য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি/ডায়ারি
শুক্রবার। ২২ আগস্ট্। ১৮৯০। দেশকালের মধ্যে যে-একটা প্রাচীন ঘনিষ্ঠতা আছে, বাষ্পযানে সেটা লোপ করে দেবার চেষ্টা করছে। পূর্বে, সময় দিয়ে দূরত্বের পরিমাণ হত; লোকে বলত এক প্রহরের রাস্তা, দু দিনের রাস্তা। এখন কেবল গজের মাপটাই অবশিষ্ট। দেশকালের চিরদাম্পত্যের মাঝখান দিয়ে অবাধে বড়ো বড়ো কলের গাড়ি এবং কলের জাহাজ চলে যাচ্ছে।
কেবল তাই নয়― আসিয়া এবং আফ্রিকা দুই ভগ্নীর বাহুবন্ধন বিচ্ছিন্ন করে মাঝে বিরহের লবণাম্বুরাশি প্রবাহিত করা হয়েছে। আমেরিকার উত্তর দক্ষিণ যমজ ভ্রাতার মতো জন্মাবধি সংলগ্ন হয়ে আছে, শোনা যায় তাদের মধ্যেও লৌহাস্ত্র-চালনার উদ্যোগ করা হয়েছিল। এমনি করে সভ্যতা সর্বত্রই জলে স্থলে দেশে কালে গৃহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়ে আপনার পথটি করে নেবার চেষ্টা করছে।
এই রকম নানা উপদ্রবে সময়কে দেশছাড়া করে ফল হয়েছে এই যে, দেশের দেশত্ব আর ভালো করে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ, দেশের বৃহত্ত্বকে যদি কালের বৃহত্ত্ব দিয়ে না বুঝি তবে তাকে যথার্থ হৃদয়ঙ্গম করবার আর কোনো উপায় নেই। সে কেবল অঙ্কের মধ্যেই বন্ধ থাকে। অর্থাৎ তহবিলের মধ্যে না থেকে সে কেবল হিসাবের খাতার মধ্যেই থেকে যায়।
য়ুরোপ এবং আসিয়ার মধ্যে যে-একটা প্রকাণ্ড প্রভেদ আছে সেটা বোঝা এখনকার য়ুরোপযাত্রীর পক্ষে অনেকটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুর্বে যখন দীর্ঘ পথ প্রদক্ষিণ করে য়ুরোপে পৌছতে অর্ধেক বৎসর লাগত তখন এই দুই মহাদেশের যথার্থ ব্যবধান সম্পূর্ণ ধারণা করবার দীর্ঘকাল অবসর পাওয়া যেত। এখন ক্রমেই সেটা হ্রাস হয়ে আসছে।
য়ুরােপ, য়ুরােপীয় সভ্যতা, শােনবামাত্র অস্তাচলের পরপারবর্তী এক নূতনজ্যৈাতিরালােকিত অপূর্ব দূরজগতের ভাব সহজেই কল্পনায় উদয় হওয়া উচিত। সেখানে যাত্রা আরম্ভ করবার পূর্বে মনে যথেষ্ট ভয় এবং যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বালকটি বালিকা নববধুর গহনা বিক্রয় এবং বৃদ্ধ পিতার বহুদুঃখসঞ্চিত অর্থ অপহরণ ক’রে সেখানে অনায়াসে নিশ্চিন্ত মনে নিরুদ্বেগে শ্মশ্রূদগমের কিঞ্চিৎ পূর্বেই গােপনে পলায়ন করে এবং শ্মশ্রূদগমের কিঞ্চিৎ পরেই বেশ বদল ক’রে, ঘাড়ের চুল ছেঁটে, দুই রিক্ত পকেটে দুই হাত গুঁজে দিয়ে, বাপের কোম্পানির কাগজ এবং চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে অত্যন্ত চটুল চঞ্চল ভাবে দেশে ফিরে আসে। এই কলেছাঁটা ছােকরাটি যে উনবিংশ শতাব্দীর তীর্থস্থানে গিয়ে মহাসমুদ্রের ঢেউ খেয়ে এসেছে এমনটা কিছুতেই মনে হয় না। মনে হয়, কোন্ এক শখের নাট্যশালায় কিছুকাল অভিনয় করে এল; সেখানকার বাঁকা সুর এখনাে মুখে লেগে আছে, এবং সেখানকার অধিকারীমহাশয় অনুগ্রহপূর্বক সাজের বেশখানি একে দান করেছেন; আর কোনােরকম পারিতােষিক দিয়েছেন কি না বলতে পারি নে।
কিন্তু দেশকালের ঘনিষ্ঠতা যতই হ্রাস হােক, চিরকালের অভ্যাস একেবারে যাবার নয়। যদিও তিন মাসের রিটার্ন্ টিকিট মাত্র নিয়ে য়ুরোপে চলেছি, তবু একটা কাল্পনিক দীর্ঘকালের বিভীষিকা মন থেকে তাড়াতে পারছি নে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিনের জন্যে চলেছি।
এমনতর ঘটনা শােনা যায় যে, ক্ষতচিকিৎসায় একজন লােকের একটা পায়ের আধখানা কেটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আজন্মকালের অভ্যাসবশতঃ সেই বিচ্ছিন্ন অংশের অস্তিত্ব কিছুতেই তার মন থেকে দূর হয় না। তেমনি ভারতবর্ষ এবং য়ুরােপের মাঝখানে স্বভাবতঃ যেএকটা দীর্ঘকালের ব্যবধান আছে সেটা যদিও অর্ধেকের বেশি কেটে ফেলা হয়েছে, তবু আমার মন থেকে সেই অবশিষ্ট অংশ তাড়াতে পারছি নে। বহু দূর, বহু প্রভেদ, এবং বহু কাল, এই তিনটে ভাব এক সঙ্গে উদয় হয়ে হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। সাত সমুদ্র তেরাে নদী -পারবর্তী এই তিন মাসের স্বদেশবিরহকে অত্যন্ত দীর্ঘ বিরহ বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু অনেকে আশঙ্কা করেন, বিরহ-নামক ব্যাপারটা সভ্যতার উপদ্রবে ভবলীলা সম্বরণ করে একান্ত কল্পনাকে প্রাপ্ত হয়েছে। কালিদাসের সময়ে যখন রেলগাড়ি ইস্টিমার পােস্ট্-আপিস ছিল তখনি খাঁটি বিরহ ছিল, এবং তখনকার দিনে বছর-খানেকের জন্য রামগিরিতে বদলি হয়ে যক্ষ যে সুদীর্ঘচ্ছন্দে বিলাপ পরিতাপ করেছিল সে তার পক্ষে অযথা হয় নি। কিন্তু স্তূপাকার তুলো যেমন কলে চেপে একটি পরিমিত গাঁঠে পরিণত হয়, সভ্যতার চাপে আমাদের সমস্তই তেমনি সংক্ষিপ্ত নিবিড় হয়ে আসছে। ছয় মাসকে যাঁতার তলায় ফেলে তিন মাসের মধ্যে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে, পূর্বে যা মুটের মাথার বােঝা ছিল এখন তা পকেটের মধ্যে ধরে। এই সংহতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সুখদুঃখ অল্প পরিসরের মধ্যে অত্যন্ত তীব্রতা প্রাপ্ত হচ্ছে। এখন ছয় মাসের বিরহ তিন মাসের মধ্যে ঘনভাবে বিরাজ করে, তাই মেঘদূতের মতাে অত বড়াে বিরহকাব্য লেখবার আর সময় পাওয়া যায় না। এখন দুই-এক পাতার মধ্যেই গীতিকাব্যের সমাপ্তি হয়; এবং বিদ্যুৎযান যখন প্রচলিত হবে তখন বিরহ এত গাঢ় হবে যে, চতুর্দশপদীও তার পক্ষে ঢিলে বােধ হবে।
আমার অবস্থা সেই রকম। সামান্য এই কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে চলেছি, কিন্তু ভারতবর্ষ একান্ত করুণম্বরে আমাকে আহ্বান করছে।
বলছে-বৎস, কোথায় যাস! কোন্ দূর সমুদ্রের তীরে? কোন্ যক্ষগন্ধর্বদের স্বর্ণপুরীতে? সেখানে আমার আহ্বানস্বর কি আর শুনতে পাবি?― আর যাই করিস, অবজ্ঞার ভাবে চলে যাস নে আর অবজ্ঞার ভাবে ফিরে আসিস নে। আমার দরিদ্রের ঘর, আমার কিছুই নেই, তোরা যা চাস তা সময়ে পাস নে― কিন্তু আমার ঘরে কেউ কি তোদের ভালোবাসে নি? শৈশবে কোনো নতনেত্র তোদর মুখের উপরে জাগ্রত স্নেহালোক বর্ষণ করে নি? রোগের সময় কোনো কোমল করতল তোদের তপ্ত ললাটে স্পর্শসুধা বিতরণ করে নি? ওরে অসন্তুষ্ট চঞ্চলহৃদয়, আমাকে ছেড়ে যাবার সময় কি কেবল দারিদ্র্যদুঃখই ছেড়ে গেলি, জগতের দুর্লভধন ভালোবাসা ছেড়ে গেলি নে? সেই অলকাপুরীতে কোনো দুঃস্বপ্নে যখন আমাকে মনে পড়বে তখন কি আমার স্নেহের কোল মনে পড়বে না, কেবল তার জীর্ণ চীরখানাই মনে পড়বে?
তখন সূর্য অস্তপ্রায়। জাহাজের ছাদের উপর হালের কাছে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের তীরের দিকে চেয়ে রইলুম। সমুত্রের জল সবুজ, তীরের রেখা নীলাভ, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সন্ধ্যা রাত্রির দিকে এবং ঞ্জাহাজ সমুদ্রের মধ্যে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছে। বামে বোম্বাই বন্দরের এক দীর্ঘ রেখা এখনো দেখা যাচ্ছে; দেখে মনে হল আমাদের পিতৃপিতামহের পুরাতন জননী সমুদ্রের বহুদূর পর্যন্ত ব্যাকুল বাহু বিক্ষেপ করে ডাকছেন; বলছেন, আসন্ন রাত্রিকালে অকূল সমুদ্রে অনিশ্চিতের উদ্দেশে যাস নে! এখনো ফিরে আয়!
ক্রমে বন্দর ছাড়িয়ে গেলুম। সন্ধ্যার মেঘাবৃত অন্ধকারটি সমুদ্রের অনন্তশয্যায় দেহ বিস্তার করলে। আকাশে তারা নেই। কেবল দুরে লাইটহাউসের আলো জ্বলে উঠল; সমুদ্রের শিয়রের কাছে সেই কম্পিত দীপশিখা যেন ভাসমান সন্তানদের জন্যে ভূমিমাতার আশঙ্কাকুল জাগ্রত দৃষ্টি।
তখন আমার হৃদয়ের মধ্যে ঐ গানটা ধ্বনিত হতে লাগল—
‘সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।’
জাহাজ বােম্বাই বন্দর পার হয়ে গেল।―
ভাসল তরী সন্ধেবেলা, ভাবিলাম এ জলখেলা,
মধুর বহিবে বায়ু― ভেসে যাব রঙ্গে।
কিন্তু সী-সিক্নেসের কথা কে মনে করেছিল!
যখন সবুজ জল ক্রমে নীল হয়ে এল এবং তরঙ্গে তরীতে মিলে গুরুতর আন্দোলন উপস্থিত করে দিলে, তখন দেখলুম সমুদ্রের পক্ষে জলখেলা বটে, কিন্তু আমার পক্ষে নয়।
ভাবলুম এই বেলা মানে মানে কুঠরির মধ্যে ঢুকে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়িগে। যথাসত্বর ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে কাঁধ হতে কম্বলটি একটি বিছানার উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে দিলুম। ঘর অন্ধকার। বুঝলুম, আলাে নিবিয়ে দিয়ে দাদা তাঁর বিছানায় শুয়েছেন। শারীরিক দুঃখ নিবেদন করে একটুখানি স্নেহ উদ্রেক করবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘দাদা, ঘুমিয়েছেন কি?’ হঠাৎ নিতান্ত বিজাতীয় মােটা গলায় কে-একজন হুহুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘হূজ দ্যাট!’ আমি বললুম, ‘বাস্রে! এ তাে দাদা নয়!’ তৎক্ষণাৎ বিনীত অনুতপ্ত স্বরে জ্ঞাপন করলুম, ‘ক্ষমা করবেন, দৈবক্রমে ভুল কুঠরিতে প্রবেশ করেছি।’ অপরিচিত কণ্ঠ বললে, ‘অল রাইট!’ কম্বলটি পুনশ্চ তুলে নিয়ে কাতরশরীরে সংকুচিতচিত্তে বেরােতে গিয়ে দেখি দরজা খুঁজে পাই নে। বাক্স তােরঙ্গ লাঠি বিছানা প্রভৃতি বিচিত্র জিনিসের মধ্যে খট্ খট্ শব্দে হাৎড়ে বেড়াতে লাগলুম। ইঁদুর কলে পড়লে তার মানসিক ভাব কিরকম হয় এই অবসরে কতকটা বুঝতে পারা যেত, কিন্তু তার সঙ্গে সমুদ্রপীড়ার সংযােগ হওয়াতে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে পড়েছিল।
এ দিকে লােকটা কী মনে করছে! অন্ধকারে পরের ক্যাবিনে ঢুকে বেরােবার নাম নেই― খট্ খট্ শব্দে দশ মিনিট কাল জিনিসপত্র হাৎড়ে বেড়ানাে― এ কি কোনাে সদ্বংশীয় সাধু লােকের কাজ! মন যতই ব্যাকুল হয়ে উঠছে শরীর ততই গলদ্ঘর্ম এবং কণ্ঠাগত অন্তরিন্দ্রিয়ের আক্ষেপ উত্তরােত্তর অবাধ্য হয়ে উঠছে। অনেক অনুসন্ধানের পর যখন হঠাৎ দ্বার-উদ্ঘাটনের গােলকটি, সেই মসৃণ চিকণ শ্বেতকাচনির্মিত দ্বারকর্ণটি হাতে ঠেকল, তখন মনে হল এমন প্রিয়স্পর্শসুখ বহুকাল অনুভব করা হয় নি। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে নিঃসংশয়চিত্তে তার পরবর্তী ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত। গিয়েই দেখি আলাে জ্বলছে, কিন্তু মেঝের উপর পরিত্যক্ত গাউন পেটিকোট প্রভৃতি স্ত্রীলােকের গাত্রাবরণ বিক্ষিপ্ত। আর অধিক কিছু দৃষ্টিপথে পড়বার পূর্বেই পলায়ন করলুম। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে বারবার তিনবার ভ্রম করবার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু তৃতীয়বার পরীক্ষা করতে আমার আর সাহস হল না। এবং সেরূপ শক্তিও ছিল না। অবিলম্বে জাহাজের ছাতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। সেখানে বিহ্বলচিত্তে জাহাজের কাঠরার ’পরে ঝুঁকে পড়ে শরীর মনের একান্ত উদ্বেগ কিঞ্চিৎ লাঘব করা গেল। তার পরে বহুলাঞ্ছিত অপরাধীর মতাে আস্তে আস্তে কম্বলটি গুটিয়ে তার উপর লজ্জিত নতমস্তক স্থাপন করে একটি কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লুম।
কিন্তু, কী সর্বনাশ! এ কার কম্বল! এ তাে আমার নয় দেখছি! যে সুখসুপ্ত বিশ্বস্ত ভদ্রলােকটির ঘরের মধ্যে রাত্রে প্রবেশ করে দশ মিনিট-কাল অনুসন্ধানকার্যে ব্যাপৃত ছিলুম, নিশ্চয় এ তারই। একবার ভাবলুম ফিরে গিয়ে চুপিচুপি তার কম্বল স্বস্থানে রেখে আমারটি নিয়ে আসি; কিন্তু যদি তার ঘুম ভেঙে যায়! পুনর্বার যদি তার ক্ষমা প্রার্থনা করবার আবশ্যক হয়, তবে সে কি আর আমাকে বিশ্বাস করবে! যদি বা করে, তবু এক রাত্রের মধ্যে দুবার ক্ষমা প্রার্থনা করলে নিদ্রাকাতর বিদেশীর খৃষ্টীয় সহিষ্ণুতার প্রতি অতিমাত্র উপদ্রব করা হবে না কি!— আরও একটা ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা মনে উদয় হল। দৈববশতঃ দ্বিতীয়বার যে ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে পড়েছিলুম তৃতীয়বারও যদি ভ্রমক্রমে সেইখানে গিয়েই উপস্থিত হই এবং প্রথম ক্যাবিনের ভদ্রলােকটির কম্বলটি সেখানে রেখে সেখানকার একটি গাত্রাচ্ছাদন তুলে নিয়ে আসি তা হলে কিরকমের একটা রােমহর্ষক প্রমাদপ্রহেলিকা উপস্থিত হয়! আর কিছু নয়, পরদিন প্রাতে আমি কার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে যাব এবং কে আমাকে ক্ষমা করবে! প্রথম ক্যাবিন -চারী হতবুদ্ধি ভদ্রলােকটিকেই বা কী বলব এবং দ্বিতীয় ক্যাবিন -বাসিনী বজ্রাহতা ভদ্ররমণীকেই বা কী বােঝাব? ইত্যাকার বহুবিধ দুশ্চিন্তায় তীব্রতাম্রকূটবাসিত পরের কম্বলের উপর কাষ্ঠাসনে রাত্রি যাপন করলুম।
২৩ আগস্ট্। আমার স্বদেশীয় সঙ্গী বন্ধুটি সমস্ত রাত্রির সুখনিদ্রাবসানে প্রাতঃকালে অত্যন্ত প্রফুল্ল পরিপুষ্ট সুস্থ মুখে ডেকের উপর দর্শন দিলেন। আমি তাঁর দুই হস্ত চেপে ধরে বললুম, ‘ভাই, আমার তাে এই অবস্থা!’— শুনে তিনি আমার বুদ্ধিবৃত্তির উপর কলঙ্ক আরােপণ করে হাস্যসহকারে এমন দুটো-একটা বিশেষণ প্রয়ােগ করলেন যা বিদ্যালয় পরিত্যাগের পর থেকে আর কখনাে শােনা হয় নি। সমস্ত রজনীর দুঃখের পর প্রভাতের এই অপমানটাও নিরুত্তরে সহ্য় করলুম। অবশেষে তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমার ক্যাবিনের ভৃত্যটিকে ডেকে দিলেন। তাকেও আবার একে একে সমস্ত ঘটনাটি খুলে বলতে হল। প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারলে না, মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বেচারার দোষ দেওয়া যায় না। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় নিঃসন্দেহ এ রকম ঘটনা আর কখনো ঘটে নি, সুতরাং শোনবামাত্রই ধারণা হওয়া কিছু কঠিন বটে। অবশেষে বন্ধুতে আমাতে মিলে যখন অনেকটা পরিষ্কার করে বোঝানো গেল, তখন সে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে একবার মুখ ফেরালে এবং ঈষৎ হাসলে— তার পর চলে গেল। কম্বলের কাহিনী অনতিবিলম্বেই সমাপ্ত হল।
কিন্তু সী-সিক্নেস ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সে ব্যাধিটার যন্ত্রণা অনভিজ্ঞ স্থলচরদের কিছুতে বোঝনো যেতে পারে না। নাড়ীতে ভারতবর্ষের অন্ন আর তিলমাত্র অবশিষ্ট রইল না। য়ুরোপে প্রবেশ করবার পূর্বে সমুদ্র এই দেহ হতে ভারতবর্ষটাকে যেন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে একেবারে সাফ করে ফেলবার চেষ্টা করছে। ক্যাবিনে চার দিন পড়ে আছি।
২৬ আগস্ট্। শনিবার থেকে আর আজ এই মঙ্গলবার পর্যন্ত কেটে গেল। জগতে ঘটনা বড়ো কম হয় নি— সূর্য চারবার উঠেছে এবং তিনবার অস্ত গেছে, বৃহৎ পৃথিবীর অসংখ্য জীব দম্ভধাবন থেকে দেশ-উদ্ধার পর্যন্ত বিচিত্র কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনটে দিন মহা ব্যস্তভাবে অতিবাহিত করেছে— জীবনসংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন, আত্মরক্ষা, বংশরক্ষা প্রভৃতি জীবরাজ্যের বড়ো বড়ো ব্যাপার সবেগে চলছিল―কেবল আমি শয্যাগত জীবন্মৃত হয়ে পড়ে ছিলুম। আধুনিক কবিরা কখনও মুহূর্তকে অনন্ত কখনও অনন্তকে মুহূর্ত আখ্যা দিয়ে প্রচলিত ভাষাকে নানাপ্রকার বিপরীত ব্যায়ামবিপাকে প্রবৃত্ত করান। আমি আমার এই চারটে দিনকে বড়ো রকমের একটা মুহূর্ত বলব, না এর প্রত্যেক মুহূর্তকে একটা যুগ বলব, স্থির করতে পারছি নে।
যাইহােক, কষ্টের সীমা নেই। মানুষের মতাে এত বড় একটা উন্নত জীব যে সহসা এতটা উৎকট দুঃখ ভােগ করে তার একটা মহৎ নৈতিক কিম্বা আধ্যাত্মিক কারণ থাকাই উচিত ছিল; কিন্তু জলের উপরে কেবল খানিকটা ঢেউ ওঠার দরুন জীবাত্মার এতাধিক পীড়া নিতান্ত অন্যায় অসংগত এবং অগৌরবজনক বলে বােধ হয়। কিন্তু জাগতিক নিয়মের প্রতি দোষারােপ করে কোনাে সুখ নেই―কারণ, সে নিন্দাবাদে কারও গায়ে কিছু ব্যথা বাজে না, এবং জগৎরচনার তিলমাত্র সংশােধন হয় না।
যন্ত্রণাশয্যায় অচেতনপ্রায় ভাবে পড়ে আছি। কখনাে কখনাে ডেকের উপর থেকে পিয়ানাের সংগীত মৃদু মৃদু কর্ণে এসে প্রবেশ করে, তখন স্মরণ হয় আমার এই সংকীর্ণ শয়নকারাগারের বাইরে সংসারের নিত্য আনন্দস্রোত সমভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। বহুদূরে ভারতবর্ষের পূর্ব সীমায় আমার সেই সংগীতধ্বনিত স্নেহমধুর গৃহ মনে পড়ে। সুখস্বাস্থ্যসৌন্দর্যময় জীবজগৎকে অতিদূরবর্তী ছায়ারাজ্যের মতাে বােধ হয়। মধ্যের এই সুদীর্ঘ মরুপথ অতিক্রম ক’রে কখন্ সেখানকার জীবন-উৎসবের মধ্যে ফিরে যেতে পারব এই কথাই কেবল ভাবি। মঙ্গলবার প্রাতে যখন শরীরের মধ্যে প্রাণটা ছাড়া আর ভৌতিক পদার্থ কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তখন আমার বন্ধু অনেক আশ্বাস দিয়ে আমাকে জাহাজের ‘ডেক’ অর্থাৎ ছাদের উপর নিয়ে গেলেন। সেখানে লম্বা বেতের চৌকিটির উপর পা ছড়িয়ে বসে পুনর্বার এই মর্ত পৃথিবীর স্পর্শ এবং নবজীবনের আস্বাদ লাভ করা গেল।
জাহাজের যাত্রীদের বর্ণনা করতে চাই নে। অতি নিকট হতে কোনাে মসীলিপ্ত লেখনীর সূচ্যগ্রভাগ-যে তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ স্থাপন করতে পারে এ কথা তারা স্বপ্নেও না মনে ক’রে বেশ বিশ্বস্ত চিত্তে ডেকের উপর বিচরণ করছে, টুংটাং শব্দে পিয়ানাে বাজাচ্ছে, বাজি রেখে হার-জিত খেলছে, ধূম্রশালায় বসে তাস পিটচ্ছে— তাদের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। আমরা তিন বাঙালী তিন লম্বা চৌকিতে জাহাজের একটি প্রান্ত সম্পূর্ণ অধিকার করে অবশিষ্ট জনসংখ্যার প্রতি অত্যন্ত ঔদাস্যদৃষ্টিপাত করে থাকি।
আমার বন্ধুর দোষগুণ সমালােচনা করতেও আমি চাই না। ত্রেতাযুগে রাজার পক্ষে প্রজারঞ্জন যেমন ছিল, কলিযুগে লেখকের পক্ষে পাঠকের মনােরঞ্জন সেই রকমের একটা পরম কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখনকার প্রজারঞ্জনকার্যে রামভদ্র স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছিলেন, এখনকার পাঠকরঞ্জনকার্যে লেখকদের অনেক সময়ে আত্মীয়বিচ্ছেদ ঘটে থাকে। কিন্তু স্মরণ রাখা উচিত আত্মীয়েরাও পাঠকশ্রেণীভুক্ত। অধিকাংশ সময়েই নন সে কথা সত্য, কিন্তু তাঁরা নিজে যখন বর্ণনার বিষয় হন তখন আত্মীয়রচিত প্রবন্ধও পাঠ করে থাকেন।
কিন্তু যে বন্ধুর বর্ণনা করবামাত্র বিচ্ছেদ ঘটবার সম্ভাবনা আছে শাস্ত্রমতে তাঁকে সৎসঙ্গ বলা যায় না। অতএব আমার বন্ধু সম্বন্ধে আমি সেরকম আশঙ্কা করি নে। কিন্তু পাঠকের মনােরঞ্জনকেই যদি প্রধান উদ্দেশ্য করা যায়, তবে নিছক প্রশংসায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবার সম্ভাবনা নেই। নিদেন বানিয়ে দুটো নিন্দে করতে এবং শানিয়ে দুটো কথা বলতে হয়। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার যদি থাকে আমার বন্ধুর থাকতেও আটক নেই। অতএব মৌনাবলম্বনই ভালাে।
জাহাজে আমরা দীর্ঘদিন দুজনে মুখােমুখি চৌকি টেনে বসে পরস্পরের স্বভাব চরিত্র জীবনবৃত্তান্ত এবং সৃষ্টির যাবতীয় স্থাবর জঙ্গম এবং সূক্ষ্ম ও স্থূল সত্তা সম্বন্ধে যার যা-কিছু বক্তব্য ছিল সমস্ত নিঃশেষ করে ফেলেছি। আমার বন্ধু চুরোটের ধোঁয়া এবং বিবিধ উড্ডীয়মান কল্পনা একত্র মিশিয়ে সমস্তদিন অপূর্ব ধূম্রলােক সৃজন করেছেন। সেগুলােকে যদি মস্ত একটা ফুলাে রবারের থলির মধ্যে বেঁধে রাখবার কোনাে সুযােগ থাকত তা হলে সমস্ত মেদিনীকে বেলুনে চড়িয়ে একেবারে ছায়াপথের দিকে বেড়িয়ে নিয়ে আসা যেতে পারত। সাধারণতঃ কাল্পনিকেরা যখন কল্পনাক্ষেত্রের হাওয়া খেতে চায় তখন তারা পৃথিবী ছেড়ে হুস করে উড়ে এক আজগবি পুরীতে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু আমার বন্ধুর পদ্ধতি অন্য রকম। তিনি তাঁর প্রবল ধূম্রশক্তির উপরে ফুল ফোর্স্ প্রয়ােগ করে পৃথিবীর সমস্ত মৃত্তিকাপিণ্ড একেবারে সঙ্গে করে উড়িয়ে নিয়ে যান। লঘু কিছুই ছাড়েন না। যখন এত ঊর্ধ্বে ওঠা গেছে যে সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক হাওয়ায় আর নিশ্বাস চলে না, সেখানে তিনি হঠাৎ তাঁর থলির মধ্যে থেকে বৈজ্ঞানিক হাওয়া বের করে দিয়ে আশ্চর্য করে দেন। যখন জগতের ডগার উপর চড়ে আধ্যাত্মিক ভাবে একেবারে বিন্দুবৎ হয়ে মিশিয়ে গেছি, তখন তিনি কোথা থেকে তার গােড়াকার মৃত্তিকা তুলে এনে আগা ও গােড়ার সামঞ্জস্য-প্রমাণে প্রবৃত্ত হন। অন্যান্য কল্পনাবিহারীগণকে মাঝে মাঝে মেঘ থেকে হঠাৎ মাটির উপরে ধুপ করে নেমে পড়তে হয়, কিন্তু তাঁর সেই গুরুতর পতনের আবশ্যক হয় না। তিনি একই সময়ে স্বর্গমর্ত গদ্যপদ্যর প্যারাডক্স্লােকে ইন্দ্রত্বপদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
এক কথায়, এক দিকে তাঁর যেমন কাব্যাকাশে উধাও হয়ে ওড়বার উদ্যম, অন্য দিকে তেমনি তন্ন তন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রবৃত্তি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, এই অনুসন্ধানের প্রবৃত্তিটা অধিকাংশ সময়েই তাঁর চুরোটের পশ্চাতে ব্যাপৃত থাকে। তাঁর তামাকের থলি, সিগারেটের কাগজ এবং দেশালাইয়ের বাক্স মুহূর্তে মুহূর্তে হারাচ্ছে, অসম্ভব স্থানে তার সন্ধান হচ্ছে এবং সম্ভব স্থান থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে। পুরাণে পড়া যায় ইন্দ্রের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে— যিনি যজ্ঞ করেন বিঘ্ন ঘটিয়ে তাঁর যজ্ঞ নাশ করা, যিনি তপস্যা করেন অপ্সরী পাঠিয়ে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করা। আমার বােধ হয় সেই পরশ্রীকাতর ইন্দ্র আমার বন্ধুর বুদ্ধিবৃত্তিকে সর্বদাই বিক্ষিপ্ত করে রাখবার অভিপ্রায়ে তাঁর কোনাে এক সুচতুরা কিন্নরীকে তামাকের থলিরূপে আমার বন্ধুর পকেটের মধ্যে প্রেরণ করেছেন। ছলনাপ্রিয় ললনার মতাে তাঁর সিগারেট মুহুর্মুহু কেবলই লুকোচ্ছে এবং ধরা দিচ্ছে এবং তাঁর চিত্তকে অহর্নিশি উদ্ভ্রান্ত করে তুলছে। আমি তাঁকে বারম্বার সতর্ক করে দিয়েছি যে, যদি তাঁর মুক্তির কোনাে ব্যাঘাত থাকে সে তাঁর চুরোট। মহর্ষি ভরত মৃত্যুকালেও হরিণশিশুর প্রতি চিত্তনিবেশ করেছিলেন ব’লে পরজন্মে হরিণশাবক হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। আমার সর্বদাই আশঙ্কা হয়, আমার বন্ধু জন্মান্তরে ব্রহ্মদেশীয় কোনাে-এক কৃষকের কুটিরের সম্মুখে মস্ত একটা তামাকের ক্ষেত হয়ে উদ্ভূত হবেন। বিনা প্রমাণে তিনি শাস্ত্রের এসকল কথা বিশ্বাস করেন না, বরঞ্চ তর্ক করে আমারও সরল বিশ্বাস নষ্ট করতে চান এবং আমাকে পর্যন্ত চুরুট ধরাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কৃতকার্য হতে পারেন নি।
২৭।২৮ আগস্ট্। দেবাসুরগণ সমুদ্র মন্থন করে সমুদ্রের মধ্যে যা-কিছু ছিল সমস্ত বাহির করেছিলেন। সমুদ্র দেবেরও কিছু করতে পারলেন না, অসুরেরও কিছু করতে পারলেন না, হতভাগ্য দুর্বল মানুষের উপর তার প্রতিশােধ তুলছেন। মন্দর পর্বত কোথায় জানি নে এবং শেষনাগ তদবধি পাতালে বিশ্রাম করছেন, কিন্তু সেই সনাতন মন্থনের ঘূর্ণীবেগ যে এখনাে সমুদ্রের মধ্যে রয়ে গেছে তা নরজঠরধারীমাত্রেই অনুভব করেন। যাঁরা করেন না তাঁরা বােধ করি দেবতা অথবা অসুর বংশীয়। আমার বন্ধুটিও শেষােক্ত দলের, অর্থাৎ তিনিও করেন না।
আমি মনে মনে তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলুম। আমি যখন বিনম্রভাবে বিছানায় পড়ে পড়ে অনবরত পূর্বোক্ত শাস্ত্রীয় বর্ণনার সত্যতা সশরীরে সপ্রমাণ করছিলুম তিনি তখন স্বচ্ছন্দে আহারামােদে নিযুক্ত ছিলেন― এটা আমার চক্ষে অত্যন্ত অসাধু বলে ঠেকেছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবতুম এক-একটা লোক আছে শাস্ত্রবাক্য ব্রহ্মবাক্যও তাদের উপর খাটে না। প্রাচীন মন্থনের সমসাময়িক কালেও যদি আমার এই বন্ধুটি সমুদ্রের কোথাও বর্তমান থাকতেন তা হলে লক্ষ্মী এবং চন্দ্রটির মত ইনিও দিব্য অনাময় সুস্থ শরীরে উপরে ভেসে উঠতেন, কিন্তু মন্থনকারী উভয় পক্ষের মধ্যে কার ভাগে পড়তেন আমি সে কথা বলতে চাই নে।
কিন্তু বােগশয্যা ছেড়ে এখন ডেকে উঠে বসেছি, এবং শরীরের যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে। এখন সমুদ্র এবং আমার সঙ্গীটির সম্বন্ধে সমস্ত শাস্ত্রীয় মত এবং অশাস্ত্রীয় মনোমালিন্য সম্পূর্ণ তিরােহিত হয়েছে। এমনকি বর্তমানে আমি তাঁদের কিছু অধিক পক্ষপাতী হয়ে পড়েছি।
এ ক’টা দিন দিনরাত্রি কেবল ডেকেই পড়ে আছি। তিলমাত্র কাল বন্ধুবিচ্ছেদ হয় নি।
বােগ কেটে গেছে কিন্তু সম্পূর্ণ বললাভ হয় নি, শরীরের এই রকম অবস্থার মধ্যে একটু মাধুর্য আছে। এই সময়ে পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, সূর্যালোেক, সবসুদ্ধ সমস্ত বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে যেন একটি নূতন পরিচয় আরম্ভ হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিছুকালের মতাে বিচ্ছিন্ন হওয়াতে আবার যেন নবপ্রেমিকের মতো উভয়ের মধ্যে মৃদু সলজ্জ মধুর ভাবে কথাবার্তা জানাশােনার অল্প অল্প সূত্রপাত হতে থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য নববধূর মতাে নানা নূতন ভাবে ক্রমশঃ আত্মপ্রকাশ করে, পুলকিত দেহ তার আদরের স্পর্শ প্রত্যেক রােমকূপের দ্বারা যেন শােষণ করে পান করতে থাকে।
সকল প্রকার সন্ধিস্থলের মধ্যেই একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে। দিনের মধ্যে যেমন উষা এবং সন্ধ্যা। বাল্য ও যৌবনের বয়ঃসন্ধিকাল কবি বিদ্যাপতি সমধিক আগ্রহের সহিত বর্ণনা করেছেন। প্রবাদ আছে সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালাে। এবং অনেকে ব’লে থাকেন ধনের চেয়ে সচ্ছলতার মধ্যে বেশি আনন্দ আছে। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের চেয়ে রােগ ও স্বাস্থ্যের মধ্যবর্তীকালে একটু বিশেষ সুখ আছে।
আজ কেদারায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে বসে এর একটা তত্ত্বনির্ণয় করেছি। ধনই বলো, সুখই বলো, স্বাস্থ্যই বলাে, তারা আমাদের প্রাত্যহিক প্রয়ােজনের অনেক অতিরিক্ত না হলে আমরা তাকে ধন সুখ স্বাস্থ্য বলে স্বীকার করি নে। প্রতিদিনের সংসার যাতে চলে তার চেয়ে বেশি যার নেই তাকে আমরা ধনী বলি নে। সন্তোষ এবং সুখের মধ্যেও প্রভেদ এই যে, একটি হচ্ছে যথেষ্ট, আরএকটি হচ্ছে তারও বেশি। এবং দেহধারণের পক্ষে ঠিক যতটা আবশ্যক স্বাস্থ্য তার চেয়ে অনেক অধিক।
এই অতিরিক্ত সঞ্চয় হাতে থাকাতে আমরা কতকগুলি সুখ থেকে বঞ্চিত হই। প্রাত্যহিক অভাব প্রত্যহ মােচনের সুখ ধনী জানে না। তার চেয়ে ঢের বেশি অভাব মােচন না হলে ধনীর মনে তৃপ্তির উদয় হয় না। সুখের উত্তেজনায় যার রক্ত ফুটে উঠেছে, জগতের শতসহস্র সহজ আনন্দে তার চেতনা উদ্রেক করতে পারে না। তেমনি স্বাস্থ্যের বেগে যার শরীর চঞ্চল হয়ে উঠেছে, শান্ত নিরুদ্বিগ্নভাবে কেবলমাত্র জীবনধারণের মধ্যে যে সুখটুকু আছে সে তাকে এক লম্ফে লঙ্ঘন করে চলে যায়।
ধনই হােক, সুখই হােক, স্বাস্থ্যই হােক, যতটুকু আমাদের প্রাত্যহিক আবশ্যকে লাগে ততটুকু নিয়মিত কাজে ব্যাপৃত থাকে। তার অতিরিক্ত যেটুকু সেইটুকুই আমাদের অস্থির করে তােলে। সে কিছুতে বেকার বসে থাকতে চায় না। ধন ধনীকে কেবল প্রশ্ন করে, খাওয়া পরা তাে হল, এখন কী করব বলো। সুখ বলে, প্রাত্যহিক জীবনটা তাে এক রকম নিঃশব্দে কাটছে, এখন তার উপরে একটা-কিছু সমারােহ না করলে টিঁকতে পারি নে। স্বাস্থ্য বলে, আর-কিছু যদি করবার না থাকে তাে নিদেন হূহূঃ শব্দে দুটো ডন ফেলে আসা যাক।
সেই জন্যেই আমরা ভারতবাসীরা বলে থাকি সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালাে, অনুরাগের চেয়ে বৈরাগ্যে ঢের কম ল্যাঠা― ভিতর থেকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে খাটিয়ে মারবার কেউ থাকে না। সুখ দুর্বলের জন্যে নয়— সুখ বলসাধ্য, সুখ দুঃখসাধ্য। অক্সিজেন প্রতি মুহূর্তে যেমন আমাদের দগ্ধ করে জীবন দেয়, মানসিক জীবনে সুখ সেই রকম আমাদের দাহ করতে থাকে। যৌবনে এই দাহ যে রকম প্রবল বার্ধক্যে সে রকম নয়; এই জন্যে বৃদ্ধ জাতি এবং বৃদ্ধ লােকেরাই বলে থাকেন, সন্তোষই যথার্থ সুখ, অর্থাৎ তাপহ্রাসই যথার্থ জীবন।
য়ুরোপ মনুষ্যের নব নব অভাব সৃষ্টি ক’রে সেইটাকে মােচন করাকেই সুখ বলে, আমরা মনুষ্যের ক্ষুধাতৃষ্ণা প্রভৃতি চিরসঙ্গী আজন্ম-অভাবগুলিকেও খােরাক-বন্ধ ও অন্যান্য কৌশল দ্বারা হ্রাস করে বসে থাকাকেই সন্তোষ বলি।
আমি সেই প্রাচীন ভারত -সন্তান। পায়ের উপর একখানি কম্বল চাপিয়ে লম্বা চৌকির উপর হেলান দিয়ে ভারতমাতার আর-একটি দুর্বল সন্তানকে সামনে বসিয়ে প্রত্যুষ থেকে মধ্যাহ্ন, মধ্যাহ্ন থেকে অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণ থেকে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত কখনাে স্বগত তত্ত্বালােচনা, কখনাে জনান্তিকে গল্প, কখনাে নিস্তব্ধভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকাকেই পরম সুখের অবস্থা মনে করছি। শরীরে যতটুকু তেজ আছে তাতে কেবল এইটুকুমাত্রই সম্পন্ন হতে পারে। আর, ঐ ইংরাজের ছেলেগুলাে আমাদের সম্মুখ দিয়ে অবিশ্রাম পায়চারি করে করে মােলাে। তাদের অপরিমিত স্বাস্থ্য কিছুতেই তাদের বসে থাকতে দিচ্ছে না; পিছনে পিছনে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সময়ে আমরা আমাদের নিবৃত্তিসিংহাসনের উপরে রাজবৎ আসীন হয়ে ভারতবাসীর নির্গুণাত্মক আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠতা অনুভব করছি। এবং মনে হচ্ছে ইংরাজের ছেলেরাও আমাদের এই অটল ঔদাসীন্য এই নিশ্চেষ্ট অনাসক্তি দেখে নিজেদের হীনতা স্পষ্টই বুঝতে পারছে, তাই আরও ছট্ফট্ করে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু বাহ্য আকৃতি থেকে আমাদের দুটিকে দিবসের পেচকের মতাে যতটা আধ্যাত্মিক দেখায়, আমাদের আলােচনাতে সকল সময়ে ততটা সাত্ত্বিক সৌরভ থাকে না। সকলের জানা উচিত যদিচ আমরা ভারতসন্তান কিন্তু তবু আমাদের বয়স এখনও ত্রিশ পেয়ােয় নি। এখনো আমাদের সন্ন্যাসাশ্রমের সময় আছে। এই বয়সেই ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে বৈরাগ্য হাড়ের মধ্যে প্রবেশ ক’রে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়, কিন্তু মনের মধ্যে এখনাে কিঞ্চিৎ উত্তাপ আছে। এই জন্যে আমরা দুই যুবক গতকল্য রাত্রি দুটো পর্যন্ত কেবল ষড়্চক্র-ভেদ চিত্তবৃত্তি-নিরােধ ত্রিগুণাত্মিকা-শক্তি সম্বন্ধে আলােচনা না করে সৌন্দর্য প্রেম এবং নারীজাতির পরম কমনীয়তা সম্বন্ধে পরস্পরের মতামত ব্যক্ত করছিলুম এবং মনে করছিলুম আমাদের বয়সী যুবকদের পক্ষে এর চেয়ে সূক্ষ্মতর আধ্যাত্মিক বাগ্বিতণ্ডায় প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্তই জ্যাঠামি এবং সেটা কেবল আজকাল বাংলাদেশেই প্রচলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে দুজনেই ইংরাজিশিক্ষা লাভ করেছি, অতএব আমাদের এ প্রকার মনের ভাবকে যদি কেউ দূষণীয় জ্ঞান করেন তবে সেটা বিদেশী শিক্ষার দোষ বলে জানবেন। তাঁরা যে প্রকার শিক্ষা দিতে চান তাতে মনুষ্যসমাজ বাল্য যৌবন সম্পূর্ণ ডিঙিয়ে একেবারে বার্ধক্যের সুশীতল কূপের মধ্যে সমাহিত হয়ে বসে। জীবনসমুদ্রের অসীম চাঞ্চল্য তার মধ্যে স্থান পায় না।
২৯ আগস্ট্। আজ রাত্রে এডেনে পৌঁছব। সেখানে কাল প্রাতে জাহাজ বদল করতে হবে। সমুদ্রের মধ্যে দুটি-একটি করে পাহাড় পর্বতের রেখা দেখা যাচ্ছে।
জ্যোৎস্নারাত্রি। এডেন বন্দরে এসে জাহাজ থামল। আহারের পর রহস্যালাপে প্রবৃত্ত হবার জন্যে আমরা দুই বন্ধু ছাতের এক প্রান্তে চৌকি দুটি সংলগ্ন করে আরামে বসে আছি। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র এবং জ্যোৎস্যবিমুগ্ধ পর্বতবেষ্টিত তটচিত্র আমাদের আলস্যবিজড়িত অর্ধনিমীলিত নেত্রে স্বপ্নমরীচিকার মতাে লাগছে।
এমন সময় শােনা গেল এখনি নূতন জাহাজে চড়তে হবে। সে জাহাজ আজ রাত্রেই ছাড়বে। তাড়াতাড়ি ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশপূর্বক স্তূপাকার বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র যেমন-তেমন করে চর্মপেটকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তার উপরে তিন-চার জনে দাঁড়িয়ে নির্দয় ভাবে নৃত্য করে বহু কষ্টে চাবি বন্ধ করা গেল। ভৃত্যদের যথাযােগ্য পুরস্কার দিয়ে ছােটো বড়ো মাঝারি নানা আকারের বাক্স তোরঙ্গ বিছানাপত্র বহন করে নৌকারোহণপূর্বক নূতন জাহাজ ‘ম্যাসীলিয়া’- অভিমুখে চললুম।
অনতিদূরে মাস্তুলকণ্টকিত ম্যাসীলিয়া তার দীপালোকিত ক্যাবিনগুলির সুদীর্ঘশ্রেণীবদ্ধ বাতায়ন উদ্ঘাটিত করে দিয়ে পৃথিবীর আদিম কালের অতিপ্রকাণ্ডকায় সহস্রচক্ষু জলজন্তুর মতো স্থির সমুদ্রে জ্যোৎস্নালোকে নিস্তব্ধ ভাবে ভাসছে। সহসা সেখান থেকে ব্যাণ্ড্ বেজে উঠল। সংগীতের ধ্বনিতে এবং নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নানিশীথে মনে হতে লাগল, অর্ধরাত্রে এই আরবের উপকুলে আরব্যউপন্যাসের মত কী-একটা মায়ার কাণ্ড ঘটবে।
ম্যাসীলিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে আসছে। কুতূহলী নরনারীগণ ডেকের বারান্দা ধরে সকৌতুকে নবযাত্রীসমাগম দেখছে। কিন্তু সে রাত্রে নূতনত্ব সম্বন্ধে আমাদেরই তিন জনের সব চেয়ে জিত। বহু কষ্টে জিনিসপত্র উদ্ধার করে ডেকের উপর যখন উঠলুম মুহূর্তের মধ্যে এক-জাহাজ দৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষিত হল। যদি তার কোনো চিহ্ন দেবার ক্ষমতা থাকত তা হলে আমাদের সর্বাঙ্গ কটা কালো ও নীল ছাপে ভরে যেত। জাহাজটি প্রকাণ্ড। তার সংগীতশালা এবং ভোজনগৃহের ভিত্তি শ্বেতপ্রস্তরে মণ্ডিত। বিদ্যুতের আলো এবং ব্যাণ্ডের বাদ্যে উৎসবময়।
অনেক রাত্রে জাহাজ ছেড়ে দিলে।
৩০ আগস্ট্। আমাদের এ জাহাজে ডেকের উপরে আর-একটি দোতলা ডেকের মতো আছে। সেটি ছোটো এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন। সেইখানেই আমরা আশ্রয় গ্রহণ করলুম।
আমার বন্ধুটি নীরব এবং অন্যমনস্ক। আমিও তদ্রূপ। দূর সমুদ্রতীরের পাহাড়গুলো রৌদ্রে ক্লান্ত এবং ঝাপসা দেখাচ্ছে, একটা মধ্যাহ্নতন্দ্রার ছায়া পড়ে যেন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।
খানিকটা ভাবছি, খানিকটা লিখছি, খানিকটা ছেলেদের খেলা দেখছি। এ জাহাজে অনেকগুলি ছোটো ছােটো ছেলেমেয়ে আছে; আজকের দিনে যেটুকু চাঞ্চল্য সে কেবল তাদেরই মধ্যে। জুতাে মােজা খুলে ফেলে তারা আমাদের ডেকের উপর কমলালেবু গড়িয়ে খেলা করছে― তাদের তিনটি দাসী বেঞ্চির উপরে বসে নতমুখে নিস্তব্ধভাবে সেলাই করে যাচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে কটাক্ষপাতে যাত্রীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।
বহু দূরে এক-আধটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে মাঝে মাঝে সমুদ্রে এক-একটা পাহাড় জেগে উঠছে— অনুর্বরকঠিন, কালো, দগ্ধতপ্ত, জনশূন্য। অন্যমনস্ক প্রহরীর মতাে সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা উদাসীনভাবে তাকিয়ে আছে, সামনে দিয়ে কে আসছে কে যাচ্ছে তার প্রতি কিছুমাত্র খেয়াল নেই।
এই রকম করে ক্রমে সূর্যাস্তের সময় হল। ‘কাস্ল অফ ইন্ডোলেন্স্’ অর্থাৎ আলস্যের আলয়, কুঁড়েমির কেল্লা, যদি কাকেও বলা যায় সে হচ্ছে জাহাজ। বিশেষতঃ গরম দিনে, প্রশান্ত লোহিত সাগরের উপরে। অস্থির ইংরাজতনয়রাও সমস্ত বেলা ডেকের উপর আরামকেদারায় পড়ে ভ্রূর উপরে টুপি টেনে দিয়ে দিবাস্বপ্নে তলিয়ে রয়েছে। চলবার মধ্যে কেবল জাহাজ চলছে এবং তার দুই পাশের আহত নীল জল নাড়া পেয়ে অলস আপত্তির ক্ষীণ কলস্বরে পাশ কাটিয়ে কোনাে মতে একটুখানি মাত্র সরে যাচ্ছে।
সূর্য অস্ত গেল। আকাশ এবং জলের উপর চমৎকার রঙ দেখা দিয়েছে। সমুদ্রের জলে একটি রেখামাত্র নেই। দিগন্তবিস্তৃত অটুট জলরাশি যৌবনপরিপূর্ণ পরিস্ফুট দেহের মতাে একেবারে নিটোল এবং সুডােল। এই অপার অখণ্ড পরিপূর্ণতা আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত থম্থম্ করছে। বৃহৎ সমুদ্র হঠাৎ এমন একটা জায়গায় এসে থেমেছে যার ঊর্ধ্বে আর গতি নেই, পরিবর্তন নেই— যা অনন্তকাল অবিশ্রাম চাঞ্চল্যের পরম পরিণতি, চরম নির্বাণ। সূর্যাস্তের সময় চিল আকাশের নীলিমার যে-একটি সর্বোচ্চ সীমার কাছে গিয়ে সমস্ত বৃহৎ পাখা সমতল রেখায় বিস্তৃত করে দিয়ে হঠাৎ গতি বন্ধ করে দেয়, চিরচঞ্চল সমুদ্র ঠিক যেন সহসা সেই রকম একটা পরম প্রশান্তির শেষ সীমায় এসে ক্ষণেকের জন্য পশ্চিম অস্তাচলের দিকে মুখ তুলে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলের যে চমৎকার বর্ণবিকাশ হয়েছে সে আকাশের ছায়া কি সমুদ্রের আলো ঠিক বলা যায় না। যেন একটা মাহেন্দ্রক্ষণে আকাশের নীরব নির্নিমেষ নীল নেত্রের দৃষ্টিপাতে হঠাৎ সমুদ্রের অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্যে থেকে একটা আকস্মিক প্রতিভার দীপ্তি স্ফূর্তি পেয়ে তাকে অপূর্বমহিমান্বিত করে তুলেছে।
সমুদ্র এবং আকাশের অসীম স্তব্ধতার মধ্যে এই আশ্চর্য বর্ণের উদ্ভাস দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছে এইটেকে ঠিক ব্যক্ত করতে পারি এমন ভাষা আমার কোথায়! কিন্তু আবার ভাবি, আবশ্যক কী? এ চঞ্চলতা কেন? বৃহৎকে ছোটোর মধ্যে বেঁধে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে এ কী রকমের দুশ্চেষ্টা! এই দুর্গম দুর্লভ বাক্যহীন এবং অনির্বচনীয় প্রকাণ্ড সুন্দরী প্রকৃতির একটি পকেটসাইজের সুলভ সংস্করণ জেবের মধ্যে পূরতে না পারলে মনের ক্ষোভ মেটে না; মাঝের থেকে এই ছট্ফটানির জ্বালায় যতটুকু সহজে পাওয়া যেতে পারত তাও হাতছাড়া হয়!
কিন্তু তবু― সমুদ্র এবং আকাশের মাঝখানটি থেকে এই দুর্লভ সন্ধ্যাটুকুকে পারিজাতপুষ্পটির মতো তুলে নিয়ে যদি আর-এক জনের হাতে না দিতে পারি তা হলে মনে হয় যেন সমস্ত নিষ্ফল হল। এই আলো এই শান্তি কেবল একা বসে চেয়ে দেখবার এবং মুগ্ধ হবার জন্যে নয়, মানুষের উপর নিক্ষেপ করে তাকে আচ্ছন্ন করে তাকে সুন্দর করবার জন্যে। ঘরের মধ্যে আনবার জন্যে, লােকালয়ের উপরে বিস্তৃত করবার জন্যে, ভালােবাসার লােকের মুখের উপরে ধরে তাকে নূতন এবং সুন্দর আলােকে দেখবার জন্যে।
সন্ধ্যা হয়ে এল। ঢং ঢং ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে গেল। সকলে বেশভূষা পরিবর্তন করে সান্ধ্যভােজনের জন্যে সুসজ্জিত হতে গেল। আধ ঘণ্টা পরে আবার ঘণ্টা বাজল। নরনারীগণ দলে দলে ভোজনশালায় প্রবেশ করলে। আমরা তিন বাঙালী একটি স্বতন্ত্র ছােটো টেবিল অধিকার করে বসলুম। আমাদের সামনে আর-একটি টেবিলে দুটি মেয়ে একটি উপাসক-সম্প্রদায়ের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে খেতে বসেছেন।
চেয়ে দেখলুম তাঁদের মধ্যে একটি যুবতী আপনার যৌবনশ্রী বহুল পরিমাণে উদ্ঘাটিত করে দিয়ে সহাস্যমুখে আহার এবং আলাপে নিযুক্ত আছেন। তাঁর শুভ্র সুগােল সুচিক্কণ গ্রীবাবক্ষবাহুর উপর সমস্ত বিদ্যুৎ-প্রদীপের অনিমেষ আলাে এবং পুরুষমণ্ডলীর বিস্মিত সকৌতুক দৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। একটা অনাবৃত আলােকশিখা দেখে দৃষ্টিগুলাে যেন কালাে কালাে পতঙ্গের মতাে চারি দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লম্ফ দিয়ে পড়ছে। এমনকি অনেকে মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে তাকে নিরীক্ষণ করছে এবং তাই নিয়ে ঘরে সর্বত্র একটা হাস্যকৌতুকের তরঙ্গ উঠেছে। অনেকেই সেই যুবতীর পরিচ্ছদটিকে ‘ইন্ডেকোরাস’ বলে উল্লেখ করছে। কিন্তু আমাদের মতাে বিদেশী লােকের পক্ষে তার বেআব্রু বেআদবিটা বােঝা একটু শক্ত। কারণ, নৃত্যশালায় এ রকম কি এর চেয়ে অনাবৃত বেশে গেলে কারও বিস্ময় উদ্রেক করে না। যেখানে সদ্যপরিচিত স্ত্রীপুরুষে পরস্পর আলিঙ্গনপাশে নিবন্ধ হয়ে উন্মতের মতাে নৃত্য করে বেড়ায় সেখানে ভদ্র কুলস্ত্রীদের শরীর থেকে লজ্জা এবং বসন অনেকটা পরিমাণে উন্মুক্ত করে ফেলা যদি দোষের না হয়, তবে এই ভােজনসভাতে আপনার পূর্ণমঞ্জরিত দেহসৌন্দর্যের কিঞ্চিৎ আভাস দিয়ে যাওয়া এমনি কী দোষের!
কিন্তু বিদেশের সমাজনীতি সম্বন্ধে বেশি উৎসাহের সঙ্গে কিছু বলা ভালাে নয়। আমাদের দেশে দেখা যায় বাসরঘরে এবং কোনাে কোনাে বিশেষ উপলক্ষে মেয়েরা যেমন অবাধে লজ্জাহীনতা প্রকাশ করে অন্য কোনাে সভায় তেমন করলে সাধারণের কাছে দুষ্য হ’ত সন্দেহ নেই। সমাজে যেমন নিয়মের বাঁধাবাঁধি থাকে তেমনি মাঝে মাঝে দুটো-একটা ছুটিও থাকে, নইলে পাছে চঞ্চল মানবস্বভাব সমাজভিত্তির মধ্যে শত শত গােপন ছিদ্রপথ খনন করে! ইংরাজিতে যাকে ‘ফ্লার্টেশন’ বলে আমাদের সমাজে তা প্রচলিত নেই, সুতরাং তার কোনাে নামও নেই, কিন্তু গৃহের মধ্যে এমন অনেকগুলি পরিহাসের স্থল রাখা হয়েছে যেখানে অনেক পরিমাণে সমাজনিয়মের সমাজসম্মত লঙ্ঘন চলতে পারে। সেখানে যে রকম রসালাপপূর্ণ অভিনয় চলে তা যে সকল সময়ে সুসম্বৃত সুশােভন তা বলা যায় না।
কিন্তু য়ুরােপীয়েরা যতই চেষ্টা করুক আবরণহীনতা সম্বন্ধে কিছুতেই আমাদের ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। এ সম্বন্ধে মানবের যতদূর সাধ্য আমাদের দেশে তার ত্রুটি হয় নি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অপূর্ব কারুকৌশলে আমাদের স্ত্রীসমাজে বসন থেকে আবরণের অংশ যতদূর সম্ভব ছাড়িয়ে ফেলা যেতে পারে তা ফেলা হয়েছে। বস্ত্র-পরিধানের দ্বারা অঙ্গকে অনাবৃত করা বঙ্গ-অন্তঃপুরে আশ্চর্য পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু একটা কথা বলা আবশ্যক; ইংরেজ মেয়েদের পক্ষে শরীরের উত্তরভাগ বিশেষরূপে অনাচ্ছন্ন করার মধ্যে একটা চেষ্টা চেতনা চাতুরী লক্ষিত হয়। আমাদের মেয়েরা যে উলঙ্গতা পরিধান পূর্বক অষ্টপ্রহর বিচরণ করে থাকেন তার মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য চেষ্টা কিম্বা চেতনা নেই, এই জন্যে আমাদের চোখে সেটা সচরাচর বিবসনতা বলে ঠেকে না। অবশ্য, সময়বিশেষে তাঁরা-যে দ্রুত হস্তক্ষেপে মস্তক বেষ্টন করে প্রায় নাসিকার প্রান্তভাগ পর্যন্ত ঘোমটা আকর্ষণ করে দেন না এ রকম ঘোরতর নির্লজ্জতার অপবাদ তাঁদের কেউ দিতে পারে না।
৩১ আগস্ট্। আজ রবিবার। প্রাতঃকালে উঠে উপরের ডেকে চৌকিতে বসে সমুদ্রের বায়ু সেবন করছি, এমন সময় নীচের ডেকে খৃস্টানদের উপাসনা আরম্ভ হল। যদিও জানি এদের মধ্যে অনেকেই শুষ্কভাবে অভ্যস্ত মন্ত্র আউড়ে কল-টেপা আর্গিনের মতো গান গেয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তবু এই-যে দৃশ্য― এই-যে গুটিকতক চঞ্চল ছোটো ছোটো মনুষ্য অপার সমুদ্রের মাঝখানে স্থির বিনম্রভাবে দাড়িয়ে গম্ভীর সমবেত কণ্ঠে এক চির-অজ্ঞাত অনন্ত রহস্যের প্রতি ক্ষুদ্র মানবহৃদয়ের ভক্তি-উপহার প্রেরণ করছে, এ অতি আশ্চর্য।
কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ এক-একবার অট্টহাস্য শোনা যাচ্ছে। গতরাত্রের সেই ডিনার-টেবিলের নায়িকাটি উপাসনায় যোগ না দিয়ে উপরের ডেকে বসে তাঁরই একটি উপাসক যুবকের সঙ্গে কৌতুকালাপে নিমগ্ন আছেন। মাঝে মাঝে উচ্চহাস্য করে উঠছেন, আবার মাঝে মাঝে গুন্গুন্ স্বরে ধর্মসংগীতেও যোগ দিচ্ছেন। আমার মনে হল সরল ভক্তমণ্ডলীর মাঝখানে শয়তান পেটিকোট প’রে এসে মানবের উপাসনাকে পরিহাস করছে।
আজ আহারের সময় একটি নূতন সংবাদের সৃষ্টি করা গেছে। ছোটো টেবিলটিতে আমরা তিন জনে ব্রেকফাস্ট্ খেতে বসেছি। একটা শক্ত গোলকার রুটির উপরে ছুরি চালনা করতে গিয়ে ছুরিটা সবলে পিছ্লে আমার বাম হাতের দুই আঙুলের উপর এসে পড়ল। রক্ত চার দিকে ছিটকে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ আহারে ভঙ্গ দিয়ে ক্যাবিনে পলায়ন করলুম। মনে এই আক্ষেপ হতে লাগল, এতখানি রক্তের অনর্থক অপব্যয় হল অথচ স্বদেশ যেমন ছিল তেমনি রইল, সাধারণ মানবেরও অবস্থার কোনাে উন্নতি হল না, মাঝের থেকে এই ঘটনাটা যদি বাড়িতে ঘটত তা হলে যে পরিমাণ স্নেহ শুশ্রূষা এবং ছিন্ন অঞ্চলখণ্ড আহত অঙ্গুলির চতুর্দিকে আকৃষ্ট হত অদৃষ্টে তাও জুটল না। ইতিহাসে অনেক রক্তপাত লিপিবদ্ধ হয়েছে, আমার ডায়ারিতে আমার এই রক্তপাত লিখে রাখলুম― ভাবী বঙ্গবীরদের কাছে গৌরবের প্রার্থী নই, বর্তমান বঙ্গাঙ্গনাদের মধ্যে কেউ যদি একবার ‘আহা’ বলেন!
১ সেপ্টেম্বর। সন্ধ্যার পর আহারান্তে উপরের ডেকে আমাদের যথাস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল। মৃদু শীতল বায়ুতে আমার বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছেন, এবং দাদা অলসভাবে ধুম সেবন করছেন, এমন সময়ে নীচের ডেকে নাচের বাজনা বেজে উঠল। সকলে মিলে জুড়ি জুড়ি ঘূর্ণনৃত্য আরম্ভ হল।
তখন পূর্বদিকে নব কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণপ্রায় চন্দ্র ধীরে ধীরে উদয় হচ্ছে। এই তীররেখাশূন্য জলময় মহামরুর পূর্বসীমান্তে চন্দ্রের পাণ্ডুর কিরণ প’ড়ে একটা অনাদি অনন্ত বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চাঁদের উদয়পথের ঠিক নীচে থেকে আমাদের জাহাজ পর্যন্ত অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে প্রশস্ত দীর্ঘ আলােকপথ ঝিক্ঝিক্ করছে। জ্যোৎস্নাময়ী সন্ধ্যা কোন্-এক অলৌকিক বৃন্তের উপরে অপূর্ব শুভ্র জনীগন্ধার মতাে আপন প্রশান্ত সৌন্দর্যে নিঃশব্দে চতুর্দিকে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। আর, মানুষগুলাে পরস্পরকে জড়াজড়ি ক‘রে ধ’রে পাগলের মতাে তীব্র আমােদে ঘুরপাক খাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, সর্বাঙ্গের রক্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরছে, বিশ্বজগৎ আদিসৃষ্টিকালের বাষ্পচক্রের মতাে চারি দিকে প্রবল বেগে আবর্তিত হচ্ছে। আশ্চর্য কাণ্ড! লােকলােকান্তরের নক্ষত্র স্থিরভাবে চেয়ে রয়েছে এবং দূরদূরান্তরের তরঙ্গ ম্লান চন্দ্রালােকে গম্ভীর সমস্বরে অনন্তকালের পুরাতন সামগাথা গান করছে। এই রজনীতে, এই আকাশের নীচে এবং এই সমুদ্রের উপরে, কতকগুলি পরিচিত অপরিচিত নরনারী জুড়ি জুড়ি জড়াজড়ি ক’রে লাঠিমের মতাে অর্থহীন অন্ধবেগে ঘুর খাওয়াকে খুব একটা সুখ মনে করছে। একটু লজ্জা নেই, সংযম নেই, চিন্তা নেই, পরস্পরের মধ্যে একটা শােভন অন্তরাল নেই। আমার কাছে এই উম্মত্ত বর্বরতা লেশমাত্র সুন্দর ঠেকে না। লজ্জা কি কেবলমাত্র কৃত্রিম নিয়ম! অনাত্মীয় স্ত্রীপুরুষ অকস্মাৎ ঘনিষ্ঠ বাহুবন্ধনে মুখে মুখে বক্ষে বক্ষে সম্বদ্ধ হতে কি একটা স্বাভাবিক আন্তরিক সুগভীর সংকোচ অনুভব করে না! এমন-কি, যে দেশে অসভ্যেরা বস্ত্রমাত্র পরে না সে দেশেও কি এই আদিম লজ্জাটুকু, প্রেমনীতির এই প্রথম অঙ্কুরটুকুও নেই!
২ সেপ্টেম্বর। সকালে ডেকে বেড়াবার সময় একটি ইংরাজ ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার বহুক্ষণ আলাপ হল। ইনি ভারতরাজ-মন্ত্রণার একটি প্রধান আসন অধিকার করেন। প্রথমে য়ুরােপের সমাজসমস্যা সম্বন্ধে আমি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলুম, তার কতক কতক আমার ভূমিকাতে ব্যক্ত করা গেছে। সাহেব জনসংখ্যাবৃদ্ধি-বশতঃ বেহার প্রভৃতি দরিদ্র দেশের ভাবী আশঙ্কা এবং কুলি-চালান সম্বন্ধে বাঙালী কাগজের অনভিজ্ঞ চীৎকারের কথা বললেন; এবং দেশের ঐতিহাসিক প্রকৃতি আলােচনা করে ভারতবর্ষে প্রতিনিধিতন্ত্র-প্রচার সম্বন্ধে দৃঢ় আপত্তি প্রকাশ করলেন। আমি বললুম, ‘দেখাে সাহেব, প্রতিনিধিতন্ত্রের জন্য যে আমরা আন্তরিক লালায়িত এরূপ কোনাে লক্ষণ দেখা যায় না। আসল কথা, তােমরা সর্বদা আমাদের প্রতি প্রকাশ্য ঔদ্ধত্য এবং অবজ্ঞা দেখিয়ে থাকো, সেইটেই আমাদের শিক্ষিত লােকদের পক্ষে অসহ্য। অন্তরের মধ্যে সেই অপমান অনুভব করি ব’লেই আমরা জাতীয় আত্মসম্মান রক্ষা করবার জন্যে আজ এত চেষ্টা করছি। নইলে, তােমাদের জাতের স্বভাবটা যদি একটু নরম হত— আমরা যদি তােমাদের কাছ থেকে যথার্থ ভদ্রতা, কথঞ্চিৎ সম্মান ও মনুষ্যোচিত সদয় ব্যবহার পেতুম— তা হলে আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে থেকে এ রকম বেদনার স্বর শুনতে পেতে না। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান দুর্দশা হচ্ছে এই যে, যারা আমাদের আন্তরিক ঘৃণা করে তারাই আমাদের বলপূর্বক উপকার করতে আসে। যারা আমাদের মানুষ জ্ঞান করে না তারাই আমাদের শান্তি রক্ষা করে, লেখাপড়া শেখায়, সুবিচার করবার চেষ্টা করে। প্রতিদিন এ রকম অবজ্ঞার দান গ্রহণ করতে বাধ্য হলে আমাদের আত্মসম্মান আর থাকে না। স্নেহের দানে হীনতা নেই। স্নেহের সম্পর্কে সহস্র অবিচার থাকতে পারে কিন্তু অপমান নেই। ধনীগৃহের একটি অনাদৃত উপেক্ষিত আশ্রিতের মতাে আমরা পাকা কোঠায় থাকি, উদ্বৃত্ত পরমান্ন খাই, সুখ বিস্তর আছে কিন্তু হীনতার আর সীমা নেই— সে কেবলমাত্র আন্তরিক প্রীতি-বন্ধনের অভাবে।
৩ সেপ্টেম্বর। আজ সকালেও সেই ভদ্রলোেকটির সঙ্গে আমার অনেক কথা হল। তিনি লর্ড্ ডাফারিনের বিদায়কালে তাঁর প্রতি বাঙালী দেশহিতৈষীদের রূঢ় আচরণের অনেক নিন্দাবাদ করলেন।
বেলা দশটার সময় সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে এসে জাহাজ থামল। চারি দিকে চমৎকার রঙের খেলা। পাহাড়ের উপর রৌদ্র ছায়া এবং নীল বাষ্প। ঘননীল সমুদ্রের প্রান্তে বালুকাতীরের রৌদ্রদুঃসহ গাঢ় পীত রেখা।
খালের মধ্যে দিয়ে জাহাজ সমস্ত দিন অতি ধীরগতিতে চলছে। দু ধারে তরুহীন বালি। কেবল মাঝে মাঝে এক-একটি ছােটো ছােটো কোটাঘর বহুযত্নবর্ধিত গুটিকতক গাছে-পালায় বেষ্টিত হয়ে বড়াে আরামজনক দেখাচ্ছে।
অনেক রাতে আধখানা চাঁদ উঠল। ক্ষীণ চন্দ্রালােকে দুই তীর অস্পষ্ট ধূ ধূ করছে।― রাত দুটো-তিনটের সময় জাহাজ পাের্ট্ সৈয়েদে নােঙর করলে।
৪ সেপ্টেম্বর। এখন আমরা ভূমধ্যসাগরে, য়ুরােপের অধিকারের মধ্যে। বাতাসও শীতল হয়ে এসেছে, সমুদ্রও গাঢ়তর নীল। আজ রাত্রে আর ডেকের উপর শােওয়া হল না।
৫ সেপ্টেম্বর। বিকালের দিকে ক্রীট দ্বীপের তটপর্বত দেখা দিয়েছিল। ডেকের উপর একটা স্টেজ বাঁধা হচ্ছে। জাহাজে এক দল নাট্যব্যবসায়ী যাত্রী আছে, তারা অভিনয় করবে। অন্যদিনের চেয়ে সকাল-সকাল ডিনার খেয়ে নিয়ে তামাশা আরম্ভ হল। প্রথমে জাহাজে অব্যবসায়ী যাত্রীর মধ্যে যাঁরা গানবাজনা কিঞ্চিৎ জানেন এবং জানেন না, তাঁদের কারও বা দুর্বল পিয়ানাে টিংটিং কারও বা মৃদু ক্ষীণকণ্ঠে গান হল। তার পরে যবনিকা উদ্ঘাটন করে নট-নটী-কর্তৃক ‘ব্যালে’ নাচ, সঙ নিগ্রোর গান, জাদু, প্রহসন-অভিনয় প্রভৃতি বিবিধ কৌতুক হয়েছিল। মধ্যে নাবিকাশ্রমের জন্যে দর্শকদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ হল।
৬ সেপ্টেম্বর। খাবার ঘরে খােলা জানলার কাছে বসে বাড়িতে চিঠি লিখছি। একবার মুখ তুলে বামে চেয়ে দেখলুম ‘আয়োনিয়ান’ দ্বীপ দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের কোলের মধ্যে সমুদ্রের ঠিক ধারেই মনুষ্যরচিত ঘনসন্নিবিষ্ট একটি শ্বেত মৌচাকের মতাে দেখা যাচ্ছে। এইটি হচ্ছে জান্তি শহর (Zanthe)। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন পর্বতটা তার প্রকাণ্ড করপুটে কতকগুলাে শ্বেত পুষ্প নিয়ে সমুদ্রকে অঞ্জলি দেবার উপক্রম করছে।
ডেকের উপর উঠে দেখি আমরা দুই শৈলশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ সমুদ্রপথে চলেছি। আকাশে মেঘ করে এসেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঝড়ের সম্ভাবনা। আমাদের সর্বোচ্চ ডেকের চাঁদোয়া খুলে ফেলে দিলে। পর্বতের উপর অত্যন্ত নিবিড় মেঘ নেমে এসেছে; কেবল দূরে একটিমাত্র পাহাড়ের উপর মেঘছিদ্রমুক্ত সন্ধ্যালােকের একটি দীর্ঘ রক্তবর্ণ ইঙ্গিত-অঙ্গুলি এসে স্পর্শ করেছে, অন্য সবগুলাে আসন্ন ঝটিকার ছায়ায় আচ্ছন্ন। কিন্তু ঝড় এল না। একটু প্রবল বাতাস এবং সবেগ বৃষ্টির উপর দিয়েই সমস্ত কেটে গেল। ভূমধ্যসাগরে আকাশের অবস্থা অত্যন্ত অনিশ্চিত। শুনলুম, আমরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছি এখান দিয়ে জাহাজ সচরাচর যায় না। জায়গাটা নাকি ভারী ঝোড়াে।
রাত্রে ডিনারের পর যাত্রীরা কাপ্তেনের স্বাস্থ্যপান এবং গুণগান করলে। কাল ব্রিন্দিশি পৌঁছব। জিনিসপত্র বাঁধতে হবে।
৭ সেপ্টেম্বর। আজ সকালে ব্রিন্দিশি পৌঁছনো গেল। মেলগাড়ি প্রস্তুত ছিল, আমরা গাড়িতে উঠলুম।
গাড়ি যখন ছাড়ল তখন টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আহার করে এসে একটি কোণে জানলার কাছে বসা গেল।
প্রথমে, দুই ধারে কেবল আঙুরের ক্ষেত। তার পরে জলপাইয়ের বাগান। জলপাইয়ের গাছগুলাে নিতান্ত বাঁকাচোরা, গ্রন্থি ও ফাটল-বিশিষ্ট, বলি-অঙ্কিত, বেঁটেখাটো রকমের; পাতাগুলাে ঊর্ধ্বমুখ; প্রকৃতির হাতের কাজে যেমন একটি সহজ অনায়াসের ভাব দেখা যায়, এই গাছগুলােয় তার বিপরীত। এরা নিতান্ত দরিদ্র লক্ষ্মীছাড়া, বহু কষ্ট বহু চেষ্টায় কায়ক্লেশে অষ্টাবক্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; এক-একটা এমন বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে যে পাথর উঁচু করে তাদের ঠেকো দিয়ে রাখতে হয়েছে।
বামে চষা মাঠ; শাদা শাদা ভাঙা ভাঙা পাথরের টুকরাে চষা মাটির মধ্যে মধ্যে উৎক্ষিপ্ত। দক্ষিণে সমুদ্র। সমুদ্রের একেবারে ধারেই এক-একটি ছােটো ছােটো শহর দেখা দিচ্ছে। চর্চ-চূড়া-মুকুটিত শাদা ধবধবে নগরীটি একটি পরিপাটি তন্বী নাগরীর মতাে কোলের কাছে সমুদ্রদর্পণ রেখে নিজের মুখ দেখে হাসছে। নগর পেরিয়ে আবার মাঠ। ভুট্টার ক্ষেত, আঙুরের ক্ষেত, ফলের ক্ষেত, জলপাইয়ের বন; ক্ষেতগুলি খণ্ড-প্রস্তরের-বেড়া-দেওয়া। মাঝে মাঝে এক-একটি বাঁধা কূপ। দূরে দূরে দুটো-একটা সঙ্গীহীন ছোটো শাদা বাড়ি।
সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল। আমি কোলের উপর এক থোলো আঙুর নিয়ে বসে বসে এক-আধটা করে মুখে দিচ্ছি। এমন মিষ্টি টস্টসে সুগন্ধ আঙুর ইতিপূর্বে কখনো খাই নি। মাথায়-রঙিন-রুমাল-বাঁধা ঐ ইতালীয়া যুবতীকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, ইতালীয়ানীরা এখানকার আঙুরের গুচ্ছের মতো,অম্নি একটি বৃন্তভরা অজস্র সুডােল সৌন্দর্য, যৌবনরসে অম্নি উৎপূর্ণ এবং ঐ আঙুরেরই মতাে তাদের মুখের রঙ, অতি বেশি শাদা নয়।
এখন একটা উচ্চ সমুদ্রতটের উপর দিয়ে চলেছি; আমাদের ঠিক নীচেই ডান দিকে সমুদ্র। ভাঙাচোরা জমি ঢালু হয়ে জলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। গােটা চার-পাঁচ পাল-মােড়া নৌকা ডাঙার উপর তোলা। নীচেকার পথ দিয়ে গাধার উপর চড়ে লোক চলেছে। সমুদ্রতীরে কতকগুলাে গােরু চরছে, কী খাচ্ছে তারাই জানে― মাঝে মাঝে কেবল কতকগুলাে শুকনাে খড়কের মতাে আছে মাত্র।
রাত্রে আমরা গাড়ির ভােজনশালায় ডিনারে বসেছি, এমন সময় গাড়ি একটা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। এক দল নরনারী প্ল্যাটফর্মে ভিড় করে বিশেষ কৌতূহলের সঙ্গে আমাদের ভোজ দেখতে লাগল। তারই মধ্যে গ্যাসের আলােকে দুটি-একটি সুন্দর মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছিল, তাতে করে ভােজনপাত্র থেকে আমাদের চিত্তকে অনেকটা পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করছিল। ট্রেন ছাড়বার সময় আমাদের সহযাত্রীগণ তাদের প্রতি অনেক টুপি-রুমাল-আন্দোলন, অনেক চুম্বনসংকেত-প্রেরণ, তারস্বরে অনেক উল্লাসধ্বনি-প্রয়ােগ করলে; তারাও গ্রীবা-আন্দোলনে আমাদের প্রত্যভিবাদন করতে লাগল।
৮ সেপ্টেম্বর। কাল আড্রিয়াটিকের সমতল শ্রীহীন তীরভূমি দিয়ে আসছিলুম, আজ শস্যশ্যামলা লম্বার্ডির মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলছে। চারি দিকে আঙুর জলপাই ভুট্টা ও তুঁতের ক্ষেত। কাল যে আঙুরের লতা দেখা গিয়েছিল সেগুলাে ছােটো ছােটো গুল্মের মতাে। আজ দেখছি ক্ষেত-ময় লম্বা লম্বা কাঠি পোঁতা, তারই উপর ফলগুচ্ছপূর্ণ দ্রাক্ষালতা লতিয়ে উঠেছে।
ক্রমে পাহাড় দেখা দিচ্ছে। পাহাড়ের উপর থেকে নীচে পর্যন্ত দ্রাক্ষাদণ্ডে কণ্টকিত হয়ে উঠেছে, তারই মাঝখানে এক-একটি লােকালয়।
রেলের লাইনের ধারে দ্রাক্ষাক্ষেত্রের প্রান্তে একটি ক্ষুদ্র কুটির; এক হাতে তারই একটি দুয়ার ধ’রে এক হাত কোমরে দিয়ে একটি ইতালিয়ান যুবতী সকৌতুক কৃষ্ণনেত্রে আমাদের গাড়ির গতি নিরীক্ষণ করছে। অনতিদূরে একটি ছােটো বালিকা একটা প্রখরশৃঙ্গ প্রকাণ্ড গােরুর গলার দড়িটি ধরে নিশ্চিন্ত মনে চরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তার থেকে আমাদের বাংলাদেশের নবদম্পতির চিত্র মনে পড়ল। মস্ত একটা চশমা-পরা দাড়িওয়ালা গ্র্যাজুয়েট-পুঙ্গব এবং তারই দড়িটি ধরে ছোটো একটি বারাে-তেরাে বৎসরের নােলক-পরা নববধূ― জন্তুটি দিব্যি পােষ মেনে চরে বেড়াচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে বিস্ফারিত নয়নে কর্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত করছে।
ট্যুরিন স্টেশনে আসা গেল। এ দেশের সামান্য পুলিশম্যানের সাজ দেখে অবাক হতে হয়। মস্ত চূড়াওয়ালা টুপি, বিস্তর জরিজরাও, লম্বা তলােয়ার, সকল ক’টিকেই সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র বলে মনে হয়। আমাদের দেশে এ রকম জমকালাে পাহারাওয়ালা থাকলে আমরা সর্বদা ডরিয়ে ডরিয়ে আরও কাহিল হয়ে যেতুম।
দক্ষিণে বামে তুষাররেখাঙ্কিত সুনীল পর্বতশ্রেণী দেখা দিয়েছে। বামে ঘনচ্ছায়া স্নিগ্ধ অরণ্য। যেখানে অরণ্যের একটু বিচ্ছেদ পাওয়া যাচ্ছে সেইখানেই শস্যক্ষেত্র তরুশ্রেণী ও পর্বত-সমেত এক-একটা নব নব আশ্চর্য দৃশ্য খুলে যাচ্ছে। পর্বতশৃঙ্গের উপর পুরাতন দুর্গশিখর, তলদেশে এক-একটি ছােটো ছােটো গ্রাম। যত এগােচ্ছি অরণ্য পর্বত ক্রমশঃ ঘন হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে যে গ্রামগুলি আসছে সেগুলি তেমন উদ্ধত শুভ্র নবীন পরিপাটি নয়; একটু যেন ম্লান দরিদ্র নিভৃত; একটি-আধটি চর্চের চূড়া আছে মাত্র; কল-কারখানার ধুমােদ্গারী বৃংহিতধ্বনিত ঊর্ধ্বমুখী ইষ্টকশুণ্ড নেই।
ক্রমে অল্পে অল্পে পাহাড়ের উপরে ওঠা যাচ্ছে। পার্বত্যপথ সাপের মতাে এঁকেবেঁকে চলেছে। ঢালু পাহাড়ের উপর চষা ক্ষেত সােপানের মতো থাকে থাকে উঠেছে। একটি গিরিনদী স্বচ্ছ সফেন জলরাশি নিয়ে সংকীর্ণ উপলপথ দিয়ে ঝরে পড়ছে।
গাড়িতে আলাে দিয়ে গেল। এখনি মণ্ট্ সেনিসের বিখ্যাত দীর্ঘ রেলওয়ে-সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। গহ্বরটি উত্তীর্ণ হতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল।
এইবার ফ্রান্স্। দক্ষিণে এক জলস্রোত ফেনিয়ে ফেনিয়ে চলেছে। ফরাসী জাতির মতাে দ্রুত, চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত, হাস্যপ্রিয়, কলভাষী। কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক নির্মল এবং শিশুস্বভাব।
ফ্রান্সের প্রবেশদ্বারে একবার একজন কর্মচারী গাড়িতে এসে জিজ্ঞাসা করে গেল আমাদের মাশুল দেবার যােগ্য জিনিস কিছু আছে কি না— আমরা বললুম, না। আমাদের একজন বৃদ্ধ সহযাত্রী ইংরাজ বললেন: I don't parlez-vous francais.
সেই স্রোত এখনাে আমাদের ডান দিক দিয়ে চলেছে। তার পূর্বতীরে ‘ফার’ অরণ্য নিয়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চলা নির্ঝরিণী বেঁকে-চুরে, ফেনিয়ে-ফুলে, নেচে, কলরব ক’রে, পাথরগুলােকে সর্বাঙ্গ দিয়ে ঠেলে, রেলগাড়ির সঙ্গে সমান দৌড়বার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা লােহার সাঁকো মুষ্টি দিয়ে তার ক্ষীণ কটিদেশ পরিমাপ করবার চেষ্টা করছে। এক জায়গায় জলরাশি খুব সংকীর্ণ হয়ে এসেছে; দুই তীরের শ্রেণীবদ্ধ দীর্ঘ বৃক্ষগুলি শাখায় শাখায় বেষ্টন ক’রে দুরন্ত স্রোতকে অন্তঃপুরে বন্দী করতে বৃথা চেষ্টা করছে। উপর থেকে ঝর্না এসে সেই প্রবাহের সঙ্গে মিশছে। বরাবর পূর্বতীর দিয়ে একটি পার্বত্য পথ সমরেখায় স্রোতের সঙ্গে বেঁকে বেঁকে চলে গেছে। এক জায়গায় আমাদের সহচরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হল। হঠাৎ সে দক্ষিণ থেকে বামে এসে এক অজ্ঞাত সংকীর্ণ শৈলপথে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
শ্যামল তৃণাচ্ছন্ন পর্বতশ্রেণীর মধ্যে এক-একটা পাহাড় তৃণহীন সহস্ররেখাঙ্কিত পাষাণকঙ্কাল প্রকাশ করে নগ্ন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে; কেবল তার মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় খানিকটা করে অরণ্যের খণ্ড আবরণ রয়েছে। প্রচণ্ড সংগ্রামে একটা দৈত্য সহস্র হিংস্র নখের বিদারণরেখা রেখে যেন ওর শ্যামল ত্বক অনেকখানি করে আঁচড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে।
আবার হঠাৎ ডান দিকে আমাদের সেই পুর্বসঙ্গিনী মুহূর্তের জন্যে দেখা দিয়ে বামে চলে গেল। একবার দক্ষিণে একবার বামে, একবার অন্তরালে। ফরাসী ললনার মতাে বিচিত্র কৌতুকচাতুরী। আবার হয়তাে যেতে যেতে কোন্-এক পর্বতের আড়াল থেকে সহসা কলহাস্যে করতালি দিয়ে আচমকা দেখা দেবে।
সেই জলপাই এবং দ্রাক্ষাকুঞ্জ অনেক কমে গেছে। বিবিধ শস্যের ক্ষেত্র এবং দীর্ঘ সরল পপ্লার গাছের শ্রেণী। ভুট্টা, তামাক, নানাবিধ শাক-সবজি। মনে হয় কেবলই বাগানের পর বাগান আসছে। এই কঠিন পর্বতের মধ্যে মানুষ বহুদিন থেকে বহু যত্নে প্রকৃতিকে বশ ক’রে তার উচ্ছৃঙ্খলতা হরণ করেছে। প্রত্যেক ভূমিখণ্ডের উপর মানুষের কত প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছে। এ দেশের লােকেরা যে আপনার দেশকে ভালােবাসবে তার আর কিছু আশ্চর্য নেই। এরা আপনার দেশকে আপনার যত্নে আপনার করে নিয়েছে। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বহুকাল থেকে একটা বােঝাপড়া হয়ে আসছে, উভয়ের মধ্যে ক্রমিক আদানপ্রদান চলছে, তারা পরস্পর সুপরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ। এক দিকে প্রকাণ্ড প্রকৃতি উদাসীন ভাবে দাঁড়িয়ে, আর-এক দিকে বৈরাগ্যবৃদ্ধ মানব উদাসীন ভাবে শুয়ে —য়ুরােপের সে ভাব নয়। এদের এই সুন্দরী ভূমি এদের একান্ত সাধনার ধন, একে এরা নিয়ত বহু আদর করে রেখেছে। এর জন্যে যদি প্রাণ না দেবে তো কিসের জন্যে দেবে! এই প্রেয়সীর প্রতি কেউ তিলমাত্র হস্তক্ষেপ করলে কি আর সহ্য হয়? আমরা তাে জঙ্গলে থাকি; খাল বিল বন বাদাড় ভাঙারাস্তা এবং পানাপুকুরের ধারে বাস করি। ক্ষেত থেকে দুমুঠো ধান আনি, মেয়েরা আঁচল ভ’রে শাক তুলে নিয়ে আসে, ছেলেরা পাঁকের মধ্যে নেমে চিংড়িমাছ ধরে আনে, প্রাঙ্গণের গাছ থেকে গােটাকতক তেঁতুল পাড়ি, তার পরে শুকনাে কাঠকুট্ সংগ্রহ করে এক বেলা অথবা দু বেলা কোনাে রকম করে আহার চলে যায়। ম্যালেরিয়া এসে যখন জীর্ণ অস্থিকঙ্কাল কাঁপিয়ে তােলে তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে রৌদ্রে পড়ে থাকি, গ্রীষ্মকালে শুষ্কপ্রায় পঞ্চকুণ্ডের হরিদ্বর্ণ জলাবশেষ থেকে উঠে এসে ওলাউঠা যখন আমাদের গৃহ আক্রমণ করে তখন ওলাদেবীর পূজা দিই এবং অদৃষ্টের দিকে কোটরপ্রবিষ্ট হতাশ শূন্যদৃষ্টি বদ্ধ করে দল বেঁধে মরতে আরম্ভ করি। আমরা কি আমাদের দেশকে পেয়েছি না পেতে চেষ্টা করেছি? আমরা ইহলােকের প্রতি ঔদাস্য় ক’রে এখানে কেবল অনিচ্ছুক পথিকের মতাে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকি এবং যত শীঘ্র পারি দ্রুতবেগে বিশ-পঁচিশটা বৎসর ডিঙিয়ে একেবারে পরলােকে গিয়ে উপস্থিত হই।
কিন্তু, একি চমৎকার চিত্র! পর্বতের কোলে, নদীর ধারে, হ্রদের তীরে, পপ্লার-উইলাে-বেষ্টিত কাননশ্রেণী। নিষ্কণ্টক নিরাপদ নিরাময় ফলশস্যপরিপূর্ণ প্রকৃতি প্রতিক্ষণে মানুষের ভালােবাসা পাচ্ছে এবং মানুষকে দ্বিগুণ ভালােবাসছে। মানুষের মতাে জীবের এই তাে যােগ্য আবাসস্থান। মানুষের প্রেম এবং মানুষের ক্ষমতা যদি আপনার চতুর্দিককে সংযত সুন্দর সমুজ্জ্বল করে না তুলতে পারে তবে তরুকোটর গুহাগহবর বন’বাসী জন্তুর সঙ্গে তার প্রভেদ কী?
৮ সেপ্টেম্বর। পথের মধ্যে আমাদের প্যারিসে নাববার প্রস্তাব হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই ট্রেন প্যারিসে যায় না।— একটু পাশ কাটিয়ে যায়। প্যারিসের একটি নিকটবর্তী স্টেশনে স্পেশল ট্রেন প্রস্তুত রাখবার জন্যে টেলিগ্রাফ করা গেল।
রাত দুটোর সময় আমাদের জাগিয়ে দিলে। ট্রেন বদল করতে হবে। জিনিসপত্র বেঁধে বেরিয়ে পড়লুম। বিষম ঠাণ্ডা। অনতিদুরে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কেবলমাত্র একটি এঞ্জিন, একটি ফাস্ট্ ক্লাস এবং একটি ব্রেক্ভ্যান। আরােহীর মধ্যে আমরা তিনটি ভারতবর্ষীয়। রাত তিনটের সময় প্যারিসের জনশূন্য বৃহৎ স্টেশনে পোঁছনো গেল। সুপ্তোত্থিত দুই-একজন ‘ম্যসিয়’ আলো হস্তে উপস্থিত। অনেক হাঙ্গাম করে নিদ্রিত কাস্টম হৌসকে জাগিয়ে তার পরীক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করলুম। তখন প্যারিস তার সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে স্তব্ধ রাজপথে দীপশ্রেণী জ্বালিয়ে রেখে নিদ্রামগ্ন। আমরা হােটেল ট্যার্মিনুতে আমাদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলুম। পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, বিদ্যুদুজ্জল, স্ফটিকমণ্ডিত, কার্পেটাবৃত, চিত্রিতভিত্তি, নীলযবনিকাপ্রচ্ছন্ন শয়নশালা― বিহগপক্ষসুকোমল শুভ্র শয্যা।
বেশপরিবর্তন-পূর্বক শয়নের উদ্যোগ করবার সময় দেখা গেল আমাদের জিনিসপত্রের মধ্যে আর-এক জনের ওভার্কোট গাত্রবস্ত্র। আমরা তিন জনেই পরস্পরের জিনিস চিনি নে; সুতরাং হাতের কাছে যে-কোনাে অপরিচিত বস্তু পাওয়া যায় সেইটেই আমাদের কারও-না-কারও স্থির করে অসংশয়ে সংগ্রহ করে আনি। অবশেষে নিজের নিজের জিনিস পৃথক করে নেবার পর যখন দুটোচারটে উদ্বৃত্ত সামগ্রী পাওয়া যায়, তখন তা আর পূর্বাধিকারীকে ফিরিয়ে দেবার কোনাে সুযােগ থাকে না। ওভার্কোটটি রেলগাড়ি থেকে আনা হয়েছে; যার কোট সে বেচারা বিশ্বস্তচিত্তে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। গাড়ি এতক্ষণে সমুদ্রতীরস্থ ক্যালে নগরীর নিকটবর্তী হয়েছে। লােকটি কে এবং সমস্ত ব্রিটিশ রাজ্যের মধ্যে তার ঠিকানা কোথায় আমরা কিছুই জানি নে। মাঝের থেকে তার লম্বা কুর্তি এবং আমাদের পাপের ভার স্কন্ধের উপর বহন করে বেড়াচ্ছি―প্রায়শ্চিত্তের পথ বন্ধ। মনে হচ্ছে, একবার যে লােকটির কম্বল হরণ করেছিলুম এ কুর্তিটিও তার। কারণ, রেলগাড়িতে সে ঠিক আমাদের পরবর্তী শয্যা অধিকার করে ছিল। সে বেচারা বৃদ্ধ, শীতপীড়িত, বাতে পঙ্গু, অ্যাংলাে-ইন্ডীয় পুলিস-অধ্যক্ষ। পুলিসের কাজ করে মানবচরিত্রের প্রতি সহজেই তার বিশ্বাস শিথিল হয়ে এসেছে, তার পরে যখন দেখবে এক যাত্রায় একই রকম ঘটনা একই লােকের দ্বারা গভীর রাত্রে দুই-দুইবার সংঘটন হল তখন আর যাই হােক কখনােই আমাকে সে ব্যক্তি সুশীল সচ্চরিত্র বলে ঠাওরারে না। বিশেষতঃ কাল প্রত্যুষে ব্রিটিশ চ্যানেল পার হবার সময় তীব্র শীতবায়ু যখন তার হৃতকুর্তি জীর্ণ দেহকে কম্পান্বিত করে তুলবে তখন সেই সঙ্গে মনুষ্যজাতির সাধুতার প্রতিও তার বিশ্বাস চতুর্গুণ কম্পিত হতে থাকবে।
৯ সেপ্টেম্বর। প্রাতঃকালে দ্বিতীয়বার বেশ পরিবর্তন করবার সময় দেখা গেল আমার বন্ধুর একটি পাের্ট্ম্যাণ্টো পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা যে তিনটি লােক পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়েছি, তিনজনেই প্রায় সমান। আমার বােধ হচ্ছে, মাস তিনেক পরে যখন জন্মভূমিতে ফিরব তখন দেখতে পাব আমাদের নিজের আবশ্যকীয় যে ক’টি জিনিস সঙ্গে এনেছিলুম তার একটিও নেই এবং পরের অনাবশ্যক স্তূপাকার জিনিস কোথায় রাখব স্থান পাচ্ছি নে, মাশুল দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি এবং মাঝে মাঝে অসহ্য ব্যাকুল হয়ে ভিন্ন ভাষার সংবাদপত্রে বহুব্যয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।
যা হােক, পুলিশে সংবাদ দিয়ে প্রাতঃকালে আমরা তিন জনে প্যারিসের পথে পদব্রজে বেরিয়ে পড়লুম। প্রকাণ্ড রাজপথ দোকান বাগান প্রাসাদ প্রস্তরমূর্তি ফোয়ারা লােকজন গাড়িঘােড়ার মধ্যে অনেক ঘুরে ঘুরে এক ভােজনগৃহের বিরাট স্ফটিকশালার প্রান্তটেবিলে বসে অল্প আহার করে এবং বিস্তর মূল্য দিয়ে ঈফেল স্তম্ভ দেখতে গেলেম। এই লৌহস্তম্ভ চারি পায়ের উপরে ভর দিয়ে এক কাননের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কলের দোলায় চ’ড়ে এই স্তম্ভের চতুর্থ তলায় উঠে নিয়ে সমস্ত প্যারিসটাকে খুব একটা বড়ো ম্যাপের মতাে প্রসারিত দেখতে পেলুম।
বলা বাহুল্য, এমন করে এক দিনে তাড়াতাড়ি চক্ষুদ্বারা বহির্ভাগ লেহন করে প্যারিসের রসাস্বাদন করা যায় না। এ যেন, ধনীগৃহের মেয়েদের মতাে বদ্ধ পাল্কির মধ্যে থেকে গঙ্গাস্নান করার মতাে— কেবল নিতান্ত তীরের কাছে একটা অংশে এক ডুবে যতখানি পাওয়া যায়। কেবল হাঁপানিই সার।
হােটলে এসে দেখলুম পুলিসের সাহায্যে বন্ধুর পাের্ট্ম্যাণ্টো ফিরে এসেছে, কিন্তু এখনাে সেই পরের হৃত কোর্তা সম্বন্ধে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছি।
১০ সেপ্টেম্বর। লণ্ডন-অভিমুখে চললুম। সন্ধ্যার সময় লন্ডনে পৌঁছে দুই-একটি হােটেল অন্বেষণ করে দেখা গেল স্থানাভাব। অবশেষে একটি পরিবারের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল।
১১ সেপ্টেম্বর। সকালবেলায় আমাদের পুরাতন বন্ধুদের সন্ধানে বাহির হওয়া গেল।
প্রথমে, লন্ডনের মধ্যে আমার সর্বাপেক্ষা পরিচিত বাড়ি দ্বারে গিয়ে আঘাত করা গেল। যে দাসী এসে দরজা খুলে দিলে তাকে চিনি নে। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম আমার বন্ধু বাড়িতে আছেন কি না। সে বললে তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। জিজ্ঞাসা করলুম কোথায় থাকেন? সে বললে, আমি জানি নে, আপনারা ঘরে এসে বসুন, আমি জিজ্ঞাসা করে আসছি। পূর্বে যে ঘরে আমরা আহার করতুম সেই ঘরে গিয়ে দেখলুম সমস্ত বদল হয়ে গেছে― সেখানে টেবিলের উপর খবরের কাগজ এবং বই— সে ঘর এখন অতিথিদের প্রতীক্ষাশালা হয়েছে। খানিক ক্ষণ বাদে দাসী একটি কার্ডে লেখা ঠিকানা এনে দিলে। আমার বন্ধু এখন লন্ডনের বাইরে কোন্-এক অপরিচিত স্থানে থাকেন। ভারী নিরাশ হৃদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরলুম।
মনে কল্পনা উদয় হল, মৃত্যুর বহুকাল পরে আবার যেন পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। আমাদের সেই বাড়ির দরজার কাছে এসে দ্বারীকে জিজ্ঞাসা করলুম— আমার সেই অমুক এখানে আছে তাে? দ্বারী উত্তর করলে— না, সে অনেক দিন হল চলে গেছে। চলে গেছে? সেও চলে গেছে! আমি মনে করেছিলুম কেবল আমিই চলে গিয়েছিলুম, পৃথিবী-সুদ্ধ আর সবাই আছে। আমি চলে যাওয়ার পরেও সকলেই আপন আপন সময়-অনুসারে চলে গেছে। তবে তো সেই-সমস্ত জানা লােকেরা আর-কেহ কারও ঠিকানা খুঁজে পাবে না! জগতের কোথাও তাদের আর নির্দিষ্ট মিলনের জায়গা রইল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এমন সময়ে বাড়ির কর্তা বেরিয়ে এলেন― জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে হে! আমি নমস্কার করে বললুম, আজ্ঞে, আমি কেউ না, আমি বিদেশী। কেমন করে প্রমাণ করব এ বাড়ি আমার এবং আমাদের ছিল! একবার ইচ্ছে হল, অন্তঃপুরের সেই বাগানটা দেখে আসি―আমার সেই গাছগুলাে কত বড়ো হয়েছে। আর সেই ছাতের উপরকার দক্ষিণমুখো কুঠরি, আর সেই ঘর এবং সেই ঘর এবং সেই আর-একটা ঘর। আর সেই-যে ঘরের সম্মুখে বারান্দার উপর ভাঙা টবে গােটাকতক জীর্ণ গাছ ছিল―সেগুলাে এত অকিঞ্চিৎকর যে হয়তাে ঠিক তেমনি রয়ে গেছে, তাদের সরিয়ে ফেলতে কারও মনেও পড়ে নি।
আর বেশিক্ষণ কল্পনা করবার সময় পেলুম না। আমাদের গাড়ি মিস শ—য়ের বাড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়ালাে। গিয়ে দেখলুম তিনি নির্জন গৃহে বসে একটি পীড়িত কুকুরশাবকের সেবায় নিযুক্ত আছেন। জল বায়ু, পরস্পরের স্বাস্থ্য, এবং কালের পরিবর্তন সম্বন্ধে কতকগুলি প্রচলিত শিষ্টালাপ করা গেল।
সেখান থেকে বেরিয়ে, লন্ডনের সুরঙ্গপথে যে পাতালবাষ্পযান চলে তাই অবলম্বন করে বাসায় ফেরবার চেষ্টা করা গেল। কিন্তু পরিণামে দেখতে পেলুম পৃথিবীতে সকল চেষ্টা সফল হয় না। আমরা দুই ভাই তো গাড়িতে চড়ে বেশ নিশ্চিন্ত বসে আছি; এমন সময় গাড়ি যখন হ্যামার্স্মিথ-নামক দূরবর্তী স্টেশনে গিয়ে থামল তখন আমাদের বিশ্বস্ত চিত্তে ঈষৎ সংশয়ের সঞ্চার হল। একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে সে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলে আমাদের গম্যস্থান যে দিকে এ গাড়ির গমস্থান সে দিকে নয়। পুনর্বার তিন-চার স্টেশন ফিরে গিয়ে গাড়ি বদল করা আবশ্যক। তাই করা গেল। অবশেষে গম্য স্টেশনে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে আমাদের বাসা খুঁজে পাই নে। বিস্তর গবেষণার পর বেলা সাড়ে তিনটের সময় বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা টিফিন খাওয়া গেল। এইটুকু আত্মজ্ঞান জন্মেছে যে, আমরা দুটি ভাই লিভিংস্টোন অথবা স্ট্যান্লির মতাে ভৌগােলিক আবিষ্কারক নই; পৃথিবীতে যদি অক্ষয় খ্যাতি উপার্জন করতে চাই তাে নিশ্চয়ই অন্য কোনাে দিকে মনােনিবেশ করতে হবে।
১২ সেপ্টেম্বর। আমাদের বন্ধুর একটি গুণ আছে তিনি যতই কল্পনার চর্চা করুন-না কেন, কখনাে পথ ভােলেন না। সুতরাং তাঁকেই আমাদের লন্ডনের পাণ্ডাপদে বরণ করেছি। আমরা যেখানে যাই তাঁকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই, এবং তিনি যেখানে যান আমরা কিছুতেই তাঁর সঙ্গ ছাড়ি নে। কিন্তু একটা আশঙ্কা আছে এ রকম অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব এ পৃথিবীতে সকল সময় সমাদৃত হয় না। হায়! এ সংসারে কুসুমে কণ্টক, কলানাথে কলঙ্ক, এবং বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ আছে― কিন্তু, ভাগ্যিস আছে!
আজ বন্ধুসহায় হয়ে নিশ্চিন্ত মনে শহর ঘােরা গেল। ন্যাশনাল গ্যালারিতে ছবি দেখতে গেলুম। বড়াে ভয়ে ভয়ে দেখলুম। কোনাে ছবি পুরােপুরি ভালাে লাগতে দিতে দ্বিধা উপস্থিত হয়। সন্দেহ হয়, কোনাে প্রকৃত সমজদারের এ ছবি ভালাে লাগা উচিত কি না। আবার যে ছবি ভালাে লাগে না তার সম্বন্ধেও মুখ ফুটে কোনাে কথা বলতে পারি নে।
১৫ সেপ্টেম্বর। স্যাভয় থিয়েটারে ‘গন্ডোলিয়ার্স্’-নামক একটি গীতিনাট্য-অভিনয় দেখতে গিয়েছিলুম। আলােকে, সংগীতে, সৌন্দর্যে, বিবিধ বর্ণবিন্যাসে, দৃশ্যে, নৃত্যে, হাস্যে, কৌতুকে মনে হল একটা কোন্ কল্পরাজ্যে আছি। মাঝে এক অংশে অনেকগুলি নর্তকনর্তকীতে মিলে নৃত্য আছে; সেখানে আমার মনে হল আমার চারি দিকে যেন কিছুক্ষণ ধরে কিন্নরলােক থেকে সৌন্দর্যের অজস্র পুষ্পবৃষ্টি হয়ে গেল। যেন, হঠাৎ এক সময়ে একটা উন্মাদকর যৌবনের বাতাসে পৃথিবী জুড়ে সুন্দর নরনারীর একটা উলটপালট ঢেউ উঠেছে— তাতে আলোক এবং বর্ণচ্ছটা, সংগীত এবং উৎফুল্ল নয়নের উজ্জ্বল হাসি সহস্র ভঙ্গীতে চারি দিকে ঠিকরে পড়ছে।
১৬ সেপ্টেম্বর। আজ আমাদের গৃহস্বামিনীর কুমারী কন্যা আমার কতকগুলি পুরাতন পূর্বশ্রুত সুর পিয়ানােয় বাজাচ্ছিলেন; তাই শুনে আমার গৃহ মনে পড়তে লাগল। সেই ভারতবর্ষের রৌদ্রালােকিত প্রাতঃকাল, মুক্ত বাতায়ন, অব্যাহত আকাশ এবং পিয়ানাে যন্ত্রে এই স্বপ্নবহ পরিচিত সংগীতধ্বনি।
১৭ সেপ্টেম্বর। যে দুর্ভাগার শীতকোর্তা আমরা বহন করে করে বেড়াচ্ছি, ইন্ডিয়া আপিস -যােগে সে আমাদের একটি পত্র লিখেছে― আমরাই যে তার গাত্রবস্ত্রটি সংগ্রহ করে এনেছি সে বিষয়ে পত্রলেখক নিজের দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করেছে; তার সঙ্গে ‘ভ্রমক্রমে’ বলে একটা শব্দ যােগ করে দিয়েছিল, কিন্তু সেটা আমার মনে হল মৌখিক শিষ্টতা মাত্র। একটা সন্তোষের বিষয় এই, যার কম্বল নিয়েছিলুম এটা তার নয়। ভ্রমক্রমে দুবার একজনের গরম কাপড় নিলে ভ্রম সপ্রমাণ করা কিছু কঠিন হত।
১৯ সেপ্টেম্বর। এখানে রাস্তায় বেরিয়ে সুখ আছে। সুন্দর মুখ চোখে পড়বেই। শ্রীযুক্ত দেশানুরাগ যদি পারেন তাে আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার বিশ্বাস, ইংরাজ মেয়ের মতাে সুন্দরী পৃথিবীতে নেই। নবনীর মতাে সুকোমল শুত্র রঙের উপরে একখানি পাতলা টুকটুকে ঠোঁট, সুগঠিত নাসিকা, এবং দীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট নির্মল নীল নেত্র― দেখে পথকষ্ট দূর হয়ে যায়। শুভানুধ্যায়ীরা শঙ্কিত এবং চিন্তিত হবেন এবং প্রিয় বয়স্যেরা পরিহাস করবেন, কিন্তু এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে— সুন্দর মুখ আমার সুন্দর লাগে। তাই যদি না লাগত বিধাতার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হত। ঈফেল স্তম্ভের চতুর্থ চুড়াও আমার তেমন আশ্চর্য বােধ হয় না, একখানি সুন্দর মুখের সুমিষ্ট হাসি যেমন লাগে। সুন্দর হওয়া এবং মিষ্ট করে হাসা মানুষের যেন একটি পরমাশ্চর্য ক্ষমতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার ভাগ্যক্রমে ঐ হাসিটা এ দেশে এসে কিছু বাহুল্যপরিমাণে দেখতে পাই। এমন অনেক সময়ে হয়, রাজপথে কোনাে নীলনয়না পান্থরমনীর যেমন সম্মুখবর্তী হই অম নি সে আমার মুখের দিকে চেয়ে আর হাসি সম্বরণ করতে পারে না। তখন তাকে ডেকে বলে দিতে ইচ্ছা করে, সুন্দরি, আমি হাসি ভালােবাসি বটে, কিন্তু এতটা নয়। তা ছাড়া বিম্বাধরের উপর হাসি যতই সুমিষ্ট হােক-না কেন, তারও একটা যুক্তিসংগত কারণ থাকা চাই; কারণ, মানুষ কেবলমাত্র যে সুন্দর তা নয়, মানুষ বুদ্ধিমান জীব। হে নীলাজনয়নে, আমি তাে ইংরাজের মতাে অসভ্য খাটো কুর্তি এবং অসংগত লম্বা ধুচুনি-টুপি পরি নে, তবে হাসাে কী দেখে? আমি সুশ্রী কি কুশ্রী সে বিষয়ে কোনাে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা রুচিবিরুদ্ধ― কিন্তু এটা আমি খুব জোর করে বলতে পারি, বিদ্রূপের তুলি দিয়ে বিধাতাপুরুষ আমার মুখমণ্ডল অঙ্কিত করেন নি। তবে যদি রঙটা কালাে এবং চুলগুলাে কিছু লম্বা দেখে হাসি পায় তা হলে এই পর্যন্ত বলতে পারি, প্রকৃতিভেদে হাস্যরস সম্বন্ধে অদ্ভুত রুচিভেদ লক্ষিত হয়। তােমরা যাকে হিউমার বলো, আমার মতে, কালাে রঙের সঙ্গে তার কোনাে কার্যকারণ-সম্বন্ধ নেই। দেখেছি বটে, তােমাদের দেশে মুখে কালী মেখে কাফ্রি সেজে নৃত্যগীত করা একটা কৌতুকের মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। কিন্তু, কনককেশিনি, সেটা আমার কাছে নিতান্ত হৃদয়হীন বর্বরতা বলে বােধ হয়।
২২ সেপ্টেম্বর। আজ সন্ধ্যার সময় গােটাকতক বাংলা গান গাওয়া গেল। তার মধ্যে গুটি দুই-তিন এখানকার শ্রোত্রীগণ বিশেষ পছন্দ করেছেন। আশা করি, সেটা কেবলমাত্র মৌখিক ভদ্রতা নয়। তবে চাণক্য বলেছেন: বিশ্বাসো নৈব কর্তব্যঃ স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ। এঁরা একে স্ত্রীলােক, তাতে আবার আমাদের রাজকুল ইংরাজ-কুলও বটেন।
২৩ সেপ্টেম্বর। আজকাল সমস্ত দিনই প্রায় জিনিসপত্র কিনে দোকানে দোকানে ঘুরে কেটে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এলেই আমার বন্ধু বলেন, এসস বিশ্রাম করি গে। তার পরে আমরা খুব সমারােহের সহিত বিশ্রাম করতে যাই। শয়নগৃহে প্রবেশ করে আমার বান্ধব অনতিবিলম্বে শষ্যাতল আশ্রয় করেন, আমি পার্শ্ববর্তী একটি সুগভীর কেদারার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে বসি। তার পরে, আমরা কোনাে বিদেশী কাব্যগ্রন্থ পাঠ করি; নাহয় দুজনে মিলে জগতের যত-কিছু অতলস্পর্শ বিষয় আছে, দেখতে দেখতে তার মধ্যে তলিয়ে অন্তর্ধান হয়ে যাই। আজকাল এইভাবে এতই অধিক বিশ্রাম করছি যে, কাজের আর তিলমাত্র অবকাশ থাকে না। ড্রয়িংরুমে ভদ্রলােকেরা গীতবাদ্য সদালাপ করেন, আমরা তার সময় পাই নে― আমরা বিশ্রামে নিযুক্ত। শরীর রক্ষার জন্যে সকলে কিয়ৎকাল মুক্ত বায়ুতে ভ্রমণাদি করে থাকেন, সে হতেও আমরা বঞ্চিত— আমরা এত অধিক বিশ্রাম করে থাকি। রাত দুটো বাজল, আলাে নিবিয়ে দিয়ে সকলেই আরামে নিদ্রা দিচ্ছে, কেবল আমাদের দুই হতভাগ্যের ঘুমােবার অবসর নেই― আমরা তখন অত্যন্ত দুরূহ বিশ্রামে ব্যস্ত।
২৫ সেপ্টেম্বর। আজ এখানকার একটি ছােটোখাটো এক্জিবিশন দেখতে গিয়েছিলুম। শুনলুম, এটা প্যারিস এক্জিবিশনের অত্যন্ত সুলভ এবং সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় সংস্করণ। সেখানে চিত্রশালায় প্রবেশ ক’রে, কারােলু ড্যুঁরা -নামক একজন বিখ্যাত ফরাসী চিত্রকর -রচিত একটি বসনহীনা মানবীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! সুন্দর মানবশরীরের মতো সৌন্দর্য পৃথিবীতে আর-কিছু নেই। আমরা প্রকৃতির সকল শােভাই দেখি, কিন্তু মর্ত্যের এই চরম সৌন্দর্যের উপর, জীব-অভিব্যক্তির এই সর্বশেষ কীর্তিখানির উপর, মানুষ স্বহস্তে একটি চির-অন্তরাল টেনে রেখে দিয়েছে। এই ছবিখানি দেখলে চেতনা হয় পশু-মানুষ বিধাতার স্বহস্তরচিত একটি মহিমাকে বিলুপ্ত করে রেখেছে, এবং চিত্রকর মনুষ্যরচিত অপবিত্র আবরণ উদ্ঘাটন করে সেই দিব্য সৌন্দর্যের আশ্চর্য আভাস দিয়ে দিলে। যবনিকার এক প্রান্ত তুলে ধরে বললে, দেখাে, তােমরা কোন্ লক্ষ্মীকে অন্ধকারে নির্বাসিত করে রেখেছ! এই দেহখানির স্নিগ্ধ শুভ্র কোমলতা এবং প্রত্যেক সুঠাম সুনিপুণ ভঙ্গিমার উপরে সেই অসীম-সুন্দরের সযত্ন অঙ্গুলির সদ্যস্পর্শ দেখা যায় যেন। এ কেবলমাত্র দেহের সৌন্দর্য নয়, যদিও দেহের সৌন্দর্য যে বড় সামান্য এবং সাধুজনের উপেক্ষণীয় তা বলতে পারি নে— কিন্তু এতে আরও অনেকখানি গভীরতা আছে। একটি প্রীতিরমণীয় সুকোমল নারীপ্রকৃতি, একটি অমরসুন্দর মানবাত্মা এর মধ্যে বাস করে, তারই দিব্য লাবণ্য এর সর্বত্র উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। দূর থেকে চকিতের মতাে মানব-অন্তঃকরণের সেই অনির্বচনীয় চিররহস্যকে দেহের স্ফটিক বাতায়নে একটুখানি যেন দেখা গেল।
২৭ সেপ্টেম্বর। আজ লাইসীয়ম নাট্যশালায় গিয়েছিলুম। স্কট-রচিত ‘ব্রাইড অফ লামার্মূর’ উপন্যাস নাট্যাকারে অভিনীত হয়েছিল। বিখ্যাত অভিনেতা আর্ভিং নায়ক সেজেছিলেন। তাঁর নিতান্ত অস্পষ্ট উচ্চারণ এবং অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী, কিন্তু তৎসত্বেও তিনি কী-এক নাট্যকৌশলে ক্রমশঃ অলক্ষ্যে দর্শকদের হৃদয়ে সম্পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন করতে পারেন।
আমাদের সম্মুখবর্তী একটি বক্সে দুটি মেয়ে বসেছিল। তার মধ্যে একটি মেয়ের মুখ রঙ্গভূমির সমস্ত দর্শকের চিত্ত এবং দুরবীন আকৃষ্ট করেছিল। নিখুঁত সুন্দর ছোটো মুখখানি, অল্প বয়স, দীর্ঘ বেণী পিঠে বুলছে— বেশভূষার আড়ম্বর নেই। অভিনয়ের সময় যখন সমস্ত আলাে নিবিয়ে দিয়ে কেবল স্টেজের আলাে জ্বলছিল এবং সেই আলাে স্টেজের অনতিদূরবর্তী তার আধখানি মুখের উপর এসে পড়েছিল, তখন তার আলােকিত সুন্দর সুকুমার মুখের রেখা এবং সুভঙ্গিম গ্রীবা অন্ধকারের উপর চমৎকার চিত্র রচনা করেছিল। হিতৈষীরা আমাকে পুনশ্চ মার্জনা করবেন— অভিনয়কালে বারবার সে দিকে আমার দৃষ্টি বদ্ধ হয়ে ছিল। কিন্তু দূরবীন কষাটা আমার আসে না। নির্লজ্জ স্পর্ধার সহিত পরস্পরের প্রতি অসংকোচে দুরবীন প্রয়ােগ করা নিতান্ত রূঢ় মনে হয়। এদের মধ্যে কতকগুলাে অভদ্র প্রথা আছে― যত কালই এদের সংসর্গে থাকি সেগুলাে আমাদের যেন অভ্যাস হয়ে না যায়। যেমন ঘূর্ণী নাচ― বিশেষতঃ ওয়ালট্জ্ মেয়েদের নাচ-বস্ত্র, পুরুষদের খাটো কুর্তি, নাট্যশালায় দূরবীন কষা, নিমন্ত্রণসভায় কাউকে গান-বাজনায় প্রবৃত্ত করে দিয়ে গল্প জুড়ে দেওয়া।
২ অক্টোবর। একটি গুজরাটীর সঙ্গে দেখা হল। ইনি ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত পথ জাহাজের ডেকে চড়ে এসেছেন। তখন শীতের সময়। মাছ মাংস খান না। সঙ্গে চিঁড়ে শুষ্কফল প্রভৃতি কিছু ছিল এবং জাহাজ থেকে শাক সবজি কিছু সংগ্রহ করতেন। ইংরাজি অতি সামান্য জানেন। গায়ে শীতবস্ত্র অধিক নেই। লন্ডনে স্থানে স্থানে উদ্ভিজ্জ-ভােজের ভােজনশালা আছে, সেখানে ছয় পেনিতে তাঁর আহার সমাধা হয়। যেখানে যা-কিছু দ্রষ্টব্য জ্ঞাতব্য বিষয় আছে সমস্ত অনুসন্ধান করে বেড়ান। বড়ো বড়ো লােকের সঙ্গে অসংকোচে সাক্ষাৎ করেন। কিরকম করে কথাবার্তা চলে বলা শক্ত। মধ্যে মধ্যে কার্ডিনাল ম্যানিঙের সঙ্গে ধর্মালােচনা করে আসেন। ইতিমধ্যে এক্জিবিশনের সময় প্যারিসে দুই মাস যাপন করে এসেছেন এবং অবসরমত অ্যামেরিকায় যাবার সংকল্প করছেন। ভারতবর্ষে এঁকে আমি জানতুম। ইনি বাংলা শিক্ষা করে অনেক ভালাে বাংলা বই গুজরাটিতে তর্জমা করেছেন। এঁর স্ত্রীপুত্র পরিবার কিছুই নেই। ভ্রমণ করা, শিক্ষা করা এবং স্বদেশীয় সাহিত্যের উন্নতি সাধন করা এঁর একমাত্র কাজ। লােকটি অতি নিরীহ, শীর্ণ, খর্ব, পৃথিবীতে অতি অল্প পরিমাণ স্থান অধিকার করেন। এঁকে দেখে আমার আশ্চর্য বােধ হয়।
৬ অক্টোবর। এখনাে আমাদের প্রবাসের সময় উত্তীর্ণ হয় নি, কিন্তু আমি আর এখানে পেরে উঠছি নে। বলতে লজ্জা বােধ হয়, আমার এখানে ভালাে লাগছে না। সেটা গর্বের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয়— সেটা আমার স্বভাবের ক্রটি।
যখন কৈফিয়ত সন্ধান করি তখন মনে হয় যে, য়ুরােপের যে ভাবটা আমাদের মনে জাজ্জ্বল্যমান হয়ে উঠেছে সেটা সেখানকার সাহিত্য পড়ে। অতএব সেটা হচ্ছে ‘আইডিয়াল’ য়ুরোপ। অন্তরের মধ্যে প্রবেশ না করলে সেটা প্রত্যক্ষ করবার যাে নেই। তিন মাস, ছ মাস কিম্বা ছ বৎসর এখানে থেকে আমরা য়ুরোপীয় সভ্যতার কেবল হাত-পা নাড়া দেখতে পাই মাত্র। বড়াে বড়াে বাড়ি, বড়াে বড়াে কারখানা, নানা আমােদের জায়গা। লােক চলছে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে, খুব একটা সমারােহ। সে যতই বিচিত্র যতই আশ্চর্য হােক-না কেন, তাতে দর্শককে শ্রান্তি দেয়; কেবলমাত্র বিস্ময়ের আনন্দ চিত্তকে পরিপূর্ণ করতে পারে না, বরং তাতে মনকে সর্বদা বিক্ষিপ্ত করতে থাকে।
অবশেষে এই কথা মনে আসে— আচ্ছা, ভালাে রে বাপু, আমি মেনে নিচ্ছি তুমি মস্ত শহর, মস্ত দেশ, তােমার ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের সীমা নেই। আর অধিক প্রমাণের আবশ্যক নেই। এখন আমি বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। সেখানে আমি সকলকে চিনি, সকলকে বুঝি; সেখানে সমস্ত বাহ্যাবরণ ভেদ করে মনুষ্যত্বের আস্বাদ সহজে পাই। সহজে উপভােগ করতে পারি, সহজে চিন্তা করতে পারি, সহজে ভালােবাসতে পারি। যেখানে আসল মানুষটি আছে সেখানে যদি অবাধে যেতে পারতুম, তা হলে আপনার স্বজাতীয়কে দেখে এ স্থানকে আর প্রবাস বলে মনে হত না। কিন্তু তােমাদের সাহিত্যের মধ্যে যাদের সঙ্গে প্রত্যহ সাক্ষাৎ হয় তােমাদের সমাজের মধ্যে তাদের দর্শন পাওয়া দুর্লভ। কারণ, সাহিত্যে সমস্ত বাত্যাবরণ দুর করে অন্তরঙ্গ মানুষটিকে টেনে এনে বিনা ভূমিকায় এবং বিনা পরিচয়পত্রে মিলন করিয়ে দেয়। তখন ভ্রম হয় ইংলন্ডে পদার্পণ করবামাত্রই এই-সব মানুষের সঙ্গে বুঝি পথে ঘাটে সম্মিলন হবে। কিন্তু এখানে এসে দেখি কেবল ইংরাজ, কেবল বিদেশী; তাদের চালচলন ধরণধারণ যা-কিছু নূতন সেইটেই কেবল ক্রমিক চক্ষে পড়ে, যা চিরকেলে পুরাতন সেটা ঢাকা পড়ে থাকে; সেইজন্যে এদের সঙ্গে কেবল পরিচয় হতে থাকে, কিন্তু প্রণয় হয় না।
এইখানে কথামালার একটা গল্প মনে পড়ছে।―
একটা চতুর শৃগাল একদিন সুবিজ্ঞ বককে আহারে নিমন্ত্রণ করেছিল। বক সভায় গিয়ে দেখে বড়াে বড়াে থালা সুমিষ্ট লেহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ। প্রথম শিষ্ট সম্ভাষণের পর শৃগাল বললে, ‘ভাই, এসাে, আরম্ভ করে দেওয়া যাক।’ বলেই তৎক্ষণাৎ অবলীলাক্রমে লেহন করতে প্রবৃত্ত হল। বক তার দীর্ঘ চঞ্চু নিয়ে থালার মধ্যে যতই ঠোকর মারে মুখে কিছুই তুলতে পারে না। অবশেষে চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়ে স্বাভাবিক অটল গাম্ভীর্য অবলম্বন -পূর্বক সরােবরকূলের ধ্যানে নিমগ্ন হল। শৃগাল বােধ করি মাঝে মাঝে কটাক্ষপাত করে বলছিল, ভাই, খাচ্ছ না যে! এ কেবল তােমাকে মিথ্যা কষ্ট দেওয়াই হল! তােমার যােগ্য আয়ােজন হয় নি! বক বােধ করি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, আহা, সে কী কথা! রন্ধন অতি পরিপাটি হয়েছে। কিন্তু শরীরগতিকে আজ আমার কেমন ক্ষুধা বােধ হচ্ছে না। পরদিন বকের নিমন্ত্রণে শৃগাল গিয়ে দেখেন, লম্বা ভাঁড়ের মধ্যে বিবিধ উপাদেয় সামগ্রী সাজানাে রয়েছে। দেখে লােভ হয়, কিন্তু তার মধ্যে শৃগালের মুখ প্রবেশ করে না। বক অনতিবিলম্বে লম্বচঞ্চুচালনা করে ভােজনে প্রবৃত্ত হল। শৃগাল বাহিরের থেকে পাত্রলেহন এবং দুটো-একটা উৎক্ষিপ্ত খাদ্যখণ্ডের স্বাদগ্রহণ করে নিতান্ত ক্ষুধাতুর ভাবে বাড়ি ফিরে গেল।
জাতীয় ভােজে বিদেশীর অবস্থা সেই রকম. খাদ্যটা উভয়ের পক্ষে সমান উপাদেয়, কিন্তু পাত্রটা তফাত। ইংরাজ যদি শৃগাল হয় তবে তার সুবিস্তৃত শুভ্র রজতথালের উপর উদ্ঘাটিত পায়সান্ন কেবল চক্ষে দর্শন করেই আমাদের ক্ষুধিতভাবে চলে আসতে হয়, আর আমরা যদি তপস্বী বক হই তবে আমাদের সুগভীর পাথরের পাত্রটার মধ্যে কী আছে শৃগাল তা ভালাে করে চক্ষেও দেখতে পায় না— দূর থেকে ঈষৎ ঘ্রাণ নিয়েই তাকে ফিরতে হয়।
প্রত্যেক জাতির অতীত ইতিহাস এবং বাহ্যিক আচার ব্যবহার তার নিজের পক্ষে সুবিধা, কিন্তু অন্য জাতির পক্ষে বাধা। এই জন্য ইংরাজসমাজ যদিও বাহ্যতঃ সাধারণসমক্ষে উদ্ঘাটিত, কিন্তু আমরা চক্ষুর অগ্রভাগটুকুতে তার দুই-চার ফোঁটার স্বাদ পাই মাত্র, ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারি নে। সর্বজাতীয় ভােজ কেবল সাহিত্যক্ষেত্রেই সম্ভব। সেখানে, যার লম্বা চঞ্চু সেও বঞ্চিত হয় না, যার লােল জিহ্বা সেও পরিতৃপ্ত হয়।
কারণটা সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হােক বা না হােক, এখানকার লোকের সঙ্গে হৌ-ডু-য়ু-ডু ব’লে, হাঁ ক’রে রাস্তায় ঘাটে পর্যটন ক’রে, থিয়েটার দেখে, দোকান ঘুরে, কল-কারখানার তথ্য নির্ণয় ক’রে— এমন-কি, সুন্দর মুখ দেখে আমার শ্রান্তি বােধ হয়েছে। কেবলমাত্র গতি, কোলাহল, সমারোহ— অবস্থাবিশেষে ভালাে লাগতে পারে। যদি কখনাে জীবন মনের নিতান্ত জড়ভাব উপস্থিত হয় তখন তাকে বাহিরের অবিশ্রাম আঘাতে সচেতন ক’রে ঈষৎ জীবনের উত্তাপ দান করতে পারা যায়। কিন্তু মন যখন সদাসচেতনভাবে কাজ করছে, চিন্তা করছে, ভালােবাসছে, তখন বাহিরের এই বিপরীত গােলযােগে তাকে কেবল উদ্ভ্রান্ত করে তােলে। বলা আবশ্যক, এই-যে গােলযােগ এ কেবল আমাদেরই পক্ষে গােলযােগ, সেখানকার নেটিভদের পক্ষে নয়। সমুদ্রের যে গর্জন সে কেবল সমুদ্রতীরেই শােনা যায়, জলজন্তুরা বেশ নিঃশব্দ নিস্তব্ধতার মধ্যে জীবন নির্বাহ করে।
অতএব স্থির করেছি এখন বাড়ি ফিরব।
৭ অক্টোবর। ‘টেম্স্’ জাহাজে একটা ক্যাবিন স্থির করে আসা গেল। পরশু জাহাজ ছাড়বে।
৯ অক্টোবর। জাহাজে ওঠা গেল। এবারে আমি একা। আমার সঙ্গীরা বিলাতে রয়ে গেলেন। আমার নির্দিষ্ট ক্যাবিনে গিয়ে দেখি সেখানে এক কক্ষে চার জনের থাকবার স্থান এবং আর এক জনের জিনিসপত্র একটি কোণে রাশীকৃত হয়ে আছে। বাক্স তােরঙ্গের উপর নামের সংলগ্নে লেখা আছে ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’। বলা বাহুল্য, এই লিখন দেখে ভাবী সঙ্গসুখের কল্পনায় আমার মনে অপরিমেয় নিবিড়ানন্দের সঞ্চার হয় নি। ভাবলুম, কোথাকার এক ভারতবর্ষের রোদে ঝলস এবং শুকনাে খট্খটে হাড়-পাকা অত্যন্ত ঝাঁঝালাে বুনাে অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ানের সঙ্গে আমাকে এক জাহাজে পুরেছে! যাদের মধ্যে শত হস্ত ব্যবধান যথেষ্ট নয়, এইটুকু ক্যাবিনের মধ্যে তাদের দুজনের স্থান সংকুলান হবে কী করে? গালে হাত দিয়ে বসে এই কথা ভাবছি এমন সময়ে এক অল্পবয়স্ক সুশ্রী ইংরাজ যুবক ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাকে সহাস্য মুখে ‘শুভ প্রভাত’ অভিবাদন করলেন— মুহূর্তের মধ্যে আমার সমস্ত আশঙ্কা দূর হয়ে গেল। সবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইনি ভারতবর্ষে যাত্রা করছেন। এঁর শরীরে ইংলন্ডবাসী ইংরাজের স্বাভাবিক সহৃদয় ভদ্রতার ভাব এখনাে সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রয়েছে।
১০ অক্টোবর। সুন্দর প্রাতঃকাল। সমুদ্র স্থির। আকাশ পরিষ্কার। সূর্য উঠেছে। ভােরের বেলা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আমাদের ডান দিক থেকে অল্প অল্প তীরের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। অল্পে অল্পে কুয়াশার যবনিকা উঠে গিয়ে ওয়াইট দ্বীপের পার্বত্যতীর এবং ভেণ্ট্নর শহর ক্রমে ক্রমে প্রকাশ হয়ে পড়ল।
এ জাহাজে বড়াে ভিড়। নিরিবিলি কোণে চৌকি টেনে যে একটু লিখব তার যাে নেই, সুতরাং সম্মুখে যা-কিছু চোখে পড়ে তাই চেয়ে চেয়ে দেখি।
ইংরাজ মেয়ের চোখ নিয়ে আমাদের দেশের লােক প্রায়ই ঠাট্টা করে, বিড়ালের চোখের সঙ্গে তার তুলনা করে থাকে। কিন্তু, এমন সর্বদাই দেখা যায়, তারাই যখন আবার বিলাতে আসে তখন স্বদেশের হরিণনয়নের কথাটা আর তাদের বড় মনে থাকে না। অভ্যাসের বাধাটা একবার অতিক্রম করতে পারলেই এক সময়ে যাকে পরিহাস করা গিয়েছে আর-এক সময় তার কাছেই পরাভব মানা নিতান্ত অসম্ভব নয়― ওটা স্পষ্ট স্বীকার করাই ভালাে। যতক্ষণ দূরে আছি কোনাে বালাই নেই, কিন্তু লক্ষপথে প্রবেশ করলেই ইংরাজ সুন্দরীর দৃষ্টি আমাদের অভ্যাসের আবরণ বিদ্ধ ক’রে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে। ইংরাজ সুনয়নার চোখ মেঘমুক্ত নীলাকাশের মতাে পরিষ্কার, হীরকের মতাে উজ্জ্বল এবং ঘন পল্লবে আচ্ছন্ন— তাতে আবেশের ছায়া নেই। অন্য কারও সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই নে— কিন্তু একটি মুগ্ধহৃদয়ের কথা বলতে পারি, সে নীলনেত্রের কাছেও অভিভূত এবং হরিণনয়নকেও কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না। কৃষ্ণ কেশপাশও সে মূঢ়ের পক্ষে বন্ধন এবং কনককুন্তলও সামান্য দৃঢ় নয়।
সংগীত সম্বন্ধেও দেখা যায়, পূর্বে যে ইংরাজি সংগীতকে পরিহাস করে আনন্দ লাভ করা গেছে, এখন তৎপ্রতি মনােযােগ করে ততােধিক বেশি আনন্দ লাভ করা যায়। এখন অভ্যাসক্রমে য়ুরােপীয় সংগীতের এতটুকু আস্বাদ পাওয়া গেছে যার থেকে নিদেন এইটুকু বােঝা গেছে যে, যদি চর্চা করা যায় তা হলে য়ুরােপীয় সংগীতের মধ্যে থেকে পরিপূর্ণ রস পাওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশী সংগীত যে আমার ভালাে লাগে সে কথার বিশেষ উল্লেখ করা বাহুল্য। অথচ দুয়ের মধ্যে যে সম্পূর্ণ জাতিভেদ আছে তার আর সন্দেহ নেই।
১৩ অক্টোবর। একটি রমণী গল্প করছিলেন, তিনি পূর্বেকার কোন্-এক সমুদ্রযাত্রায় কাপ্তেন অথবা কোনাে কোন পুরুষ যাত্রীর প্রতি কঠিন পরিহাস ও উৎপীড়ন করতেন— তার মধ্যে একটা হচ্ছে চৌকিতে পিন ফুটিয়ে রাখা। শুনে আমার তেমন মজাও মনে হল না এবং সেই-সকল বিশেষ অনুগৃহীত পুরুষদের স্থলাভিষিক্ত হতেও একান্ত বাসনার উদ্রেক হল না। দেখা যাচ্ছে, এখানে পুরুষদের প্রতি মেয়েরা অনেকটা দূর পর্যন্ত রূঢ়াচরণ করতে পারেন, তাতে ততটা সামাজিক নিলার কারণ হয় না। ভেবে দেখতে গেলে ইংরাজসমাজেও পুরুষের মধ্যে উচ্চনীচভেদ আছে ব’লেই এটা সম্ভব হতে পেরেছে। যেমন বালকের কাছ থেকে উপদ্রব অনেক সময় আমােদজনক লীলার মতাে মনে হয়, স্ত্রীলােকদের অত্যাচারের প্রতিও পুরুষেরা সেই রকম স্নেহময় উপেক্ষা প্রদর্শন করে, এবং অনেক সময় সেটা ভালােবাসে। পুরুষদের মুখের উপর রূঢ় সমালােচনা শুনিয়ে দেওয়া স্ত্রীলােকদের একটা অধিকারের মধ্যে। সেই লঘুগতি তীক্ষ্ণ তীব্রতার দ্বারা তাঁরা পুরুষের শ্রেষ্ঠতাভিমান বিদ্ধ করে আপনার গৌরব অনুভব করেন। সামাজিক প্রথা এবং অনিবার্য কারণ-বশতঃ নানা বিষয়ে তাঁরা পুরুষের অধীন ব’লেই লৌকিকতা এবং শিষ্টাচার সম্বন্ধে অনেক সময়ে তাঁরা পুরুষদের লঙ্ঘন করে আনন্দ লাভ করেন। কার্যক্ষেত্রে যারা পরস্পর সমকক্ষ প্রতিযােগী, সামাজিক আচারে ব্যবহারে তাদের মধ্যে সমান ভাবের ভদ্রতার নিয়ম থাকা আবশ্যক; কিন্তু যেখানে সেই প্রতিযােগিতা নেই সেখানে দুর্বল কিঞ্চিৎ দুরন্ত এবং সবল সম্পূর্ণ সহিষ্ণু এটা দেখতে মন্দ হয় না। এবং বলোন্মত্ত পুরুষের পক্ষে এ একটা শিক্ষা। স্ত্রীলােকের যে বল সে এক হিসাবে পুরুষেরই প্রদত্ত বল—মাধুর্যের কাছে আমরা স্বাধীনভাবে আপন স্বাধীনতা বিসর্জন করি। অবলার দুর্বলতা পুরুষের ইচ্ছাতেই বলপ্রাপ্ত হয়েছে এই জন্য যে, পুরুষের পৌরুষ আছে স্ত্রীলােকের উপদ্রব সে বিনা বিদ্রোহে আনন্দের সহিত সহ্য করে এবং এই সহিষ্ণুতায় তার পৌরুষেরই চর্চা হতে থাকে। যে দেশের পুরুষেরা কাপুরুষ তারাই কোনাে বিষয়েই স্ত্রীলােকের কাছে পরাভব স্বীকার করতে চায় না— তারাই নির্লজ্জভাবে পুরুষপূজাকে, পুরুষের প্রাণপণ সেবাকেই, স্ত্রীলােকের সর্বোচ্চ ধর্ম বলে প্রচার করে। সেই দেশেই দেখা যায় স্বামী রিক্তহস্তে আগে আগে যাচ্ছে আর স্ত্রী তার বােঝাটি বহন ক’রে পিছনে চলেছে; স্বামীর দল ফাস্ট্ ক্লাসে চড়ে যাত্রা করছে আর কতকগুলি জড়সড় ঘােমটাচ্ছন্ন স্ত্রীগণকে নিম্নশ্রেণীতে পুরে দেওয়া হয়েছে; সেই দেশেই দেখা যায় আহারে বিহারে ব্যবহারে সকল বিষয়েই সুখ এবং আরাম কেবল পুরুষের, উচ্ছিষ্ট এবং উদ্বর্ত কেবল স্ত্রীলােকের― এবং তাই নিয়ে বেহায়া কাপুরুষেরা অসংকোচে গৌরব করে থাকে এবং তার তিলমাত্র ইতস্ততঃ হলে সেটাকে তারা খুব একটা প্রহসনের বিষয় বলে জ্ঞান করে। স্বভাবদুর্বল সুকুমার স্ত্রীলােকদের সর্বপ্রকার আরামসাধন এবং কষ্টলাঘবের প্রতি সযত্ন মনােযােগ যে কঠিনকায় বলিষ্ঠ পুরুষদের একটি স্বভাবসিদ্ধ গুণ হওয়া উচিত এ তারা কল্পনা করতে পারে না― তারা কেবল এইটুকু মাত্র জানে শাসনভীতা স্নেহশালিনী রমণী তাদের চরণে তৈল লেপন করবে, তাদের বদনে অন্ন যুগিয়ে দেবে, তাদের তপ্ত কলেবরে পাখার ব্যজন করবে, তাদের আলস্যচর্চার আয়ােজন করে দেবে, পঙ্কিল পথে পায়ে জুতো দেবে না, শীতের সময় গায়ে কাপড় দেবে না, রৌদ্রের সময় মাথায় ছাতা দেবে না, ক্ষুধার সময় কম ক’রে খাবে, আমােদর সময় যবনিকার আড়ালে থাকবে এবং এই বৃহৎ মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে যে আলােক আনন্দ সৌন্দর্য স্বাস্থ্য আছে তার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবে। স্বার্থপরতা পৃথিবীর সর্বত্রই আছে, কিন্তু নির্লজ্জ নিঃসংকোচ স্বার্থপরতা কেবল সেই দেশেই আছে যে দেশে পুরুষেরা পুরুষমানুষ নয়।
মেয়েরা আপনার স্নেহপরায়ণ সহৃদয়তা থেকে পুরুষের সেবা করে থাকে, এবং পুরুষেরা আপনার উদার দুর্বলবৎসলতা থেকে স্ত্রীলােকের সেবা করে থাকে; যে দেশে স্ত্রীলােকেরা সেই সেবা পায় না, কেবল সেবা করে, সে দেশে তারা অপমানিত এবং সে দেশও লক্ষ্মীছাড়া।
কিন্তু কথাটা হচ্ছিল স্ত্রীলােকের দৌরাত্ম্য সম্বন্ধে। গােলাপের যে কারণে কাঁটা থাকা আবশ্যক, যেখানে স্ত্রীপুরুষে বিচ্ছেদ নেই সেখানে স্ত্রীলোকেরও সেই কারণে প্রখরতা থাকা চাই, তীক্ষ্ণ কথায় মর্মচ্ছেদ করবার অভ্যাস থাকলে অবলার পক্ষে অনেক সময়েই কাজে লাগে।
আমাদের গােলাপগুলিই কি একেবারে নিষ্কণ্টক? কিন্তু সে বিষয়ে সমধিক সমালােচনা করতে বিরত থাকা গেল।
১৪ অক্টোবর। জিব্রাল্টার পৌঁছনো গেল। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।
আজ ডিনার-টেবিলে একটা মােটা আঙুল এবং ফুলাে গোঁফ-ওয়ালা প্রকাণ্ড জোয়ান গােরা তার সুন্দরী পার্শ্ববর্তিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় পাখাওয়ালার গল্প করছিল। সুন্দরী কিঞ্চিৎ নালিশের নাকীস্বরে বললেন— পাখাওয়ালারা রাত্রে পাখা টানতে টানতে ঘুমােয়। জোয়ান লােকটা বললে তার একমাত্র প্রতিবিধান হচ্ছে লাথি কিম্বা লাঠি। এবং পাখা-আন্দোলন সম্বন্ধে এই ভাবে আন্দোলন চলতে লাগল। আমার বুকে হঠাৎ যেন একটা তপ্ত শূল বিঁধল। এইভাবে যারা স্ত্রীপুরুষে কথােপকথন করে তারা যে অকাতরে এক সময় একটা দিশি দুর্বল মানব-বিড়ম্বনাকে ভবপারে লাথিয়ে ফেলে দেবে তার আর বিচিত্র কী? আমিও তাে সেই অপমানিত জাতের একটা লােক, আমি কোন্ লজ্জায় কোন্ সুখে এদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাই এবং একত্রে দন্তোন্মীলন করি। শরীরের সমস্ত রাগ কণ্ঠ পর্যন্ত এল, কিন্তু একটা কথাও বহু চেষ্টাতে সে জায়গায় এসে পৌঁছল না! বিশেষতঃ ওদের ঐ ইংরাজি ভাষাটা বড়ােই বিজাতীয় রকমের ভাষা― মনটা একটু বিচলিত হয়ে গেলেই ও ভাষাটা আর কিছুতেই মনের মতাে কায়দা করে উঠতে পারি নে― তখন মাথার চতুর্দিক হতে রাজ্যের বাংলা কথা চাকনাড়া মৌমাছির মতো মুখদ্বারে ভিড় করে ছুটে আসে। ভাবলুম এত উতলা হয়ে উঠলে চলবে না, একটু ঠাণ্ডা হয়ে দুটো-চারটে ব্যাকরণ শুদ্ধ ইংরিজি কথা মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিই। ঝগড়া করতে গেলে নিদেন ভাষাটা ভালো হওয়া চাই।
তখন মনে মনে নিম্নলিখিতমত ভাবটা ইংরাজিতে রচনা করতে লাগলুম।—
‘কথাটা ঠিক বটে মশায়! পাখাওয়ালা মাঝে মাঝে রাত্রে তুললে অত্যন্ত অসুবিধা হয়। দেহধারণ করলেই এমন কতকগুলো সহ্য করতে হয় এবং সেইজন্যই খৃস্টীয় সহিষ্ণুতার আবশ্যক হয়ে পড়ে। এবং এইরূপ সময়েই ভদ্রাভদ্রের পরিচয় পাওয়া যায়।
‘যে লোক তোমার আঘাতের প্রতিশোধ নিতে একেবারেই অক্ষম, খপ করে তার উপরে লাথি তোলা চূড়ান্ত কাপুরুষতা—অভদ্রতার চেয়ে বেশি!
‘আমরা জাতটা যে তোমাদের চেয়ে দুর্বল সেটা একটা প্রাকৃতিক সত্য, সে আর আমাদের অস্বীকার করবার যো নেই। তোমাদের গায়ের জোর বড় বেশি, তোমরা ভারী পালোয়ান।
‘কিন্তু সেইটেই কি এত গর্বের বিষয় যে, মনুষ্যত্বকে তার নীচে আসন দেওয়া হয়!
‘তোমরা বলবে, কেন, আমাদের আর কি কোনো শ্রেষ্ঠতা নেই?
‘থাকতেও পারে। তবে, যখন একজন অস্থিজর্জর অর্ধ-উপবাসী দরিদ্রের রিক্ত উদরের উপরে লাথি বসিয়ে দাও এবং তৎসম্বন্ধে রমণীদের সঙ্গে কৌতুকালাপ কর এবং সুকুমারীগণও তাতে বিশেষ বেদনা অনুভব করেন না, তখন কিছুতেই তোমাদের শ্রেষ্ঠ বলে ঠাহর করা যায় না।
‘বেচারার অপরাধ কী দেখা যাক! ভোরের বেলা আহার করে বেরিয়েছে, সমস্ত দিন খেটেছে। হতভাগা আরো দুটো পয়সা বেশি উপার্জন করবার আশায় রাত্রের বিশ্রামটা তোমাকে দু-চার আনায় বিক্রয় করেছে। নিতান্ত গরিব ব’লেই তার এই ব্যবসায়, বড়োসাহেবকে ঠকাবার জন্যে সে ষড়যন্ত্র করে নি।
‘এই ব্যক্তি রাত্রে পাখা টানতে টানতে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে— এ দোষটা তার আছে বলতেই হবে।
‘কিন্তু আমার বোধ হয় এটা মানবজাতির একটা আদিম পাপের ফল। যন্ত্রের মতো বসে বসে পাখা টানতে গেলেই আদমের সন্তানের চোখে ঘুম আসবেই। সাহেব নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
‘এক ভৃত্যের দ্বারা কাজ না পেলে দ্বিতীয় ভৃত্য রাখা যেতে পারে, কিন্তু যে কাপুরুষ তাকে লাথি মারে সে নিজেকে অপমান করে। কারণ, তখনি তার একটি প্রতিলাথি প্রাপ্য হয়— সেটা প্রয়োগ করবার লোক কেউ হাতের কাছে উপস্থিত নেই এইটুকু মাত্র প্রভেদ।
‘তোমরা অবসর পেলেই আমাদের বলে থাক যে, তোমাদের মধ্যে যখন বাল্যবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত তখন তোমরা রাজ্যতন্ত্রের মধ্যে কোনো স্বাধীন অধিকার প্রাপ্তির যোগ্য নও।
‘কিন্তু তার চেয়ে এ কথা সত্য যে, যে জাত নিরাপদ দেখে দুর্বলের কাছে ‘তেরিয়া’— অর্থাৎ তোমরা যাকে বল ‘বুলি’— যার কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই— অপ্রিয় অশিষ্ট ব্যবহার যাদের স্বভাবতঃ আসে, কেবল স্বার্থের স্থলে যারা নম্রভাব ধারণ করে, তারা কোনো বিদেশীরাজ্য-শাসনের যোগ্য নয়।
‘অবশ্য, যোগ্যতা দু রকমের আছে-ধর্মত এবং কার্যতঃ। এমন কতকগুলি স্থল আছে যেখানে শুদ্ধমাত্র কৃতকারিতাই যােগ্যতার প্রমাণ নয়। গায়ের জোর থাকলে অনেক কাজই বলপূর্বক চালিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বিশেষ বিশেষ কাজে বিশেষ বিশেষ উপযােগী নৈতিক গুণের দ্বারাই সে কার্য-বহনের প্রকৃত অধিকার পাওয়া যায়।
‘তুমি কেবল প্রহারের জোরে পিতার কর্তব্যসাধন করতে পার, কিন্তু পিতৃস্নেহ এবং মঙ্গল-ইচ্ছা ব্যতীত ধর্মতঃ পিতৃত্বের অধিকার জন্মে না।
‘কিন্তু ধর্মের শাসন সদ্য সদ্য দেখা যায় না ব’লে যে ধর্মের রাজ্য অরাজক তা বলা যায় না। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিষ্ঠুরতা এবং প্রতিদিনের ঔদ্ধত্য প্রতিদিন সঞ্চিত হচ্ছে, এক সময় এরা তােমাদেরই শিরে ভেঙে পড়বে।
‘যদি বা আমরা সকল অপমানই নীরবে অথবা কথঞ্চিৎ কলরব সহকারে সহ্য করে যাই, প্রতিকারের কোনাে ক্ষমতাই যদি আমাদের না থাকে, তবু তােমাদের মঙ্গল হবে না।
‘কারণ, অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ জাতীয় চরিত্রের মূল আক্রমণ করে। যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার ভিত্তির উপর তােমাদের জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠিত, তলে তলে সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে। সেই জন্য অনেক ইংলন্ড্বাসী ইংরাজের কাছে শােনা যায় ভারতবর্ষীয় ইংরাজ একটা জাতই স্বতন্ত্র; কেবলমাত্র বিকৃত যকৃৎই তার একমাত্র কারণ নয়, যকৃতের চেয়ে মানুষের আরো উচ্চতর অন্তরিন্দ্রিয় আছে— সেটাও নষ্ট হয়ে যায়।
‘কিন্তু আমার এ বিভীষিকায় কেউ ডরাবে না। যার দ্বারে অর্গল নেই সেই অগত্যা চোরকে সাধুভাবে ধর্মোপদেশ দিতে বসে; যেন চোরের পরকালের হিতের জন্যেই তার রাত্রে ঘুম হয় না। যে সৌভাগ্যবানের দ্বারে অর্গল আছে, চোরের আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের প্রতি তার তাদৃশ আগ্রহ দেখা যায় না— অর্গলটাই তার আশু উপকারে দেখে।
‘লাধির পরিবর্তে উপদেশ দেওয়া এবং ধর্মভয় দেখানো যদিচ দেখতে অতি মনোহর হয় বটে, কিন্তু লাথির পরিবর্তে লাথি দিলেই ফলটা অতি শীঘ্র পাওয়া যায়। এই পুরাতন সত্যটি আমাদের জানা আছে, কিন্তু বিধাতা আমাদের সমস্ত শরীরমনের মধ্যে কেবল রসনার অগ্রভাগটুকুতে মাত্র বলসঞ্চার করেছেন। সুতরাং হে জোয়ান, কিঞ্চিৎ নীতিকথা শোনো।
‘শোনা যায় ভারতবর্ষীয়ের পিলে যন্ত্রটাই কিছু খারাপ হয়ে আছে, এই জন্য তারা পেটের উপরে ইংরাজ প্রভুর নিতান্ত ‘পেটার্নাল ট্রীট্মেন্ট্’টুকুরও ভর সইতে পারে না। কিন্তু ইংরাজের পিলে কিরকম অবস্থায় আছে এ পর্যন্ত কার্যত তার কোনো পরীক্ষাই হয় নি।
‘আমাদের ভারতবর্ষীয়দের বিশ্বাস, পৃথিবীতে খুব অল্প লোকেরই পিলে এত অতিশয় স্বাভাবিক অবস্থায় আছে যে, বুট-সমেত সজোরে লাথি বেশ নিরাপদে সহ্য করতে পারে।
‘কিন্তু সে নিয়ে কথা হচ্ছে না; পিলে ফেটে যে আমাদের অপঘাত মৃত্যু হয় সেটা আমাদের ললাটের লিখন। কিন্তু তার পরেই সমস্ত ব্যাপারটা তোমরা যে রকম তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাও তাতেই আমাদের সমস্ত জাতিকে অপমান করা হয়। তাতেই এক রকম করে বলা হয় যে, তোমাদের আমরা মানুষ জ্ঞান করি না— তোমাদের দুটো-চারটে যে খামকা আমাদের চরণতলে বিলুপ্ত হয়ে যায় সে তোমাদের পিলের দোষ! পিলে যদি ঠিক থাকত তা হলে লাথিও খেতে, বেঁচেও থাকতে, এবং পুনশ্চ দ্বিতীয়বার খাবার অবসর পেতে।
‘যা হােক, ভদ্রনাম ধারণ করে অসহায়কে অপমান করতে যার সংকোচ বােধ হয় না, তাকে এত কথা বলাই বাহুল্য। বিশেষতঃ যে ব্যক্তি অপমান সহ্য করে, দুর্বল হলেও, তাকে যখন অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা না ক’রে থাকা যায় না।
‘কিন্তু একটা কথা আমি ভালাে বুঝতে পারি নে। ইংলন্ডে তত তােমাদের এত বিশ্বহিতৈষিণী মেয়ে আছেন, তাঁরা সভাসমিতি করে নিতান্ত অসম্পর্কীয় কিম্বা দূরসম্পর্কীয় মানবজাতির প্রতিও দূর থেকে দয়া প্রকাশ করেন। এই হতভাগ্য দেশে সেই ইংরাজের ঘর থেকে কি একটি মেয়েও আসেন না যিনি উক্ত বাহুল্য করুণরসের কিয়দংশ উপস্থিত ক্ষেত্রে ব্যয় করে মনােভার কিঞ্চিৎ লাঘব করে যেতে পারেন। বরঞ্চ পুরুষমানুষে দয়ার দৃষ্টান্ত দেখেছি, যেমন মহাত্মা ডেভিড হেয়ার। তিনি তাে আমাদের মুরুব্বি ছিলেন না, যথার্থই পিতা ছিলেন। কিন্তু তােমাদের মেয়েরা এখানে কেবল নাচগান করেন, সুযােগমতে বিবাহ করেন এবং কথােপকথনকালে সুচারু নাসিকার সুকুমার অগ্রভাগটুকু কুঞ্চিত করে আমাদের স্বজাতীয়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। জানি না, কী অভিপ্রায়ে বিধাতা আমাদের ভারতবাসীকে তােমাদের ললনাদের স্নায়ুতন্ত্রের ঠিক উপযােগী করে সৃজন করেন নি’—!
যাই হােক, স্বগত উক্তি যত ভালােই হােক স্টেজ ছাড়া আর কোথাও শ্রোতাদের কর্ণগােচর হয় না। তা ছাড়া, যে কথাগুলাে আক্ষেপবশতঃ মনের মধ্যে উদয় হয়েছিল সেগুলাে যে এই গোঁফওয়ালা পালােয়নের বিশেষ কিছু হৃদয়ঙ্গম হত এমন আমার বােধ হয় না। এ দিকে, বুদ্ধি যখন বেড়ে উঠল চোর তখন পালিয়েছে ―তারা পূর্বপ্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য কথায় গিয়ে পড়েছে। মনের খেদে কেবল নিজেকেই ধিক্কার দিতে লাগলুম।
১৫ অক্টোবর। জাহাজে আমার একটি বন্ধু জুটেছে। লােকটাকে লাগছে ভালাে। অল্প বয়স, মন খুলে কথা কয়, কারও সঙ্গে বড়াে মেশে না, আমার সঙ্গে খুব চট ক’রে ব’নে গেছে। আমার বিবেচনায় শেষটাই সব চেয়ে মহৎ গুণ।
এ জাহাজে তিনটি অস্ট্রেলিয়ান কুমারী আছেন— তাঁদের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। বেশ সহজ সরল রকমের লােক, কোনােপ্রকার অতিরিক্ত ঝাঁজ নেই। আমার নববন্ধু এঁদের প্রশংসাস্বরূপে বলে: They are not at all smart। বাস্তবিক, অনেক অল্পবয়সী ইংরাজ মেয়ে দেখা যায়, তারা বড়ােই smart—বড্ড চোখমুখের খেলা, বড্ড নাকে মুখে কথা, বড্ড খরতর হাসি, বড্ড চোখাচোখা জবাব— কারও কারও লাগে ভালাে, কিন্তু শান্তিপ্রিয় সামান্য লােকের পক্ষে নিতান্ত শ্রান্তিজনক।
১৬ অক্টোবর। আজ জাহাজে দুটি ছােটো ছােটো নাট্যাভিনয় হয়ে গেল। দলের মধ্যে একটি অভিনেত্রীকে যেমন সুন্দর দেখতে, তিনি তেমনি সুন্দর অভিনয় করেছিলেন।
আজ অনেক রাত্রে নিরালায় একলা দাঁড়িয়ে জাহাজের কাঠ ধরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে অন্যমনস্কভাবে গুন্গুন্ করে একটা দিশি রাগিণী ধরেছিলুম। তখন দেখতে পেলুম অনেক দিন ইংরাজি গান গেয়ে গেয়ে মনের ভিতরটা যেন শ্রান্ত এবং অতৃপ্ত হয়ে ছিল। হঠাৎ এই বাংলা সুরটা পিপাসার জলের মতাে বােধ হল। আমি দেখলুম সেই সুরটি সমুদ্রের উপর অন্ধকারের মধ্যে যেরকম প্রসারিত হল, এমন আর কোনাে সুর কোথাও পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। আমার কাছে ইংরাজি গানের সঙ্গে আমাদের গানের এই প্রধান প্রভেদ ঠেকে যে, ইংরাজি সংগীত লোকালয়ের সংগীত, আর আমাদের সংগীত প্রকাণ্ড নির্জন প্রকৃতির অনির্দিষ্ট অনির্বচনীয় বিষাদের সংগীত। কানাড়া টোড়ি প্রভৃতি বড়ো বড়ো রাগিণীর মধ্যে যে গভীরতা এবং কাতরতা আছে সে যেন কোন ব্যক্তিবিশেষের নয়— সে যেন অকূল অসীমের প্রান্তবর্তী এই সঙ্গীহীন বিশ্বজগতের।
১৭ অক্টোবর। বিকালের দিকে জাহাজ মল্টা দ্বীপে পৌঁছল। কঠিন দুর্গপ্রাকারে বেষ্টিত অট্টালিকাখচিত তরুগুল্মহীন শহর। এই শ্যামল পৃথিবীর একটা অংশ যেন ব্যাধি হয়ে কঠিন হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখে নাবতে ইচ্ছে করে না। অবশেষে আমার নববন্ধুর অনুরোধে তাঁর সঙ্গে একত্রে নেবে পড়া গেল। সমুদ্রতীর থেকে সুড়ঙ্গপথের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ঘাটের মতো উঠেছে, তারই সোপান বেয়ে শহরের মধ্যে উঠলুম। অনেকগুলি গাইড-পান্ডা আমাদের ছেঁকে ধরলে। আমার বন্ধু বহুকষ্টে তাদের তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু একজন কিছুতেই আমাদের সঙ্গ ছাড়লে না। বন্ধু তাকে বারবার ঝেঁকে ঝেঁকে গিয়ে বললেন― ‘চাই নে তোমাকে’— ‘একটি পয়সাও দেব না’— তবু সে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে লেগে ছিল। তার পরে যখন তাকে নিতান্তই তাড়িয়ে দিলে তখন সে ম্লানমুখে চলে গেল। আমার তাকে কিছু দেবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বন্ধু বললেন লোকটা গরিব সন্দেহ নেই, কিন্তু কোনো ইংরাজ হলে এমন করত না। আসলে, মানুষ পরিচিত দোষ গুরুতর হলেও মার্জনা করতে পারে, কিন্তু সামান্য অপরিচিত দোষ সহ্য করতে পারে না। এই জন্যে এক-জাতীয়ের পক্ষে আর-এক-জাতীয়কে বিচার করা কঠিন।
দৃষ্টান্তস্বরূপে বলা যেতে পারে, একজন ইংরাজ ভিক্ষুক এবং একজন ভারতবর্ষীয় ভিক্ষুক ঠিক এক শ্রেণীর নয়। আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তির অগৌরব না থাকাতে যে ব্যক্তি ভিক্ষা অবলম্বন করে তার আত্মসম্মান দূর হয় না। আমাদের দেশে মানুষের দয়া এবং দানের উপর মানুষের অধিকার আছে; দাতা এবং ভিক্ষুক, গৃহস্থ এবং অতিথির মধ্যে একটা সামাজিক সম্বন্ধবন্ধন নির্দিষ্ট আছে। সুতরাং ভিক্ষার মধ্যে সেই হীনতা নেই। আমাদের মহাদেব ভিখারী। ইংলন্ডে নিজের ক্ষমতা এবং নিজের পরিশ্রম ছাড়া আর-কিছুর উপরে নির্ভর করা হীনতা, সুতরাং ইংরাজ ‘বেগর’ ঘৃণার পাত্র।
ভিন্ন জাতিকে বিচার করবার সময় তার সমস্ত অতীত ইতিহাস-পরম্পরা যদি হৃদয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারি তা হলেই আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারি। কিন্তু সে সহৃদয়তা কোথায় পাওয়া যায়!
‘মল্টা’ শহরটা দেখে মনে হয় একটা অপরিণত বিকৃত য়ুরােপীয় শহর। পাথরে বাঁধানাে সরু রাস্তা একবার উপরে উঠছে, একবার নীচে নামছে। সমস্তই দুর্গন্ধ, ঘেঁষাঘেষি, অপরিষ্কার। রাত্রে হােটেলে গিয়ে খেলুম। অনেক দাম দেওয়া গেল, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য অতি কদর্য। আহারান্তে, শহরের মধ্যে একটি বাঁধানাে চক আছে, সেইখানে ব্যান্ড্বাদ্য শুনে রাত দশটার সময় জাহাজে ফিরে আসা গেল। ফেরবার সময় নৌকাওয়ালা আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কিছু বেশি আদায়ের চেষ্টায় ছিল। আমার বন্ধু এদের অসৎ ব্যবহারে বিষম রাগান্বিত। তাতে আমার মনে পড়ল এবারে লন্ডনে প্রথম যেদিন আমরা দুই ভাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলুম গাড়ােয়ান পাঁচ শিলিং ভাড়ার জায়গায় আমাদের কাছে বারাে শিলিং ঠকিয়ে নিয়েছিল। সে লােকটার তত দোষ ছিল না― আমাদেরই দোষ। আমাদের দুই ভাইয়ের মুখে বােধ করি বিষয়বুদ্ধির চিহ্নমাত্র ছিল না। এরকম মুখঞ্জ দেখলে অতি বড়ো সৎ লােকেরও ঠকিয়ে নিতে হঠাৎ প্রলােভন হতে পারে। যা হক, মল্টাবাসীর অসাধু স্বভাবের প্রতি আমার বন্ধুর অতিমাত্র ক্রোধ দেখে এ ঘটনাটা উল্লেখ করা আমার কর্তব্য মনে করলুম।
১৮ অক্টোবর। আজ ডিনার-টেবিলে ‘স্মাগ্লিং’ সম্বন্ধে কেউ কেউ নিজ নিজ কীর্তি রটনা করছিলেন। গবর্মেণ্ট্কে মাশুল ফাঁকি দেবার জন্যে মিথ্যা প্রতারণা করাকে এরা যেন কিঞ্চিৎ গৌরবের বিষয় মনে করে। আর যাই হােক, তেমন নিন্দা বা লজ্জার বিষয় মনে করে না। অথচ মিথ্যা এবং প্রতারণাকে যে এরা দূষণীয় জ্ঞান করে না সে কথা বলাও অন্যায়। মানুষ এমনি জীব! একজন ব্যারিস্টার তার মক্কেলের কাছ থেকে পুরা ফি নিয়ে যদি কাজ না করে এবং সেজন্যে যদি সে হতভাগ্যের সর্বনাশ হয়ে যায় তা হলেও কিছু লজ্জা বােধ করে না, কিন্তু ঐ মক্কেল যদি তার দেয় ফি’র দুটি পয়সা কম দেয় তা হলে কৌঁসুলির মনে যে ঘৃণামিশ্রিত আক্রোশের উদয় হয় তাকে তাঁরা ইংরাজি করে বলেন ‘রাইটিয়াস ইন্ডিগ্নেশন’। সর্বনাশ!
১৯ অক্টোবর। আজ সকালে জাহাজ যখন ব্রিন্দিশি পৌঁছল তখন ঘাের বৃষ্টি আরম্ভ হল। এই বৃষ্টিতে এক দল গাইয়ে বাজিয়ে হার্প্ বেয়ালা ম্যান্ডােলিন নিয়ে ছাতা মাথায় জাহাজের সম্মুখে বন্দরের পথে দাঁড়িয়ে গান বাজনা জুড়ে দিলে।
বৃষ্টি থেমে গেলে বন্ধুর সঙ্গে ব্রিন্দিশিতে বেরােনাে গেল। শহর ছাড়িয়ে একটা খােলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলুম। আকাশ মেঘাচ্ছ, পাহাড়ে রাস্তা শুকিয়ে গেছে, কেবল দুই ধারে নালায় মাঝে মাঝে জল দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ধারে গাছে চ’ড়ে দুটো খালি-পা ইটালিয়ান ছােকরা ফিগ পেড়ে খাচ্ছিল; আমাদের ডেকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলে, তােমরা খাবে কি? আমরা বললুম, না। খানিক বাদে দেখি তারা ফলবিশিষ্ট একটা ছিন্ন অলিভশাখা নিয়ে এসে উপস্থিত। জিজ্ঞাসা করলে, অলিভ খাবে? আমরা অসম্মত হলুম। তার পরে ইশারায় তামাক প্রার্থনা ক’রে বন্ধুর কাছ থেকে কিঞ্চিৎ তামাক আদায় করলে। তামাক খেতে খেতে দুজনে বরাবর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল। আমরা পরস্পরের ভাষা জানি নে আমাদের উভয় পক্ষে প্রবল অঙ্গভঙ্গীদ্বারা ভাবপ্রকাশ চলতে লাগল। জনশূন্য রাস্তা ক্রমশঃ উচ্চ হয়ে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে বরাবর চলে গিয়েছে। কেবল মাঝে মাঝে এক-একটা ছোেটা বাড়ি, জানলার কাছে ফিগ-ফল শুকোতে দিয়েছে। এক-এক জায়গায় ছােটো ছােটো শাখাপথ বক্রগতিতে এক পাশ দিয়ে নেমে নীচে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ফেরবার মুখে একটা গােরস্থানে ঢোকা গেল। এখানকার গাের নূতন রকমের দেখলুম। অধিকাংশ গােরের উপরে একএকটি ছােটো ঘর গেঁথেছে। সেই ঘর পর্দা দিয়ে, ছবি দিয়ে, রঙিন জিনিস দিয়ে, নানা রকমে সাজানাে; যেন মৃত্যুর একটা খেলাঘর— এর মধ্যে কেমন একটি ছেলেমানুষি আছে মৃত্যুটাকে যেন যথেষ্ট খাতির করা হচ্ছে না।
গােরস্থানের এক জায়গায় সিঁড়ি দিয়ে একটা মাটির নীচেকার ঘরে নাবা গেল। সেখানে সহস্র সহস্র মড়ার মাথা অতি সুশৃঙ্খল ভাবে স্তূপাকারে সাজানাে। তৈমুর্লঙ বিশ্ববিজয় ক’রে একদিন এই রকম একটা উৎকট কৌতুকদৃশ্য দেখেছিলেন। আমার সঙ্গে সঙ্গেই নিশিদিন যে-একটা কঙ্কাল চলে বেড়াচ্ছে ঐ মুণ্ডগুলাে দেখে তার আকৃতিটা মনে উদয় হল। জীবন এবং সৌন্দর্য এই অসীম জীবলােকের উপর একটা চিত্রিত পর্দা ফেলে রেখেছে― কোনাে নিষ্ঠুর দেবতা যদি হঠাৎ একদিন সেই লাবণ্যময় চর্মষবনিকা সমস্ত নরসংসার থেকে উঠিয়ে ফেলে, তা হলে অকস্মাৎ দেখতে পাওয়া যায় আরক্ত অধরপল্লবের অন্তরালে গােপনে ব’সে ব’সে শুষ্ক শ্বেত দন্তপংক্তি সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বিকট বিদ্রূপের হাস্য করছে। পুরােনাে বিষয়। পুরােনাে কথা। ঐ নরকপাল অবলম্বন করে নীতিজ্ঞ পণ্ডিতেরা অনেক বিভীষিকা প্রচার করেছেন— কিন্তু অনেক ক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখে আমার কিছুই ভয় হল না। শুধু এই মনে হল, সীতাকুণ্ডের বিদীর্ণ জলবিম্ব থেকে যেমন খানিকটা তপ্ত বাষ্প বেরিয়ে যায়, তেমনি পৃথিবীর কত যুগের কত দুশ্চিন্তা দুরাশা অনিদ্রা ও শিরঃপীড়া ঐ মাথার খুলিগুলাের, ঐ গােলাকার অস্থিবুদ্বুদগুলাের, মধ্যে থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এবং সেই সঙ্গে এও মনে হল, পৃথিবীতে অনেক ডাক্তার অনেক টাকের ওষুধ আবিষ্কার করে চীৎকার করে মরছে, কিন্তু ঐ লক্ষ লক্ষ কেশহীন মস্তক তৎপ্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, এবং দন্তমার্জনওয়ালারা যতই প্রচুর বিজ্ঞাপন প্রচার করছে এই অসংখ্য দন্তশ্রেণী তার কোনাে খোঁজ নিচ্ছে না।
যাই হােক, আপাততঃ আমার এই কপালফলকটার মধ্যে বাড়ির চিঠির প্রত্যাশা সঞ্চরণ করছে। যদি পাওয়া যায় তা হলে এই খুলিটার মধ্যে খানিকটা খুশির উদয় হবে, আর যদি না পাই তা হলে এই অস্থিকোটরের মধ্যে দুঃখ-নামক একটা ব্যাপারের উদ্ভব হবে— ঠিক মনে হবে আমি কষ্ট পাচ্ছি।
২৩ অক্টোবর। সুয়েজ খালের মধ্যে দিয়ে চলেছি। জাহাজ অতি মন্থর গতিতে চলেছে।
উজ্জ্বল উত্তপ্ত দিন। এক রকম মধুর আলস্যে পূর্ণ হয়ে আছি। য়ুরােপের ভাব একেবারে দূর হয়ে গেছে। আমাদের সেই রৌদ্রতপ্ত শ্রান্ত দরিদ্র ভারতবর্ষ, আমাদের সেই ধরাপ্রান্তবর্তী পৃথিবীর অপরিচিত নিভৃত নদীকলধ্বনিত ছায়াসুপ্ত বাংলাদেশ, আমার সেই অকর্মণ্য গৃহপ্রিয় বাল্যকাল, কল্পনাক্লিষ্ট যৌবন, নিশ্চেষ্ট নিরুদ্যম চিন্তাপ্রিয় জীবনের স্মৃতি এই সূর্যকিরণে― এই তপ্ত বায়ুহিল্লোলে— সুদুর মরীচিকার মতাে আমার দৃষ্টির সম্মুখে জেগে উঠছে।
ডেকের উপরে গল্পের বই পড়ছিলুম। মাঝে একবার উঠে দেখলুম দু ধারে ধূসরবর্ণ বালুকাতীর— জলের ধারে ধারে একটু একটু বনঝাউ এবং অর্ধশুষ্ক তৃণ উঠেছে। আমাদের ডান দিকের বালুকারাশির মধ্যে দিয়ে একদল আরব শ্রেণীবদ্ধ উট বােঝাই করে নিয়ে চলেছে। প্রখর সূর্যালােক এবং ধুসর মরুভূমির মধ্যে তাদের নীল কাপড় এবং শাদা পাগড়ি দেখা যাচ্ছে। কেউ বা এক জায়গায় বালুকাগহ্বরের ছায়ায় পা ছড়িয়ে অলসভাবে শুয়ে আছে― কেউ বা নমাজ পড়ছে, কেউ বা নাসারজ্জু ধরে অনিচ্ছুক উটকে টানাটানি করছে। সমস্তটা মিলে খররৌদ্র আরব-মরুভূমির একখণ্ড ছবির মতাে মনে হল।
২৪ অক্টোবর। আমাদের জাহাজের মিসেস ―কে দেখে একটা নাট্যশালার ভগ্নাবশেষ বলে মনে হয়। সেখানে অভিনয়ও বন্ধ, বাসের পক্ষেও সুবিধা নয়। রমণীটি খুব তীক্ষ্ণধার―যৌবনকালে বােধ করি অনেকের উপর অনেক খরতর শর চালনা করেছে। যদিও এখনাে এ নাকে মুখে কথা কয় এবং অচিরজাত বিড়ালশাবকের মতাে ক্রীড়াচাতুরীশালিনী, তবু কোনাে যুবক এর সঙ্গে দুটো কথা বলবার জন্যে ছুতাে অন্বেষণ করে না, নাচের সময় আহ্বান করে না, আহারের সময় সযত্নে পরিবেশন করে না। তার চঞ্চলতার মধ্যে শ্রী নেই, প্রখরতার মধ্যে জ্যোতি নেই, এবং প্রৌঢ়তার সঙ্গে রমণীর মুখে যে-একটি স্নেহময় সুপ্রসন্ন সুগভীর মাতৃভাব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তাও তার কিছুমাত্র নেই। আমি এর ইতিহাস জানি নে— কিন্তু যে-সব রমণী চিত্তজয়ােৎসাহে মত্ত হয়ে উগ্র উত্তেজনায় জীবনের সমস্ত সহজ সুখের প্রতি অনেক পরিমাণে বীততৃষ্ণ হয়েছে তাদের বয়স্ক অবস্থা কী শূন্য এবং শােভাহীন! আমাদের মেয়েরা এই উদগ্র আমােদমদিরার আস্বাদ জানে না― তারা অল্পে অল্পে অতি সহজে স্ত্রী থেকে মা, এবং মা থেকে দিদিমা হয়ে আসে। পূর্বাবস্থা থেকে পরের অবস্থার মধ্যে প্রচণ্ড বিপ্লব বা বিচ্ছেদ নেই।
ও দিকে আবার মিস অমুক এবং অমুককে দেখাে। কুমারীদ্বয় অবিশ্রাম পুরুষসমাজে কী খেলাই খেলাচ্ছে। আর কোনাে কাজ নেই, আর কোনাে ভাবনা নেই, আর কোনাে সুখ নেই― সচেতন পুত্তলিকা― মন নেই, আত্মা নেই, কেবল চোখে মুখে হাসি এবং কথা এবং উত্তর-প্রত্যুত্তর।
২৫ অক্টোবর। আজ সকাল বেলা স্নানের ঘর বন্ধ দেখে দরজার সামনে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ বাদে বিরলকেশ পৃথুকলেবর দ্বিতীয় ব্যক্তি তােয়ালে এবং স্পঞ্জ্ হস্তে উপস্থিত। ঘর খালাস হবামাত্র সেই জন্বুল অম্লানবদনে প্রথমাগত আমাকে অতিক্রম করে ঘরে প্রবেশ করলে। প্রথমেই মনে হল তাকে ঠেলেঠুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ি; কিন্তু শারীরিক দ্বন্দ্বটা অত্যন্ত হীন এবং রূঢ় ব’লে মনে হয়, বেশ স্বাভাবিকরূপে আসে না। সুতরাং অধিকার ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলুম নম্রতা গুণটা খুব ভালাে হতে পারে, কিন্তু খৃস্টজন্মের উনবিংশ শতাব্দী পরেও এই পৃথিবীর পক্ষে অনুপযােগী এবং দেখতে অনেকটা ভীরুতার মতাে। নাওয়ার ঘরে প্রবেশ করতে যে খুব বেশি সাহসের আবশ্যক ছিল তা নয়, কিন্তু প্রাতঃকালেই এতটা মাংসবহুল কপিশবর্ণ পিঙ্গলচক্ষু রূঢ় ব্যক্তির সঙ্গে সংঘর্ষ-সম্ভাবনাটা কেমন সংকোচজনক মনে হল। স্বার্থপরতা অনেক সময় এই জন্যই জয়লাভ করে― বলিষ্ঠ ব’লে নয়, অতিমাংসগ্রস্ত কুৎসিত ব’লে।
২৬ অক্টোবর। জাহাজের একটা দিন বর্ণনা করা যাক।
সকালে ডেক ধুয়ে গেছে, এখনাে ভিজে রয়েছে। দুই ধারে ডেক-চেয়ার বিশৃঙ্খলভাবে পরস্পরের উপর রাশীকৃত। খালি-পায়ে রাত-কাপড়-পরা পুরুষগণ কেউ বা বন্ধুসঙ্গে কেউ বা একলা মধ্যপথ দিয়ে হূহু করে বেড়াচ্ছে। ক্রমে যখন আটটা বাজল এবং একটিআধটি করে মেয়ে উপরে উঠতে লাগল তখন একে একে এই বিরলবেশ পুরুষদের অন্তর্ধান।
স্নানের ঘরের সম্মুখে বিষম ভিড়! তিনটি মাত্র স্নানাগার; আমরা অনেকগুলি দ্বারস্থ। তােয়ালে এবং স্পঞ্জ্ হাতে দ্বারমােচনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দশ মিনিটের অধিক স্নানের ঘর অধিকার করবার নিয়ম নেই।
স্নান এবং বেশভূষা সমাপনের পর উপরে গিয়ে দেখা যায় ডেকের উপর পদচারণশীল প্রভাতবায়ুসেবী অনেকগুলি স্ত্রীপুরুষের সমাগম হয়েছে। ঘন ঘন টুপি উদ্ঘাটন করে মহিলাদের এবং শিরঃকম্পে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শুভপ্রভাত অভিবাদন-পূর্বক গ্রীষ্মের তারতম্য সম্বন্ধে পরস্পরের মতামত ব্যক্ত করা গেল।
নটার ঘণ্টা বাজল। ব্রেক্ফাস্ট্ প্রস্তুত। বুভুক্ষু নরনারীগণ সােপানপথ দিয়ে নিম্নকক্ষে ভােজনবিবরে প্রবেশ করলে। ডেকের উপরে আর জনপ্রাণী অবশিষ্ট রইল না। কেবল সারি-সারি শূন্যহৃদয় চৌকি ঊর্ধ্বমুখে প্রভুদের জন্যে অপেক্ষা করে রইল।
ভােজনশালা প্রকাণ্ড ঘর। মাঝে দুই সার লম্বা টেবিল, এবং তার দুই পার্শ্বে খণ্ড খণ্ড ছোটো ছােটো টেবিল। আমরা দক্ষিণ পার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র টেবিল অধিকার করে সাতটি প্রাণী দিনের মধ্যে তিনবার ক্ষুধানিবৃত্তি করে থাকি। মাংস রুটি ফলমূল মিষ্টান্ন মদিরায় এবং হাস্যকৌতুক গল্পগুজবে এই অনতি-উচ্চ সুপ্রশস্ত ঘর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।
আহারের পর উপরে গিয়ে যে যার নিজ নিজ চৌকি অম্বেষণ এবং যথাস্থানে স্থাপনে ব্যস্ত। চৌকি খুঁজে পাওয়া দায়। ডেক ধোবার সময় কার চৌকি কোথায় ফেলেছে তার ঠিক নেই।
তার পর চৌকি খুঁজে নিয়ে আপনার জায়গাটুকু গুছিয়ে নেওয়া বিষম ব্যাপার। যেখানে একটু কোণ, যেখানে একটু বাতাস, যেখানে একটু রৌদ্রের তেজ কম, যেখানে যার অভ্যাস সেইখানে ঠেলেঠুলে, টেনেটুনে, পাশ কাটিয়ে, পথ করে আপনার চৌকিটি রাখতে পারলে সমস্ত দিনের মতো নিশ্চিন্ত।
তার পরে দেখা যায় কোনাে চৌকিহারা ম্লানমুখী রমণী কাতরভাবে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করছে, কিন্তু কোনাে বিপদ্গ্রস্ত অবলা এই চৌকি-অরণ্যের মধ্যে থেকে নিজেরটি বিশ্লিষ্ট করে নিয়ে অভিপ্রেত স্থানে স্থাপন করতে পারছে না― তখন আমরা পুরুষগণ নারীসহায়ব্রতে চৌকি-উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত হয়ে সুশিষ্ট ও সুমিষ্ট ধন্যবাদ অর্জন করে থাকি।
তার পরে যে যার চৌকি অধিকার করে বসে যাওয়া যায়। ধূম্রসেবীগণ, হয় ধূম্রকক্ষে নয় ডেকের পশ্চাদ্ভাগে সমবেত হয়ে পরিতৃপ্ত মনে ধূমপান করছে। মেয়েরা অর্ধনিলীন অবস্থায় কেউবা নবেল পড়ছে, কেউ-বা শেলাই করছে; মাঝে মাঝে দুইএকজন যুবক ক্ষণেকের জন্যে পাশে বসে মধুকরের মতাে কানের কাছে গুন্গুন্ করে আবার চলে যাচ্ছে।
আহার কিঞ্চিৎ পরিপাক হবামাত্র এক দলের মধ্যে ক্কয়ট্স্ খেলা আরম্ভ হল। দুই বালতি পরস্পর হতে হাত দশেক দূরে স্থাপিত হল। দুই যুড়ি স্ত্রীপুরুষ বিরােধী পক্ষ অবলম্বন করে পালাক্রমে স্ব স্ব স্থান থেকে কলসীর বিড়ের মতো কতকগুলি রজ্জুচক্র বিপরীত বালতির মধ্যে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল। যে পক্ষ সর্বাগ্রে একুশ করতে পারবে তারই জিত। মেয়ে খেলােয়াড়েরা কখনাে জয়ােচ্ছ্বাসে কখনাে নৈরাশ্যে ঊর্ধ্বকণ্ঠে চীৎকার করে উঠছেন। কেউ বা দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ বা গণনা করছে, কেউ বা খেলায় যােগ দিচ্ছে, কেউ বা আপন আপন পড়ায় কিম্বা গল্পে নিবিষ্ট হয়ে আছে।
একটার সময় আবার ঘণ্টা। আবার আহার। আহারান্তে উপরে ফিরে এসে দুই স্তর খাদ্যের ভারে এবং মধ্যাহ্নের উত্তাপে আলস্য অত্যন্ত ঘনীভূত হয়ে আসে। সমুদ্র প্রশান্ত, আকাশ সুনীল মেঘমুক্ত, অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। কেদারায় হেলান দিয়ে নীরবে নভেল পড়তে পড়তে অধিকাংশ নীলনয়নে নিদ্রাবেশ হয়ে আসছে। কেবল দুই-একজন দাবা, ব্যাক্গ্যামন, কিম্বা ড্রাফ্ট্ খেলছে, এবং দুই-একজন অশ্রান্ত অধ্যবসায়ী যুবক সমস্ত দিনই ক্কয়ট্স্ খেলায় নিযুক্ত। কোনাে রমণী কোলের উপর কাগজ কলম নিয়ে একাগ্রমনে চিঠি লিখছে, এবং কোনাে শিল্পকুশলা কৌতুকপ্রিয়া যুবতী নিদ্রিত সহযাত্রীর ছবি আঁকতে চেষ্টা করছে।
ক্রমে রৌদ্রের প্রখরতা হ্রাস হয়ে এল। তখন তাপক্লিষ্ট ক্লান্তকায়গণ নীচে নেমে গিয়ে রুটি মাখন মিষ্টান্ন -সহযােগে চা-রস পান করে শরীরের জড়তা পরিহার পুর্বক পুনর্বার ডেকে উপস্থিত। পুনর্বার যুগল মূর্তির সোৎসাহ পদচারণা এবং মৃদুমন্দ হাস্যালাপ আরম্ভ হল। কেবল দু-চার জন পাঠিকা উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদ থেকে কিছুতেই আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না— দিবা-বসানের স্নান ক্ষীণালোকে একাগ্রনিবিষ্ট দৃষ্টিতে নায়ক-নায়িকার পরিণাম অনুসরণ করছে।
দক্ষিণে জ্বলন্ত কনকাকাশ এবং অগ্নিবর্ণ জলরাশির মধ্যে সূর্য অস্ত গেল এবং বামে সূর্যাস্তের কিছু পূর্ব হতেই চন্দ্রোদয় হয়েছে। জাহাজ থেকে পূর্বদিগন্ত পর্যন্ত বরাবর জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ঝিক্ করছে। পূর্ণিমার সন্ধ্যা নীল সমুদ্রের উপর আপনার শুভ্র অঙ্গুলি স্থাপন করে আমাদের সেই জ্যোৎস্নাপুলকিত পূর্ব ভারতবর্ষের পথ নির্দেশ করে দিচ্ছে।
জাহাজের ডেকের উপরে এবং কক্ষে কক্ষে বিদ্যুদ্দীপ জ্বলে উঠল। ছটার সময় ডিনারের প্রথম ঘণ্টা বাজল। বেশ পরিবর্তন উপলক্ষে সকলে স্ব স্ব কক্ষে প্রবেশ করলে। আধ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় ঘণ্টা বাজল। ভোজনগৃহে প্রবেশ করা গেল। সারি সারি নরনারী বসে গেছে। কারো-বা কালো কাপড়, কারো রঙিন কাপড়, কারোবা শুভ্রবক্ষ অর্ধ-অনাবৃত। মাথার উপরে শ্রেণীবদ্ধ বিদ্যুৎ-আলোক জ্বলছে। গুন্গুন্ আলাপের সঙ্গে কাঁটা-চামচের টুংটাং ঠুং ঠুং শব্দ উঠছে, এবং বিচিত্র খাদ্যের পর্যায় পরিচারকদের হাতে হাতে নিঃশব্দ স্রোতের মতো যাতায়াত করছে।
আহারের পর ডেকে গিয়ে শীতলবায়ুসেবন। কোথাও বা যুবক যুবতী অন্ধকার কোণের মধ্যে চৌকি টেনে নিয়ে গিয়ে গুন্ গুন্ করছে, কোথাও বা দুজনে জাহাজের বারান্দা ধরে ঝুঁকে পড়ে রহস্যালাপে নিমগ্ন, কোনো কোনো যুড়ি গল্প করতে করতে ডেকের আলোক ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দ্রুতপদে একবার দেখা দিচ্ছে একবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কোথাও বা এক ধারে পাঁচসাত জন স্ত্রীপুরুষ এবং জাহাজের কর্মচারী জটলা করে উচ্চহাস্যে প্রমােদকল্লোল উচ্ছ্বসিত করে তুলছে। অলস পুরুষরা কেউ বা ব’সে কেউ বা দাঁড়িয়ে কেউ বা অর্ধশয়ান অবস্থায় চুরট খাচ্ছে, কেউ বা স্মােকিং সেলুনে কেউ বা নীচে খাবার ঘরে দুইস্কি-সােডা পাশে রেখে চার জনে দল বেঁধে বাজি রেখে তাস খেলছে। ও দিকে সংগীতশালায় সংগীতপ্রিয় দু-চার জনের সমাবেশ হয়ে গানবাজনা এবং মাঝে মাঝে করতালি শােনা যাচ্ছে।
ক্রমে সাড়ে-দশটা বাজে— মেয়েরা নেবে যায়, ডেকের উপরে আলাে হঠাৎ নিবে যায়, ডেক নিঃশব্দ নির্জন অন্ধকার হয়ে আসে, এবং চারি দিকে নিশীথের নিস্তব্ধতা চন্দ্রালােক এবং অনন্ত সমুদ্রের অশ্রান্ত কলধনি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
২৭ অক্টোবর। লােহিত সমুদ্রের গরম ক্রমেই বেড়ে উঠছে। ডেকের উপর মেয়েরা সমস্ত দিন তৃষাতুরা হরিণীর মতাে ক্লিষ্ট কাতর হয়ে রয়েছে। তারা কেবল অতি ক্লান্তভাবে পাখা নাড়ছে, স্মেলিং সল্ট্ শুকছে, এবং সকরুণ যুবকেরা যখন পাশে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করছে তখন নিমীলিত প্রায় নেত্রপল্লব ঈষৎ উন্মীলন করে ম্লানহায্যে কেবল গ্রীবাভঙ্গীদ্বারা আপন সুকুমার দেহলতার একান্ত অবসন্নতা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে। যতই পরিপূর্ণ করে টিফিন এবং লেবুর শরবৎ খাচ্ছে ততই জড়ত্ব এবং ক্লান্তি বাড়ছে, নেত্র নিদ্রানত ও সর্বশরীর শিথিল হয়ে আসছে।
২৮ অক্টোবর। আজ এডেনে পৌঁছনাে গেল।
২৯ অক্টোবর। আমাদের জাহাজে একটি পার্সী সহযাত্রী আছে। তার ছুঁচোলাে ছাঁটা দাড়ি এবং বড়ো বড়ো চোখ সর্বপ্রথমেই চোখে পড়ে। অল্প বয়স। নয় মাস য়ুরােপে বেড়িয়ে বিলিতী পােশাক এবং চালচলন ধরেছে। বলে ইন্ডিয়া লাইক করে না। বলে, তার য়ুরােপীয় বন্ধুদের (অধিকাংশই স্ত্রীবন্ধু) কাছ থেকে তিনশাে চিঠি এসে তার কাছে জমেছে, তাই নিয়ে বেচারা মহা মুশকিলে পড়েছে— কখনই বা পড়বে, কখনই বা জবাব দেবে! লােকটা আবার নিজে বন্ধুত্ব করতে বড়োই নারাজ, কিন্তু বিধাতার বিড়ম্বনায় বন্ধুত্ব তার মাথার উপরে অনাহূত অযাচিত বর্ষিত হতে থাকে। সে বলে বন্ধুত্ব করে কোনাে ‘ফন’ নেই! উপরন্তু কেবল ল্যাঠা! এমনকি শত শত জর্মান ফরাসী ইটালিয়ান এবং ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে সে ‘ফ্লার্ট্’ করে এসেছে কিন্তু তাতে কোনাে মজা পায় নি! একটা মেয়েকে কতকগুলাে মিথ্যে কথা বলা যায়, সে আদর করে পাখার বাড়ি মারে, এই তো ফ্লার্টেশন—এতে ‘ফন’ নেই! লোকটা পৃথিবীতে কিছুতেই যথেষ্ট মজা পাচ্ছে না, কিন্তু তার কাছ থেকে অন্য লােকে যে মজা উপভােগ করছে তা বােধ হয় সে স্বপ্নেও জানে না।
২ নভেম্বর। ভারতবর্ষের কাছাকাছি আসা গেছে। বােম্বাই পৌঁছবার কথা।
আজ সুন্দর সকালবেলা। ঠাণ্ডা বাতাস ব’চ্ছে— সমুদ্র সফেন তরঙ্গে নৃত্য করছে, উজ্জ্বল রৌদ্র উঠেছে; কেউ ক্কয়ট্স্ খেলছে, কেউ নবেল পড়ছে, কেউ গল্প করছে; ম্যুজিক সেলুনে গান চলছে, স্মোকিং সেলুনে তাস চলছে, ডাইনিং সেলুনে খানার আয়ােজন হচ্ছে, এবং একটি সংকীর্ণ ক্যাবিনের মধ্যে আমাদের একটি বৃদ্ধ সহযাত্রী মরছে।
সন্ধ্যা আটটার সময় ডিলন সাহেবের মৃত্যু হল। আজ সন্ধ্যার সময় একটি নাটক অভিনয় হবার কথা ছিল।
৩ নভেম্বর। সকালে অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানের পর ডিলনের মৃতদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হল। আজ আমাদের সমুদ্রযাত্রার শেষ দিন।
অনেক রাত্রে জাহাজ বোম্বাইবন্দরে পৌঁছল।
৪ নভেম্বর। জাহাজ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে নেমে এখন আমার অদৃষ্টের সঙ্গে আর কোনো মনান্তর নেই। সংসারটা মোটের উপরে বেশ আনন্দের স্থান বোধ হচ্ছে। কেবল একটা গোল বেধেছিল— টাকাকড়ি-সমেত আমার ব্যাগটি জাহাজের ক্যাবিনে ফেলে এসেছিলুম, তাতে করে সংসারের আকৃতির হঠাৎ অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হোটেল থেকে অবিলম্বে জাহাজে ফিরে গিয়ে সেটি সংগ্রহ করে এনেছি। এই ব্যাগ ভুলে যাবার সম্ভাবনা কাল চকিতের মতো একবার মনে উদয় হয়েছিল। মনকে তখনি সাবধান করে দিলুম ব্যাগটি যেন না ভোলা হয়। মন বললে, ক্ষেপেছ? আমাকে তেমনি লোক পেয়েছ!— আজ সকালে তাকে বিলক্ষণ এক চোট ভর্ৎসনা করেছি— সে নতমুখে নিরুত্তর হয়ে রইল। তার পর যখন ব্যাগ ফিরে পাওয়া গেল তখন আবার তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে হোটেলে ফিরে এসে স্নান করে বড় আরাম বোধ হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে আমার স্বাভাবিক বুদ্ধির প্রতি কটাক্ষপাত ক’রে পরিহাস করবেন সৌভাগ্যক্রমে এমন প্রিয়বন্ধু কেউ উপস্থিত নেই। সুতরাং রাত্রে যখন কলিকাতামুখী গাড়িতে চড়ে বসা গেল, তখন যদিও আমার বালিশটা ভ্রমক্রমে হোটেলে ফেলে এসেছিলুম তবু আমার সুখনিদ্রার বিশেষ ব্যাঘাত হয় নি।