা হলে কি আর স্ত্রীচরিত্রের কমনীয়তা রক্ষা হবে, এবং স্ত্রীলােক যদি একবার সাহিত্য ইতিহাসের আস্বাদ পায় তা হলে সে কি আর আপনার গর্ভের ছেলেকে কিছুতে ভালােবাসতে পারবে?

 কিন্তু কাজ চালানো নিয়ে বিষয় নয়। মানুষকে কাজও চালাতে হবে এবং তার চেয়ে অনেক বেশি হতে হবে। এমনকি কাজ চালানাে ছাড়িয়েও যত বেশি উঠতে পারি ততই বেশি মনুষ্যত্ব। কেবলমাত্র যে ব্যক্তি চাষ করতে পারে সে চাষা, তার দ্বারা আমরা যতই উপকার পাই আমাদের সমকক্ষ মনুষ্য বলে আমরা তাকে সমাদর করতে পারি নে।

 অতএব, স্ত্রীলােকেরা যে কেবল আমাদের বিশেষ কাজ করবেন এবং কেবলমাত্র তারই জন্যে উপযােগী হবেন তাই তাঁদের পক্ষে যথেষ্ট নয়; তাঁরা কেবল ভার্যা এবং গর্ভধারিণী নন, তাঁরা মানবী, অতএব সাধারণ বুদ্ধি এবং সাধারণ জ্ঞান তাঁদের উন্নতির পক্ষেও আবশ্যক। কেবল তাই নয়— বলতে সাহস হয় না, গড়ের মাঠ যদি সাধারণের জন্যে হয় তবে এই গড়ের মাঠের হাওয়ায় তাঁদেরও শরীরের স্বাস্থ্য এবং চিত্তের প্রফুল্লতা ও কমনীয়তা সাধন করা কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়। তাঁরা আমাদের স্ত্রী এবং জননী ব’লেই যে তাঁদের এই পৃথিবীর শােভা স্বাস্থ্য জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা অত্যাবশ্যক এ কথার কোনাে অর্থ বােঝা যায় না।

 এমন কথা কেন কেহ বলেন না যে, ‘দয়ামায়া স্নেহপ্রেমের চর্চা পুরুষের পক্ষে যে কেবলমাত্র অনাবশ্যক তা নয় হানিজনক। কারণ, হৃদয়ের চর্চায় পুরুষেরা কঠিন কর্মক্ষেত্রের অনুপযােগী হয়ে পড়েন। পুরুষের এমন শিক্ষা হওয়া উচিত যাতে করে কেবলমাত্র পুরুষের বিশেষত্বটুকুই প্রস্ফুটিত হয়।’

 বরং বিপরীত কথাই বরাবর শুনে আসছি, সকলেই একবাক্যে বলেন কেবল বুদ্ধি বিদ্যা কর্মিষ্ঠতাতেই পুরুষের পূর্ণতাসাধন হয় না, তার সঙ্গে সহৃদয়তা একান্ত আবশ্যক। স্ত্রীলােকের সম্বন্ধেও তাঁরা কেন সেইরূপ বলেন না যে, কেবলমাত্র সেই প্রেম এবং গৃহকর্মপটুতাই স্ত্রীলােকের পক্ষে যথেষ্ট নয়— তাঁর মনুষ্যত্বসাধনের জন্যে বুদ্ধিবিদ্যার চর্চাও নিতান্ত আবশ্যক।

 যদি এমন কথা কেউ বলেন ‘আমাদের সামর্থ্য নেই’ অথবা ‘আমাদের রমণীদের সময় নেই’, সে স্বতন্ত্র। যদি কোনো ব্যবসায়ী লােক বলেন ‘পড়াশুনা করা, সংগীতশিল্প আলােচনা করা, শরীর মনের স্বাস্থ্য ও প্রফুল্লতা সাধন করার অবসর অথবা শক্তি আমার নেই, আমার সমস্ত সময় এবং সমস্ত অর্থ ব্যবসায়ে না লাগালে নিতান্তই চলে না’, তবে আর কী বলব? বলব, দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ কথা বলব না— ব্যবসায়ীর পক্ষে শরীর মনের উন্নতিসাধনের চেষ্টা একেবারে অনুচিত।

 বাড়ির চারি দিকে ফাঁকা স্থান না থাকলেও বাস করা চলে এবং স্ত্রীলোেকদের শরীর মনের অপরিণতি সত্ত্বেও ঘরকর্নার কাজ চলে আসছে, কিন্তু তাই বলে বাগান করা যে অর্থের অসৎকার এবং স্ত্রীলােকদের মনুষ্যোচিত সুশিক্ষা দেওয়া যে সময় ও শক্তির অপব্যয় তা কৃপণস্বভাব লােকের কথা। এবং কোনাে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যাঁরা কেবলমাত্র কল্পনাবলে সুশিক্ষিতা রমণীদের প্রতি হৃদয়হীনতা প্রভৃতি অমূলক অপবাদ আরােপ করে থাকেন তাঁরা যে কেবলমাত্র আপনাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন তা নয়, তাঁরা আপনাদের স্বাভাবিক বর্বরতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

 যাঁদের এ বিষয়ে কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যটুকু পুনশ্চ জানতে পেরেছেন যে, রমণী স্বভাবতঃই রমণী। এবং শিক্ষা এমন একটা অত্যাশ্চর্য ইন্দ্রজালবিদ্যা নয় যাতে করে নারীকে পুরুষ করে দিতে পারে। তাঁরা এইটে দেখেছেন, শিক্ষিতা রমণীও রোগের সময় প্রিয়জনকে প্রাণপণে শুশ্রূষা করে থাকেন, শোকের সময় স্বাভাবিক স্ত্রীবুদ্ধিপ্রভাবে তপ্তহৃদয়ে যথাকালে যথাবিহিত সান্ত্বনা বর্ষণ করেন, এবং অনাথ আতুর জনের প্রতি তাঁদের যে স্বাভাবিক করুণা সে তাঁদের শিক্ষার অসম্পূর্ণতার উপর কিছুমাত্র নির্ভর করছে না।

 কিন্তু পূর্বেই বলেছি এতে অনেক কাজ এবং অনেক ভাবনা বেড়ে যায়, এবং সমাজ যতই উন্নতি লাভ করে ততই তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের জটিলতা স্বভাবতঃই বেড়ে উঠতে থাকে। যদি আমরা বলি আমরা এতটা পেরে উঠব না, আমাদের এত উদ্যম নেই, শক্তি নেই― যদি আমাদের পিতামাতারা বলে ‘পুত্রকন্যাদের উপযুক্ত বয়স পর্যন্ত মনুষ্যত্ব শিক্ষা দিতে আমরা অশক্ত কিন্তু মানুষের পক্ষে যত সত্বর সম্ভব (এমন-কি অসম্ভব বললেও হয়) আমরা পিতামাতা হতে প্রস্তুত আছি’― যদি আমাদের ছাত্রবৃন্দ বলে ‘সংযম আমাদের পক্ষে অসাধ্য, শরীর মনের সম্পূর্ণতা-লাভের জন্যে প্রতীক্ষা করতে আমরা নিতান্তই অসমর্থ, অকালে অপবিত্র দাম্পত্য আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক এবং হিঁদুয়ানিরও সেই বিধান— আমরা চাই নে উন্নতি, চাই নে ঝঞ্ঝাট, আমাদের এই রকম ভাবেই বেশ চলে যাবে’— তবে নিরুত্তর হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এ কথাটুকু বলতেই হয় যে, হীনতাকে হীনতা ব’লে অনুভব করাও ভালো, কিন্তু বুদ্ধিবলে নির্জীবতাকে সাধুতা এবং অক্ষমতাকে সর্বশ্রেষ্ঠতা বলে প্রতিপন্ন করলে সদ্গতির পথ একেবারে আটে-ঘাটে বন্ধ করা হয়।

 সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থাকে তা হলে এত কথা ওঠে না। তা হলে কৌশলসাধ্য ব্যাখ্যা দ্বারা আপনাকে ভুলিয়ে কতকগুলো সংকীর্ণ বাহ্য সংস্কারের মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করার প্রবৃত্তিই হয় না।

 আমরা যখন একটা জাতির মত জাতি ছিলুম তখন আমাদের যুদ্ধ বাণিজ্য শিল্প, দেশে বিদেশে গতায়াত, বিজাতীয়দের সঙ্গে বিবিধ বিদ্যার আদানপ্রদান, দিগ্বিজয়ী বল এবং বিচিত্র ঐশ্বর্য ছিল। আজ বহু বৎসর এবং বহু প্রভেদের ব্যবধানে থেকে কালের সীমান্তদেশে আমরা সেই ভারত-সভ্যতাকে পৃথিবী হতে অতিদূরবর্তী একটি তপঃপূত হোমধুমরচিত অলৌকিক সমাধিরাজ্যের মতো দেখতে পাই, এবং আমাদের এই বর্তমান স্নিগ্ধচ্ছায়া কর্মহীন নিদ্রালস নিস্তব্ধ পল্লীটির সঙ্গে তার কতকটা ঐক্য অনুভব করে থাকি― কিন্তু সেটা কখনোই প্রকৃত নয়।

 আমরা যে কল্পনা করি, আমাদের কেবল আধ্যাত্মিক সভ্যতা ছিল— আমাদের উপবাসক্ষীণ পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকে একলা একলা বসে আপন আপন জীবাত্মাটি হাতে নিয়ে কেবলই শান দিতেন, তাকে একেবারে কর্মাতীত অতি সূক্ষ্ম জ্যোতির রেখাটুকু করে তোলবার চেষ্টা— সেটা নিতান্ত কল্পনা।

 আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হল পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযোনি মাত্র। আমাদের অবয়বসাদৃশ্যের উপর ভর করে আমরা মনে করি আমাদের প্রাচীন সভ্যতারও এইরূপ দেহের লেশমাত্র ছিল না, কেবল একটা ছায়াময় আধ্যাত্মিকতা ছিল। তাতে ক্ষিত্যপ্‌তেজের সংস্রবমাত্র ছিল না, ছিল কেবল খানিকটা মরুৎ এবং ব্যোম।

 এক মহাভারত পড়লেই দেখতে পাওয়া যায় আমাদের তখনকার সভ্যতার মধ্যে জীবনের আবেগ কত বলবান ছিল। তার মধ্যে কত পরিবর্তন, কত সমাজবিপ্লব, কত বিরোধী শক্তির সংঘর্ষ দেখতে পাওয়া যায়। সে সমাজ কোনো একজন পরম বুদ্ধিমান শিল্পচতুর লোকের স্বহস্তরচিত অতি সুচারু পরিপাটি সমভাববিশিষ্ট কলের সমাজ ছিল না। সে সমাজে এক দিকে লোভ হিংসা ভয় দ্বেষ অসংযত-অহংকার, অন্য দিকে বিনয় বীরত্ব আত্মবিসর্জন উদার-মহত্ব এবং অপূর্ব সাধুভাব মনুষ্যচরিত্রকে সর্বদা মথিত করে জাগ্রত করে রেখেছিল। সে সমাজে সকল পুরুষ সাধু, সকল স্ত্রী সতী, সকল ব্রাহ্মণ তপঃপরায়ণ ছিলেন না। সে সমাজে বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় ছিলেন, দ্রোণ কৃপ পরশুরাম ব্রাহ্মণ ছিলেন, কুন্তী সতী ছিলেন, ক্ষমাপরায়ণ যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় পুরুষ ছিলেন এবং শত্রুরক্তলোলুপা তেজস্বিনী দ্রৌপদী রমণী ছিলেন। তখনকার সমাজ ভালোয়-মন্দয় আলোকে-অন্ধকারে জীবনলক্ষণাক্রান্ত ছিল; মানবসমাজ চিহ্নিত বিভক্ত সংযত সমাহিত কারুকার্যের মতো ছিল না। এবং সেই বিপ্লবসংক্ষুব্ধ বিচিত্র মানববৃত্তির সংঘাত দ্বারা সর্বদা জাগ্রতশক্তিপূর্ণ সমাজের মধ্যে আমাদের প্রাচীন ব্যূঢ়োরস্ক শালপ্রাংশু সভ্যতা উন্নতমস্তকে বিহার করত।

 সেই প্রবল বেগবান সভ্যতাকে আজ আমরা নিতান্ত নিরীহ নির্বিরোধী নির্বিকার নিরাপদ নির্জীব ভাবে কল্পনা করে নিয়ে বলছি আমরা সেই সভ্য জাতি, আমরা সেই আধ্যাত্মিক আর্য; আমরা কেবল জপতপ করব, দলাদলি করব; সমুদ্রযাত্রা নিষেধ ক’রে, ভিন্ন জাতিকে অস্পৃশ্যশ্রেণীভুক্ত ক’রে, হিউমকে ম্লেচ্ছ ব’লে, কন্‌গ্রেসকে একঘরে ক’রে, আমরা সেই মহৎ প্রাচীন হিন্দুনামের সার্থকতা সাধন করব।

 কিন্তু তার চেয়ে যদি সত্যকে ভালোবাসি, বিশ্বাস অনুসারে কাজ করি, ঘরের ছেলেদের রাশীকৃত মিথ্যার মধ্যে গোলগাল গলগ্রহের মতো না করে তুলে সত্যের শিক্ষায় সরল সবল দৃঢ় ক’রে উন্নতমস্তকে দাঁড় করাতে পারি—যদি মনের মধ্যে এমন নিরভিমান উদারতার চর্চা করতে পারি যে, চতুর্দিক থেকে জ্ঞান এবং মহত্ত্বকে সানন্দে সবিনয়ে সাদর সম্ভাষণ করে আনতে পারি― যদি সংগীত শিল্প সাহিত্য ইতিহাস বিজ্ঞান প্রভৃতি বিবিধ বিদ্যার আলোচনা ক’রে, দেশে বিদেশে ভ্রমণ ক’রে, পৃথিবীতে সমস্ত তন্নতন্ন নিরীক্ষণ ক’রে এবং মনোযোগ-সহকারে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা ক’রে আপনাকে চারি দিকে উন্মুক্ত বিকশিত করে তুলতে পারি— তাহলে আমরা যাকে হিঁদুয়ানি বলে থাকি তা সম্পূর্ণ টিঁকবে কি না বলতে পারি নে, কিন্তু প্রাচীনকালে যে জীবন্ত সচেষ্ট তেজস্বী হিন্দুসভ্যতা ছিল তার সঙ্গে অনেকটা আপনাদের ঐক্যসাধন করতে পারব।

 এইখানে আমার একটি তুলনা মনে উদয় হচ্ছে। বর্তমান কালে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা খনির ভিতরকার পাথুরে কয়লার মতো। এক কালে যখন তার মধ্যে হ্রাসবৃদ্ধি আদানপ্রদানের নিয়ম বর্তমান ছিল তখন সে বিপুল অরণ্যরূপে জীবিত ছিল। তখন তার মধ্যে বসন্তবর্ষার সজীব সমাগম এবং ফলপুষ্পপল্লবের স্বাভাবিক বিকাশ ছিল। এখন তার আর বৃদ্ধি নেই, গতি নেই বলে যে তা অনাবশ্যক তা নয়। তার মধ্যে বহুযুগের উত্তাপ ও আলোক নিহিত ভাবে বিরাজ করছে। কিন্তু আমাদের কাছে তা অন্ধকারময় শীতল। আমরা তার থেকে কেবল খেলাচ্ছলে ঘন কৃষ্ণবর্ণ অহংকারের স্তম্ভ নির্মাণ করছি। কারণ, নিজের হাতে যদি অগ্নিশিখা না থাকে তবে কেবলমাত্র গবেষণা-দ্বারা পুরাকালের তলে গহ্বর খনন করে যতই প্রাচীন খনিজপিণ্ড সংগ্রহ করে আনোনা কেন তা নিতান্ত অকর্মণ্য। তাও যে নিজে সংগ্রহ করছি তাও নয়। ইংরাজের রানীগঞ্জের বাণিজ্যশালা থেকে কিনে আনছি। তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু করছি কী? আগুন নেই, কেবলই ফুঁ দিচ্ছি, কাগজ নেড়ে বাতাস করছি এবং কেউ বা তার কপালে সিঁদুর মাখিয়ে সামনে বসে ভক্তিভরে ঘণ্টা নাড়ছেন।

 নিজের মধ্যে সজীব মনুষত্ব থাকলে তবেই প্রাচীন এবং আধুনিক মনুষ্যত্বকে, পূর্ব ও পশ্চিমের মনুষ্যত্বকে, নিজের ব্যবহারে আনতে পারা যায়।

 মৃত মনুষ্যই যেখানে পড়ে আছে সম্পূর্ণরূপে সেইখানকারই। জীবিত মনুষ্য দশ দিকের কেন্দ্রস্থলে; সে ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য এবং বিপরীতের মধ্যে সেতুস্থাপন ক’রে সকল সত্যের মধ্যে আপনার অধিকার বিস্তার করে; এক দিকে নত না হয়ে চতুর্দিকে প্রসারিত হওয়াকেই সে আপনার প্রকৃত উন্নতি জ্ঞান করে।

 আমার আশঙ্কা হচ্ছে, প্রবন্ধটা কমে অনেকটা উপদেশের মতো শুনতে হয়ে আসছে— এজন্যে আমি সর্বসাধারণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। এ রকম দুরভিসন্ধি আমার গোড়ায় ছিল না। তৎপক্ষে আমার কতকগুলি গুরুতর বাধাও আছে।

 অল্পদিন হল আমার কোনো লেখা যদি আমার দুরদৃষ্টক্রমে কারও অবিকল মনের মতো না হত তিনি বলতেন আমি তরুণ, আমি কিশোর, এখনো আমার মতের পাক ধরে নি। আমার এই তরুণ বয়সের কথা আমাকে এতকাল ধরে এতবার শুনতে হয়েছে যে শুনতে শুনতে আমার মনে এই একটা সংস্কার অজ্ঞাতসারে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এই বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলেই বয়স সম্বন্ধে প্রতিবৎসর নিয়মিত ডবল প্রোমোশন পেয়ে থাকে, কেবল আমিই পাঁচজনের পাকচক্রে কিম্বা নিজের অক্ষমতা-বশতঃ কিছুতেই কিশোরকাল উত্তীর্ণ হতে পারলুম না।

 এই তো গেল পুর্বের কথা। আবার সম্প্রতি যদি আমার স্বভাব-বশতঃ আমার কোনো রচনায় আমি এমন একটা বিষম অপরাধ করে বসি যাতে করে কারও সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য হয়ে পড়ে তা হলে তিনি বলেন আমি সম্পদের ক্রোড়ে লালিত পালিত, দরিদ্র ধরাধামের অবস্থা কিছুই অবগত নই। আমার সম্বন্ধে এই প্রকারের অনেকগুলাে কিম্বদন্তি প্রচলিত থাকাতে আমি সাধারণের সমক্ষে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত ভাবেই আছি। এইজন্য উচ্চ মঞ্চে আরোহণ করে অসংকোচে উপদেশ দেবার চেষ্টা আমার মনে উদয় হয় না।

 বিশেষতঃ এই প্রবন্ধে এত রকম রচনার ত্রুটি আছে যে, সে-সমস্ত জেনেশুনে উপদেশ দিতে কিম্বা কোনাে-একটা মত ওরই মধ্যে একটু উচ্চস্বরে বলতে আমার সাহস হয় না। প্রথমতঃ আমার ভাষা সম্বন্ধে আমি চিন্তিত আছি। আমি প্রচলিত ভাষা এবং পুঁথির ভাষার মধ্যে পংক্তিভেদ রক্ষা করি নি।

 দ্বিতীয়তঃ ভাবেরও আনুপূর্বিক সংগতি নেই। বিশ্বরচনা থেকে আরম্ভ করে দরখাস্ত-রচনা পর্যন্ত সকল রচনাতেই হয় সাধারণ থেকে বিশেষের পরিণতি নয় বিশেষ থেকে সাধারণের উদ্ভব; হয় সূক্ষ্ম হতে স্থূল নয় স্থূল হতে সূক্ষ্ম, হয় বাষ্প থেকে জল নয় জল থেকে বাষ্পেদ্গম হয়ে থাকে। আমি যে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কিসের থেকে কী করেছি ভালাে স্মরণ হচ্ছে না। যদি কোনাে তর্ককুশল ব্যক্তি কাজটা তাঁর অযােগ্য না মনে করেন তবে অনায়াসে প্রমাণ করে দিতে পারেন যে, এই রচনায় পদে পদে আমার এক পদ আর-এক পদকে প্রতিবাদ করে চলেছে; আমার এক পদ যখন গতি আশ্রয় করে অগ্রসর আমার আর-এক পদ তখন স্থিতি আশ্রয় করে পশ্চাৎবর্তী; আমার দক্ষিণপদ যখন পূর্বের দিকে আমার বামপদ তখন পশ্চিমের দিকে এবং চলেছি হয়তাে উত্তরের দিকে। এ কথা বললেই আমাকে তৎক্ষণাৎ থামতে হবে, কারণ, এর ঊর্দ্ধে আর উত্তর নেই।

তৃতীয়তঃ শত্রু মিত্র সকলেই স্বীকার করবেন আমার এ লেখা প্র্যাক্‌টিকাল হয় নি; সমালোচনা এবং প্রতিবাদ করা ছাড়া সাধারণে একে আর-কোনো ব্যবহারে আনতে পারবেন না। কিন্তু সেটা আমাদের বংশাবলীর ধারা। ভগবান শাণ্ডিল্য এবং তাঁর সমসাময়িক পিতামহগণ কেউ প্র্যাক্‌টিকাল ছিলেন না। তাঁরা হোমানলে যে পরিমাণে অজস্র ঘৃত ব্যয় করেছেন সে খরচটা কি বর্তমান সভ্যতার কোনো হিসাবী লোক প্র্যাক্‌টিকাল শিরে লিখতে পারেন?

 অবশ্য, তাঁদের সময়েও প্র্যাক্‌টিকাল এবং অপ্র্যাক্‌টিকালের একটা সীমা নির্দিষ্ট ছিল। ভস্মে ঘৃত ঢালাটা তাঁদের কালের বিষয়বুদ্ধিতেও নিতান্ত অপব্যয় বলে বোধ হত। কিন্তু অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে সহসা যে-একটি লৌকিক প্রভাবসম্পন্ন দীপ্তিমান পরমরমণীয় শিখার উদ্ভব হয় সেটাকে তখনকার কালের প্র্যাক্‌টিকাল লোকেরা একটা ফললাভস্বরূপ গণ্য করতেন।

 যুনোপীয় বিজ্ঞসমাজে যে-কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার হোক-না কেন, তৎক্ষণাৎ পাঁচজনে প’ড়ে তার উপরে সহস্র পেয়াদা লাগিয়ে, সেটাকে ধরে বেঁধে, নির্যাতন ক’রে, কখনো বা তার ঘর ভেঙে দিয়ে, কখনো বা তাকে কারারুদ্ধ ক’রে, তার যথাসর্বস্ব আদায় করে নিয়ে তবে ছাড়েন; তার বসনাঞ্চল ঝাড়া দিয়ে ভূরিভূরি প্র্যাক্‌টিক্যাল ফল বাহির করেন। তাঁরা মন্ত্র পড়ে এই বিশ্বের মধ্যে থেকে যে ষাট-সত্তরটি ভূত নামিয়েছেন তাদের দিয়ে অহর্নিশি ভূতের বেগার খাটিয়ে নেন।

 আমাদের পূর্বপুরুষগণও সৃষ্টির অনেক তত্ত্ব আবিষ্কার করে গেছেন। কিন্তু সত্ত্ব রজ তম নিয়ে কারও ধুয়ে খাবার যো নেই; যে পাঁচটি ভূতের সন্ধান পেয়েছেন তাদের দ্বারা সময়ে অসময়ে কোন-যে একটা বিশেষ ফল পাওয়া যাবে এমন সম্ভাবনা দেখি নে। অতএব যাঁরা কৌলিক স্বভাবের নিয়ম মানেন তাঁরা আমার এই প্র্যাক্‌টিকাল ভাবের অভাব দেখে দুঃখিত হবেন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিস্মিত হবেন না।

 তার পরে আবার আমরা বাঙালিরা অধিকাংশই চিন্তাশীল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ‘স্বাধীন’চিন্তাশীল। স্বাধীন চিন্তার অর্থ এই― যে চিন্তার কোনো অবলম্বন নেই; যার জন্যে কোনো বিশেষ শিক্ষা বা সন্ধান, প্রমাণ বা দৃষ্টান্তের কোনো আবশ্যক করে না। আর সকল প্রকার অপবাদই আমাদের সহ্য হয়, কিন্তু চিন্তা সম্বন্ধে কারও সাহায্য গ্রহণ করেছি এ অপবাদ অসহ্য। স্ত্রীলোকদের ন্যায় আমাদের অশিক্ষিতপটুত্ব। প্রচলিত বিজ্ঞানশাস্ত্রের সঙ্গে যতই অনৈক্য হবে আমাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও ততই স্বাধীনচিন্তাসম্পন্ন বলে সমাদৃত হবে; এবং যতই আমরা অধিক চক্ষু মুদ্রিত করতে পারব, দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে ততই আমাদের সমধিক পারদর্শিতা লাভ হবে।

 আমিও এই রকম স্বাধীন চিন্তা ভালোবাসি বলে আমার লেখা প্র্যাক্‌টিকাল হয় না। আমাদের চিন্তাশীলগণ কোন্‌-এক অপূর্ব তপস্যাবলে স্বর্গ মর্ত উভয়েরই অতীত এক স্বতন্ত্র স্বাধীন লোক লাভ করেছেন; সেই আশমানপুরীর সব চেয়ে সৃষ্টিছাড়া একটা কোণ আশ্রয় করে আমি পড়ে থাকি। তবু এখানকার অনেকেই স্বমনঃকল্পিত দর্শন বিজ্ঞানের সৃষ্টি ক’রে এবং স্বগৃহরচিত পলিটিক্‌স্ চর্চা করে এই নিরাধার চিন্তাজগতের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু আমি এমনি হতভাগ্য যে এখানকার লোকেরাও আমার নামে অভিযোগ করে থাকেন যে, আমার দ্বারা কোনো প্র্যাক্‌টিকাল কাজ হচ্ছে না, কেবল আমি রাশি রাশি বাষ্প রচনা করে দেশের বীর্য বল বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে দিচ্ছি।

 আমি চিহ্নিত অপরাধী। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে থাকি। অস্মদ্দেশের সকলেই স্বাধীন চিন্তা করে থাকেন, আমিও তাই করি; কিন্তু আমি যে-সকল বিষয় নিয়ে আলােচনা করি তাতে চিন্তার স্বাধীনতার কোনাে গৌরব নেই। এই, জগতের গাছটা-পালাটার কম্পন কিম্বা মর্মর, কিম্বা মলয়বাতাসের হিল্লোল, কি বড়ো বাড়াবাড়ি হল তাে কৃষ্ণনয়ন এবং মিষ্ট হাস্য― এই নিয়ে নিজের মনে বসে জাল বােনা এবং নিজের জালে নিজে জড়িয়ে থাকা এটা বড় বেশি কথা হল না। কিন্তু মানবতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ধর্মতত্ত্ব ইতিহাস এবং পলিটিক্‌স যদি সম্পূর্ণ নিজের মন থেকে গড়ে তুলতে পারা যায়, তা হলেই একটা দুরূহ কাজ করা হয় বটে এবং আমরা যে ত্রিশঙ্কুর স্বর্গরাজ্যে থাকি সেখানকার অধিবাসীদের বিশেষ উপকার করা হয়।

 যাই হােক, আমি ভারতবর্ষ কিম্বা য়ুরােপ সম্বন্ধে কোনাে নূতন কথা, দুরূহ কথা, কিম্বা কাজের কথা বলতে অক্ষম। আমার মনে স্বতঃ যখন যে ভাবের উদয় হয় তাই মনের মতাে করে প্রকাশ করতে সুখ হয় এবং তাই সকলকে শােনাতে ইচ্ছা করে। উপকার করবার জন্যে নয়, আনন্দ করবার জন্যে।

 এ লেখাটার সেই রকম ভাবেই উৎপত্তি। কখনাে সমুদ্রপথে কখনাে বা য়ুরােপের মহাদেশে যখন যে কথাটা মনে উদয় হয়েছে তখন সেইটেই ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করেছি। বেশি চিন্তা কিম্বা বহুল অন্বেষণ কি কোনাে বিষয়ের চরম সিদ্ধান্ত পর্যন্ত মনে মনে অনুসরণ করবার চেষ্টা করিনি। সমালােচনার ভাষায় যাকে ‘গবেষণা’ বলা হয় আমার এ লেখায় তার চিহ্নমাত্র নেই। কখনাে আশা কখনাে নৈরাশ্য, কখনাে হৃদয় এক দিকে টেনেছে কখনাে অভিজ্ঞতা আর-এক দিকে পথ দেখিয়েছে। হয়তাে একটি কি দুটি মাত্র ঘটনা থেকে একটা বিশ্বাস অলক্ষিতভাবে মনের মধ্যে স্থানলাভ করেছে, কোনো রকম বহুল প্রমাণের অপেক্ষা রাখে নি। এই জন্যে আমার এ-সমস্ত কথাই কাঁচা, গাছের পল্লবের মতো কাঁচা, অল্প আঘাতেই ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু গাছের পক্ষে সে অত্যাবশ্যক এবং দর্শকের পক্ষেও হয়তো তার এক প্রকার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য থাকতে পারে।


বাসস্থানের ব্যবস্থা অনেক রকমের হতে পারে। এক, বসে বসে গভীর ভিত্তি খনন ক’রে, মেপেজুখে, একটি ইঁটের পরে আর-একটি ইঁট বসিয়ে দৃঢ় অট্টালিকা নির্মাণ করা; কিন্তু তা সময় ও ব্যয়-সাপেক্ষ এবং সেটা কাঁধে করে টেনে নিয়ে বেড়াবার যো নেই। আর এক রকম আছে, তাঁবুর বন্দোবস্ত; তার অনেক উপস্থিত সুবিধা আছে।

 ভ্রমণকালে আমি এই রকমের একটা তাঁবু আশ্রয় করে ঘুরেছিলুম। বসে বসে অসীম ধৈর্য সহকারে কোথাও মতের পাকা ইমারত বানাবার চেষ্টা করি নি। যথেষ্ট সময়ও ছিল না এবং আমার মানসিক স্বভাবটাও ঐ রকম ভিটেছাড়া।

 যখন চেয়ে দেখি সংসারপথের দুই ধারে বড়ো বড়ো লক্ষ্মীমন্ত লোক বেড়াটি ফেঁদে, দালানটি তুলে, গোলাঘরটি পরিপূর্ণ ক’রে, তুলসীতলটি বাঁধিয়ে, উঠোনটি তক্‌তকে ক’রে বংশপরম্পরায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট সন্তুষ্ট হয়ে বাস করছে— অবশিষ্ট পৃথিবী অবশিষ্ট লোকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানটুকুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় বন্ধন করেছে— তখন আমার লোভ হয়; গুটিকতক অত্যন্ত পাকা বিশ্বাসের মধ্যে মানসিক গার্হস্থ্য স্থাপন করে একটি জায়গায় স্থায়িত্ব লাভ করবার জন্যে ক্ষণেককাল মন ব্যাকুল হয়; কিন্তু পরক্ষণেই অদৃষ্টের অলক্ষ্মী নানা প্রলােভনে ভুলিয়ে আবার পথ থেকে পথে, দ্বার থেকে বারে, দেশ থেকে দেশান্তরে টেনে নিয়ে যায়।

 যখন দেখলুম আমার দশাই এই রকম, তখন মনকে এই বলে প্রবােধ দিলুম— তা, এক রকম ভালােই হয়েছে। কারণ, যদি অধিকার স্থাপন করতে চাও তা হলে অল্প পরিমাণের জন্যে বিশ্বসংসারের অধিকাংশই আপােষে ছেড়ে দিতে হয়। আর যদি কেবল দেখতে শুনতে, উপভােগ করতে চাও, তা হলে কিছুরই উপরে দাবি না ছেড়ে সর্বত্রই গতিবিধির পথ মুক্ত রাখা যায়।

 সেই কারণে আমি যখন য়ুরোপে গেলুম তখন কিছুই অধিকারের চেষ্টা করি নি। পথের উপর দিয়ে নয়ন মেলে চলে এলুম এবং মনে আপনি যা উদয় হল তাই সংগ্রহ করে নিয়ে এলুম— এ কেবল সাহিত্যের ছিটেবুনানি, এতে হাল লাঙল চাষ নিড়েনের কোন সম্পর্ক নেই।

 এরা কী করে এত সস্তায় দেশালাই তৈরি করে তা আমি দেখি নি; তা ছাড়া ইস্পাতের ছুরি, কাঁচের বাসন এবং কাপড়ের কল সম্বন্ধেও আমি কোনােরূপ সন্ধান করতে পারি নি।

 আমি কেবল দেখলুম জাহাজ চলছে, গাড়ি চলছে, লোক চলছে, দোকান চলছে, থিয়েটার চলছে, পার্লেমেণ্ট্ চলছে— সকলই চলছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল বিষয়েই একটা বিপর্যয় চেষ্টা অহর্নিশি নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে; মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্যে সকলে মিলে অশ্রান্তভাবে ধাবিত হচ্ছে।

 দেখে আমার ভারতীয় প্রকৃতি ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে বিস্ময়-সহকারে বলে—হাঁ, এরাই রাজার জাত বটে! আমাদের পক্ষে যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি এদের কাছে তা অকিঞ্চনদারিদ্র্য। এদের অতি সামান্য় সুবিধাটুকুর জন্যেও, এদের অতি ক্ষণিক আমোদের উদ্দেশেও, মানুষের শক্তি আপন পেশী এবং স্নায়ু চরম সীমায় আকর্ষণ করে খেটে মরছে।

 জাহাজে বসে ভাবতুম এই-যে জাহাজটি অহর্নিশি লৌহবক্ষ বিস্ফারিত করে চলেছে, ছাদের উপরে নরনারীগণ কেউ বা বিশ্রামসুখে কেউ বা ক্রীড়াকৌতুকে নিযুক্ত, কিন্তু এর গোপন জঠরের মধ্যে যেখানে অনন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে, যেখানে অঙ্গারকৃষ্ণ নিরপরাধ নারকীরা প্রতিনিয়তই জীবনকে দগ্ধ করে সংক্ষিপ্ত করছে—সেখানে কী অসহ্য চেষ্টা! কী দুঃসাধ্য পরিশ্রম! মানবজীবনের কী নির্দয় অপব্যয় অশ্রান্তভাবে চলছে! কিন্তু, কী করা যাবে! আমাদের মানবরাজা চলেছেন; কোথাও তিনি থামতে চান না; অনর্থক কাল নষ্ট কিম্বা পথকষ্ট সহ্য করতে তিনি অসম্মত।

 তাঁর জন্যে অবিশ্রাম যন্ত্রচালনা করে কেবলমাত্র দীর্ঘ পথকে হ্রাস করাই যথেষ্ট নয়; তিনি প্রাসাদে যেমন আরামে যেমন ঐশ্বর্যে থাকেন পথেও তার তিলমাত্র ত্রুটি চান না। সেবার জন্যে শত শত ভৃত্য অবিরত নিযুক্ত; ভোজনশালা সংগীতমণ্ডপ সুসজ্জিত, স্বর্ণচিত্রিত, শ্বেতপ্রস্তরমণ্ডিত, শত বিদ্যুদ্দীপে সমুজ্জ্বল। আহারকালে চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়ের সীমা নেই। জাহাজ পরিষ্কার রাখবার জন্যে কত নিয়ম কত বন্দোবস্ত; জাহাজের প্রত্যেক দড়িটুকু যথাস্থানে সুশোভনভাবে গুছিয়ে রাখবার জন্যে কত দৃষ্টি।

 যেমন জাহাজে, তেমনি পথে ঘাটে দোকানে নাট্যশালায় গৃহে সর্বত্রই আয়োজনের আর অবধি নেই। দশ দিকেই মহামহিম মানুষের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের ষোড়শোপচারে পূজা হচ্ছে। তিনি মুহূর্তকালের জন্যে যাতে সন্তোষ লাভ করবেন তার জন্যে সম্বৎসরকাল চেষ্টা চলছে।

 এ রকম চরমচেষ্টাচালিত সভ্যতাযন্ত্রকে আমাদের অন্তর্মনস্ক দেশীয় স্বভাবে যন্ত্রণা জ্ঞান করত। দেশে যদি একমাত্র যথেচ্ছাচারী বিলাসী রাজা থাকে তবে তার শৌখিনতার আয়ােজন করবার জন্যে অনেক অধমকে জীবনপাত করতে হয়, কিন্তু যখন শতসহস্র রাজা তখন মনুষ্যকে নিতান্ত দুর্বহভারাক্রান্ত হয়ে পড়তে হয়। কবিবর Hood -রচিত Song of the Shirt সেই ক্লিষ্ট মানবের বিলাপসংগীত।

 খুব সম্ভব দুর্দান্ত রাজার শাসনকালে ইজিপ্টের পিরামিড অনেকগুলি প্রস্তর এবং অনেকগুলি হতভাগ্য মানবজীবন দিয়ে রচিত হয়। এখনকার এই পরমসুন্দর অভ্রভেদী সভ্যতা দেখে মনে হয় এও উপরে পাষাণ নীচে পাষাণ এবং মাঝখানে মানবজীবন দিয়ে গঠিত হচ্ছে। ব্যাপারটা অসম্ভব প্রকাণ্ড এবং কারুকার্যও অপূর্ব চমৎকার, তেমনি ব্যয়ও নিতান্ত অপরিমিত। সেটা বাহিরে কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু প্রকৃতির খাতায় উত্তরােত্তর তার হিসাব জমা হচ্ছে। প্রকৃতির আইন অনুসারে উপেক্ষিত ক্রমে আপনার প্রতিশােধ নেবেই। যদি টাকার প্রতি বহু যত্ন করে পয়সার প্রতি নিতান্ত অনাদর করা যায় তা হলে সেই অনাদৃত তাম্রখণ্ড বহু যত্নের ধন গৌরাঙ্গ টাকাকে ক্রমশঃ ধ্বংস করে ফেলে।

 স্মরণ হচ্ছে, য়ুরােপের কোনাে-এক বড়ােলােক ভবিষ্যদ্‌দ্বাণী প্রচার করেছেন যে, এক সময়ে কাফ্রিরা য়ুরােপ জয় করবে। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণ অমাবস্যা এসে য়ুরোপের শুভ্র দিবালােক গ্রাস করবে। প্রার্থনা করি তা না ঘটুক, কিন্তু আশ্চর্য কী! কারণ, আলােকের মধ্যে নির্ভয়, তার উপরে সহস্র চক্ষু পড়ে রয়েছে, কিন্তু যেখানে অন্ধকার জড়ো হচ্ছে বিপদ সেইখানে বসে গােপনে বলসঞ্চয় করে, সেইখানেই প্রলয়ের তিমিরাবৃত জন্মভূমি। মানব-নবাবের নবাবি যখন উত্তরোত্তর অসহ্য হয়ে উঠবে, তখন দারিদ্র্যের অপরিচিত অন্ধকার ঈশানকোণ থেকেই ঝড় ওঠবার সম্ভাবনা।

 এই সঙ্গে আর-একটা কথা মনে হয়― যদিও বিদেশীয় সমাজ সম্বন্ধে কোনো কথা নিঃসংশয়ে বলা ধৃষ্টতা, কিন্তু বাহির হতে যতটা বোঝা যায় তাতে মনে হয় য়ুরোপে সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে।

 স্ত্রীলোক সমাজের কেন্দ্রানুগ (centripetal) শক্তি; সভ্যতার কেন্দ্রাতিগ শক্তি সমাজকে বহির্‌মুখে যে পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে, কেন্দ্রানুগ শক্তি অন্তরের দিকে সে পরিমাণে আকর্ষণ করে আনতে পারছে না। পুরুষেরা দেশে বিদেশে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, অভাববৃদ্ধির সঙ্গে নিয়ত জীবিকাসংগ্রামে নিযুক্ত হয়ে রয়েছে। সৈনিক অধিক ভার নিয়ে লড়তে পারে না, পথিক অধিক ভার বহন করে চলতে পারে না, য়ুরোপে পুরুষ পারিবারিক ভার গ্রহণে সহজে সম্মত হয় না। স্ত্রীলোকের রাজত্ব ক্রমশঃ উজাড় হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। কুমারী পাত্রের অপেক্ষায় দীর্ঘকাল বসে থাকে, স্বামী কার্যোপলক্ষে চলে যায়, পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে পর হয়ে পড়ে। প্রখর জীবিকাসংগ্রামে স্ত্রীলোকদেরও একাকিনী যোগ দেওয়া আবশ্যক হয়েছে। অথচ তাদের চিরকালের শিক্ষা স্বভাব এবং সমাজনিয়ম তার প্রতিকূলতা করছে।

 য়ুরোপে স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে সমান-অধিকারপ্রাপ্তির যে চেষ্টা করছে সমাজের এই সামঞ্জস্যনাশই তার কারণ বলে বোধ হয়। নরোয়ে-দেশীয় প্রসিদ্ধ নাট্যকার ইব্‌সেন -রচিত কতকগুলি সামাজিক নাটকে দেখা যায় নাট্যোক্ত অনেক স্ত্রীলোক প্রচলিত সমাজবন্ধনের প্রতি একান্ত অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করছে, অথচ পুরুষেরা সমাজপ্রথার অনুকূলে। এই রকম বিপরীত ব্যাপার পড়ে আমার মনে হল, বাস্তবিক বর্তমান য়ুরােপীয় সমাজে স্ত্রীলােকের অবস্থাই নিতান্ত অসংগত। পুরুষেরা না তাদের গৃহপ্রতিষ্ঠা করে দেবে, না তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্ণাধিকার দেবে। রাশিয়ার নাইহিলিস্ট্ সম্প্রদায়ের মধ্যে এত স্ত্রীলােকের সংখ্যা দেখে আপাতত আশ্চর্য বােধ হয়। কিন্তু ভেবে দেখলে য়ুরােপে স্ত্রীলােকের প্রলয়মূর্তি ধরবার অনেকটা সময় এসেছে।

 অতএব সবসুদ্ধ দেখা যাচ্ছে, য়ুরােপীয় সভ্যতায় সর্ব বিষয়েই প্রবলতা এমনি অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে যে, অসমর্থ পুরুষই বলো আর অবল রমণীই বলো, দুর্বলদের আশ্রয়স্থান এ সমাজে যেন ক্রমশই লােপ হয়ে যাচ্ছে। এখন কেবলই কার্য চাই, কেবলই শক্তি চাই, কেবলই গতি চাই; দয়া দেবার এবং দয়া নেবার, ভালােবাসার এবং ভালােবাসা পাবার যারা যােগ্য তাদের এখানে যেন সম্পূর্ণ অধিকার নেই। এই জন্যে স্ত্রীলােকেরা যেন তাদের স্ত্রীস্বভাবের জন্যে সজ্জিত। তারা বিধিমতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে, ‘আমাদের কেবল যে হৃদয় আছে তা নয় আমাদের বলও আছে।’ অতএব ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে!’ হায়, আমরা ইংরাজশাসিত বাঙালিরাও সেইভাবেই বলছি ‘নাহি কি বল এ ভুজমৃণালে’।

 এই তো অবস্থা। কিন্তু ইতিমধ্যে যখন ইংলন্‌ডে আমাদের স্ত্রীলোেকদের দুরবস্থার উল্লেখ করে মুষলধারায় অশ্রুবর্ষণ হয় তখন এতটা অজস্র করুণা বৃথা নষ্ট হচ্ছে ব’লে মনে অত্যন্ত আক্ষেপ উপস্থিত হয়। ইংরাজের মুলুকে আমরা অনেক আইন এবং অনেক আদালত পেয়েছি। দেশে যত চোর আছে পাহারাওয়ালার সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশি। নিয়ম সুশৃঙ্খলা সম্বন্ধে কথাটি কবার যাে নেই। ইংরাজ আমাদের সমস্ত দেশটিকে ঝেড়েঝুড়ে, নিংড়ে, ভাঁজ ক’রে, পাট ক’রে, ইস্ত্রি ক’রে, নিজের বাক্সর মধ্যে পুরে তার উপর জগদ্দল হয়ে চেপে বসে আছে। আমরা ইংরাজের সতর্কতা, সচেষ্ট, প্রখর বুদ্ধি, সুশৃঙ্খল কর্মপটুতার অনেক পরিচয় পেয়ে থাকি; যদি কোনো-কিছুর অভাব অনুভব করি তবে সে এই স্বর্গীয় করুণার— নিরুপায়ের প্রতি ক্ষমতাশালীর অবজ্ঞাবিহীন অমুকুল প্রসন্ন ভাবের। আমরা উপকার অনেক পাই, কিন্তু দয়া কিছুই পাই নে। অতএব যখন এই দুর্লভ করুণার অস্থানে অপব্যয় দেখি তখন ক্ষোভের আর সীমা থাকে না।

 আমরা তো দেখতে পাই আমাদের দেশের মেয়েরা তাঁদের সুগোল কোমল দুটি বাহুতে দুগাছি বালা প’রে সিঁথের মাঝখানটিতে সিঁদুরের রেখা কেটে সদাপ্রসন্নমুখে স্নেহ প্রেম কল্যাণে আমাদের গৃহ মধুর করে রেখেছেন। কখনো কখনো অভিমানের অশ্রুজলে তাঁদের নয়নপল্লব আর্দ্র হয়ে আসে, কখনো বা ভালোবাসার গুরুতর অত্যাচারে তাঁদের সরল সুন্দর মুখশ্রী ধৈর্যগম্ভীর সকরুণ বিষাদে ম্লানকান্তি ধারণ করে— কিন্তু রমণীর অদৃষ্টক্রমে দুর্‌বৃত্ত স্বামী এবং অকৃতজ্ঞ সন্তান পৃথিবীর সর্বত্রই আছে— বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হওয়া যায় ইংলন্‌ডেও তার অভাব নেই। যা হোক, আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি এবং তাঁরা যে বড় অসুখী আছেন এমনতর আমাদের কাছে তো কখনো প্রকাশ করেন নি, মাঝের থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে লোকের অনর্থক হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় কেন?

 পরস্পরের সুখদুঃখ সম্বন্ধে লোকে স্বভাবতই অত্যন্ত ভুল করে থাকেন। মৎস্য যদি উত্তরোত্তর সভ্যতার বিকাশে সহসা মানবহিতৈষী হয়ে উঠে, তা হলে সমস্ত মানবজাতিকে একটা শৈবাল বহুল গভীর সরোবরের মধ্যে নিমগ্ন না করে কিছুতে কি তার করুণ হৃদয়ের উৎকণ্ঠা দূর হয়? তোমরা বাহিরে সুখী আমরা গৃহে সুখী, এখন আমাদের সুখ তোমাদের বোঝাই কী করে?

 একজন লেডি-ডফারিন স্ত্রীডাক্তার আমাদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করে যখন দেখে অপরিচ্ছন্ন ছোটো কুঠরি, ছোটো ছোটো জালনা, বিছানাটা নিতান্ত দুগ্ধফেননিভ নয়, মাটির প্রদীপ, দড়িবাঁধা মশারি, আর্ট্ স্টডিয়োর রঙ-লেপা ছবি, দেয়ালের গাত্রে দীপশিখার কলঙ্ক এবং বহুজনের বহুদিনের মলিন করতলের চিহ্ন— তখন সে মনে করে কী সর্বনাশ, কী ভয়ানক কষ্টের জীবন, এদের পুরুষেরা কী স্বার্থপর, স্ত্রীলোকদের জন্তুর মতো করে রেখেছে! জানে না আমাদের দশাই এই। আমরা মিল পড়ি, স্পেন্সর পড়ি, রঙ্কিন পড়ি, আপিসে কাজ করি, খবরের কাগজে লিখি, বই ছাপাই, ঐ মাটির প্রদীপ জ্বালি, ঐ মাদুরে বসি, অবস্থা কিঞ্চিৎ সচ্ছল হলে অভিমানিনী সহধর্মিণীর গহনা গড়িয়ে দিই, এবং ঐ দড়িবাঁধা মোটা মশারির মধ্যে আমি, আমার স্ত্রী এবং মাঝখানে একটি কচি খোকা নিয়ে তালপাতার হাতপাখা খেয়ে রাত্রি যাপন করি।

 কিন্তু আশ্চর্য এই, তবু আমরা নিতান্ত অধম নই। আমাদের কৌচ কার্পেট কেদারা নেই বললেই হয়, কিন্তু তবুও তো আমাদের দয়ামায়া ভালোবাসা আছে। তক্তপোশের উপর অর্ধশয়ান অবস্থায় এক হাতে তাকিয়া আঁকড়ে ধরে তোমাদের সাহিত্য পড়ি, তবুও তো অনেকটা বুঝতে পারি এবং সুখ পাই; ভাঙা প্রদীপে খোলা গায়ে তোমাদের ফিলজফি অধ্যয়ন করে থাকি, তবু তার থেকে এত বেশি আলো পাই যে, আমাদের ছেলেরাও অনেকটা তোমাদেই মতো বিশ্বাসবিহীন হয়ে আসছে।

 আমরাও আবার তোমাদের ভাব বুঝতে পারি নে। কৌচকেদারা খেলাধুলা তোমরা এত ভালোবাস যে স্ত্রী পুত্র না হলেও তোমাদের বেশ চলে যায়। আরামটি তোমাদের আগে, তার পরে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা নিতান্তই আবশ্যক, তার পরে প্রাণপণ চেষ্টায় ইহজীবনে কিছুতেই আর আরামের জোগাড় হয়ে ওঠে না।

 অতএব, আমরা যখন বলি ‘আমরা যে বিবাহ করে থাকি সেটা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার প্রতি লক্ষ রেখে পারত্রিক মুক্তিসাধনের জন্য’,কথাটা খুব জাঁকালো শুনতে হয়, কিন্তু তবু সেটা মুখের কথা মাত্র এবং তার প্রমাণ সংগ্রহ করবার জন্য আমাদের বর্তমান সমাজ পরিত্যাগ করে প্রাচীন পুঁথির পাতার মধ্যে প্রবেশ-পূর্বক ব্যস্তভাবে গবেষণা করে বেড়াতে হয়। প্রকৃত সত্য কথাটা হচ্ছে, ও না হলে আমাদের চলে না— আমরা থাকতে পারি নে। আমরা শুশুকের মতো কর্মতরঙ্গের মধ্যে দিগ্‌বাজি খেলে বেড়াই বটে, কিন্তু চট্ করে অমনি যখন-তখন অন্তঃপুরের মধ্যে হুস্ করে হাঁফ ছেড়ে না এলে আমরা বাঁচি নে। যিনি যাই বলুন সেটা পারলৌকিক সদ্গতির জন্যে নয়।

 এমন অবস্থায় আমাদের সমাজের ভালো হচ্ছে কি মন্দ হচ্ছে সে কথা এখানে বিচার্য নয়; সে কথা নিয়ে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হয়ে গেছে। এখানে কথা হচ্ছিল, আমাদের স্ত্রীলোকেরা সুখী কি অসুখী। আমার মনে হয় আমাদের সমাজের যে রকম গঠন তাতে সমাজের ভালোমন্দ যাই হোক আমাদের স্ত্রীলোকেরা বেশ এক রকম সুখে আছে। ইংরাজেরা মনে করতে পারেন লন টেনিস না খেললে এবং ‘বলে’ না নাচলে স্ত্রীলোক সুখী হয় না; কিন্তু আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস, ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ। তবে সেটা একটা কুসংস্কার হতেও পারে।

 আমাদের পরিবারে নারীহৃদয় যেমন বিচিত্র ভাবে চরিতার্থতা লাভ করে এমন ইংরাজ পরিবারে অসম্ভব। এই জন্যে একজন ইংরাজ মেয়ের পক্ষে চিরকুমারী হওয়া দারুণ দুরদৃষ্টতা। তাদের শূন্যহৃদয় ক্রমশ নীরস হয়ে আসে, কেবল কুকুরশাবক পালন করে এবং সাধারণহিতার্থে সভা পােষণ করে আপনাকে ব্যাপৃত রাখতে চেষ্টা করে। যেমন মৃতবৎসা প্রসূতির সঞ্চিত স্তন্য কৃত্রিম উপায়ে নিক্রান্ত করে দেওয়া তার স্বাস্থ্যের পক্ষে আবশ্যক তেমনি য়ুরােপীয় চিরকুমারীর নারীহৃদয়সঞ্চিত স্নেহরস নানা কৌশলে নিস্ফল ব্যয় করতে হয় কিন্তু তাতে তাদের আত্মার প্রকৃত পরিতৃপ্তি হতে পারে না।

 ইংরাজ old maidএর সঙ্গে আমাদের বালবিধবার তুলনা বােধ হয় অন্যায় হয় না। সংখ্যায় বােধ করি ইংরাজ কুমারী এবং আমাদের বালবিধবা সমান হবে, কিম্বা কিছু যদি কমবেশ হয়। বাহ্য সাদৃশ্যে আমাদের বিধবা য়ুরােপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবার নারীপ্রকৃতি কখনাে শুষ্ক শূন্য় পতিত থেকে অনুর্বরতা-লাভের অবসর পায় না। তাঁর কোল কখনাে শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকর্মণ্য থাকে না, হৃদয় কখনাে উদাসীন থাকে না। তিনি কখনাে জননী, কখনাে দুহিতা, কখনাে সখী। এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরস স্নেহশীল সেবাতৎপর হয়ে থাকেন। বাড়ি শিশুরা তাঁরই চোখের সামনে জন্মগ্রহণ করে এবং তাঁরই কোলে কোলে বেড়ে ওঠে। বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে স্নেহ ভক্তি পরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়ের ভালােবাসে তাও তাঁর অভাব নেই। এবং ওই মধ্যে রামায়ণ-মহাভারত দুটো একটা পুরাণ পড়বার কিম্বা শোনবার সময় থাকে, এবং সন্ধ্যাবেলায় ছোটো ছোটো ছেলেদের কোলের কাছে টেনে নিয়ে উপকথা বলাও একটা স্নেহের কাজ বটে। বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্‌বৃত্ত থাকতে প্রায় দেখা যায় না।

 এই-সকল কারণে, তোমাদের যে-সকল মেয়ে প্রমোদের আবর্তে অহর্নিশি ঘূর্ণ্যমান কিম্বা পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত, কিম্বা দুটো-একটা কুকুরশাবক এবং চারটে-পাঁচটা সভা কোলে করে একাকিনী কৌমার্য কিম্বা বৈধব্য-যাপনে নিরত, তাদের চেয়ে যে আমাদের অন্তঃপুরচারিণীরা অসুখী এ কথা আমার মনে লয় না। ভালোবাসাহীন বন্ধনহীন শূন্য স্বাধীনতা নারীর পক্ষে অতি ভয়ানক― মরুভূমির মধ্যে অপর্যাপ্ত স্বাধীনতা গৃহীলোকের পক্ষে যেমন ভীষণ শূন্য।

 আমরা আর যাই হই, আমরা গৃহস্থ জাতি। অতএব বিচার করে দেখতে গেলে আমরা আমাদের রমণীদের দ্বারেই অতিথি; তারাই আমাদের সর্বদা বহু যত্ন আদর করে রেখে দিয়েছেন। এমনি আমাদের সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে নিয়েছেন যে, আমরা ঘর ছেড়ে দেশ ছেড়ে দুদিন টিঁকতে পারি নে; তাতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয় সন্দেহ নেই কিন্তু তাতে করে নারীরা অসুখী হয় না।

 আমাদের সমাজে স্ত্রীলোেকদের সম্বন্ধে যে কিছুই করবার নেই, আমাদের সমাজ যে সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বসম্পূর্ণ এবং আমাদের স্ত্রীলোকদের অবস্থা তার একটা প্রমাণ, এ কথা বলা আমার অভিপ্রায় নয়। আমাদের রমণীদের শিক্ষার অঙ্গহীনতা আছে এবং অনেক বিষয়ে তাঁদের শরীর মনের সুখসাধন করাকে আমরা উপেক্ষা এবং উপহাস-যোগ্য জ্ঞান করি। এমন-কি, রমণীদের গাড়িতে চড়িয়ে স্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করানোকে আমাদের দেশের পরিহাসরসিকেরা একটা পরম হাস্যরসের বিষয় বলে স্থির করেন। কিন্তু তবুও মোটের উপর বলা যায় আমাদের স্ত্রী কন্যারা সর্বদাই বিভীষিকারাজ্যে বাস করছেন না, এবং তাঁরা সুখী।

 তাঁদের মানসিক শিক্ষা সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে এই প্রশ্ন ওঠে, আমরা পুরুষেরাই কি খুব বেশি শিক্ষিত? আমরা কি এক রকম কাঁচা-পাকা জোড়াতাড়া অদ্ভুত ব্যাপার নই? আমাদের কি পর্যবেক্ষণশক্তি বিচারশক্তি এবং ধারণাশক্তির বেশ সুস্থ সহজ এবং উদার পরিণতি লাভ হয়েছে? আমরা কি সর্বদাই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অপ্রকৃত কল্পনাকে মিশ্রিত করে ফেলি নে এবং অন্ধসংস্কার কি আমাদের যুক্তিরাজ্যসিংহাসনের অর্ধেক অধিকার করে সর্বদাই অটল এবং দাম্ভিক ভাবে বসে থাকে না? আমাদের এই রকম দুর্বল শিক্ষা এবং দুর্বল চরিত্রের জন্য সর্বদাই কি আমাদের বিশ্বাস এবং কার্যের মধ্যে একটা অদ্ভুত অসংগতি দেখা যায় না? আমাদের বাঙালিদের চিন্তা এবং মত এবং অনুষ্ঠানের মধ্যে কি এক প্রকার শৃঙ্খলাসংযমহীন বিষম বিজড়িত ভার লক্ষিত হয় না?

 আমরা সুশিক্ষিতভাবে দেখতে শিখি নি, ভাবতে শিখি নি, কাজ করতে শিখি নি, সেই জন্যে আমাদের কিছুর মধ্যেই স্থিরত্ব নেই। আমরা যা বলি, যা করি, সমস্ত খেলার মতো মনে হয়; সমস্ত অকালমুকুলের মতো ঝরে গিয়ে মাটি হয়ে যায়। সেইজন্যে আমাদের রচনা ডিবেটিং ক্লাবের এসের মতো, আমাদের মতামত সূক্ষ্ম তর্কচাতুরী প্রকাশের জন্য, জীবনের ব্যবহারের জন্য নয়— আমাদের বুদ্ধি কুশাঙ্কুরের মতো তা কিন্তু তাতে অস্ত্রের বল নেই। আমাদেরই যদি এই দশা তো আমাদের স্ত্রীলোকদের কতই বা শিক্ষা হবে! স্ত্রীলােকেরা স্বভাবতই সমাজের যে অন্তরের স্থান অধিকার করে থাকেন সেখানে পাক ধরতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। য়ুরােপের স্ত্রীলোেকদের অবস্থা আলােচনা করলেও তাই দেখা যায়। অতএব আমাদের পুরুষদের শিক্ষার বিকাশ-লাভের পূর্বেই যদি আমাদের অধিকাংশ নারীদের শিক্ষার সম্পূর্ণতা প্রত্যাশা করি তা হলে ঘােড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার প্রয়াস প্রকাশ পায়।

 তবে এ কথা বলতেই হয় ইংরাজ স্ত্রীলােক অশিক্ষিত থাকলে যতটা অসম্পূর্ণস্বভাব থাকে আমাদের পরিপূর্ণ গৃহের প্রসাদে আমাদের রমণীর জীবনের শিক্ষা সহজেই তার চেয়ে অধিকতর সম্পূর্ণতা লাভ করে।

 কিন্তু এই বিপুল গৃহের ভারে আমাদের জাতির আর বৃদ্ধি হতেই পেলে না। গার্হস্থ্য উত্তরােত্তর এমনি অসম্ভব প্রকাণ্ড হয়ে পড়েছে যে, নিজ গৃহের বাহিরের জন্যে আর কারও কোনাে শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। অনেকগুলায় একত্রে জড়ীভূত হয়ে সকলকেই সমান খর্ব করে রেখে দেয়। সমাজটা অত্যন্ত ঘনসন্নিবিষ্ট একটা জঙ্গলের মতাে হয়ে যায়, তার সহস্র বাধাবন্ধনের মধ্যে কোনােএক জনের মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠা বিষম শক্ত হয়ে পড়ে।

 এই ঘনিষ্ঠ পরিবারের বন্ধনপাশে পড়ে এ দেশে জাতি হয় না, দেশ হয় না, বিশ্ববিজয়ী মনুষ্যত্ব বৃদ্ধি পায় না। পিতামাতা হয়েছে, পুত্র হয়েছে, ভাই হয়েছে, স্ত্রী হয়েছে, এবং এই নিবিড় সমাজশক্তির প্রতিক্রিয়াবশে অনেক বৈরাগী সন্ন্যাসীও হয়েছে, কিন্তু বৃহৎ সংসারের জন্যে কেউ জন্মে নি— পরিবারকেই আমরা সংসার বলে থাকি।

 কিন্তু য়ুরােপে আবার আর-এক কাণ্ড দেখা যাচ্ছে। য়ুরােপীয়ের গৃহবন্ধন অপেক্ষাকৃত শিথিল ব’লে তাঁদের মধ্যে অনেকে যেমন সমস্ত ক্ষমতা স্বজাতি কিম্বা মানব -হিতব্রতে প্রয়ােগ করতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি আর-এক দিকে অনেকেই সংসারের মধ্যে কেবলমাত্র নিজেকেই লালন পালন পােষণ করবার সুদীর্ঘ অবসর এবং সুযােগ পাচ্ছেন। এক দিকে যেমন বন্ধনহীন পরহিতৈষা আর-এক দিকেও তেমনি বাধাবিহীন স্বার্থপরতা। আমাদের যেমন প্রতিবৎসর পরিবার বাড়ছে, ওদের তেমনি প্রতিবৎসর আরাম বাড়ছে। আমরা বলি যাবৎ দারপরিগ্রহ না হয় তাবৎ পুরুষ অর্ধেক, ইংরাজ বলে যতদিন একটি ক্লাব না জোটে ততদিন পুরুষ অর্ধাঙ্গ। আমরা বলি সন্তানে গৃহ পরিবৃত না হলে গৃহ শ্মশানসমান, ইংরাজ বলেন আসবাব-অভাবে গৃহ শ্মশানতুল্য।

 সমাজে একবার যদি এই বাহ্যসম্পদ্‌কে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সে এমনি প্রভু হয়ে বসে যে, তার হাত আর সহজে এড়াবার যাে থাকে না। তবে ক্রমে সে গুণের প্রতি অবজ্ঞা এবং মহত্ত্বের প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করতে আরম্ভ করে। সম্প্রতি এ দেশেও তার অনেকগুলি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। ডাক্তারিতে যদি কেহ পসার করতে ইচ্ছা করেন, তবে তাঁর সর্বাগ্রেই যুড়িগাড়ি এবং বড়াে বাড়ির আবশ্যক; এই জন্যে অনেক সময়ে রােগীকে মারতে আরম্ভ করবার পূর্বে নবীন ডাক্তার নিজে মরতে আরম্ভ করেন। কিন্তু আমাদের কবিরাজ-মহাশয় যদি চটি এবং চাদর পরে পাল্কিঅবলম্বন-পুর্বক যাতায়াত করেন তাতে তাঁর পসারের ব্যাঘাত করে না। কিন্তু একবার যদি গাড়ি ঘােড়া ঘড়ি ঘড়ির-চেন’কে আমল দেওয়া হয় তবে সমস্ত চরক সুশ্রুত ধন্বন্তরির সাধ্য নেই যে, আর তার হাত থেকে পরিত্রাণ করে। ইন্দ্রিয়সূত্রে জড়ের সঙ্গে মানুষের একটা ঘনিষ্ঠ কুটুম্বিতা আছে, সেই সুযােগে সে সর্বদাই আমাদের কর্তা হয়ে উঠে। এইজন্যে প্রতিমা প্রথমে ছল করে মন্দিরে প্রবেশ করে, তার পরে দেবতাকে অতিষ্ঠ করে তােলে। গুণের বাহ্যনিদর্শন স্বরূপ হয়ে ঐশ্বর্য দেখা দেয়, অবশেষে বাহ্যাড়ম্বরের অনুবর্তী হয়ে না এলে গুণের আর সম্মান থাকে না।

 বেগবতী মহানদী নিজে বালুকা সংগ্রহ করে এনে অবশেষে নিজের পথরােধ করে বসে। য়ুরােপীয় সভ্যতাকে সেই রকম প্রবল নদী বলে এক-একবার মনে হয়। তার বেগের বলে, মানুষের পক্ষে যা সামান্য আবশ্যক এমন-সকল বস্তুও চতুর্দিক থেকে আনীত হয়ে রাশীকৃত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সভ্যতার প্রতিবর্ষের আবর্জনা পর্বতাকার হয়ে উঠছে। আর আমাদের সংকীর্ণ নদীটি নিতান্ত ক্ষীণস্রোত ধারণ করে অবশেষে মধ্যপথে পারিবারিক ঘন শৈবালজালের মধ্যে জড়ীভূত হয়ে আচ্ছন্নপ্রায় হয়ে গেছে। কিন্তু তারও একটি শােভা সরসতা শ্যামলতা আছে। তার মধ্যে বেগ নেই, বল নেই, ব্যাপ্তি নেই, কিন্তু মৃদুতা স্নিগ্ধতা সহিষ্ণুতা আছে।

 আর, যদি আমার আশঙ্কা সত্য হয়, তবে য়ুরােপীয় সভ্যতা হয়ত বা তলে তলে জড়ত্বের এক প্রকাণ্ড মরুভূমি সৃজন করছে। গৃহ, যা মানুষের স্নেহ প্রেমের নিভৃত নিকেতন, কল্যাণের চিরউৎসভূমি, পৃথিবীর আর-সমস্তই লুপ্ত হয়ে গেলেও যেখানে একটুখানি স্থান থাকা মানুষের পক্ষে চরম আবশ্যক, স্তূপাকার বাহ্যবস্তুর দ্বারা সেইখানটা উত্তরােত্তর ভরাট করে ফেলছে; হৃদয়ের জন্মভূমি জড় আবরণে কঠিন হয়ে উঠছে।

 নতুবা যে সভ্যতা পরিবারবন্ধনের অনুকুল সে সভ্যতার মধ্যে কি নাইহিলিজ্‌ম্-নামক অতবড়ো একটা সর্বসংহারক হিংস্র প্রবৃত্তির জন্মলাভ সম্ভব হয়? সােস্যালিজ্‌ম্‌, কম্যুনিজ্‌ম্‌ কি কখনাে পিতামাতা ভ্রাতাভগ্নী পুত্রকলত্রের মধ্যে এসে প’ড়ে নখদন্ত বিকাশ করতে পারে? যখন কেবল আপনার সম্পদের বােঝাটি আপনার মাথায় তুলে নিয়ে গৃহত্যাগী সার্থবাহী সংসারপথ দিয়ে একলা চলে তখনি সন্ধ্যাবেলায় ঐ শ্বাপদগুলাে এক লম্ফে স্কন্ধে এসে পড়বার সুযােগ অন্বেষণ করে।

 যা হােক, আমার মতাে অভাজন লােকের পক্ষে য়ুরােপীয় সভ্যতার পরিণাম -অন্বেষণের চেষ্টা অনেকটা আদার ব্যাপারীর জাহাজের তথ্য নেওয়ার মতাে হয়। তবে একটা নির্ভয়ের কথা এই যে, আমি যে-কোনাে অনুমানই ব্যক্ত করিনা কেন, তার সত্য-মিথ্যা-পরীক্ষার এত বিলম্ব আছে যে ততদিনে আমি এখানকার দণ্ড পুরস্কারের হাত এড়িয়ে বিস্মৃতিরাজ্যে অজ্ঞাতবাস গ্রহণ করব। অতএব এ-সকল কথা যিনি যে ভাবেই নিন আমি তার জবাবদিহি করতে চাই না। কিন্তু য়ুরােপের স্ত্রীলােক সম্বন্ধে যে কথাটা বলছিলুম সেটা নিতান্ত অবজ্ঞার যােগ্য বলে আমার বােধ হয় না।

 যে দেশে গৃহ নষ্ট হয়ে ক্রমে হােটেল-বৃদ্ধি হচ্ছে― যে-যার নিজে নিজে উপার্জন করছে এবং আপনার ঘরটি, easy-chairটি, কুকুরটি, ঘােড়াটি, বন্দুকটি, চুরটের পাইপটি এবং জুয়া খেলবার ক্লাবটি নিয়ে নির্বিঘ্ন আরামের চেষ্টায় প্রবৃত্ত আছে সেখানে নিশ্চয়ই মেয়েদের মৌচাক ভেঙে গেছে। পূর্বে সেবক-মক্ষিকারা মধু অন্বেষণ করে চাকে সঞ্চয় করত এবং রাজ্ঞী-মক্ষিকারা কর্তৃত্ব করতেন; এখন স্বার্থপরগণ যে-যার নিজের নিজের চাক ভাড়া করে সকালে মধু-উপার্জন-পূর্বক সন্ধ্যা পর্যন্ত একাকী নিঃশেষে উপভােগ করছে। সুতরাং রানী-মক্ষিকাদের এখন বেরােতে হচ্ছে, কেবল মাত্র মধুদান এবং মধুপান করবার আর সময় নেই। বর্তমান অবস্থা এখনাে তাঁদের স্বাভাবিক হয়ে যায় নি, এই জন্যে অনেকটা পরিমাণে অসহায়ভাবে তাঁরা ইতস্ততঃ ভন্ ভন্ করে বেড়াচ্ছেন। আমরা আমাদের মহারানীদের রাজত্বে বেশ আছি এবং তাঁরাও আমাদের অন্তঃপুর অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক সমাজের মর্মস্থানটি অধিকার ক’রে সকল-ক’টিকে নিয়ে বেশ সুখে আছেন।

 কিন্তু সম্প্রতি সমাজের নানা বিষয়ে অবস্থান্তর ঘটছে। দেশের আর্থিক অবস্থার এমন পরিবর্তন হয়েছে যে, জীবনযাত্রার প্রণালী স্বতঃই ভিন্ন আকার ধারণ করছে এবং সেই সূত্রে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার কালক্রমে কঞ্চিৎ বিশ্লিষ্ট হবার মতাে বােধ হচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্রমশঃ আমাদের স্ত্রীলােকদের অবস্থা-পরিবর্তন আবশ্যক এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। কেবল মাত্র গৃহলুণ্ঠিত কোমল হৃদয়রাশি হয়ে থাকলে চলবে না, মেরুদণ্ডের উপর ভর করে উন্নত উৎসাহী ভাবে স্বামীর পার্শ্বচারিণী হতে হবে।

 অতএব স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত না হলে বর্তমান শিক্ষিতসমাজে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য নষ্ট হয়। আমি স্থানান্তরে অন্য এক প্রবন্ধে বলেছি, আমাদের দেশে বিদেশী শিক্ষা প্রচলিত হওয়াতে, ইংরাজি যে জানে এবং ইংরাজি যে জানে না তাদের মধ্যে একটা জাতিভেদের মতাে দাঁড়াচ্ছে, অতএব অধিকাংশ স্থলেই আমাদের বরকন্যার মধ্যে যথার্থ অসবর্ণ বিবাহ হচ্ছে। এক জনের চিন্তা, চিন্তার ভাষা, বিশ্বাস এবং কাজ, আর-একজনের সঙ্গে বিস্তর বিভিন্ন। এইজন্যে আমাদের আধুনিক দাম্পত্যে অনেক প্রহসন এবং সম্ভবতঃ অনেক ট্র্যাজেডিও ঘটে থাকে। স্বামী যেখানে ঝাঁঝালাে সােডাওয়াটার চায়, স্ত্রী সেখানে সুশীতল ডাবের জল এনে উপস্থিত করে।

 এই জন্যে সমাজে স্ত্রীশিক্ষা ক্রমশই প্রচলিত হচ্ছে। কারও বক্তৃতায় নয়, কর্তব্যজ্ঞানে নয়, আবশ্যকের বশে।

 এখন, অন্তরে বাহিরে এই ইংরাজি শিক্ষা প্রবেশ করে সমাজের অনেক ভাবান্তর উপস্থিত করবেই সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা আশা করেন আমরা এই শিক্ষার প্রভাবে য়ুরােপীয় সভ্যতার মধ্যে প্রাচ্যলীলা সম্বরণ করে পরম পাশ্চাত্যলােক লাভ করব— আমার আশা এবং আমার বিশ্বাস তাঁদের সে আশঙ্কা ব্যর্থ হবে।

 কারণ, যেমন শিক্ষাই পাই-না কেন, আমাদের একেবারে রূপান্তর হওয়া অসম্ভব। ইংরাজি শিক্ষা আমাদের কেবল কতকগুলি ভাব এনে দিতে পারে, কিন্তু তার সমস্ত অনুকূল অবস্থা এনে দিতে পারে না। ইংরাজি সাহিত্য পেতে পারি, কিন্তু ইংলন্‌ড্‌, পাব কোথা থেকে। বীজ পাওয়া যায়, কিন্তু মাটি পাওয়াই কঠিন।

 দৃষ্টান্তস্বরূপে দেখানাে যেতে পারে, বাইব্‌ল্‌ যদিও বহুকাল হতে য়ুরোপের প্রধান শিক্ষার গ্রন্থ, তথাপি য়ুরােপ আপন অসহিষ্ণু দুর্দান্ত ভাব রক্ষা করে এসেছে; বাইবেলের ক্ষমা এবং নম্রতা এখন তাদের অন্তরকে গলাতে পারে নি।

 আমার তো বােধ হয় য়ুরােপের পরম সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, য়ুরোপে বাল্যকাল হতে এমন একটি শিক্ষা পাচ্ছে যা তার প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুযায়ী নয়, যা তার সহজ স্বভাবের কাছে নূতন অধিকার এনে দিচ্ছে এবং সর্বদা সংঘাতের দ্বারা তাকে মহত্ত্বের পথে জাগ্রত করে রাখছে।

 য়ুরোপ কেবল যদি নিজের প্রকৃতি-অনুসারিণী শিক্ষা লাভ করত তা হলে য়ুরোপের আজ এমন উন্নতি হত না। তা হলে য়ুরােপের সভ্যতার মধ্যে এমন ব্যাপ্তি থাকত না, তা হলে একই উদারক্ষেত্রে এত ধর্মবীর এবং কর্মবীরের অভ্যুদয় হত না। খৃষ্টধর্ম সর্বদাই য়ুরােপের স্বর্গ এবং মর্ত, মন এবং আত্মার মধ্যে, সামঞ্জস্য সাধন করে রেখেছে।

 খৃষ্টীয় শিক্ষা কেবল যে তলে তলে য়ুরােপীয় সভ্যতার মধ্যে আধ্যাত্মিক রসের সঞ্চার করছে তা নয়, তার মানসিক বিকাশের কত সহায়তা করেছে বলা যায় না। য়ুরোপের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাইব্‌ল্‌-সহযােগে প্রাচ্যভাব প্রাচ্যকল্পনা য়ুরোপের হৃদয়ে স্থান লাভ ক’রে সেখানে কত কবিত্ব কত সৌন্দর্য বিকাশ করেছে। উপদেশের দ্বারায় নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নজাতীয় ভাবের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্রবের দ্বারায় তার হৃদয়ের সার্বজনীন অধিকার যে কত বিস্তৃত করেছে তা আজ কে বিশ্লেষ করে দেখাতে পারে?

 সৌভাগ্যক্রমে আমরা যে শিক্ষা প্রাপ্ত হচ্ছি তাও আমাদের প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুগত নয়। এই জন্যে আশা করছি এই নূতন শক্তির সমাগমে আমাদের বহুকালের একভাবাপন্ন জড়ত্ব পরিহার করতে পারব, নবজীবনহিল্লোলের স্পর্শে সজীবতা লাভ করে পুনরায় নবপত্রপুষ্পে বিকশিত হয়ে উঠব, আমাদের মানসিক রাজ্য সুদূরবিস্তৃতি লাভ করতে পারবে।

 কেহ কেহ বলেন য়ুরােপের ভালাে য়ুরােপের পক্ষেই ভালাে, আমাদের ভালাে আমাদেরই ভালাে। কিন্তু কোনাে প্রকৃত ভালাে কখনােই পরস্পরের প্রতিযােগী নয়, তারা অনুযােগী। অবস্থা-বশতঃ আমরা কেহ একটাকে কেহ আর-একটাকে প্রাধান্য দিই, কিন্তু মানবের সর্বাঙ্গীণ হিতের প্রতি দৃষ্টি করলে কাউকেই দূর করে দেওয়া যায় না। এমন-কি, সকল ভালাের মধ্যেই এমন একটি পারিবারিক বন্ধন আছে যে, এক জনকে দূর করলেই আর-এক জন দুর্বল হয় এবং অঙ্গহীন মনুষ্যত্ব ক্রমশঃ আপনার গতি বন্ধ করে সংসারপথপার্শ্বে এক স্থানে স্থিতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয় এবং এই নিরুপায় স্থিতিকেই উন্নতির চূড়ান্ত পরিণাম বলে আপনাকে ভােলাতে চেষ্টা করে।

 গাছ যদি সহসা বুদ্ধিমান কিম্বা অত্যন্ত সহৃদয় হয়ে ওঠে তা হলে সে মনে মনে এমন তর্ক করতে পারে যে, মাটিই আমার জন্মস্থান, অতএব কেবল মাটির রস আকর্ষণ করেই আমি বাঁচব। আকাশের রৌদ্রবৃষ্টি আমাকে ভুলিয়ে আমার মাতৃভূমি থেকে আমাকে ক্রমশই আকাশের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, অতএব আমরা নব্যতরুসম্প্রদায়েরা একটা সভা করে এই সততচঞ্চল পরিবর্তনশী-রৌদ্রবৃষ্টিরায়ুর সংস্পর্শ বহুপ্রযত্নে পরিহার-পুর্বক আমাদের ধ্রুব অটল সনাতন ভূমির একান্ত আশ্রয় গ্রহণ করব। কিম্বা সে এমন তর্কও করতে পারে যে, ভূমিটা অত্যন্ত স্থূল হেয় এবং নিম্নবর্তী, অতএব তার সঙ্গে কোনাে আত্মীয়তা না রেখে আমি চাতকপক্ষীর মতাে কেবল মেঘের মুখ চেয়ে থাকব।―

 দুয়েতেই প্রকাশ পায় বৃক্ষের পক্ষে যতটা আবশ্যক তার চেয়ে তার অনেক অধিক বুদ্ধির সঞ্চার হয়েছে।

 তেমনি বর্তমান কালে যাঁরা বলেন ‘আমরা আর্যশাস্ত্রের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে বাহিরের শিক্ষা হতে আপনাকে রক্ষা করবার জন্যে আপাদমস্তক আচ্ছন্ন করে বসে থাকব’, কিম্বা যাঁরা বলেন ‘হঠাৎ শিক্ষার বলে আমরা আতসবাজির মতাে এক মুহূর্তে ভারতভূতল পরিত্যাগ করে সুদূর উন্নতির জ্যোতিষ্কলােকে গিয়ে হাজির হব’, তাঁরা উভয়েই অনাবশ্যক কল্পনা নিয়ে অতিরিক্ত বুদ্ধিকৌশল প্রয়ােগ করছেন।

 কিন্তু সহজবুদ্ধিতে স্বভাবতই মনে হয় যে, ভারতবর্ষ থেকে শিকড় উৎপাটন করেও আমরা বাঁচব না এবং যে ইংরাজি শিক্ষা আমাদের চতুর্দিকে নানা আকারে বর্ধিত ও প্রবাহিত হচ্ছে তাও আমাদের শিরােধার্য করে নিতেই হবে। মধ্যে মধ্যে দুটোএকটা বজ্রও পড়তে পারে এবং কেবলই যে বৃষ্টি হবে তা নয়, কখনাে কখনাে শিলাবৃষ্টিরও সম্ভাবনা আছে, কিন্তু বিমুখ হয়ে যাব কোথায়! তা ছাড়া এটাও স্মরণ রাখা কর্তব্য, এই-যে নূতন বর্ষার বারিধারা, এতে আমাদের সেই প্রাচীন ভূমির মধ্যেই নবজীবন সঞ্চার করছে।

 অতএব, ইংরাজি শিক্ষায় আমাদের কী হবে? আমরা ইংরাজ হব না, কিন্তু আমরা সবল হব, উন্নত হব, জীবন্ত হব। মােটের উপরে আমরা এই গৃহপ্রিয় শান্তিপ্রিয় জাতিই থাকব; তবে, এখন যেমন ‘ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশ’ তেমনটা থাকবে না। আমাদের বাহিরেও বিশ্ব আছে সে বিষয়ে আমাদের চেতনা হবে। আপনার সঙ্গে পরের তুলনা করে নিজের যদি কোনাে বিষয়ে অনভিজ্ঞ গ্রাম্যতা কিম্বা অতিমাত্র বাড়াবাড়ি থাকে তবে সেটা অদ্ভুত হাস্যকর অথবা দুষণীয় বলে ত্যাগ করতে পারব। আমাদের বহুকালের রুদ্ধ বাতায়নগুলাে খুলে দিয়ে বাহিরের বাতাস এবং পূর্ব-পশ্চিমের দিবালােক ঘরের মধ্যে আনয়ন করতে পারব। যে-সকল নির্জীব সংস্কার আমাদের গৃহের বায়ু দূষিত করছে কিম্বা গতিবিধির বাধারূপে পদে পদে স্থানাবরােধ করে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার বিদ্যুৎ-শিখা প্রবেশ করে কতকগুলিকে দগ্ধ এবং কতকগুলিকে পুনর্জীবিত করে দেবে। আমরা প্রধানতঃ সৈনিক বণিক অথবা পথিক -জাতি না হতেও পারি, কিন্তু আমরা সুশিক্ষিত পরিণতবুদ্ধি সহৃদয় উদারস্বভাব মানবহিতৈষী গৃহস্থ হয়ে উঠতে পারি এবং বিস্তর অর্থসামর্থ্য না থাকলেও সদাসচেষ্ট জ্ঞান-প্রেমের দ্বারা সাধারণ মানবের কিছু সাহায্য করতেও পারি।

 অনেকের কাছে এ ‘আইডিয়াল’টা যথেষ্ট উচ্চ না মনে হতেও পারে, কিন্তু আমার কাছে এটা বেশ সংগত বােধ হয়। এমন-কি, আমার মনে হয় পালােয়ান হওয়া আইডিয়াল নয়, সুস্থ হওয়াই আইডিয়াল। অভ্রভেদী মনুমেণ্ট্ কিম্বা পিরামিড আইডিয়াল নয়, বায়ু ও আলােক -গম্য বাসযােগ্য সুদৃঢ় গৃহই আইডিয়াল।

 একটা জ্যামিতির রেখা যতই দীর্ঘ এবং উন্নত করে তোলা যায় তাকে আকৃতির উচ্চ আদর্শ বলা যায় না। তেমনি মানবের বিচিত্র বৃত্তির সহিত সামঞ্জস্যরহিত একটা হঠাৎগগনস্পর্শী বিশেষত্বকে মনুষ্যত্বের আইডিয়াল বলা যায় না। আমাদের অন্তর এবং বাহিরের সম্যক্ ফুর্তিসাধন ক’রে আমাদের বিশেষ ক্ষমতাকে সুস্থ সুন্দর ভাবে সাধারণ প্রকৃতির অঙ্গীভূত করে দেওয়াই আমাদের যথার্থ সুপরিণতি।

 আমরা গৃহকোণে বসে রুদ্র আর্যতেজে সমস্ত সংসারকে আপনমনে নিঃশেষে ভস্মসাৎ ক’রে দিয়ে, মানবজাতির পনেরাে আনা উনিশ গণ্ডা দুই পাইকে একঘরে ক’রে কল্পনা করি— পৃথিবীর মধ্যে আমরা একটা বিশেষ মহত্ব লাভ করেছি, আমরা আধ্যাত্মিক— পৃথিবীতে আমাদের পদধূলি এবং চরণামৃত বিক্রয় করে চিরকাল আমরা অপরিমিত স্ফীতিভাব রক্ষা করতে পারব। অথচ সেটা আছে কি না আছে ঠিক জানি নে, এবং যদি থাকে তাে কোন্ সবল ভিত্তি অধিকার করে আছে তাও বলতে পারি নে। আমাদের সুশিক্ষিত উদার মহৎ হৃদয়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছে না শাস্ত্রের শ্লোকরাশির মধ্যে নিহিত হয়ে আছে তাও বিবেচনা করে দেখি নে। সকলে মিলে চোখ বুজে নিশ্চিন্ত মনে স্থির করে রেখে দিই কোথাও কোথাও আছে― তা নিজের অন্তরের মধ্যেই হােক আর তুলটের পুঁথির মধ্যেই হােক, বর্তমানের মধ্যেই হোক আর অতীতের মধ্যেই হােক। অর্থাৎ আছেই হোক আর ছিলই হােক, ও একই কথা!

 ধনীর ছেলে যেমন মনে করে ‘আমি ধনী অতএব আমার বিদ্বান হবার কোনাে আবশ্যক নেই— এমন-কি চাকরি-পিপাসুদের মতাে কালেজে পাশ দেওয়া আমার ধনমর্যাদার হানিজনক’, তেমনি আমাদের শ্রেষ্ঠতাভিমানীরা মনে করেন পৃথিবীর মধ্যে আমরা বিশেষ কারণে বিশেষ বড়ো, অতএব আমাদের আর কিছু না করলেও চলে, এমনকি কিছু না করাই কর্তব্য।

 এ দিকে হয়তাে আমার পৈতৃক ধন সমস্ত উড়িয়ে বসে আছি। ব্যাঙ্কে আমার যা ছিল হয়তাে তার কানাকড়ি অবশিষ্ট নেই, কেবল এই কীটদষ্ট চেক-বইটা মাত্র অবশিষ্ট আছে। যখন কেহ দরিদ্র অপবাদ দেয় তখন প্রাচীন লােহার সিন্দুক থেকে ঐ বইটা টেনে নিয়ে তাতে বড়াে বড়ো অঙ্কপাতপূর্বক খুব সতেজে নাম সই করতে থাকি। শত সহস্র লক্ষ কোটি কলমে কিছুই বাধে না। কিন্তু যথার্থ তেজস্বী লােকে এ ছেলেখেলার চেয়ে মজুরি করে সামান্য উপার্জনও শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে।

 অতএব আপাততঃ আমাদের কোনাে বিশেষ মহত্বে কাজ নেই। আমরা যে ইংরাজি শিক্ষা পাচ্ছি সেই শিক্ষা-দ্বারা আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতির অসম্পূর্ণতা দূর ক’রে আমরা যদি পুরা প্রমাণসই একটা মানুষের মতাে হতে পারি তা হলেই যথেষ্ট। তার পরে যদি সৈন্য হয়ে রাঙা কুর্তি প’রে চতুর্দিকে লড়াই ক’রে ক’রে বেড়াই কিম্বা আধ্যাত্মিক হয়ে ঠিক ভ্রূর মধ্যবিন্দুতে কিম্বা নাসিকার অগ্রভাগে অহর্নিশি আপনাকে নিবিষ্ট করে রেখে দিই, সে পরের কথা।

 আশা করি আমরা নানা ভ্রম এবং নানা আঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সেই পূর্ণ মনুষ্যত্বের দিকেই যাচ্ছি। এখন আমরা দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে দোদুল্যমান, তাই উভয় পক্ষের সত্যকেই অনিশ্চিত ছায়ার মতাে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে; কেবল মাঝে মাঝে ক্ষণেকের জন্য মধ্য-আশ্রয়টি উপলব্ধি করে ভবিষ্যতের পক্ষে একটা স্থির আশাভরসা জন্মে। আমার এই অসংলগ্ন অসম্পূর্ণ রচনায় পর্যায়ক্রমে সেই আশা ও আশঙ্কার কথা ব্যক্ত হয়েছে।

 কিন্তু এ-সকল কেবল আমার মনের কথা মাত্র। নতুবা আমি যে য়ুরােপ এবং এসিয়ার মধ্যবর্তী ককাশ্বস পর্বতের সর্বোচ্চ শিখরে চড়ে এই খানকতক কাগজের ভেঁপু পাকিয়ে তার মধ্যে ফুৎকার প্রয়ােগ করছি, যা শুনে যুবক য়ুরোপ সহসা তার কাজকর্ম বন্ধ করে স্তম্ভিত হয়ে ঊর্ধ্বকর্ণে দাঁড়িয়ে যাবে এবং এই গুরুতর দেহভারক্লান্ত প্রাচীনা এসিয়ার অকালে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে মুহুর্‌মুহু হৃৎস্পন্দন হতে থাকবে, এমন উপহাস অনুগ্রহপূর্বক কেউ আমার প্রতি প্রয়ােগ করবেন না।

 কেবল এইটুকুমাত্র দুরাশাকে কোনােমতে মনে স্থান দিয়েছি যে, এই প্রবন্ধে আমার শ্রোতৃবর্গের ক্ষণকালের জন্যে চিত্তবিনােদন হতেও পারে এবং সম্ভবতঃ তাঁদের মনে মধ্যে মধ্যে গুটিকয়েক তর্কের উদয় হবে― যদিও রুচিভেদে সে তর্কের তাঁরা যেমনি মীমাংসা করুন তাতে তাঁদের জীবনযাত্রার লেশমাত্র ভিন্নতা সাধন করবে না। সুধীগণ আমার রচনার বহুল পরিমাণ নীর পরিত্যাগ ক’রে, যৎসামান্য ক্ষীরটুকুমাত্র পথের মধ্যে সম্পূর্ণ পরিপাক-পূর্বক নিরাপদে গৃহে প্রত্যাগত হবেন। এই পরমসুসম্পন্ন চরমশ্রেষ্ঠ বঙ্গসমাজের কিছুমাত্র ইতস্ততঃ হয় এমন দুর্ঘটনা কিছুতেই না ঘটুক—কেবল যদি শ্রোতৃমহােদয়গণের মনে ক্ষণেকের জন্যে এই চিন্তার আভাসমাত্র উদয় হয়ে থাকে যে আমরা যত বড়ােই হই হয়তাে পৃথিবী আমাদের চেয়ে বড়াে, এবং আমাদের সেকাল যত বড়াে কালই হােক না কেন এই অনন্তপ্রবাহিত কালের একটি অংশ মাত্র অধিকার করে ছিল’, যদি মনে সংশয়মাত্র উত্থিত হয় যে ‘কী জানি এই বৃহৎ পৃথিবীতে দৈবক্রমে যদি কোথাও কেহ আমাদের সমকক্ষ থাকে এবং এই অসীমকালে স্বভাবতই এমন পরিবর্তনপরম্পরা ঘটতেও পারে যা আমাদের সনাতন প্রথার আয়ত্তের অতীত’, যদি ভবভূতির সেই মহদ্‌বাক্য কারও স্মরণ হয় যা তিনি অহংকারচ্ছলে উচ্চারণ করে ছিলেন কিন্তু যা শুনে মনে বৃহৎ আশার সঞ্চার হয় এবং ক্ষুদ্র অহংকার আতঙ্কে পলায়ন করে, তবেই আমার শ্রম সফল জ্ঞান করব—

কালােহ্যয়ং নিরবধির্‌বিপুলাচ পৃথ্বী।